ভীনদেশী তারা পর্ব-০২

0
2

#ভীনদেশী_তারা
শারমিন_প্রিয়া

২.

রাত এগারোটার বাসে উঠি। উঠার আগে মেয়ের আর আমার খাবার কিনে নেই। বাড়ি থেকে এখনও কোনো কল আসেনি, তার মানে কেউ এখনও বুঝতে পারেনি। কেউ বোঝার আগে বাসটা ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়লেই হলো। সব যাত্রী উঠার পর বাস ছেড়ে দেয়। আমি দুইটা সিট বুক করেছিলাম। শিহা এখনও ঘুমোচ্ছে, তাকে চুমু খেয়ে সিটে শুইয়ে দিই। এক হাত মেয়ের উপর রেখে আমিও মাথা হেলিয়ে দিই সিটে। জানলা আধো খোলা রেখে বাইরে চোখ রাখি। নির্জন রাতে শাঁ শাঁ শব্দে গাড়ি চলছে। শহরে কত রকমের আলো ঝলমল করছে,লাল, হলুদ, সাদা। আবার কখনও অন্ধকার। আলো-ছায়ার এই শহর যেন স্বপ্নপুরী মনে হচ্ছে।

এর থেকেও সুন্দর একটা শহর আমি চিনি। সেটা শুধু শহর না, এক যাদুকরী শহর । যে কেউ সে শহরের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে যাবে। চার বছর কাটিয়েছি আমি সে শহরে। সেখানে পড়ে আছে আমার আপনজনের থেকেও আপন একজন মানুষ। এই রাতে আমার খুব ইচ্ছে করছে সেই মানুষটার স্মৃতিতে ডুব দিতে। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডুব দিই আমি আমার অতীতে।

ছোট থেকে লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিলাম আমি। মা-বাবা স্বপ্ন দেখতেন আমাকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পড়াবেন। আমারও ইচ্ছে ছিলো বিদেশে গিয়ে পড়ার। এইচএসসি শেষে স্কলারশিপের জন্য আমি কয়েকটা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি। তার মধ্যে চীনের উহান ইউনিভার্সিটিতে BBA-তে চান্স পেয়ে যাই।

চীনের মানুষজন কেমন যেন মনে হতো আমার কাছে। প্রথমে ওখানে যেতে মন সায় না দিলেও অবশেষে যেতে হয়। যাওয়ার আগেই বাবা এজেন্টের মাধ্যমে কলেজ ক্যাম্পাসের পাশেই আমার জন্য বাসা ঠিক করে রেখেছিলেন।

ফ্লাইটের দিন হলো। মা, বাবা, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত সব মানুষ, মাতৃভূমি, সবকিছু রেখে একা অন্য দেশে যাচ্ছি। কীভাবে সেখানে থাকব, কী করব, কোনো বন্ধু পাবো কি না? এইসব ভেবে মন খারাপ হচ্ছিল ভীষণ। আকাশপথে এসব ভাবতে ভাবতেই জার্নি শেষ হলো।

বিমানবন্দরে নামার পর ভিড়ভাট্টা দেখে বুক আরও বেশি ধকধক করছিল। চারপাশে অপরিচিত মানুষ, কত রকম ভাষা। কারও ভাষা আমি বুঝতে পারছি না। এদিক-সেদিক এলোভাবে তাকাচ্ছি। ঠিক সেই সময়েই দূরে একজন লোককে দেখা গেল হাতে ছোট্ট প্ল্যাকার্ড—তাতে স্পষ্ট লেখা “Niharika।”

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। লোকটি এজেন্ট, যার সঙ্গে আগেই সব ঠিক করা ছিল। আমি কাছে গেলে উনি হেসে ইংরেজিতে বললেন,
“Miss Niharika? Welcome to Wuhan.”

কৃতজ্ঞ চোখে মাথা নাড়লাম। এজেন্ট লাগেজ টেনে নিতে লাগলেন আর বললেন,
“Your apartment is ready, very near to University. You don’t worry.”

তিনি একটা ট্যাক্সি ধরলেন। গাড়ি ছুটে চলল শহরের ভেতর দিয়ে। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি গাছ। গাছ থেকে লাল, হলুদ, কমলা রঙের পাতা বাতাসে উড়ছে। কি সুন্দর গাছগুলো। নাম অবশ্য জানিনা। দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার আলোয় পাহাড়ি দৃশ্য দেখে মনে হলো, এ তো ছবির মতো দেশ।

ফ্ল্যাটে পৌঁছে এজেন্ট সব বুঝিয়ে দিলেন, চাবি, প্রয়োজনীয় কাগজ, খাবারের দোকান কোথায়। তারপর বললেন, “Any problem, just call me.”

এজেন্টের এমন ব্যবহারে একা বিদেশে এসেও হঠাৎ একটু নিরাপদ বোধ করলাম। তবু ভেতরে অদৃশ্য ভয় কাজ করতে লাগলো। কীভাবে একা একা থাকব? বাড়িতে এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও আমি একা ঘুমাতে ভয় পেতাম। নিশ্চিত আজ রাতেও ঘুম আসবে না।

ফ্রেশ হয়ে আগে মা-বাবাকে কল দিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললাম। তারপর মোবাইলে কলেজ ক্যাম্পাস আর শহরের তথ্য দেখতে লাগলাম। কোথায় কী আছে, এইসব।

রাতে ঘুমানোর আগে সকাল আটটার অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। ঠিক সময়ে সেটা বেজে উঠতেই বারবার স্নুজ করে দিচ্ছিলাম। চোখে প্রচুর ঘুম। আমি যে বিদেশে আছি, খেয়ালই নেই। আরও দু’বার বাজতেই হঠাৎ মনে পড়ল আমি বিদেশে। মনটা চট করে খারাপ হয়ে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুললাম।

সকালের নরম মিষ্টি রোদ কাচের জানলা ভেদ করে ঘরে এসে পড়েছে, ঠান্ডা হাওয়ায় পর্দা নাচছে। মুচকি হাসলাম। সকালের শুরুটা ভালো লাগছে। মনে হলো, প্রকৃতি বোধহয় জেনে গেছে আমি ভিনদেশী। তাই এমন অভ্যর্থনা করছে।

হাত পা একটু টেনে, এক ঝটকায় বিছানা থেকে উঠলাম। শাওয়ার নিলাম। এখনো কোনো খাবার কিনিনি। এজেন্টের দেওয়া ইনস্ট্যান্ট কফি আর কিছু শুকনো খাবার টেবিলে রাখা ছিল। ইলেকট্রিক কেটলিতে কফি রেডি করলাম। কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালাম। ধোঁয়া ওঠা কফিতে চুমুক দিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলাম।

দূরে পাহাড়ে সবুজ আর নানান প্রজাতির সুন্দর গাছগাছালি। দেশে আসার আগে যতটা মন খারাপ ছিল, এখন আর তেমন লাগছে না। ভালোই লাগছে সবকিছু।

মোবাইলের রিং বাজতেই রুমে গিয়ে দেখি এজেন্ট কল করেছেন। রিসিভ করলে বললেন,
“আপনার বাসা থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই একটা স্ট্যান্ড আছে। ওখানেই দাঁড়াবেন। ইউনিভার্সিটির বাস যাবে। উঠে পড়বেন। আজ আপনার প্রথম ক্লাস। শুভকামনা রইল, মিস নীহারিকা।”

ঘড়িতে নয়টা বাজে। মা-বাবা হয়তো ঘুমোচ্ছে। তাই কল দিইনি। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি খেলাম। তারপর সময়মতো রেডি হয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বাসের অপেক্ষায় থাকলাম।

বাস আসতেই উঠে পড়লাম। মুগ্ধ চোখে জানলা দিয়ে দু’পাশের গাছের সারি, পাহাড় এসব দেখছি। প্রকৃতি যেন মন কেড়ে নিচ্ছে। মনে মনে ঠিক করলাম, একে একে সব ঘুরে দেখব, ছবি তুলব।

বিশাল বড় উহান কলেজ। চারিদিকে নানা দেশের মানুষ। বিভিন্ন ভাষা। কেউ জাপানিজ, কেউ কোরিয়ান, কেউ পাকিস্তানি। এতসব ভাষার মধ্যে হঠাৎ কানে বাজল নিজের পরিচিত ভাষা- বাংলা। দুজন ছাত্রী কথা বলছে বাংলায়। এরা হয়তো বাংলাদেশি বা ভারতীয়। ইচ্ছে হলো গিয়ে কথা বলি, কিন্তু সংকোচে আর পারলাম না।

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। অডিটোরিয়ামের বাইরে বড় বড় অক্ষরে লেখা “WELCOME”। অনেকে বক্তব্য দিলো, কথা বলল। তারপর ভলান্টিয়াররা ক্যাম্পাস, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, ক্যান্টিন ইত্যাদি ঘুরিয়ে দেখালেন।
আমার একটা খারাপ অভ্যাস আছে, আমি যেচে কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি না। তাই সহজে পরিচয়ও হয় না। আজও হলো না। একা একা খানিক ঘুরে আবার বাসায় চলে এলাম।

চলমান….!