#ভীনদেশী_তারা
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৬ (শেষ পর্ব)
ভীষণ মানসিক যন্ত্রণায় কাটতে লাগল আমার দিন। মায়ের সাথে কথা বললাম। কেঁদে কেঁদে সব বললাম, যা যা ঘটেছে একটুও লুকোলাম না। মা শুনে অস্থির হয়ে উঠলেন। তারপর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, “তুমি আর শিহা ফিরে এসেছো সহীহ সালামতে, এটাই অনেক। তোমাদের কিছু হয়ে গেলে আমি শেষ হয়ে যেতাম।”
তার এক ঘণ্টা পরেই মা কল করে বললেন, বাড়ি চলে যেতে।
থেমে প্রশ্ন করলাম,
“বাবা?”
মা নিশ্বাস ফেলে বললেন,
“মা–বাবার থেকে আপন কেউ নেই, মা। বাবা–মায়ের রাগ বেশিদিন থাকে না। তুমি আমাদের একমাত্র মেয়ে। বাবা ভীষণ ভালোবাসেন তোমায়। তোমার বাবা নিজেই বলেছেন, তোমাকে বাড়ি আসতে বলতে।”
নিজের মানসিক চাপ আর শিহাকে নিয়ে পারছিলাম না আমি। পরদিন চলে গেলাম বাড়ি। আমাকে আর শিহাকে পেয়ে সবাই খুশি। বাবাও সুন্দরভাবে কথা বলেছেন। বাবাকে বলে দিয়েছি, যদি কখনও বিয়ের কথা তোলেন, আমি কিন্তু বাড়ি থাকব না। বাবা বললেন,
“ঠিক আছে, জোর করব না। তুমি শিক্ষিত মেয়ে। নিশ্চয়ই তুমি তোমার ভালো বুঝবে।”
মোটামুটি দিন কাটতে লাগল আমার। কিন্তু শিয়াং-এর সাথে কী হলো, এই অস্থিরতায় শান্তি পাচ্ছিলাম না। কতবার কল করতাম, ফোন অফ পেতাম। তারা ইচ্ছে করেই আমাকে এভয়েড করত, আর করবে না-ই বা কেন! আমার জন্য তাদের যা ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করার মতো নয়। দিন দিন অপরাধবোধ এতই বাড়তে লাগল যে, মারিয়া আপার চায়নিজ বন্ধুর সাথে আবার যোগাযোগ করলাম। রিকোয়েস্ট করলাম, মারিয়া আপাকে দিয়ে করালাম। উনি যেন মাংজিয়া গ্রামে গিয়ে খোঁজটা নিয়ে আসেন। উনি ফেলে দেননি আমাদের রিকোয়েস্ট। সব ঠিকানা দিলাম। দু’দিন পর উনি গিয়ে ঘুরে এলেন মাংজিয়া গ্রাম। আমাকে জানালেন, শিয়াং এবং তার বাড়ির সবাই ভালো আছে।আমার বুক হালকা হলো। আমি রিল্যাক্স ফিল করলাম। খুশি হলাম খুব। তারা ভালো থাকলে আমিও ভালো।
জিয়ানের জন্য মনটা এখন আর আগের মতো অশান্ত থাকে না। মনে হয়, সে মিশে গেছে আমার আত্মার সঙ্গে, সবসময় সাথেই আছে। তবে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে, বৃষ্টি নামলে, কিংবা নীরব জোৎস্না রাত হলে, তখন ভীষণভাবে মনে পড়ে আমার জিয়ানকে। তখন আর নিজেকে সামলাতে পারি না। কান্নায় ভেঙে পড়ি। গ্যালারিতে বসে তার মায়াভরা মুখ দেখি, ছবিটা জুম করে দেখি, কখনও চুমু খাই, কখনও আবার ছবির সাথেই কথা বলি। যেন জিয়ান আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
এভাবেই কেটে গেল আরও কয়েক দিন। বাড়িতে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে ভীষণ বোর হচ্ছিলাম। মাস্টার্স তো শেষ হয়ে গিয়েছে আগেই। বিদেশে গিয়ে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়েছি ঘরে বসে থাকার জন্য নয়। অতীত আঁকড়ে ধরে যদি এভাবে পড়ে থাকি, তবে একদিন সত্যিই ভেতরে ভেতরে পচে যাব।
তাই মনস্থির করলাম, আমি বিজনেস শুরু করব। বাবাকে জানালাম। বাবা একটুও আপত্তি করলেন না। ভাইয়েরাও সমর্থন দিল। বাবা শুধু বললেন,
“তোমার ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। তবে পরিশ্রমটা তোমাকেই করতে হবে।”
বাবা নিজে গিয়ে বনানীতে একটি ফ্ল্যাট কিনলেন। সেখানেই হবে আমার নিজস্ব বিজনেস। দু’দিন ধরে ভেবেও ব্র্যান্ডের নাম ঠিক করতে পারছিলাম না। শেষ বিকেলে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম৷ একটা ইউনিক নাম হতে হবে, যা শুনেই মানুষ আকৃষ্ট হবে।
ঠিক তখনই মারিয়া আপা ডাক দিলেন,
“আকাশে মেঘ জমেছে নীহা। দরজা টেনে রুমে চলে আয়।”
চমকে আকাশের দিকে তাকালাম। সত্যিই কালো মেঘে ঢেকে গেছে চারপাশ। মনে হচ্ছিল, যে কোনো মুহূর্তে মেঘ ভেঙে নামবে বৃষ্টি। দূরে মেঘেরা দলে দলে ঘুরছে, বৃষ্টির আগমনী গন্ধে ভিজছে চারদিক।
হঠাৎ আমার মুখে মুচকি হাসি ফুটল। জিয়ান আমাকে “মেঘমালা” বলে ডাকত। নামটা এত সুন্দর, অথচ আমি অকারণে নতুন নাম খুঁজছিলাম! এই নামেই যদি ব্যবসা শুরু করি, তাহলে নামটা শুধু আকর্ষণীয়ই হবে না, জিয়ানের স্মৃতিও জড়িয়ে থাকবে এর সঙ্গে।
আমি তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম—আমার ব্র্যান্ডের নাম হবে “মেঘমালা এক্সপোর্টস”।
নাম শুনে বাবা জানতে চাইলেন, “এ নাম কেন? এটার মানে কী?”
বাবাকে হেসে বললাম,
“মেঘমালা মানে, আকাশের বুকে ছড়িয়ে থাকা স্বপ্ন।”
বাবা খুশি হয়ে বললেন,
“পারফেক্ট নাম হয়েছে।”
শিহাকে মায়ের কাছে রাখলাম। বাবা ঢাকায় এলেন আমাকে হেল্প করার জন্য। আমাকে গুছিয়ে দিয়ে তিনি চলে যাবেন। শপে তুলতে লাগলাম নতুন নতুন পণ্য। শুধু শাড়ি বা জামাকাপড়ে সীমাবদ্ধ থাকলাম না। দেশীয় হস্তশিল্প, জুয়েলারি, হোম ডেকর, যা যা বাংলাদেশের মাটি আর সংস্কৃতির গন্ধ বহন করে, সবকিছুকে আমি আমার ব্র্যান্ডে তুলে ধরলাম। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত, কারখানা, ডিজাইন, প্যাকেজিং, শোরুম সবকিছুর পিছনে আমি ছুটে বেড়াতাম। নিয়োগ করলাম অনেক কর্মী।
মাত্র এক বছরের মধ্যে আমার কষ্ট সার্থক হতে শুরু করল। “মেঘমালা এক্সপোর্টস” ঢাকার বাইরে পা বাড়িয়ে দিল। কলকাতা, দুবাই, এমনকি লন্ডনের বড় বড় প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণ পেতে লাগলাম। বিদেশি ক্রেতারা বলত,
“বাংলাদেশের ক্র্যাফটে নতুন জীবন এনেছো তুমি।”
সংবাদপত্রে শিরোনাম উঠল, “মেঘমালা: এক তরুণী উদ্যোক্তার হাতে বাংলাদেশী সংস্কৃতির আনৃতর্জাতিক জয়যাত্রা।”
আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না, এত দ্রুত এই সাফল্য! বাবা প্রতিদিন খবরের কাগজে আমার ছবি দেখে হাসেন আর বলেন,
“তুই আমার গর্ব, মা। শেষ পর্যন্ত এ ব্যবসায় আমি তোকে সাহায্য করব।”
মা-ও খুশি হন। আমিও যেন ব্যস্ততায় ভুলতে বসেছিলাম আমার সব পুরনো দুঃখ। কিন্তু ভাগ্য সবসময় সহায় থাকে না। একাধিক দেশের ট্যাক্স আর কাস্টমসের জটিল নিয়মে আটকে গেল বড় বড় অর্ডার। নতুন নতুন প্রতিযোগী এসে বাজার দখল করতে শুরু করল। রপ্তানি খরচ বাড়ল, ডেলিভারি বিলম্বিত হলো। কয়েক লাখ টাকার লস হঠাৎ করে সবকিছুকে ওলটপালট করে দিল।
দিনরাত হিসাব মিলাতে মিলাতে আমি যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। খাওয়া, ঘুম, সব উধাও হয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হতো, বুকের ভেতরটা থমকে যাবে। সব দিক থেকে চাপ বাড়তে থাকল। একটা সময় মনে হলো, আর হয়তো পারব না, ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। ঠিক তখনই বিদেশের এক নামী কোম্পানি যোগাযোগ করল। তাদের সোজাসাপ্টা প্রস্তাব_
“আমরা ‘মেঘমালা এক্সপোর্টস’ কিনতে চাই। যত টাকা বলবেন দেব।”
প্রস্তাব শুনে রাগে গলা শুকিয়ে গেল আমার। এই ব্র্যান্ডে আমার ঘাম, আমার নিদ্রাহীন রাত, আমার ভাঙা স্বপ্নের টুকরো লেগে আছে। এই নামটা আমার জীবনের এক টুকরো স্মৃতি। কী করে আমি বিক্রি করি!
মা–বাবা বুঝিয়ে বললেন, “তুই যেভাবে দাঁড় করিয়েছিস, তেমনভাবে আবার দাঁড় করাতে পারবি। কিন্তু আপাতত এই ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে এই টাকা দরকার।”
শেষ অব্দি কোনো উপায় না পেয়ে বিদেশি কোম্পানির সাথে মিটিং-এ বসতে রাজি হলাম।
ঢাকার এক নামি হোটেলের কনফারেন্স রুমে মিটিং ডাকা হলো। এক আকাশ পরিমাণ মন খারাপ নিয়ে আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। বুক চিনচিন করে ব্যথা করছিল। বিপদে না পড়লে আমার এত শখের ব্র্যান্ডটা বিক্রি করতে হতো না। ভাগ্য কেন সবসময় আমাকে নিয়ে এভাবে খেলে! সব কিছু চলে যায় আমার হাতের বাইরে।
কোম্পানির প্রতিনিধি দেখিয়ে দিলেন ওই রুমে মিটিং-এ বসতে। এক পা দু’পা করে ধীরে ধীরে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখি— একজন লম্বা মানুষ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। গাঢ় রঙের স্যুট, সাদা শার্ট, হাতে সোনালি ওয়াচ। তার পিঠ ঘুরানো, মুখ দেখা যাচ্ছে না।
কোম্পানির প্রতিনিধি তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “Meet Mr. Jian, Founder of Horizon Group.”
এক ঝটকায় থমকে গেলাম আমি। মাথার ভেতর যেন বজ্রপাত হলো। দাঁড়ানো লোকটার হাতের ইশারায় প্রতিনিধি চলে গেলেন বাইরে। তারপর মানুষটা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল।
চোখদুটো তার গভীর শান্ত, ঠোঁটে হালকা হাসি। আলতো হেসে ঠোঁট সামান্য ফাঁক করে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলো, “মেঘমালা! …”
নামটা কানে আসতেই হিমেল স্রোতের মতো কাঁপন বইল আমার সারা শরীর জুড়ে। কতদিন কাতরাত পর এই নাম ধরে কেউ আমাকে ডাকছে! আমার বুকের ভেতর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। কাঁপছি ক্রমাগত। পানি টলমল করছে চোখে। আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে বসে পড়লাম।
সামনের মানুষটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তারপর এগিয়ে এসে দু’হাত দিয়ে আমাকে তুলে নিলো চেয়ার থেকে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আদরমাখা গলায় বলল,
“উহু, মেঘমালা… এখনও কান্না করছো? আমি তো এসে গেছি… তাই না?”
আমি কান্না করতে করতে হাত দিয়ে তার পিঠ চাপড়াতে লাগলাম, “তুমি কোথায় ছিলে, জিয়ান? এতদিন কেন খোঁজ নিলে না? আমি পাগলের মতো খুঁজেছি তোমাকে…”
সে আলিঙ্গন মুক্ত করে তর্জনী আঙুল ঠোঁটে চেপে ধরে বলল,
“শশশ। শিয়াং আমায় সব বলেছে। ওসব আর বলা লাগবে না। আমি তো এসে গেছি তোমার কাছে। এখন থেকে আমরা একসাথে থাকব। আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।”
কাঁপা কণ্ঠে বললাম,
“তুমি কেন আগে আসোনি? কেন এত কষ্ট দিয়েছো আমাদের?”
জিয়ান হালকা নিঃশ্বাস ফেলে, হাতটা আমার চুলে বুলিয়ে বলল, “নিশ্চয় কারণ ছিলো, মেঘমালা। হুদাই কি তোমাকে দূরে রাখব বলো তো? নাও, পানি খাও। শান্ত হও। জোরে শ্বাস নাও। আমি আর যাব না কোথাও। তুমি বসো… আমি মন ভরে তোমাকে দেখি…”
আমি ওর চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার সাথে কী হয়েছিল, জিয়ান? বলো… না বললে আমি শান্তি পাব না।”
“পরে বলব সব।”
“না, এখনি বলো। কারণ না জানলে শান্তি পাব না আমি।”
জিয়ানের মুখ মলিন হয়ে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বলতে লাগল, “চার মাস আমি কোমায় ছিলাম নীহারিকা। কোমা থেকে ফিরে সবার প্রথমে তোমাকে খুঁজি। মা তখন প্রতিশ্রুতি করান যেন তোমার সাথে যোগাযোগ না করি। করলে তোমারও বিপদ বাড়বে। মায়ের কথাটা যুক্তিসম্মত। তোমার ভালোর জন্য আমি তোমার থেকে দূরে থাকব। বাবা তখন বিয়ে ঠিক করেন আমার অন্যত্র। বিয়ের কয়েকদিন আগে তুমুল ঝগড়া বাধে আবার বাবার সাথে। সাফ সাফ জানিয়ে দেই আমি বিয়ে করব না। আরও অনেক ঝামেলা হয়। তারপর রাতের আধারে বাড়ির সবার অগোচরে বাবা আমায় আটক করে অন্য প্রদেশে উনার ঘনিষ্ট বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেন। উনার বন্ধু ছিলো রাজার বংশধর। বাবার মতো নিষ্ঠুর সে। আমাকে আটক করে রাখে। খাওয়া-দাওয়া সব ঠিকঠাক দিতো, বাবা তাকে কথা দিয়েছেন, তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিবেন। কিন্তু বাইরে বের হতে দিতো না আমায়। জনমানব থেকে দূরে রাখতো। এক কথায় জেলখানা থেকেও বড় জেলখানায় বন্দি ছিলাম আমি। বাবা মাঝেমধ্যে গিয়ে আমাকে দেখে আসতেন আর শর্ত দিতেন, যদি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে উনার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করি তবে আমাকে মুক্তি দেবেন। আমি রাজি হইনি। বন্দি জীবন কাটাতে থাকি। তোমাকে আমি তোমার থেকেও বেশি মিস করেছি। পুরুষ হয়েও কত কেঁদেছি তোমার জন্য শুধু আল্লাহ জানেন। তবু দোয়া করতাম তুমি যেন ভালো থেকো। কী বলব নীহারিকা। ওই দিনের কথা মনে হলে দম বন্ধ লাগে আমার।”
আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম,
“তারপর মুক্ত হলে কীভাবে?”
“বাবা মারা যান মাস তিনেক আগে।”
চমকে উঠলাম আমি।
“উনি মারা গেলেন কীভাবে?”
“হঠাৎ করে। বাবা অসুস্থ অবস্থায় উনার বন্ধুকে খবর পাঠান যাতে আমাকে নিয়ে আসেন। উনার বন্ধু আমাকে খবরটা বলতেই বাড়ি চলে আসি। পরদিন বাবা মারা যান। এরপর প্রাণ ভরে আমি শ্বাস নেই। মুক্ত হই। জোরাজোরি করার মতো আর কেউ নাই আমার। শিয়াং, শাওলি, মা, সবাই তোমার কথা বলল, তুমি উহান গেলে বাড়ি গেলে তারপর কী কী হলো সব বললেন। শিহার ছবি দেখালেন, ভিডিও দেখালেন।”
“তখন তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করলে না কেন?”
জিয়ান ধীরে ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে। মৃদু হাসি দিয়ে আমার গালে হাত বুলিয়ে বলল,
“নিতে পারতাম, নেইনি… ভাবলাম এতদিন যখন আমাকে ছাড়া থাকতে পেরেছো, আরও কয়েকটা দিন পারবে। আমি ঠিক করেছিলাম সরাসরি তোমার দেশে চলে এসে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে সারপ্রাইজ দেব।”
আমি কিছু বলার আগেই সে নিঃশ্বাস নিয়ে আবার বলল,
“বিজনেসের আইডিয়া তো তুমি যখন ছিলে তখন থেকেই নিয়েছিলাম। আমি সেটাই উহানে আবার শুরু করি। দিনরাত পরিশ্রম করে দাঁড় করাই। শিয়াংকে নিয়ে ভিসার জন্যও আবেদন করি। সবকিছু প্রায় ঠিক হয়ে যাচ্ছিল। হয়তো আরও কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশে চলে আসতাম… কিন্তু যেদিন পত্রিকায় দেখলাম ‘মেঘমালা এক্সপোর্টস’ লসের মুখে -নামটা শুনেই বুক ধড়ফড় করে উঠল আমার। খবর নিয়ে দেখি তুমি। আর দেরি করিনি। সব কাজ ফেলে চলে এলাম।”
আমার গলার স্বর ভারী হয়ে এল।
“তবু তুমি ফোনে খোঁজ নিতে পারতে জিয়ান। একবারও কল করোনি। এটা ঠিক করোনি।”
জিয়ান নরম চোখে তাকাল আমার দিকে।
“এখন আমাকে কাছে পেয়ে যেমন লাগছে, তখন ফোনে শুনলে তেমন লাগত? মাত্র তিন মাস গেছে নীহা… খুব বেশি দেরি করিনি তো। অভিমান করলে কিন্তু আবার চলে যাব।”
আমি চোখ গরম করে বললাম,
“মেরে ফেলব গেলে…”
জিয়ান হেসে উঠল জোরে। আগের মতো করে বলল, “রাগলে তোমাকে গোলাপি চেরি ব্লসমের মতো লাগে, জানো?”
আমি মুচকি হেসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। কতক্ষণ যেন দাঁড়িয়ে থাকলাম আমরা, নিঃশব্দে। তারপর ফিসফিসিয়ে বললাম,
“নড়ো না, এতদিনের জ্বলন্ত আগুনটা ঠান্ডা করি…”
আলিঙ্গন থেকে সরে এসে চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি কি সত্যিই আমার মেঘমালা কিনে নেবে?”
জিয়ান মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ল,
“বোকা মেয়ে, কিনতে আসিনি। তোমাকে কিনে দিতে এসেছি। তুমি আর আমি মিলে আবার এই ব্যবসা দাঁড় করাবো।”
বুকটা কেমন হালকা হয়ে গেল জিয়ানের কথা শুনে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম,
“বাড়ির সবাই ভালো আছেন তো?”
“ ভালো। আর শিয়াং তো এসেছে।”
উৎফুল্ল হয়ে বললাম, “সত্যি?”
“সত্যি।”
“কোথায় সে?”
“আছে বাইরে।”
ঠিক তখন দরজায় টকটক শব্দ হলো। শিয়াংয়ের গলা, “ভাইয়া, আসতে পারি?”
জিয়ান দরজা খুলে দেয়। আমি নড়েচড়ে বসি। শিয়াংকে দেখে ভালো লাগছে আমার। হেসে জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছো নীহারিকা? আমাদের আবার দেখা হলো!”
অভিমান নিয়ে বলি,
“জিয়ান ফিরে এসেছে এটা কি আমায় বলা যেতো না? হু? দু’ভাই আমায় কষ্ট দিয়েছো।”
শিয়াং এগিয়ে এসে নরম স্বরে বলল, “ভাইয়া এসেছে তো। এবার সব মান-অভিমান ছুড়ে ফেলে দাও নীহা।”
আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে নীরব হাসলাম। মনে হলো, এতদিনের জমে থাকা আগুন ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে।
শিয়াং সেটা লক্ষ্য করে হাত ইশারা দিয়ে বলল, “এখান থেকে চলো। বাসায় যাওয়া যাক।”
“কোথায় উঠেছো?”
“হোস্টেলে।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
“হোস্টেল ছেড়ে আমার বাসায় এসো। আজকেই। আমি সাথে যাব। আমার সাথে বাসায় উঠবে।”
রাস্তায় জিয়ান জিজ্ঞেস করল, “আমার মেয়ে কি বাসায়?”
“মায়ের কাছে শিহা। মায়ের ওখানে কালই যাব আমরা। বাবা সব মেনে নিয়েছেন। তোমাকে দেখলে খুশি হবেন। ”
“আজই চলোনা। কাছে এসে দেরি সইছে না। শিহাকে কোলে নিতে চাই। আদর করতে চাই।”
মারিয়া আপার বাসায় দুপুরের লাঞ্চ করি আমরা। অনেক রকম গল্প হয় আমাদের। তারপর ঢাকা শহর ঘুরে দেখাই। রাতে বাসে উঠি বাড়ি যাওয়ার জন্য। শিয়াং আলাদা সিটে বসে। আমি জিয়ান এক সিটে। বাসের লাইট অফ করা হয়। আমি জিয়ানের কোলে মাথা রাখি। পরম যত্নে সে আমাকে আঁকড়ে ধরে। কতক্ষণ পরপর চুমু খায়। বাসের জানালা খুলে রাখি আমরা। রাতের শহর দেখি আর কত বছরের না বলা গল্প বলি একে অপরকে। আজ আমি সবচেয়ে খুশি। কোনো দুঃখ নেই আমার মনে।
সকালে বাড়ি পৌঁছাই। আগেই মা-বাবা জানতেন আমরা আসছি। হাসিমুখে সবাই গেট থেকে এগিয়ে নিয়ে যান। জিয়ানকে সরাসরি দেখে মা-বাবা সবাই খুশি। মা আবেগভরা কণ্ঠে বলেন,“এত সুন্দর ছেলে আমি আগে দেখিনি।”
জিয়ান আমাকে বলল, “আগে শিহার কাছে নিয়ে যাও।”
শিহা এখনও ঘুমাচ্ছে। জিয়ান শিয়াংকে নিয়ে তার কাছে যাই। শিহাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে তুলে নেয় জিয়ান, বুকে শক্ত করে চেপে ধরে থাকে কতক্ষণ। তার চোখে টলমল করছে অশ্রু। মুহূর্তেই সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গালে। সে চোখের পানি মুছে চুমু খায় শিহাকে আর ডাকে, “উঠো সোনা মা আমার।”
শিহা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে জিয়ানের দিকে। সে চিনতে পারে না। চেনার কথাও না। জিয়ান অস্থির হয়ে বারবার বলে, “আমি তোমার বাবা হই সোনা। বাবা হই। আমি এসেছি….!”
মা পেছন থেকে নরম গলায় বলেন, “হঠাৎ বাবাকে কাছে পেয়েছে তো, চিনতে পারছে না। ধীরে ধীরে চিনে যাবে। বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝবে না তখন।”
শিহাকে কোলে থেকে একবারের জন্যও নামাচ্ছে না জিয়ান। শিহা চিনতে পারেনি ঠিক, কিন্তু শান্তভাবে বসে আছে জিয়ানের কোলে। হাহাকার করে উঠলো আমার বুক। আমার মনে হলো, আমার থেকেও জিয়ানের কষ্ট বেশি মেয়েকে কাছে না পাওয়ার জন্য।
জিয়ান মা-বাবাকে বলে, “আমাকে নিয়ে উহান চলে যাবে। ওখানে থাকব সবাই। মাঝেমধ্যে দেশে এসে ঘুরে যাব।”
বাবা-মা আপত্তি করেননি। আমার শপ বিক্রি করে দেই। তাতে কিছুটা টাকা উঠে আসে। উহানে গিয়ে নতুনভাবে স্বাধীনভাবে সব শুরু করব আমি আর জিয়ান। মা, শাওলি, শিয়াং সবাই মিলে আমাদের জীবন খুব ভালো কাটবে।
দুই সপ্তাহ পর আমরা উহানের উদ্দেশ্যে প্লেনে উঠি। জিয়ানের কোলে শিহা বসে আছে। বাপ-মেয়ে গল্প করছে। শিয়াং জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে। আমাকে ডেকে বলল, “আকাশপথ অনেক সুন্দর নীহারিকা।”
আমি মুচকি হেসে জানালার বাইরে তাকালাম, “হুম। অনেক সুন্দর।”
“আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম বাংলাদেশ আমরা আসবো। এসেছি। আবার তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ভাগ্য আমাদের সহায় হয়েছে নীহারিকা। সব ঠিক হয়ে গেছে। আমি অনেক খুশি।”
মজা করে বললাম, “এখন তোমাকে বিয়ে দিতে পারলে আমাদেরও খুশি লাগবে। পরিপূর্ণ হবে ঘর।”
“তোমার মতো কিউট মেয়ে না পেলে বিয়েই করব না, নীহা।”
হেসে বললাম, “সারা উহান শহর খুঁজে তোমার জন্য কিউট মেয়ে বের করবই।”
শিয়াং দুষ্টু হাসি হেসে মাথা ঝাঁকাল, “তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই।” -বলেই হাত বাড়িয়ে শিহাকে কোলে তুলে নিলো। শিহার কচি হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলল, “আকাশপথে শিহাই হবে আমার সঙ্গী। তাইনা মা?”
শিহা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।
জিয়ান আমার কাঁধে হাত রেখে আরেকটু টেনে নিলো কাছে। জানলার বাইরের তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ দেখিয়ে বলল, “দেখো তোমার মতো সুন্দর।”
আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম, “তুমি তার থেকেও সুন্দর।”
তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার হাত আঁকড়ে ধরলাম, “এখনও সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে জিয়ান। ভয়ংকর দিনগুলো আমাদের জীবনে আর ফিরে না আসুক।”
জিয়ান গম্ভীর গলায় বলল, “আসবে না ইনশাআল্লাহ। সব নতুন করে শুরু হবে। মা শাওলিকে উহানে নিয়ে আসবো। সবাই একসাথে এখানে থাকব।”
“আর তোমাদের এত সুন্দর বাড়ি?”
“বাড়ি থাকবে, মাঝেমাঝে যাব।”
“শীতকালে কিন্তু যেতেই হবে। শীতকালের মাংজিয়া গ্রাম অসাধারণ। ছবির চেয়েও সুন্দর। তুষার ঝরা আকাশ! উফ। এবার কিন্তু তুষার-বৃষ্টি বিলাস করব আমি। বাধা দিতে পারবে না।”
“বাধা নয়, সঙ্গী হব আমি।”
“আর হে, যতবার শীতকাল আসবে ততবার দাদুর কাঠের ঘরে যাব। তুমি আমি সপ্তাহে একবার করে যাব। তুষার ঝরা দেখব। আকাশ দেখব। ছাদের উপর পড়া তুষারের গায়ে যখন চাঁদের আলো চিকচিক করবে তখন কাঠের চুল্লিতে চা বানিয়ে খাব আর…”
জিয়ান কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আর?”
আমিও তাল মিলিয়ে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “আগুন ধরিয়ে বসব স্টোভের সামনে। সেই আগুনের ঝিলিকে তোমাকে দেখব। জানো তো জিয়ান? তোমায় আগুনের আলোয় দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগে।”
আলতো করে কানের লতিতে কামড়াল জিয়ান, বলল, “আমি ভাবছিলাম আরও কিছু বলবে।”
লাজুক হেসে চিমটি কাটলাম তার হাতে, “দুষ্টু কোথাকার।”
হে মিষ্টি হাসলো। আমিও হেসে জিয়ানের কাঁধে মাথা রাখলাম। সে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল আমায়। হাত বুলাতে লাগল চুলে। তার এই গুণটা আরও বেশি মন কেড়ে নেয় আমার। মনে হয়, বাচ্চাদের মতো আদর করছে আমায়। ভেতরটা খুশিতে ভরে উঠে। জিয়ানের এমন আদর পেয়ে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসলো আমার। চোখ আর খোলা রাখতে পারিনি। আমি ঘুমের দেশে পাড়ি জমাই।
সমাপ্ত|