ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী পর্ব-১৩+১৪

0
115

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,১৩
মৌমো তিতলী

আজ মির্জা পরিবারের বড় ছেলে মেহরাব মির্জার জন্মদিন।
বাহারি আলোর রোশনাইয়ে ঝলমলে হয়ে উঠেছে মির্জা ম্যানশন। চারদিকে চোখ ঝলসানো আলোর ছড়াছড়ি। মির্জা ম্যানশনের বিলাসবহুল বাড়িটির প্রতিটি কোনা কোনা তার আভিজাত্য ছড়াচ্ছে। ড্রইংরুমের বড় হল রুম জুড়ে অতিথিরা নিজেদের মতো বার্থডে পার্টি এনজয় করছে। সাদা কালো ইউনিফর্মে ওয়েটাররা অতিথিদের কোমল পানীয়,সফট ড্রিংকস, বিভিন্ন ধরনের স্ন্যাকস সার্ভ করছে। মনোরম পরিবেশে হালকা মিউজিক সোভা পাচ্ছে। একপাশে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি সব লাজিজ, ডিলিসিয়াস খাবারের আইটেম সাজানো,, অতিথিদের আপ্যায়নে কোনরকম ত্রুটি না হয় সেজন্য আহাদ মির্জা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছুর তদারকি করছেন।

মেহরাব তৈরি হয়ে নিজের রুমেই বসে আছে। ব্লু প্যান্ট, হোয়াইট শার্ট, উপরে ব্লু রঙের স্যুট পড়েছে মেহরাব। পায়ে ব্ল্যাক লোফার স্যু, সুটের পকেটে সুন্দর করে ভাঁজ করে রাখা সাদা রংয়ের রুমাল, হাতে দামি ব্রান্ডের ঘড়ি শোভা পাচ্ছে, মুখে ট্রিম করা চাপ দাড়িতে সৌন্দর্যের ওপর যেন ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে।মাথায় ব্যাক ব্রাশ করা একরাশ সিল্কি চুল তার জেল্লা ছড়াচ্ছে।
এই মুহূর্তে মেহরাব ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে,,, এই মুহূর্তে তার মনে একটাই ভাবনা…

_আরশির বাবা-মা তাকে পছন্দ করবে তো!! লাগছে না একদম হিরো মাফিক!!👌

পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তেই ফোনটা বের করে আরুশ কে ফোন লাগায়। কয়েকবার রিং বাজতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হয়।

:- হ্যালো!! মেহরাব বল!!

:- আরে দোস্ত পার্টি শুরু হয়ে গেছে। আর তোরা এখনো কোথায়?

:- আরে ইয়ার!! আমরা এখন গাড়িতে। জ্যামে আটকে আছি। ২০ ,২৫ মিনিটে পৌঁছে যাবো। টেনশন লেনেকা নেই!!

:- ধুরো ব্যাটা!! তোর জন্য টেনশন কে করছে!! আমার বউটাকে খুব মিস করছি সেই জন্য বার বার ফোন করে জানতে চাইছি কখন পৌছাবি!!

(বলাই বাহুল্য, মেহরাব অনেক আগে থেকেই আরশির ব্যাপারটা আরুশের সাথে শেয়ার করেছিলো ।আর এই সম্পর্কে আরুশের কোন আপত্তিও ছিল না। তার শর্ত একটাই ছিল কলেজে থাকাকালীন আরশিকে বিয়ে দিবে না। পরীক্ষার এই কটা দিন পার হলেই আরশির কলেজ লাইফে ইতি টানবে। তাই এখন দু পরিবারের মধ্যে কথা হতেই পারে.. তাতে কোন আপত্তি নেই আরুশের)

মেহরাবের কথা শুনে আরুশ নিচু গলায় বলে,,,

:-তোকে দেখে নেব শালা !!এখন বন্ধু পর হয়ে গেছে না? কাজের সময় কাজী আর কাজ ফুরালেই পাজি তাইনা?

মেহরাব নাক কুঁচকে বলে,,,

:- ছিঃ তুই আমাকে শালা বলছিস কেন?? শালা তো হবি তুই। আর আমি তোর বোন জামাই!! respect দিয়ে কথা বল।

:-আইছে আমার বোন জামাই!! আগের দেখ আমার বাবা-মা রাজি হয় কিনা! দেখ, বাবা মা রাজি না হলে কিন্তু আমি তোর সাথে বোন বিয়ে দেবো না।

মেহরাব মুখ বাকিয়ে বলে,,

:- তোর বাবা-মা রাজি হবে, তাদের ঘাড়ও রাজি হবে। আর যদি রাজি নাই হয় ,তাহলে তোর বোনকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে এক সেকেন্ডও সময় নেবে না এই মেহরাব মির্জা।আমি কি করতে পারি সেটা তুই ভালো করেই জানিস। তাই কোন ডাউট রাখিস না।

মেহরাবের হুমকিতে নিঃশব্দে হাসে আরুশ। মাস্টারমশাই খুব ভালোই ফেঁসেছে বোনের প্রেমে।

:-যাই হোক তোকে আমি যেটা বলেছিলাম সেটা ঠিকঠাক করেছিস তো?? আরশি নীল রংয়ের গাউন পড়েছে তো?

:-আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই এত চাপ নিস না। পৌঁছে যাব তাড়াতাড়িই।

:-ওকে ওকে তাহল সাবধানে আয়। ফোন রেখে দেয় মেহরাব। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে নীল গাউনে তার প্রিয়সিকে তারপাশে কাপলের মতো লাগবে নিশ্চয়!!
হাসি ফুটে ওঠে মেহরাবের ঠোঁটে। মনের ভেতর সে এক অদ্ভুত অস্থিরতা টের পাচ্ছে!! আজই তার প্রেয়সী তার নামে বাধা পড়বে তো? রাজি হবে তো আরশির বাবা-মা!!

___________

অরুদ্ধের ফোনে লাগাতার কল করে যাচ্ছে সাহিত্য। আজ সকাল থেকে ছেলেটা যেন লাপাত্তা। এতটা লম্বা সময় সাহিত্যের থেকে আলাদা থাকা অরুদ্ধের এই প্রথম। সে সারাক্ষণই সাহিত্যের পাশেপাশে থাকে। অথচ আজ এমন একটা দিনে ওর সব থেকে আগে মির্জা মেনসনে পৌঁছানোর কথা।অথচ সে আসেনি। সাহিত্য কলের উপর কল করছে কিন্তু ফলাফল শূন্য।ব্যাপারটা নিয়ে সাহিত্য বেশ চিন্তিত। কোন বিপদ হলো না তো ওর? বন্ধুর জন্য উদ্বিগ্ন হয় সাহিত্যর মন। এমনিতেও সাহিত্যর সব থেকে কাছের বন্ধু হিসেবে ওর ওপর দিয়ে কোন ঝড়ঝাপটা যায় না, বন্ধুর চিন্তায় ভাইয়ের বার্থডে পার্টির আনন্দ ফিকে লাগছে। সাহিত্যর বুঝতে পারছে না কি হয়েছে অরুদ্ধের।

তিয়াশ আর সিফাতও কিছু বলতে পারছে না। সাহিত্যের মতো তিয়াশ আর সিফাত ও চিন্তিত।

এমন সময়ে একটা মেয়ে ঝড়ের গতিতে সাহিত্য রুমে ঢোকে।কোনদিকে না তাকিয়েই সাহিত্যকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে সাহিত্যর বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগে। মেয়েটা কে খেয়াল করেই তিয়াশ আর সিফাতের চক্ষু চড়কগাছ!!

তিয়াশ কেবলই গ্লাস উঠিয়ে পানি খাতে নিচ্ছিল, কিন্তু পানিটা আর গিলা হলো না তার ।মেয়েটাকে দেখেই সবটুকু পানি তিয়াশের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো।
গোল গোল চোখ করে মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে। সিফাতের কানে ফিসফিস করে বললো,,

:-এই শাকচুন্নি ছেড়ি এইহানে ক্যালা?

সিফাত সাহিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে,,,

:- আমারে ক্যান জিগাস? তুইও যেইহানে,,মুইও সেইহানে। দোস্ত এমনিতেই সাহিত্যের এখন মন মেজাজ ভালো নেই এই ছেড়ি নির্ঘাত সাহিত্যর হাতে এখন একটা দাবাং মার্কা থাপ্পর খাইবো।
তিয়াশ,সিফাত দু’জনেই আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে সাহিত্যের দিকে।

বুকের উপর আছড়ে পড়া মেয়েটা কে সেটা বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগে সাহিত্যর। মেয়েটা কে বুঝতে পেরেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। নীলিমা!! সাহিত্যর একমাত্র ফুপি শেফালি বেগমের একমাত্র ঢংগি মেয়ে। মেয়েটা এ বাড়িতে আসলেই জোঁকের মতো সাহিত্যর পিছে পড়ে থাকে ।
এই পর্যন্ত না হলেও এক হাজার বার সাহিত্যকে প্রপোজ করেছে, আর ২ হাজার বার রিজেক্ট হয়েছে। তবুও সে নাছোড়বান্দা। সাহিত্য মেয়েটাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। মুখে ১৪ স্তরের মেকআপ ,হাইলাইট করা হেয়ার স্টাইল, ওয়েস্টার্ন ড্রেসে অশ্লীল ভাবে চলাফেরা করে নীলিমা। তার টাইম পাসের জন্যও না হলে ২০-২৫ জন ছেলে সব সময় থাকে। ক্যারেক্টারলেস নির্লজ্জ মেয়ে একটা।

সাহিত্য এক ঝটকায় নীলিমাকে দূরে দাঁড় করিয়ে দাঁতের দাঁত চেপে বলে,,,

:- এটা কোন ধরনের অসভ্যতা?? আশেপাশের কারোর কোন তোয়াক্কা নেই ,এসেই পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরে আদিখ্যেতা করছো!!

নীলিমার ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,,

:- ওহ হো বেইবি।আই লাভ ইউ!! ইউ নোউ না সোহরাব বেইবি?? আর কে পর পুরুষ?? কয়েকদিন পরে তো আমি তোমাকে বিয়ে করে নেবো। তখন তো তুমি আর পরপুরুষ থাকবে না।

এদিকের রাগে হাত-পা কাঁপতে থাকে সাহিত্যর। রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাই নীলিমার দিকে।বলে,,,

:- লাস্ট বার অর্ন করছি নীলিমা। আমার ধারে কাছেও ঘেঁষবে না। আর বিয়ে মাই ফুট!! তোমার মতন নির্লজ্জ মেয়েকে এই এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা বিয়ে করবে??
হাউ মাচ ফানি!!

সাহিত্যর করা কটাক্ষে ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ে নীলিমা। তবে মুখে সেটা প্রকাশ না করে বাঁকা হাসে সে। আবারো সাহিত্যের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলে,,

:- এই ফান টাই আমি সত্যি করে ছাড়বো। এমপি সোহরাব মির্জা!! বিয়ে তো তুমি আমাকেই করবে। বলে একবার তিয়াশ আর সিফাতের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় নীলিমা।

তিয়াশ ঢোক গিলে বলে,,,

:- সাংঘাতিক নির্লজ্জ মাইয়া।

সাহিত্য তিয়াশ আর সিফাতের দিকে তাকিয়ে বলে,,,

:- আজ ইভেন্টে সুহাসিনীও আসবে। এই নির্লজ্জ জোঁক টার দিকে খেয়াল রাখবি তোরা।কোন ভাবেই যেন সুহাসিনীর ব্যাপারটা জানতে না পারে।
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সাহিত্য। আবারো ফোনটা বের করে অরুদ্ধের ফোনে কল দেয়। আশ্চর্যজনকভাবে এবার রিং হয় অরুদ্ধদের ফোনে।

কিছুক্ষণ পর ফোনটা রিসিভও হয়। ওপাশ থেকে অরুদ্ধ বলে,,,

:- সাহিত্য আই এম সরি দোস্ত!!আ’মএক্সট্রিমলি সরি!! তুই অনেক বার কল করেছিস ,আমি বুঝতে পারিনি। সকালবেলায় বেরোতে নিছিলাম তখনই মায়ের শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়। তখন নিয়ে ছুটে এসেছি হসপিটালে। এখানে এসে পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারলাম মায়ের পেটে টিউমার হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। এদিকে ফোনটাও কখন চাপ লেগে অফ হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। এদিকের ঝামেলা মিটিয়ে, ফোনটা বের করে দেখলাম বন্ধ আছে। খুলে দেখলাম তুই অনেকবার কল দিয়েছিস। সরি দোস্ত তোকে টেনশনে ফেলার জন্য।

অরুদ্ধের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় সাহিত্য। সত্যিই টেনশনে মাথা খারাপ হচ্ছিলো। সাহিত্য নিজের থেকেও বন্ধু তিনজনের জন্য চিন্তা করে বেশি। সবসময় মনে হয় তার সাথ দিতে গিয়ে তার বন্ধুদের যেন কোন ক্ষতি না হয়। তাহলে কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না সাহিত্য। তিয়াশ,সিফাত, অরুদ্ধ কে অনেকবার তার সাথ ছেড়ে ভালো কোন চাকরি করতে বলেছে সাহিত্য। কিন্তু বন্ধু তিনজন তাকে ছাড়তে নারাজ। হাজারও সুখ -দুঃখ, হাসি কান্না, ভালো খারাপ স্মৃতিতে তিন বন্ধু অটুট হয়ে আছে একসাথে।

আসলেই বন্ধুত্ব এমন একটা সম্পর্ক যেটা সব রকম রক্তের সম্পর্ক কেউ হার মানিয়ে যায়।

সাহিত্য আবারো বলে,,,

:- আন্টির কি অবস্থা এখন? আর কোন হসপিটালে ভর্তি করেছিস??

:-চিন্তা করিস না দোস্ত। সিটি হসপিটালে ভর্তি করেছি!

:-কোন কিছুর দরকার থাকলে বলিস। নাকি হসপিটালে আসবো আমরা ??

:-আরে না না !!এখন আসতে হবে না ।ওদিকে থাক।আমি সবটা সামলে নেবো‌ ওদিকের সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে হয়ে গেলে তারপর না হয় আসিস। এমনিতেও এখানে এখন কোন কাজ নেই।অপারেশন কাল হবে বলেছে ডাক্তার। এখন মাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে।ঘুমাচ্ছে মা।

:- আচ্ছা!! কোন কিছুর প্রয়োজন হলে অবশ্যই কিন্তু ফোন করবি।

:-ওকে দোস্ত ওকে!!

ফোন রেখে তিয়াশ আর সিফাত কে জানায় অরুদ্ধের মায়ের কথা ‌। সিফাত সাথে সাথে বলে,,

:- দোস্ত তাহলে তিয়াশ এখানে তোর সাথে থাকুক ।আমি না হয় অরুদ্ধের কাছে যাই। যতই হোক একা আছে ও। আমি গিয়ে ওর সাথে থাকি।
সাহিত্যও ভেবে দেখে সিফাত ঠিকই বলেছে ।এই মুহূর্তে অরুদ্ধকে একেবারেই একা ছাড়া ঠিক নয়। সে নিজেই যেতো ,কিন্তু আজ এত বড় একটা ইভেন্ট বাড়িতে ।অনেক ধরনের মানুষ আসবে। শত্রুপক্ষ সবসময়ই ওত পেতে আছে ক্ষতি করার জন্য। এরকম লোক সমাগমের অনুষ্ঠানে দু চার জন শত্রুপক্ষ যে ঢুকে বসে থাকবে না, তার কোন গ্যারান্টি নেই। সবদিকেই চোখ রাখতে হবে সাহিত্যর।

সিফাত বেরিয়ে যায় হসপিটাল এর উদ্দেশ্যে। সাহিত্য আর তিয়াশ নেমে আসে লিভিং রুমে।
______

মেহরাব দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে ।তার নজর সবসময়ই দরজার দিকে। অদ্ভুত অস্থিরতায় ছটফট করছে সে। কিছুক্ষণ পরেই আরুশ এসে পৌঁছায় পরিবার নিয়ে।
আরুশ, সাথে তার বাবা-মা গাড়ি থেকে নেমে আসে। মেহরাব এগিয়ে যায় তাদের দিকে। শেষে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আরশি। দুহাতে গাউন উঁচু করে ধরে বের হয় সে।
মেহরাবের দৃষ্টি থমকায়!! নীল গাউনে তার প্রেয়সীকে একেবারে সিনড্রেলার মত লাগছে ।যেন রূপকথার রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে মেহরাব। ঠোঁটে তার অমায়িক হাসি।

আরুশ এগিয়ে এসে কাঁধে হালকা চাপড় মেরে বলে,,

:- নিজেকে সামলা দোস্ত!! তোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে কিছুদিন পর পাবনায় টিকিট কনফার্ম করতে হবে।

মেহরাব ঘোরের মাঝে জবাব দেয়,,

:- আরে ইয়ার!! তোর বোন মুঝে মার ডালা রে!!!! ইচ্ছে করছে এখনই গিয়ে জড়িয়ে ধরে টপাটপ চুমু খায়!

আরুশ নাক মুখ কুঁচকে বলে,,,

:- ছি অশ্লীল!! তুই না শিক্ষক? ছাত্রীর দিকে এরকম বদ নজর দিস, ব্যাটা খচ্চর।
:- খচ্চর হবি তুই! আর তোর ১৪ গুষ্টি। আর আমি তোর বোনের শিক্ষক নই ,প্রেমিক বুঝলি!! আর দুদিন পর হবে তোর দুলাভাই । সো রেসপেক্ট!!

:- আমার ১৪ গুষ্টিতে কিন্তু আমার বোনও আছে।

:- তোর বোন বাদে। সে কিছুদিন পর আর তোদের গুষ্টির কেউ থাকবে না।

আরুশ আর কিছু না বলে হাতের কনুই দিয়ে মেহরাবের পেটে খোঁচা মেরে হাসতে হাসতে ভেতরে যায়!!

আরশি এতক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলো মেহরাবের দিকে। আরুশ ভেতরে যেতেই পেছন ফিরেই আরশির চোখে চোখ পড়ে মেহরাবের। চকিতে চোখ সরিয়ে নেয় আরশি। মেহরাব বাঁকা হেসে আরশির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার চোখের আড়ালে আরশির দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,,,

:- Welcome to my home my love !!

মেহরাবের কথায় লজ্জায় লাল হয়ে আরশি। স্মিত হেসে মুখ নামিয়ে নেয়। মেহরাব মুগ্ধ হয়ে দেখে প্রেয়সীর সেই রুপ।

_______
সুহা তার বাবার সাথেই এসেছে মির্জা ম্যানশনে। টুকটুকে লাল রঙের চুড়িদার পরেছে সে। মাথায় সোনালী রঙের হিজাব মার্জিত ভাবে বেঁধেছে। সাহিত্যের কড়া আদেশ!! হিজাব ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। কিন্তু এখনো সেই নিষ্ঠুর মানবের দেখা নেই। আসার পরেই তো মেসেজ করলো।
মোতালেব হোসেন মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে যায় বন্ধু আহাদ মির্জার দিকে। মোতালেব হোসেন কে দেখে আহাদ মির্জা হাসিমুখে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। পাশেই দাড়িয়ে আছে মেহরাব। মোতালেব হোসেন মেহরাব এর সাথে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন । মেহরাব সুহার দিকে তাকায়। সুহার চোখ যেন এদিক ওদিক কাউকে খুঁজছে। মেহরাব তার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে বলে,,

:- কেমন আছো বনু? কাউকে খুঁজছো নাকি?

সুহা অপ্রস্তুত হাসে। মুখে বলে,,

:-আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন? জন্মদিনের অনেএএকক শুভেচ্ছা আপনাকে।

:- আমিও ভালো আছি। আর ধন্যবাদ শুভেচ্ছার জন্য।
বাবা আর আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে সুহাকে আস্তে করে বলে,,,

:- বড়দের মাঝে তুমি বোর হবে। তার থেকে আমার সাথে এসো। আরশি এসেছে। ওর সাথে থেকো। আর ভাই মনে হয় উপরে আছে। একটু পরেই তাকে দেখতে পাবে।

মেহরাবের কথায় বেশ লজ্জা পায় সুহা। তবে আরশির কথা শুনেই সুহার খুশি দিগুন হয়। উচ্ছাসিত ভঙ্গিতে মেহরাব কে বলে,,

:- সত্যি!! কোথায় আরশি আপু? আমাকে নিয়ে চলুন এক্ষুনি।
মেহরাব সুহাকে নিয়ে দোতলার সিঁড়ির কাছে গিয়ে বলে,,

:- এতো ভিড়ের মাঝে তোমায় যেতে হবে না সুহা। তুমি এখানেই দাঁড়াও, আমি আরশিকে ডেকে নিয়ে আসছি।
মেহরাবের কথা মতো সেখানে দাঁড়ায় সুহা।

পার্টিতে দুজন লোক ওয়েটারের ছদ্মবেশে চারদিকে নজর রাখছে। এরা আমজাদ তালুকদারের লোক। একজন হাতে করে কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে অতিথিদের দিকে এগিয়ে যায়!!
সিঁড়ির কাছে আসতেই আচমকা নীলিমা সামনে চলে আসে। সে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছিলো। ওয়েটারের ছদ্মবেশে লোকটা দ্রুত সরতে নিলেই ধাক্কা লাগে সুহার সাথে। আর কোল্ড ড্রিংকস ছিটকে গিয়ে পড়ে নীলিমার গায়ে। নীলিমা চোখ তুলতেই সামনে সুহাকে দেখেই প্রচন্ড রাগে সপাটে একটা চড় বসাই সুহার ফর্সা গালে। তাৎক্ষণাক দ্বিগুণ জোরে থাপ্পর পড়ে নীলিমার গালে। চড়ের তোড়ে নীলিমা ছিটকে গিয়ে পরে সুহার পায়ের কাছে। ছল ছল চোখে সামনের দিকে তাকাতেই দেখে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগে কাঁপছে সাহিত্য। মুহুর্তেই ঘটা ঘটনায় থমকে যায় লিভিং রুমের সবাই। পরপর দুটো চড়ের শব্দে স্তম্ভিত সকলে। কে কাকে কেন মারলো এখনো কেউ বুঝে উঠতে পারছে না!!
সুহা এমন পরিস্থিতিতে জীবনে কখনোই পড়েনি। বাবা-মা কখনোই তার গায়ে হাত তোলেনি। আর এখন পার্টিতে এতগুলো মানুষের সামনে অচেনা একটা মেয়ের হাতে থাপ্পড় খেয়ে হতভম্ব সুহা। গালে হাত দিয়ে ছল ছল চোখে তাকায় সাহিত্যর দিকে।
এদিকে সাহিত্য রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে নীলিমার দিকে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে সুহা আঁতকে ওঠে। সাহিত্যকে দেখে যে কেউ বলতে পারবে, এই মুহূর্তে প্রচন্ড রেগে আছে সাহিত্য।
একটুখানি দূরেই আতঙ্কিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তিয়াশ। মনে মনে ভাবছে,,

:- শাকচুন্নি মাইয়া আজকে শ্যাষ। হেই তো জানে না কার গালে থাপড়াডা মারছে। মাইয়ার নিজের গাল এবার আস্তো থাকলে হয়!!

To be continue,,,

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,১৪
মৌমো তিতলী

:-শাকচুন্নি মাইয়া আজকে শ্যাষ। হেই তো জানে না কার গালে থাপড়াডা মারছে। মাইয়ার নিজের গাল এবার আস্তো থাকলে হয়!!

লিভিং রুমের সবাই একবার নিচে পড়ে থাকা নীলিমার দিকে তাকাচ্ছে, তো একবার সাহিত্যের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কেউ আসলে বুঝতে পারছে না এখানে কি ঘটলো ।

সাহিত্য আবারো তেড়ে গেলো নীলিমার দিকে। নীলিমার দু বাহু শক্ত করে চেপে ধরে টেনে তুলে বলল,,

:- হাউ ডেয়ার ইউ!! How dare you touch her!! বলেই সোপাটে আরও একটা চড় দিলো নীলিমার গালে। একই গালে দুবার দাবাং মার্কা চড় খেয়ে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো নীলিমার।

তখনই সাহিত্যর ফুপু শেফালী বেগম দৌড়ে এসে সাহিত্যর হাত থেকে মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে এসে আগলে ধরে। সাহিত্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,,

:-সাহিত্য!!! এতো গুলো বাইরের লোকের সামনে তুমি আমার মেয়ের গায়ে এভাবে হাত তুললে কেনো??

সাহিত্য ফুঁসে ওঠে বললো,,

:- এই সোহরাব সাহিত্য মির্জা কখনো এমনি এমনি কোন কাজ করে না ফুপু। তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো কেন তার গায়ে হাত তুলেছি! এতগুলো বাইরের লোকের সামনে তাকে চড় দিয়েছি বলে গায়ে লাগছে, আর আমারই বাড়িতে, আমাদেরই পারিবারিক অনুষ্ঠানে বিনা কারণে আমার গেস্টের গায়ে হাত তোলে কোন সাহসে তোমার মেয়ে?? তাও তার থেকে যথেষ্ট ছোট্ট বয়সী একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেছে। এতো উদ্ধ্যত্ব আসে কি করে ওর?

এতক্ষণে ছলছল চোখে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুহার দিকে সবার নজর যায়। মোতালেব হোসেন মেয়ের দিকে খেয়াল করেই দ্রুত গিয়ে মেয়েকে বুকের সাথে জাপটে ধরেন।
_এই মেয়েটা তার মেয়ের গালে চড় দিয়েছে! কেনো? সুহা তো কারো সাথে কোন বেয়াদবি করার মেয়ে নয়। বিশেষ করে কোন রিলেটিভ এর অনুষ্ঠানে এসে অচেনা কোন মেয়ের সাথে বেয়াদবি করবে এমন মেয়ে সুহাসিনী নয়। মোতালেব হোসেন জিজ্ঞাসিত চোখে তাকাই সাহিত্যর দিকে।

সাহিত্য এবার নীলিমাকে ধমকে বলে,,,

:- বল কেন সুহার গায়ে হাত তুলেছিস তুই?? একদম ন্যাকামি না করে সত্যি করে বল?

নীলিমা এতক্ষণ মনে মনে রাগে ফুসছিলো।
সাহিত্যের প্রশ্ন শুনে কোনরকম দাঁতের দাঁত চেপে বলল,,,

:- এই মেয়েটা আমার গায়ে কোল্ড ড্রিংকস ফেলে আমার এতো দামি ড্রেসটা নষ্ট করে ফেলেছে।তাই….

নীলিমার কথা শেষ না হতেই সাহিত্য আবার বলে ওঠে,,

:- তোর কোন অ্যাঙ্গেল থেকে সুহাসিনীকে ওয়েটার মনে হচ্ছে?
নীলিমা বুঝতে না পেরে ভ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকে। সাহিত্য আবার বলে ,,,

:-তোর গায়ে যখন কোল্ড ড্রিংকস পড়েছে ,তখন তোর বোঝা উচিত ছিল কোন ওয়েটারের কাছ থেকে পড়েছে। সেখানে তুই সুহাসিনীর গায়ে হাত তুললি কেনো ? কমনসেন্স নেই তোর? সুহাসিনী কে দেখে তোর ওয়েটার মনে হচ্ছে??

ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রাগে কাঁপছে নীলিমা। এখনো ক্রোধের বসে এতোটুকু মাথায় ঢুকছে না, সাহিত্যের বলা কথাটা সত্যি। সে তো ওয়েটারকেই তার দিকে আসতে দেখেছিলো। তবুও রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে নীলিমা।তার মাথায় শুধু একটাই কথা ঘুরছে, এই মেয়েটার জন্য আজ তাকে এতটা অপমানিত হতে হলো সাহিত্যের কাছে।
সে ভাবছে,,,

_ সামান্য একটা বাইরের মেয়ের জন্য সাহিত্য তার গায়ে হাত তুললো। কে এই মেয়ে? যার জন্য সাহিত্য এতগুলো লোকের সামনে স্ট্যান্ড নিতে দুবার ভাবলো না। এতই কি ইম্পর্টেন্ট এই মেয়েটা? দেখে তো কোন হাইফাই কেউ মনে হচ্ছে না। এই মেয়েটাকে তো সে দেখেই নেবে। এই অসভ্য ছোটলোক মেয়েটার জন্য এতগুলো লোকের সামনে আজ নীলিমার যথেষ্ট অপমানিত হতে হয়েছে। এর শোধ সে তুলবেই।

নীলিমা আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে যায়। শেফালী বেগমও মেয়ের পেছন পেছন যায়, মেয়েকে সামলাতে।

পার্টির পরিবেশ খারাপ হচ্ছে দেখে আহাদ মির্জা অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন,,,

:-সম্মানিত অতিথিবৃন্দ!! আমার মনে হয় কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে একটু ঝামেলা হয়ে গেছে।যাই হোক!! আপনারা সবটা ভুলে আবার পার্টি এনজয় করুন।

তারপর মোতালেব হোসেনের কাছে এসে ক্ষমা চাই,,

:- ক্ষমা কর বন্ধু!আমাদের খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। নয়তো আমার বোনের মেয়েটা সুহা মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারতো না।
মোতালেব হোসেন বুঝতে পারেন না কি বলবেন। মেয়েটার গায়ে হাত তুলেছে, তার জন্য বুকটা পুড়ছে তার। মেয়ের গায়ে কখনো হাত তোলেননি তারা। সেখানে অনুষ্ঠানে আনন্দ করতে এসে, কারো হাতে বিনা দোষে চড় খেয়েছে তার মেয়েটা। বাবা হিসেবে তার অত্যন্ত খারাপ লাগছে।

আহাদ মির্জা সুহার কাছে এসে বলেন,,

:- তোমার আংকেল কে ক্ষমা করো মা! সে তোমাকে প্রটেক্ট করতে পারেনি।

বাবার বয়সী আঙ্কেলকে ক্ষমা চাইতে দেখে খারাপ লাগে সুহার । সুহা দ্রুত বলে,,

:- ছিঃ ছিঃ আঙ্কেল। এমন বলবেন না। এটা একটা ভুল বুঝাবুঝির কারণে হয়েছে। আমি কিছু মনে করিনি।

মেহরাব আরশি কে ডেকে এনে, এতটুকু সময়ে এতো কিছু কিছু ঘটতে দেখে থম মেরে দাঁড়িয়েছিলো।
সাহিত্য বড় ভাইয়ের দিকে কিছু একটা ইশারা করতেই নড়েচড়ে ওঠে মেহরাব। আস্তে করে আরশীকে বলে সুহাকে এখান থেকে সরিয়ে উপরে নিয়ে যেতে।

আরশি মেহেরাবের কথামতো সুহার কাছে এগিয়ে যায়। পেছন থেকে সুহার ঘাড়ে হাত দিয়ে ডাকে, সোহা তাকিয়ে আরশি কে দেখে আলতো করে করে হেসে দেয়। আরশি ভাবে,,
_ এরকম একটা মিষ্টি মেয়েকে কিভাবে গায়ে হাত তুলতে পারে কেউ!!

আরশি মোতালেব হোসেনকে বলে,,

:- আঙ্কেল আমি সুহাকে নিয়ে যাচ্ছি।
তারপর সহার দিকে তাকিয়ে বলে,,

:- চলো আমার সাথে। সুহা চুপচাপ আরশীর সাথে উপরে চলে আসে।
সুহাও এতগুলো লোকের সামনে থেকে একটু সরতে চাইছিলো। ভীষণ অকওয়ার্ড ফিল হচ্ছিলো এতক্ষণ।

আরশি তাকে সাহিত্যের রুমে নিয়ে যায়। মেহরাবই তাকে চিনিয়ে দিয়েছিলো কোন রুমটা সাহিত্যের।
সুহা রুমে ঢুকে চারপাশে দেখতে থাকে।
_বাহ!! এতো সুন্দরও কারো রুম হয়!! সবকিছু সাদা। রুমের রং, জানালার ফিনফিনে পাতলা পর্দা, বেডশীট, সোফা সবকিছু সাদা। এমনকি একটা ফ্লাওয়ার ভাস, সেটাও সাদা। তাতে কিছু রজনীগন্ধা আর সাদা রঙের গোলাপ সাজানো রয়েছে।

আরশি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয় সুহার দিকে। সুহা হালকা হেসে গ্লাসটা নেয়। ঢকঢক করে পুরোটাই খেয়ে শেষ করে। গলাটা বেশ শুকিয়ে গেছিলো।

পানিটা শেষ করে আরশির হাতে দিতেই, রুমে প্রবেশ করে সাহিত্য। সাহিত্যকে দেখেই একটু মিইয়ে যাই সুহা। লোকটা তার সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে নিজের ফুফাতো বোনের গায়ে হাত তুললো ।শুধুমাত্র সুহার জন্য। কেনো করল এমপি সাহেব তার জন্য এমন?? কে হয় সে এমপি সাহেবের? প্রশ্ন সুহার মনে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা।

সাহিত্য আসতেই আরশি বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। সাহিত্য আলতো করে দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে সুহার কাছে এগিয়ে এসেই সুহার হাত টেনে কাছে এনে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। শিউরে উঠে সুহা।

সুহাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরেই মাথায় ঠোঁট ছোঁয়ায় সাহিত্য। তারপর দুহাতের আজলে সুহার মুখটা উঁচু করে ধরে। সুহার ফর্সা গালে লাল দাগ হয়ে গেছে। সাহিত্য সেখানে আলতো করে আঙ্গুল বুলিয়ে দেয়। গভীর কন্ঠে বলে,,,

:- আ’ম সরি ফুলকুঁড়ি। আ’ম এক্সট্রিমলি সরি । ক্ষমা করে দে তোর এমপি সাহেব কে। আমি উপস্থিত থাকতে কেউ তোর গায়ে হাত তুলেছে এটা মানতে পারছি না আমি। এই.. পদ্মফুল অনেক ব্যাথা লেগেছে তাইনা? চিন্তা করিস না। যার জন্য তোকে ব্যাথা পেতে হলো তাকে আমি এতো অল্পতেই ছেড়ে দেবো না।

সাহিত্যের কথায় আঁতকে ওঠে সুহা। যথেষ্ট তো হলো!! আবার কি করতে চায় সাহিত্য? বিচলিত হয় সুহা,,,ছটফট করে বলে,,

:- কিছু করতে হবে না আর। এমনিতেও তো দুইটা চড় মারলেন। আপুটার নিশ্চয় আমার থেকে অনেক বেশি ব্যথা লেগেছে। আমার জন্য প্লিজ আর আপুটাকে কিছু বলবেন না।

সহার কথা শুনে দাঁতের দাঁত চাপে সাহিত্য। সুহার গালটা শক্ত করে ধরে বলে,,,

:-খবরদার সুহাসিনী !ওর জন্য দরদ দেখাবি না। ফালতু বাজে মেয়ে একটা!!

সুহা বেশ অবাক হয়। ভ্রু কুঁচকে বলে,,

:- উনি না আপনার ফুপাতো বোন?

:- নাহ। ও আমার কেউ না। বলেই সুহার লাল হয়ে যাওয়া গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
আচমকা স্পর্শে পা বেঁকে আসে সুহার। থরথর করে কেঁপে ওঠে সুহা। ধাপে ধাপে দ্রুত হয় হৃদস্পন্দন। সাহিত্যের বুকের কাছে পাঞ্জাবির অংশ খামচে ধরে।

সুহার দিকে তাকিয়ে ঘোর লেগে যায় সাহিত্যের। মেয়েটাকে দেখলেই আজকাল নিজেকে সামলে রাখতে পারে না সাহিত্য। তার মত শক্ত ব্যাক্তিত্বের একজন দায়িত্বশীল এমপি,সে কিনা এই পুঁচকে মেয়েটার কাছে এসেই বেসামাল হয়ে যায়!! মৃদু হাসে সে। এতেও যে সুখ সুখ লাগে তার।

এক হাতে সুহার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে আনে সাহিত্য। কপালে চুমু দিয়ে বলে,,

:- তোর কারো কথা ভাবতে হবে না। অন্যর জন্য না ভেবে আমাকে নিয়ে ভাব। তাতে লাভ হবে!!

সুহান ঠোঁট উল্টে তাকায় সাহিত্যের দিকে।

:- ওভাবে তাকায় না ফুল!! তাহলে ভুল হয়ে যাবে।

সুহা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাহিত্যের দিকে। সুহার মুখ দেখে ভিষণ হাঁসি পাচ্ছে সাহিত্যের। সুহা আসলেই এখনো অবুঝ। এই যে সাহিত্য তাকে এতো কাছে টানছে। আদরে জড়িয়ে নিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে,তাতে কি কিছুই বুঝতে পারছে না তার বোকা ফুল। অন্য কেউ হলে এতো দিনে ঠিক বুঝতে পারতো তার অনুভূতি।

__________

অনুষ্ঠান শেষে অতিথিরা সবাই এক এক করে বিদায় নেন। মোতালেব হোসেনও বন্ধুর থেকে বিদায় নিয়ে আসে। সাহিত্যের সাথে নিচে আসে সুহা। সাহিত্য গিয়ে আবারো সরি বলে মোতালেব হোসেন কে। সাহিত্যের এমন নমনীয় ব্যবহারে ভিষণ সন্তুষ্ট তিনি। এতো স্বনামধন্য একজন এমপি হয়েও এতটুকু অহংকার নেই মনে। আরো তার মেয়েটাকে সেভ করতে আপন মানুষদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও পিছপা হয়নি ছেলেটি। মোতালেব হোসেন হাসিমুখে বিদায় নেন। মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন মির্জা ম্যানশন থেকে।

যতক্ষণ চোখের আড়াল না হয় সাহিত্য তাকিয়ে রয় তার প্রাণ আঁটকে থাকা রমনীর দিকে। বুকের মধ্যে ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। এইতো কিছুক্ষণ আগেও তার বুকের সাথে লেপ্টে ছিলো মেয়েটা। এখন চলে যেতেই বুকটা খালি খালি লাগে সাহিত্যের। মেয়েটাকে কবে যে নিজের করে পাবে সে। তখন আর কোথাও যেতে দেবে না তাকে ছেড়ে। কখনো যেতে দেবে না।
_________

অতিথিরা সবাই চলে গেছে। এখন শুধু মির্জা পরিবার আর আরুশ,তার বাবা মা আর আরশি রয়ে গেছে। আহাদ মির্জা নিজে শাহেদ খান( আরুশ-আরশির বাবা) কে এখন না যেতে অনুরোধ করেছেন। কি নাকি ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলবেন তিনি।
আরশির মা রত্না খান স্বামীকে ইশারা করে জানতে চাই কি বলতে চায় আহাদ মির্জা? শাহেদ খান ঠোঁট উল্টে তাকায় যার অর্থ তিনিও জানেন না।
লিভিং রুমেই সোফায় বসে আছেন তারা। কিছুক্ষণ পর পুরো মির্জা পরিবার এসে বসেন সেখানে। আরশির বুক টা কেমন ঢিপঢিপ করছে। সে যা সন্দেহ করছে তাই কি ঠিক? মেহরাব স্যারের বাবা মা কি তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাইছে তাদের বেপারে!!
স্যার কি বলে দিয়েছে বাড়িতে তার কথা? মেহরাব স্যারের সাথে তার সম্পর্কের কথা জানলে কি বাবা-মা,ভাই তাকে ভুল বুঝবে যে কলেজে পড়তে গিয়ে স্যারের সাথে প্রেম করেছে সে?? ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে আরশির।

নীরবতা ভেঙে আহাদ মির্জা নিজেই কথা পাড়েন।

:-শাহেদ ভাই! আমাদের দুই ফ্যামিলির চেনা জানা তো অনেক দিনের। আরুশ,মেহরাব যখন সদ্য কলেজে ভর্তি হয়েছে তখন থেকেই তাদের বন্ধুত্ব। সেই কাল থেকেই তো আমাদের কে আপনারা জানেন চেনেন। সেখান থেকেই বন্ধুত্বের একটা সম্পর্ক আমাদের মাঝেও গড়ে উঠেছে আশা করি। কি বলেন?

শাহেদ খান হেসে মাথা নাড়ান। অর্থাৎ হ্যাঁ। আহাদ মির্জা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আবার বলেন,,,

:- তো সেই বন্ধুত্ব থেকেই একটা আবদার করবো আপনার কাছে । আবদার টা অবশ্যই আপনাকে রাখতে হবে।

শাহেদ খান আর রত্না খানের কপালে ভাঁজ পড়ে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না কোন বিষয়ে আবদার করতে চাইছেন আহাদ মির্জা। তাদের মতো বড়লোকদের কি এমন আবদার থাকতে পারে তাদের মত মধ্যবিত্ত মানুষদের কাছে।

আরুশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে। কারন কি নিয়ে কথা হবে সেটা তার জানা। আহাদ মির্জা বলেন,,,

:- ভাই!! মেহরাব কে তো আপনারা সেই উঠতি বয়স থেকেই জানেন। আমি আমার বড় সন্তান মেহরাব মির্জার জন্য আপনার একমাত্র আদরের মিষ্টি কন্যা আরশি মায়ের হাত চাইছি! আশা করি আপনাদের আপত্তি থাকবে না।

এই প্রস্তাব খান দম্পতির কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। হুট করে এমন একটা প্রস্তাব রাখায় অপ্রস্তুত হলো শাহেদ খান এবং রত্না খান ।ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না তাদের কি বলা উচিত।

আরশি চোখ মুখ শক্ত করে কাঠ হয়ে বসে আছে। শাহেদ খান হেসে বলেন,,

:- আসলে ভাই, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না! মানে আমার মেয়ে আরশি আর মেহরাব বাবা! মানে বেপার টা কেমন হয়? মেহরাব বাবা তো শুনেছি আরশির কলেজের স্যার। সেখানে এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠলে তো চারদিক থেকে নানান রকম কথা ছড়াবে। এটা ঠিক কেমন হয়?

মেহরাব বিচলিত হয়। কিছু বলতে নিতেই আহাদ মির্জা ছেলেকে থামিয়ে দেন। বলেন,,

:- শাহেদ ভাই ,ব্যাপারটা সেরকম নয় সেখানে মানুষ কি বলল ইম্পরট্যান্ট না। আপনারা পাত্র হিসেবে মেহেরাবকে চেনেন জানেন। আর আরশি মাকে আমাদের পছন্দ। আমরা চাইছি পারিবারিকভাবেই তাদের চার হাত এক করে আমাদের সম্পর্কটাও মজবুত করতে।এখানে আশেপাশে নিন্দুকের অভাব হবে না। কিন্তু তাদের কথা আমরা ভাবলে চলবে না।

ভাবনায় পড়ে যান শাহেদ খান। সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে সম্মতি আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করেন। রত্না খানকে দেখে বেশ খুশিই মনে হলো। আসলেই পাত্র হিসেবে মেহেরাবকে অপছন্দ করার মতো কিছু নেই। শাহেদ খান ছেলে আরুশের দিকে তাকায়। আরুশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

এতক্ষণে মুখ খোলে সাহিত্য। বলে,,,

:- শাহেদ আঙ্কেল!! আরশি আমার বোনোর মতো্। আমরা আপনার চিন্তাটা বুঝতে পারছি। আমি জানি একজন শিক্ষক আর ছাত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে অনেকে অনেক রকম কথাই ভাবতে পারেন, ছড়াতে পারেন।সে দিক থেকে আমরা ভেবেছি। এই জন্যই চাইছি আরশিকে ভাইয়ার সাথে এনগেজমেন্ট করিয়ে রাখতে। এখন আংটি পরিয়ে রাখলে বিয়েটা না হয় আরশীর পরীক্ষার পরে হবে। তখন তো আরশি কলেজের ছাত্রী ও থাকবে না আর ভাইয়ার স্টুডেন্টও থাকবে না।

সাহিত্যর সিদ্ধান্তটা সবার পছন্দ হয়। শাহেদ খান আর আপত্তি করেন না। তিনি জানান, বাড়িতে গিয়ে একটা ভালো দিন দেখে এনগেজমেন্টের ব্যাপারে কথা বলবেন দুই পরিবার।

আরশি ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা আর লজ্জায় লাল হয়ে বসে আছে। অবশেষে তার পরিবার মেনে নিলো। আর তাকে কোন রকম দোষীও হতে হলোনা। বেশ কায়দা করে প্রস্তাব রেখেছেন মেহরাব স্যার। সম্পর্কের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আড়াল করাতে কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে আরশির চোখ মুখ।

আড় চোখে মেহরাবের দিকে তাকায় আরশি। মেহরাব আগে থেকেই আরশির দিকে তাকিয়ে ছিলো ।আরশি তাকাতেই সবার আড়ালে চোখ টিপ দেয় মেহরাব। দারুন লজ্জায় মুখ নিচু করে আরশি।

To be continue,,,