#ভীনদেশী_তারা
শারমিন_প্রিয়া
পর্ব_১
“জানো, জিয়ান? বাবা আবার আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। আমি বলেছিলাম, আমার ছোট মেয়ে শিহাকে রেখে আমি বিয়ে করব না। বাবা আমার কথা কর্ণপাতও করেননি। আমি তোমার স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আরেকজনকে বিয়ে করব, বলতে পারো? আমার খুব অসহায় লাগছে। কী করব, আমি বুঝে উঠতে পারছি না। তুমি কোথায় আছো, জিয়ান? কেন খোঁজ নাও না আমাদের? শিহা আবার আধো-আধো করে “আ… ব… বু” বলা ডাক শিখেছে। সে যখন এটা ডাকার চেষ্টা করে, আমার ভিতরটা ভেঙে যায়, কান্না আসে। বাবা থেকেও মেয়েটা বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে; এটা আমাকে কষ্ট দেয়। জানো? মেয়েটা দেখতে একদম তোমার মতো হয়েছে, ধবধবে সাদা গায়ের রং, ছোট চোখ, পাতলা ঠোঁট, মায়াবী মুখশ্রী, চকচক করে চেহারা। যেখানে থাকো, দ্রুত এসে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও। প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ!”
এতটুকুই লিখে সেন্ড করলাম আমার স্বামীর নম্বরে, যে নম্বর এখন আর সচল নয়। কোনো একদিন সিমটা আবার চালু হবে আর মানুষটা নিশ্চয়ই আমার মেসেজ দেখবে এই আশায়, যখন যা হয়, মনে যা আসে তাই লিখে দিই। জিয়ান হয়তো দেখবে না বা কখনো সিম সচল হবে না, তবু আমার শান্তির জন্য এই নাম্বরে বহু হাবিজাবি লিখি, দুই বছর ধরে। লিখে শান্তি পাই।
আমার বিয়ের আজ চার বছর প্রায়। জিয়ানের থেকে কোনো ডিভোর্স পাইনি। আমিও ডিভোর্স দিইনি। শুধু কোনো যোগাযোগ নেই, আজ দু’বছর ধরে। আমরা দুজন নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। আমাদের যে একটা মেয়ে হয়েছে, এটাও জিয়ান জানে না। আমার সঙ্গে আমার দেড় বছরের মেয়ে থাকা সত্ত্বেও বাবা আমার সেই বিয়েটা মেনে নেননি। ভবিষ্যতেও তা মেনে নেবেন না বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন। আমিও ঠিক করে রেখেছি, কখনও জিয়ানকে ডিভোর্স দেবো না। এভাবেই যতদিন যায় যাবে। আমার বিশ্বাস, আমার স্বামী একদিন আমাকে ঠিকই খুঁজে নিবে। কিন্তু বাবা আমার বিরুদ্ধে গিয়ে আবারও বিয়ে ঠিক করেছেন। বলেছেন জেদ করে ডিভোর্স না দিলে উনি সেই অবস্থায় বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। এলাকার সম্মানিত চেয়ারম্যান তিনি, ভীষণ কড়া আর এক কথার মানুষ। তাঁর কথা অমান্য করার সাহস পরিবারের কারো নেই। আমি জানি, কারও মাধ্যমে বাবাকে অনুরোধ করলেও কাজ হবে না।
কি করবো এখন, এ নিয়ে আমি ভয়ংকর চিন্তিত। আমার ছোট মেয়ে শিহা আমাকে ছাড়া এক সেকেন্ড থাকে না। আমাকে ছাড়া কারো সঙ্গে ঘুমোয় না। কারো হাতে ভাত খায় না। ঘুম থেকে উঠে আমাকে না দেখলে সে কাঁদে। কীভাবে এমন ছোট মেয়েকে রেখে আমি বিয়ে করব? কোন মায়ের পক্ষে এটা সম্ভব?
রাত গভীর। চেয়ারম্যানবাড়ি নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁঝি পোকার শব্দ ছাড়া আর কারও কোনো সাড়া নেই। শিহাকে বুকে নিয়ে এসব ভাবছি আর চোখের কোণা ভিজে বুকে গড়িয়ে পড়ছে নোনা পানি। শিহার দিকে তাকালাম৷ ঘুমন্ত অবস্থায় কি নিষ্পাপ লাগছে আমার ছোট্ট পাখি টাকে! তার মাথায় হাত বুলালাম, চুমু খেলাম। ফিসফিস করে বললাম, “তোমাকে রেখে আমি কোথাও যাব না মা। কোথাও না। তুমি আমার সাত রাজার ধন, আমার ভালোবাসার একমাত্র চিহ্ন।” তোমার জন্য প্রয়োজন হলে আমি আমার ভয়ংকর বাবার বিরুদ্ধে যাব। আমি পালাব, বাড়ি থেকে পালাব। তোমাকে নিয়ে থাকব।
বিয়ের মাত্র চার দিন বাকি। বাবা তার বিশ্বস্ত লোকজন নিয়ে ইতোমধ্যে বিশাল আয়োজন শুরু করে দিয়েছেন; কোনো কিছুর ত্রুটি রাখছেন না। তিন ছেলের মধ্যে একজন মেয়েই আমি। ভীষণ কড়া হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন। তাঁর মতে আমি জিয়ানের কাছে ঠকেছি; বয়স এখনও কম, নিজের ভাল নাকি বুঝি না। তিনি বলেছেন বেঁচে থাকতেই আমাকে ভালো ছেলের হাতে তুলে দেবেন। পাশের ইউনিয়নের কলেজের একজন ইংরেজি প্রফেসরের সঙ্গে তাই আমার বিয়ে ঠিক করেছেন।
সকাল হয়। সূর্যের লাল রশ্মির রেখা আলোকিত হয়ে পড়েছে পুরো বাড়িতে। বাড়ির বড়রা ইতিমধ্যেই উঠে গিয়েছেন। মা বড় ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরে পরোটা আর মুরগির মাংস রান্না করছেন। মাংস খসানোর ঘ্রাণ পুরো বাড়িতে মো মতো করছে। বিয়ে উপলক্ষে ফুপুরা আগেই এসেছেন, উনারা সকালের তারকারি কুটছেন আর গল্প করছেন।
বিয়ের জন্য বাবা বড় দুটো গরু কিনেছেন, ছোট ভাই তাকে খাবার খাওয়াচ্ছে। শিহা ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে মামার কোলে উঠে যেয়ে গরুর সঙ্গে বকবক করতে থাকে। আমি দূর থেকে সেটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি, তারপর মেয়েকে নিয়ে এসে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে যাই। মা নাস্তা সামনে এনে দেন, নিজে খাই আর মেয়েকে খাওয়াই। মেজো ফুফু বলেন, “ সবসময় মুখ ভার করে কেন থাকিস, নীহা? একটু হাসতে ও তো পারিস! সুন্দর মুখে বিয়েটা করে নে সোনা। জীবন এভাবে চলে না। জীবনের একটা গতি দরকার। স্বামী ছাড়া মেয়েরা চলতে পারে না। এখনও সময় আছে, জিয়ানকে ডিভোর্স দে। জানিস তো, ভাই কোন কিছুর পরোয়া করেন না। শিহার জন্য কোনো চিন্তা করিস না, ওকে আমরা দেখব।” মেজো ফুফুর কথায় সবাই একমত হয়ে আমাকে বোঝায়। আমি কোনো উত্তর দেইনি। কিছু বললেও কেউ বুঝবে না। বোঝার হলে আগেই বোঝত। সবার কাছে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, বাবা ধনী হোক বা গরীব, মেয়েরা স্বামী ছাড়া বাবার ঘরে থাকতে পারে না। যে কোনো পরিস্থিতিতেই তার স্বামী প্রয়োজন। এতে ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে ফের বিয়ে করলেও করতে হবে। কারও কথার কোন উত্তর দিলাম না৷
উঠে এসে বারান্দার বড় পিলারে ধরে ভাবলাম, মা বেঁচে থাকা অবস্থায় ছোট বাচ্চা অন্য কারও কাছে থাকবে! মায়ের বিয়ে হয়ে গেলে সে যখন খুশি মাকে পাবে না। মাঝরাতে কান্না করে ঘুম থেকে উঠে মায়ের শান্তির বুক পাবেনা। এসব ভাবতেই আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। আর এটাকে আমি কখনও বাস্তবে রুপ নিতেই দেবো না।
সেদিন রাতে আর ঘুম হলো না। শিহাকে ঘুম পাড়ানো শেষ করে উঠে বসে রুমের পেছনের দরজা খুলে বারান্দায় যাই। আকাশ আলো করে চাঁদ উঠেছে; সেই আলোয় আমাদের বাড়ি একেবারে চকচকে। সারারাত ওই আলোয় হেঁটে-ফিরে ভাবলাম কি করা যায়। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনো অবস্থাতেই আমি বিয়ে করব না। তাতে বাবা ত্যাজ্য করলেও আমি রাজি। সন্তানের জন্য মায়েরা সব করতে পারে। আমার বাবা আমার জন্য ভালো করলেও আমার বাচ্চার অকল্যান করছেন, আমি তাঁর বিরুদ্ধে যাবই। আমি পালাবো,বাড়ি থেকে পালাবো। শিহাকে নিয়ে থাকব।
রুমে গিয়ে নিজের ব্যাংক একাউন্ট, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখলাম। আজ রাত অনেক হয়ে গেছে; আজ পালাব না। আগামীকাল রাতে অবশ্যই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হবে। সকালে অনলাইনে টিকেট করে রাখব। কাল রাতেই ঢাকায় যাব। আমি পালানোর পরেও বাবা যদি আমার পিছু না ছাড়েন, আমি পুলিশের শরণাপন্ন হব।
রাত নয়টা বাজে। বাবা জরুরি কাজে একটু দূরে গেছেন, এখনও ফেরেননি। রান্নাঘরে খাওয়া চলছে। মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমিও খেয়ে নেই। মাকে বলি, “শরীর খারাপ লাগছে, আমি ঘুমাচ্ছি মা। কেউ যেন আমাকে না ডাকে।” এই বলে রুমে চলে যাই। যাওয়ার সময় বারান্দার শেষ মাথায় থাকা কারেন্টের মেইন সুইচ অফ করে দেই, সবাই ভাববে কারেন্ট চলে গেছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে রান্নাঘরে খাওয়ার পর্ব চলছে। সেই সুযোগে পেছনের দরজা খুলে রাখি। গায়ে শাল জড়াই, কাঁধে ব্যাগ তুলে নেই। বাহিরে বেশ ঠান্ডা। মেয়েকে গরম কাপড় পরিয়ে, ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে তুলে নিয়ে সাবধানে বাড়ি থেকে বের হই। আগে থেকেই গাড়ি রাস্তার পাশে রাখা ছিল। আমার কাজিন এই কাজে আমাকে সাহায্য করেছে। গাড়িতে উঠে পড়ি। গাড়ি চলতে শুরু করে। এখান থেকে কাউন্টার এক ঘন্টার পথ। রাত এগারোটার টিকিট কাটা আমার। দ্রুতই পৌঁছে যাব।
চলমান…!