#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,৫
মৌমো তিতলী
পার্টি অফিসে নিজের চেম্বারে বসে ছিলো সাহিত্য। কক্ষে উপস্থিত পঞ্চ পান্ডব। তখনই একজন লোক এসে ভেতরে আসার জন্য অনুমতি চাইলো।
সাহিত্য ইশারায় তাকে অনুমতি দিলে সে এসে জানাই,,
:- স্যার যে ছেলেটার খোঁজ নিতে বলেছিলেন তার খোঁজ নিয়েছি। ছেলেটা পূর্বপাড়ার মাছ ব্যবসায়ী মালেক উদ্দিনের ছেলে রমিজ উদ্দিন। ছেলেটা অত্যন্ত বখাটে। তার নামে কয়েকটা ধর্ষণ আর ব্ল্যাকমেলিং এর মামলা আছে। কয়েকদিন ধরে তাকে সুহাসিনী ম্যাডামের স্কুলের আশেপাশে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কয়েক দিন ধরে ম্যাডামকেও উত্ত্যক্ত করতে দেখা গেছে বলে আশেপাশের লোকেরা জানিয়েছে।
মুহূর্তেই সাহিত্যর চোয়াল শক্ত হয়। তার ধারণাই ঠিক। ওই ছেলেটার জন্যই তার ফুলকুঁড়ি এভাবে ভয় পেয়েছিল।
সাহিত্য লোকটাকে হাতের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বলল। লোকটা সালাম দিয়ে চলে যায়।
অরুদ্ধ আক্রোশে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলে,,,
:- ওই ছিঁচকে ছোড়ার এত বড় সাহস। সুহাসিনীকে বিরক্ত করে। দোস্ত তুই শুধু একবার বল ওই ছোড়া কে জন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে দেবো।
তিয়াশ বলে,,
: – সাহিত্য আমি বলি কি! চল ব্যাটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে ডিম থেরাপি দেই। অনেকদিন একটু খেলাধুলা হয়নি। হাতে পায়ে কেমন একটা জং ধরেছে। বলে হাত পা ছুড়তে লাগলো।
সাহিত্য ভুরু কুচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলল:-
_ এখনি আমাদের কোন অ্যাকশন নেয়া ঠিক হবে না। আরো কিছুদিন দেখি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ওর কাম তামাম করতে বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া ও জানে না কার কলিজার দিকে নজর দেয়ার সাহস করেছে। এমনিতেও ওর চোখ দুটো আমি উপড়ে ফেলবো।
সিফাত শিষ বাজিয়ে বলে,,,
:- ওয়াহ,,,,কিয়া ডায়লগ মারা হে তুনে!!! লা জাওয়াব!!
সাহিত্য চোখ বন্ধ করে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দেয়। মুহুর্তেই তার প্রাণনাশিনীর মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঝট করে চোখ খুলে তাকালো সাহিত্য। অদ্ভুত পিপাসায় খাঁ খাঁ করছে বুক। এই মুহূর্তেই তাকে চোখের সামনে দেখতে না পেলে যেন তার প্রাণ বধ হবে। হাতঘড়ি তবে নজর বুলায় সাহিত্য। পৌনে ৮ টা বাজে। বেশি রাত হয়নি। তড়িঘড়ি বেরিয়ে আসে অফিস কক্ষ থেকে। বাকি পাঁচ বন্ধু হাঃ করে তাকিয়ে আছে ওর যাওয়ার পথের দিকে। সাহিত্যর হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা যেন ওদের মাথার উপর দিয়ে গেলো। পরপর তারাও বেরিয়ে পড়লো বাড়ির পথে।
_____
নিজের রুমে অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করছে মেহরাব। মনের মাঝে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। একবার চঞ্চল প্রেয়সীর কন্ঠ টা শোনার তিব্র বাসনা জেঁকে বসেছে মনে। কিন্তু এখন এই রাতে কোন কারণ ছাড়া তাকে ফোন করবে!! কেমন দেখাবে না বেপার টা। আরে ধুর কি ভাবছে সে। কি এমন হবে? আরশির টিচার সে। পড়াশোনার খোঁজ নিতে ফোন করতেই পারে। হ্যাঁ এটা তো সে চাইলে করতেই পারে। তা ছাড়া মেয়েটা পড়ে গিয়ে পায়ে যেভাবে ব্যাথা পেলো,না জানি কি অবস্থা এখন। তখন আরশির পায়ে রক্ত দেখে বুকের ভেতর টা কেমন অস্থির হয়ে গেছিলো। উফফফ! মেয়েটাকে নিয়ে পারা যায় না। সামনে থেকেও এক দন্ড শান্তি দেয়না আর এখন দূরে থেকেও জ্বালাচ্ছে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোনটা হাতে নিয়ে একান্ত ব্যক্তিগত সিমটা থেকে কল লাগায় কাঙ্খিত নম্বরটিতে। ওপরেই ডায়াল প্যাডে ভেসে ওঠে calling “দুষ্টু পরী”
আরশি আনমনে পড়ার টেবিলে বসে একটা ম্যাথ সলভ করার চেষ্টা করছে। হুট করেই তার তখনকার কথা মনে পড়ে যায়। মেহরাব স্যার কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিলো তার পা কেটেছে দেখে। আবার এতো যত্ন করে ঔষধও লাগিয়ে দিলো। আজকে যেন তাকে সেই রগচটা, গম্ভীর হুঁকোমুখো লাগছিলো না। অদ্ভুত এক শীতলতা ছেয়ে ছিলো তার মুখ জুড়ে। আনমনে ঠোঁট প্রসারিত হয় মেয়েটার। চোখের সামনে ভাসতে থাকে এক রাগী অথচ সুদর্শন পুরুষের অবয়ব।
হঠাৎ ফোনের শব্দে ধ্যান ফেরে আরশির। এখন আবার কে ফোন দিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো কোন আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। আরশি ভেবেছিলো হয়তো মিরা বা লাবণ্য কেউ একজন হবে। কিন্তু অপরিচিত নাম্বার দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে। এসময় কে তাকে কল করবে??
ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেলো!! আরশি অতটা গুরুত্ব দিলো না। ফোনটা টেবিলে রাখতে নিতেই আবার বেজে উঠলো। এবার রিসিভ করে আরশি।
:- আসসালামু আলাইকুম !! কে বলছেন??
আরশির কন্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে ধক ধক করে উঠলো মেহরাবের। মেয়েটার কন্ঠেও যেন মাদকতা ছড়িয়ে আছে। বুকে হাত চেপে নিজেকে স্বাভাবিক করে মেহরাব।
:- হ্যালো!! কে বলছেন? কথা বলছেন না কেন?
মেহরাব গম্ভীর গলায় সালামের উত্তর দেয়।
পুরুষালী গম্ভীর আওয়াজ কানে আসতেই থমকে যায় আরশি। কন্ঠ টা খুব পরিচিত লাগলো। এরকম গভীর স্বরে বুকে কাঁপন বাড়লো মেয়েটার। কিছুক্ষণ চুপ করেই থাকলো সে। যেটা ভাবছে সেটা হতে পারে না। কোনভাবেই সম্ভব নয়।এম এম এস তাকে ফোন করবে!! এটাও সম্ভব??
বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোটানায় কোনমতে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করে,,
:- ক,কে??
মেহরাব তার প্রশ্নকে তোয়াক্কা না করে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,,,
:- পায়ের ব্যাথা কমেছে?? অয়েনমেন্ট লাগিয়েছিলে??
এবার সত্যিই আরশির চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো!!
_ওহ মাই গড!!!ওহ মাই গড!! সত্যিই মেহরাব মির্জা স্যার!!আরশি যেন উত্তর দিতেই ভুলে গেলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই মেহরাবের ধমক শুনে কেঁপে উঠলো মেয়েটা।
:- কি জিজ্ঞেস করেছি কানে যায়নি বেয়াদব মেয়ে!! চুপ করে আছো কেনো?? উত্তর দাও।
:- জ্বী!!না মানে হ্যাঁ থতমত খায় আরশি।
আরশির কনফিউশনে জড়ানো কন্ঠে নিঃশব্দে হাসে মেহরাব। কিন্তু সেটা সামান্যতম বুঝতে না দিয়ে যথাযথ গম্ভীর গলায় বলে,,,
:- কি না ,,,হ্যাঁ করছো? পরিষ্কার করে বলো।
:- জ্বী কমেছে। মেডিসিন লাগিয়েছিলাম।
:- গুড গার্ল। কি করছিলে এখন?
আরশি আকাশ থেকে পড়ে যেনো এম.এম.এস কথা বলছে !!তাও আবার এত বাইরের কথা!
সে তো আরশি কে দেখতেই পারেনা। সব সময় বকাঝকা করে। আর আজকে এত কেয়ার করলো। আবার ফোন দিয়ে খবরও নিচ্ছে।বাহ মেহরাব মির্জা স্যারের কি মাথায় কোন গন্ডগোল দেখা দিলো !!নাকি আমি আরশি সেটা ভুলে গেছে!!
:- জ্বী তেমন কিছু না। একটা ম্যাথ সলভ করছিলাম।
:- আচ্ছা। খেয়েছো রাতে?
:- ন,,না স্যার! একটু পরে খাবো।আরশিও সৌজন্যের খাতিরে জিজ্ঞাসা করলো,,
:- আপনি খেয়েছেন স্যার??
ব্যাস এইটুকু জিজ্ঞাসাতেই ঠোঁট প্রসারিত হয় মেহরাবের।
:- না। ছোট! মানে আমার ভাই.. ও এখনো বাইরে। ফিরলে একসাথে খাবো।
:- ওহ আচ্ছা ।
কথা বলতে বলতেই অনেকটা সহজ হয়ে যায় মেহরাব আরশি দুজনেই। হুট করেই যেন কথার মধ্যে জড়তা ভাবটা কেটে যায়।
:- আরশি!
মেহরাবের মুখে নিজের নামটা এতো মোহময় শোনালো আরশির কাছে যে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। হার্টবিট বেড়ে গেলো মুহুর্তেই। কোনমতে কাঁপা গলায় বলে,,
:- জ্বী!
:- তোমার ভাই আরুশ আমার বন্ধু। জানো তুমি?
:- কই না তো স্যার। আমি ভাইয়ার কোন বন্ধুদেরকেই চিনি না। আপনি কি আমাকে আগে থেকেই চিনতেন?
হাহঃ কোন বন্ধু কে চেনার দরকারও নেই তোমার,,, বিড়বিড় করে মেহরাব।
:- জ্বী স্যার কিছু বললেন??
:- না,,, মানে হ্যাঁ আমি তোমাকে চিনতাম। তোমার ভাইয়ার বিয়ে থেকে চিনতাম।
আরশি বেশ অবাক হয়। চোখ দুটো ছোট ছোট করে ভাবতে থাকে,,,
কত বড় ফাজিল লোক!!! আমাকে আগে থেকেই চেনে অথচ কোন পরিচয় দিলো না। আর কলেজে আমার সাথে সব সময় খ্যাক খ্যাক করে চোটপাট দেখায়।
:- তাই নাকি স্যার!! আমি তো জানতাম না কিছু।
:- হ্যাঁ। আচ্ছা তুমি খেয়ে মেডিসিন নিও ঠিকঠাক। এখন রাখছি তবে। আর শোন কলেজে এসে এখন থেকে দুষ্টুমি টা কম করবে। মনে থাকে যেন। রাখছি!!
:- স্যার ,,,স্যার ,,,স্যার এক মিনিট।
মেহরাব হেসে আবার ফোনটা কানে লাগায়।
:- স্যার actually ধন্যবাদ।
:- ফর হুয়াট?
:- তখন হেল্প করার জন্য আর এখন ফোন করে খোঁজ নেয়ার জন্য।
:- মৃদু হাসে মেহরাব। ইটস ওকে। আর শোন কাল পায়ে বেশি ব্যাথা থাকলে কলেজে এসো না। ঠিক আছে?
:- জ্বী স্যার। আসসালামু আলাইকুম। ভালো থাকবেন
সালামের জবাব দিয়ে ফোনটা কেটে দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে মেহরাব। আবেশে চোখ বন্ধ করে প্রেয়সির কন্ঠস্বর অনুভব করতে থাকে। আরশির বলা প্রত্যেকটা কথা যেন তার কানে বাজছে।
এদিকে আরশি আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। এম.এম.এস তাকে ফোন করে খবর নিলো। এত মিষ্টি ভাষায় কথা বললো। স্যার এমন চমৎকার ভাবেও কথা বলতে জানেন?? হৃদয়ে মিষ্টি সুখের হাওয়া বয় আরশির। কেমন লজ্জা এসে আষ্টে ঘিরে ধরে তাকে। দুহাতে মুখ ঢেকে হেসে দেয় আরশি।
___________
এই মুহূর্তে সাহিত্য সুহাসিনী দের বাসার নিচে অবস্থান করছে। পুরো শরীরে কালো কাপড়ের ঢাকা মাথায় ক্যাপ, মুখে মাস্ক। হুট করে দেখে কারোর চেনার উপায় নেই এটা এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা।
সাহিত্য একবার চারিদিকে চোখ বুলিয়ে উপরের ব্যালকনির দিকে দৃষ্টি ফেলে। রুমটা সুহাসিনীর। ব্যালকনির দরজা খোলা। ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে। মানে সুহা জেগে আছে।
রাস্তা থেকে ছোট একটা পাথরের টুকরো তুলে সোজা ব্যালকনির উপরে থাই গ্লাসে টার্গেট করে ছুড়ে মারে সাহিত্য। মৃদু শব্দের ঝনঝন করে বেজে ওঠে চারপাশ।
কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে সাহিত্য।নাহ সুহাসিনী হয়তো বুঝতেই পারেনি। রাগ হয় সাহিত্যর। এতো টুকু একটা পুঁচকে মেয়ে!! কি হাল করে ছেড়েছে তার। তার বিরহে দিওয়ানা হয়ে কিনা এলাকার এমপি এরকম একটা টিনেজার স্টুডেন্ট এর মতো বিহেভ করছে। হাই!!! আর কি কি করতে হবে এই মেয়ের জন্য কে জানে।
কিছু একটা ভেবে এক টুকরো কাগজে বের করে কিছু লিখল সাহিত্য। তারপর সেটা একটা পাথরে জড়িয়ে ছুঁড়ে দিল ব্যালকনির দরজা বরাবর। এতে হয়তো কাজ হলো। কিছুক্ষণ পরেই হন্তদন্ত সুহাসিনী ছুটে এলো বেলকনিতে। সুহাসিনীর উপস্থিতি বুঝতে পেরে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে সাহিত্যর। কিন্তু উপরের দিকে চোখ পড়তেই দৃষ্টি থমকে যায় সাহিত্যর। চুল এলোমেলো হয়ে আছে সুহার। পরনে একটা ঢোলা গেঞ্জি। বুকে ওড়না নেই। নির্ঘাত চিরকুটের হুমকি দেয়াতে হুস হারিয়ে হন্তদন্ত ছুটে এসেছে মেয়েটা। নয়তো এমন বিধ্বংসী রূপে কখনোই সাহিত্যের সামনে আসতো না সুহাসিনী।
চিরকুটে সাহিত্য লিখেছিলো। ভালোই ভালোই ব্যালকনিতে আয়। নয়তো আমি সোজা তোর রুমে আসবো।
এমন হুমকি কে দিতে পারে সেটা খুব ভালো করে জানে সুহা। তারমানে এতোটুকু দেরি হলে সত্যিই এমপি সাহেব তার রুমে চলে আসবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। ছেলেটা বড্ড এক রোখা আর জেদি। যা বলে সেটা বাস্তবে করতে এতোটুকু সময় নেবে না সে। তাইতো পড়ি মরি ছুটে এসেছে বেলকনিতে। নিজের বেশভূসার দিকে নজর দেয়ার খেয়াল হয়নি মেয়েটার।
কিন্তু এই মুহূর্তে সাহিত্যর কন্ঠনালীতে পানির অভাব দেখা দিল প্রচন্ড। মেয়েটা তাকে মেরেই ক্ষান্ত হবে। আর কত রূপে মুগ্ধ করবে তার ফুলকুঁড়ি!!! অপলক তাকিয়ে থাকলেও তার সর্বনাশিনী ,প্রেয়সী তার ছোট্ট ফুলকুঁড়ির দিকে।
চলবে,,
#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,৬
মৌমো তিতলী
রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে সাহিত্যর প্রায় ১১ টা বাজে।
বাসায় কলিং বেল দিতেই সাহিত্যর মা আয়েশা সিদ্দিকা হাতের মুঠোয় ঝাড়ু নিয়ে দরজা খুলে দিয়ে একরকম চড়াও হয় সাহিত্যর ওপর। সাহিত্যও কম যায় না,,মায়ের হাতে ঝাড়ু দেখেই এক লাফে সটান বড় ভাইয়ের পিছনে গিয়ে লুকাই। আহাদ মির্জা ডাইনিং টেবিলে বসে মিচমিচে হাসি দিচ্ছে। মেহরাব ছোট ভাই কে আড়াল করে মা কে বলে ওঠে,,,
:- আহ মা কি করছো?? ছোট কি এখনো সেই ছোট্ট আছে?? ও কখন এলাকার এমপি। কত বড় দায়িত্ব বলোতো!! বাসায় আসতে মাঝে মধ্যে একটু তো লেইট হতেই পারে!! তাই বলে তুমি সেই ছোটবেলার মতো ওকে ঝিড়ু নিয়ে তাড়া করছো??
এদিকে আসেপাশের কিছু সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে মুখ টিপে হাসছে। তারা জানেন আয়েশা সিদ্দিকা তার স্বামী সন্তান অন্ত প্রাণ। খুবই দয়ালু আর ভালো মনের মানুষ তিনি। বাসার সব কর্মচারী আর সার্ভেন্টরা নিজের পরিবারের মতো ভালোবাসে এই মা বাবা ও দুই সন্তানের এই পরিবার টা কে।
আয়েশা সিদ্দিকা ঝেজে উঠে বলেন,,,
:- এই মেহু তুই একদম ছোট ভাইয়ের তরফদারি করতে আসবি না।
:- উফফফ মা। কতবার বলেছি আমাকে মেহু ডাকবে না। কেমন মেয়ে মেয়ে লাগে।
মেহরাবের কথা শুনে সাহিত্য, আহাদ মির্জা সহ সার্ভেন্ট রা সকলে হেসে দেয়।
আয়েশা সিদ্দিকা সেসব তোয়াক্কা না করে বলেন,,,
:- তুই চুপ কর। বড় এমপি হয়েছেন উনি!! এমপি হোক বা মন্ত্রী বলেছি না রাত ৯ টার আগে বাসায় ঢুকতে? এমনিতেই দিনকাল ভালো নয় তার ওপর এখন শত্রুর অভাব নেই। চিন্তা হয়না আমাদের? ফোন করলে সে ঠিক আছে কিনা অন্তত সেটা রিসিভ করে বলে দিতে পারতো। বলেই মেহরাবের পেছন থেকে সাহিত্যর কান ধরে টেনে আনেন তিনি।
:- কতবার কল করেছি তোকে!! ফোন তুলিসনি কেন সেটা বল আগে।
সাহিত্যর মনে পড়ে তখন সুহাদের বাসার নিচে গিয়ে ফোন সাইলেন্ট করেছিলো সে। পরে আর জেনারেল মোড চালু করা হয়নি। ফোন বের করে দেখে মায়ের ৫৬ টা মিস কল।
সাহিত্য ক্যাবলা হেসে মায়ের দিকে তাকিয়ে কানে হাত দিয়ে বলে,,
:- সরি মা। একদম ভুল হয়ে গেছে। ফোন সাইলেন্ট ছিলো তাই বুঝতে পারিনি। আর কখনো এমন হবে না। প্রমিজ। এই দেখো সারাদিন কিচ্ছু খাইনি আমি!! আর তুমি তোমার হাতের মজার মজার খাবার খেতে না দিয়ে ঝাড়ুর বাড়ি খেতে দিচ্ছো।
ছেলে সারাদিন অভুক্ত শুনেই রাগ গলে জল হয় জননীর।
:- কি বলিস!! সারাদিন না খেয়ে কোথায় কোথায় ঘুরেছে আমার ছেলেটা। এখনি আয় সোনা বাবু! খেতে দিচ্ছি। তোর জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। তারপর সবাইকে নিয়ে টেবিলে বসে যায়।
মায়ের অস্থিরতা দেখে হাসে মেহরাব। দুনিয়ার সব মায়েরা বুঝি এমনই হয়। সন্তানের এতটুকু কষ্ট সহ্য করতে পারে না। সন্তান অভুক্ত থাকলে মায়ের বুঝি কলিজা শুকিয়ে যায়। তাদের মুখে খাবার তুলে না দেয়া পর্যন্ত।
খেতে খেতেই বাবা ছেলে বিভিন্ন রকমের আলাপ আলোচনা সারে। রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কি কি থাকা উচিত। কোন কোন দিকে নজর রাখা জরুরি সেসব নিয়ে উপদেশ দেন আহাদ মির্জা। সাহিত্য মন দিয়ে শোনে সেসব।
আহাদ মির্জা বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন,,
:- বড় খোকা!! তোমার কলেজে চাকরি কেমন চলছে?? এখনো বলছি ভালো না লাগলে রাজনীতি না হোক আমাদের পারিবারিক বিজনেসের দায়িত্বটা অন্তত নিতে পারো।
:- না বাবা। শিক্ষকতার পেশাটা বরাবরই আমার ভালো লাগে। এটা নিয়েই আমি খুব ভালো আছি। তুমি বলেছো বলে তোমার অফিসে সপ্তাহের শুক্রবার,, মঙ্গলবার দুদিন করে তো বসছি। কিন্তু সমস্ত দায়িত্ব টা আমাকে নিতে বলো না প্লিজ।
আহাদ মির্জা আর কিছু বলেন না। বড় ছেলের শিক্ষকতায় তার প্রথমে সায় না থাকলেও তিনি কখনো বাঁধা দেননি। তিনি বরাবরই সন্তানদের ইচ্ছে খুশিকে বড় করে দেখেন। তাদের স্বপ্ন কে সম্মান করেন।
আয়েশা সিদ্দিকা স্বামীর দিকে তাকিয়ে মেহরাব কে দেখিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই আহাদ মির্জা একটু ভেবে গলা ঝেড়ে আবার বলেন,,
:- বলছি বড় খোকা ! অনেক তো হলো। এবার অন্তত বিয়েটা কর। বিয়ের বয়স তো পেরিয়ে যাচ্ছে। কবে বৌমা এনে দিবি আমাদের??
এক লোকমা খাবার মুখে দিতেই বাবার কথা শুনে বিষম খায় মেহরাব। আয়েশা সিদ্দিকা তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস নিয়ে বড় ছেলের মুখে ধরে পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।
মেহরাব একবার সবার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে,,
:- করবো বাবা। তবে আর তিন মাস মতো টাইম দাও। তারপর করবো।
সাহিত্য বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। সে জানে বড় ভাইয়ের মনের কথা। দু ভাই অন্তত নিজেদের মধ্যে কিছু লুকাই না।
আয়েশা সিদ্দিকা চোখ বড় বড় করে তাকায় মেহরাবের দিকে।
:- কি বললি আব্বা?? আবার বল? তিন মাস সময় কেনো চাইছিস?? তোর কি কোন মেয়ে পছন্দ আছে?? আমাকে তো বলিসনি কখনো!! কবে হলো? কে সেই মেয়ে??
:- উফফফ মা। শান্ত হও একটু। কি বলছো তুমি এসব? আমার কোন রিলেশন নেই। থাকলে তোমাকে বলতাম না বলো?
:- তাহলে সময় চাইছিস কেনো?
:- আসলে ওই মানে!! সামনে তো ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের বোর্ড এক্সাম। এই মুহূর্তে ছুটি নেয়া বা বড় কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। শিক্ষক হিসেবে অনেক দায়িত্ব তো থাকে বলো। তাই আগে এক্সাম শেষ হোক। তারপর তোমরা যা বলবে করবো।
:- আচ্ছা তাহলে তো ভালোই হলো। তোর যেহেতু কোন পছন্দ নেই তাহলে আমরা মেয়ে দেখি। পছন্দ হলে তিনমাস পরেই না হয় বিয়ের আয়োজন করলে হবে।
মায়ের কথা শুনে মেহরাব খুক খুক করে কেশে ওঠে।
**********
আগামী কাল সুহাদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু। সুহা সকাল থেকে টেনশনে অস্থির হচ্ছে। নিপা একেবারে গুছিয়ে সুহাদের বাসায় আসে। তাহিরা বেগম মেয়েকে তাড়া দেয়।
:- এতো চিন্তা করছিস কেন সুহা? নিপা দেখ কি সুন্দর গুছিয়ে চলে এসেছে। লম্বা করে একটা শ্বাস নে।
সুহা মায়ের কথায় রিল্যাক্স হওয়ার চেষ্টা করে। সুহা এমনি। কোন পরীক্ষা বা বড় কিছু হলে কেমন প্যানিক করে। তাহেরা বেগম মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত রেখে আশ্বস্ত করে।
:- তোর তো প্রিপারেশন ভালো। তাহলে এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো। হলে ঢুকে কোশ্চেন পেপার হাতে পেলে আগে সুস্থির হয়ে পড়ে নিবি তারপর আস্তে আস্তে আনসার গুলো লিখবি। একদম ঘাবড়াবি না। তোর বাবা যাবে তো সাথে। ভয় পাস না।
সুহা মায়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
তারপর নিপা কে নিয়ে বাবার সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রের উদ্যেশে বেরিয়ে পড়ে।
____
পার্টি অফিসের সামনে সাতটা গাড়ি সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে তিনটা আর সামনে তিনটা। মাঝের ডার্ক কালারের গাড়িটায় উঠে বসে এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা। পাশে অরুদ্ধ,তিয়াশ। সিফাত হৃদয় নিরব আজ আসেনি। নিরব আর সিফাতের বোনেদেরও পরীক্ষা তাই ওরা গেছে সাথে। ওদের কেন্দ্র পড়েছে আলাদা জায়গায়। হৃদয় আছে সাহিত্যর দেয়া দায়িত্বে। কিছুক্ষণ পরেই সাহিত্যের ফোন হৃদয়ের কল আসে। ফোন রিসিভ করে কানে ধরতেই আওয়াজ আসে,,,
:- ভাই!! ভাবি আর তার বান্ধবী ভাবির বাবার সাথে পরীক্ষা কেন্দ্রে এসেছে। ভাবির মুখ দেখে মনে হচ্ছে প্যানিক করছে।
চিন্তিত ভাব ফুটে ওঠে সাহিত্যর মুখে। ড্রাইভারকে বলৈ দ্রুত পরীক্ষা কেন্দ্রের পথ ধরে।
সুহা বাবার পাশেই দাঁড়িয়েছিল তখনই শা শা করে সাতটা গাড়ি পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করে। সুহা দেখেই বুঝতে পারে এমপি সাহেব এসেছে। মুহুর্তেই ভয় ছেড়ে লজ্জা ঘিরে ধরে তাকে। সেই যে সেদিন রাতে হুমকি দিয়ে দেখা করে গেলো এরপর এই আজকে দেখা মিললো তার।
সাহিত্য গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। আশেপাশের সব মেয়েরা হা করে তাকিয়ে থাকে সাহিত্যর দিকে। স্মার্ট সুদর্শন সুপুরুষ এই তরুণ এমপি কে পেহলি নাজার দেখেই তো অধিকাংশ তরুণীদের ঘুম উড়ে যায়।
পাশ থেকে কয়েকটা মেয়ের কথোপকথন কানে আসে সুহার।
:- আরে ইয়ার কি ড্যাসিং দেখতে এমপি সাহিত্য মির্জা কে। ইচ্ছে করে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়। উফফফ চোখ দুটো দেখ কি সুন্দর!!
:- ঠিক বলেছিস রে দোস্ত। এই সাহিত্য মির্জা কে দেখলেই না বুকের ভেতর টা কেমন কেমন করে। আহ এটাকে যদি নিজের করে পেতাম,,,
বাকি মেয়েগুলো খিল খিল করে হাসতে থাকে।
কান ঝা না করে ওঠে সুহার। ছিঃ ছিঃ কি অসভ্য মেয়ে গুলো। নির্লজ্জের মতো কি সব বলছে এমপি সাহেব কে নিয়ে। মনে মনে রাগ হয় সুহাসিনীর। হাহঃ এমপি সাহেবকেও বা কি বলি!! দেখো ফিটফাট হয়ে সেজে গুজে এমপি গিরি দেখাতে চলে এসেছে। মেয়েরা গিলে খাক তাতে কি!!
সাহিত্য সুহাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। সুহার দিকে এক পলক তাকিয়ে সুহার বাবার দিকে এগিয়ে যায়।
:- আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল! কেমন আছেন?
মোতালেব হোসেন সাহিত্য কে দেখে হাসি মুখে সালামের জবাব দিলো। তারপর কাঁধে হাত রেখে বললেন,,
:- আরে সোহরাব বাবা!! তুমি কেমন আছো?? এতো বড় দায়িত্ব পালন করে অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাইনা??
:- আমি ভালো আছি আঙ্কেল। কি যে বলেন। আপনাদের দোয়ার হাত আমার মাথার ওপরে থাকলে আর কিসের কষ্ট। এলাকার জনগনের মুখে সস্তির হাসি দেখলে সব কষ্ট দুর হয়ে যায় আঙ্কেল।
বন্ধু পুত্র ও সদ্য আসন গ্রহণ করা এমপির বিনয়ী ব্যাবহারে খুব খুশি হন তিনি। সাহিত্য আর তার বন্ধু রা এক সময় তার
ছাত্র ছিলো। তিনি অত্যন্ত গর্বিত সাহিত্য কে নিয়ে। পাশ থেকে অরুদ্ধ আর তিয়াশ এসে সালাম দেয় মোতালেব হোসেন কে। তারপর বিভিন্ন রকমের কথা বলতে থাকে।
সেই সুযোগে সাহিত্য সুপার হাত ধরে একটু সাইডে টেনে নেয়।
:- কি রে!! পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন নিয়েছিস?
:- ভ,,ভালো।
সাহিত্য সুহার একটু কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখে। আদুরে গলায় বলে,,
:- একদম টেনশন করিস না কেমন। রিলাক্স হয়ে পরীক্ষা দিবি।
:- আচ্ছা।
সাহিত্য খেয়াল করে সুহার মুখে হাসি নেই। সে কিছুক্ষণ পরপর আশপাশের মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে আর একটু একটু করে সাহিত্যের দিকে তাকাচ্ছে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ রেগে যাচ্ছে সুহা। ব্যাপারটা খেয়াল করে সাহিত্য। চারপাশে তাকিয়ে দেখে আসেপাশের মেয়েরা তার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে।
সাহিত্য মনে মনে ভাবে,,সুহা কি জেলাস হচ্ছে?? মেয়েদের আমার দিকে তাকানোই কি সুহার রাগের কারণ!!
দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।সুহার রাগ হচ্ছে। মনে এক ঝাঁক সুখ এসে দোলা দেয় এমপি সাহেবের। সুহা জেলাস তারমানে সাহিত্যর জন্য তার মনে অনুভূতি তৈরি হচ্ছে।
এটাই তো চায় সে। তার ফুলকুড়ি তাকে নিয়ে ভাবুক। তার অনুভূতি গায়ে মাখুক। মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই সে তার সুহাসিনীকে এক আকাশ সমান অনুভূতির সাথে পরিচয় করাবে। তার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবে তার ফুলকুড়ি কে। সেখানে কারো হস্তক্ষেপ চলবে না। তার সুহা রানির সবটুকু জুড়ে একমাত্র তার অধিকার থাকবে।
চলবে,,,