ভীনদেশী তারা পর্ব-১২

0
7

#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া(১২)

মাসখানেক পর আমার সবকিছু ওকে হয়ে যায়। এমনকি ডেটও পড়ে যায়। সামনের সপ্তাহে ফ্লাইট। আবার আমি উহানে যাচ্ছি প্রিয় মানুষের খোঁজে। এ আনন্দ বুঝানোর মতো নয়।

এতদিন ঢাকায় আছি, আমার উপর কোন প্রেশার পড়েনি। হঠাৎ করে বাবা এত শান্ত কী করে হয়ে গেলেন জানি না। বাবা হয়তো ধরে নিয়েছেন আমি উহানে চলে গেছি সেদিন। মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। মাকে অবশ্যই কল করব উহানে গিয়ে। এখন করলে ঝামেলায় পড়ব।
মারিয়া আপার ক্লোজ ফ্রেন্ড আছে অনেক উহানে। উনি তাদের একজনের সাথে কথা বলে আমার জন্য বাসা ঠিক করে রেখেছেন।

ফ্লাইটের দিন আসে। সন্ধ্যায় ফ্লাইট। আসরের সময় আমরা রেডি হয়ে বের হয়ে পড়ি। আমার কাজিন ঢাকায় আসে। মারিয়া আপা আর সে মিলে আমাকে প্লেনে তুলে দেয়। প্লেন ছাড়ে। উড়ে চলে মেঘের দেশে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। অনেক চড়াই-উতরাই করে আমি আজ সফল হতে যাচ্ছি। দেরিতে হলেও জিয়ানের খোঁজে যাচ্ছি আমি। এবার নিশ্চয় তার খোঁজ পাব।

শিহা নতুন কথা বলা শিখছে। সারাক্ষণ কথা বলছে। মুখ থেকে কথা থামছেই না। আমি গ্যালারিতে গিয়ে তাকে দেখাচ্ছি তার পাপাকে। তাকে দিয়ে চুমু খাওয়াচ্ছি। সে উৎফুল্ল হয়ে হাত বাড়িয়ে বের করতে চাইছে পাপাকে। এক এক করে দেখালাম তাকে তার পাপা, চাচ্চু, ফুফু, দাদীকে। সবাইকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে সে। এভাবে মজা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। আমার চোখেও রাজ্যের ঘুম জড়ো হয়। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজি।

টানা ৬ ঘণ্টার জার্নি শেষে উহান তিয়ানহে বিমানবন্দরে গিয়ে নামি। প্রথমবারের মতো এবার আর অত অসহায় লাগেনি। সব রাস্তাঘাট চেনা আমার। সোজা ট্যাক্সি ধরে চলে যাই উহানে। ওখানে গিয়ে পাই মারিয়া আপার চায়নিজ ফ্রেন্ড লিওকে। উনি আমাকে স্বাগত জানিয়ে আমার জন্য বরাদ্দ বাসায় নিয়ে যান। আমাকে পৌঁছে উনি চলে যান। যাওয়ার আগে বলেন, দরকার হলে যেন উনাকে ডাকি। বিকেল হয়। শিহাকে নিয়ে বের হই, বাজার থেকে খাবারদাবার কিনে নিয়ে আসি। রাতটা কাটিয়ে দেই কোনভাবে।

সকাল হলেই মা-মেয়ে বের হই। ভার্সিটিতে যাই। ক্যাম্পাস এখনও জমজমাট হয়নি। কয়েকজন স্টুডেন্টকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে এখানে-সেখানে । আমি আর শিহা কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করলাম। প্রফেসররা চলে আসলে আমি আমার পরিচিত প্রফেসরের কাছে গেলাম। উনি আমাকে দেখেই চিনতে পেরে হাসিমুখে কথা বলেন। জানতে চান কেন মাস্টার্সে স্কলারশিপ পেয়েও করিনি। কারণ জানাই উনাকে। জানতে চাই, জিয়ান কোথায়? নিরুদ্দেশ কেন সে?
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট শেষ হওয়ার পর জিয়ানকে আর দেখতে পাইনি আমরা। ওর সাথের অনেক ফ্রেন্ডও খুঁজেছে, পায়নি। হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে গেল ছেলেটা।

আমার মুখ মলিন হয়ে যায়।স্যারকে বলি, খোঁজ পেলে বা হঠাৎ কোথাও দেখলে যেন আমাকে জানান। বের হয়ে আসি প্রফেসরের রুম থেকে। বাইরে হাজার হাজার স্টুডেন্ট। আমার সাথের যারা তারা সবাই হয়তো যার যার দেশে চলে গেছে, যারা স্কলারশিপ পেয়েছে তারা হয়তো এখনও এই ভার্সিটিতে আছে। তবু পরিচিত কোনো মুখ খুঁজে পেলাম না। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখলাম সারা ক্যাম্পাস।

শিহাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে যাই আমার মোস্ট ফেভারিট, আমার আর জিয়ানের প্রথম মুখোমুখি হওয়ার জায়গা ইস্ট লেকের ধারে। লেকটা আগের মতোই আকর্ষণীয় আছে। লেকের কুয়াশা মাখা পানির উপর সোনালি রোদ পড়েছে, হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় জলের ঢেউ কাঁপছে ধীরে ধীরে।
প্রথমবার যখন এখানে আসি তখন শরতের লাল রঙে রঙিন ছিল চারপাশ। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল রেড ম্যাপল গাছটা। এখন শীতকাল, রেড ম্যাপল গাছসহ নানান প্রজাতির গাছ এখন নিরাবরণ। সব গাছের পাতারা ঝরে পড়েছে, শুধু ডালপালা অবশিষ্ট আছে।

পাথরের সব আসনগুলো খালি। কারও উপস্থিতি নেই। বিকেল হলেই জমজমাট হয়ে উঠবে এ জায়গা। আমি আর জিয়ান যে আসনে বসেছিলাম, সেখানটায় গিয়ে বসি। হাত বুলিয়ে জিয়ানের আসনটায় বসিয়ে দিই শিহাকে। তীক্ষ্ণ চোখে দেখি শিহাকে। শিহাকে দেখে মনে হচ্ছে জিয়ান বসে আছে। চোখের সামনে যেন জিয়ানকে দেখতে পাচ্ছি। আমি মলিন হেসে পাহাড়ের চূড়ায় তাকাই। তুষার গলে ধোঁয়া বের হচ্ছে সেখানটায়।

শিহা কান্না শুরু করে দেয়। ফিডারটা বের করে খাইয়ে দেই তাকে। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। কত আশা নিয়ে এখানে এসে প্রথমেই নিরাশ হয়ে গেলাম আমি। কোথায় আছে আমার জিয়ান? কেন কেউ তার খবর জানে না? তারপর মনে হলো শিয়াংয়ের ভার্সিটিতে যেতে। কিন্তু আমার যখন বিয়ে হয় তখন শিয়াং মাস্টার্স করতে আসে উহানে। এই দুই বছরে হয়তো তার মাস্টার্স শেষ। তবু মনকে শান্ত করার জন্য আমি ট্যাক্সি ধরে শিয়াংয়ের ভার্সিটিতে যাই। এর আগে এই ভার্সিটিতে আমি যাইনি। শিয়াং ইংরেজি নিয়ে মাস্টার্স করেছে তাই সেই ডিপার্টমেন্টের একজন টিচারের সাথে কথা বলি। নাম বললে উনি চিনতে পারেননি। হতাশ হয়ে ফিরে আসি।

বাসায় এসে গা এলিয়ে দিই বিছানায়। কান্না করি কতক্ষণ। পরে আবার সাহস জুগিয়ে ভাবি, এভাবে ভেঙে পড়লে হবে না। মেয়ের কথা মাথায় রাখতে হবে। উঠে রান্না-বান্না করি, দুজনে খাই। সারারাত ভাবি। তারপর ঠিক করি জিয়ানের বাড়ি যাব। ওটাই একমাত্র রাস্তা আর। কিন্তু হুট করে গিয়ে যদি জিয়ানের বাবার সামনে পড়ে যাই? শুনেছি উনি কঠোর মানুষ। আচ্ছা, উনি আবার কিছু করেননি তো জিয়ানের সাথে?

না, না! উনার মোকাবিলা হতেই হবে আমাকে। ওখানে গেলে কোনো একটা ক্লু পাব জিয়ানের। ওরা কেউ শিহার কথাও জানে না। দেখে নিশ্চয় খুশি হবে।

আমি আর দেরি করিনি। ছটফট করছে মন, কখন খোঁজ পাব জিয়ানের। তাই তাড়াতাড়ি মাংজিয়া গ্রামের টিকেট কেটে নিলাম আগামী কাল রাতের। রাত ১১ বা ১২টায় বাসে উঠলে সকালে গিয়ে পৌঁছাতে পারব। শহর থেকে গ্রামে শীত আরও বেশি। শিহা আর আমার শীতের পোশাক গুছিয়ে নিলাম। কোনো অবস্থায় শিহার ঠান্ডা লাগানো যাবে না।

মায়ের কাছে কল করলাম। মা আমার ফোন পেয়ে কেঁদে কুটে অস্থির। কেন খোঁজ নেইনি এতদিন। এই সেই নানান কথা বললেন। শিহাকে তাড়াতাড়ি ভিডিও কলে দেখলেন। শিহার জন্য নাকি উনি সবসময় কান্না করেন। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বললেন, বিয়ের আগের দিন চলে আসায় পাত্রপক্ষের কাছে মান-সম্মান শেষ। অনেক কৈফিয়ত দিতে হয়েছে তাদেরকে। এ নিয়ে বাবা-ভাইদের অনেক রাগ আমার উপর। বাবা নাকি বলে দিয়েছেন সবাইকে, আমার জন্য বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ।
আমি নিভে যাওয়া গলায় বলি, “আমি তোমার গলার হার নিয়েছি মা।”
“জানি। এই টাকায় কী হয়েছিল সব?”
“ওটা বিক্রি করিনি মা, মারিয়া আপা টাকা দিয়েছেন, আরও ম্যানেজ হয়েছে। ওটা তোমাকে ফেরত দেবো।”
“লাগলে বিক্রি করিস। আর টাকা লাগলে আমাকে জানাবি। আমি লুকিয়ে পাঠাব। ছেলেটার খোঁজ পেলি?”
কন্ঠ নামিয়ে বলি, “না মা। এখনও পাইনি।”
“সবকিছু যেন আল্লাহ ঠিক করে দেন। শিহার খেয়াল রাখিস।”
“হুম। রাখছি মা।”

পরদিন রাত ১০টায় কাউন্টারে চলে গেলাম। এগারোটার বাস আসলে উঠে পড়ি। বাসে হিটার থাকায় ঠান্ডা থেকে একটু স্বস্তি পাই। শীতের কাপড় পরিয়ে মুড়িয়ে রেখেছি শিহাকে। সে মার্বেলের মতো চোখ দিয়ে আগ্রহ নিয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। তার তাকানোর স্টাইল দেখে হেসে ফেলি আমি।

মাঝরাস্তায় সেই চা-স্টলে বিরতিতে থামে বাস। স্টলটা আরও বড় করা হয়েছে। হোস্টেলের মতো। যাত্রীদের অনেকেই নেমে চা খাচ্ছে, নাস্তা করছে। আমি নেমে আগে চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে তুষারের গন্ধ টেনে নেই। তারপর আমার জন্য চা, মোমো আর মেয়ের জন্য গরম খাবার নিয়ে বারান্দায় বেঞ্চে বসি। শিহাকে পাশে বসিয়ে রাখি। চা খেতে খেতে দেখতে থাকি চারপাশ। শ’শ’ শব্দে তুমুল বাতাস বইছে, তুষারের বাতাস। বাতাসে দিগুণ বাড়িয়েছে ঠান্ডা। আশেপাশের সব রাস্তা সাদা আর সাদা। দূরপাল্লার যানবাহন ছুটছে রাস্তায়, গাড়িগুলোর হেডলাইটের আলোয় কিছু দূরের বাড়িগুলোর ছাদের জমে থাকা তুষার চকচক করছে। শিহা দেখি আমার থেকেও বেশি কৌতূহল নিয়ে দেখছে এসব। আমি তার হাত নেড়ে আদুরে গলায় বলি, “জানো সোনা, এই সুন্দর শহরটা তোমার। তোমার পাপা এখানেই আছে।” কি বুজলো কে জানে। সে হেসে উঠলো জোরে। নিস্তব্ধ রাতে তার হাসির শব্দটা একটু বেশি জোরে কানে বাজলো। হাসির শব্দে যাত্রীরা তার দিকে ফিরে তাকায় একবার।

আচমকা বৃষ্টি শুরু হয়, তুষারবৃষ্টি। তাড়াতাড়ি করে সবাই বাসে উঠে। আমি শিহাকে আরেকটা শাল দিয়ে গুটিয়ে নেই ভালো করে। তারপর ঘুম পাড়িয়ে দিই। আমার চোখে ঘুম আসে না।
সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কেমন যেন অশান্তি লাগছিল। কী হবে ওখানে? জিয়ানকে পাব তো? এইসব ভেবে কেটেছে রাত।

ভোরে স্ট্যান্ডে নামিয়ে দেয়। একটা ঘোড়ার গাড়ি ধরে চলে যাই জিয়ানদের বাড়ি। তেমন আনাগোনা নেই মানুষের। এত ঠান্ডায় বোধহয় কেউ উঠেনি এখনও। তুষারে ঢাকা রাস্তায় বাড়ির ভেতরে ঢুকি। সবার আগে চোখে পড়ে দাদুর পুরনো কাঠের ঘরটা। তালা লাগানো সে ঘরে। তুষার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে দরজা-জানলায়। আরেকটু যেতেই জিয়ানদের মেইন ঘরের বারান্দায় বড় চেয়ারে বসে থাকতে দেখা যায় একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে। মুখ ছাড়া সারা শরীর কাপড়ে মোড়া উনার। বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছেন উনি। চোখ বুজা। বারান্দায় পা দেওয়া মাত্র আমার চটির শব্দে চোখ খুলেন তিনি। পা থেকে মাথা অব্দি পরখ করে চায়নিজ ভাষায় বললেন, “কে তুমি?”

আমি শিওর হলাম উনি জিয়ানের বাবা। উনি গরম মানুষ এটা শুনেছি। কিন্তু উনার মুখমণ্ডলও যে দেখতে পাষাণ মানুষের মতো সেটা এখন বুঝলাম। ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠলাম আমি। সহজে উত্তর দিতে পারছি না। উনি চিৎকার করে কক্ষের দিকে তাকিয়ে কী একটা বললেন। শিহা ঘুম ছিল। উনার হুংকারে শিহাসহ আমিও কেঁপে উঠলাম। ঠোঁট উল্টে কাঁদতে লাগল শিহা। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। ঠান্ডা ঠোঁট দিয়ে চুমু খেতে খেতে বললাম, “কাঁদিস না সোনা।”

চলমান….!