ভালোবাসি তোকে সুহাসিনী পর্ব-২৬ + বোনাস পর্ব

0
104

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
পর্ব,,,,২৬
মৌমো তিতলী

দেখতে দেখতে কেটে গেছে এক সপ্তাহ।
এই এক সপ্তাহ সুহার সাথে দেখা হয়নি সাহিত্যের। ফোনেও পাওয়া যায়নি মেয়েটাকে। হৃদয়ের কোণে ঘন মেঘের আস্তরণ এমপি সাহেবের। প্রিয় নারীর অদর্শনে অন্তর পুড়ে ছাই হয়। একি জ্বালাময়ী অনুভূতি একি আকুলতা। একবার, শুধু একবার তাকে চোখের সামনে দেখার তৃষ্ণায় বুকটা খা খা করে সাহিত্যের।
পার্টি অফিসের চেম্বারে বসে আছে সাহিত্য। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ‌। সুদর্শন মুখটা ঢাকা পড়ে আছে ধবধবে সাদা রুমালে।

অরুদ্ধ অনেক্ষণ ধরে কিছু একটা বলে যাচ্ছে,তার কিছুই যেন কানে ঢুকছেনা এমপি সাহেবের। শেষে অরুদ্ধ গিয়ে সাহিত্যের মুখের ওপর থেকে রুমাল টা টান দিয়ে সরিয়ে নেয়। কড়া গলায় কিছু বলতে নিতেই থমকে যায় অরুদ্ধ।
সাহিত্যের চোখে পানি। এ যেন তার কাছে অষ্টম আশ্চর্যের ন্যায়। বন্ধুকে সারাজীবন কঠোর আর শক্ত পুরুষ হিসেবে দেখে আসা অরুদ্ধ যেন কথা বলতে ভুলে গেছে।
আস্তে করে সাহিত্যের কাঁধে হাত রাখে অরুদ্ধ। সাহিত্য তড়িঘড়ি উঠে বসে। আলগোছে মুছে নেয় চোখের কোনে জমা অবাধ্য জলের অস্তিত্ব।

:- এতোই যখন কষ্ট পাচ্ছিস তাহলে যাচ্ছিস না কেনো ওর কাছে? চাইলেই তো ওকে তুলে আনতে পারিস।

থমথমে মুখে জবাব দেয় সাহিত্য,,,

:- ভালোবাসায় কোন জোর খাটে না রে। সেদিন এতো মিথ্যা অপবাদ পেয়ে মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। আমি পারিনি একবারও তার সাথে কথা বলতে। তাই হয়তো অভিমানে আর সামনে আসছে না। শেষের কথাটা বলতে গলা কাঁপে সাহিত্যের।
অরুদ্ধ বোঝে কতটা কষ্ট পাচ্ছে তার কঠোর খোলসে ঢাকা প্রেমিক পুরুষ বন্ধু। সাহিত্যের কম তো পাগলামি দেখেনি সুহাসীনির জন্য। আর এরকম একটা ঘটনার পর দির্ঘ্য সময় ধরে প্রেয়সীকে চোখের সামনে না দেখায় সাহিত্যের মনে যে কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে সেটা আন্দাজ করা যায় অনায়াসে।

অরুদ্ধ কিছু একটা মনে হতেই প্রফুল্ল চিত্তে বলে,,

:- আজ সুহাসীনিদের কলেজের প্রথম দিন। জানিস তুই?

মুহুর্তেই মেঘে ঢাকা মুখটা চকচক করে ওঠে সাহিত্যের। সে তো ভুলেই গিয়েছিলো বিষয়টা। সাহিত্য দ্রুত গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে আসে অফিসের বাইরে। অরুদ্ধ দৌড় দেয় পিছে,,

:- আরে রুখ ইয়ার!!! আমাকে তো নিয়ে চল! আমারটাও তো আছে সেখানে নাকি?

সাহিত্য মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। লাফ দিয়ে উঠে বসে গাড়িতে। গন্তব্য সুহাসিনী কলেজ।

__________

আজ এক সপ্তাহ প্রায় ঘরবন্দিই থেকেছে সুহাসীনি। শুধু খাওয়া দাওয়া করেছে বাবা মায়ের সাথে। টুকটাক কথা বলেছে। মোতালেব হোসেন,তাহিরা বেগম দুজনেই মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত। সেদিনের ঘটনা মেয়ের উপরে বেশি প্রভাব ফেলেছে বলেই তাদের ধারণা। কিন্তু এখানে ঘটনা সম্পূর্ণ উল্টো। সুহা ইচ্ছে করে আড়ালে থেকেছে। বিশেষ করে তার এমপি সাহেবের কাছ থেকে। ফোনটাও বন্ধ রেখেছে। সেদিন সবার সাথে কথা বললেও তার সাথে কোন কথা বলেননি ওই বদ এমপি সাহেব। তারই শাস্তি স্বরুপ এই সিদ্ধান্ত তার।
_আমার সাথে কথা বলেননি তো! থাকুন আপনি আপনার মতো। আমিও বলবো না কথা। বিড়বিড় করে সুহা।

কিন্তু আজ তার কলেজের প্রথমদিন। নিপা টা সেই সকাল বেলা সেজেগুজে রেডি হয়ে তার বাসায় হাজির। সুহাও গুছিয়ে নেই কলেজে যাওয়ার জন্য। এর আগে একদিন বাবার সাথে গিয়ে ভর্তির ফর্মালিটিজ পূরণ করে এসেছে।
তাই আজ আর কোন ঝামেলা নেই। তবে মনটা খচখচ করছে সুহার । তার কেন যেন মনে হচ্ছে আজ এমপি সাহেব আসবেন। আর তার করা এই সাত দিনের বোকামির জন্য রাস্তার মাঝখানেই আচ্ছাসে ঝাড়বেন। যা রাগ তার এমপি সাহেবের। ভাবতেই ঢোক গিলে সুহা।
রেডি হয়ে নিপার সাথে বেরোয় কলেজের উদ্দেশ্যে। বেরোনোর আগে তাহেরা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নানা রকম উপদেশ দেন। মায়ের কথায় ঘাড় নারে সুহা।

রাস্তায় বেরিয়ে এসে রিকশা ডেকে নিয়ে উঠে বসে দুই বান্ধবী। ১০ মিনিটেই পৌঁছে যায় কলেজে। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে কলেজ গেটের দিকে এক পা বাড়াতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় সুহার।
চোখ মুখ শক্ত করে বুকে হাত গুজে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে তার প্রিয়তম এমপি সাহেব। ক্ষেপা সিংহের মত তীক্ষ্ণ রক্ত চক্ষু দুটো তার ওপরেই নিবন্ধ। মুহূর্তে সুহার মুখের আদল বদলে যায়। সুহাসিনী কে দেখলেই মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তাকে দশ নম্বর বিপদ সংকেত দেয়া হয়েছে। ঢোক গিলে নিপার পেছনে নিজেকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করে সুহাসিনী। এই মুহূর্তে নিজের করা বোকামির জন্য ভীষণ আফসোস হয়েছে তার। কেন যে বোকার মত এই দানবটাকে শাস্তি দেয়ার কথা ভাবলো তার মত একটা চুনোপুটি মেয়ে। সেটা ভাবতেই এখন নিজের মাথায় চাটা মারতে ইচ্ছা হচ্ছে।

নিপা তো অরুদ্ধ কে দেখেই দাঁত কেলিয়ে এগিয়ে গেল তাদের দিকে। সুহার আর কি করা! মুখটা আমসি করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াই নিপার পাশে। নিপা তো চিল মুডে আছে। কলেজের প্রথম দিনে প্রেমিক পুরুষের সাথে থাকা মানেই বিশাল ব্যাপার !! কারণ, অরুদ্ধের খুব কমই সময় হয় তাকে সময় দেয়ার। সে তো আর ভেতরের কথা জানেনা। কি বোকামো টা করেছে এই এক সপ্তাহ তার গর্ধব বান্ধবী।
নিপারা কাছে আসতেই অরুদ্ধ কথার ছলে নিপা কে নিয়ে সেখান থেকে দূরে সরে যায়।
এদিকে আড় চোখে সাহিত্যর দিকে তাকায় সুহা। লোকটা এখনো একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে।ঠাই দাঁড়িয়ে আছে যেন, একদম পাথর।
ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠামদেহের অধিকারী এমপি সাহেব কে দেখে তৃষ্ণা মেটে না সুহার। লোকটা কে কি আজ একটু বেশিই সুদর্শন লাগছে না?
চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাই সুহা। কলেজ গেটের বাইরে অবস্থিত মেয়েগুলোর নজর তার এমপি সাহেবের দিকে। তাদের দৃষ্টি এমন যে তার এমপি সাহেব মিষ্টি গুড়, আর এই মেয়ে গুলো সব কালো কালো পিঁপড়ে। কেমন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েগুলো। জঘন্য! একেবারে অসহ্য জঘন্য অনুভূতি!!
মুহূর্তেই ভেতরটা তেঁতো হয়ে আসে সুহার। নিজের বিপদ ভুলে মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে সুহা।

:- গাড়িতে ওঠ!!

আচমকা সাহিত্যর কথাই ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে সুহা।

:- জ্ব….জ্বী??

খেঁকিয়ে ওঠে সাহিত্য,,,

:- কি বললাম শুনতে পাসনি? কানে কালা তুই? বললাম না গাড়িতে ওঠ!

সাহিত্যের ধমকে গলা শুকিয়ে যায় সুহার। সন্তর্পনে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গিয়ে গাড়িতে ওঠে সুহা। মনে মনে ভাবে,,
_বিদায় পৃথিবী! বিদায় কলেজ! বেঁচে থাকলে দেখা হবে আবার।
সাহিত্য গিয়ে বসে ড্রাইভিং সিটে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফুল স্পিডে টান দেয় সাহিত্য।
এদিকে সুহা ভয়ে কাঁপাকাঁপি অবস্থা। বেজায় চটেছে তার এমপি সাহেব। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে সুহা!!
_আল্লাহ এবারের মত বাঁচিয়ে দাও! আর জীবনেও এরকম বোকামি সে করবে না।

গাড়ি নিয়ে একটা নির্জন জায়গায় থামে সাহিত্য। আসেপাশে ঘন জঙ্গল ছাড়া কোন বসতবাড়ি, এমনকি মানুষজনও চোখে পরলো না সুহার। ভয়ে বুক শুকিয়ে গেছে মেয়েটার।
_ এমপি সাহেব কি তাকে মেরে ফেলবে? তারপর এই জঙ্গলে ফেলে দিয়ে যাবে! এই মুহূর্তে কান্না পাচ্ছে সুহার। কেন সে এমন একটা বোকামো করলো!!

হুট করে নিজের বাহুতে টান পড়ায় ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে সুহার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কারো বক্ষ পিঞ্জরে আটকা পড়ে মেয়েটা।
নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সুহাসিনীকে নিজ বক্ষের সাথে জড়িয়ে ধরেছে সাহিত্য। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে তার পদ্মফুল। তাকে বুকে জড়িয়েই এই এক সপ্তাহের তৃষ্ণা মেটানোর বৃথা প্রয়াস তলায় তার প্রেমিক হৃদয়।
প্রায় পাঁচ মিনিট এভাবে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সাহিত্য। সাহিত্য শরীর থেকে মিষ্টি একটা পারফিউমের ঘ্রাণ আসছে সুহার নাকে। লম্বা শ্বাস টানে সুহা।
পর মুহুর্তেই সুহাকে ছেড়ে দিয়ে দুহাতে তার মুখটা তুলে ধরে অধরের অধর ডুবিয়ে দেয় সাহিত্য।
শিউরে ওঠে সুহা। দুহাতে সাহিত্যর বুকের কাছে পাঞ্জাবি খামচে ধরে মেয়েটা। সাহিত্য যেন আজ উন্মাদ। ছেলেটাকে সামলাতে পারেনা সুহা। কিছুক্ষণ পরেই তার অধরে আদরের ছোঁয়া রাগে পরিণত হয়। আলতো স্পর্শ পরিণত হয় কামড়ে। ছটফট করে ওঠে সুহা‌। ছাড়া পাওয়ার জন্য সাহিত্যর বুকে ধাক্কা দিতে থাকে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এক ইঞ্চিও সরাতে সক্ষম হয় না তাকে। নিমিষেই মাথার হিজাব এলোমেলো হয়।
এদিকে ঠোঁটে তীব্র ব্যথা, সাথে নিঃশ্বাস নিতে না পারায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে সুহাসিনী। সুহার হাত আলগা হতেই হুস হয় সাহিত্যের। দুহাতে আগলে নেয় প্রেয়সীকে। জ্ঞান হারিয়েছে তার বোকা ফুল।
চোখে অশ্রুর ছড়াছড়ি নিয়েও ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে সাহিত্যর।
_যার এইটুকু কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই, সে কিনা এক সপ্তাহ জেদ ধরে আড়ালে থেকেছে। রাগ দেখিয়েছে তার এমপি সাহেবের উপর। ঠোঁট আরো একটু প্রসারিত হয়
সাহিত্যের। গাড়ির সামনে থেকে পানির বোতল নিয়ে সুহার মুখে ঢেলে দেয়।
মুখের উপরে পানির ঝাঁপটা পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুলে সুহা। ঝাপসা চোখ পরিষ্কার হতেই সাহিত্যর মুখটা দৃশ্যমান হয়। সাহিত্য ঝুঁকে আছে সুহার ওপরে। সুহা চোখ ঘুরিয়ে ভালোভাবে নিজের অবস্থান দেখে বুঝতে পারে তারা এখনও গাড়িতেই আছে। এমনকি সে নিজে এমপি সাহেবের কোলে। তাকে একপ্রকার নিজ বাহুডোরে জড়িয়ে ধরে বসে আছে সাহিত্য।
সুহা সোজা হয়ে বসতে নিতেই বাধা দেয় সাহিত্য। উল্টে নিজ হাতে গাল চেপে ধরে সুহার। দাঁতের দাঁত চেপে বলে,,

:- এবার সত্যি করে বল কি ভূত চেপেছে তোর মাথায়? কি করতে চাইছিস তুই? আমার থেকে দূরে থেকে কি বোঝাতে চাস, আমাকে আর প্রয়োজন নেই তোর??

ছটফট করে ওঠে সুহা‌। কি বলছে তার এমপি সাহেব! যে মানুষটাকে ছাড়া তার ভাবনায় দ্বিতীয় কোন পুরুষ আসে না, যার স্বপ্ন, বাস্তবতা, কল্পনা, জীবন সবটা জুড়ে রয়েছে যেই পুরুষটা! তাকে অপ্রয়োজনীয় ভাবা আদৌ সম্ভব?
দ্রুত মাথা নাড়ায় সুহা।

:- কি মাথা নাড়াচ্ছিস!! মুখ নেই তোর? মুখে পরিষ্কার করে বল, কি চাস তুই?

সুহা ঘোরের মাঝে আনমনে জবাব দেয়,,

:- চায়,,আমার চায়!!

কপাল কুঁচকে তাকায় সাহিত্য। ধমকে ওঠে,,

:- চায় মানে কি চায় তোর?

সাহিত্যর ধমকে হুশ ফিরে সুহার। করে উঠে বলে,,

:- চাই মানে আপনাকে শাস্তি দিতে চাই। সেদিন সবার সাথেই কথা বললেন, সবাইকে সান্ত্বনা দিলেন, আমার সাথে একটা কথাও বলেছিলেন আপনি??

সহার বোকা বোকা কথায় হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারেনা সাহিত্য। এই ফালতু একটা বিষয় নিয়ে এই এক সপ্তাহ আড়ালে থাকলে মেয়েটা। শাস্তির নাম করে তাকে ধুকে ধুকে মারলো!! এইটা একটু বেশি হয়ে গেল না??

সাহিত্য ঠাট্টার স্বরে ঠোঁট ভেঙ্গিয়ে বলে,,,

:- আচ্ছা তাহলে কি করতাম তুই বল?? ঘর ভর্তি লোকের সামনে তোকে জড়িয়ে ধরে বলতাম জান! আর কেঁদোনা!!
তুমি কাঁদলে আমার একটুও ভালো লাগেনা। প্লিজ তুমি আর কাঁদবেনা!!

সাহিত্যর বলার ভঙ্গিতে রাগ অভিমান ভুলে খিলখিল করে হেসে দেয় সুহা। মুহূর্তে সাহিত্যের মনে আকাশ ঝলমল করে ওঠে। সুহার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে এই এক সপ্তাহের জমা কষ্ট নিমিষেই যেন উধাও হয়ে যায়। একদম আস্ত একটা আদরের বস্তা তার পদ্মফুল!! সাহিত্য মুগ্ধ চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
সুহাসিনী হাসতে হাসতে তাকাই সাহিত্যের দিকে। মুহূর্তেই সাহিত্যর চাহনি দেখে হাসি থেমে যায় সুহার। ডুবে যায় তার এমপি সাহেবের চোখের গভীরতায়। আটকা পরে তার প্রিয়তমের নেশাক্ত দৃষ্টিতে।
সাহিত্য হ্যাচকা টানে সুহা কে নিজের বক্ষে এনে ফেলে। এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে চুমু এঁকে দেয় কপালে। গাঢ় কন্ঠে বলে,,,

:- এই এক সপ্তাহ আমার ওপর দিয়ে কি গেছে তোর কোন আইডিয়া আছে ফুল? কি করে পারলি এমন একটা লেইম বিষয় নিয়ে আমার থেকে আড়ালে থাকতে?? আমাকে শাস্তি দিতে চাস তো?? বল কি করলে তুই খুশি হবি? তুই যে কোন শাস্তি দে, আমি সবটা মাথা পেতে নেবো ।কিন্তু কখনো এভাবে আমার থেকে দূরে সরে যাস না জান। তুই চোখের আড়ালে গেলে যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। শান্তিতে শ্বাস নিতে পারি না আমি। তোকে না দেখায় চোখের তৃষ্ণায় ছটফট করে মন। ঘুম আসে না রাতে। এমন আর কখনো করিস না জান!! তুই কখনো আমার থেকে দূরে গেলে আমি শেষ হয়ে যাবো। তুই না থাকলে নিঃস্ব হয়ে যাবে তোর এমপি সাহেব।

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সুহা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সাহিত্য কে।নিজে যে ভিষণ বোকামি করেছে তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে সে।
সাহিত্য নিজের অধর দ্বারা সুহার চোখের জল শুষে নেয়। চুমু এঁকে দেয় দু চোখের পাতায়। তারপর কেঁদে লাল হয়ে যাওয়া নাকের ডগায় চুমু দেয়। সুহার চোখের দৃষ্টি একদম স্বচ্ছ ঝিলের মতো। বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ে সাহিত্যের।
সুহা কে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে দুহাতে চুলগুলো গুছিয়ে দেয়। মাথার হিজাবটা ঠিকঠাক করে দিয়ে কপালে অধর ছোঁয়ায়। এক হাতে সুহাকে জড়িয়ে নেয়। আরেক হাতে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ফিরে আসে সুহার কলেজে।
গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় সুহা। সাহিত্য নিজে তাকে কলেজের ভেতরে নিয়ে যায়। প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে দেখা করে সুহা আর নিপাকে পরিচয় করিয়ে দেয় নিজের আত্মীয় হিসেবে। কলেজে যেন তাদের কোনো অসুবিধাই না পড়তে হয়, কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে সে বিষয়ে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলে সাহিত্য। কলেজের শিক্ষকেরা এমপি সাহেবের কথামতো সবটা দেখে রাখবেন বলে কথা দেয়।

________

মোতালেব হোসেন শিক্ষক মানুষ। গ্রামে তার যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। সেদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্কুলে বেশ গসিপ হচ্ছে শিক্ষকদের মাঝে। মোতালেব হোসেনের সামনে কেউ কিছু না বললেও পেছনে অনেকে অনেক রকম কথা বলছেন তার মেয়েকে নিয়ে। এমনই কিছু কথা মোতালেব হোসেনের কানে আসে,,,

_আরে হ্যাঁ সবটা জানা আছে!! যা কিছু রটে তার কিছু তো অবশ্যই ঘটে। এমনি এমনি তো আর কথা উঠেনি! এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জা বড়লোক মানুষ। একজন এমপি সে।কোন কিছু ঘটলেও তার রাজনৈতিক পাওয়ার দিয়ে সেটা চাপা দেয়ার ক্ষমতা রাখে। দেখো গিয়ে হয়তো ঘটনাটা সত্যিই কিন্তু নিজেদের ক্ষমতা ব্যবহার করে সেটা ভুল প্রমাণিত করেছে।

আরেকজন বলে,,,

:- ঠিকই বলেছেন। মোতালেব মাস্টারই বা কেমন মানুষ? তিনি তো জানতেন মির্জা বাড়িতে একজন অবিবাহিত যুবক ছেলে আছে। তারপরও নিজের বিবাহযোগ্য মেয়েকে কিভাবে সে বাড়িতে একা ছাড়েন তিনি? হয়তো তিনিও এসবের মধ্যে আছেন। মধ্যবিত্ত মানুষ, মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে যদি বড়লোকের ঘরের বউ বানানো যায়, তাতে তো ফায়দা তাদেরই।

পাশ থেকে আরেকজন বলেন,,,

:-ফায়দা যেমন আছে তেমনি আবার ক্ষতিও আছে। এমপি সোহরাব সাহিত্য মির্জার কি কম শত্রু আছে?? তারা তো সবসময় ওত পেতে থাকবে তার কাছের মানুষদের ক্ষতি করতে। দেখলে না তাদের বাড়িতে ওইযে একটা মেয়ে, কি যেন নাম! যাকে পুলিশ সেদিন ধরে নিয়ে গেছে! ওই মেয়ে নাকি মোতালেব মাস্টারের মেয়ের অনেক ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে ‌বোঝো! ঘরের ভেতরেই যদি তার জানের নিরাপত্তা না থাকে। তাহলে বাইরে কি করে থাকবে? দেখা যাবে এমপি সাহেবের শত্রুরা তার উপরের রাগ ওই ছোট্ট মেয়েটার উপর দিয়েই নিলো। রাস্তাঘাটে বের হলে যদি কখনো এসিড ছুড়ে মারে? কিংবা গাড়ি চাপা দেয়, তাহলে তো অকালে প্রাণটা যাবে মেয়েটার।

এতক্ষণের সব কথা কানে এসেছে মোতালেব হোসেনের। প্রথম কথাগুলো তিনি আমলে না নিলেও শেষের বলা দুটো বাক্য পিতৃহৃদয় নাড়িয়ে দেয়। সেদিনের ঘটনার পর তার আদরের মেয়ে সুহাসিনীর প্রতি এমপি সাহেবের যে একটা দুর্বলতা আছে সেটা তিনি সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন। তবে ঘটনাটা একপাক্ষিক নাকি দুপাক্ষিক সেটা তিনি বুঝতে পারেননি। অবশ্যই ঘটনাটা একপাক্ষিকই কি হতে পারে। কারণ নিজের মেয়েকে দেখে তার মনে এমপি সাহেবের প্রতি কোন অনুভূতি আছে কিনা বোঝা যায়নি। তিনি অবশ্য মেয়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তার এতদিনের অভিজ্ঞ চোখে তেমন কিছু ধরা পড়েনি।
তিনি বেশ চিন্তিত হন।
মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নেন তিনি। মেয়েকে অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর খুব ইচ্ছা ছিল মোতালেব হোসেনের। কিন্তু পরিস্থিতি এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, সমাজের লোকেরা মেয়েকে বাঁকা চোখে দেখছে। ঘটনাটা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরেও অনেকের মনে প্রশ্ন থেকে গেছে। পড়াশুনা করতে গেলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েটা কে বাঁকা চোখের শিকার হতেও হতে পারে। এমত অবস্থায় তার সিদ্ধান্তটা সঠিক বলে মনে হয়।
হ্যাঁ !বিয়ে।একজন যোগ্য পাত্র খুঁজে তার হাতে মেয়েকে তুলে দিবেন। যত দ্রুত সম্ভব মেয়ের বিয়ে দিবেন তিনি।
দ্রুত তিনি স্কুল থেকে বেরিয়ে আসেন। বাড়িতে গিয়ে সহধর্মিনীর সাথে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে ঠিক করেন তিনি।

বাজারের কাছাকাছি আসলে মেয়ের সাথে দেখা হয় মোতালেব হোসেনের। সুহা মাত্রই কলেজ থেকে ফিরে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে। ভাড়া মিটিয়ে এদিকে তাকাতেই বাবাকে চোখে পড়ে সুহাসিনীর। বাবাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে মেয়েটা রাস্তা পার হয়ে আসতে নিতেই মোতালেব হোসেন খেয়াল করেন একটা গাড়ি দ্রুত তার মেয়ের দিকেই ধাবিত হয়েছে। মুহূর্তের স্কুলে তার পেছনে বলা কথা গুলো মনে পড়ে মোতালেব হোসেনের। শরীর ছেড়ে দেন তিনি। সত্যিই কি তবে মেয়েকে হারাতে বসেছেন অসহায় বাবা। চোখের সামনে মেয়ের হাসিমুখ এদিকে মৃত্যুদূতের মতো এগিয়ে আসছে গাড়িটা তার মেয়ের দিকে। মোতালেব হোসেনের যেন রাস্তার সাথে পা আটকে গেছে। পা তুলে যে মেয়ের কাছে এগিয়ে যাবেন সেই শক্তিটুকুও যেন অবশিষ্ট নেই দেহে। রাস্তার মাঝে ধপ করে বসে পড়েন তিনি। একমাত্র আদরের মেয়েকে হারানোর ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন তিনি।
বাবাকে এভাবে রাস্তার মাঝখানে বসে পড়তে দেখে কপাল কুঁচকে আসে সুহার। গাড়ির হর্ন শুনে পাশে তাকিয়ে দেখে একটা গাড়ি দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসছে। সুহা এক লাফে সরে দাঁড়ায়। একটুর জন্য বেঁচে যায় সে। গাড়িটা পার হতেই দ্রুত দৌড়ে বাবার কাছে আসে সুহা। হাঁটু মুড়ে বাবার সামনে বসে দুহাতে ঝাপড়ে ধরে বাবাকে। আকুল হয়ে ডাকতে থাকে,,,
:- বাবা! ও বাবা! কি হলো তোমার? এভাবে রাস্তার মাঝে বসে পড়লে কেন? বাবা তোমার কি খারাপ লাগছে? শরীর খারাপ করছে তোমার? কথা বলছো না কেন বাবা?

মোতালেব হোসেন শূন্য চোখে মেয়ের দিকে তাকান। তারপর হঠাৎ করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। সুহা বুঝতে পারে তার বাবার শরীর কাঁপছে। ভাবে হয়তো বাবার শরীর খারাপ করছে। নিজের ছোটখাটো শরীরের শক্তি দিয়ে বাবাকে টেনে তোলার চেষ্টা করে সুহা। আশেপাশের মানুষ যেন ফ্রিতে নাটক দেখছে। কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করার আগ্রহ দেখাচ্ছে না। রাগ হয় সুহার ।
মানুষের মধ্যে মানবতা যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

মোতালেব হোসেন নিজেকে ধাতস্থ করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ান। মেয়েকে একহাতে জড়িয়ে ধরে রাস্তা থেকে নেমে আসেন ফুটপথে। হাঁটতে নিলে সুহা বাধা দেয়। একটা খালি রিক্সা ডেকে বাবাকে নিয়ে উঠে বসে। এই অবস্থায় হাটা ঠিক মনে হয় না তার। রিকশা নিয়ে দ্রুত বাড়িতে চলে আসে। তাহিরা বেগম মেয়েকে তার বাবাকে এভাবে ধরে আনা দেখে অস্থির চিত্তে এগিয়ে যান। ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,,,

:- ও সুহা! কি হয়েছে তোর বাবার? এভাবে ধরে নিয়ে আসছিস কেন?

সুহা বাবাকে সোফায় বসিয়ে দিতে দিতে বলে ,,,,

:-জানিনা মা। মনে হয় বাবার শরীর খারাপ করছে। মা তুমি একটু পানি আনো তো।
তাহেরা বেগম দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে স্বামীর মুখে ধরেন। মোতালেব হোসেন ঢকঢক করে গ্লাসের পুরোটা পানি শেষ করেন। তারপর আস্তে আস্তে বলেন,,

:- তোমরা অস্থির হইও না! আমি ঠিক আছি। হয়তো প্রেশারটা একটু লো হয়ে গিয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে।
সুহানও গুটি গুটি পায়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল সবকিছু। মোতালেব হোসেন ইশারায় ছেলেকে কাছে ডাকেন। তারপর দুহাতে ছেলে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। তাহিরা বেগমও এগিয়ে এসে স্বামীর কাঁধে ভরসার হাত রাখেন। মোতালেব হোসেন তাকিয়ে দেখেন!
_ এই তো তার পরিবার! তার এই সুখের ছোট্ট পরিবারে কোন দুখের ছায়া তিনি চান না। মেয়ের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য হলেও, তিনি এবার সুহাসিনীর বিয়ে দেবেন।

চলবে,,,

#ভালোবাসি_তোকে_সুহাসিনী
বোনাস পর্ব,,,
মৌমো তিতলী

কেটে গেছে আরোও এক সপ্তাহ। রাত প্রায় ৮ টা।
আরশি নিজের রুমে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় চিরুনি করছে আর একটা গানের কলি গুনগুন করছে।
হঠাৎ পেটে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠলো আরশি। মুহুর্তেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে। এই স্পর্শ তার পরিচিত। তার প্রিয়তম স্বামীর ছোঁয়া।
মেহরাব পেছন থেকে আরশিকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দেয়। ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দেয় প্রিয়তমা স্ত্রীর গলায়। আবেশে চোখ বন্ধ করে আরশি। অনুভব করতে থাকে স্বামীর আদর। এক সময় আরশি জিজ্ঞাসা করে ,,

:- কি ব্যাপার!! আজকে কি খুব ক্লান্ত মাষ্টার মশাই??

:-উমমম।

:- আচ্ছা!! তা কি করলে আপনার ক্লান্তি দূর হবে বলেন তো!!

মেহরাব আরশির গলায় ঠোঁট রেখেই উত্তর দেয়,,,

:- কিছু করতে হবে না। শুধু আমার কাছে থাকো একটু। তোমাকে কিছু বলার আছে।

মেহরাবের কথায় কপালে ভাঁজ পড়ে আরশির।
ঘুরে স্বামীর দিকে তাকায় সে। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকায় মেহরাবের দিকে। মেহরাব আরশির দু বাহু আলতো করে ধরে টেনে এনে বিছানায় বসিয়ে দেয়। নিজেও পাশে বসে।
তারপর আস্তে ধীরে বলে,,,

:- আরশি তুমি তো জানো, কলেজে শিক্ষকতা ছাড়াও বাবার বিজনেস টাও আমি দেখাশোনা করি। আর এবার একটা গুরুত্বপূর্ণ টেন্ডারের জন্য আমাকে প্রায় তিন মাসের জন্য কানাডা যেতে হবে। আর তিন দিন পরেই আমার ফ্লাইট।

প্রাণপ্রিয় স্বামী প্রায় তিন মাসের জন্য দূরে যাবে জেনে মনটা খারাপ হয়ে আরশির। তবে অহেতুক চিন্তা করার মেয়ে নয় আরশি। সে প্রচন্ড ম্যাচিউড একটা মেয়ে। বাস্তবতা সে খুব ভালোই বোঝে। বলে,,

:- কিন্তু স্যার! আপনার কলেজ….

:- উফফ আরশি!! তুমি আগে আমাকে এই “স্যার” ডাকা বন্ধ করো। তুমি যখন কলেজে ছিলে, আর না আমি তোমার স্বামী ছিলাম, তখন আমি তোমার স্যার ছিলাম। কিন্তু এখন আমি শুধুই তোমার স্বামী। তোমার একমাত্র ভালোবাসার মানুষ।

:- আমার লজ্জা লাগে স্যা..না মানে মেহরাব। মিন মিন করে বলে আরশি।

মেহরাব হেসে জড়িয়ে ধরে হালকা করে চুমু দেয় আরশির ঠোঁটে। তারপর বলে,,

:- আমি কলেজ থেকে তিন মাসের জন্য ছুটি নিয়েছি। আমার জায়গায় আমার এক বন্ধু গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন করবে‌।

আরশি মনোযোগ দিয়ে শোনে,, তারপর বলে,,

:- আব্বু আম্মু জানেন আপনি যে দেশের বাইরে যাবেন?

:- আব্বু আম্মু এ বিষয়ে আগে থেকেই অভ্যস্ত। তাছাড়া এটাই প্রথম নয় আমার দেশের বাইরে যাওয়া। বিয়ের আগেও এমন বিভিন্ন সময় আমাকে অফিসের কাজে বাইরে যেতে হয়েছে। তাই এটা খুবই স্বাভাবিক ভাবেই নিবেন তারা।

এমন সময় নিচ থেকে আয়েশা সিদ্দিকার ডাক আসে। ডিনারের জন্য সবাইকে ডাকা হয়েছে।
মেহরাব ভাবে তার কানাডায় যাওয়ার বিষয়টা খাবার টেবিলে সবাইকে জানিয়ে দেবে। আরশিকেও জানিয়ে দেয় ডিনার করে এসে তার লাগেজটা যেন গুছিয়ে রাখে। কিছু কাগজপত্র ঠিক করার জন্য তাকে আবার বেরোতে হবে। আরশিও স্বামীর কথায় সম্মতি দেয়।

_______

আমজাদ তালুকদার নিজের বাড়িতে বসে আছে। সামনে বসা একজন সোন্ডা মার্কা লোক। লোকটা হাতের কাঠি দ্বারা দন্ত খুঁচিয়ে চলেছেন। এটা তার মুদ্রা দোষ। মাঝে মধ্যে পানের পিক ফেলছে বা হাতে ধরে রাখা একটা ডিব্বায়। দেখেই কেমন গা গুলিয়ে ওঠে আমজাদ তালুকদারের। নেহায়েৎ লোকটা কে তার প্রয়োজন। নয়তো এসব আজাইরা লোককে তিনি লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিতেন।
লোকটা আরো একবার চপাৎ করে পানের পিক ফেললেন ডিব্বায়। তারপর লাল হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো বের করে হেসে বলেন,,,

:- আপনি কইতে চাইতাছেন আফনার পোলা আফনানের জন্য মোতালেব মাস্টারের মাইয়ার সম্বন্ধ লইয়া যাইতে??

আমজাদ তালুকদার মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ তুলে বলেন,,

:- তোর সেই ধরে আপনাকে কি বোঝালাম??

:- আরে চ্যাঁতেন কেন তালুকদার সাহেব। বুঝবার পারছি। মোদ্দা কথা হইলো গিয়া আপনের পোলার জন্য মাস্টারের মাইয়ারে আপনার চাই তাইতো??

:- হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। আর এই সম্বন্ধটা আপনাকে পাকা করতেই হবে।

:- আরে আপনি কোন চিন্তা কইরবেন না। এই মন্টু ঘটক যেই সম্বন্ধে হাত লাগাই সেইডাই রাজযোটক হইয়া যায়।
কিন্তু কথা হইলো গিয়া, আপনের পোলা আফনানের তো মাথায় ব্যারাম আছে। মাঝেমধ্যেই তার মাথাও আউলাইয়া যায় শুনছি। তো মোতালেব মাস্টার কি রাজি হইবো, তারা মন ফুলের মত মাইয়ারে আপনার পাগল পোলার লগে বিয়া দিতে?

সাথে সাথেই হুংকার দিয়ে ওঠে আমজাদ তালুকদার।

:-খবরদার মন্টু ঘটক!! আমার পোলারে নিয়া তুমি একটাও খারাপ কথা বলবা না। আমার পোলা পাগল না। ওর মাথায় একটু সমস্যা আছে, কিন্তু সেটা সব সময় থাকে না। তাছাড়া ছেলের মাথায় সমস্যা তাতে তোমার কি?? আমার কি কোন কিছুর কমতি আছে? কোটি কোটি টাকার সম্পদ আমার। এই সবটাই তো আমার ছেলেরই। মোতালেব মাস্টার মধ্যবিত্ত মানুষ। এমন বড়লোক বাড়িতে মাইয়া বিয়ে দিতে পারলে তারই লাভ। তুমি কালই যাইবা মোতালেব মাস্টারের কাছে। ভালই ভালই মানলে ভালো, আর না মানলে যা করা লাগে আমিই করবো।

মন্টু ঘটকও আইচ্ছা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। সদর দরজা পার হয়ে আবার ফিরে তাকায় তালুকদার বাড়ির দিকে। তারপর বিড়বিড় করে বলে,,,

:- হালায় জাত হারামী নমরুদের বংশধর!! ওয়াক থু!! করে একদলা থুথু ফেলে তালুকদার বাড়ির দরজার সামনে।

পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে ফোন লাগায়। ফোনটা রিসিভ হলে শুধু একটা কথাই বলে।

“আমজাদ তালুকদার তার ব্রহ্মাস্ত্র তৈরি করতাছে। সর্বনাশ হইয়া যাইবো ফুলের মত মাইয়াডার। ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে হারামজাদা তালুকদার।

__________

আজকের ফ্লাইটে কানাডার উদ্দেশ্যে আকাশ পথ পাড়ি দিলো মেহরাব। আহাদ মির্জা নিজে ছেলেকে সি অফ করতে এসেছিলেন। সাথে এসেছিলো আরশি। এখন শ্বশুর আর বৌমা মিলে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
মির্জা মেনসনে ঢুকে ছোট ছেলেকে বাড়িতে থাকতে দেখে বেশ অবাক হন তিনি।
মুখ থমথমে হয়ে আছে সাহিত্যের। সামনে চিন্তিত মুখে বসে আছে আয়েশা সিদ্দিকা।
আহাদ মির্জা এগিয়ে যান। ছেলের পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে বলেন,,,

:- কি হয়েছে আব্বা? তোমায় খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। কোন সমস্যা হয়েছে কি??

কোনরকম ভনিতা না করে সাহিত্য সরাসরি বাবাকে বলে,,,

:- বাবা আমি বিয়ে করবো।

সরাসরি ছেলের মুখে বিয়ের কথা শুনে হতভম্ব আহাদ মির্জা। চোখ বড় বড় করে তাকাই ছেলের মুখের দিকে।
ঘটনা কি বুঝতে না পেরে সহধর্মিনের দিকে তাকায়। আয়েশা সিদ্দিকা মুখে আঁচল চেপে নিঃশব্দে হাঁসছেন। আরশিও গিয়ে শাশুড়ির গা ঘেঁষে বসে পড়ে।

আহাদ মির্জা গলা ঝাড়া দিয়ে বলেন,,

:- বিয়ে করবে মানে??

:- মানে আবার কি? বিয়ে করবো মানে, বিয়ে করবো! আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে না যে, আমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে??

ছেলের কথায় ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে যান আহাদ মির্জা। তার ছোট ছেলে কবে এমন ঠোঁটকাটা হলো সেটাই ভাবছেন তিনি। তবে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলেন,,

:- সেটা তো ঠিক আছে, বিয়ে করবে বুঝলাম। কিন্তু বললেই তো বিয়ে হয়ে যায় না। তার জন্য তো আমাদেরকে মেয়ে দেখতে হবে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি তোমাকে না জানিয়েই নীলিমার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু সেটা আমার ভুল ছিলো। আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছিলাম। কিন্তু এখন যখন তোমাকে বিয়ে দিতেই হবে ,তখন তোমার উপযুক্ত একটা যোগ্য মেয়ে তো আমাদেরকে খুঁজতে হবে। তারপর না হয়….

বাবাকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে দেয় না সাহিত্য। তার আগেই বলে,,,

:- মেয়ে খোঁজার দরকার নেই বাবা। মেয়ে আমার পছন্দ করাই আছে।

এবার যেন ছেলের কথায় আকাশ থেকে পড়লেন আহাদ মির্জা। ছেলেকে দেখে তিনি কখনো ধারণাও করতে পারেননি, এসব মেয়ে পছন্দ করার ব্যাপারে ইনভোল্ট থাকতে পারে তার রাজনীতিবিদ ছোট ছেলে।
কপালে ভাঁজ পড়ে আহাদ মির্জার। শান্ত গলায় জানতে চান কে সেই মেয়ে?

সাহিত্য আবারও সোজাসুজি উত্তর দেয়,,

:- মোতালেব আঙ্কেলের মেয়ে সুহাসিনী!!

আহাদ মির্জার কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায়। ছেলের মুখে মেয়ে পছন্দ করার কথা শুনে মনে মনে তিনি এমনই কিছু হবে ভেবেছিলেন। মেহরাবের রিসিপশনের দিনের ঘটনায় কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি। তবে ছেলে যে এমন বেপরোয়া হয়ে প্রস্তাব দিয়ে বসবে সেটা বুঝতে পারেননি।
তবে মেয়েটা সুহাসিনী জেনে তিনি মনে মনে খুশি হয়েছেন। তাছাড়া মোতালেব তার বন্ধু। তারা কেমন মানুষ তিনি খুব ভাল করেই জানেন। তাই মুখে হাসি টেনে বললেন,,

:-সুহাসিনীকে যদি তোমার পছন্দ হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই সম্বন্ধ নিয়ে যাবো মোতালেবের বাড়িতে। কিন্তু তার জন্য তো কিছু সময়ের প্রয়োজন। এভাবে হুট করেই তো চলে যাওয়া যায় না।

:- সুহাসিনী কে আমার শুধু পছন্দ নয় বাবা, আই স্টিল লাভ হার!
কোনো সময়ের প্রয়োজন নেই বাবা। আমরা আজ, এক্ষুনি যাবো।
ছেলের কথায় আবারও ভ্যাঁবাচ্যাকা খেলেন আহাদ মির্জা।

:-আজই মানে? এভাবে একটা বিয়ের সম্বন্ধ হয় নাকি? বলা নেই কওয়া নেই হুট করে তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে না??

:-আমি ওসব কিছু জানি না বাবা! আজ যাবো মানে আজই যাবো।

শেষে ছেলের জেদ আর পরিবারের সম্মতি পেয়ে সবাই মোতালেব হোসেনের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়।
তার আগে মোতালেব হোসেনকে ফোন করে জানিয়ে দেন তারা আসছেন তাদের বাড়িতে বেড়াতে। মেয়ে দেখার ব্যাপারে বা বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানালেন না আগে।

এদিকে সাহিত্য মনে মনে ভাবছে ,,
_তোকে নিজের করে পাওয়া এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা পদ্মফুল। তোকে আমি আমার করে নেবো খুব তাড়াতাড়ি। দেখবো কে তোকে আমার থেকে কেড়ে নিতে আসে। তোর আমার মাঝে যেই আসবে তাকেই আমি উপড়ে ফেলে দেবো। আই ওয়ান্ট ইউ মাই লাভ !!আই এম কামিং সুন….

চলবে,,,,