#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:১৫
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
আবেশের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মাধুর্যের বোজে থাকা চোখের উপর। চাঁদের আলো বারান্দায় লুটিয়ে পড়ছে। নরম কোমল আদর মাখছে প্রতিটা পরশে। মাধুর্র নির্বাক! সে কী বলবে খুজে পাচ্ছে না। মাথার মধ্যে ঝেঁকে আছে হাজারো বিষাদের ছায়া । এই মুহূর্তে আবেশের এই ধরণের ব্যবহার তার বোধগম্য হচ্ছে না।
আবেশ যেন ঘোরে আছে। তার কল্পনায় আঁকা মাধবীলতার সামনে। যার জন্য সাজিয়েছে তার ভেতরে সুখের আঙ্গিনা।
যে মাধবীলতার চোখেমুখে ছিলো চঞ্চলতা,ছিলো একরাশ মুগ্ধতা ।মাধুর্য কেঁপে উঠছে,আবেশের এতোটা ঘনিষ্ঠতার ছোঁয়া পেয়ে।কাঁপা কন্ঠেই বলল,
‘ আবে..শ…!’
আবেশের কোনো ভাবান্তর নেই। সে ঝুঁকে আছে মাধুর্যের দিকে। প্রাণভরে পর্যবেক্ষণ করছে তাকে।মনে আঁকা মাধবীলতার সাথে মেলাচ্ছে। যার চোখেমুখে ছিলো দীপ্তিময় উচ্ছ্বাস,জাম রাঙা ঠোঁটে ছিলো দুষ্টুমির হাসি।
আবেশ ঘোর লাগা কন্ঠেই বলল,
‘ কেন আমাকে নীরব আঘাত করেছিলে,মাধবীলতা!’
মাধুর্য বুঝতে পারলো না। এতোক্ষণ সে যে ভয় পাচ্ছিলো সেটার সম্ভবনা নেই দেখে ধীর কন্ঠে বলল,
‘ আঘাত!’
‘ হ্যাঁ,আঘাত। তুমি বেইমানি করেছিলে মাধবীলতা। সেই ছোট বয়সে এতোটা জঘন্য কীভাবে হয়েছিলে তুমি?’
মাধুর্য আজ চমকে উঠছে বারেবারে। সে মিথ্যা সাজিয়েছিলো! প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি বেইমানি করেছি।কিন্তু কবে! আপনার সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলো,আবেশ।’
আবেশের শান্ত চোখে রাগ ধরা পড়লো। শক্ত করে চেঁপে ধরলো মাধুর্যের দুই হাতের বাহু। রাগী কন্ঠে বলল,
‘ করেছো! আমাকে মিথ্যা বলেছো তুমি। আমার অনুভূতি নিয়ে প্রতারণা করেছো তুমি। ছোট বয়সে কী করে পারলে এতোটা জঘন্য হতে। বলো মাধুর্য! আমার চিঠির প্রত্ত্যুতরে তুমি কী লেখেছিলে মনে নেই,তোমার?
‘ চিঠি,কীসের চিঠির কথা বলছেন আপনি!’
‘ লাস্ট চিঠি,যেটা সাত বছর আগে আমি তোমায় দিয়েছিলাম।’
মাধুর্য বেশ অবাক হলো। সাত বছর! কথাটা বারবার আওড়ালো নিজ মনে। কিন্তু তার কাছে আবেশের সর্বশেষ একটা চিঠি গিয়েছে যেটা আটবছর আগে। তখন সে তেরো বছরের কিশোরী। আবেশের দিকে তাকিয়েই মনে করার চেষ্টা করলো সব। আবেশ নিজেও তাকিয়ে আছে মাধুর্যের দিকে। তার মনের দুয়ারে কড়া নাড়ছে সেইসব দিনের কথা। দূরে থেকেও যেন কাছে ছিলো তারা।
মনের দুয়ারে ঝলকানি দিয়ে ঊঠলো ১৯৯৯ সালের ১৯ ডিসেম্বরের স্মৃতি,
সময়টা ১৯৯৯ এর ১৯ ডিসেম্বর,চারদিকে কুয়াশার আস্তরণে ঢেকে আছে। বিশাল সাদা চাদরে মুড়িয়ে আছে রুপগঞ্জ।আবেশদের সিলেট চলে যাবার কয়েকদিনের মাথায় আবেশ চিঠি দেয় রুপগঞ্জের পোস্ট অফিসে। সেটা ছিলো নজরুলের সাহায্যে।মেহরুন থাকতে সে চিঠি নিয়ে এসে পড়ে শোনাতো মাধুর্যকে।ছোট বয়সী মাধুর্যের সবটা ঘিরে ছিলো তার মা মেহরুন আর বাবা শাহেদ।
আবেশরা সিলেট আসার পর তিন বছরের মাথায় মানে ২০০২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মেহরুন উধাও হয়ে যায়। তার মা মেহরুন হারিয়ে যায় তখন মাধুর্য দশ বছর বয়সে পা দিয়েছে সবেমাত্র। যখন মেহরুন ছিলেন ওই তিনটে বছর চিঠি দেওয়া নেওয়া চলতো সিলেট থেকে রুপগঞ্জে।
সবটা জুড়ে ছিলো আবেশের ছোট ছোট অনুভূতি ।মেহরুন খুব হাসতেন আবেশের চিঠি পড়ে। তার ধারণা ছিলো,আবেশ তার মেয়েকে ভালোবাসে,যত্ন করে। মেহরুন কখনো খারাপ নজরে দেখে নি সেই সম্পর্ক। বাচ্চামো ঘিরে থাকা সম্পর্কটা ছিলো মধুর।
আর চিঠির উত্তর ছোট মাধুর্য নিজ হাতে লেখে দিতো। যেখানে ছিলো শুধুই বাচ্চামো কথার ছড়াছড়ি। আবেশের চিঠিতে সুন্দর গোছানো কথা।মাধুর্যের জন্য উপদেশ।
আবেশ বরাবর গোছালো ধাঁচের ছেলে ছিলো।সে চিঠি দিতো খোজ খবর নেওয়ার জন্য। তখনো তার ভেতরে অনুভূতি শূন্যের কোঠায়। মাথায় চলতো,মাধুর্য ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে। যার সঙ্গে আত্মিক একটা সম্পর্ক বেঁধে গিয়েছে সে।
প্রতিটা চিঠি দেওয়ার পনেরো দিনের মাথায় তিনটে বছর মাধুর্যের চিঠি আসলেও পরবর্তিতে হ্ঠাৎ করেই ইতি ঘটে মেহরুন হারিয়ে যাবার পর।
একের পর এক চিঠি টানা দুই বছর দিয়েও উত্তর পায় নি আবেশ।একেকটা চিঠি দেওয়ার পর কলেজ ছুটির পর বসে থেকেছে পোস্ট অফিসে গিয়ে। তবে তার আশায় পানি ঢেলে দিতো প্রতিবার। তবুও সে চিঠি দিতো মাধুর্যকে। থেমে থাকে নি কখনো। একরাশ একাকীত্ব ঘিরে ধরে আবেশকে তখন।
মাথায় ঘুরেফিরে বেড়ানো শুরু করে মাধুর্যকে তার চাই। যে কোনো উপায়ে তার মাধুকে চাই। তার আম্মা মাহফুজার কাছেও কোনো খোজ ছিলো না মাধুর্যদের। তবে,থেমে থাকে নি আবেশ। একের পর এক চিঠি দিতো প্রতি বছর! প্রতিটা সময়।
একটু খোজ নেওয়ার জন্য। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কেটে যায় তিনটে বছর। কলেজ পেরিয়ে ভার্সিটিতে পা দিয়েছে আবেশ। হাজার হাজার মেয়ের ভীড়ে তার চোখ আটকে থাকতো মাধুর্যের টানা চোখ,জোড়া ভ্রু,ঢেউ খেলানো চুলে। দিনশেষে মাধুর্যের মায়ায় বেঁধে গিয়েছিলো সে। নিজের আবেগ,অনুভূতি তুলে ধরা শুরু করলো চিঠিতে।সেই চিঠি জমা হয়ে আবার ফেরত আসতো আবেশের কাছেই।তবে ২০০৫ এর জুলাই মাসের উত্তপ্ত গরমে লেখা এক চিঠি আর ফেরত আসে নি। যে চিঠিতে ছিলো তার মাধবীলতা কে নিয়ে লেখা হাজারো অনুভূতির ছড়াছড়ি। যে চিঠিতে ছিলো আবেশের মোহময় সব অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ।
আবেশ যখন খোজ নিয়ে জানে চিঠি নিয়েছে কেউ একজন অফিসে এসে। আশার আলো জাগে আবেশের মনে।সে উৎফুল্ল হয়। মাহফুজাকে জানান।
তিনিও খুশি হয় অনেকটা। আবেশকে বলে আবার চিঠি দিতে। আবেশ দেয়! হ্যাঁ,আবেশ সেই চিঠি দিয়েছিলো।
রুপগঞ্জের ছোট গ্রাম মুয়াপাড়া।মেহরুন হারিয়ে যাওয়ার এক বছরের মাথায় রুপগঞ্জ সদর ছেড়ে মুড়াপাড়ায় গিয়ে উঠে শাহেদ।তবে,চিঠি আসতো পোস্ট অফিসে।মেহরুন হারিয়ে যাবার পর মাধুর্য কখনো আর আবেশ ভাইয়ার চিঠি পড়তে পারে নি। দিনশেষে হাজার নির্যাতনের পর ছুটে যেতে ইচ্ছা হতো আবেশের কাছে,তার আম্মু’মায়ের কাছে।
সে পারে নি ছুটে যেতে।২০০৫ সালের ২৭ আগষ্ট কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে পুরো তিনটে বছর পর পেয়েছিলো তার আবেশ ভাইয়ার চিঠি। দরকারী কী যেন একটা কাজে রাব্বী নিয়ে গিয়েছিলো পোস্ট অফিসে। সেখানে একটা দরকারেই রাব্বী তার নাম জোরে উচ্চারণ করতেই পিয়ন চমকে উঠে তাকিয়ে বলে,
‘ তুমি মাধুর্য…’
রোগাটে চেহারার ব্যক্তিটি তার নাম ধরে ডাকতেই বেশ খানিক চমকে উঠেছিলো মাধুর্য। পেছন ফিরে রাব্বীকে দেখে নিলো। সে ব্যস্ত। কারণ কারো সাথে কথা বলতে দেখলেই সে বাসায় নিয়ে মারতো লোকটার কথায় ভ্রু কিছুটা বাকিয়ে ফেললো মাধুর্য। লোকটা মাধুর্যকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একদলা থু থু মাটিতে ছিটেয়ে দিয়ে বলল,
‘ যদি মাধুর্য হইয়া থাহো তাইলে,তোমার লাই একখান চিঠি আছে।মেলা দিন হইলো পইড়া আছে।দেহো তো তোমার লাই আইছে কি’না!’
মাধুর্য কোনো কথা না বলে পিয়নের পিছু পিছু সেদিন গিয়েছিলো।ভয়ে তার আত্মা কাঁপছিলো থেকে থেকে।চট করে মাথায় আসে আবেশের কথা। সাথে সাথেই চোখেমুখে ফুঁটে উঠে এক চিলতে হাসি।
পিয়ন যখন মাধুর্যের হাতে চিঠিটা দেয় মাধুর্য খপ করে ধরেই কেঁদে উঠে। তেরো বছর বয়সী ছোট একটা মেয়ে হাজার নির্যাতন থেকে মুক্ত পাবার জন্য ছটফটিয়ে উঠে। নাকের কাছে চিঠিটা নিয়ে গন্ধ নেয়। ঠিক রজনীগন্ধার সৌরভ ভেসে আসছিলো।
তার রজনীগন্ধা খুব প্রিয় বলেই আবেশ ফুল জুগিয়ে আনতো প্রায়শই। মাধুর্য প্রাণ ভরে সেদিন চিঠিটা দেখছিলো। পিয়ন অনেক কিছু বললেও সে কোনোটাই শুনে নি।
চিঠির উপর প্রেরকের নাম দেখে আবারো কেঁদে উঠেছিলো মাধুর্য। সে ধরেই নিয়েছিলো তার মা মেহরুন আবেশদের কাছে আছে।
তবে সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয় আবারো। আবেশের অনুভূতি মাখানো চিঠিটা পড়ে কেমন অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করে ছোট মাধুর্যের মনে।হাজারো প্রজাপতি ডানা ঝাপটা দেয় কিশোরী মাধুর্যের মনে।
লুকিয়ে বাড়িতে নিয়ে এসে হাজার বার পড়েছিলো সেই চিঠি। তবে শেষ রক্ষা হয় নি! রাব্বীর চোখে পড়তেই চুল টেনে ইচ্ছা মতো মেরেছিলো রাব্বী। বিশ্রী ভাষায় গালী দিয়েছিলো। প্রথম অনুভূতি মাখানো চিঠিটা ছিড়ে ফেলেছিলো।
শাহেদ এসে জিগ্যেস করতেই রাব্বী বলে,পালানোর ধান্ধায় আছে মাধুর্য।
শাহেদ সেদিন না মেরে প্রেরকের নাম দেখে থমকেছিলো। কিছু না বলেই বেরিয়ে গিয়েছিলো বাড়ি ছেড়ে। রাব্বী টানা দুইদিন মাধুর্যকে ঘরে আটকে রেখেছিলো খাবার পানি ছাড়া।
মাধুর্য মৃত্যুসম যন্ত্রণা সহ্য করেও বেঁচে ছিলো আবেশের আশায় তার আম্মু’মায়ের আশায়।
কিন্তু আবেশ বলছে সে প্রতারণা করছে! পুরোনো সৃতি থেকে বেরিয়ে মাধুর্য আরেকদফা থমকালো। দেখলো আবেশের চোখ লাল হয়ে আছে।
মাধুর্যের হাতের বাধন আলগা করে দিয়েছে। মাধুর্য অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আপনি কাঁদছেন আবেশ!’
‘ ত..তোমাকে বলেছে।’ আবেশ চোখ ঘুরিয়ে বলল। তার চোখ জ্বলছে। মাধুর্য তার অনুভূতিকে অপমান করেছিলো। এই কথা মনে হলেই তার রাগ লাগছে। সে যখন জানতে পারলো,চিঠিটা আর ফেরত আসে নি তখন সে কতোটা খুশি ছিলো তার ভেতর জানে। এর পরেই পুরো ছয় পৃষ্ঠার একটা চিঠি আবারো দিয়েছিলো মাধুর্যকে।
সেই কথা মনে হতেই আবেশ ঘুরে তাকিয়ে আবারো ধরলো মাধুর্যের হাত। রাগী কন্ঠে বলল,
‘ তোমাকে আমি ফাঁসাতে চাই! তোমাকে শহরে এনে বিক্রি করতে চাই। আমি তোমাকে ভোগ করতে চাই। তাই তো,মাধুর্য!’
‘ কী বলছেন আপনি! এইসব কথা কে বলেছে আপনাকে।’
‘ বাহ..খুব তো নাটক করতে পারো মাধুর্য। এখন বলছো কে বলেছে।’ আবেশ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল। মাধুর্য হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল,
‘ আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না,আমি।’
‘ বুঝবে কেন! তোমার তো প্রেমিক আছে। শেইম অন ইউ মাধুর্য। তা সেই প্রেমিক বুঝি ছেড়ে গেছে! অতোটুকু একটা মেয়ে এতো নোংরা কী ভাবে হয়েছিলে,বলো তো।’
’ কী যা তা বলছেন আবেশ। উল্টাপাল্টা কথা একদম বলবে না।’
মাধুর্য আবেশকে ধাক্কা দিয়ে বলল। এতে আবেশ বেশ রেগে গেলো। মাধুর্যকে হুট করেই চেপে ধরলো দেয়ালের সাথে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘ আমি বলছি উল্টাপাল্টা কথা..আমি! নিজে বলে আমা দোষ দিচ্ছো। এতোদিনে বুঝেছি কেন শাহেদ আঙ্কেল তোমায় মারতো। নিশ্চয় খারাপ কাজ করতে গিয়ে ধরা খেয়েছিলে তোমার প্রেমিকের সাথে।’
‘ ছাড়ুন আবেশ আমার লাগছে। আর প্রেমিক! কার প্রেমিক। কী বলছেন আপনি।’
মাধুর্য ব্যথাতুর কন্ঠে বলল। আবেশ যেন আরো ক্ষিপ্র হয়ে উঠলো। আরো চেপে ধরলো মাধুর্যের হাত তার ভেতরে জমে থাকা রাগ প্রকাশ পাচ্ছে। মাধুর্যকে খুন করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। মাধুর্য কাঁপা কন্ঠে বলল,
‘ আ..বে..শ আমার হাত ছাড়ু..’
মাধুর্য কথাটুকু শেষ করতে পারলো না তার আগেই আবেশ হুট করেই..
চলবে…
#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:১৫| #পরবর্তী_অংশ |
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
আবেশ শক্ত হাতে ঘুরিয়ে নিলো মাধুর্যকে। তার বুকের উপর মাধুর্যের পিঠ ঠেকিয়ে মাধুর্যের হাত ছেড়ে দিয়ে শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো তাকে।আবেশের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে মাধুর্যের ঘাড়ে। মাধুর্য বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে আছে। তার শ্বাস ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে। আবেশের মতিগতি একদম বুঝতে পারছে না,মাধুর্য! আবেশের একটু আগের রাগ আর এখনকার রাগ ধরতে পারছে না সে। তবে আবেশের হাতের বাঁধন কেমন আড়ষ্টভাব এনে দিচ্ছে মাধুর্যের মাঝে। তীব্র শিরশিরে অনুভূতি গ্রাস করছে ভেতরে।
মাধুর্য চোখ বন্ধ করেই কাঁপছে। আবেশের হাত তখন তার পেটের মাঝামাঝিতে। আবেশ স্তব্ধ,নির্বাক!
মাধুর্য চোখ বন্ধ করেই আবেশের আগের বলা চিঠির কথা মনে করলো। তার কাছে আবেশ আবার চিঠি দিয়েছিলো! তবে সেটা কোথায়? আর যদি দিয়েও থাকে সেই চিঠির উত্তর কে দিয়েছে!
আবেশের কোনো ভাবান্তর নেই। তার গরম নিঃশ্বাস ভারী ঠেকছে তার কাছে। ওইদিলে ক্রমাগত কম্পয়মান মাধুর্যের মধ্যকার ভাব বুঝতে পারলো না সে। আবেশ তার ভেতরকার রাগ দমানোর চেষ্টায় আছে! মাধুর্য আবেশের হাতের উপর থেকে নিজের হাত সরিয়ে ফেলে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন!’
আবেশ উত্তর দিলো না। নীরব ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো মাধুর্যকে ধরে। আকাশে তখন মেঘ জমেছে। চাঁদ লুকিয়ে পড়ছে মেঘের আড়ালে। আবেশ নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগ সংযত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তার মাথায় মাধুর্যের বলা সাত বছর কথাটা ঘুরছে! তারমানে মাধু এর পরের চিঠিটা পায় নি। তবে,সেই চিঠির উত্তরে জঘন্য কথা গুলো কে লেখেছিলো!
আবেশ ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করলো। রাগ হলে সব এলোমেলো লাগে তার কাছে। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে উঠে। স্বাভাবিক কথা অস্বাভাবিক লাগে। এইজন্য নিজের রাগ থামানোর চেষ্টার জন্য মাধুর্যকে ঘুরিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে সে। তবে মাধুর্যকে বুঝতে না দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
‘ ছয় পাতার চিঠিটা তুমি রিসিভ করেছিলে,তাই না মাধুর্য?’
আবেশের কথায় ঘুরে তাকানোর চেষ্টা করলো মাধুর্য। কিন্তু পারলো না। তবে গলায় জোর এনে বলল,
‘ আপনার দেওয়া শেষ চিঠি পেয়েছিলাম ২০০৫ সালের আগষ্টে।এর পর আমার কাছে কোনো চিঠি যায় নি! না আমি কোনো চিঠির উত্তর দিয়েছি।’
‘ তবে…
‘ কী তবে! বলুন আবেশ। আমার জীবন তো নাটকীয়। এখানেও না হয় আরেকটু নাটক হোক।আমি মেনে নিবো,গুছিয়ে নিবো। আবার ভাঙ্গবো তবে মরবো না। কারণ,সবার মৃত্যু থাকলেও দুঃখের সাগরে ভাসমান ছেড়া পাতা ভাসে তারা ডুবে না। ভাসতে ভাসতেই তীরে গিয়ে ঠেকে আবার কারো পায়ে দুমড়ে মরে।’
মাধুর্যের কথার রেশ আবেশের কান অবধি পৌছালেও সে চুপ করে আছে। হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে।চট করে কিছু একটা মনে হতে মাধুর্যকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ তুমি এতো বোকা কেন,মাধুর্য!’
আবেশের এমন কথায় থতমত খেয়ে যায় মাধুর্য।ভ্রু জোড়া খানিক বাঁকিয়ে ফেলে।অবাক হয়েই বলল,
‘ বোকা!’
‘ অবশ্যই বোকা! তোমার উচিৎ ছিলো প্রথম দিন সব বলা।’
‘ আপনি সেই সুযোগ দিয়েছিলেন?’
‘ সুযোগ করে নিতে হয়! এইজন্যই তুমি বোকা। আর আমি চিঠির কথা বলার সাথে সাথে তুমি সব বললে আমার রাগ দেখতে হতো না তোমায়।’
‘ আপনি কী বলছেন,আবেশ! আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’
মাধুর্য গলার খাদ নামিয়ে বলল। আবেশ তার হাতের বাঁধন আলগা না করে আরো শক্ত করে ধরলো।রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
‘ তুমি যদি আমার দেওয়া ২০০৬ এর চিঠি না পেয়ে থাকো তাহলে নিশ্চয় সেটা অন্যকেউ পেয়েছে! আর সেই চিঠি যে পেয়েছে সে গেম খেলেছে আমার সাথে।তুমি হয়ে আমাকে ভুল বুঝিয়েছে।’
মাধুর্য চুপ করে শুনছিলো আবেশের কথা। যে চিঠি সম্পর্কে সে জানে না তাই আগ বাড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো কাজটা করতে তার একদম ইচ্ছা হলো না। চুপ করে রইলো আবেশের হাতের বাঁধনের কাছে। আবেশ নিজ মনে সব ভাবছে। তার দৃষ্টি সামনে। যেখানে সব কিছু ধোঁয়াটে আবার খোলা জানালার মতো। তবে দীর্ঘতর ভুল বুঝে মাধুর্যের জন্য জমানো রাগ,অভিমানের পাহাড় হ্ঠাৎ করেই ভেঙ্গে যেতে শুরু করলো। কে দিয়েছে সেই চিঠি! তবে যে দিয়েছিলো তাকে সামনে পেলে মাটিতে পুঁতে ফেলবে সে।
এতো জঘন্য ভাবে মাধুর্য হয়ে তার কাছে চিঠি লেখেছিলো যার জন্য মেয়েটাকে সে কতোকিছু বলেছে। এইসব ভেবে নিজের প্রতি তীব্র রাগ জমা হলো তার। একটু ঠান্ডা মাথায় সব ভাবলেই পানির মতো স্বচ্ছ হয়ে যেত তার সামনে।
মাধুর্য যেখানে পদে পদে নির্যাতিত হয়ে গুমরে মরছিলো সেখানে এইসব চিঠি দেওয়া তার সাধ্যের বাইরে। আবেশ সব ঠান্ডা মাথায় ভেবে নিজস্ব অপরাধবোধে শিউরে উঠলো। হাত গুলো গুটিয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ালো মাধুর্যের থেকে। মাধুর্য স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আবেশের দিকে তাকাতেই আবেশ শান্ত চোখে তাকিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পাঁ বাড়িয়ে বলল,
‘ সব কিছুর ভেতরে জঘন্য একটা মিথ্যা আছে মাধুর্য! যেই মিথ্যার আড়ালে হারিয়েছিলাম আমি। তবে কথা দিচ্ছি,দিনের প্রস্ফুটিত আলোর মতো রঙিন হবে তোমার জীবন। আর মিথ্যা গুলো টেনে বের হবে রাতের অন্ধকারে।’
মাধুর্য অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । একটু আগে এতো রাগ হ্ঠাৎ করে উধাও হলো কী করে?
তবে আবেশ যে বরাবর ঠান্ডা মাথার মানুষ যেটা বেশ জানে মাধুর্য।বহুদিন পর আবারো সেই আবেশকে দেখতে পাচ্ছে মাধুর্য!
_________
পূর্ব আকাশে রঙটা আজ কমলা রঙ ধারণ করেছে। সরু সাদা মেঘের বিন্দু বিন্দু টানা রেখা আবছা হয়ে কমলা রঙে মেতেছে। পাখির কলতানে বিভোর প্রকৃতি। আজকে ঘুম ভেঙ্গেই আবেশ উঠে দেখলো মাধুর্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে। খাট থেকে সোফা বিশেষ একটা দূরে নয়। মাধুর্যের এমন চাউনিতে ভড়কে গেলো আবেশ। কাল রাতে সে সোফায় শুয়েছিলো। তবে সকাল সকালে মাধুর্যের এমন অন্য ধরণের চাউনি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। আড়মোড়া ভেঙে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ কী হয়েছে!’
‘ আমি স্বপ্ন দেখছি!একটু পর ঘুম ভাঙবে,তাই না?’
মাধুর্যের এলোমেলো কথা শুনে আবেশ কি বলবে খুজে পেলো না। তবে মাধুর্যের চোখের নীচে কান্নার রেখা দেখতে পেয়ে রাগী সুরে বলল,
‘ কাল রাতে কেঁদেছো কেন?’
মাধুর্য উত্তর দিলো না। আবেশ ধমকে উঠলো আবার।মাধুর্য কেঁপে উঠে বলল,
‘ আমি ঘুমাতে পারি না,আবেশ। অনেক দিন ঘুমাই নি।কাল রাতে ও ঘুমাই নি।’
আবেশ কিছুটা ভড়কে গেলো। মনে করার চেষ্টা চালালো সে উল্টাপাল্টা কিছু বলেছে কী’না? কাল রাতে চিঠির ব্যাপার টা সে ঠান্ডা মাথায় বুঝে নিতেই মাধুর্যকে দোষী ভাবার জন্য অনুতপ্ত হয়ে আছে ।সেই চিঠিটা নিশ্চয় কোনো কলুষিত ব্যক্তি দিয়েছিলো। না হলে অতোটুকু একটা মেয়ের নামে এতো জঘন্য কথা কীভাবে লেখে?
আবেশ উঠে দাঁড়ালো।মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘ মাধুর্য..’
‘ আবেশ আজ আমি বলবো আপনি আজ শুনবেন।আপনি এতো সহজে আমাকে বিশ্বাস করে নিবেন আমি কখনো কল্পনা করি নি।’
মাধুর্যের কথায় আবেশের কেমন অসহায় লাগছে। ওই এক পৃষ্ঠার চিঠি পড়ে সে মাধুর্যকে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টায় মত্ত্ব ছিলো।মাধুর্য ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,
‘ আমি ভাবতাম সব ভুল আমার! কিন্তু সব ভুল আমার নয়। সবাই নিজেদের মতো আমাকে ভুল বুঝে,আবেশ। যেখানে আপনি নিজেও আমাকে ভুল বুঝে ছিলেন এতো বছর।’
‘ চিঠির লেখা আমি তোমার ভেবে ভুল বুঝেছি,মাধু।’
‘ কেন বুঝেছেন ভুল? সবাই কেন আমাকে ভুল বুঝে।সবার নিজেদের মতো ভাবা ভুল আমার উপর চাপিয়ে আমাকে দোষী করে। আমি ভাবতাম আমার আবেশ ভাইয়া আমাকে কখনো ভুল বুঝবে না। কিন্তু সেই আপনি নিজেও আমাকে ভুল বুঝে ছিলেন।’
আবেশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে থাকা মানবীটির হাহাকার তার ভেতর দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। আবেশ এগিয়ে যেতে চাইলে মাধুর্য তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আসবেন না আমার কাছে! একদম আসবেন না।প্রথম যেদিন আপনার নাম শুনেছিলাম বিয়ের আসরে তখন আমি জানতাম আপনিই আমার আবেশ ভাইয়া। যার কাছে আমার ভরসা,আমার ভালোথাকা। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।শরীরে ব্যথা নিয়ে ঘোমটা টেনে বসে ছিলাম।যখন আপনি রুমে এসেই আমাকে টেনে নামাতে চাইলেন খাট থেকে তখন আমার সমস্ত ভাবনা ভুল হয়। কারণ আমার আবেশ ভাইয়া আমার নাম শুনে কখনো আমাকে ছুড়ে ফেলতে পারবেই না। কিন্তু আপনি ছুড়ে ফেলতে গিয়েছিলেন। আমি যখন বারবার বলছিলাম,আমায় স্পর্শ করবেন না আমার শরীরে ব্যথা। তখন আপনি আমার কাছে কারণ জিগ্যেস করতে চান নি কারণটা।বরং আমায় টেনে নীচে নামিয়েছে পুড়ে যাওয়া হাত ধরে। তখন আমার সামনে দাঁড়ানো আবেশ ভাইকে আমি চিনতে পারছিলাম না। এক মুহূর্তে ভেবে নিয়েছিলাম আপনি হয়তো অন্যকেউ। কিন্তু না! আপনি আমার আবেশ ভাই ছিলেন। যে আমার পরিচয় পেয়েও অহেতুক কারণে আমাকে শাসিয়ে গেছে। কাল যখন কারণ জানতে পারলাম তখন আমার কী ইচ্ছা হয়েছিলো জানেন?
ওই বারান্দা থেকে লাফিয়ে মরে যাই। চিঠিটা আমি দিয়েছি কী’না সেটা আমাকে না জিগ্যেস করেই আমাকে ভুল বুঝে ছিলেন। কেন? আমি মাধুর্য বলে? আমার মা বেইমানি করেছে,আব্বু পরিবর্তন হয়ে আমার যম হয়েছে। কী কারণ! যেটা আমি জানিও না। আমিই কেন সব সহ্য করবো?
আমি আর সহ্য করবো না। চাই না আমার সম্পত্তি। চাই না কারো মিথ্যা ভালোবাসা। আমি মুক্তি চাই। মুক্তি চাই এই জীবন থেকে।’
বলেই মাধুর্য উঠে দাঁড়ালো। আবেশ মাথা নীচু করে সব অভিযোগ শুনছিলো। তার অপরাধ সবচেয়ে বেশি এখানে। সে কেন আগে সব মাধুর্যকে কিছু জিগ্যেস করে নি?
‘ আবেশ,আপনার জীবনে আসার জন্য আমি খুব করে চাইতাম। আপনার সেই চিঠি পাবার পর থেকে চাইতাম।তবে যে মানুষটা আমায় ভুল বুঝে অবিশ্বাস করে গেছে তার জীবনে আমি আর থাকতে চাই না। মাধুর্য চলে গেলে সব স্থির হয়ে যাবে।আমি চাই চলে যেতে! সেই সাত আসমানে।’
শেষের কথাটুকু শুনে আবেশ চমকে তাকালো। মাধুর্য খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।আবেশের বুকের ভেতর কেঁপে উঠে। আজ মাধুর্য হাসছে।ভুবনমোহিনী মনকাড়া সেই হাসি। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে,আবেশ। আপনার জীবনের সেরা সারপ্রাইজ।’
চলবে…