ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব-২৫+২৬

0
33

#ভূমধ্যসাগরের_তীরে
#পর্বঃ২৫
#লেখিকা_দিশা_মনি

মিষ্টির হুশ ফিরতেই সে রাফসানের থেকে দূরে সরে আসে। রাফসানও হঠাৎ এমন কাণ্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেছিল৷ আবেগের বশে পরিবেশ, পরিস্থিতি সবকিছুর কথাই তারা ভুলতে বসেছিল। মিষ্টি এখন বেশ খানিকটা লজ্জা পাচ্ছে। সাথে রাফসানও বেশ অস্বস্তিকর অনুভব করছে৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রাফসান বলে ওঠে,
“আমাদের মনে হয় এখন ফেরা দরকার। তুষারপাত বাড়ছে।”

মিষ্টি মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলে,
“জ্বি, চলুন।”

অতঃপর দুজনেই চুপচাপ কিছুটা সামনে এগিয়ে আসে। দুজনেই এতটা বিব্রতবোধ করছিল যে সারাটা রাস্তা তারা আর কোন কথাই বলে না।

মিষ্টি ও রাফসান রাফসানের ডুপ্লেক্স বাড়িটায় ফিরে এসেছে। দুজনের গায়েই তুষার মাখা। রাফসান মিষ্টিকে বলে,
“তোমার তো এর আগে কখনো তুষারপাতের অভিজ্ঞতা হয়নি৷ তাই কিছু মেডিসিন খেয়ে নিও। নাহলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারো।”

মিষ্টি হালকা হেসে বলে,
“ঠিক আছে।”

বলেই সে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। মিষ্টি চলে যেতেই রাফসান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তখনকার ঘটনাটা না চাইতেই বারবার তার মনে পড়ে যাচ্ছে। এসব ভাবনা কাটিয়ে নিজের ফোনটা বের করে একটা নম্বর ডায়াল করে কল লাগায় রাফসান। কিছুক্ষণ রিং হবার পর ফোনটা রিসিভ হতেই সে বলে ওঠে,
“আমার সাথে এখনই দেখা করতে চলে আসুন। এখনই মানে এখনই। আমি চাই না আর বেশি দেরি হোক৷ আর জায়গাটা আপনি জানেনই,আমাদের গোপন ডেরায়।”

অতঃপর সে ফোনটা রেখে চোয়াল শক্ত করে বলে,
“এবার সমস্ত সত্যটা আমায় যে করেই হোক জানতে হবে।”

★★
রাফসান একটা চেয়ার দখল করে বসে আছে। তার সামনেই বসে আছে তার সেই গোয়েন্দা সহযোগী। রাফসান বেশ শক্ত স্বরেই তাকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?”

বিপরীত পাশ্বে বসে থাকা ব্যক্তিটি উত্তর দেয়,
“হঠাৎ আপনার এমন কেন মনে হলো?”

“আমার কেন জানি খটকা লাগছে আপনার উপর। আপনি এর আগে আমাকে যথা সময়ে অনেক সঠিক সত্য দিয়েছেন। আপনার বুদ্ধিমত্তা এবং ক্ষমতা সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছুদিন থেকে খেয়াল করছি আপনি অনেক তথ্যই গোপন করে চলেছেন। এই সন্ত্রাসী দলের মার্সেই শহরের প্রধান কে, সেই সত্য আপনার অনেক আগেই পাওয়ার কথা ছিল। কেননা, ক্রিসমাস বাজারে যেদিন হামলা হলো সেদিনই তাকে ধরার প্রায় ৮০% কাজ হয়ে গেছিল। কিন্তু তারপর থেকে কিভাবে যেন আপনি ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দিলেন। ব্যাপার‍টা আমার কাছে ঠিক লাগছে না।”

“আপনি ভুল ভাবছেন৷ আমি কিছুই লুকাচ্ছি না। আর আমি কেনই বা কিছু লুকাতে যাব বলুন?”

“আমিও সেটাই ভাবছি। কিন্তু কি জানেন,আমার মনে হচ্ছে আপনি আসল অপরাধীকে আড়াল করতে চাইছেন। সত্যিই কি এমন কিছু? আর যদি এমনও হয় তাহলে তার কারণ কি? অপরাধী কি আপনার খুবই কাছের কেউ?”

“না, তেমন কিছু না। আচ্ছা,আপনি থাকুন। আমার কিছু জরুরি কাজ কাছে। কাল ক্রিসমাস তার প্রিপারেশন নিতে হবে তো।”

বলেই সেই ব্যক্তিটি বের হতে যাবে এমন সময় রাফসান বলে উঠল,
“কোন সত্য লুকিয়ে যদি আপনি অপরাধীকে সুযোগ করে দেন তাহলে কি আপনিও সেই অপরাধের ভাগ নিতে হবে এবং এই অপরাধের কর্মফলও আপনাকে ভোগ করতে হবে। যা নিশ্চয়ই আপনার জন্য ভালো হবে না।”

গোয়েন্দাটি কোন কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল। আর ঠিক এমন সময় সেখানে এসে প্রবেশ করল মিষ্টি। মিষ্টিকে হঠাত দেখেই রাফসান বলে উঠল,
“তুমি হঠাৎ এখানে কেন?”

“আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন? আমি মনে হয় একটা মেয়ের কন্ঠস্বর শুনলাম। কে ছিল এখানে?”

“তেমন কেউ না।”

“আপনি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন? যদি গোপনীয় কিছু হয় তাহলে নাই বলতে পারেন। তবে মিথ্যা বলবেন না প্লিজ।”

“আসলে মিষ্টি আমাদের এই মিশনে অনেক গোপন গোপন কাজ করতে হয়। অনেকেই এই মিশনে নিযুক্ত। তাই সব কিছু এত সহজে প্রকাশ্যে আনা ঠিক নয়। বুঝতেই পারছ,এই মিশনটার উপর পুরো পৃথিবীর নিরাপত্তা নির্ভর করছে।”

“ঠিক বলেছেন আপনি। আচ্ছা, চলুন ডিনার করে নেবেন।”

“আচ্ছা, চলো।”

★★
পুরো মার্সেই শহরে আজ একটু বেশিই আলোকসজ্জা। ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী আজ ২৫ সে ডিসেম্বর। অর্থ্যাৎ খ্রিষ্টানদের সবথেকে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ক্রিসমাস আজ। ইউরোপের শহরগুলোতে ক্রিসমাস বেশ জাঁকজমক ভাবে পালিত হয়। মার্সেইও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এবারের ক্রিসমাসটা একটু ব্যতিক্রম। নিরাপত্তার খাতিরে পুরো শহরজুড়েই কঠোর ভাবে পালিত হচ্ছে ক্রিসমাস।

এলিস মনমরা হয়ে নিজের ঘরের জানালার পাশে বসে ছিল। আজকের মতো এত বেশি একটা আনন্দের দিনেও তার মনে যেন কোন খুশি নেই। এমনি সময় ক্রিসমাস তার জীবনে আনন্দের ধারা নিয়ে এলেও এই বছর তার মন মেজাজ একদম ভালো নেই। তার বাবা মিস্টার ল্যুঁই কিছু জরুরি কাজে এখন বাইরে গেছেন, এলিজাও নিজের কাজে ব্যস্ত। আর সর্বোপরি এলিসের ভালোবাসার মানুষটা, ইয়াসিনের থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যান এলিসকে ভেতর থেকে একদম কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এলিস নিজের মনের দুঃখে চোখের জল ফেলে বলে,
“আমায় ক্ষমা করে দিও যিশু, তোমার জন্মদিনটা এবার আর আমি মনযোগ দিয়ে পালন করতে পারব না। আমার মনের অবস্থা যে একদম ভালো নেই।”

তবে ছোটবেলা থেকে এলিসের একটা স্বভাব আছে। যদিও সে তেমন একটা ধার্মিক নয় তবে ক্রিসমাসের দিনটা সে সারাদিন চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করে কাটায়। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটতে দিতে চায় না এলিস। আর তাই তো এত মন খারাপের মাঝেও কোন রকমে তৈরি হয়ে রওনা দিতে চলেছে চার্চের উদ্দ্যেশ্যে। এলিসের আবার খুব একটা ভীড় ভাট্টাও ভালো লাগে না। তার পছন্দ শান্ত পরিবেশ। এজন্য সে মার্সেইয়ের একদম ভিন্নপ্রান্তে ছোট শহরতলীতে অবস্থিত সেন্ট ক্যাথেরাল গির্জায় যাওয়ার কথা ভাবছে। সেখানকার পরিবেশ বেশ শান্ত এবং শহর থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত হওয়ায় তেমন লোক সমাগমও হয় না।

এলিস আর বেশি না ভেবে তৈরি হয়ে নিল। সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে সেন্ট ক্যাথেরাল গির্জার উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিল এলিস। দীর্ঘ ৪০ মিনিটের যাত্রার পরে অবশেষে সে পৌঁছে গেল কাঙখিত গন্তব্যে।

গির্জার সামনের সাদা মার্বেলের সিঁড়িতে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল এলিস। সারা শহর ক্রিসমাসের আলোকসজ্জায় ভরে গেলেও এখানে পরিবেশটা অনেক শান্ত, অনেক নির্জন। বাতাসে যেন বিষাদের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। সে ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করল। গির্জার ভেতরে হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ বসে প্রার্থনা করছে। মোমবাতির আলোয় মৃদু স্বর্ণালি আভা ছড়াচ্ছে পুরো চত্বর। এলিস সামনের সারিতে বসে চোখ বন্ধ করল।

“হে ঈশ্বর, তুমি কি সত্যিই আমার কষ্ট অনুভব করছো? যদি করো, তবে আমার হৃদয়ের ভার একটু লাঘব করে দাও। আমি তোমার কাছে কিছু চাই না, শুধু একটু শান্তি চাই,” মনের মধ্যে বলল সে।

এমন সময় গির্জার পেছনের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। হালকা বাতাসের সাথে কারো আসার শব্দ শোনা গেল। এলিস চোখ খুলে তাকাতেই চমকে গেল। কিছু বন্দুকধারী সন্ত্রাসী প্রবেশ করেছে চার্চে। তারা এসেই এলোপাতাড়ি চার্চে গুলি চালাতে শুরু করল। পুরো চার্চে এক মুহুর্তেই যেন হট্টগোল লেগে যায়। সবাই যে যার মতো ছুটছিল। চার্চে যে ১৫-২০ জন মানুষ ছিল তার মধ্যে ৭-৮ জন ইতিমধ্যেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। বাকিরাও প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে। এলিস এককোনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে তার অন্তরাত্মা কাপছে। এমন সময় হঠাৎ এক বন্দুকধারী তার দিকে এগিয়ে এসে তার মাথায় বন্দুক তাক করে। এলিস তার চোখের দিকে তাকায়৷ এই চোখ দুটো সে চেনে। নিমেষেই তার চোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। সে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“তুমি সন্ত্রাসী!”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

#ভূমধ্যসাগরের_তীরে
#পর্বঃ২৬
#লেখিকা_দিশা_মনি

এলিস অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল তার মাথায় বন্দুক তাক করা ব্যক্তিটির দিকে৷ তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না। এলিস আজ ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। সে কখনো ভাবতেও পারে নি, যেই লোকটাকে সে ভালোবেসেছে সে কিনা এত বড় সন্ত্রাসী বের হবে। এলিস বলে ওঠে,
“এটা সত্যি হতে পারে না।”

ততক্ষণে পুরো চার্চটা যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে রক্ত এবং নিথর দেহ। এত সবকিছুর পরেও এলিসের পুরো নজর তার সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির দিকে। এলিসের চোখ থেকে টুপটাপ অশ্রু পড়তে লাগল। অন্যদিকে ব্যক্তিটি তখন অনেকটাই স্থির। অন্য একজন মুখোশধারী ব্যক্তি এসে বলল,
“দাঁড়িয়ে আছ কেন? এই মেয়েটাকেও শেষ করে দাও।”

এমন সময় হঠাৎ করে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বেজে উঠতেই সন্ত্রাসীর দল সচেতন হয়ে যায়। এতক্ষণ ধরে বন্দুকের মুখে থাকা এলিসও সাহস করে বলে ওঠে,
“এটা কি সত্যিই তুমি ইয়াসিন? কিন্তু এটা কিভাবে হতে পারে? আমি যেই ইয়াসিনকে চিনেছি, আমি যেই ইয়াসিনকে ভালোবেসেছি সে তো এমন হতে পারে না। তুমি সন্ত্রাসী হতে পারো না..কিছুতেই না।”

ইয়াসিন গম্ভীর স্বরে বলে,
“পুলিশ চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছে৷ এখন এই মেয়েটাকে হোস্টেজ বানিয়েই আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।”

ইয়াসিনের কথা শুনে এলিসের হতবিহ্বল হওয়ার দশা। ইয়াসিনের চোখে সে অদ্ভুত হিংস্রতা লক্ষ্য করছে। এতগুলো নিরপরাধ মানুষকে মে*রে ফেলেও তার চোখে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই! এ কি আদৌ সম্ভব? তার চেনা ইয়াসিন তো এতটা নির্দয় নয়। তাকে এইরূপে কল্পনা করার কথাও তো এলিস স্বপ্নে ভাবেনি। এরইমধ্যে ইয়াসিন এলিসের মাথায় বন্দুক তাক করে নির্দয়ের মতো তাকে নিয়ে যেতে থাকে। যাওয়ার পথে কিছু পুলিশ তাদের পথ আটকে ধারালে ইয়াসিন কঠোর স্বরে বলে,
“যদি তোমরা আমার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করো তাহলে এই মেয়েটাকে আমি শেষ করে দেব।”

এলিসকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ সদস্যরা আর সামনে আগায় না। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ইয়াসিন দ্রুত এলিসকে সাথে নিয়ে পালিয়ে যায়। তার পুরো মুখ ঢাকা ছিল বিধায় তার পরিচয় জানা কারো পক্ষে সম্ভব না। তাছাড়া সে গলার স্বরটাও বদলে অন্য টোনে কথা বলছিল। অথচ এলিস শুধুমাত্র চোখ দেখেই চিনতে পেরেছে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। যার নতুন রূপ তাকে পুরো চমকে দিয়েছে।

★★
পলরূপী রাফসান ত্রস্ত পায়ে থানায় পায়চারি করছে। তার চোখমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। এরইমধ্যে এলিজা ছুটে আসে রাফসানের কাছে। সে এসেই রাফসানকে বলে,
“আমার বোনটাকে ঐ সন্ত্রাসীরা কোথায় নিয়ে গেল? ওর কোন বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে আমার বোনের জন্য। ও অনেক ইনোসেন্ট একটা মেয়ে। না জানি ও এখন কি অবস্থায় আছে কেমন আছে…আমার আজ নিজেকে ভীষণ ব্যর্থ মনে হচ্ছে মিস্টার পল। এত বড় একজন গোয়েন্দা হয়েও আমি কিছু করতে পারছি না।”

“আপনি এভাবে ভেঙে পড়বেন না মিস এলিজা। আপনার বোনের কিছু হবে না। আমরা চেষ্টা করছি তাকে উদ্ধার করার। আপনার বোনকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করবো আমরা।”

এমন সময় মিষ্টিও সেখানে চলে আসে। মিষ্টিকে দেখেই রাফসান বলে,
“তুমি হঠাত এই সময়ে এখানে?”

মিষ্টি বলে,
“আমিও মিস এলিসকে খুঁজতে চাই। ওনাকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। উনি সত্যিই একজন ভালো মানুষ। তাছাড়া, আমি চাই না আর কোন মানুষ ঐসব সন্ত্রাসীদের শিকার হোক। আজ ঐসব সন্ত্রাসীরা চার্চে হামলা চালিয়ে ১৫ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। মিস এলিসই একমাত্র জীবিত ব্যক্তু এখনো অব্দি। তাকে উদ্ধার করা গেলে হয়তো ঐ সমস্ত সন্ত্রাসী সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য জানা যাবে। তাই আমাদের মিস এলিসকে একদম সুস্থ স্বাভাবিক অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতেই হবে।”

“ঠিক বলেছ তুমি।”

এলিজা কান্নারত স্বরে বলে,
“আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। আমি শুধু আমার বোনকে ফেরত চাই। পাপা কিছু জরুরি কাজে প্যারিসে গেছে। যাওয়ার আগে আমাকে বলে গেছিল এলিসের খেয়াল রাখতে। এখন যদি ওর কোন ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে আমি পাপাকে নিজের মুখ দেখাতে পারব না। প্রয়োজনে আমি নিজের সব শক্তি কাজে লাগাবো, তবুও নিজের বোনকে উদ্ধার করে ছাড়ব।”

★★
এলিস পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তাকে একটি বদ্ধ ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। চোখ খুলে তাকাতেই সে বুঝতে পারে তাকে ঐসব সন্ত্রাসীরা বন্দি করেছে। তাই তো সে চিৎকার করতে শুরু করে। এলিসের চিৎকার শুনে কিছুক্ষণ পরই একটি ব্যক্তি ছুটে এসে তার মুখ চেপে ধরে। এত অন্ধকারের মাঝেও ব্যক্তিটিকে সে চিনতে পারে। এই স্পর্শ, এই গন্ধটা যে তার বড্ড চেনা। এলিস ক্রন্দনরত স্বরে বলে ওঠে,
“ইয়াসিন..এটা কি সত্যিই তুমি? আমার না এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না এটা তুমি।”

ইয়াসিন এলিসকে বলে,
“বিশ্বাস করো বা না করো। এটাই আমি। আর এটাই হল বাস্তব।”

“তুমি কেন এত গুলো নিরপরাধ মানুষকে মে*রে ফেললে? ওরা তো তোমার কোন ক্ষতি করে নি। আমি তো এই ইয়াসিনকে চিনতাম না। আমি যেই ইয়াসিনকে চিনতাম সে ছিল ভদ্র, দয়ালু, পরোপকারী….যার স্বভাব, চরিত্র আমাকে তার প্রেমে ফেলতে বাধ্য করেছিল। তাহলে আজ এই কোন ইয়াসিনকে দেখছি আমি?”

“ভালো করে দেখে নাও। এটাই আসল আমি। ইয়াসিন আল খলিলির আসল পরিচয় এটাই।”

“না, এটা হতে পারে না। এই সব মিথ্যা৷ আমি নিশ্চয়ই কোন দুঃস্বপ্ন দেখছি তাই না? এটা সত্য হতে পারে না।”

বলেই এলিস ইয়াসিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ইয়াসিন ধাক্কা দিয়ে এলিসকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বলে,
“এসব নাটক বন্ধ করো। এসব নাটক করে তুমি আমায় ভোলাতে পারবে না। তোমাকে এর আগেও আমি বারবার সতর্ক করেছি আমার থেকে দূরে থাকতে কিন্তু তুমি শুনলে না। বারবার আমায় বিরক্ত করে গেছ..তবে এবার আর নয়।”

ইয়াসিনের কথা শুনে এলিস বলে ওঠে,
“তুমি খারাপ হতে পারো না। তুমি যদি খারাপ হতে তাহলে এখন অব্দি তুমি আমায় বাঁচিয়ে রাখতে না। এটাই প্রমাণ করে যে, তোমার মনে অনুভূতি আছে। তুমি খারাপ মানুষ নও। হয়তো কোন কারণে ভুলপথে চলে এসেছ কিন্তু..তুমি আমার সাথে ফিরে চলো। আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করে দাও। আমি আমার বাবা আর বোনকে বলে তোমার যথাসম্ভব কম শাস্তির ব্যবস্থা করব। তুমি একদম ঠিক হয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো তোমার জন্য। আমি যে তোমায় ভীষণ ভালোবাসি ইয়াসিন। আমি তোমাকে ভালো দেখতে চাই।”

ইয়াসিন এলিসের গলা টিপে ধরে বলে,
“তোকে বললাম না এটাই আমার আসল রূপ। বুঝছিস না কেন?”

“ছাড়াও..আমায়..আমি নিঃশ্বাস..নিতে..পারছি না।”

“তোকে আর নিঃশ্বাস নিতে হবেও না। অনেক জ্বালিয়েছিস আমায় আর নয়।”

বলেই ইয়াসিন একটা ধারালো ছু*রি হাতে নেয়। ইয়াসিনকে এভাবে দেখেও এলিস একটুও ভয় পায় না। কারণ তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ইয়াসিন তার কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু এলিসের বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে ইয়াসিন নির্দয়ভাবে এলিসের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। এলিস বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। ইয়াসিন এতেই ক্ষান্ত হয়না। ছু*রি দিয়ে ২০-২৫ বার আঘাত করে এলিসের শরীরে। এলিসের সুন্দর শরীর পুরো ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। শরীর ভেসে যায় লাল রক্তে। এলিসের নিঃশ্বাস ভাড়ী হয়ে আসে। এত কিছুর পরেও এলিস নিজের শেষ শব্দে বলে ওঠে,
“ভালোবাসি..তোমায় ভীষণ ভালোবাসি..ইয়াসিন..

কথাটা বলার পরই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এলিস। অতঃপর ধীরে ধীরে তার চোখে আধার নেমে আসে। এই নির্মম পৃথিবীক বিদায় জানায় সে! যেখানে সত্যিকারের ভালোবাসার কোন মূল্য নেই! এলিস মৃত্যুর আগেও ইয়াসিনের জন্য এতটুকু ঘৃণা প্রকাশ করতে পারে নি। বরং নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগেও ইয়াসিনকে ঠিক সেভাবেই ভালোবেসে গেছে যেমনটা আগে বাসত!

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨