ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব-১৯+২০

0
69

#ভূমধ্যসাগরের_তীরে
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা_দিশা_মনি

মিষ্টির জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে একটি আবদ্ধ ঘরে আবিষ্কার করে। মিষ্টি চোখ খুলেও বেশি কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। ভয়ে তার কান্না করার উপক্রম ছিল। এমন সময় হঠাৎ সে বাইরের কোন একটা স্থান থেকে শোরগোলের আওয়াজ শুনতে পায়৷ অতঃপর ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দেখে একটা দরজা। যা হালকা চাপানো৷ মিষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে আসে সেই বদ্ধ রুম থেকে। অতঃপর সামান্য এগোতেই অবাক হয়ে যায়। কারণ সে আবার মার্সেই শহরে চলে এসেছে! মিষ্টি এটা বুঝতে পেরে হতবাক স্বরে বলে,
“আমি তো প্যারিসে ছিলাম তাহলে মার্সেই তে কিভাবে চলে এলাম?”

অতঃপর সে জ্ঞান হারানোর পূর্ব মুহুর্ত মনে করে। সেই কথাটা মনে কর‍তেই ভীষণ ভয় জাগে তার মনে। অজানা আশংকায় কেপে ওঠে তার বুক৷ মিষ্টি বুঝতে পারে না এখন সে কি করবে। তার কি এখন আবার ইয়াসিনদের কাছে ফেরা উচিৎ? এসব প্রশ্নই ঘুরপাক খেতে থাকে মিষ্টির মনে। তবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না।

★★
ইমানুয়েল পল নিজের কার্যালয়ে বসে ছিল৷ তাকে ভীষণ উদ্বিগ্ন লাগছিল। এমন সময় কারো আগমন ঘটে। ইমানুয়েল পল চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় এলিজা ল্যুঁইকে। তাকে দেখেই পল খানিক বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে,
“আপনি এখানে কি করছেন মিস এলিজা? আমি তো বলেছিলাম আমি কিছু সময় একা থাকতে চাই। আপনি সেটা শোনেন নি?”

এলিজা হালকা হেসে বলে,
“এত রেগে যাচ্ছন কেন মিস্টার পল? আপনার এত রাগের কারণ কি?”

পল আর কিছু বলে না। এলিজা পলকে চুপ দেখে বলতে শুরু করে,
“দেখলেন তো, আমার সন্দেহটাই ঠিক। ঐ মিষ্টি নামক মেয়েটা কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে জড়িত। প্যারিসে আজ যেই ব্লাস্ট হয়েছে তার পেছনে ওরই হাত রয়েছে।”

পল চোখ বন্ধ করে নেয়। এই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্যটা যেন সে মানতেই চায় না। এলিজা আরো রেগে বলে,
“আপনাকে ফ্রান্সে নিয়ে আসা হয়েছিল পৃথিবীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন আপনি? মিশনের উদ্দ্যেশ্য কি ভুলে গেছেন আপনি? আজ প্যারিসের রেলওয়ে স্টেশনে যে হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল তার ফলে কতটা মারাত্মক ফল হতে পারত বুঝতে পারছেন? ভাগ্য ভালো যে, পুলিশ সঠিক সময় ঐ মিষ্টিকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। তবে, তাতেও বা লাভ হলো কৈ? ঐ সন্ত্রাসীটা তো ঠিকই পালিয়ে গেল।”

পল এবার ক্রোধ প্রকাশ করে বলল,
“বেশিদিন পালিয়ে বেড়াতে পারবে না ও। খুব শীঘ্রই ওকে খুঁজে বের করব আমি।”

“এসবের কিছুই হতো না যদি আপনি ওকে জেল থেকে ছেড়ে না দিতেন। আমি তো আগেই আমার সন্দেহের কথা আপনার কাছে প্রকাশ করেছিলাম কিন্তু আপনি আমার কথা আমলে নিলেন না। ভুলে গেলেন যে, আমি ফ্রান্সের অন্য শক্তিশালী একজন গোয়েন্দা। আপনার থেকে আমার অভিজ্ঞতা কিছুটা হলেও বেশি। অথচ আপনি কোন এক অজানা কারণে ঐ মেয়েটাকে ছেড়ে দিলেন। আচ্ছা, এর কারণ কি মিস্টার পল? শুধু এটাই যে ঐ মেয়েটা আপনার দেশের নাগরিক? এজন্যই ওর প্রতি এত দয়া দেখিয়েছেন? নাকি অন্য কোন ব্যক্তিগত কারণ আছে?”

পল বলে ওঠে,
“মিস এলিজা..আপনি আমার ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।”

“দুঃখিত, মিস্টার পল। কিন্তু আপনার কাজকর্ম দেখে আমি এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। আমি তো আপনাকে একজন ন্যায়পরায়ণ, বলিষ্ঠ ব্যক্তি ভেবেছিলাম। যে নিজ দায়িত্বে সব পিছুটান ভুলে পৃথিবী রক্ষার এই মিশনে নেমেছে। এজন্যই তো আমি আপনাকে এতটা বিশ্বাস করেছিলাম। অথচ আপনি কি করলেন? আপনি জানেন না, কতটা ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে ফ্রান্সে নিয়ে এসেছিলাম আমি৷ নিজের দেশের সরকারের থেকেও ব্যাপারটা লুকিয়ে রেখেছি। নিজের প্রভাব খাটিয়ে একটা মিথ্যা পরিচয় দিয়েছি আপনাকে। কিসের জন্য করেছি এসব? শুধু বিশ্বব্যাপী ধ্বংসলীলা চালানো ঐ সন্ত্রাসীদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্য। শুধু আপনাকেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আরো ৪০-৫০ জনকে এই কাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোতে। কেননা, এসব সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেট ফ্রান্সের মতো পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোতে অশান্তি সৃষ্টি করে এখানকার পরমাণু অস্ত্র চুরি করে বিশ্বে ধ্বংসলীলা চালানো। সে জন্যই আপনার মতো অকুতোভয় কাউকে দরকার ছিল ফ্রান্সে। অথচ আপনি কি করলেন? এত স্পর্শকাতর একটা মিশনে যোগ দিয়েও এতটা ঢিলেঢালা ভাব দেখালেন?”

পল মাথা নিচু করে দেয়। তার এখন খানিকটা আফসোস হচ্ছে। এলিজা শুরুতেই তাকে এমন কিছু গোয়েন্দা তথ্য দিয়েছিল যে মিষ্টি এই সন্ত্রাসী সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকতে পারে আর সেজন্যই তাকে গ্রেফতার করে টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। যদিওবা পলের নিজেরই কাছে কেমন জানি খারাপ লাগছিল মিষ্টিকে এভাবে টর্চার সেলে পাঠাতে। কেননা, মেয়েটা তো তার জন্যই এদেশে এসেছে। তবে যেহেতু এলিজার মতো এত তুখোড় একজন গোয়েন্দা দাবি করেছিল মিষ্টির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে তাই আর সে এ নিয়ে কোন আপত্তি করতে পারে নি। পরে যখন এত নির্যাতন সহ্য করেও মিষ্টি কিছু বলল না৷ আবার একজন স্বনামধন্য আইনজীবী তার হয়ে কথা বলল, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই পল মিষ্টিকে ছেড়ে দেয়। কেননা, তার নিজেরও মন কেমন করছিল মিষ্টির জন্য। তবে এখন তার মনে হচ্ছে, সে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। আবেগের বশে বিবেক হারানো উচিৎ হয়নি তার। যেভাবে সব পিছুটান ভুলে, অতীতকে পেছনে ফেলে, নিজের আসল পরিচয়কে হ*-ত্যা করে সে এই মিশনে নেমেছিল তার সেই পিছুটানই কি এখন তার মিশন ব্যর্থ করে দেবে? পল সেটা হতে দেবে না।

এমন সময় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছুটে এসে বললেন,
“স্যার, একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর আছে। আমি খবর পেয়েছি, মিষ্টি নামক ঐ সন্ত্রাসীকে মার্সেই পোর্টের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।”

পল চোয়াল শক্ত করে বলে,
“এক্ষুনি আমার টিমকে প্রস্তুত করো। ঐ সন্ত্রাসীকে ধরতে হবে আমাদের। সে জীবিত হোক বা মৃত!”

“ওকে, স্যার।”

বলেই সে বেরিয়ে যায়। এদিকে এলিজা পলকে স্পষ্ট করে বলে দেয়,
“আশা করি, নিজের এই জেদ আর মনোবল শেষ অব্দি বজায় রাখবেন মিস্টার পল। ঐ সন্ত্রাসীকে আরো কোনরকম দয়া দেখাবেন না।”

পল মাথা নাড়ায়।

★★
মিষ্টি উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে মার্সেই পোর্ট এলাকায় হেটে চলছে। যদিও তার মন চাইছিল ইয়াসিনদের সাথে দেখা কর‍তে কিন্তু সে করল না। কারণ যেভাবে তাকে প্যারিসে গ্রেনেডসহ হাতেনাতে ধরা হয়েছিল তাতে করতে হয়তো ইতিমধ্যেই তাকে সন্ত্রাসী তালিকাবদ্ধ করা হয়েছে। এই মুহুর্তে সে ইয়াসিনদের সাথে দেখা করে তাদের কোন বিপদে ফেলতে পারে না। এজন্য আপাতত সে কোনরকমে স্কার্ফে মুখ লুকিয়ে চলছে। কিন্তু হঠাৎ করে সাইরেনের শব্দ শুনে তার বুকটা কেপে ওঠে। সে দেখতে পায় একটা পুলিশের গাড়ি এগিয়ে আসছে তার দিকেই। মিষ্টির মনে হঠাৎ করে ভয় জেগে ওঠে। সে আর এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে একদম ভূমধ্যসাগরের তীরে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর আর কোন উপায় না দেখে মার্সেই বন্দরের সামনেই দাঁড়ানো একটা জাহাজে উঠে পড়ে।পল ও অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা তাকে অনুসরণ করতে করতে সেই জাহাজে উঠে পড়ে।

মিষ্টি নিজেকে বাঁচাতে জাহাজের মধ্যেই পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু একসময় পল তাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে তার দিকে বন্দুক তাক করে। মিষ্টি এবার ভয় পেয়ে যায়। পল তাকে বলে,
“আপনার পালানোর আর কোন পথ নেই।”

মিষ্টি বলে,
“বিশ্বাস করুন, আমি কিছু করিনি। আমি কোন সন্ত্রাসী নই।”

“বিশ্বাসের আর কোন সুযোগ নেই। হয় ধরা দিন, আর নয়তো…”

মিষ্টি ভয়ে পুনরায় পালানোর চেষ্টা করে এতে পল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বন্দুকের ট্রিগারে একটা চাপ দেয়। গুলিটা বের হয়ে ঠিক মিষ্টির কাধকে ভেদ করে। মিষ্টি হতবাক হয়ে তাকায় পলের দিকে। পলও হতভম্ব। মিষ্টি গিলিবি হয়েই জাহাজ থেকে পড়ে যায় ভূমধ্যসাগরের মধ্যে৷ ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকে ভূমধ্যসাগরের অতল সাগরে। তার রক্তের স্রোত মিশে যায় ভূমধ্যসাগরের তীরজুড়ে…

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

#ভূমধ্যসাগরের_তীরে
#পর্বঃ২০
#লেখিকা_দিশা_মনি

পল মিষ্টিকে পড়ে যেতে দেখে হতবাক হয়ে যায়। সে তো মিষ্টিকে গুলি করতে চায়নি! কিভাবে তার দ্বারা এত বড় ভুল হয়ে গেল! পল এক মুহুর্তের জন্য ভাবল সে পানিতে ঝাঁপ দেবে মিষ্টিকে বাঁচানোর জন্য। আর এক মুহুর্ত সময় দেরি না করে সে ভূমধ্যসাগরের জলে ডুব দিতে চায় কিন্তু তার টিমের কিছু লোক তাকে আটকে বলে,
“স্যার, এখানে অনেক গভীর পানি। এখানে ঝাঁপ দিবেন না।”

“ছাড়ো আমায়,”

“স্যার, আপনি এমন করছেন কেন? একটা সন্ত্রাসীই তো পড়ে গেছে৷ তার তো মরে যাওয়াই উচিৎ। আপনি ওনাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।”

পল কিছু বলতে পারে না। তবে নিজের বিবেকের কাছে সে ধাক্কা খাচ্ছিল। তাই সবার সব বাধা অতিক্রম করে সে ভূমধ্যসাগরের জলে ঝাঁপ দেয়। ভালো সাতার পাড়ার পরও সে এই গভীর জলে হাবুডুবু খেতে থাকে। আশেপাশে মিষ্টিকে খুঁজতে থাকে কিন্তু ফলাফল শূন্য! মিষ্টিকে না পেয়ে হতাশার শ্বাস ফেলে পল। অতঃপর মনে মনে বলে,”এটা কি হওয়ার ছিল আমার সাথে? মিষ্টির কিছু না হলে যে আমি নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারব না। হে আল্লাহ, আপনি কৃপা করুন আমার উপর। মিষ্টিকে যেন আমি খুঁজে পাই।”

পলের এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে সে খেয়াল করে কিছু ডুবুরি তার আশেপাশে। তারা দ্রুত পলকে জোরপূর্বক জাহাজে টেনে তোলে। পল রেগে বলে,
“আমায় এভাবে তুললেন কেন? আমায় মিষ্টিকে খুঁজতে হবে।”

ডুবুরি দলের একজন সদস্য বলে ওঠে,
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা খুঁজে দেখছি যদি ওনাকে পাওয়া যাই।”

এরপরই মিষ্টির খোঁজ শুরু হয়। কিন্তু কিছু সময় কেটে ওঠেও মিষ্টির কোন খোঁজ না পেয়ে তারা ফিরে আসে। পল তাদের হতাশাগ্রস্ত চেহারা দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে৷ তার অনুশোচনার বোঝা বাড়ে।

★★
পল নিজের অফিসে বসে ছিল। তাকে ভীষণ মনমরা লাগছিল। এমন সময় কারো আগমনে তার ধ্যান ভাঙে। এলিজা পলের কক্ষে প্রবেশ করতে করতে বলে,
“কি ব্যাপার মিস্টার পল? আপনাকে এত উদাস লাগছে কেন?”

পল দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। কিন্তু কিছু বলে উঠতে পারে না। এলিজা একগাল হেসে বলে,
“চারিদিকে আপনাকে নিয়ে কতো প্রশংসা হচ্ছে জানেন! আমার তো এসব শুনে ভীষণ ভালো লাগছে। আপনার কাজে আমি নিজেও ভীষণ আনন্দিত।”

পল বলে,
“আপনি আমায় একটু একা থাকতে দেবেন? আমার এখানে কিছুই ভালো লাগছে না।”

“এত উদাস হবার কি আছে এখানে? একটু হাসুন, আমি একটা পার্টির আয়োজন করেছি আপনার সফলতা উদযাপন করতে। সেই পার্টিতে যোগদান করুন।”

পল এবার ভীষণ রেগে বলে,
“আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন না মিস এলিজা? আমার কিছু স্পেস দরকার৷ আপনার এত আনন্দ করার ইচ্ছা হলে যান গিয়ে যত খুশি আনন্দ করুন। আমাকে এসবে ইনভলভ করার চেষ্টা করবেন না।”

“মিস্টার রাফসান শিকদার! আপনি কিন্তু নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। আমার সাথে এমন অসভ্যতামি করার রাইট আপনার নেই।”

এলিজার মুখে নিজের আসল মুখটা শুনে রাফসান আরো রেগে বলে,
“আমায় আর এই নামে ডাকবেন না। রাফসান শিকদার মারা গেছে। আমি নিজে মেরে ফেলেছি তাকে। যেটুকুও বা বেঁচে ছিল সেটাও আজ আমি শেষ করে ফেলেছি। এখন শুধু নির্দয় অফিসার ইমানুয়েল পল বেঁচে আছে!”

তাদের মধ্যে এমন তর্কযুদ্ধই চলছিল এমন সময় রাফসানের অধীনস্থ একজন স্টাফ এসে বলে,
“স্যার, আপনি জলদি আসুন। একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আপনাকে দেখাতে চাই।”

রাফসান ভ্রু কুচকে বলে,
“কি দরকারি জিনিস?”

“আপনি আসুন। এলেই দেখতে পারবেন।”

রাফসান আর কথা না বাড়িয়ে রুমের বাইরে আসে। তার একটা গোপন কক্ষে চলে যায়। সেখানে যেতেই একজন ছদ্মবেশী গোয়েন্দার মুখোমুখি হয় সে৷ যার হাত-মুখ সবকিছুই বাধা। সেই গোয়েন্দাকে রাফসান নিজেই নিয়োগ করেছে। রাফসান তার কাছে এসে বলে,
“বলো, কি নিউজ এনেছ তুমি?”

“অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা নিউজ। এই ভিডিওটা দেখুন।”

রাফসান একটা সিসিটিভি ফুটেজের স্ক্রিনে মনযোগ দেয়। এই সিসিটিভিটা মেট্রো স্টেশনের মধ্যকার। এখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেট্রোর মধ্যে যখন মিষ্টির চোখ একটু লেগে যাচ্ছিল তখনই কেউ একজন এসে সুকৌশলে মিষ্টির সাথে নিজের ব্যাগটা চেঞ্জ করে নিয়ে চলে যায়। দুজনের ব্যাগটা এতটাই সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল যে স্বাভাবিক ভাবে পার্থক্য বের করা সম্ভব নয়। এই দৃশ্যটা দেখেই রাফসান নিজের হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। চিৎকার করে বলে ওঠে,
“এসবের মানে কি?”

“আপনি যা সন্দেহ করেছিলেন সেটাই ঠিক মিস্টার পল। মিসেস মিষ্টি একদম নির্দোষ। তাকে এসব ঘটনায় ফাঁসানো হয়েছে।”

“কি বলছ তুমি? কিন্তু কে করবে এই কাজ? মিষ্টির সাথে কার শত্রুতা থাকতে পারে?”

সেই ছদ্মবেশী গোয়েন্দাটা বলে,
“সেটাই তো আসল প্রশ্ন। কিন্তু স্যার, আমি তো আগেই আপনাকে এই বিষয়ে সতর্ক করেছিলাম যে হয়তোবা মিসেস মিষ্টিকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তাহলে আপনি কেন তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেন?”

রাফসান কিছু একটা ভেবে বলে,
“আমার উদ্দ্যেশ্য মিষ্টিকে গুলি করা ছিল না। আমার উদ্দ্যেশ্য ছিল ওকে গ্রেফতার করা। আর সবথেকে বড় কথা আমার রাইফেলে কোন গুলিই ছিল না।”

“তার মানে গুলিটা আপনি করেন নি?”

“না।”

“তাহলে মিসেস মিষ্টিকে গুলিটা করল কে?”

“সেটাই তো ভাবছি।”

ছদ্মবেশী গোয়েন্দা বলে ওঠে,
“ওহ বুঝেছি৷ তার মানে এর পেছনে ঐ সন্ত্রাসী সংগঠনেরই কারো হাত থাকতে পারে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, কে আছে এসবের পেছনে?”

“সেটাই তো খুঁজতে হবে। যাইহোক, মিষ্টি এখন কেমন আছে?”

ছদ্মবেশী গোয়েন্দা রাফসানের এহেন প্রশ্ন শুনে হালকা হেসে বলে,
“আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আপনার স্ত্রী একদম ঠিক আছে। তার গায়ে লাগা গুলিটা বের করা হয়েছে। যদিও এখনো জ্ঞান ফেরেনি তবে চিন্তার কিছু নেই দ্রুতই ফিরবে হয়তোবা।”

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। মিষ্টির খেয়াল রাখবেন। এখন হয়তোবা ও আমায় ভুল বুঝবে। তবে একসময় ঠিকই সবটা বুঝবে।”

“আপনি চিন্তা করবেন না, স্যার। আমি সব সামলে নেব। এখন আপনার কি আর কোন বিশেষ আদেশ আছে আমার প্রতি?”

“হ্যাঁ, মিষ্টির এই ভিডিওটা অনলাইনে ভাইরাল করে দিতে হবে। পারবা না?”

“জ্বি, পারব।”

“আমি চাই না মিষ্টিকে কেউ অপরাধী হিসেবে দেখুক। ওর সত্যটা সামনে আসা দরকার। যাতে করে আর কেউ ওকে সন্ত্রাসী না ভাবে।”

রাফসান গভীর চিন্তায় মগ্ন। মিষ্টিকে নিয়ে তার মনে এক অজানা ভয় কাজ করছে। সে জানে, যদি মিষ্টি জ্ঞান ফিরে তার সাথে কথা বলতে না চায়, তাহলে সে কোনোভাবেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।

★★
মিষ্টির চোখ ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। ঘরের ছাদটা ধূসর রঙের। আশেপাশে শোনা যাচ্ছে যন্ত্রের বীপবীপ শব্দ। সে অনুভব করতে পারে, শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথাটা ভারী লাগছে, হাত-পা যেন অবশ হয়ে গেছে।

হঠাৎ করে পাশ থেকে একটি অপরিচিত কণ্ঠ ভেসে আসে।
“আপনি কেমন অনুভব করছেন?”

মিষ্টি চোখ সরু করে তাকিয়ে দেখে একজন নার্স তার পাশে দাঁড়িয়ে। নার্সের মুখে হাসি, কিন্তু চোখে কৌতূহল।মিষ্টি বলে,
“আমি… আমি কোথায়?”
মিষ্টির কণ্ঠ কাঁপছিল।

“আপনি হাসপাতালে, মিসেস মিষ্টি। আপনি ভাগ্যবান, গুলিটা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গে লাগেনি। আর হ্যাঁ, আপনি এখন নিরাপদ।”

নিরাপদ? মিষ্টি কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বলে ওঠে,
“কে আমাকে এখানে এনেছে?”

“এটা বলা যাবে না, তবে একজন ভদ্রলোক আপনাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।”

মিষ্টির মনে পড়ে গেল পলের কথা। সেই ভয়ানক মুহূর্ত… সেই গুলির শব্দ… তারপর গভীর সমুদ্রের ঠান্ডা জল। তার মানে, সে বেঁচে গেছে!

কিন্তু পল? সে কি এখনো তাকে একজন সন্ত্রাসী ভাবছে?

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨