ভীনদেশী তারা পর্ব-১১

0
5

#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া(১১)

এরপর আমি পাগলামি বাদ দিয়ে দিলাম। পাগলামি করে আসলে কিছুই করা যায় না। আমি শান্ত হয়ে গেলাম, একদম শান্ত। বাবা যেমনে বলেন তেমন শুনতে লাগলাম। বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে হলে বুদ্ধি দিয়ে করতে হবে, তাও ধীরে-সুস্থে। মাস্টার্সে ভর্তি হলাম ভালো একটা ভার্সিটিতে। শিহা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। আমি যথেষ্ট ভালোবাসি তাকে। যখন তার সাথে কথা বলি তখনই আমার মুখে হাসি থাকে, নয়তো আমার মুখে হাসি ফুটেই না। আগের আমি আর এখনকার আমির মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যদি জানতে পারতাম জিয়ান কেমন আছে, কীভাবে আছে, কেন আমার সাথে এমন করছে তাহলে শান্তি পেতাম একটু। কোনো কিছু না জানিয়ে হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়া—এটাই আমাকে বেশি অশান্ত করে তুলে। আগের মতো কান্না করি না আমি, কিন্তু হৃদয়টা ঠিকই রোজ পুড়ে।

লুকিয়ে লুকিয়ে আবার ভিসার আবেদন করার কথা ভাবলাম কিন্তু বাবা টাকা-পয়সা সব দেওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছেন। আমার অ্যাকাউন্টে একটা টাকাও নাই। ভেতর থেকে ভেঙে পড়লাম আমি। জিয়ানের প্রতিও আমার রাগ জমতে লাগল। মনে হলো সবাই যা বলছে তা সত্যি নয়তো? জিয়ান কি আমার সাথে প্রতারণা করছে? সে তো অ্যাডাল্ট একজন মানুষ। বছর হতে গেল তাও সে একবারও আমার খোঁজ নিলো না। কেন এমন করছে আমার সাথে? এসব ভাবলে মাথায় কাজ করে না আমার। এমন মনে হয়, কখন স্ট্রোক করে ফেলব আমি। এত স্ট্রেস মানুষ নিতে পারে নাকি?

বাবাও জ্বালিয়ে রাখছেন আমায়। উনি আর বড় ভাই কড়া নজরে রাখছেন। কলেজ গেলে সাথে পাঠান কাউকে। শহরের খালার বাড়িতেও আমার যাওয়া অফ। আমিও এমনভাব দেখাতে লাগলাম, উহানে যাওয়ার কোনো আগ্রহ দেখালাম না। এভাবে কাটল আর ক’মাস। হঠাৎ বাবা আমায় জোর করলেন জিয়ানকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য। এটা শুনে তো থ বনে গেলাম আমি। আমি ডিভোর্স দেব না বললে, সবাই রীতিমতো জোর করল আমাকে, এমনকি মা ও। সবার কথা জিয়ানকে ডিভোর্স দিতে। এভাবে আমার জীবন নাকি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই বিয়ে দিবে।
আমি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছি, “আমাকে মেরে ফেললেও ডিভোর্স দেব না জিয়ানকে। বিয়েও করব না।” বাবা ও বলে দিয়েছেন, “ডিভোর্স দেওয়া আর না দেওয়া তোমার ব্যাপার। কিন্তু বিয়ে তো আমি দিয়েই ছাড়ব।”

বিয়ে ঠিক ও করে ফেললেন আমার। দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না আমার। হাতে টাকা-পয়সা নাই, তাই কোনো পথ দেখছি না আমি। আগে মা আমার পক্ষে থাকলেও মাও এখন পক্ষে নেই। শিহাকে বুকে নিয়ে শুধু কাঁদতাম রাতে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। জিয়ানকে রোজ কল করতাম, মেসেজ করতাম।

আমার ফুফাতো ভাই সুইডেন ছিলো, সে দেশে ফেরে আমাদের বাড়ি আসে। আমরা সমবয়সী ছিলাম। আমার চেহারার বেহাল অবস্থা দেখে সে আশ্চর্য হয়ে যায়। পরে সবার থেকে শুনতে পায় আমার সাথে ঘটা ঘটনা। সে একান্তে কথা বলে আমার সাথে। সে বিশ্বস্ত তাই সব শেয়ার করি। এটাও বলি আমাকে সাহায্য করতে, আমার অ্যাকাউন্টে টাকা দিতে। সে আমাকে চিন্তা করতে বারণ করে। বলে আমাকে সাহায্য করবে।

আমার কান-গলার যা অলংকার ছিল সেগুলো বাবার কথায় মা নিয়ে নিয়েছেন। আমি কয়েকদিন থেকে মায়ের অলংকার চুরি করার ফন্দি আঁটছিলাম। এক সুযোগে মায়ের গলার বড় হার নিয়ে নেই। সব নিয়ে বিয়ের আগের দিন সেই ফুফাতো ভাইয়ের সাহায্যে বের হয়ে আসি।

____________________________________

বর্তমান

শিহার ঘুম ভাঙে। সে ডাকে আমায়, “মা… মা…” বলে। চোখের জল বুক বেয়ে পড়ে, জামা ভিজে গেছে আমার। জানলা খুলে বোতলের মুখ খুলে চোখে-মুখে পানি ছিটাই। ওড়না দিয়ে ভালো করে চোখ মুখ মুছে, শিহাকে কোলে নেই। আমি হেসে ওর দিকে তাকাতে মিষ্টি একটা হাসি দেয় সে।

মাঝপথে বিরতি দিলে হোটেলে নেমে আমি খাই আর শিহাকে খাওয়াই। পরে আবার গাড়ি চলতে শুরু করে।

সকালে ঢাকায় নামি। ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে যাই বুকিং করা হোস্টেলে। সেখানে গিয়ে গোসল সেরে নেই আগে। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছছি তখনই ফোন বেজে উঠল। আমি বুঝে গেলাম আমার বাড়ি থেকে কল আসছে। নিশ্চয় সকাল বেলা আমাকে না পেয়ে হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে বাড়িতে। আমি ভালো করে চুল মুছে নেই। তিন-চারবার রিং হওয়ার পর ফোন তুলি। ফোনের ওপাশে একজন নয়, অনেকজন জড়ো হয়ে আছে। মুখ দিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লাম, চোখ বন্ধ করে ঢোক গিললাম। আর ভয় পেলে চলবে না। গরম হয়ে কথা বলতে হবে।

“কথা বলছিস না কেন নীহারিকা?” ভাইয়াসহ অনেকের গলা শোনা যাচ্ছে।

“সবাই শুনে রাখো। আজ একটু পরে আমার ফ্লাইট। আমি উহানে চলে যাচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। আর বাবাকে বলে দিয়ো আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলে আমি থেমে থাকব না। আমি পুলিশের কাছে যাব। আমার মেয়ের অধিকার আছে তার বাবার কাছে যাওয়ার। আমারও অধিকার আছে আমার স্বামীকে খোঁজার। আমাকে আর কেউ ডিস্টার্ব করো না।”

ফোন রেখে দিলাম। বাবা থেমে থাকবেন না জানি। এয়ারপোর্টে হয়তো লোক পাঠাবেন কিন্তু আমি তো আজ যাচ্ছি না। আর আমার মেয়ের কসম, বাবা আর আমাকে আটকাতে পারবে না।

সিম খুলে জ্বালিয়ে ফেলি। নতুন সিম ঢুকাই।
মারিয়া আপার কাছে কল করি। উনি ঢাকার নামকরা কলেজের কম্পিউটার প্রফেসর। এতদিনের সবকিছু মারিয়া আপা জানতেন, উনিও জিয়ানের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, পাননি। পরে দীর্ঘসময় আর আমাদের যোগাযোগ হয়নি। আজকে ঢাকায় আসছি এটাও জানেন না।

আমার কল পেয়ে উনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “আরে নীহারিকা। কোনো খোঁজ নেই তোমার। জিয়ানের খবর পেলে? মেয়ে কেমন আছে?”

“মেয়ে ভালো আছে। জিয়ানের খবর পাইনি। আমি ঢাকায় আসছি মারিয়া আপা। এজেন্সিতে গিয়ে ভিসার আবেদন করব, তুমি আসবে একটু?”

“কেন আসব না? কোথায় আছো বলো, আসছি।”

মারিয়া আপার সাথে দেখা হয়। উনি শিহাকে কোলে নিয়ে আদর করেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “এ তো একদম বাপের কপি নীহারিকা।”
আমি মৃদু হাসি।
“তুমি ঢাকায় এসে হোস্টেলে কেন উঠছো? আমার বাসায় থাকতে। টাকা-পয়সার সংকট এখন হোস্টেলে থাকতে হবে না। কালই আমার বাসায় উঠবে কেমন?”

মারিয়া আপা সদ্য ঘটে যাওয়া সব শোনেন। বলেন, “পালিয়ে ঠিক করেছো। নয়তো বিয়ে হয়ে যেতো তোমার। আমাদের জিয়ান কোনো খারাপ ছেলে নয়। নিশ্চয় তার সাথে কিছু একটা হয়েছে। আল্লাহ তার সহায় হোক। আশা করি তাড়াতাড়ি তোমার ভিসা-পাসপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।”

আমরা ভিসার আবেদন করে ফিরি। মারিয়া আপার সাথে গিয়ে মায়ের গলার হার বিক্রি করতে যাই। উনি বাধা দেন বলেন, “নিশ্চয় তোমার মায়ের শখের জিনিস এটা। এটা বিক্রি করা ঠিক হবে না। এতকাল একসাথে থেকেছি আমরা। বিপদে পড়েছো তুমি। আমি কিছুটা সাহায্য করব তোমাকে।”

মারিয়া আপা টাকা দেন আমায়। আমার কাজিন ও আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। টাকার আর চিন্তা থাকে না আমার।
মারিয়া আপার বাসায় উঠেছি। আলাদা একটা রুম দিয়েছেন আমায়। মারিয়া আপা কলেজ চলে গেলে শিহা আর আমি একসাথে সময় কাটাই। যত দিন যায় আমার উত্তেজনা কাজ করে ভেতরে, শীঘ্রই আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছি।

জানুয়ারী মাস। হাড় কাঁপানো শীত। সন্ধ্যা হলেই শীতের মাত্রা আরও বাড়ে। মারিয়া আপার সাথে গল্পগুজব শেষে রাতের ডিনার করে নেই তাড়াতাড়ি। দ্রুত গিয়ে বিছানায় উঠি। শিহার সাথে কতক্ষণ খেলাধূলা করে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। কপালে মুখে চুমু খেয়ে কম্ফোর্টার টা গুটিয়ে দেই ভালো করে।

সেকেন্ডের কাটা পার হয়ে মিনিট হয়। মিনিট পার হয়ে ঘণ্টা, আমি জেগে থাকি। চোখের পাতা ভারী হয় না। আমার স্মৃতিপটে ঘুরে বেড়ায় স্মৃতি আর স্মৃতি। প্রতিটি স্মৃতি যেন ছোট ছোট কাটার মতো খচখচ করে অস্থির করে তুলে আমাকে। আমি আর শুতে পারি না। অশান্ত করে তুলে আমাকে। শোয়া থেকে উঠে টাইম দেখি রাত তিনটা বাজে। খাট থেকে নেমে পানি খাই। তারপর কাচের গ্লাস টেনে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াই। শা শা শব্দে বাতাস বইছে। শালটা গায়ে জড়িয়ে নেই ভালো করে। শীতের রাতের আকাশ সবসময় রহস্যময় সুন্দর হয় দেখতে। আজও তাই। চাঁদের আলোয় আলোকিত চারপাশ। একটা মায়া জড়িয়ে আছে সারা আকাশ জুড়ে। ব্যস্ত ঢাকা শহরের ঝলমলে আলো চাঁদের আলোর কাছে ফিকে মনে হচ্ছে। চাঁদকে ঘিরে হাজার হাজার ঝলমলে তারার মেলা বসেছে আকাশে। মাংজিয়া গ্রামের রাতের আকাশটা এমনই চমৎকার ছিলো। তফাৎ শুধু এখানে তুষার নেই, ওখানে তুষারে ঢাকা ছিল প্রকৃতি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি, “সেই রাতটা কি এ জীবনে কখনও ভোলা যায়? যায় না?”

মাংজিয়া গ্রামের সেই রাতের কথা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই, মনের ভেতর কেমন কেমন করে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশকে প্রশ্ন করি, “এই যে মাঝরাতে আমার এত অস্থিরতা হচ্ছে, আচ্ছা জিয়ান কি আমাকেও মিস করছে? আমার মতো সেও কি স্মৃতিগুলো হাতড়ে বেড়াচ্ছে? ও কি এই মুহূর্তে কোনো এক আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমার কথাই ভাবছে? নাকি ভুলে গেছে আমাকে?”

আকাশ কোনো উত্তর দেয় না। তারা ঝলমল করে। চাঁদ নীরব থাকে। নিজেকে সামলাতে পারি না। টনটন করে উঠে বুকটা। অশ্রু জমে চোখে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠি। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করি আকাশের তারা। গুনগুনিয়ে গাই—

আমার ভীনদেশী তারা,
একা রাতেরই আকাশে।
তুমি বাজালে একতারা আমার
চিলেকোঠার পাশে….

আমার রাতজাগা তারা,
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ি।
আমি পাই না ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী…

চলমান…..!