ভুলতে পারিনি তাকে পর্ব-১৯

0
442

#ভুলতে_পারিনি_তাকে
#Writer_Mahfuza_Akter
#পর্বঃ১৯

ঘরের ভেতর পিনপতন নিস্তব্ধতা। আভাস পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে শ্রুতি দিকে। তার চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু শ্রুতি ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে যেন, এটা খুবই নরমাল একটা ব্যাপার। আভাস চেহারায় অবাকতা বজায় রেখেই বললো,

—কী বললে? উনি মানুষ নন? তাহলে উনি কে?

শ্রুতি আভাসের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
—আপনার কী মনে হয়? সেদিন মাঝরাতে কোনো সাধারণ মানুষ সেই গহীন জঙ্গলে গিয়ে আমায় বাঁচাতে পারতো?

আভাসের এবার ভাবান্তর ঘটলো। আসলেই তো! এ ব্যাপারটা তো তার মাথায় আসেনি! কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে মাঝরাতে জঙ্গলে যাওয়া সম্ভব নয়। আভাসের ভাবুক মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রুতি নিঃশব্দে হেসে বললো,
—শুনুন, এতো ভাবাভাবির কিছু নেই। ওনি একজন জ্বিন। তাও আবার সাধারণ কোনো জ্বিন নন, ওনার মধ্যে অনেক ক্ষমতা আছে। এই যে, ওনার এই শাড়ি পরিহিত বৃদ্ধার গেটআপ দেখছেন; এটাও ওনার আসল রূপ না। ওনি জাস্ট মানুষের সামনে এমনটা সেজে থাকেন। তবে একটা কথা মানতেই হবে, ওনি অসম্ভব বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। তাই ওনার ওপর নির্দ্বিধায় ভরসা করা যায়।

আভাস ভ্রূকুটি কুঁচকে বললো,
—কীভাবে বুঝলে যে, উনি অনেক বুদ্ধিমতি?

—কারণ ওনি অনেক ভেবে চিন্তে কাজ করেন। আপনার মা যাদেরকে দিয়ে আমায় মারতে চেয়েছিল, তাদের কাউকেই মিনহা জি বাঁচিয়ে রাখেননি। আপনার মাকেও রাখতো না। কিন্তু শুধু একটা কারণে বাচিয়ে রেখেছেন।

—কী কারণ?

—আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর দুদিনের মধ্যে মিনহা জি ঐ লোকগুলোকে সেই জঙ্গলেই ধরে আনেন যেখানে ওরা আমায় মারতে চেয়েছিল। তখন ওরাই আরিহা খানের কথা বলে। আর এটা শোনার পর, মিনহা জি আরো খবর নেন। কিন্তু আশানুরূপ কিছু জানতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো আপনার মা আমায় পছন্দ করতেন না! কিন্তু পছন্দ না করার মতো কোনো কারণ ছিলোনা। কারণ, আমার ধন-দৌলত ও সৌন্দর্য দুটোই ছিল। তবে আপনার মায়ের আমার প্রতি একটা আক্রোশ ছিল যেটা সম্পর্কে মিনহা জি নিশ্চিত হয়েছিল। তাই তিনি যদি জানতে পারেন যে, আমি বেঁচে আছি তাহলে আবার আক্রমণ করবেন। এজন্য মিনহা জি ঐ লোকগুলোকে মেরে ফেলেছিলো যেন তারা আপনার মাকে কোনো খবর দিতে না পারে। এরপর আমাদের শহর ছেড়ে চলে যেতে বলেন।

শ্রুতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে থামলো। আভাসের দিকে তাকিয়ে দেখলো, আভাস রাগে অনেকটা কাঁপছে। রাগী গলায় বললো,
—তো তুমি কি এখন আমায় মিনহার কথাই মেনে নিতে বলবে?

—এছাড়া আর কোনো উপায়ও তো নেই! আমাদের তো জানতে হবে উনি কেন আমার সাথে এমন করতে চেয়েছিলেন!

আভাস আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। তবে মনে মনে বললো,
—যদি আবার তুমি শ্রুতির কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করো, মিসেস খান! আমি কারো কোনো কথা শুনবো না। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আক্ষেপ হলো, তুমি আমার মা। ছিঃ!
______________

সকালে আভাস শ্রুতির সাথে ব্রেকফাস্ট করে ভার্সিটির জন্য বেরিয়ে গেল। আজ তাকে যেতেই হবে বলে অনেকটা বাধ্য হয়েই রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সাথে আরাফ আহসান আর তন্ময়ও গেল। কিন্তু তানিয়া আহসান আর স্নেহা যায়নি, কারণ শ্রুতিকে একা রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে না। সারাদিন স্নেহার সাথে আড্ডা দিয়ে তেমন একটা বোরিং লাগেনি শ্রুতির। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই বিরক্তি গুলো সব জেঁকে বসেছে। আভাসকে কল দিয়ে দেখে বারবার নন-রিচেবেল বলছে। হয়তো গাড়িতে আছে, তাই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না।

অনেকক্ষণ যাবৎ তানিয়া আহসানের কোনো খবর নেই বলে শ্রুতি তার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু হুট করে নাতাশা শ্রুতির ঘরে ঢুকে ওর পথ আগলে দাঁড়ায়। শ্রুতির কাছে নাতাশা একদমই অপরিচিত, কখনো দেখেনি ওকে। কিন্তু আভাসের মুখে অনেকবারই শুনেছে নাতাশার কথা। তবে কোনো প্রশংসা কখনো শুনেনি।

নাতাশা শ্রুতির দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, এটা দেখে শ্রুতি খানিকটা ভ্রু কুঁচকালো।

—তাহলে তুমিই সেই মেয়ে, যে কিনা আভাসের মাথা খেয়েছি।

শ্রুতি অবাক হয়ে বললো,
—আজব তো! কে আপনি? হুট করে এখানে এসে এসব আজেবাজে বকছেন কেন?

নাতাশা চোখ রাঙ্গিয়ে বললো,
—আমি আজেবাজে বকছি? তুমি যে আমার জিনিসে হাত দিয়েছো, সেটার কী হবে? কী দেখিয়ে আভাসকে বশে এনেছো? তোমাদের মতো ছোটলোক মানুষদের আমার বেশ ভালো করেই চেনা আছে।

শ্রুতি দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—মুখ সামলে কথা বলুন। আমি আমায় একের পর এক অপমানজনক কথা বলেই যাবেন আর আমি চুপ করে থাকবো, এমনটা কিন্তু হবে না। আমি কোনো দিক দিয়েই ছোটলোক নই। আমার যে পরিমান টাকা আছে, তা আপনি গুনে শেষ করতে পারবেন না। ছোটলোক তো আপনারা যারা অহংকারে মানুষকে মানুষ মনে করে না।

নাতাশা রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
—টাকার গরম দেখাচ্ছো? তাহলে এভাবে মুখ ঢেকে রেখেছো কেন? নিজের মুখ লুকিয়ে সাহসিকতা দেখাচ্ছো? কই দেখি একটু তোমার সুন্দর চেহারাটা! যেটা দেখে আভাস এতোই পাগল হলো যে, ভুলতেই পারলো না!
বলেই নাতাশা শ্রুতির কাছে এগিয়ে আসলো।

শ্রুতি একটা শুকনো ঢোক গিলে দুপা পিছিয়ে যায়। কিন্তু নাতাশা একটানে শ্রুতির মুখের বাঁ পাশ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলে। নাতাশা চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে। জোরে চিৎকার দিয়ে বললো,
—তোমার, তোমার মুখ এমন ঝলসানো কেন? তোমার মুখে এসিড মেরেছে কেউ! ওহ মাই গড!

নাতাশার কথা শুনে শ্রুতি কিছু বললো না, কারণ তার বলার মতো কিছুই নেই এখন। তার মুখটাই যে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দূর্বলতা! এমন একটা চেহারা নিয়ে সে কীভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলবে?

এদিকে শ্রুতির কোনো উত্তর না পেয়ে নাতাশা ওর দিকে তেড়ে এসে বললো,
—তোমার মতো থার্ড ক্লাস মেয়েদের আমি ভালো মতোই চিনি। নষ্টা মেয়ে!!! কার সাথে নষ্টামি করতে গেছিলে কে জানে? এ জন্যই শেষ পর্যন্ত তোমার এই পরিনতি হ……..

—নাতাশাআআআআ……….

নাতাশার কথার মাঝেই হঠাৎ পেছন থেকে কারো জোরে চিৎকারের শব্দে নাতাশা আর শ্রুতি কেঁপে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো আভাস অগ্নি দৃষ্টিতে নাতাশার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। নাতাশা ভয়ে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বললো,
—আমি আসলে ওর সাথে, মানে……….

আভাস এগিয়ে গিয়ে নাতাশার সামনে মুখোমুখি হয়ে দাড়াতেই নাতাশার মুখ বন্ধ হয়ে গেল। আভাস দাঁত কিড়মিড় করতে করতে নাতাশার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে বললো,
—তোর সাহস কীভাবে হয় আমার ঘরে এসে আমার বউকে প্রস্টিটিউটের মতো গালাগাল করিস? তোর মতো বেহায়া মেয়েকে বারবার বলেও লাভ নেই। তুই আজই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি এবং এক্ষুনি চলে যাবি।

নাতাশা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—এই মেয়েটার জন্য তুমি আমায় এতো কথা শোনালে, দুই বার থাপ্পড় মারলে? কী পেয়েছো ওর মধ্যে? ওর তো চেহারাটাই পুরো নষ্ট হয়ে গেছে! কোথায় তুমি আর কোথায় এই মেয়ে?

আভাস শ্রুতির কাছে গিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
—আমি কাকে বিয়ে করবো, কাকে ভালোবাসবো? সেটা তোর কাছে জিজ্ঞেস করে নেব না নিশ্চয়ই! ওর ফেস যেমনই হোক না কেন? শতসহস্র নারীর মাঝে আমার যে শুধু ওকেই চাই! আমার মিষ্টিপাখিটাই যে আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দরী! এই চোখ দুটো চাতক পাখির মতো আজীবন তাকেই খুঁজে যাবে।

নাতাশা চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে আর এখানে থাকবে না, আজই চলে যাবে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে উদ্যত হলেই পাশ থেকে আরিহা খান খপ করে নাতাশার হাত ধরে ফেললেন। নাতাশা তার দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকালে তিনি বলেন,
—এখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে নিজের বিপদ ঢেকে আনার চেষ্টা করিস না। একটু পর শ্রুতি নিচে যাবে খাবার আনতে, কারণ আভাস এখন ক্লান্ত। তাই বিপদটা ওর ওপর দিয়ে যেতে দে।

—মানে? কিসের বিপদ?

আরিহা খান শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
—সেটা তো একটু পরেই দেখতে পাবি!

নাতাশা উৎসাহ দেখিয়ে বললো,
—বলো না, খালামনি। প্লিজ!

—সিঁড়িতে তেল ঢেলেছি। যে পা রাখবে, তার আর রক্ষা নেই। এখন চল তাড়াতাড়ি, এখান থেকে কেটে পড়ি। নয়তো আভাস সন্দেহ করতে পারে।

নাতাশা আহ্লাদী স্বরে বললো,
—ওকে, চলো। আজ তাহলে সেই মজা হবে।

এদিকে আভাস শ্রুতির দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
—তোমাকে কেউ ঘর বয়ে এসে যা নয় তাই বলে যাবে, আর তুমি চুপচাপ শুনবে, ইডিয়েট?

শ্রুতি মাথা নিচু করে বললো,
—চুপ ছিলাম না৷ কিন্তু উনি যখন আমার ফেস নিয়ে কথা তুললো, তখন…………

—তখন তোমার সেন্টিভ পয়েন্টে আঘাত লেগেছে এন্ড তুমি চুপ করে গেলে, তাই তো?

—হুম। কী-ই বা বলতাম আমি?

—কী বলতে মানে? তোমার হাত দিয়ে একটা ঠাটিয়ে চড় মেরে দিতে পারলে না? এটা কি ওর বাড়ি নাকি? এটা আমার বাড়ি। আর আমার বাড়ি মানে তোমার বাড়ি। বুঝেছো?

—হুম।

—কচু বুঝেছো।

শ্রুতি কাচুমাচু হয়ে বললো,
—রাগ করেছেন?

—করেছিলাম, কিন্তু তোমার ঐ চেহারা দেখে রাগ বোধ হয় পানি হয়ে গেছে। এখন আমার আর নিজের জন্য খাবার নিয়ে আসো তো নিচ থেকে! অনেক টায়ার্ড লাগছে, আর খিদেও পেয়েছে।

শ্রুতি হেসে সম্মতি জানিয়ে ঘরের বাইরে পা বাড়ালো।

-চলবে…………