ভালোবাসি তাই পর্ব-৩৭+৩৮

0
514

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩৭

সাদের মুখে কোনো উত্তর নেই, সে মলিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে এরুপ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় আশা। সেই সাথে মনের মধ্যে এক অজানা ভয় জেঁকে বসে। মনে মনে ভাবে, “বাজে কোনো কিছু হয়ে যায় নি তো?”

সে ভয়ার্ত গলায় বলে
“এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, কোনো সমস্যা হয়েছে?
সাদ এবারেও আগের মতো, মুখে নেই কোনো কথা।।আশার মাথায় নানা উদ্ভব চিন্তা উদয় হতে শুরু করে, এই বুঝি খারাপ কিছু হতে চলেছে। চোখেমুখে অজানা ভয় জেঁকে বসেছে। আশাকে এইরুপে দেখে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে সাদ। আশা অবাক হয়। এইতো কিছুক্ষণ আগে তার মুখের অবস্থা ফ্যাকাসে ছিলো, তাহলে এখন? সে সামান্য রাগান্বিত গলায় প্রশ্ন করে
“মানে কি, এই দেখছি মন খারাপ, আবার বিনা কারণে হাসছেন। ব্যাপারটা কি?
“তোমার ভয়ভয় মুখটা দেখে অনেক হাসি পাচ্ছিলো কিউটি…
আশা সামান্য অভিমানের স্বরে বললো
“আপনার মুখের যে বিশ্রী অবয়ব ছিলো, ভয় পাওয়াটা কি স্বাভাবিক ছিলো না?
সাদ হাসলো। আশা অভিমান করে উলটোদিক মুখ করে দাঁড়ালো। সাদের এবার মনে হলো, অভিমানীর অভিমান ভাঙ্গানো উচিত।

সে দুপা এগিয়ে আশার একদম কাছাকাছি চলে এলো। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো
“মেয়েরা অভিমান করে স্বামীর কাছ থেকে বেশি বেশি ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। আমি তো এখনো তোমার স্বামী হয়ে উঠিনি, তাই অভিমানগুলো তুলে রেখে দাও…
আর মাত্র কয়েকটা দিন, এরপরই নাহয় অভিমানগুলো আমার কাছে সোপর্দ করো।
আশা অবাক হয়ে তাকালো সাদের দিকে, এবার রাগ করে নয়। নয় কোনো অভিমান.. অবাক চাহনিতে সে তাকিয়ে আছে। সাদ এক পাশের ভ্রু উপর দিকে টেনে বললো
“কি?
“আর মাত্র কয়েক দিন? বিস্ময় ভরা গলায় প্রশ্ন করলো আশা।
সাদ মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে জানান দিলো, “হ্যাঁ।
হঠাৎ আশার মনে এক অজানা অনুভূতি সাড়া দিলো। সে অনুভূতির ছোঁয়ায় সে ভুলে গেলো নিজেকে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলো সাদের ভালোবাসার রাজ্যে। আশা এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো সাদের দিকে। সাদ নির্বাক, এখন পর্যন্ত আশাকে নিজ থেকে ওর কাছে যেতে দেখেনি সে। সাদ মুচকি হেসে আশার দুই বাহু চেপে ধরলো। আশা ফিরে এলো নিজের মধ্যে। থতমত খেয়ে তাকালো সে সাদের দিকে। সাদ মৃদু গলায় বললো
“নিজেকে সামলাও কিউটি.. আর তো মাত্র কয়েকটা দিন।
আশা লজ্জায় পরে গেলো। সে তারাতাড়ি করে সাদের কাছ থেকে মুখ লুকালো। মনে মনে সাদকে হাজারো বার বকাঝকা করলো । সে বার বার আমার কাছে আসতে চায়.. ভালোবাসতে চায়.. আমাকে ছুতে চায়। আর আজ আমি নাহয় একটু ভুল করে নিজ থেকেই ওর কাছে যেতে চেয়েছিলাম, তাই বলে এভাবে লজ্জায় ফেলবে?

আশা ঠোঁট বাকালো, তবে সেটা সাদের অলক্ষে।।

বিকেলের পরপর লুৎফুন্নাহার যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গিয়েও হতে পারলোনা আদিবের অনুরোধ আর দিলারার বিশেষ জোরাজুরিতে তাকে থেকে যেতে হলো। তবে সাদের মামা আর চারার জরুরি কাজ থাকায় উনারা চলে গেলেন। লুৎফুন্নাহার বেশ সাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন এখানে। গ্রামে তার খুব কমই আসা হয় তার। পাঁছ ছয় বছরে একাধবার নিজের বাপের বাড়ি যেতেন আগে। ইদানিং সেটাও হয়ে উঠে না। ছেলের বিয়ের আলাপচারিতার উদ্দেশ্যে এবার অনেকদিন পর গ্রামে বেড়ানো টা হলো।
সন্ধ্যের পর উঠোনে চাঁদের মৃদু আলোয় বেশ একটা আড্ডার আয়োজন হয়। দিলারা, লুৎফুন্নাহার, আদিব, মৃদুলা, সাদ, আশা..
সবাই মিলে একে অন্যের সাথে নানান ধরনের কথাবার্তায় মশগুল হন। এক পর্যায়ে ছোটদের মাঝে নিজেদের বেমানান লাগছে সেই অযুহাতে দিলারা আর লুৎফুন্নাহার উঠে পরেন সেখান থেকে। উনারা চলে যান দিলারার ঘরে।

রয়ে যায় সাদ, আশা, আদিব আর মৃদুলা। ওরাও বেশ ভালো সময় কাটাতে থাকে একসাথে বসে। হাসি তামাশা.. খোশগল্পের মাঝে হঠাৎ ই সাদ আর আশার বিয়ের কথা তুলে মৃদুলা। সে উৎফুল্ল মেজাজে বলে উঠে
“আমি কিন্তু খুবই এক্সাইটেড হয়ে আছি, আমাদের আশার বিয়েটা কবে আসবে, সাজগোছ করবো, মজার মজার খাবো.. আনন্দ করবো।
মৃদুলা সাদের দিকে তাকিয়ে বললো
“হবু ননদি জামাই, সেদিন কিন্তু গেইটটা আমিই আটকাবো। পকেট কিন্তু খালি করে কিংবা কিপটামো করে আসা যাবেনা….
সাদ হেসে বললো
“সেদিন আমি পকেট ছাড়াই আসবো।
“তাহলে বউ ছাড়াই ফেরত যেতে হবে।
সাদ আশার দিকে তাকালো। আশার মুখটা লজ্জায় চুপসে আছে। সাদ হেসে আশার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো
“যে আমার, যে তো আমার হবেই। তা যেভাবেই হোক..
মৃদুলা মুখের ভঙ্গিতা পরিবর্তন করে বললো
“উহু, সেটা হচ্ছেনা বাপু, টাকা চাই টাকা… টাকা দিবেন, বউ পাবেন।
সাদ দুষ্টুমি করে বললো
“বউ কি আমার কোনো পণ্য নাকি যে টাকা দিয়ে নিয়ে যাবো। আমি হবো সেদিন রাজপুত্র, এমন এক রাজপুত্র.. যাকে দেখেই আপনারা আপনাদের রাজকন্যাকে আমার হাতে তুলে দিবেন। আমি বিশ্বজয়ের আনন্দ নিয়ে রাজকন্যাকে আমার রাজরানী বানিয়ে স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমাবো। আপনারা চেয়ে চেয়ে দেখবেন, কারো সাধ্য থাকবেনা সেদিন আমাকে আটকানোর।

সাদের দৃষ্টি আবারও আশার দিকে। আশা নতমস্তকে বসে আছে একভাবে। ইচ্ছে করছে উঠে পরুক এখান থেকে, বড় ভাইয়ের সামনে সাদের এমন কথা আশাকে বরাবরই সঙ্কুচিত করছে। হঠাৎ আদিবের গলার কন্ঠস্বর পাওয়া গেলো। সে নির্জীব গলায় বললো
“আমি উঠছি, তোমরা গল্প করো।।
আদিব উঠে চলে গেলো বাড়ির সদর দরজাটার দিকে। যেখান থেকে এ বাড়িতে আসা যাওয়া করা হয়।।
আদিব চলে যাওয়ার পর সবাই কিছুক্ষণ তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। সাদ মৃদুলার দিকে তাকিয়ে বিস্ময় নিয়ে বললো
“ভাইয়ার কি হলো?
মৃদুলা ঠোঁটজোড়া উল্টিয়ে বললো
“কি জানি।।
তারা আবারও আলাপচারিতায় মন দিলো।

তবে আশার নজর এখনো আদিবের দিকে। চাঁদের ক্ষীণ আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সদর দরজাটায় সামান্য হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আদিব। চোখমুখ স্পষ্ট বুঝা না গেলেও আশা নিশ্চিত তার ভাইয়ের চোখে এই মুহূর্তে পানি জমে আছে। বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো আশার। হঠাৎ ভাইয়ের ব্যথিত হবার কারণ আশার বোধগম্য হলো। সেও তৎক্ষনাৎ উঠে পরলো সেখান থেকে। সাদ অবাক হয়ে বললো
“কোথাও যাচ্ছো কিউটি?
আশা একবার সাদের দিকে তাকালো। বিমর্ষ গলায় বললো
“আমার ভাইয়ার কাছে।
বরাবরই আদিবকে ভাইয়া বলে সম্বোধন করলেও আমার ভাইয়া বলা হয় না কখনোই। তবে আজ বলতে ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে…
আমার ভাইয়া, হ্যাঁ আমার ভাইয়া। কথাটা এতটাই মধুর আর এতটাই আপন যেটা কোনো বোনই তার ভাইয়ের প্রতি উপলব্ধি করতে পারবে। আর ভাই যদি হয় আদিব কিংবা আদিবের মত কোনো এক জন, তাহলে ডাকটার মাধুর্য আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

আশা ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আদিবের দিকে। আদিব নিশ্চুপ, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে দুরের ওই চাঁদটার দিকে, যেটা অসংখ্য বড় বড় গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মেরে আছে। আশাও আদিবের দৃষ্টি লক্ষ্য করে তাকালো আকাশপানে। আদিব দৃষ্টি ফেরালো আশার দিকে। এরপর আবারও চাঁদের দিকে তাকিয়ে ক্ষীন গলায় বললো
“ওরা ওখানে আনন্দ করছে, তুই চলে এলি যে এখানে?
আশা আদিবের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো
“আমার ভাইয়াকে ছাড়া সকল আনন্দই যে আমার জন্য অসম্পূর্ণ।
আদিব এবার ফিরে তাকালো বোনের দিকে। জড়ানো গলায় বললো
“আশামনি!
আশার চোখে এবার পানি, এই ভাইটাকে ছেড়ে এতটা দূরে সে কিভাবে থাকবে?

হ্যাঁ, এতগুলো দিনও সে থেকেছে, তবে সেটা লেখাপড়ার জন্য। সারাজীবনের জন্য নয়, কিংবা অন্যের অধীনেও নয়। তবে এবার যে সে চলে যাবে, সারাজীবনের জন্য চলে যাবে অন্যের বাড়ি। হয়ে যাবে অন্যের অধীন। ইচ্ছে করলেই চলে আসতে পারবেনা তার ভাইটির কাছে। যদিও যে মানুষটা তাকে বিয়ে করছে সে তার ভালোবাসা। কখনোই তাকে ঘরবন্দী বউ করে রাখবেনা, তার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেবনা। তবুও তো, হবে তো সেই অন্যের অধীনই।
আশা কিছু বলছেনা আদিব আবারও বললো
“আশামনি…
এবার উত্তর করলো আশা। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় বললো
“বলো ভাইয়া।
“আমায় পর করে চলে যাবি?
এবার আর নিজেকে সামলাতে পারবো না আশা। হু হু করে কেঁদে উঠলো সে। আশার কান্নার আওয়াজ কানে এসে ঠেকলো সাদের, মৃদুলার কানেও এলো সেটা। এরপর দুইজনই দুইজনের চোখের দিকে তাকালো একবার।। হঠাৎ সাদ উঠে দাড়ালো, কিউটি কাঁদছে ব্যাপারটা সাদের ভেতরে এক ধরনের জ্বালা ধরিয়েছে। সে তৎক্ষনাৎ আশার দিকে ছুটে গেলো। পেছন পেছন ছুটে গেলো মৃদুলাও। একটা নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রেখে ওরা দুজনই দাঁড়িয়ে গেলো। ওদের দুই ভাইবোনের মাঝে গিয়ে দাঁড়ানোর জন্য মন কিছুতেই সায় দিলো না সাদের।

আদিব আশাকে একহাতে জরিয়ে ধরে বললো
“কাঁদছিস কেন পাগলী?
“তোকে পর করে চলে যাবো, এটা কিভাবে বলতে পারলি তুই? তুই আর মা, তোরা তো আমার কলিজা.. আমি কি করে আমার কলিজাদের পর করে বাঁচতে পারি।
আদিব হাসলো, বললো
“ওরে পাগলী বোন আমার, ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দে।
আদিব হাতজোর করে আশার সামনে দাড়ালো। আদিবকে এমন করতে দেখে আশা কান্নার মাঝেও হেসে দিলো। সে আদিবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো
“আবার যদি এমন কথা বলিস আমি বিয়েই করবোনা বলে দিলাম।
আদিব হাসির আড়ালে কান্নাটাকে ঢেকে নিলো, নিজে কষ্ট পাচ্ছে পাক, আদরের বোনটাকে কষ্ট দেওয়া যাবেনা।

এভাবে কিছুটা সময় পার হয়ে যাবার পর সাদ এগিয়ে গেলো ওদের কাছে। সাদকে দেখে ওরা দুই ভাইবোন স্বাভাবিক হয়ে দাড়ালো। মৃদু হাসলো সাদ। সে আশার দিকে তাকিয়ে বলল
“মন হালকা হয়েছে কিউটি?
আশা না বুঝার মত করে তাকিয়ে রইলো সাদের দিকে। সাদ মুচকি হেসে আদিবের দিকে তাকালো। ধীর গলায় বললো
“আমার কাছে কিউটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনি কি চিন্তিত?
আদিব সাদের ঘাড়ে হাত রেখে বললো
“এতকিছু করলাম তোমার জন্য, আর তুমি আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করছো!
সাদ হেসে বললো
“আপনি আমার জন্য যা যা করেছেন, আমি এ জন্য সারা জীবন আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। আপনার যায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো কিউটি আমার নয়, ওই বদমায়েশ রানার জীবনেই চলে যেত। আপনাকে হাজার বার স্যালুট ভাইয়া।

আদিব হাসলো। সাদ আবারও বললো
“আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের ভাইবোনের সম্পর্ক কোনোদিন দুরত্বে চলে যাবেনা। আমি নিজ চোখে দেখেছি, আপনাদের দুজনের প্রতি একে অপরের মায়া, একে অপরের ভালোবাসা। আমারও ভাইবোন আছে, তবে আপনাদের দুজনের মত বন্ডিং আমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে ছিলো না আদেও। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনাদের ভালোবাসার সম্মান দিয়ে যাবো। কিউটিকে হাসি খুশি রাখার, ওকে সুন্দর একটা বিবাহিত জীবন উপহার দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তবে, ওর খুশি আপনার কাছে। ওর ভালো থাকার ঔষধ নিঃসন্দেহে আপনি। তাই ওকে খুশি দেখতে চাইলে সর্বপ্রথম আপনাকে খুশি থাকতে হবে।
আদিব হেসে বললো
“তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, আমার বোনকে এতটা ভালোবাসো তাই। আমি শুধু আমার বোনের খুশিই চাই না, আমি তোমার চোখে আমার বোনের জন্য এই ভালোবাসাটা সারা জীবন দেখতে চাই।
সাদ হাসলো।

আদিব সেখান থেকে চলে আসার জন্য পা বাড়ালো। দুপা এগিয়েই দেখলো মৃদুলা দাঁড়িয়ে আছে বেশ খানিকটা দূরে। তার চোখে আদিবের জন্য অসীম ভালোবাসার উপস্থিতি। আদিব মৃদুলার দিকে এগিয়ে গেলো। ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে ক্ষীণ গলায় বললো
“এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে।
“ভাইবোনের ভালোবাসা দেখছিলাম।।
আদিব হেসে বললো
“বরের ভালোবাসা দেখতে চাও না?
মৃদুলা অবাক হয়ে বললো
“কিহ!!
আদিব মুচকি হাসলো। মৃদুলার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো
“এবার বরের ভালোবাসাও দেখবে, এসো…

চলবে….

#ভালোবাসি_তাই
তন্বী ইসলাম-৩৮

ভ্যাপসা গরম, সেই সাথে শরীর ঠান্ডা করা ফুরফুরে বাতাস। দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোই লাগছে… তবে আশার নির্বিকার রুপ, মনে শান্তি দিচ্ছেনা সাদকে। সাদ আশার দিকে তাকায়। মৃদু গলায় বলে
“কিউটি..
“হুম।
“এখনো মন খারাপ?
“মা আর ভাইয়াকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে খুব।
“তাহলে কি আমি তোমায় বাদ দিয়ে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করবো?
আশা চোখ পাকিয়ে তাকালো সাদের দিকে। সাদ হাসলো। আশার শরীরে জ্বলন ধরালো সেই হাসি। সাদ বললো
“ভুল বললাম কিছু?
আশা কোনো কথা না বলে সাদের পিঠে কিল গুতো দিতে লাগলো এবার। সাদ হাসতে হাসতে বললো
“ব্যাথা পাচ্ছি তো কিউটি..
“ব্যাথা পাওয়ার জন্যই তো দিচ্ছি।
“আমার কষ্ট তোমার সহ্য হচ্ছে?
“খুব হচ্ছে, উনার নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করার শখ জেগেছে।।
সাদ অভিযোগের সাথে বললো
“আমি কিন্তু কখনোই বলিনি আমার অন্য কাউকে বিয়ে করার শখ জেগেছে।
আশা রাগী গলায় বললো
“মাত্রই তো বললেন।
“তুমিই তো বললে মা আর ভাইকে ছেড়ে যেতে তোমার কষ্ট হবে। আমি কি করে তোমার কষ্ট সহ্য করতে পারি।।
আশা দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“তাই বলে আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে!! আমি খুন করবো তাকে। আশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
“আপনাকেও।
সাদ হেসে বললো
“আমাকেও?
“হু। মুখ বাকিয়ে বললো আশা।

আশা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাদ এবার স্বাভাবিক হয়ে বললো
“কিউটি!
“কি?
“একটু জরিয়ে ধরি?
আশা অবাক হয়ে তাকাল সাদের দিকে। পরক্ষণে তখনকার সেই ঘটনাটার কথা মনে পরে গেলো তার। ততক্ষণে কপালের রগ ফুলে গেছে রাগে৷ সে জোর গলায় বললো
“আমি ভুলিনি তখন আপনি কিভাবে আমায় লজ্জায় ফেলেছিলেন।
সাদ হাসলো। আশা আবারও বললো
“আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি, আপনিও নিজেকে সামলান।
সাদ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো
“স্যরি কিউটি।
আশা তাকালো না সাদের দিকে। সাদ হাসলো। এক পর্যায়ে সাদ আশাকে দুহাতে চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। আশা হতভম্ভের মত তাকিয়ে রইলো সাদের দিকে। সাদ আশার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে নরম গলায় বলল
“তখন তোমাকে নিজের দিকে ভালোবাসার আহবানে আসতে দেখে আমি নিজেই কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছিলাম। তাই নিজেকে সামলানোর জন্যই তোমাকে এ কথা বলেছিলাম, পাছে যদি কোনো অঘটন ঘটে যেত, আমাকে তখন গণধোলাই দেওয়া হত। আশা হাসলো সাদের কথায়। সাদ আবার মিহি স্বরে বললো
“রাগলে তোমায় অপূর্ব লাগে..
আশা বিস্মিত চোখে তাকালো সাদের দিকে। সাদ আবারও বললো
“মন খারাপ করে থাকলেও তোমায় সুন্দর লাগে, যদিও আমার কষ্ট হয়। তবুও সুন্দর লাগে।
আশা ক্ষীন গলায় বললো
“আপনার ঘুম প্রয়োজন, ঘুমাতে যান।
সাদ কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে এরপর মৃদু হেসে বললো
“আপনার হুকুম অমান্য করা দায়.. আমি এক্ষুনি ঘুমোতে যাচ্ছি, আপনিও গিয়ে ঘুমিয়ে পরুন।

আশা হেসে বললো
“ঠিক আছে।
সাদ দু পা এগিয়ে যেতেই কি যেনো মনে হলো তার। সে তৎক্ষনাৎ আশার নিকট ফিরে এলো৷ আশা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো সাদের দিকে। এক পাশের ভ্রু উঁচু করে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলো
“আবার কি?
“তুমি ঘুমোবে কোথায় কিউটি?
আশা অবাক হলো সাদের কথায়। এ কেমন প্রশ্ন! সে বললো
“আমার রুমে তো ঘুমাতে পারবো না, সেখানে আপনি আছেন। তাই বরাবরের মত মায়ের রুমেই ঘুমোতে হবে।
সাদ আবারও বললো
“কিন্তু ওখানে তো বোধহয় আমার মা থাকবে।
আশার এবার মনে হলো,
“সত্যিই তো। এটা সে ভুলে গেছিলো। এনারা দুইজন যেভাবে একে অপরের সাথে মিশে আছে, দেখে মনে হচ্ছে ছোটবেলাকার বান্ধবী। এতদিন হারিয়ে ফেলেছিলো, দীর্ঘদিন পর ফিরে পেয়েছে। তাই মনে হচ্ছেনা এখানে আজ ওর যায়গা হবে। যদিও এ বাড়িতে আরো দুটো রুম আছে, অনেক মেহমান এলে সেখানে থাকতে দেওয়া হয়। লুৎফুন্নাহার বোধহয় ওখানে একা একা থাকবেনা, আর সাদ, তাকে তো আশার রুম থেকে ভুতে এসেও সরাতে পারবেনা। তাহলে ওকে কি ওই রুমে থাকতে হবে আজ? কথাটা ভেবেই গলা শুকিয়ে যাচ্ছে আশার। কারণ ওই রুম দুটো বাকি রুমগুলো থেকে কিছুটা দূরে, আর ওই রুমের সাথেই রয়েছে ইয়া বড় বড় বাঁশঝাড়। ব্যাপারটা ভৌতিক, আশা মোটেও থাকতে পারবেনা সেখানে।

আশাকে এভাবে একভাবে কিছু ভাবতে দেখে সাদ ওকে নাড়া দিয়ে বলে
“কি ব্যাপার কিউটি, কি এতো ভাবছো?
আশা সাদের দিকে তাকিয়ে আনমনে বললো
“আমি কোথায় থাকবো?
সাদ দুষ্টু হাসি হেসে বললো
“তুমি চাইলে আমার সাথেই থাকতে পারো, আই ডোন্ট মাইন্ড।
কপাল কুচকালো আশা। চোখেমুখে রুক্ষতা এনে বললো
“ফাজিল কোথাকার।
আশা সেখানে আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে চলে এলো মায়ের রুমে। দেখুক, কোনো কুল-কিনারা করা যায় কিনা।
মায়ের রুমে এসে আশার রুম ছানাবড়া। তার নিজের মা আর হবু শাশুড়ী মা পাশাপাশি শুয়ে দুজন দুজনার দিকে মুখ করে মনের আনন্দে সুখ দুখের গল্প করছে, আশা এবার নিশ্চিত হয়ে গেলো এ রুমে আজ তার ঠাঁই নেই। মানুষগুলো কত স্বার্থপর, একবার তার শোবার থাকার কথা কেউ ভাবলো না। আশা ঠোঁট বাকালো, মুখে কাঁদোকাঁদো ভাব। সাদের মা আছে এখানে, তাই খুবই নম্রতার সাথে আশা ডাকলো তার মাকে।
“মা..
দিলারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন মেয়ের দিকে। স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন
“কি হয়েছে মা?
আশা নিরাশ চোখে একবার সাদের মায়ের দিকে তাকালো। উনি উৎসুক চোখে আশার দিকে তাকিয়ে আছেন। কথাটা বলতে খুব সঙ্কোচবোধ করলো আশা৷ এরপরও নিরুপায় হয়ে সে বললো
“আমি আজ কোথায় ঘুমাবো মা?
দিলারা বললেন
“ওপাশের রুম দুটো তো খালিই আছে, আজকের রাতটা ওখানে গিয়ে ঘুমিয়ে পর।
আশা হতাশ গলায় বললো
“ও ঘরগুলো বড্ড ভৌতিক, আমি ওখানে একা থাকতে পারবো না।
এমন সময় লুৎফুন্নাহার হেসে বললেন
“আমাদের সাথে এসে শুয়ে পরো আশা। আমাদের দুজনের মাঝখানে, দুই মায়ের মাঝখানে থাকতে তোমার নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা হবেনা।

দুই মায়ের মাঝখানে, আহ! কথাটা কতটাই না সুমিষ্ট। কিন্তু আশা এই কাজ কক্ষনই করবে না। উনাদের গল্পের ধরণ দেখে মনে হচ্ছেনা এ গল্প আজ রাতে শেষ হবে। আশা ওদের মাঝখানে শুয়ে কাবাব মে হাড্ডি হতে চায় না। আশা তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো
“মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে পরি মা?
দিলারা লুৎফুন্নাহারের দিকে তাকিয়েই উত্তর করলেন
“শুয়ে পর।
আশা মাদুরটা মাটিতে পেতে তারউপর একটা মোটা কাথা বিছিয়ে নিলো, এরপর একটা বালিশ এনে সেটাতে রেখে শুতে যাবে এমন সময় দরজায় টুকা পরলো। আশার কপালে সামান্য বিরক্তির ভাজ দেখা গেলো, তবুও সে উঠে দরজাটা খুললো। আদিব দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে। আশা বললো
“এত রাতে তুই এখানে কি করছিস? ঘুমাস নি?
আদিব নিশ্বব্দে হেসে বললো
“দেখতে এলাম তোরা কি করছিস। মা কোথায়?
“শুয়ে আছে।
আদিব রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো। ওকে দেখে লুৎফুন্নাহার কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। আদিব হেসে বললো
“এখানে আপনার কোনো অসুবিধা হচ্ছেনা তো আন্টি?
লুৎফুন্নাহার হেসে বললো
“মোটেও না, আমার তো এখানে বেশ ভালোই লাগছে।
আদিব ভদ্রতার সাথে বললো
“রাতে কিছু প্রয়োজন হলে আশাকে বলবেন, মা ও আছে এখানে, আশা করছি আপনার কোনো সমস্যা হবে না।।
লুৎফুন্নাহার হাসিমুখে মাথা নাড়ালো। আদিব এবার দিলারার দিকে তাকিয়ে বললো
“রাতের ঔষধ খেয়েছো মা?
দিলারা হেসে বললেন
“খেয়েছি।
“আচ্ছা আমি আসছি।
আদিব যখন বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়ালো তখনই তার নজরে এলো মাটিতে পাতা বিছানাটা। সে ভ্রু নাচিয়ে আশার দিকে তাকালো। বিস্ময়ে বললো
“মেঝেতে বিছানা কেন?
“ওটা আমার শোবার যায়গা। অসহায় মুখ করে বললো আশা।
“কেন?
“আমার জন্য কোথাও যায়গা বরাদ্দ করা নেই, অগত্যা নিজের যায়গার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়েছে।
আদিব কয়েক সেকেন্ড কিছু ভেবে আশার দিকে তাকালো। এরপর ধীর কন্ঠে বললো
“আয় আমার সাথে।
“কোথায়?
“আয় তো।
আশা আদিবের পিছু পিছু বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে দিলারাকে আদিব বলে গেলো ভেতর থেকে দরজাটা লাগিয়ে দেবার জন্য। আশাকে নিয়ে আদিব যখন সাদের রুমের দিকে যাচ্ছিলো তখন আশা অবাক হয়ে বললো
“আমরা ওখানে যাচ্ছি কেন?
“গেলেই জানতে পারবি।।

সাদের রুমের সামনে গিয়ে দেখলো রুম ভেতর থেকে লাগানো।।আদিব দরজায় নক করলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সাদ। এভাবে ওদের দুই ভাইবোনকে দেখে কিছুটা অবাকও হলো সে। অবাক কন্ঠে আদিবকে প্রশ্ন করলো
“এত রাতে আপনারা এখানে, কোনো সমস্যা হয়েছে?
আদিব আগপাছ কিছু না ভেবে বললো
“আজ রাতটা যদি আমি তোমার সাথে থাকি, তাহলে কি তোমার কোনো আপত্তি থাকবে?
“আমার সাথে থাকবেন, আপনি? বিস্মিত কন্ঠে বললো সাদ।
আদিব সামান্য রাগান্বিত গলায় বললো
“তো কি আশা?
সাদ হতচকিত হলো। থতমত খেয়ে বলল
“অবশ্যই না, আপনিই থাকবেন। আমার রুমে কোনো মেয়ে এলাও না।
আশা আঁড়চোখে তাকালো সাদের দিকে। আদিবের এমন ধমকানো গলা শুনে বেচারা দিশেহারা হয়ে গেছে। আদিব এবার আশার দিকে তাকিয়ে বললো
“তুই মৃদুলার সাথে গিয়ে ঘুমিয়ে পর, ওকে বলে দিস আমি এখানে আছি।
আশা মাথা নাড়ালো। সে আরো একবার সাদের দিকে তাকালো, বেচারা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে আশার দিকে। আশা চলে এলো সেখান থেকে।

__________
মৃদুলা মশারী টানিয়ে সবেমাত্র বিছানায় শুয়েছে, তখন আশা শোয়া থেকেই বলে উঠলো
“আন এক্সপেক্টেড…
মৃদুলা ভ্রু বাকিয়ে বললো
“কি?
“এই যে, তোমার পাশে ভাইয়ার বদলে আজ আমি।
মৃদুলা হেসে বললো
“আমার মনে কিন্তু তোমার ভাইয়াই রয়েছে এখনো ।
আশা বললো
“মনকে বুঝ দিচ্ছো?
“সত্য কথাই তো বললাম, খামোকা মনকে বুঝ দিতে যাবো কেন?
“মন কে বুঝ দাও আর যাই করো, একটা কথা কিন্তু মাথায় রেখো।
“কি কথা? প্রশ্ন করলো মৃদুলা।।
আশা মৃদুলার দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বললো
“ঘুমের মধ্যেও মাথায় রেখো, তোমার পাশে তোমার বর নেই, বরের বোন আছে। আমার গায়ে যেনো কারো হাত পায়ের ছোঁয়াও না লাগে।
“বাব্বাহ.. লাগলে কি হবে শুনি?
“আমার সুড়সুড়ি লাগে, কথাটা বলে হাসলো আশা
মৃদুলা হেসে বললো
“বিয়ের পর সুড়সুড়ি থাকবে তো?
আশা সামান্য লজ্জা পেয়ে বললো
“জানিনা।

গভীর রাতে, কারো চোখেই নেই কোনো ঘুম। এপাশ ওপাশ করছে দুজনেই। প্রায় অনেকটা সময় এপাশ ওপাশ করার পর একটা সময় সাদ উঠে বসলো বিছানায়। ওর দেখাদেখি আদিবও বসলো। আদিব ভ্রু বাকিয়ে বললো
“কি হলো, উঠে বসলে কেন?
“ঘুম আসছেনা সম্বন্ধী ভাই।
আদিব ভ্রু বাকিয়ে বললো
“এতদিন তো ভাইয়া ভাইয়া বলে এসেছো, আজ হঠাৎ সম্বন্ধী ভাই?
“এতদিন আপনি আমার গার্লফ্রেন্ডের ভাই ছিলেন, তাই ভাইয়া ডেকেছি। আজ থেকে আপনি আমার হবু বউ এর ভাই, তাই সম্পর্কটা পালটে গেছে।
আদিব হাসলো। বললো
“আচ্ছা ঠিক আছে, এবার ঘুমিয়ে পরো।
“কিভাবে ঘুমাবো?
আদিব অবাক হয়ে বললো
“কিভাবে ঘুমাবে মানে, শুয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমাবে।।
“আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেন?
আদিব অন্যদিকে তাকিয়ে বললো
“ঘুম আসছেনা।
সাদ হাসলো। আদিবের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো
“ভাবিকে বোধহয় খুব বেশিই মিস করছেন তাইনা?
আদিব বড় বড় চোখ করে তাকালো সাদের দিকে। সে সামান্য ধমকানোর মত করে বললো
“আমি কিন্তু সম্পর্কে তোমার গুরুজন হই সাদ।
সাদ হেসে বললো-
“সেটা দিনের বেলায়।

চলবে……