#ভীনদেশী_তারা
শারমিন_প্রিয়া
৪
মারিয়া আপার কথা ঠিক হলো না। জিয়ানের সঙ্গে কলেজে আরেকবার মুখোমুখি হয়েছি আমি। লাইব্রেরিতে একটা বই খুঁজছিলাম, তখন উনার সাথে হঠাৎ দেখা। উনি বের হচ্ছিলেন লাইব্রেরি থেকে। চোখাচোখি হলে উনি মুচকি হেসে চলে গেলেন। এটা মোটেও উপেক্ষা করা নয়। রাতে মারিয়া আপুকে বললাম। মারিয়া আপু ঠোঁট বাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন, কোন কথা বললেন না। বিষয়টা আমার কাছে বেশ মজা লাগলো। আমি মুখ টিপে হাসলাম।
পরের বেশ কয়েকদিন জিয়ানের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আমার চোখ খুঁজতো উনাকে, কিন্তু দেখতে পেতাম না। একদিন ক্লাস শেষে বের হতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ছুটে একটা গাছের নিচে দাঁড়ালাম। পাতার ফাঁক দিয়ে টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছিলো গায়ের উপর। তখনই হঠাৎ দেখি পেছন থেকে জিয়ান দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একটা কালো ছাতা। আমাকে বললেন, “You are safe now. স্ট্যান্ড অব্দি আমার সঙ্গে গেলে চলো। গাড়িতে উঠতে পারবে।” আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে উনার সাথে যেতে লাগলাম। দু’কদম পার হতেই বৃষ্টির গতি বাড়ল। বাতাসের ঝাপটায় জিয়ানের হাত থেকে ছাতা উড়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে একসঙ্গে হেসে উঠলাম দু’জন। হাসি শেষ হচ্ছিল না আমার, যে আমাকে সেফ করতে এসেছে তারই এখন বেহাল অবস্থা। জিয়ান হাসতে হাসতে বললেন, “বৃষ্টি চাচ্ছে, তার ফোটায় আমরা ভিজি। ভিজবে তুমি?”
“ভিজব?”
“তাহলে চলো, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে লেকের ধারে যাই। দেখবে বৃষ্টির ফোটা পড়ে লেকের পানি অদ্ভুত সুন্দর আকার ধারণ করে।”
হেটে ভিজে ভিজে আমরা ওখানে যাই। সত্যিই কি সুন্দর করে বৃষ্টির ফোটা পড়ে ফেনা তুলছিল লেকে। গাছগুলো সব নুয়ে গেছিল। পাতারা চকচক করছিল। লেকের পানিতে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাগুলো হাজারও ছোট ছোট বৃত্ত তৈরি করছে। কী অসাধারণ দৃশ্য!
যখন জিয়ানের দিকে চোখ দিলাম, তখন মনে হলো, এই প্রকৃতির সবথেকে সুন্দর দৃশ্য আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে: ধবধবে ফর্সা চেহারার জিয়ান। চোখে মুখে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। সাদা শার্ট জিয়ানের গায়ে ছিল। শার্ট ভিজে চেপে লেগে আছে, জিয়ানের বুকের রেখাগুলো স্পষ্ট চকচক করছে। ছেলেদের চেহারাও যে এত আকর্ষণীয় হয়, এর আগে আমি জানতাম না। তার গোলাপি ঠোঁটে বৃষ্টির বিন্দু-বিন্দু ফোটা জমে আছে। এটা দেখে উথাল-পাথাল হয়ে উঠলো আমার বুক। আমি আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। আমার তাকানো দেখে জিয়ান ভ্রুকুটি উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে?”
আমি তার কথার উত্তর দেইনি। দ্রুত তার কাছে গিয়ে তার মাথা নুইয়ে ঠোঁটজোড়া আলতো করে কামড়ে ধরলাম। হৃৎস্পন্দন এত জোরে বাজছিল যে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি ঠোঁট সরিয়ে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, “এই বুকে আমাকে জায়গা দিন। আমি স্থির থাকতে পারছি না। আপনি আমাকে পাগল করে দিয়েছেন। শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন আমাকে। আমাকে স্থির হতে দিন।”
উনি আমার মাথা হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হয়েছে কি নীহারিকা? এমন করছো কেন? তুমি ঠিক আছো?”
নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে উনাকে ছেড়ে দিলাম। জোরে শ্বাস নিয়ে বসে পড়লাম পাথরের আসনে। উনি আমার কাছে এসে বসলেন, মৃদু হেসে বললেন, “এটা তুমি কি করলে? শুরু করলে শেষ করলে না কেন?”
“মানে?”
“মানে বুঝাচ্ছি”—বলেই দু’হাত দিয়ে আমার মাথা ধরে ঠোঁটে চুমু খেলেন অনেকক্ষণ। আমার মনে হচ্ছিল নিজেকে উজাড় করে দেই। নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। উনি ছেড়ে দিয়ে মুখে সেই হাসি বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “হয়েছে? নাকি আরও চাই?”
লজ্জায় লাল হয়ে উঠলাম। কি করে বসলাম হুট করে। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, “আপনি সত্যিই এত সুন্দর? নাকি আমার চোখেই এত সুন্দর?”
উত্তর না দিয়ে উনি জোরে হাসলেন।
কাতর চোখে বললাম, “এভাবে হাসবেন না। আমি কন্ট্রোল থাকতে পারি না। আচ্ছা, ভার্সিটির সবাই যে বলে, আপনি মেয়েদের ফিরেও দেখেন না, প্রেমও করেন না,তাহলে এখন কেন এটা করলেন?”
“কে বলছে দেখিনা? এই যে তোমাকে দেখছি। আর আমি কিছু করিনি। তুমি অসমাপ্ত রেখেছিলে, আমি সমাপ্ত করেছি।”
“অনেক চালাক আপনি। আবার বলছি, সরি। বৃষ্টি থেমে যাচ্ছে, যেতে হবে। কাউকে এসব বলবেন না প্লিজ। লজ্জায় মাথা কাটা যাবে আমার।”
“তুমি যাও। আমি আরও কতক্ষণ এখানে কাটাব, আমার বৃষ্টি ভালো লাগে।”
আমি চোরা চোখে উনাকে দেখতে দেখতে চলে আসলাম। বাসায় এসে ড্রেস চেঞ্জ করলাম। মারিয়া আপা দেখি এখনও আসেননি। বিছানায় শুয়ে পড়লাম। বারবার সেই দৃশ্য ভাসতে লাগল। মনে হলো, জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা দিন ছিল আজ আমার। এই মুহূর্তটা যদি সবসময় থাকতো কত না মধুর হতো। এত সুন্দর, হ্যান্ডসাম, স্মার্ট একটা ছেলে। তার ঠোঁটে কি যে সুখ! জানিনা কার ভাগ্য এত ভালো, যার স্বামী সে হবে। বারবার আয়নায় নিজের ঠোঁট দেখতে লাগলাম। জিয়ানের ঠোঁটের ছোয়া লেগে আছে তাতে। মনে মনে বললাম, আরেকটা এমন দিন আসুক। আমি ঠোঁট ডুবিয়ে আর তুলবো না।
সকালে মনে হলো কাজটা ঠিক করিনি; আমি আবেগে করে ফেলেছি। এখন অপরাধবোধ কাজ করছে। দুই দিনের পরিচিত একজনকে এভাবে হঠাৎ করে কিস করা অনুচিত, আমি আর মুখোমুখি হতে পারব না। কীভাবে ভার্সিটি যাব! কেমন কেমন যেন লাগতে লাগলো। ভার্সিটি গিয়ে উনাকে দেখতে মন চাইলেও লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতাম। এভাবে কেটে গেল আরও অর্ধ মাস। উনাকে মাঝেমধ্যে মনে পড়তো, মনে পড়তো সেই দৃশ্যের কথা। তবু নিজে শান্তি পেলাম, যাইহোক প্রেমে পড়িনি, ভালোবাসিনি। নয়তো অস্থির লাগতো। লেখাপড়া করতে লাগলাম মনোযোগ দিয়ে। সামনে এক্সাম, হাতে একটু সময় নেই। মা-বাবার কথা ইদানীং খুব মনে পড়ে। বিকেলে যখন পাখিদের আকাশে উড়তে দেখি, তখন মনে হয়, যদি একবার পাখি হতাম, তাহলে উড়ে গিয়ে মা-বাবাকে দেখে আসতাম, দেশের ঘ্রাণ নিয়ে আসতাম।
একদিন মা-বাবার জন্য এমনভাবে মন খারাপ হলো। মনে হলো এখনই কান্না করে দেব। মায়ের কাছে কল করতে পারতাম, কিন্তু কথা বলতে গেলেই আমি কান্না করে দেব, এটা নিশ্চিত। আর এটা লজ্জার। তাই মন ভালো করতে চলে গেলাম ইস্ট লেকের ধারে। কতক্ষণ নিরিবিলিতে কাটালে ভালো লাগতে পারে।
সেদিনের মতো আজ নিরিবিলি নয় লেক, লেকের ধারে আজ অনেক কাপল বসে আছে। আমি একটা আসন পেয়ে বসে পড়লাম। চুপচাপ দেখতে লাগলাম পাহাড়, ঝর্ণা আর লেক। ডানে জিয়ানকে এদিক আসতে দেখে ধুকপুক করে উঠলো আমার বুক। এতদিন শান্ত থাকলেও জিয়ানকে দেখে অস্থির হয়ে উঠলাম। মনে হলো পাহাড়ের চিপায় গিয়ে লুকিয়ে থাকি, কেন এমন হচ্ছে উনাকে দেখে, কে জানে। উনি কাছে এসে বসলেন, বললেন, “অনেক দিন পর দেখা। কলেজেও দেখি না। এড়িয়ে চলো নাকি আমাকে?”
“না, এমন কিছু না। এক্সাম তো, সময় পাইনা।”
“মলিন দেখাচ্ছে তোমায়। কি হয়েছে?”
“কিছু না। বাড়ির কথা, দেশের কথা মনে পড়ছে।”
উনি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, “কেমন তোমার দেশ? বাড়ি?”
এটা জিজ্ঞেস করতেই মুখে হাসি ফুটলো আমার। আগ্রহ নিয়ে বলতে লাগলাম, “আমার দেশ খুব সুন্দর। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সকালে মধুর সুরে পাখি ডাকে। আপনাদের মতো আমাদের অনেক পাহাড় আছে। পাহাড়গুলো পাইন গাছের মতো লম্বা লম্বা। সুন্দরবন আছে আমাদের দেশে, যেটা বিখ্যাত। সুন্দর সুন্দর নদী আছে। সাদা পাথর আছে। আরও অনেক কিছু। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সকালের আকাশ, কি সুন্দর নিরিবিলি থাকে, মনকাড়া বাতাস থাকে, পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকে। আর সকালের আকাশটাও থাকে মনোমুগ্ধকর! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ইশ, কত দিন দেখিনি এসব ।”
“কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয়। মন খারাপ না করে পড়ায় মনোযোগ দাও। কয়টা বছর, দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে।”
“জানো, আমার বাড়িও দূরে। বছর হয়ে গেছে বাড়ি যাইনি। মনে পড়ে; কিন্তু ফোকাসটা এখন পুরোপুরি পড়াশোনায় দিচ্ছি। শীতকালে ছুটি পেলে তখন যাব।”
“কোথায় আপনার বাড়ি?”
“এই শহর থেকে অনেকটা দূরে, সিচুয়ান প্রদেশের শাংরিয়া গ্রামে আমাদের বাড়ি। খুবই শান্তিপূর্ণ জায়গা সেটা। শীতকালে পুরো গ্রাম সাদা হয়ে উঠে তুষারে। আমার দাদার পুরনো একটা কাঠের ঘর আছে, শীতকালের রাতে সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা রাতের তুষার পড়া দেখি, আকাশ দেখি। অনেক অনেক সুন্দর সে জায়গা।”
“তুষার? এত সুন্দর? আমি কখনও তুষার পড়া দেখিনি। নিশ্চয়ই অসম্ভব সুন্দর হবে ওই জায়গাটা!”
“হুম। তুমি যাবে নাকি আমার বাড়িতে তুষার দেখতে?”
“আমি? আমি কীভাবে যাব?”
“ আরে, আমার সাথে। ভয় পাচ্ছো আমাকে? আরে, আমরা ভালো মানুষ। ভয় পেও না। তোমায় নিয়ে ফেলে দেবো না। চলো একদিন দেখে আসবে। আমি বাজি ধরলাম, আমার গ্রামের দৃশ্য তোমার মন কেড়ে নিবে।”
চলমান…..!