ভীনদেশী তারা পর্ব-১০

0
7

#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া(১০)

মারিয়া আপা আগে যে বাসায় থাকতেন, সে জায়গায় চলে যান। জিয়ান হোস্টেল ছাড়ে। আমার বাসায় জিয়ান আর আমি একসাথে থাকি। শুধু ভালো নয়, খুব ভালো দিন কাটতে লাগলো আমাদের। একসাথে খাওয়া, একসাথে ঘুমানো, একসাথে কলেজ যাওয়া, একসাথে লেখাপড়া করা চলতে লাগলো আমাদের। মাঝেমধ্যে, মাঝরাতে আমরা দুজন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রই; আধো আলো, আধো অন্ধকারে পাহাড়ের রাতের সৌন্দর্য দেখি। সে বসে পড়তো। আমি তার কোলে মাথা রাখতাম, দুজনে হরেক রকমের গল্প করতাম, দুষ্টুমি করতাম৷ হাসতাম। শুধু ভালোবাসার জন্য মাঝেমধ্যে আমাদের অভিমান হতো। তাছাড়া কোন ঝগড়া হতো না আমাদের। আমার জীবনের বেস্ট সময় ছিলো জিয়ানের সাথে কাটানো সময়গুলো। আমি বাংলাদেশে থাকতে কখনও ভাবতেও পারিনি, বিদেশে আমার জন্য এত সুখ অপেক্ষা করছে।

শিয়াং মাস্টার্স করতে উহান চলে আসে। আলাদা বাসায় থাকে। রোজ সে আমাদের সাথে এসে দেখা করে, আড্ডা দেয়। দেবর হিসাবে আমার কাছে ওয়ার্ল্ডের বেস্ট দেবর সে।

আমার চার বছরের স্নাতক কোর্স ছিলো উহানের। ফোর্থ ইয়ার শেষ হলেই আমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। জিয়ান বলল, মাস্টার্সে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে, যাতে মাস্টার্সও এখানে করতে পারি। ফাইনাল এক্সাম শেষ হলেই এপ্লাই করে রাখব। জিয়ান মাস্টার্স করছে উহানে। মাস্টার্স শেষ হলে সে বিজনেস শুরু করবে।

ইতিমধ্যে বাবা জেনে গেছেন আমার বিয়ের কথা। মায়ের সাথে অনেক ঝগড়া করেছেন এই নিয়ে। পরবর্তীতে ঠান্ডা হয়েছেন, কিন্তু জানিয়ে দিয়েছেন কখনও এই বিয়ে মেনে নেবেন না।

সংসার জীবনের দুই বছর হতে চলল আমাদের। আমার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়। রেজাল্ট দেয়। আমি ভালো রেজাল্ট করি। আবেদন ও মঞ্জুর হয়।আমি মাস্টার্স করতে পারব উহানে। সেই খুশিতে সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করে জিয়ান। সে আমাকে বলল, দুজন যেহেতু বিজনেস নিয়ে পড়েছি, তাহলে একসাথে যেন দুজনেই এক ব্যবসায় লাগি। আমি রাজি হই। তাকে বলি, কত বছর দেশে যাইনি, পরান পুড়ছে খুব। একবার দেশে গিয়ে ঘুরে আসি। মাত্র দুমাস থাকব। তারপর এখানে এসে মাস্টার্স শেষ করে বিজনেসে যোগ দেবো। জিয়ান রাজি হয়।

শীতকাল এসে পড়েছে। অন্যবার শীতকাল নিয়ে যে আগ্রহ জিয়ানের মধ্যে দেখতাম, এইবার তা নেই। সে বাড়ি যাওয়ার কথা মুখেই নিচ্ছে না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই শীতে বাড়ি যাবে না?”
সে মৃদু হেসে বলল, “প্রতিবার তো যাই। এই শীতে আর যাব না। লেখাপড়ার চাপ বেশি।”

জিয়ানের হঠাৎ শীতে বাড়ি না যাওয়া আশ্চর্য লাগলো আমার কাছে। কিন্তু এ বিষয়ে আর জোর করলাম না। কদিন পর, শীতের পিঠা সহ নানান খাবার নিয়ে জিয়ানের মা আর শাওলি আসলেন। শিয়াংও এলো সাথে। কতদিন পর সবাই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম। ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল।

মারিয়া আপা এক বছর আগেই বাংলাদেশ চলে গেছেন। আমারও চলে যাওয়ার দিন আসে। চলে যাওয়ার আগের দিন রাতে জিয়ান প্রায় ঘন্টাখানেক কোন কথা না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। এমন বিহেভ করছিল মনে হচ্ছিল, যেন আমাদের আর এই জীবনে দেখা হবে না। আমি তাকে আশ্বাস দিলাম, “মন খারাপ করো না। আমি তো একেবারে যাচ্ছি না। মাত্র দুই মাস বাংলাদেশে কাটিয়ে তোমার কাছে চলে আসব। আর ফোনে তো কথা বলবই।”

পরদিন এয়ারপোর্টে আমাকে নিয়ে গেছিলো সে। চোখে চকচক করছিলো পানি। আমাকে ধরে আলতো করে চুমু খেয়েছিলো, হাতে কপালে। আমি জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলাম তার থেকে। যতক্ষণ দেখা গেল, তাকিয়ে থাকলো সে আমার দিকে। প্লেন ছাড়ার সাথে সাথে মনে হচ্ছিল আমার কলিজা কেউ টান দিয়ে ছিড়ে ফেলতেছে। আমার মূল্যবান জিনিস আমি রেখে চলে যাচ্ছি। বিদেশ আসার সময় যেমন ফিল হচ্ছিল, বিদেশ থেকে ফেরার সময় আরও বেশি কষ্ট হচ্ছিল। চোখের পানি পড়ছিল অনবরত। চোখ মুছে আকাশে উড়া মেঘ দেখতে লাগলাম। গোলাকার মেঘ। কখনও একসাথে কখনও চাকা চাকা হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে। মনে হচ্ছিল এখুনি হাত দিয়ে ধরে ফেলি।

এয়ারপোর্ট থেকে মা-বাবা ও ভাই রিসিভ করেন আমায়। আমাকে পেয়ে সবাই খুশি। বহু বছর পর দেশে ফিরে অনুভুতি অন্যরকম লাগছিল। নতুনভাবে দেখছিলাম চারপাশ। বাড়িতে যতটা ছোট ছোট বাচ্চা ছিল, সবাই বড় হয়ে গেছে। আমার সাথের সব মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। পাঁচ বছর বয়সে যে আমগাছটা লাগিয়েছিলাম, সেটাও অনেক লম্বা হয়ে গেছে। মা বলেছে, এই গাছে প্রচুর আম ধরে।

সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার পরে জিয়ানের কাছে কল করলাম। দেখি কল ডুকে না। ভাবলাম হয়তো বিজি। ঘুমিয়ে পড়লাম। টানা ৮ ঘন্টা ঘুমালাম। উঠে গোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া করে মোবাইল চেক করি, দেখি জিয়ানের একটা কল নেই। খচ করে উঠে আমার ভেতর। কল করি, আবারও তার ফোন অফ পাই। শিয়াংয়ের কাছে কল করি, শাওলির কাছে করি। না, কারও ফোনে আমার ফোন ডুকে না। শুরু হয় আমার অস্থিরতা। আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। কি হলো জিয়ানের? এমন করছে কেন? শাওলি, শিয়াংদের বা কি হলো? একসাথে সবার ফোন অফ থাকবে কেন? আমি এজেন্টের কাছে কল দিয়ে জিয়ানের খোঁজ নিতে বলি, উনি চেষ্টা করেও কোন খোঁজ পাননি।

পাগল হয়ে উঠি। সারাদিন-রাত কান্না করি। সিদ্ধান্ত নেই, উহানে ফিরে যাব তাড়াতাড়ি। বাধা হয়ে উঠলেন মা-বাবা। মা-বাবা নিষেধ করতেছেন আমাকে, বুঝাচ্ছেন ওদেশে ফেরত আর না যেতে। এখানে মাস্টার্স করাবেন। “যা হওয়ার হয়েছে, তোমাকে ঠকিয়েছ, ওকে ভুলে যাও।” এই সেই নানান রকম কথা। সবার কথায় আগুন জ্বলছিল আমার মাথায়। রাগে, দুঃখে চুল ছিঁড়ছিলাম। নিজেকে আঘাত করছিলাম। কীভাবে জলজ্যান্ত একটা মানুষ হাওয়া হয়ে যেতে পারে। জিয়ান কেন আমার সাথে এমনটা করছে? ও আমার সাথে এমনটা করলে, মৃত্যু ছাড়া আর কোন পথ নেই আমার।

বাবাকে জানিয়ে দেই, আমি উহানে যাবই যাব। কেউ বাধা দিলে গলায় ফাঁস দেবো।

শরীরের অসুস্থতা বাড়তে থাকে। না খেয়ে, নিজের যত্ন না নিয়ে অবস্থা খারাপ হয় আমার। সাথে শুরু হয় বমি আর বমি। গ্যাসের ওষুধ মা খাওয়াতে খাওয়াতে বমি কমার লক্ষণ না থাকায় মা সন্দেহ করে প্রেগনেন্সি টেস্ট করান। পজিটিভ আসে। আমি হাসব না, কাদব কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। জিয়ান যদি এ খবর শুনতো, খুশিতে বোধহয় পাগল হয়ে যেতো। উহানে ফিরে যাওয়ার জন্য হৈচৈ শুরু করলাম। কেউ যেতে দেয় না। একদিন ব্যাগ খুলে দেখি আমার পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই নেই। চিৎকার শুরু করলাম। জিয়ানের কাছে যাওয়ার এই পথটাই ছিলো আমার। সেটাও সরিয়ে নিলেন বাবা। আমার আর বাঁচার উপায় নেই। আমি গলায় ফাঁস দেবো।

মা আমাকে বুঝালেন, পাগলামি না করতে, নিজের যত্ন নিতে। ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া করতে, যেন বাচ্চাটার ক্ষতি না হয়। কে শুনে কার কথা, আমার কোন পরিবর্তন নেই।
বাবা প্রথম প্রথম আমার পাগলামো প্রশ্রয় দিলেও পরে আগুন হয়ে উঠলেন। আমাকে ঘরে বন্ধী করে রাখার হুকুম দিলেন। মাকে কেঁদে কেঁদে বললাম, “বাবা, এটা কি করলেন মা? আমার ভিসা-পাসপোর্ট সরিয়ে নিলেন। জিয়ান আমার সব। হঠাৎ তার সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ। বুঝতে পারছো মা, আমার বিষয়টা। আমার ভেতর জ্বলতে জ্বলতে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যদি বাবা উহানে যেতে না দেন, আমি কিন্তু কিছু করে বসব মা।”

মা আশ্বাস দেন, “তুমি এখন অসুস্থ। বাচ্চাটা সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসুক, তারপর আমি তোমার ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করব। এই অবস্থায় আমিও তোমাকে ছাড়ব না। জিয়ানের খবর নাই। ওখানে গিয়ে কোথায় কি করবে ঠিক নাই। অন্তত বাচ্চাটার কথা চিন্তা করো, নীহারিকা।”

রাতদিন কাটতে লাগলো, আমার কান্না করে করে। রাতে তো ঘুমই আসেনা চোখে। জানলা খুলে বসে থাকি। আকাশ দেখে আমার আর জিয়ানের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করি। চোখের পানিতে বুক ভিজে যায়। মানুষটা কোথায়? আমার কথা কি তার মনে পড়ে না? এসব ভাবি আর কাঁদি। চোখের পানি একবারও শুকায় না। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল ভরে উঠেছে। এমন কোন দিন নাই, রাত নাই, যে জিয়ানের নাম্বারে আমি কল করিনি, মেসেজ করিনি। শুধু জিয়ান না, তার ভাইবোনের নাম্বারে আমি কল করতাম। কলেজের একজনের কাছে ও খোঁজ নিয়েছি। কেউ জানে না তার খবর। যখন মনে হতো জিয়ান আমার সাথে প্রতারণা করেছে, তখন চোখের সামনে ভাসতো তার সাথে কাটানো মুহূর্ত। দুনিয়া ভাগ হয়ে গেলেও কেউ আমাকে বিশ্বাস করাতে পারবে না, জিয়ান বেইমানি করেছে। নিশ্চয় কিছু হয়েছে আমার জিয়ানের। আমি অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করব।

পুরো নয় মাস কীভাবে নরক যন্ত্রণায় কেটেছে, সেটা শুধু আমি জানি। আমার ফুটফুটে মেয়ে হয়। চেহারা একদম জিয়ানের মতো। শিয়াং একদিন মজার ছলে আবদার করেছিল, “তোমাদের যদি বেবি হয়, তবে অবশ্যই আমার নামের অক্ষর দিয়ে নাম রাখবে।” আমি তাই মেয়ের নাম রাখলাম শিহা। মা আর আমি মিলে শহরে যাই বেড়াতে খালার বাড়ি। সেই সুযোগে ভিসার জন্য আবেদন করি।

শিহার দুমাস হলো। আমার সবকিছু রেডি করেছেন মা। ইতিমধ্যে ভিসা আর পাসপোর্ট সব রেডি আমার। মিথ্যা বলে সেদিনও শহরে খালার বাড়ি যাই, সাথে মা। পরের দিন সন্ধ্যায় আমার ফ্লাইট। এয়ারপোর্টে চলে গিয়েছিলাম প্রায়। কোথা থেকে জানিনা, বাবা এসে পড়লেন। শ’ শ’ মানুষের মধ্যে ছিড়ে ফেলেন আমার টিকেট, ভিসা, পাসপোর্ট, ফেলে দেন পুকুরে। আমি ওইখানেই চিৎকার শুরু করি।

গাড়ি করে সোজা বাড়ি নিয়ে যান আমায়। আমার রাগ সেই দিন কন্ট্রোল হয় না। আমার ভালোবাসার মানুষের খোঁজ খবর নেই এক বছর ধরে। তাকে ছাড়া কীভাবে বেঁচে আছি, সেটা কেন বাবা বোঝেন না? যেই তার কাছে যাওয়ার সময় হলো শেষ মুহূর্তে তিনিই আবার আটকে দিলেন আমায়। এই নরক যন্ত্রণা নিয়ে আর বাঁচা সম্ভব না আমার। আমি এক ডজন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলি।

পরদিন নিজেকে দেখি হাসপাতালে। সামনে মা দাঁড়িয়ে। বাহির থেকে শিহার কান্নার আওয়াজ আসছে। মা বললেন, “কাল থেকে একনাগাড়ে নাকি শিহা কান্না করছে। কোনভাবে শান্ত হচ্ছে না। তুই একবার কোলে নিয়ে দেখ, ঠান্ডা হয় কিনা।”

তাকে নিয়ে এসে আমার কোলে দেওয়া হয়। আশ্চর্যভাবে আমার কোলে দেওয়ার সাথে সাথে তার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। অশ্রুসজল চোখে ড্যাবড্যাব করে থাকিয়ে থাকে আমার দিকে। এই চাহনিটা একদম জিয়ানের শেষ চাহনির মতো। যেদিন আমাকে বিদায় জানাচ্ছিল জিয়ান, সেদিন ঠিক এইরকম চোখে পানি নিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল। আমার কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমি শিহাকে চেপে ধরলাম বুকে। চুমু খেতে খেতে বললাম, “মা, আর কখনও এমন কাজ করবে না। তোমার থেকে দূরে যাবে না। তোমার আর কান্না করতে হবে না। বেঁচে থেকে মা-মেয়ে দুজন মিলে তোমার পাপাকে খুঁজে বের করার পথে খুঁজব।”

চলমান….!