ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী পর্ব-২৪+২৫

0
111

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,২৪
মৌমো তিতলী

সকাল থেকে মির্জা ম্যানসনে তোড়জোড়। অবশেষে বিয়ের বিয়ের দিন এসেই গেলো। মেহরাব কে বর সাজাতে হেল্প করছে বিয়েতে আসা কিছু রিলেটিভ -সমবয়সী ছেলেরা। বাসরঘর সাজানোর ভার পড়েছিলো সাহিত্য আর তার বন্ধুদের ওপর। কিন্তু কাজটা সিফাত কে একাই করতে হচ্ছে। সাথে অবশ্য কিছু ছেলেপেলে জুটিয়ে নিয়েছে সিফাত।
সাহিত্য অরুদ্ধ কে নিয়ে বেরিয়েছে। শীতলপুরের কপোতাক্ষ নদ পেরিয়ে কয়েকটা গ্রামের পর কুমোর ডাঙ্গা গ্রাম। সেখানে বাচ্চাদের জন্য একটা স্কুল তৈরির কাজ চলছে। সেখানেই আমজাদ তালুকদারের লোকেরা বাঁধা দিয়ে ঝামেলা তৈরি করতে চাইছে। গ্রামের যে সকল লোকেরা স্কুলের জন্য জমি দান করেছিলো তাদেরকে আমজাদ তালুকদারের লোকেরা উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে ভোড়কে দিতে চাইছে।
এখন জমির অনেক দাম। সেখানে চাষবাস করলে তাদের লাভ হতো, ফ্রিতে দান না করে আমজাদ তালুকদারের কাছে বিক্রি করলে তারা অনেক টাকা পাবে। আমজাদ তালুকদার সেখানে ফ্যাক্টরি বানাবে‌। সেখানে স্কুলের বদলে ফ্যাক্টরি হলে এসব কৃষকদের ছেলেরা কাজের সুযোগ পাবে। তারা আর বেকার থাকবে না।
এই ধরনের নানা রকমের প্রলোভন দেখিয়ে স্কুলের জন্য জমি দান না করতে উল্টোপাল্টা বুঝিয়েছে তারা।
গ্রামের সহজ সরল লোকেরা কেউ কেউ তাদের প্রলোভনে পড়ে জমি দিতে অস্বীকার করছে,তো আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ করছে। গ্রামের কিছু উঠতি বয়সের যুবকেরা যারা এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার ভক্ত, তারা সেসব সরল কৃষকদের বোঝানোর চেষ্টা করছে, একটা স্কুল কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে বাচ্চারা বিনা বাধায় পড়তে পারবে। কত বাচ্চারা নদ পেরিয়ে কষ্ট করে পায়ে হেঁটে পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্কুলে যায়। কিছু বাচ্চাদের কপোতাক্ষে ডুবে মরার নজিরও আছে অতীতে। তাছাড়া গ্রামে স্কুল হলে বাচ্চারা চোখের সামনে পড়াশোনা করতে পারবে। তাদেরকে গ্রাম ছেড়ে দূরে যেতে হবে না জ্ঞান অর্জন করতে। শিক্ষা মানুষের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোই তারা বোঝানোর চেষ্টা করছে।
তাতে আবার কিছু কিছু মানুষ বুঝতে পারছে আবার কেউ কেউ দোটানায় পড়ছে।
এমন সময় সাহিত্য সেখানে গিয়ে পৌঁছায়। অরুদ্ধ কে নিয়ে সাহিত্য এগিয়ে যায় সেসব কৃষকদের কাছে। সাহিত্য খুব ধৈর্যের সাথে শিক্ষার গুরুত্ব আর স্কুলের সুফল সম্পর্কে তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করে। এক সময় বোঝাতে সক্ষমও হয়। আমজাদ তালুকদার যে ইচ্ছে করে তাদেরকে এরকম একটা পূণ্যর কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে, লোভ দেখিয়ে একটা নেক কাজ করা থেকে বিরত রাখতে চাইছে, তাদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে, সেটাও সাহিত্য তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়।
কৃষকদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানেই আমজাদ তালুকদার কে গালাগালি শুরু করে। কেউ কেউ সাহিত্যকে এসে বলে,,

:- বাবা আমরা তো নিজেদের ইচ্ছেই স্কুলের জন্য জমি দান করতে চাইছিলাম ।এই আমজাদ তালুকদার, বদ লোকটাই আমাদের মতলব ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলো। আমাদের ভুল হয়েছে বাবা। তুমি এমন একটা পুণ্যের কাজ করতে চাইছো আমাদের গ্রামের বাচ্চাদের কথা ভেবে, আল্লাহ তোমার ভালো করুক।
অরুদ্ধ আড়ালে হাসে এসব গ্রামের সহজ সরল মানুষদের কথা শুনে। গ্রামের মানুষেরা আসলে এতটাই সরল, তাদেরকে সহজেই কেউ যা তা বুঝিয়ে ফেলতে পারে।
স্কুলের কাজ কয়েক দিনের মাঝেই শুরু হবে বলে জানায় সাহিত্য। তার জন্য দলিল পত্র ঠিকঠাক করে, জমি দানকৃত কৃষকদের দস্তখত নিয়ে, সমস্ত কাজ মিটিয়ে উকিলের কাছে হস্তান্তর করে তবেই বাড়িতে ফিরে সাহিত্য।

____________

সুহা আর নিপা বরযাত্রী যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। এরমধ্যে সুহা কয়েকবার জানালা দিয়ে বাইরের গেটের দিকে তাকাচ্ছে। নিপা সেটা খেয়াল করে ঠাট্টা করে বলে,,,

:- আহা কি প্রেম!!

নিপার কথায় ভড়কে যাই সুহা। অপ্রস্তুতি হেসে বলে,,

:- তেমনটা নয়। আসলে অনেকক্ষণ হয়েছে উনি বাইরে। এখনো তো এলেন না।

:- তাই বলে এমন করে বারবার বাইরের দিকে কি দেখছিস?? তোর টার সাথে সাথে তো আমারটাও বাইরে। আমি কি এভাবে তাকাচ্ছি বারবার??

নিপার কথায় বেশ লজ্জা পায় সুহা। সুহা আজ একটা নীল রংয়ের গর্জিয়াস গাউন পড়েছে। সাথে সোনালী রঙের হিজাব। চমৎকার দেখতে লাগছে মেয়েটাকে। নিপা এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে প্রাণের বান্ধবী সুহার দিকে। দুষ্টু হেসে বলে,,,

:- আজকে তোর এমপি সাহেবের সাথে সাথে বিয়ে বাড়িতে কত ছেলের যে মাথা ঘুরিয়ে দিবি! সেটা ভেবেই আমি চিন্তিত হচ্ছি।

সুহা নিপার বাহুতে হালকা চাপড় মেরে বলে,,,

:- ছিঃ এমন কথা বলিস না। উনি থাকতে কেউ আমার দিকে নজর দিতে পারবে বলে তোর মনে হয়?? আর না আমি সেটা চাই। আর আমার কথা কেন বলছিস? তোকেও যে কত সুন্দর লাগছে এই মিষ্টি কালারের ড্রেসটাই। আমাদের অরুদ্ধ ভাইয়া আজ নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাবে। দেখ আবার মেহরাব ভাইয়ার সাথে সাথে সেও তোকে না বিয়ে করে ফেলে আজ।
খিল খিল করে হেসে ওঠে দুই বান্ধবী। তখনই গেট দিয়ে প্রবেশ করে সাহিত্যর গাড়ি। সুহা জানালা দিয়ে সেদিকে তাকায়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠামদেহের অধিকারী এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা।
তার বলিষ্ঠ দেহের প্রতিটা ভাঁজ যেন ফুটে বেরিয়ে আসে ঘেমে লেপ্টে যাওয়া পাঞ্জাবির উপর দিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই রক্তিম হয় সুহার মুখ।

_______

সাহিত্য বাড়িতে ঢুকেই কোন দিকে না তাকিয়ে আগে নিজের রুমে চলে যায়। ওয়াশরুমে ঢুকে টানা ২০ মিনিট গোসল সেরে বাইরে আসে। বাইরে বেশ গরম পড়েছে। গোসল করে কিছুটা সস্তি মেলে। আলমারি থেকে হালকা আকাশী রঙের পাঞ্জাবিটা বের করে গায়ে চড়ায়,সাথে সাদা পাজামা,কালো লোফার স্যু। হাতে কালো বেল্টের ব্র্যান্ডের ঘড়ি। বেশ লম্বা সিল্কি চুলগুলো হেয়ার ড্রাই দিয়ে শুকিয়ে উঁচু করে সেট করে। চোখে বরাবরের মতো সাদা গোল চশমা।
এতেই যেন তাকে কোন রাজ্যের রাজকুমারের থেকে কম লাগছে না। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সাহিত্য। বোঝার চেষ্টা করে তাকে তার পদ্ম ফুলের পাশে ঠিকঠাক মানায় কিনা। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় নক করার শব্দে ঘুরে তাকায় সাহিত্য। কপালে ভাঁজ পড়ে,,
_ কে এলো আবার এখন!!

:-কে???
জোর স্বরে জানতে চাই সাহিত্য। ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসে না। বেশ একটু বিরক্ত হয়ে দরজাটা খুলে দেয় সাহিত্য। দরজাটা খুলতেই দৃশ্যমান হয় অতি স্নিগ্ধ, হৃদয় শীতল করা সুন্দর একটা মুখ। যে মুখটার দিকে তাকিয়ে নির্বিশেষে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতে পারে সাহিত্য। যাকে দেখলেই বুকের বা পাশটা বেসামাল হয়ে তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। সাহিত্যের অজান্তেই তার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বের হয়,,

_ফুল,আমার প্রাণের পদ্মফুল!

কথাটা সাহিত্য অস্ফুট স্বরে বললেও সুহার কানে যায়! দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে মুখ নামিয়ে নেয় সুহা।
সাহিত্যের কাছে তার হৃদয়ের হত্যাকারীনির এই লজ্জায় রাঙ্গা মুখটা রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার মতো লাগে। উজ্জ্বল আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতো তার উত্তাপ। তার উত্তাপে নিষিক্ত হয় এক বেপরোয়া প্রেমিকের হৃদয়। বেহায়া হয় মন। সুহার হাত টেনে রুমে ঢুকিয়ে দরজা ভেজিয়ে দেয়। সুহাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে চুমু দেয় কপালে। অন্তরে প্রশান্তি আসে সাহিত্যের। সুহার মুখটা দুহাতে তুলে বলে,,,

:- বিয়ে বাড়িতে শান্ত হয়ে থাকবে, কোন ছেলের সাথে কথা বলবে না। সারাক্ষণ নিপাকে সাথে নিয়ে থাকবে। ঠিক আছে? আমি আশেপাশেই থাকবো। কোন সমস্যা হলে বা কেউ ডিস্টার্ব করলে সাথে সাথে আমাকে জানাবে। মনে থাকবে?

আদুরে ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে সুহা। আবারো কপালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে সুহার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে সাহিত্যে।
_____

সবগুলো গাড়ি মেহমানদের দ্বারা ভর্তি। সুহার বাবা-মাও এসেছে। তারা আহাদ মির্জার সাথে গাড়িতে বসেছে।
সাহিত্য, অরুদ্ধ, সিফাত, সুহা,নিপা ,নীলিমা বরের গাড়িতে একসাথে বসেছে। নীলিমার মুখে কয়েক স্তরের মেকআপ। মুখের হালকা লাল দাগ তখনও বিদ্যমান। সেটা ঢাকতেই এই মেকাপের প্রলেপ। গাড়িতে বসতে গিয়ে সে অবশ্য চেষ্টা করেছিলো সাহিত্যর পাশে বসতে। কিন্তু সাহিত্য তাকে কোনরকম সুযোগই দেয়নি। সুহাকে হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দিয়েছে আগেই। মুখে কিছু না বললেও প্রতিহিংসায় দগ্ধ হয় নীলিমার অন্তর। মনে মনে ভাবে, শুধু একটা ঠিকঠাক সুযোগ পেলেই বুঝিয়ে দেবে এই ছোটলোক মেয়েটাকে‌ তার জন্যই আজ তার মুখের এই অবস্থা। কখনো ছেড়ে দেবে না সে। সেও এর শেষ দেখে ছাড়বে।

__________

দুপুর দুইটা নাগাদ বরের গাড়ি এসে পৌঁছায় কনের বাড়িতে। বিয়ে বাড়ির জমজমাট। আত্মীয়-স্বজন ভরপুর। বাতাসে নানা রকম মনমুগ্ধকর খাবারের সুগন্ধ ছড়িয়ে আছে। গেট দিয়ে বরের প্রবেশের পথে কনে পক্ষের কিছু মেয়েরা শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ৫০ হাজার টাকার দাবি। সেটা দিলেই ঢুকতে পারবে তারা। এমপি সাহেবের ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। টাকা কম দিলে চলবে না। এমনটাই তাদের দাবি।
সাহিত্য কোন ঝামেলা বাড়াতে চাইলো না। এরপরে আর কোন ফালতু রিচুয়াল যাতে না হয় সে ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দিয়ে, ক্যাশ ৫০ হাজার টাকা বের করে পক্ষের মেয়েদের হাতে দিয়ে দেয়। এমপি সাহেবের মুখের ওপর সাহস করে আর কেউ কিছু বলে না। সেই টাকাটাই মিটিয়ে নেয়।

বিয়েটা কমিউনিটি সেন্টারে হওয়ার প্রস্তাব রাখলেও, দুপক্ষের লোকেরা আলোচনা করে ঠিক করে বিয়েটা গ্রামের বিয়ের মতোই সব রিচ্যুয়াল মেনেই হবে। এভাবে গ্রামীণ বিয়ের মজাটাই আলাদা। পরে রিসিপশন কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করবে বলে ঠিক করা হয়েছে।

_________

বিয়ে বাড়িতে বেশ অনেকক্ষণ ধরে দুটো ছেলে নিপা আর সুহাকে ফলো করছে। সুহা আর নিপা খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে চেয়ার নিয়ে কোলাহল মুক্ত একটা জায়গা দেখে বসে। তখনই সুযোগ পেয়ে ছেলে দুটো তাদের কাছে আসে। একজন সুহাকে উদ্যেশ্য করে বলে,,,

:- হেই সুন্দরী!! কি নাম তোমার?
আকস্মিক অচেনা কন্ঠের প্রশ্ন শুনে ভোড়কে যায় সুহা। সামনের দিকে তাকিয়ে অচেনা দুটো ছেলেকে দেখে আঁতকে ওঠে।
সন্তর্পনে আশেপাশে তাকাই। এমপি সাহেবকে কোথাও দেখতে না পেয়ে ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস করে মেয়েটা।
সুহা কে কথা বলতে না দেখে ছেলেটা আবারও বলে,,,

:-কি ফুলটুসি ভয় পাচ্ছো আমাদের? আরে ভয় পেয়ো না। কি নাম বলো??
সুহাকে কথা বলতে না দেখে নিপা সাহস করে বলে,,

:- দেখতেই তো পারছেন সে আপনাদের সাথে কথা বলতে চাইছে না ।তাহলে বারবার জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

এতক্ষণ যে প্রশ্ন করছিল তার সাথের ছেলেটা এবার নিপা কে উদ্দেশ্য করে বলে,,,

:- বাবা মেয়ের আবার তেজ আছে দেখছি!! শুধু নামই তো জিজ্ঞেস করেছি। তাতেই এত তেজ?

তখনই পাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন ভেসে আসে,,,

:-কি হচ্ছে এখানে??

প্রশ্ন শুনে পাশে তাকিয়ে এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা কে দেখে যেন একটু চমকে উঠলো ছেলেদুটো। সুহা ঘাড় ঘুরিয়ে সাহিত্যর মুখ দেখে আঁতকে ওঠে।সাহিত্যের জ্বলন্ত চোখ দুটো আর শক্ত চোয়ালের মুখ দেখে ঠিক বুঝতে পারে এতক্ষণের ঘটনা কিছুই চোখ এড়ায়নি তার ।

এর মধ্য যে ছেলেটা বারবার সুহাকে নাম জিজ্ঞাসা করছিলো, সেই ছেলেটা আমতা আমতা করে বলল,,

:- আসলে তেমন কিছু নয় স্যার!! মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে। তাই নাম ঠিকানা জানতে চাইছিলাম। বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলছিলো তাই ভাবলাম……

বাকিটা কথাটা আর বলতে পারে না ছেলেটা। তার আগেই সাহিত্যর দানবীয় হাতের একটা থাবা এসে পড়ে ছেলেটার গালে। আচমকা তরুণ এমপির হাতে দাবাং মার্কা চড় খেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় ছেলেটি।
মুহূর্তের সাহিত্য ছেলেটির কলার চেপে ধরে বলে,,,,

:- এই মুহূর্তে মুখে লাগাম দে,, নয়তো তোর জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো।
কাউকে নিয়ে বিয়ে পর্যন্ত ভাবার আগে তার আগে পিছে কেউ আছে কিনা সেটা জেনে নেয়া জরুরী। এতটুকু জ্ঞান নেই? মেয়েটার মতামত আছে কিনা, মেয়েটা আদেও সিঙ্গেল কিনা, সে ম্যারিড কিনা কোন কিছু জানার দরকার পড়ে না??

সুহা গিয়ে সাহিত্যর হাত ছেলেটার কলার থেকে ছাড়িয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে।

ছেলেটার মুখের যেন বুলি ফুরিয়েছে। এতক্ষণে কিছু কিছু মানুষের ভিড়ও জমেছে ছোটখাটো। কনে পক্ষের কিছু ছেলেরা এসে ছেলে দুটো কে টেনে নিয়ে যায়। মুখের উপর দুই একটা কড়া কথাও শুনিয়ে বরপক্ষের মেয়েদেরকে হেনস্তা করার জন্য। এমপি সোহরাবের কাছে ক্ষমা চায় তারা ছেলে দুটোর এহেন ব্যবহারের জন্য।

ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেলে পারতো। কিন্তু ঘটনাটার ফায়দা নিল অন্য কেউ। ছেলে দুটোকে আলাদা জায়গায় ডেকে নিলো নীলিমা। ঠাট্টা করে হেসে জিজ্ঞাসা করলো,,

:- কি ব্যাপার মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছিলো ভাইয়া?

ছেলেটা কিছু না বলে মুখ নামিয়ে নেয়। এমনিতেই ভরা বিয়ে বাড়ির মাঝে এমপির হাতে চড় খেয়ে কিছুটা সম্মানে লেগেছে ছেলেটার। তার উপর নীলিমার প্রশ্ন শুনে যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা পড়েছে। মনে মনে বেশ আক্রোশে ফেটে পড়ে ছেলেটা।
আর সেই আক্রোশ আরেকটু বাড়িয়ে তুলতে নীলিমা বলে,,

:- সামান্য একটা মেয়ের জন্য এমপির হাতে হেনস্থা হলেন। মেয়েটা কে? এমপির সাথে তার কি সম্পর্ক? তার জন্য এমপি এতটা রিঅ্যাক্ট করলো কেন? প্রশ্ন আসেনি আপনাদের মনে?

ছেলে দুটো অবাক হয়ে তাকায় নীলিমার দিকে। আসলেই তো !! তারা তো শুধু নামটাই জিজ্ঞাসা করেছিল তাতে এতটা রিঅ্যাক্ট করলো কেন এমপি সোহরাব!!

নীলিমা নিচু গলায় বলল,,

:- মেয়েটা এমপি সাহেবের রক্ষিতা। বিয়ে উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে তো বাড়িতেই এনে রেখেছে। একজন রক্ষিতা মেয়ের জন্য এতটা হেনস্থা হলেন, এরকম একটা সরগরম খবর আপনারা চেপে যাবেন?

ছেলে দুটো যেন আকাশ থেকে পড়লো। তরুণ এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার এরকম একটা সাইট আছে, তার চরিত্রে কোন সমস্যা আছে এমন তো কোন নজির তারা কখনো শোনেনি। এমনিতেই সাহিত্যর হাতে চড় খেয়ে অপমানিত হয়েছিলো ছেলেটা। তার উপরে এরকম একটা খবর পেয়ে যেন ফুঁসে উঠলো। নীলিমার উস্কানিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দিলো ঘটনাটা ।ক্যাপশনে লিখলো,,

“নিজের ভাইয়ের বিয়েতে,, কোনে পক্ষের সাথে রক্ষিতাকে ঘিরে হলো এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার ঝামেলা”

আবার কয়েকটা পোস্টে লিখলো “এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার গোপন কুকীর্তি ফাঁস”

নিউজের এভিডেন্স হিসেবে নীলিমা কিছু ছবি তাদেরকে দিলো। যে সকল ছবিতে সাহিত্য আর সুহা অনেকটাই কাছাকাছি। এমনকি সকালে সুহাকে নিজের রুমে নিয়ে দরজা দিচ্ছে এমন একটা ছবিও তার মধ্যে দেখা গেলো।

ছেলেগুলো সেখান থেকে যেতেই মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠল নীলিমার। নিউজ টা কেবল ভাইরাল হওয়ার অপেক্ষা। তারপর সোহরাবের রেপুটেশনের বারোটা বেজে যাবে। সাথে নাকের জল চোখের জল এক হবে ছোটলোক মেয়েটার। চরিত্রে কলঙ্ক নিয়ে কতদিন বেঁচে থাকে সেও দেখবে।
______

মেহরাব আরশির বিয়েটা পরবর্তীতে নির্বিবাদেই হয়ে গেল। কনে বিদায় হলো। সকলে মিলে নতুন বউকে নিয়ে ফিরে এলো মির্জা মেনসনে। নতুন বউকে নিয়ে আনন্দের ঢেউ মির্জা বাড়িতে। কেউ জানতেও পারলো না আগামীকাল কি বিপদ ধেয়ে আসছে তাদের দিকে।

বিয়ের সমস্ত রিচ্যুয়াল শেষ করতেই রাত ১১ টা। খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে ,বর বউকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে যে যার মতো নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আগামীকাল রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে। অনেক ধকল যাবে তাই সকলেরই বিশ্রামের প্রয়োজন।

________

ফুলে ফুলে মোড়ানো বিছানায় আধ হাত ঘোমটা টেনে বসে আছে আরশি। গাঢ় লাল রংয়ের ভারী লেহাঙ্গা আর জুয়েলারিতে পুতুলের মত লাগছে আরশিকে।

মেহেরাব রুমে ঢুকে অপলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার সদ্য বিবাহিত প্রেয়সীর দিকে। আস্তে করে গিয়ে বসে আরশির পাশে। বুকের ভিতর দুরু দুরু। তার স্বপ্ন, তার প্রেম, তার ভালবাসা আজ পার্মানেন্টলি তার ঘরে তার হালাল স্ত্রী হিসেবে। ভাবতেই শির দাঁড়া বেয়ে অনুভূতির ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় মেহরাবের। এদিকে অনুভূতির জোয়ারে কাঁপছে আরশি। কলেজের গুরু গম্ভীর রাগী স্যার,, তার পাগল প্রেমিক প্রিয়তম আজ তার স্বামী। আজকের মত খুশি আরশি আর কখনোই হয়নি।
মেহরাব আলতো করে আরশির মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে দেয়। দুই হাতের আঁযলে আরশির মুখটা উঁচু করে ধরে বলে,,,

:- মাশাআল্লাহ!! বলেই কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। এতোটুকু ছোঁয়ায় শিউরে ওঠে আরশি।
মৃদু হাসি খেলে যায় মেহরাবের ঠোঁটে।
আরশি সালাম দেয় তার সদ্য বিবাহিত প্রিয়তম স্বামীকে।

মেহরাব সালামের উত্তর দিয়ে বলে,,,

:- উঠে এসো। এই কাপড় চেঞ্জ করে অজু করে এসো দুজনে একসাথে নামাজ পড়বো। আমাদের দুজনের ভালোবাসাময় সংসার না হয় সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শুরু করা যাক।
আরশিও উঠে এসে লাগেজ থেকে একটা খয়রি রঙের সুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। প্রায় ৩০ মিনিট পর বিয়ের সাজ ছেড়ে শাড়ি পরে অজু করে বেরিয়ে আসে।
মেহরাবও শেরওয়ানি চেঞ্জ করে একটা কালো ট্রাউজার আর এ্যাশ কালারের পাতলা টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে অজু করে আসে। দুজন একসাথে নামাজ পড়ে।

আরশি গিয়ে বিছানায় বসতেই মেহরাব ছোট্ট একটা প্যাকেট নিয়ে এসে বসে স্ত্রীর পাশে। প্যাকেটটা থেকে একটা মোটা ইনভেলাপ বের করে আরশির হাতে দেয়। বলে,,

:- এতে তোমার দেনমোহরের টাকা আছে। এটা তোমার হক! তুমি নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করতে পারো।
আরশি হাত বাড়িয়ে মেহরাবের হাত থেকে ইনভেলাপটা নেয়। মেহরাব প্যাকেটটা থেকে কিছু স্বর্ণের জিনিস বের করে আরশির সামনে মেলে ধরে। সেখান থেকে দুটো ছোট কানের দুল বের করে আরশির কানে পরিয়ে দেয়,, সুন্দর ডিজাইনের সিম্পল দুটো চুড়ি পরিয়ে দেয় আরশির হাতে, একটা ছোট্ট ডায়মন্ডের রিং পরিয়ে দেয় আরশির অনামিকায়। গলায় একটা চিকন চেইন পরিয়ে দেয়। তাতেও একটা সুন্দর লাভ শেপের লকেট ভেতরে এ ইংরেজি বর্ণমালার এ আর এম একসাথে জড়িয়ে লেখা। এটা বেশ পছন্দ হয় আরশির।
আরশি জিজ্ঞাসিত চোখে মেহরাবের দিকে তাকালে মেহরাব হেসে বলে,,,

:- আমার চাকরিতে জয়েন করার পর থেকে প্রত্যেকবার স্যালারি থেকে টাকা জমিয়ে তোমার জন্য বানিয়ে রেখেছিলাম.. অপেক্ষা করেছিলাম আজকের দিনের জন্য।
তোমার পছন্দ হয়েছে?? আবেগে মিষ্টি হেসে মেহেরাবকে জড়িয়ে ধরে আরশি। মেহরাবও পরম আদরে জড়িয়ে নেয় প্রিয়তমাকে।
অন্তরে প্রশান্তির বাতাস বয় আরশির। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই মানুষটাকে তার জীবনে এনে দেয়ার জন্য। এতটা ভালোবাসে মানুষটা তাকে। সেও যে তাকে ভালোবাসে জীবনের থেকেও বেশি।

মেহরাব উঠে গিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে হালকা বেগুনি রঙের ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। তারপর বিছানায় এসে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। অনেক ধকল গেছে আজ। পাশ থেকে হেচকা টানে আরশি কে এনে ফেলে বুকের উপর।কানে কানে ফিসফিস করে বলে,,,

:- এখন থেকে এখানেই ঘুমানোর অভ্যাস করো জান। এখন থেকে এটাই তোমার জায়গা!!
আজ অনেক ক্লান্ত। কাল আবার রিসেপশনের অনুষ্ঠান আছে। ঘুমিয়ে পড়ো। নয়তো তোমার লস।

মেহরাবের কথার মানে বুঝতে পেরে লজ্জায় রক্তিম হয় আরশির মুখ‌। সেও মেহরাবের বুকে মুখ গুজে ফটাফট চোখ বন্ধ করে। দুটো মানুষ ভালোবাসার হালাল আলিঙ্গনে ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।

চলবে,,,,

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,২৫
মৌমো তিতলী

পূর্ব আকাশে মাত্রই উদিত হয়েছে গাঢ় কমলা রঙের রবি।
ছিমছাম রুমটাই জানালায় লাগানো ফিনফিনে সাদা পর্দা হালকা বাতাসে ফুরফুর করে উড়ছে। বিছানায় উপুড় হয়ে কোমর অব্দি সাদা চাদর টেনে ঘুমে আচ্ছন্ন এক সুদর্শন।
হঠাৎই কোথা থেকে চেঁচামেচির শব্দ সেই সুদর্শনের কানে এসে ধাক্কা খায়। কপাল কুঁচকে যায়।মস্তিষ্ক সজাগ হয়। পুরোপুরি ঘুম ছুটলেই পরিচিত কারোর কান্নার আওয়াজ কানে ভেসে আসে। সেই পরিচিত কন্ঠ তার অতি পরিচিত। হুট করেই হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠে বসে সাহিত্যে। মাথাটা হ্যাং হয়ে আছে। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে কান সজাগ করে সাহিত্য।
নিচ থেকে সুহার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে না!!
বুকের ভেতর ধক করে ওঠে সাহিত্যের। এতো সকালে সুহা এভাবে কাঁদছে কেনো?? আর কিছু ভাবতে পারে না সাহিত্য। ছুটে বেরিয়ে আসে নিজের ঘর থেকে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতেই চোখে পড়ে তার পুরো পরিবার ড্রয়িং রুমে উপস্থিত। সুহার বাবা মাকেও দেখা যাচ্ছে। অরুদ্ধ,সিফাতও আছে। ভ্রু কুঁচকে আসে সাহিত্যের। সকাল সকাল পুরো পল্টন এখানে হাজির হয়েছে কেনো? রিসেপশনের অনুষ্ঠান বলেই কি? তাহলে সুহা এমন মরা কান্না জুড়েছে কেনো। হচ্ছে টা কি এসব??
মুহুর্তেই সদর দরজা ধাক্কাধাক্কির শব্দ আসে। বাইরে থেকে কারা যেন চিৎকার করে বলছে,,

:- আপনারা এভাবে দরজা বন্ধ করে থাকতে পারেন না। প্লিজ আমাদের এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার সাথে কথা বলতে দিন।

আবার কেউ চিল্লিয়ে নিউজ কভার করছেন,,

“আপনারা দেখতেই পারছেন এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা আমাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেননি। তারা দরজা বন্ধ করে আছেন। কেন?
তার মানে কি ঘটনাটা সত্যি? এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার রক্ষিতা কি এখনো এই বাড়িতেই উপস্থিত আছেন?? তার কুকীর্তি মিডিয়ার সামনে ফাঁস হয়ে যাবে বলে দরজা খুলছেন না তরুণ এমপি?? জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
আপনারা দেখছেন বাংলা নিউজ সাথে আমি আছি…….”

নিউজের কথাগুলো কানে আসতেই আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদছে সুহা।
বাইরে থেকে এসব কথার আওয়াজ শুনে যেন তাজ্জব বনে গেছে সাহিত্য। যা কিছুই হোক ঘটনার সাথে যে সে আর সুহা জড়িত সেটা এতক্ষণে বুঝে গেছে সে।
তখনই অরুদ্ধের চোখে পড়ে সাহিত্য কে। অরুদ্ধ বলে,,,

:- ওইতো সাহিত্য।
বাড়ির সকলে সাহিত্যের দিকে ঘুরে তাকায়। সাহিত্যকে এভাবে থমকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আয়েশা সিদ্দিকা মুখে কাপড় চেপে ধরে কেঁদে ওঠেন। অরুদ্ধ দ্রুত সাহিত্যের দিকে এগিয়ে যায়। বলে,,,

:-তুই জানিস না কি হয়েছে সাহিত্য!! নিউ চ্যানেলে ভীষণ বাজে কথা ছড়াচ্ছে তোকে আর সুহাকে নিয়ে। ফোন বের করে সাহিত্যের সামনে মেলে ধরে অরুদ্ধ।

সাহিত্যর চোখের সামনে একে একে ক্যাপশন আর ছবিগুলো সহ সামনে আসতে থাকে নিউজের বলা প্রত্যেকটা কথা। চোয়াল শক্ত হয় সাহিত্যর। চোখ তুলে তাকায় সুহার দিকে। তাহিরা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর সুহা মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে সাহিত্যর। কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ একদম ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
সহ্য হয়না তরুন এমপির। অসহনীয় চিনচিনে ব্যথা হয় বুকের বাঁ পাশে।
পাশেই সোফায় মাথার নিচু করে বসে আছে সুহার বাবা মোতালেব হোসেন। ফুলের মত মেয়ের চরিত্রে রক্ষিতার মতো জঘন্য কলঙ্ক লেপ্টাতে দেখে পিতৃহৃদয় আজ ভঙ্গুর। শ্বাস নিতেও যেন কষ্ট হচ্ছে মোতালেব হোসেনের। কি হয়ে গেল তার মেয়ের জীবনে!! এতটুকু বয়সে এত বড় একটা জঘন্য অপবাদ, এত জঘন্য কলঙ্ক সে সারা জীবন কিভাবে বয়ে বেড়াবে? এই সমাজ কি তাকে সুস্থভাবে আর কখনো বাঁচতে দেবে?
এমন নয় যে নিউজের কথাগুলো তিনি বিশ্বাস করেছেন। তিনি মেয়েকে চেনেন। নিজের আদর্শে বড় করেছেন মেয়েকে। তিনি এতোটুকু বুঝতে পেরেছেন সোহরাব সাহিত্য মির্জার রাজনৈতিক জীবনে কলঙ্কের দাগ ফেলতেই কেউ তার ফুলের মত মেয়েকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তিনি অসহায় মেয়ের বাবা। আমাদের সমাজ সত্যি-মিথ্যে যাচায় করে দেখে না।সেটা জানার চেষ্টাও করবে না তারা। মেয়েটাকেই দোষারোপ করবে। তার দিকেই কালি ছুড়বে। তার দিকে আঙ্গুল তুলে তাকে কলঙ্কিত করবে। বুকে চাপ অনুভব করেন অসহায় পিতা।

আহাদ মির্জা ছেলেকে দেখেই এগিয়ে আসেন। জানতে চান,,

:- এসব কি সাহিত্য? নিউজে এগুলো কিসের ছবি দেখাচ্ছে? কাল বিয়ে বাড়িতে কি ঘটেছিলো ?আর এইসব নিউজই বা কেন ছড়াচ্ছে?
বাবার প্রশ্নে চোখ তুলে তাকাই সাহিত্য। শান্ত কন্ঠে বলে,,

:- এসব মিথ্যে রটনা বাবা। এতটুকু ভরসা,বিশ্বাস করো তো আমাকে?
আহাদ মির্জার সাথে সাথে বলেন,,

:- অবশ্যই বিশ্বাস করি। আমার ছেলে কখনো কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন সেটা নয়। প্রশ্ন সুহা মা কে নিয়ে। মেয়েটার জীবনে কি বিরুপ প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছো? কিন্তু ঘটনাটা কি ঘটেছে সেটাই তো আমরা জানি না।
সাহিত্য আবার বলে,,

:- ঘটনাটা কি ঘটেছে সেটা আমি হয়তো কিছুটা বুঝতে পারছি!
সাহিত্য এগিয়ে যাই সুহার বাবার কাছে। মোতালেব হোসেনের পায়ের কাছে হাটু মুড়ে বসে সাহিত্য। সুহার বাবার হাত দুটো নিজের হাতের ভাজে তুলে নিয়ে কাতর কণ্ঠে বলে,,

:- আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন তো আঙ্কেল??

অসহায় চাহনিতে চোখ তুলে তাকাই সুহার বাবা। বৃদ্ধ ভদ্রলোকের চোখে পানি টলমল করছে। সাহিত্য সেই টলটলে চোখে বিশ্বাসের ছায়া দেখতে পায়। এতোটুকু ভরসা নিয়েই সাহিত্য বলে,,

:- আমি কথা দিচ্ছি আঙ্কেল!! আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত আমি সুহার গায়ে কোন কলঙ্ক লাগতে দেবো না। যেটা ঘটেছে সেটার যথাযথ সমাধান আমি করবো ।আমাকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় দিন আপনারা।

নিজের বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,,

:- আঙ্কেল-আন্টি আর সুহা কে এই বাড়িতেই রেখো বাবা। এখন এনাদের বাইরে যেতে দেয়া ঠিক হবে না। বাইরে গেলে মানুষের কটুক্তি শুনতে হবে। তার থেকে এ বাড়িতেই থাকুক।সুহার দিকে কিছুক্ষণ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,,

:-আমি আসছি!!
বাইরে বেরোতে উদ্যোত্ব হলে আয়েশা সিদ্দিকা তাড়াহুড়ো করে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলেন,,

:- আব্বা এই বিপদের মধ্যে তুই বাইরে কোথায় যাবি?

সাহিত্য মায়ের কথার জবাবে বলে,,

:- শুধু আমাকে নিয়ে কিছু হলে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিলো মা।এখানে সুহার জীবন জড়িয়ে আছে। আমি বেঁচে থাকতে সহার গায়ে কোন ফুলের টোকাও সহ্য করবো না। সেখানে এত বড় একটা মিথ্যে অপবাদ ওর উপরে এসে পড়বে আর আমি বাড়িতে বসে থাকবো, এটা কি কখনো সম্ভব ছিলো মা??

আয়েশা সিদ্দিকা বোঝেন ছেলের ভেতরের কষ্ট,অস্থিরতা।
সাহিত্য ফোন বের করে পুলিশ ফোর্স কে আদেশ দেয় মিডিয়ার লোকদের সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে। সে এখন কাউকে কোনো কৈফিয়ত দিবে না। অরুদ্ধ আর সিফাতকে গতকাল বিয়ে বাড়ির ঘটনাটা বলে। ছেলে দুটোকে তুলতে বলে। বাকি কথা ওদের থেকেই শোনা যাবে।
সাহিত্যের কথামতো কাজে লেগে পরে অরুদ্ধ আর সিফাত।
সাহিত্যও রুমে এসে ওয়াশ রুমে ঢোকে। গোসল সেরে একেবারে রেডি হয়ে নিচে আসে। দেখতে পায় সুহা তখনও ফুলে ফুলে কাঁদছে। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে নিজে নিজে কিছু বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।
এদিকে সুহা হতভম্ব হয়ে সাহিত্য যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে,, কি নিষ্ঠুর পাষাণ লোক!! সবাইকে সান্ত্বনা দিলো। আর যাকে নিয়ে এত কিছু, দেখলো সে কাঁদছে তবুও তাকে কিছু বললো না। সেতো এমপি সাহেবকে বিশ্বাস করে।

__________

নিজের ঘরের দরজা আটকে একপ্রকার নাগিন ডান্স দিচ্ছে নীলিমা। মনে মনে ভাবে,,
_আচ্ছা জব্দ হয়েছে মেয়েটা। এরপর লজ্জা থাকলে আর সোহরাবের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না। তার সাথে,, এই সুন্দরী মডান নীলিমার সাথে টেক্কা নেয়া?? ছোটলোক মেয়ে কোথাকার!! ওর জায়গা সোহরাবের পাশে না। ওর জায়গাটা যেখানে সেটাই ওকে দেখিয়ে দিতে পেরে যেনো আকাশে উড়ছে নীলিমা।

_____

নিজের ঘরে থমথমে মুখে বসে আছে আরশি। আজ রিসিপশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এই মুহূর্তে কারোর মন মানসিকতা কোন অনুষ্ঠান পালন করার মত নেই। নতুন শ্বশুরবাড়িতে এক রাত কাটতেই না কাটতেই এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে ভাবতে পারিনি আরশি।

মেহরাব রুমে ঢুকে আরশির থমথমে মুখ দেখে তার পাশে গিয়ে বসে। আরশির মুখে আলতো করে হাত রেখে বলে,,

:- আই এম সরি আরশি। আমি জানি তোমার খারাপ লাগছে। আজ আমাদের রিসিপশনের অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এরকম একটা পরিস্থিতি হবে বুঝতে পারিনি। তুমি মন খারাপ করো না প্লিজ!!

আরশি অবাক হয়ে মেহরাবের মুখের দিকে তাকায়। থমথমে গলায় বলে,,,

:- আপনি আমাকে এই চিনেছেন স্যার?? হ্যাঁ খারাপ তো আমার লাগছে। কিন্তু সেটা মোটেও আমার রিসিপশন অনুষ্ঠিত না হওয়ার জন্য নয়। খারাপ লাগছে সুহা মেয়েটার জন্য। কি মিষ্টি মেয়েটা। আর এরকম একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে।
স্যার আমি জানি রাজনৈতিক পরিবারে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটতে পারে ।একজন জনপ্রিয় নেতাকে ছোট করার জন্য , তার চরিত্রে কালি লেপন এর জন্য শত্রুর অভাব হয় না। আমি জানি সাহিত্য ভাইয়া ঠিক সামলে নেবে। শুধু খারাপ লাগছে সুহার জন্য। মেয়েটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে।

মেহরাবের অন্তর প্রশান্তিতে ছেঁয়ে যাই। সহধর্মিনী প্রিয়তমার চিন্তা ধারা দেখে মনে মনে গর্বিত হয় মেহরাব। সে ভুল কাউকে ভালোবাসে নি। ভুল কাউকে জীবনসঙ্গিনী করেনি। মৃদু হেসে আরশিকে আলতো করে বুকে টেনে নেয় মেহরাব।

__________

“গতকালের বিয়ে বাড়িতে ঝামেলা করে মিথ্যা নিউজ আপলোড করা ছেলে দুটোকে ধরে আনা হয়েছে স্যার”

ছিপছিপে গড়নের একটা ছেলে এসে খবর দেয় সাহিত্যকে।
খবরটা শুনেই পাশ থেকে একটা চার, পাঁচ হাত লম্বা লোহার রড টেনে নিয়ে কাঙ্খিত ঘরটার দিকে এগিয়ে যায় সাহিত্য।
কালকের ছেলে দুটোকে হাতমুখ বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সাহিত্য লোহার রডটা শান বাঁধানো মেঝেতে ঘষতে ঘষতে এগিয়ে যায় ছেলে দুটোর দিকে। ছেলে দুটোর আতঙ্কিত দৃষ্টি সাহিত্যর হাতের লোহার রডের অগ্রভাগ মেঝের সাথে প্রবল ভাবে ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন হওয়া আগুনের স্ফুলিঙ্গের দিকে।

সাহিত্য নিজের বাম হাত দ্বারা ঘাড় ঘষে। মাথাটা এদিক ওদিক নেড়ে নেয়। তারপর ধপ করে ছেলে দুটো সামনে বসে। অতি শান্ত কন্ঠে বলে,,

:- কার কথায় কাজটা করেছিস? আর এই ছবিগুলো কে দিয়েছে তোদের কে?

ছেলে দুটো কথা না বলতে পেরে আতঙ্কে মাথা নাড়াতে থাকে

:-দেখ যদি জানে বেঁচে থাকতে চাস তাহলে সত্যিটা বল। আমি জানি এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর কু বুদ্ধি তোদের মাথা থেকে আসেনি। তাই নিজেদেরকে বাঁচাতে চাইলে আসল কার্লপীট কে তার নামটা আমাকে বলে দে। তোরা ওপরের এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা কে চিনিস। কিন্তু আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া SSM কে চিনিস না।

সাহিত্যের কথা শুনে আর তার মুখে SSM এর নাম শুনে আঁতকে ওঠে ছেলে দুটো। সাহিত্যই যে দেশের আতংকের আরেক নাম সেটা সকলেরই অজানা। অকষ্মিক তার লুকায়িত পরিচয় সামনে দেখে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলার উপক্রম হয় ছেলে দুটোর।

সাহিত্য আবারো বলে ,,

:-সোহরাব সাহিত্য মির্জার চরিত্রে কালি লেপন করার অধিকার কারোর নেই। আর না তার পদ্ম ফুলের চরিত্রে কালি ছেটানোর অধিকার আছে। আমার পদ্ম ফুলের দিকে চোখ তুলে তাকানোর অধিকারটাও আমি কাউকে দিইনি। সেখানে তাকে নিয়ে এত বড় একটা কুৎসিত জঘন্য অপবাদ ছুড়ে দিয়েছিস তোরা। তার চোখে অশ্রু ঝরিয়েছিস।
ইচ্ছে তো করছে তোদের দুইজনকে জীবিত ঝুলিয়ে রেখে চামড়া গুলো টেনে টেনে ছিলে নিতে,, জিভ টেনে ছিড়ে দিতে, চোখ দুটো এই লোহার রড দিয়ে খুঁচিয়ে বের করে নিতে।
কিন্তু আমার তোদেরকে না আসল অপরাধী কে চাই। তাই ভালোই ভালোই সবটা খুলে বল।

ছেলে দুটো দ্রুত মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে মুখের কাপড়টা খুলে দিতে। সাহিত্য পাশের একজন গার্ডকে ইশারা করে কাপড়টা খুলে দিতে। গার্ড এসে কাপড় খুলে দিতেই ছেলে দুটো গড়গড় করে সব সত্যি কথা উগরে দেয়।
জানিয়ে দেয় একটা মেয়ের কথা মতো এগুলো করেছে তারা। এইসব ছবিগুলো ওই মেয়েটাই তাদেরকে দিয়েছে। তাছাড়া এরকম কোন কিছু করার চিন্তা তাদের মাথাতেও আসেনি আগে। সাহিত্যর কাছে অপমানিত হয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে সুযোগ পেয়ে কাজটা করে ফেলেছে তারা।

ছেলে দুটের প্রত্যেকটা স্বীকারোক্তি ভিডিও রেকর্ড করে সাহিত্য। তারপর ফোন থেকে একটা ছবি বের করে ছেলে দুটোর সামনে ধরে জিজ্ঞাসা করে,,

:- ভালো করে দেখে বল এই মেয়েটাই ছিলো কি??

ছেলে দুটো ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত মাথা নাড়াই। অর্থাৎ হ্যাঁ।

উঠে দাঁড়ায় সাহিত্য। আবারও তার সন্দেহ সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। এই সবকিছুর পেছনে একমাত্র নীলিমা দায়ী। ঘর শত্রু বিভীষণ। তা আবারো প্রমাণিত হলো।মেয়েটার এখনো পর্যন্ত শিক্ষা হয়নি দেখছি। এবার একটা পার্মানেন্ট শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

সাহিত্যকে চলে যেতে দেখে ছেলে দুটো কাকুতি মিনতি করে বলে ,,,

:-স্যার এবার তো আমাদের ছেড়ে দিন। আমরা তো সব সত্যি কথা বলে দিয়েছি।

সাহিত্য পেছনে ফিরে না তাকিয়েই বলে,,,

:- SSM এর পরিচয় পেয়ে তার আজাব ঘরে একবার যে অপরাধী ঢোকে,, সে আর কখনো দুনিয়ার আলো দেখতে পায় না। আর তোরা তো আমার পদ্ম ফুলের চোখে অশ্রু ঝরিয়েছিস। তার নামে মিথ্যে কলঙ্কের অপবাদ দিয়েছিস।
প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে একটা ফুলের মত মেয়ের জীবন বিষাক্ত করেছিস। তোদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।
সাহিত্য গার্ডদের ইশারা করে বেরিয়ে আসে। বাকি কাজটা তার গার্ডেরাই করে দেবে। গুদাম ঘর থেকে বেরোতে বেরোতেই পেছনে ছেলে দুটোর গগন বিদারী চিৎকার ভেসে আসে কানে।

______

সন্ধ্যায় আবারো মির্জা ম্যানসনের লিভিং রুমে জড়ো হয়েছে সবাই। সাহিত্যই ডেকেছে তাদের। সাথে কিছু মিডিয়ার লোকদেরকেও ডাকা হয়েছে। তাদেরকে সসম্মানে বসিয়ে রাখা হয়েছে সোফায়। তাদের পাশে কিছু পুলিশ ফোর্স, মহিলা পুলিশদেরকেও দেখা যাচ্ছে। অথচ যার কথায় এত আয়োজন তারই এখনো খোজ নেই। প্রায় ২০ মিনিট পর দেখা মিলল সাহিত্যর। অরুদ্ধ আর সিফাত এসে প্রজেক্টর সেট করে দেয়।

সাহিত্য আসার সাথে সাথেই আহাদ মির্জা জিজ্ঞাসা করেন,,

:- ঘটনাটা কি সাহিত্য? এভাবে সবাইকে এখানে ডেকে জড়ো করলে!!

সাহিত্য মৃদু হেসে জবাব দেয়,,

:-ঘটনার কিছুই নয় বাবা। আজ আমরা সবাই মিলে একটা নাটক দেখবো।

:- কি বলছো নাটক মানে??

মিডিয়ার লোকেরাও প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সাহিত্যর দিকে,,,

:- মিস্টার সোহরাব সাহিত্য মির্জা!! আপনি এগুলো কি বলছেন? আমাদের সময়ের যথেষ্ট মূল্য আছে। আপনি এখানে আমাদেরকে ডেকে আসল কথা না বলে এখন নাটক দেখার কথা বলছেন??

সাহিত্য তাচ্ছিল্য হেসে বলে,,

:- সে আমি জানি আপনাদের সময়ের মূল্য একটু বেশিই। এতটাই বেশি যে কোন একটা নিউজ হাতে পেলেই সেটা সত্যি না মিথ্যা বাঁছ বিচার না করেই,, বরং মশলা মাখিয়ে গরম গরম করে তা পরিবেশন করার কাজে লেগে পড়েন। এতটাই সময়ের মূল্য আপনাদের।
সাহিত্যর কথায় কিছুটা অপমানিত বোধ করে মিডিয়ার লোকটা। অগত্যা চুপ করে থাকেন।

সাহিত্য সবাইকে চুপ করতে বলে প্রজেক্টরটা চালু করে দেয়। লিভিং রুমে অবস্থিত প্রত্যেকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রজেক্টর এর দিকে।
এদিকে অকারণেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে নীলিমার। কি করতে চাইছে সোহরাব? সে কি সত্যিটা বের করে ফেললো ?ধরা পড়ে যাবে না তো নীলিমা? সাহিত্যকে হালকা ভাবে নিয়ে সে মোটেও ঠিক করেনি। ভীষণই ধুরন্ধর চালাক এই সাহিত্য। তার সাথে পাঙ্গা নেয়াটা মনে হয় ঠিক হয়নি তার। এভাবে কাঁচা গুটি নিয়ে মাঠে নামার জন্য মনে মনে নিজেকে কোঁচতে থাকে নীলিমা।

মুহূর্তে প্রজেক্টরে দুটো ছেলের মুখ ভেসে ওঠে। ছেলে দুটোকে দেখেই নীলিমার হাটু ভেঙে আসার উপক্রম হয়। ফাটাফাটা চোখে সে তাকিয়ে থাকে প্রজেক্টর এর দিকে। এতো সেই ছেলে দুটোই, যাদেরকে দিয়ে গতকাল নীলিমা সাহিত্য আর সুহা কে নিয়ে এই মিথ্যে নিউজটা ছড়িয়েছে।
কপালে চিকন ঘাম দেখা দেয় নীলিমার। হাতে হাত রেখে অস্থিরভাবে কচলাতে থাকে সে।
এদিকে সবার আড়ালেই নীলিমার দিকে নজর রেখেছে সাহিত্য। নীলিমার অস্থিরতা দেখে মুখে ক্রুড় হাসি ফুটে ওঠে তার।

এক এক করে ছেলে দুটোর সকল স্বীকারোক্তি প্রকাশিত হয়। লিভিং রুমের প্রত্যেকটা মানুষ তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে প্রজেক্টর এর দিকে। ছেলে দুটোর স্বীকারোক্তি শেষ হতেই সকলের নজর যায় নীলিমার দিকে। সবার এমন ঘৃণিত নজরে কুকড়ে যায় নীলিমা।
সব থেকে বেশি শকড হয়েছেন শেফালী বেগম নিজে। তার মেয়ে এতটা নিচে নেমে গেছে! এতটা অধঃপতন হয়েছে তার মেয়ের যে, সে নিজে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের জীবনে এরকম একটা জঘন্য কুৎসিত কলঙ্ক ছুড়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি, এত হিংসা? এত ময়লা তার মনে? কার সঙ্গ দোষে তার মেয়েটার এতো অধঃপতন হলো? মা হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে শেফালী বেগমের। তিনি ধপ করে বসে পড়েন সোফায়। মাকে এভাবে বসে পড়তে দেখে নীলিমা ছুটে এসে মাকে ধরতে গেলেই হাত তুলে থামিয়ে দেন শেফালী বেগম।

এরই মাঝে সুহা একটা দুঃসাহসিক কাজ করে বসে। হুট করে নীলিমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ঠাস করে নীলিমার গালে চড় বসিয়ে দেয় সুহা।
সুহার হাতে চড় খেয়ে, নিজের অপরাধ এবং স্থান-কাল পাত্র ভুলে রেগে নীলিমা সুহাকে পাল্টা চড় মারতে গেলে আবারো একটা দানবীয় হাতের থাপ্পড় এসে পড়ে নীলিমার গালে।

এবারের চড়টা আহাদ মির্জা স্বয়ং এসে মেরেছে ভাগ্নির গালে। বয়স হয়েছেন তাই শান্ত হয়ে থাকেন তিনি। নয়তো তিনিও ছেলেদের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না যুবক বয়সে। এখনো শরীর থেকে পাঞ্জাবি সরালে শরীরের মাংসপেশিগুলো ফুলে থাকার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় সহজেই ।শরীরের শক্তির ক্ষিণ অবনতি হলেও একেবারে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েন নি তিনি। বেশ জোরেশোরেই থাপ্পড়টা মেরেছেন ভাগ্নির গালে। ক্রোধে থর থর করে কাঁপছেন তিনি।

:- তোমার উদ্ধ্যত্ব দেখে অবাক হচ্ছি আমি। এত বড় একটা জঘন্য অপরাধ করার পরেও তুমি আবার সুহার গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছো। সুহার কাছ থেকে চড়টা তোমার প্রাপ্য ছিলো ।সে নরম মেয়ে বলে তোমাকে একটা থাপ্পড় মেরেছে। ওর জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে তোমাকে চড় মারতে মারতে গাল ফাটিয়ে দিতো।
আর আমি কিনা কারোর মতামতের তোয়াক্কা না করে তোমার মত একটা নোংরা মানসিকতার মেয়ের সাথে আমি আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাইছিলাম। ভাবতেও এখন আমার ঘৃণা হচ্ছে। তার থেকে বেশি খারাপ লাগছে আমার বোনটার জন্য, যে তোমার মত একটা মেয়েকে জন্ম দিয়ে আজ এতটা কষ্ট পাচ্ছে এতটা অপমানের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

আয়েশা সিদ্দিকা ছেলের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করে ,,,,

:-তুই কি করে এই ছেলেদুটোকে খুঁজে পেলি আব্বা? কে এই ছেলে দুটো?

মায়ের প্রশ্ন শুনে সাহিত্য গতকাল বিয়েতে ঘটে যাওয়া সবকিছু সবার সামনে খুলে বলে। অবশ্য তার আর সুহাসিনীর সম্পর্কটা গোপন করে।বলে,,,

:- প্রথমে আমার ছবিগুলো দেখে সন্দেহ হয়েছিলো। কারণ প্রত্যেকটা ছবি আমাদের বাড়িতে এই মির্জা মেনশন থেকে তোলা হয়েছে। যদিও ছবিগুলো খুবই কায়দা করে এমনভাবে তোলা হয়েছে যাতে সত্যিকার ভাবে প্রমাণ করা যায় আর লোকে সহজে বিশ্বাস করে। মির্জা ম্যানসনে কখনো বাইরের মানুষ এসে কাছ থেকে এভাবে ছবি তোলা অসম্ভব। তাহলে বাড়ির ভেতরেরই কারো কাজ এটা। আর এই বাড়িতে সুহা আসার প্রথম দিন থেকেই তার সাথে কে ঝামেলা করেছে?কে বারবার সুহার ক্ষতি করতে চেয়েছে সেটা তো কারো অজানা নয়। তাই সন্দেহের তীরটা আমার নীলিমার দিকেই সবার আগে গেছিলো। আর সোহরাব সাহিত্য মির্জার সন্দেহ খুব একটা অবান্তর হয় না।

মীর্জা মেনশন এর লিভিং রুমের প্রত্যেকটা মানুষ আজ বিমুড়।তারা তাদের ভাষা হারিয়েছে। সাহিত্য পুলিশ ফোর্সদেরকে বলে নীলিমাকে এরেস্ট করতে। তার নামে মানহানির মামলা দায়ের করতে বলে ।সাথে একটা মেয়েকে হ্যারেস করা, তার নামে মিথ্যা অপবাদ দেয়া, তার চরিত্রে কালী লেপন করার অপরাধে কঠিন শাস্তির আরজি জানানো হয়। সাথে সাথে এটাও বলা হয় যে, মিথ্যা নিউজ এবং ছবি গুলো আপলোড হয়েছে সেগুলো যেন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এই মিথ্যা নিউজটা যদি আর একটাও শেয়ার পাই তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়।

মহিলা পুলিশরা এসে নীলিমার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে নীলিমা চিৎকার করে মাকে ডেকে বলে,,

:- ছাড়ো আমাকে, মা দেখো আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি কোন অন্যায় করিনি। যা করেছি বেশ করেছি। ছাড়ো আমাকে। মা প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিতে বলো।

সোফায় কাঠ হয়ে বসে আছেন শেফালী বেগম। মেয়ের আর্তনাদ আজকে তাকে ছুতে পারছে না। তিনি কোন কথাই বললেন না। মহিলা কনস্টেবলরা নীলিমাকে টেনে নিয়ে চলে গেল।

এতক্ষণে আহাদ মির্জা ভাইসম বন্ধুর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাই। আয়েশা সিদ্দিকা হাতজোড় করে ক্ষমা চাই মোতালেব হোসেন আর তাহিরা বেগমের কাছে। ক্ষমা চাইতে গিয়ে কেঁদে দেন তিনি। বলেন,,
_ তিনিই আবদার করে সুহাকে এনেছিলেন নিজ দায়িত্বে। কিন্তু তিনি তার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে পারেননি। ব্যর্থ হয়েছেন মেয়েটাকে লাঞ্চিত হওয়ার থেকে বাঁচাতে।
এতকিছুর পর মোতালেব হোসেন এবং তাহেরা বেগম তাদেরকে নিজ গুনে ক্ষমা করে দেন। এবং বলেন,,

ছিঃ ছিঃ আপনারা এভাবে বলবেন না। আমার মেয়েটা সাথে সাথে সাহিত্যবাবাকেও অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। দুপক্ষকেই কম বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হোক। আর এত কিছুর পরে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে বলবেন না দয়া করে। মেয়েটার মনের উপর দিয়ে যা গেলো তাতে অনুষ্ঠানে আনন্দ করতে কেউ পারবো না আমরা। আমরা কেউই সেই পরিস্থিতিতে নেই। অনুমতি দিন আমরা ফিরে যাই নিজ বাড়িতে। আয়েশা বেগম আহাদ মির্জা কেউই আর বাধা দিতে পারলেন না। মোতালেব হোসেন মেয়েটার কাঁধ জড়িয়ে মির্জা মেনশন থেকে বেরিয়ে আসে।
বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুহা একবার তাকায় তার প্রিয়তম এমপি সাহেবের দিকে। সাহিত্য সুহার দিকেই করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলো । এত কিছু ঘটে গেল অথচ সে মেয়েটাকে একবার বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার সুযোগ পেলোনা।
সকাল থেকে কত কষ্ট না পেয়েছে তার পদ্মফুল। কেঁদে কেঁদে চোখটা লাল করে ফেলেছে। একবার ওই ফুলো ফুলো চোখের পাতায় চুমু এঁকে দিতে না পারায় হাঁসফাঁস করে ওঠে বুকের ভেতর। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখের আড়াল হয় সুহা। চোখ বন্ধ করে নেয় সাহিত্য। দু ফোঁটা অশ্রু কি ঝরে পড়লো কঠিন শক্ত মনের পুরুষ টার চোখ থেকে??
কারো চক্ষু গোচর হওয়ার আগেই তা আড়াল করে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায় সাহিত্য।

চলবে,,,,,