#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া(৯)
রাতে মায়ের কাছে কল দিলাম। এই সেই নানান রকম কথা বলতে বলতে একসময় কাপা-কাপা গলায় বলে দিলাম জিয়ান আর আমার কথা। মা শুনে চুপ করে থাকলেন। তারপর বকলেন, “আমি তোকে এসব করার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছি। দু’দিন তোকে নিয়ে কাটাবে, ঘুরবে-ফিরবে, তারপর ফুর্তি করে উড়াল দিবে। এসব ফাঁদে পা দিস না, মা। পড়ালেখায় মন দে। ওসব ভুলে যা।”
যখন কেউ আমার জিয়ানকে খারাপ বলে, বলে সে আমাকে ইউজ করে ফেলে দেবে, তখন আমার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো স্থির থাকে না। সেই মানুষটার প্রতি এক আকাশ পরিমাণ ক্ষোভ জন্মে। জিয়ানকে যদি খারাপ ছেলে বলা হয়, তাহলে ভালো কারা? নিজেকে কন্ট্রোল করে মাকে আরও বুঝালাম, “ছেলেটা অনেক ভালো। আমি তাকে খুব ভালোবাসি, মা।”
মা বললেন, “তোমার বিচার-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। প্রেমে পড়লে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তোমার বেলায়ও তাই হয়েছে, নীহা। তোমার বাবাকে তুমি চেনো, এসব শুনলে ত্যাজ্য করবেন তোমায়। আমাকেও ঘরের বাহির করে দেবেন।’’
“আমি জিয়ানকে ছাড়তে পারব না, মা। আমি জিয়ানকে বিয়ে করব। বাবাকে বলে দিয়ো। বাবা যদি তোমার সাথে কিছু করেন বা এই বিয়ে মেনে না নেন, দেশে কিন্তু আমি যাব না, আমার লাশ যাবে।”
ফোন কেটে দিয়ে বারান্দায় বের হয়ে বসে পড়লাম; দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে। চোখ কতক্ষণ বন্ধ করে আবার খুললাম। শা-শা শীতল বাতাস এসে শিহরণ তুলছে গায়ে। ঝলমলে শহরের মৃদু আলো পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছে। না অন্ধকার, না চকচকে আলো — অন্যরকম লাগছে। এই মুহূর্তে আমার জিয়ানকে পাশে পেতে ইচ্ছে করছে। সংকট, দ্বিধাগ্রস্ত, একাকী, টেনশনের মুহুর্তে প্রিয় মানুষকে কাছে পেতে মন চায়, কী এক আশ্চর্য সায়েন্স এটা! ভিন্ন রক্তের, ভিন্ন গোত্রের, ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন দেশের মানুষ হয়ে কীভাবে হৃদয়ের সাথে এত মিশে যেতে পারে, আমি বুঝি না।
মা বারবার কল দিচ্ছেন। মায়ের প্রতিও আমার মায়া কাজ করে, মা-কে টেনশন দিতে একদম ইচ্ছে করে না। কিন্তু জিয়ানকে আমি ছাড়ছি না। মা আমাকে ভালোবাসেন, বাবা ও বাসেন। বাবা একটু বেশি গরম এটাই। উনাদের অমতে বিয়ে করলে তারা হয়তো কথাই বলবেন না, রাগ করবেন। কিন্তু কতদিন আর করবেন? একসময় ঠিকই বুকে টেনে নিবেন আমায়। আল্লাহ পাক এতটা মমতা পিতা-মাতার ভিতরে দিয়ে দিয়েছেন। আর উনাদের মর্জি রাখতে গিয়ে যদি জিয়ানকে বিয়ে না করি, তাহলে চিরজীবনের জন্য জিয়ানকে হারাতে হবে। এমনটা আমি বেঁচে থাকতে দেবো না। আমি বিয়ে করবই। করে মাকে জানাবো। যা হওয়ার হবে।
থার্ড ইয়ারের এক্সাম শেষ হলেই আমরা বিয়ের তারিখ ফেলি। জিয়ান উহান শহরের “ ব্লসম ব্যাঙ্কোয়েট হল” ( কাল্পনিক) বুক করছিল। রাতে বিয়ে হবে। ওখানে রুম বরাদ্দ আছে। রাতটা হল-এ কাটাব আমরা। গ্রাম থেকে জিয়ানের ভাই-বোন এসেছিল। জিয়ানের বাবা সন্দেহ করবেন বলে মা আসেননি। কাল রাতেই আমার বিয়ে। কেনাকাটা ও শেষ। বুকটা খচখচ করছিলো। কীভাবে মাকে না জানিয়ে জীবনের নতুন অধ্যায়ে পা দিই? কল করলাম মাকে। কান্না করে বললাম, “কাল বিয়ে আমার, জিয়ানের সাথে। আমি জানি আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছি, তবু আমাকে অনুমতি দাও। আমি জিয়ানকে অনেক ভালোবাসি, মা। আমি বেঁচে থাকব না তাকে ছাড়া। যতক্ষণ না রাজি হও, আমি ততক্ষণ কান্না করবো।” মা রাজি হননি। ফোন কেটে দেন।
মারিয়া আপা কল করে অনেক বুঝালেন মাকে। বললেন, “নীহারিকা না খেয়ে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে উঠছে, আন্টি। জিয়ান অনেক ভালো ছেলে। নীহারিকা ভালো থাকবে। আপনি মেনে নিন।” মা তাও ফোন কেটে দিলেন।
আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। দ্বিধায় ভুগছিলাম। শেষরাতে মায়ের কল দেখে লাফিয়ে উঠি আমি। তাড়াতাড়ি রিসিভ করি। উনি কতক্ষণ নীরব থেকে নরম গলায় বললেন, “তুমি যখন এতই ভালোবাসো, তাহলে বিয়ে করো। আমার দোয়া রইলো।”
আসমানের চাঁদ হাতে পেয়েছি এমন অবস্থায় আমি খুশিতে মারিয়া আপাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা বললেন, “ছেলেটার সাথে আমার কথা বলাই দিও। আর বউ সেজে ভিডিও কল দিও।”
মা সাথে আছেন তো সব আছে। আমার আর টেনশন থাকলো না। সকালে পার্লার থেকে মেহেদী পরে আসলাম। বিকেলে পৌঁছে যাই হলে। উপস্থিত সবাই ছিলো ওখানে। জিয়ানের মুখোমুখি হইনি। খুব সুন্দর করে সাজানো ছিল স্টেজ। আমাকে মারিয়া আপু সাজিয়ে দিলো। আমি আমার দেশের ঐতিহ্য লাল শাড়ি পরে বিয়ের পিসিতে বসলাম। মেহমান হিসেবে ছিলো শিয়াং ও শাওলি, জিয়ানের অল্প কয়েকজন বন্ধু, আমি আর মারিয়া আপা। একজন হুজুর এসে আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। জিয়ান বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল আর চোখ টিপছিল। সে পরেছিলো কালো শেরওয়ানি, শেরওয়ানির বর্ডারে চেরি ব্লসম ফুলের এমব্রয়ডারি ছিল। মাথায় রুপালি ছোট্ট টুপি। কালো শেরওয়ানি আর চেরি ব্লসমের ডিজাইনে জিয়ানকে রাজপুত্র লাগছিল। সামনে সবাইকে উপেক্ষা করে ঘন্টার পর ঘন্টা তার দিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইছিল।
বিয়ে শেষে সবাই অভিনন্দন জানাল। খাওয়া হলো। ইমাম চলে গেলেন। তিনটি রুম বুক করা ছিল। এক রুমে শিয়াং আর জিয়ানের বন্ধুরা ছিল, অন্য রুমে মারিয়া আপা ও শাওলি। সবচেয়ে সুন্দর রুমটি সাজানো ছিল আমাদের বাসর ঘর। রুমে যাওয়ার আগে মায়ের কাছে কল দিলাম। বউয়ের বেশে আমাকে দেখে মা আবেগী হয়ে উঠলেন। আমার সঙ্গে কথা বলে জিয়ানের সঙ্গেও কথা বললেন। জিয়ানকে দেখে উনি অনেক খুশি হয়ে উঠলেন। মায়ের মুখে মৃদু হাসি দেখে মনে হচ্ছিল মায়ের দুশ্চিন্তা কমে এসেছে। মা অনেক দোয়া দিলেন।
রাত বারোটার কাছাকাছি। শাওলি আর মারিয়া আপা আমাকে আমার রুমে নিয়ে গেলো।“রাতটা উপভোগ করো,” বলে দুষ্টু হেসে তারা দুজন বের হয়ে গেলো। রুমটা দেখে বিস্মিত হলাম আমি, অনেক সুন্দর করে সাজানো। রুমজুড়ে ছড়িয়ে আছে গোলাপ আর চেরি ব্লসমের পাপড়ি। মেঝে থেকে বিছানার চারপাশে লাল-সাদা পাপড়ির কার্পেটের মতো বিছানো। চারপাশে রাখা গোলাপ আর টিউলিপের ফুলদানি; সারা ঘরে মিষ্টি সুগন্ধি ছড়িয়ে আছে। বিছানার চারকোণে ঝুলছে লাল রঙের হালকা ঝালর, উপরে ছোট ছোট ফেয়ারি লাইট টিমটিম করছে। আলোটা খুব বেশি উজ্জ্বল নয়, একদম মৃদু, কোমল। মোমবাতিগুলো কাঁচের ছোট ক্যান্ডেলহোল্ডারে সাজানো, যা আলোকে আরও নরম করেছে। দুজন ভালোবাসার মানুষ এক হওয়ার রাতের পারফেক্ট সাজ তৈরি হয়েছে। আমি লাজুক ভঙ্গিতে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলাম, সত্যি অনেক সুন্দর লাগছে আমাকে!
মিনিট পাঁচেক পর জিয়ান রুমে ঢুকলো। দরজা দিয়ে সে এসে বসে পড়লো আমার খাটে। লজ্জা লাগছিল ভীষণ, আঙুলে আঙুল জড়িয়ে নাড়াচাড়া করছি শুধু। এক চোখ বন্ধ করে আড়চোখে তাকালেই দেখি জিয়ান মিটিমিটি হাসছে। আমি হুদাই এক আঙ্গুল দিয়ে ঘষতে লাগলাম ললাট। জিয়ান আরও কাছে এসে বসলো, ললাট ধরে মুখ উঁচু করে তুললো। “তাকাও আমার দিকে।”
সারা মুখময় হাসি আষ্ঠেপৃষ্ঠে লেগে আছে আমার। লজ্জা লজ্জা চোখে তাকালাম জিয়ানের দিকে। আঙ্গুল ছুঁয়ে কপাল থেকে ললাট অব্দি নামাল সে। মৃদু কন্ঠে বলল, “আজ তোমাকে অনেক অনেক আর অনেক সুন্দরী লাগছে। তোমার সৌন্দর্যের কাছে চারপাশের সবকিছু ফিকে লাগছে।”
গাল লাল হয়ে উঠলো আমার। চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বললাম, “তুমি না হলে এই সৌন্দর্যের দামটা থাকতো? তোমার জন্যই সব!”
জিয়ান মৃদু হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ মেঘমালা! মনে আছে আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা? আর দ্বিতীয়বারের স্মৃতিটা কি মিষ্টি ছিল! কোথা থেকে হঠাৎ করে তুমি আসলে, আমাদের দেখা হলো, কথা হলো।তারপর আচমকা তুমি হৃদয়ের এত কাছে চলে আসলে। এতটা ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। যার ফলসরুপ আজ তুমি আমার স্ত্রী। আজ থেকে তুমি শুধু আর শুধুই আমার। জানো তো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এখনও। সব যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।”
হাত বাড়িয়ে জিয়ানের হাত ধরে বললাম “ স্বপ্ন তো ভোর হলেই ভেঙে যায়। আমি তোমার স্বপ্ন নয়, আমি বাস্তব। ভোরের আলোয় ভেঙে যাব না, যতদিন আছি একসাথে থাকব। তুমি আমার জান, জিয়ান। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
জিয়ান আরও কাছে এগোল। দু’জনের নিশ্বাসের শব্দ কাছে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। সে কানের কাছে মাথা নিয়ে ফিসফিস করে বললো, “আমি চাইনা আজ কোন কথা দিয়ে বোঝাই কতটা ভালোবাসি! আজ শুধু তোমায় অনুভব করাতে চাই আমার ভালোবাসার গভীরতা। তুমি রেডি তো?”
তার গরম নিশ্বাস কানে লেগে মৃদু শিহরণ বয়ে গেল সারা দেহ জুড়ে। স্নায়ুতন্ত্র কাজ করছে না আমার৷ রক্ত চলাচল বেড়েছে বিদ্যুতের বেগে। ঝাপটে ধরলাম জিয়ানকে। কাঁপা কণ্ঠে শুধালাম “তুমি কিন্তু আমাকে অস্থির করে তুলছো, জিয়ান।”
“আজ তো অস্থির হওয়ার সময়, মেঘমালা। এই রাতের জন্য কত অপেক্ষা করেছি, মনে নেই? এসো স্থির করে দিচ্ছি!”
আমি আর কোন কথা বলতে পারলাম না। জিয়ান জড়িয়ে ধরে থাকলো কতক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর মাখা গলায় বলল, “এত কাঁপছো কেন? শান্ত হও। সব ঠিক হয়ে যাবে।” তারপর কপালে চুমু খেলো। চোখে চোখ রেখে দুষ্ট হেসে আচমকাই ঠোঁটে ডুবিয়ে দিলো ডুব।
চলমান….!