#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ১৬
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্য বিছানা থেকে উঠতে গেলেই বুঝতে পারে তার হাত কারো কাছে আবদ্ধ ৷ বলিষ্ঠ হাত জোড়া শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে৷ সকালের নরম রোদ হাসছে৷ পূর্ব আকাশে সোনালি রঙের মেলা বসেছে৷ আবেশ মাধুর্যের একদম কাছাকাছি শুয়ে আছে বললে ভুল হবে আধশোয়া হয়ে বসে আছে ৷ মাধুর্য উঠে বসার চেষ্টা করেই বুঝতে পারলো তার মাথা ঝিমঝিম করছে ৷ মাথায় হাত দিয়ে ‘উফফ’ শব্দটা মুখ থেকে উচ্চারণ করেও আটকে যায় আবেশের বলা কথায়,
‘ আর ইউ ক্রেজি,মাধুর্য!তুমি বারান্দায় পা রাখবে না৷ প্লীজ স্টপ আর এক পা ও নাড়াবে না তুমি৷’
মাথা উঁচিয়ে আবেশের বলা কথা শোনে বিস্ময়ে পড়ে যায় মাধুর্য ৷ আবেশের চোখেমুখে উঁপচে পড়ছে ক্লান্তি৷ চুল গুলো উষ্কখুষ্ক৷ গালের দাড়ি গুলো ছন্নছাড়া৷ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ঘুমায় নি৷ মাধুর্য দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ৷ কাল সকালে কথা মনে হয় তার৷ তার জীবন কেমন অগোছালো ৷ সব ছেড়ে শান্তির আবাস খুজতে গিয়েই বারান্দা থেকে লাফ দেওয়ার জন্য ছুটে যায় ৷ সেটাই ছিলো আবেশের জন্য সারপ্রাইজ!
সে মারা গেলে সব কষ্ট ধুয়েমুছে যাবে তার রক্তের সাথে ৷ মাধুর্য নামক একটা মেয়ে যে তার বাবা আর ভাইয়ের পাওয়া কলুষিত অতীত থেকে মুক্তি পাবে৷ মুক্ত হবে তার কষ্ট৷ এইসকল কথা তার মস্তিষ্কে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছিলো বলেই বারান্দার শেষ সীমানায় চলে গিয়েছিলো৷ আবেশের চেহারা তখন শুকিয়ে একটুখানি হয়ে উঠেছিলো৷ ছুটে যায় আবেশ ৷ হেঁচকা টান দিতেই মাধুর্য পড়ে যায় বারান্দার উপর ৷ মাথা গিয়ে বাড়ি খায় ফুলের টবে৷ গলগল করে রক্ত ছুটে আসে কেটে যাওয়া জায়গা থেকে ৷ এরপরেই জ্ঞান হারায় মাধুর্য৷
এর পর কী হয়েছিলো সে জানে না! তবে তার অভিশপ্ত জীবনের মুক্তি হয় নি ভেবে খুশি হবে না দুঃখ পাবে ভেবে পেলো না মাধুর্য ৷
উঠে বসতে গেলেই কোমড়ে আর হাতে ব্যথার অস্তিত্ব টের পায় মাধু ৷ চোখমুখ কুঁচকে ফেলে তবে মুখে একদম শব্দ করে না ৷ সামনে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়তেই মাথায় ব্যান্ডেজ করা দেখতে পেলো৷ আচ্ছা! এর পর আবেশ কী কেঁদেছিলো? না-কী তাকে বকেছিলো! মাহফুজা আর বাড়ির সবাই কী ভেবেছিলো! মাধুর্য সব ভাবছে৷ বিষাক্ত অতীতের পর এই মানুষ গুলো তার ভরসা ৷ মাহফুজাকে সে দোষী ভাবে না! কারণ তারা সকল সম্পদ আত্মসাৎ করলেও নজরুল তার নামে উইল করে রেখেছে ৷ তার মা মেহরুন অপরাধী! যার অপরাধে অভিযুক্ত তারা সকলে৷ হুট করে উধাও হয়ে সকলের মাঝে কলুষিত অধ্যায়ের সূচনা করেছে ৷ যার ভুক্তভোগী মাধুর্য!
তবে আবেশ! সে কী করে পারলো তাকে অবিশ্বাস করতে? এই কথা মাথায় আসতে আবেশের প্রতি তার অভিমান হলো ৷ সে কারো দয়ায় আজ থেকে আর বাঁচবে না! সে মরার চেষ্টাও করবে না৷ মাধুর্য ঘুরে দাঁড়াবে ৷
নতুন এক সকালের সূচনার সাথে সাথে মাধুর্যের জীবনে সূর্যের আগমণ ঘটবে৷ মাধুর্য একা লড়াই করতে পারবে,অবশ্যই পারবে! তবে আবেশ,আপনার জায়গা হবে না এই মাধুর্যের কাছে৷ আপনি ছুড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন,আমাকে চরিত্রহীন বলেছেন,জঘন্য বলেছেন,আমার সব কথা না শুনেই ৷ এই কথা আমি কখনো ভুলবো না,আবেশ৷
মাধুর্য নিজ মনে আওড়িয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আবেশ বলল,
‘ উঠার চেষ্টা করবে না,মাধুর্য৷ শুয়ে থাকো৷আমি সব এনে দিবো তোমায়৷’ মাধুর্য নিজের হাত টান দিয়ে সরাতে গেলেই আবেশের ঘুম ছুটে যায়৷ ঘুম কন্ঠে ব্যাকুল ভাবে বলতেই মাধুর্য বলল,
‘ আমি পারবো৷’
‘ পারবে না তুমি! কতোটা ইনজুরড হয়েছে ধারণা আছে তোমার?’
মাধুর্য জবাব দিলো না৷ চুপচাপ বসে রইলো বেডের এক কোণায়৷ আবেশের শুষ্ক মুখ ৷ তার কঁপালে চিন্তার সূক্ষ্ম ভাজ৷ কাল সকাল থেকে তার সমস্ত শক্তি যেন লোপ পাচ্ছিলো৷ মাধুর্যকে হঠাৎ করে বারান্দায় ছুটে যাওয়া দেখে দুনিয়া ঘুরে উঠেছিলো মুহূর্তে৷ মাধুর্য যখন একদম শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলো তখনো আবেশ ভেবেছিলো,তার মাধবীলতা সত্যি সাত আসমানে চলে যাবে ৷ আল্লাহর রহমতে সে বাঁচাতে পেরেছে৷ তবে অতিরিক্ত জোরে টান দেওয়ার ফলে মাধুর্য ওইভাবে ব্যথা পাবে সে কল্পনা করেই কিছুটা মিইয়ে গেলো৷
রক্তে রাঙা মুখ৷ চোখে মুখে কান্নার ছাপ দেখে আবেশ কী করবে ভেবে পায় নি ৷মাধুর্যকে ধরে অনেকটা সময় জ্ঞানশূন্য হয়ে বসে ছিলো৷
মাহফুজা আবেশের চিৎকার শুনে ছুটে এসে ওই অবস্থা দেখে আরো পাগল হয়ে উঠেছিলেন ৷ আবেশ নিজেকে সামলিয়ে মাধুর্যকে নিয়ে ছুটেছিলো হসপিটালে ৷ মেয়েটাকে না চাইতেও হাজার কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে৷ এই অপরাধবোধ থেকে কী করে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে সে জানে না!
‘ উঠতে মানা করলাম তো,তোমাকে৷’
‘ আমি ওয়াশরুমে যাবো!’ মাধুর্য উঠার চেষ্টা করেই বলল ৷ আবেশ মাধুর্যকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ বললাম তো আমি দিয়ে আসবো৷’
‘ কারো করুণা লাগবে না আমার ৷’ মাধুর্য স্বাভাবিক গলায় বলল ৷ আবেশ অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে ফেললো৷ সেদিন রাতে রাগের মাথায় সে বলেছিলো,
‘ তোমার প্রতি আমার করুণা হয়৷ একজন অসহায় মেয়ের প্রতি যেমনটা ঠিক তেমন করুণা৷’
মাধুর্য অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো ৷ সেই কথাটুকু মনে পড়তেই আবেশ বলল,
‘ আমি দিয়ে আসি এতে প্রবলেম কোথায়!’
‘ আবেশ..মাধুর্য উঠেছে?’
মাহফুজা দরজায় কড়া নেড়ে বলল৷ মাহফুজার ডাক শুনেই আবেশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেলা ০৮ঃ৫৪ মিনিট! বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে এলো তার ৷ ঠিক আটটা সময় মাধুর্যের একটা মেডিসিন ছিলো আর সে ঘুমিয়েছে ৷ মাহফুজার আবার ডাকে ভাবনায় ভাঁটা পড়ে আবেশের ৷ সে তড়িঘড়ি করে বলল,
‘ হ্যাঁ আম্মা! তুমি অপেক্ষা করো আমি দরজা খুলছি৷’
‘ খুলতে হবে না! তুই অফিস যাবি?’
‘ ইয়াসিন কে সব বুঝিয়ে দিয়ে আমি দুইদিনের ছুটি নিয়েছি৷ আর কাল তো আব্বু আসবেন তাই কাজের চাপ নেই৷’
আবেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল৷ নিজেত গায়ের টি-শার্ট ঝেড়ে আবার বলল,
‘ স্যুপ টা রেডি করো আম্মা৷ আমি আসছি!’
‘ দ্রুত আয়৷’ বলেই মাহফুজা পা বাড়ালেন নীচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ৷ আবেশ শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মাধুর্যের দিকে ৷ মাধুর্য সব কিছু শুনে অবাক হলো৷ আবেশ যেখানে সব কাজ নিজে করে সে না-কি আবার দুইদিনের ছুটি নিয়েছে,কেন! তার জন্য বুঝি?
‘ হাত ধরো৷’ আবেশ হাত বাড়িয়ে বলল ৷ মাধুর্য গলায় কাঠিন্য ভাব এনে বলল,
‘ আমি পারবো! আপনাকে চিন্তা করতে হবে না৷’
বলেই উঠতে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো মাধুর্য ৷ আবেশ মাধুর্যকে ধরে অস্থির গলায় বলল,
‘ কাল থেকে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছো! কমনসেন্স নেই তোমার? পড়ে গেলে কী হবে৷’
‘ কাল যখন মরবো নি আজও মরবো না।
‘ মাধুর্য!’ আবেশ চেচিয়ে বলল ৷ মাধুর্য কেঁপে উঠলো আবেশের এহেন ডাকে৷ আবেশ মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে হুট করেই কোলে তুলে নিলো তাকে। কিছু মুহূর্তের হওয়া ছোট একটা ঘটনায় ভড়কে গেলো মাধুর্য ৷ ভয়ে চোখমুখ খিঁচে আছে সে ৷ আবেশ মাধুর্যের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তখন হাত ধরলেই এখন ভয় পেতে হতো না,মাধু৷’
আবেশের কোমল কন্ঠের আওয়াজে মাধুর্য চোখ তুলে তাকিয়েও ফিরিয়ে নিলো ৷ আজ থেকে সে আর মুখ বুজে সব সহ্য করবে না ৷ নিজ পায়ে দাঁড়াবে সে৷ মাধুর্য আবার হাসবে ৷ তার জীবনের কালো অধ্যায়ের অবসান নিজ হাতে করবে৷ তবে আবেশের সাথেও দূরত্ব রাখবে ৷ অবশ্যই রাখবে!কারণ তার আবেশ ভাইয়া তাকে অবিশ্বাস করে পদে পদে অপমান করেছে ৷ যেটার মূল কারণ সে ছিলোই না ৷ বুকের ভেতরে কেমন ব্যথার আভাস পাচ্ছে ৷ সে কী আদেও পারবে! ঘুরে দাঁড়াতে? আবেশের ভুল বুঝার জন্য তাকে দূরে ঠেলে দিতে!
__________
বাইরে সন্ধ্যা ঘণিয়ে আসছে ৷ সূর্য লুকায়িত হচ্ছে কালো গহ্বরে৷ এক ফালি রশ্মি উঁকি দিচ্ছে মেঘের আড়ালে ডুবে যাওয়া সূর্য থেকে ৷ বিশাল আকাশ আজ লাল মিশ্রিত হলদে আলোয় সেজেছে ৷ ঝিরিঝিরি বাতাসে আচ্ছাদিত আরণ্যক৷ মাধুর্য বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে আছে ৷ সকালে পর থেকে টাইম টু টাইম আবেশ মেডিসিন জোর করে খাওয়াচ্ছে তাকে ৷ তবে দুপুরের পর থেকে তার দেখা নেই ৷ কোথায় গিয়েছে মাধুর্য জানে না! জানার চেষ্টাও করে নি ৷ তবে অবাধ্য মন বারবার জানতে চাইছে,কোথায় গিয়েছে সে!
‘ তোমার জামাই এতো পাগল,মাধুর্য৷ আমার গম্ভীর দেবরকে কি করে পাগল বানালে গো?’
ইরা হাতভর্তি ফল এনে বলল ৷ মাধুর্য ইরার কথার মানে বুঝতে না পেরে তাকালো ৷ ইরা মাধুর্যের পাশে বসে বলল,
‘ বুঝলে না তো?’
‘ না!’ মাধুর্যের সহজ স্বীকারোক্তি৷ ইরা ফলের একটা বাটি নিজ হাতে উঠিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলল,
‘ কাল যখন তুমি ইনজুরড হয়ে পড়েছিলে তখন তোমার জামাই পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে নিয়েছিলো ৷ তোমার ভাসুরকে অসুস্থ অবস্থায় তার ভাইকে সামলাতে হয়েছে,ভাবো! আর তোমার কেবিন থেকে এক পাঁ ও নড়ে নি সে৷ বাড়িতে এসে আম্মা তোমার কাছে থাকতে চাইলে সেটাও দেয় নি৷ গম্ভীর গলায় বলেছে,
মাধুর্যের খেয়াল আমি রাখতে পারবো আম্মা!’
বলেই ইরা হাসলো ৷ মাধুর্য হাসছে না একদম ৷ তার ভেতর নিংড়ে বেরিয়ে আসছে সব তিক্ত মুহূর্ত ৷ ইরা আবার বলল,
‘ বাইরে যাওয়ার আগে আমার কাছে তোমাকে রেখে গেছে ৷ সেই সাথে এতো দায়িত্ব দিয়ে গেছে৷ আমার অসুস্থ জামাই বেচারা মুখ গোমড়া করে বসে আছে ঘরে,তার ভাইয়ের নির্যাতনে৷’
‘ ফয়েজ ভাইয়া এসেছে!’
মাধুর্য উৎফুল্ল ভাবে বলল ৷ ইরা থেমে গেলো৷ ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করল,
‘ তুমি চেনো?’
‘ হ্যাঁ,ফয়েজ ভাইয়া তো আমার ভাই হয়! অনেক বছর ভাইয়াকে দেখি না৷ জানো,ভাবী! ফয়েজ ভাইয়া আমাকে অনেক চকলেট দিতো৷’
ইরা অবাক হলো কিছুটা ৷ মাধুর্য এখন হাসছে৷ তার গোমড়া মুখে হাসি ফুঁটে উঠেছে দেখে ইরা বেশি প্রশ্ন করলো না ৷ মাহফুজার কাছে জিগ্যেস করলে সব উত্তর পাবে ভেবে চুপ হয়ে মাধুর্যের সাথে তাল মিলালো ৷
প্রায় অনেকটা সময় গল্প করার পর ইরার কিছু একটা মনে হতেই বলল,
‘ মাধুর্য,তুমি ফল খাও আমি পাঁচ মিনিটে আসছি৷’
মাধুর্য ইরার হাত ধরে বলল,’ কোথায় যাচ্ছো,ভাবী!’
‘ তোমার জামাই যাওয়ার আগে একটা চিঠি গুজে দিয়ে গেছেন আমার হাতে ৷ বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম আমি ৷ এখুনি নিয়ে আসছি দাঁড়াও৷’
‘ কী’সের চিঠি ভাবী!’
ইরা দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,
‘ তুমি না-কি রেগে আছো! তোমার রাগ ভাঙ্গানোর চিঠি ৷ সে তো চলে গেছে! তাই যাওয়ার আগে চিঠিটা আমায় দিয়ে গেছে৷’
মাধুর্য অবাক হলো! সকালে বললো দুইদিনের ছুটি নিয়েছে৷ এর মাঝে কোথায় গেলো আবেশ!
চলবে…