ভীনদেশী তারা পর্ব-০৫

0
6

#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া(৫)

এভাবে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে, কথা হয়ে, একসময় ভালো সম্পর্ক হয়ে গেলো জিয়ান আর আমার মধ্যে। ছুটির দিনে সে আমাকে নিয়ে কফিশপে যায়। কাছাকাছি দেখার মতো কোনো জায়গায় নিয়ে যায়। অনেক কথা হয়, আড্ডা হয় আমাদের মধ্যে। কলেজের প্রায় সবাই ধরে নিয়েছে আমরা কাপল, তবে বাস্তবে এখনও সেরকম কিছু হয়ে উঠিনি। আমার উনাকে ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে। জড়িয়ে ধরতে মন চায়। কিন্তু আমি এসব ভুলেও প্রকাশ করি না। সেও আমার অনেক প্রশংসা করে, কেমন করে যেন মাঝেমধ্যে তাকিয়ে থাকে। আমার মনে হয় উনিও আমাকে পছন্দ করেন। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগ কথা হয় দেশ, প্রকৃতি আর পড়াশোনা নিয়ে।

এক্সাম শেষ হয়। এক্সাম শেষ হলেই উনি আমাকে অফার করেন উনার গ্রামে যাওয়ার জন্য। মারিয়া আপা যেতে নিষেধ করছিল, কিন্তু আমি মানিনি। জিয়ানের প্রতি আমি এতটা ডুবে গেছি যে সে যেখানে বলবে সেখানে যেতে আমি রাজি। তাছাড়া মানুষটা মোটেও খারাপ নয়, এতটুকু চিনতে পেরেছি।

শীতকাল পড়ে গেছে। সারাদিন ঠান্ডা মোটামুটি থাকলেও রাত হলে গা-শিরশির ঠান্ডা পড়ে। জিয়ান রেডি হয়ে আমাকে কল করে জানিয়েছে, তাড়াতাড়ি যেন পৌঁছে যাই। আমি মেরুন রঙের লম্বা উলের কোট গায়ে পরলাম। গলায় জড়ালাম স্কার্ফ। হাতে উলের গ্লাভস। মোটামুটি ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য আমি প্রস্তুত। বের হয়ে কাউন্টারে যাই। জিয়ান আগে থেকে বসা ছিল। বাসে উঠে পড়ি। রাতের অন্ধকারে বাস এগিয়ে চলেছে। জানালার বাইরে কাচে জমে থাকা শিশিরের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে, বাতাসে শীতের তীব্রতা এত প্রখর যে, জানালা খোলাই যাচ্ছিল না। ফলে উহান শহরের শীতের রাতের প্রকৃতি দেখতে পারলাম না।

ধীরে ধীরে ঠান্ডার গতি বাড়তে থাকলো। ভেতরে হিটারের হালকা গরম হাওয়া থাকলেও আমার শরীর কাঁপছে। কোটটা আঁকড়ে ধরেও যেন উষ্ণতা মিলছে না। আমার অবস্থা জিয়ান টের পাচ্ছিল। তাই আলতো করে হাত বাড়িয়ে আমার হাতটা ধরল। চোখাচোখি হতেই মৃদু হাসল সে। আমি ইতস্তত করে কুঁকড়ে গিয়ে হালকা করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। জিয়ানের ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল। তাকে দেখে মনে হলো, সে বোধহয় এটারই অপেক্ষা করছিল। পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তার স্পর্শে মনে হলো, শীতল রাতটা মুহূর্তে উষ্ণ হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ পর বাস শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে গ্রামীণ পথে ঢুকে গেল। মাঝরাতে বাস থামল বিরতিতে। শীতের রাতে সবাইকে গরম চা খাওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো। মাঝারি সাইজের কাঠের চায়ের দোকান। শুধু চা নয়, বিভিন্ন খাবার আইটেমও রয়েছে। আমি বসলাম চায়ের দোকানের বারান্দায়, যাতে চারপাশ দেখতে পারি। বাহিরের দৃশ্য দেখে তো অবাক হয়ে গেলাম, চারপাশে তুষার আর তুষার। তুষারে ঢাকা প্রান্তর। গাছগুলোর ডালে ঝুলছে বরফের ঝাড়বাতির মতো বরফকণা। সাদা রঙের চাদরে ঢাকা যেন এক পরীর রাজ্য। দূরে দূরে ছোট ছোট ঘরবাড়ির ছাদের ওপর মোটা তুষারের আস্তর জমে আছে। সেসব বাড়িগুলো থেকে আগুনের আলো ও দেখা যাচ্ছে।

জিয়ান ধোঁয়া উঠা গরম চা আর মোমো নিয়ে আমার পাশে এসে বসল। আমার হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিলো। ঠান্ডায় হাত জমে যাচ্ছিলো, গরম কাপ হাতে নিয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। জিয়ান চা আর মোমো খাচ্ছে। আমি চা খেতে খেতে আকাশ দেখছি। তুষারের মধ্যেও আকাশ পরিষ্কার। তারাগুলো ঝলমলে। দূরে পাহাড়ের গায়ে জমে থাকা বরফে চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছে। জিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“গ্রামের শীতকাল সবসময়ই এরকম। আমি ছোটবেলা থেকে এই দৃশ্য দেখে বড় হয়েছি। এখনও অনেক দেখার বাকি আছে। সময় শেষ। চলো।”

বাস আবার চলতে শুরু করল। গ্রামের পথে তুষার ঝরে পড়ছে আলতো করে। হেডলাইটের আলোয় ঝরে পড়া তুষারকণা নাচছে ঝলমলে হীরের মতো।

মুগ্ধ হয়ে বলে উঠলাম,
“এটা তো একেবারে রূপকথার মতো।”
জিয়ান শক্ত করে হাত ধরে বলল,
“বলেছিলাম না, আমার গ্রামের প্রেমে পড়ে যাবে তুমি।”

ভোর হতে আর কিছুক্ষণ বাকি। বাস থামল একটা ছোট্ট স্টপেজে। জিয়ান আমাকে নিয়ে নামল। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু হালকা বাতাসে শিস বাজছে। তুষারের আস্তরণে ঢেকে আছে পুরো পথ। বাস থেকে নামতেই শীতের হিমেল হাওয়া আমার গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। কোটের কলার আরও উঁচু করে নিলাম।

সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট একটা ঘোড়ার গাড়ি। সাথে দুজন পুরুষ মানুষ। একজন বোধহয় গাড়োয়ান, আরেকজন ইয়াং ছেলে। পরণে কোট, মাথা থেকে পা অব্দি আবরণ। শুধু মুখ দেখা যাচ্ছে। দেখতে একদম জিয়ানের মতো৷ ফর্সা, মুখের গড়ন ও সুন্দর । উনি জিয়ানকে হেসে চায়না ভাষায় কী বলল বুঝতে পারলাম না। জিয়ান আমাকে বলল, “ও আমার ছোট ভাই। নাম শিয়াং।” শিয়াং হেসে ইংরেজিতে আমাকে বলল,
“ওয়েলকাম মিস নীহারিকা। চলুন এবার।”
আমরা উঠে পড়লাম। গাড়োয়ান গাড়ি টানতে লাগলেন।

ঘোড়ার গাড়ি এগোতে লাগল সরু পথ ধরে। তুষারে পায়ের ছাপ ফেলে দৌড়াচ্ছে কয়েকটা গ্রামীণ কুকুর। দূরে দূরে ঘরের ভেতর আগুনের আলো ঝিলিক দিচ্ছে।

প্রায় ২০ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম জিয়ানের বাড়িতে। পুরনো কাঠের তৈরি দুইতলা বাড়ি। ছাদের ওপর মোটা তুষার জমে আছে। দরজার সামনে লাল কাগজের লণ্ঠন ঝুলছে।

জিয়ানের মা হাসিমুখে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমি অচেনা হলেও অচেনা ভাব দেখালেন না। চায়না ভাষায় কিসব বললেন, শিয়াং বুঝিয়ে দিলো আমাকে, উনি বলছেন,
“তুমি নিশ্চয়ই বাংলাদেশ থেকে এসেছো? জিয়ান অনেকদিন ধরে আমাদের বলছিল। এসো মা, ঠান্ডায় জমে গেছো নিশ্চয়ই।”

আমি অবাক হয়ে জিয়ানের দিকে তাকালাম।
“আপনি আমার কথা বলে দিয়েছেন?”
জিয়ান মৃদু হাসলো।

ঘরে হিটার চালু করা, বিধায় ঠান্ডা কম লাগছে। টেবিলে খাবার সাজানো। আমাকে আর জিয়ানকে বসানো হলো। দেখি সব পরিচিত খাবার রাখা। জিয়ানের দিকে তাকালাম, ও বলল,
“মাকে বলেছি তুমি যা যা খেতে পারো তা রান্না করতে। মা ইউটিউব দেখে করেছেন।”
আমি জিয়ানের মায়ের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা দেখালাম।

খাওয়ার পর খাটের ওপর বসে আছি জিয়ান, আমি, শিয়াং আর ওদের মা। মা-ছেলেরা গল্প করছেন জমিয়ে। হাসছেন। অনেক দিনের জমানো গল্প বোধহয় করছে মা-ছেলে। তখন পাশের রুম থেকে চোখ কচলিয়ে একটা মেয়ে আসলো, আমার বয়সী। জিয়ান এগিয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মেয়েটা আমাকে দেখে জিয়ানকে কী একটা বলল। তারপর আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল,
“তোমার কথা ভাইয়া বলেছে। তুমি অনেক সুন্দর। জমিয়ে আড্ডা দেবো আমরা, কেমন?”

উনাদের এত আন্তরিকতা দেখে আমিও কেমন ফ্রি হয়ে গেলাম। শিয়াং বলল,
“মিস নীহারিকা, ঘুম পাচ্ছে নিশ্চয়ই। ভোর হয়ে যাচ্ছে, আমাদের সকাল হয় অনেক সুন্দরভাবে। সকাল শুরু হওয়া দেখে ঘুমিয়ো।”
আমি রাজি হয়ে গেলাম। জিয়ান মা আর বোনের সাথে গল্প করছে। শিয়াং আমার সাথে কথা বলছে। আমার দেশ কেমন, পরিবার কেমন, এখানে এসে কেমন লাগছে,এইসব কথাবার্তা। তিন ভাইবোন ভীষণ সুন্দর আর স্মার্ট। আমার খুব ভালো লাগলো তাদের। বিশেষ করে জিয়ানের মাকে। জিয়ান বলল,
“আমাদের পরিবারে অনেক মানুষ। সকাল হলে দেখতে পাবে।”

একটু পরেই বাহির থেকে পাখির ডানার শব্দ ভেসে আসছে। শিয়াং বলল, “চলো, বাহিরে। সকাল হওয়া দেখবে।”
আমি উঠে গেলাম শিয়াংয়ের সাথে। আকাশ সোনালি হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। উঠোনে পা রেখেই বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে গেল। চারপাশে তুলার মতো সাদা তুষার। বাঁশের বেড়ায় ঝুলে আছে বরফের কণিকা, সূর্যের আলো পড়তেই তারা যেন হীরের মতো ঝিলমিল করছে।

কয়েকটা শিশু রঙিন জ্যাকেট পরে উঠোনে তুষার নিয়ে খেলা করছে। তারা ছোট ছোট বল বানিয়ে ছুড়ছে একে অপরকে। তাদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। আমি হাত বাড়িয়ে বরফ ছুঁলাম। শীতল ভীষণ।

পেছন থেকে জিয়ান এসে দাঁড়াল। হালকা গলায় বলল,
“কেমন লাগছে আমার গ্রামের ভোর?”

আমি মৃদু হাসলাম।
“মনে হচ্ছে কোনো ছবির ভেতরে আছি।”

জিয়ান বলল,
“ঠিক আছে। অনেক দেরি হয়ে গেছে। চেহারা শুকিয়ে আসছে। চলো এখন ঘুমাবে। বিকালে উঠে মজা করবে।”

চলমান….!