#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২১
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
নিশীথের অন্ধকারে ডুবে আছে চারিধার৷ নিস্তব্ধ চারিদিক৷ খোলা জানালা দিয়ে শীতল হাওয়া তীব্রবেগে ঢুকে ছুঁয়ে দিচ্ছে সমস্ত শরীর৷ আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ সৃষ্টিতে আড়ষ্টভাব এনে দিচ্ছে মাধুর্যকে ৷ সে বরাবর বজ্রপাতে আওয়াজে শিউরে উঠে ৷ আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না ৷ আবেশ ড্রাইভ করছে দক্ষতার সাথে৷ পাহাড়ি রাস্তা নামতে বৃষ্টির সময় বেগ পেতে হয়৷ সিলেট থেকে রূপগঞ্জ যেতে অনেক বেশিই সময় লাগবে ৷ তার এখন আফসোস হচ্ছে! রাতে না বের হওয়াটাই উচিৎ ছিলো মাধুর্যকে নিয়ে ৷ ভোররাত পার হয়ে যাবে পৌছাতে৷ আকাশ জুড়ে বৃষ্টির আসর বসবে কে জানতো এইসময়ে।
মাধুর্য ভয়ে বিমূর্ত হয়ে বসে আছে৷ চোখেমুখে ফুঁটে উঠেছে ভয়৷ থেকে থেকেই আকাশ জুড়ে আলোকপাত হয়ে তীব্র শব্দ আচ্ছাদিত হচ্ছে পরিবেশ ৷ প্রত্যেকটা শব্দ ভয়ে জমিয়ে দিচ্ছে তাকে৷ তীব্র শব্দে আবারো বাজ পড়তেই আবেশের হাত শক্ত করে ধরলো সে ।ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। মাধুর্যের আচমকা ধরাতে আবেশ ভড়কে যায়। মাধুর্যের চোখেমুখে ভয় দেখে শীতল হেসে বলল,
‘ ভয় পাচ্ছো? আমি আছি তো। ভয় পেও না।’
আবেশের এমন ভরসার কথা শুনে এমনি এক বজ্রপাতের রাতের কথা মনে পড়লো তার ৷ তার মা হারিয়ে যাওয়ার পর উন্মাদ হয়ে খোজ করছিলেন শাহেদ ৷ হুট করে সেও উধাও হয়ে যায় একদিন। একা রেখে গেলো মাধুর্যকে ৷ ছোট মাধুর্য সেদিন বাড়ির উঠানে বসে ছিলো রাস্তার দিকে তাকিয়ে ৷ আষাঢ় মাস! হঠাৎ করেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি সেই সাথে বজ্রপাত ৷ থেকে থেকে গর্জে উঠে মেঘ৷ সেদিন মাধুর্য সারা ঘরে লুকানোর আশ্রয় খুজেছিলো৷ আশেপাশের মানুষ নিজেদের ঘরে ৷ সে একা ভয়ে শিউরে উঠছিলো সারারাত ভর৷ শাহেদ ফেরে নি সে রাতে ৷ অতিরিক্ত ভয়ে মাধুর্যের ধুম জ্বর এলো ৷ এরপরের দিন শাহেদ ফিরলেন লতা বেগম আর রাব্বীকে নিয়ে ৷ সেইদিন আসার পরেই ইচ্ছামতো মারলেন শাহেদ ৷ মোটা একটা লাঠি দিয়ে ৷ সেই রাতের পর থেকেই তার জীবন পাল্টে যায় ৷ রাব্বী যখন তাদের কাছে আসে তখুনি সে আট নয় বছরের বড় ছিলো। শাহেদ তাকে মেরে যাবার পর ব্যথাতুর শরীরে লাথি দিয়ে একটা কথা বলেছিলো,
‘ তোর মা যেমন আমার মায়ের জীবন বিষাক্ত বানিয়ে ছিলো আমি তোর জীবন বানাবো৷ তোকে শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে দিবো না ৷ আমার মায়ের প্রতিটি চোখের পানির মূল্য তুই দিবি৷ তোর মা তো পালিয়েছে ৷ ওই হারামজা*র জীবন ও শেষ করে দিয়েছি ৷ এখন তুই আছিস ৷ তোকে তিলে তিলে মারবো ঠিক আমার মা যেমন তিলে তিলে কষ্ট পেয়েছিলো৷’
মাধুর্যের অসুস্থ শরীরের বেধড়ক ভাবে মার পড়ার জন্য বিছানায় পড়ে গিয়েছিলো সে ৷ এর পর সে যখন ভালো রেজাল্ট করেছিলো সেই বছর রাব্বী মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে তৃতীয় বারের মতো ফেল করে যার জন্য শাহেদ তাকে বকেছিলো ৷ এই কারণেও তাকে মেরেছিলো রাব্বী৷ লতা বেগম কেমন শান্ত প্রকৃতির ৷ মাধুর্য যখন চিৎকার করে কাঁদতো সে তখন দাঁড়িয়ে দেখতো৷ না কাছে আসতো না কখনো তাকে মারতো ৷ ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মাধুর্য ৷ রাব্বীর বউ ইকরা মেয়েটাকে জোর করে তুলে এনেছে রাব্বী৷ তাকে যখন রাব্বী মারতো সে ফেরাতে আসলে ইকরাকেও মারতো ৷ ইকরার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতো মাঝেমধ্যেই তাদের রুমে থেকে৷ রাব্বীর প্রতি মাধুর্যের ক্ষোভ জন্মেছে প্রচন্ড ৷ এতো নিকৃষ্ট কেন সে! ইকারার কথা মনে হতেই মাধুর্য আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ইকরা ভাবীর জন্য আমার কষ্ট হয় ৷ রাব্বীর জন্য তার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে৷ আমাদের স্কুলের কলেজে পড়তো ইকরা ভাবী৷ তাকে তুলে এনে বিয়ে করেছিলো রাব্বী ৷ ইকরা ভাবীর বাবা ওর নামে কেস করলে তাকে মানুষ দিয়ে গায়েব করে ফেলেছে৷’
মাধুর্যের হঠাৎ বলা কথায় গাড়ি থামিয়ে দিলো আবেশ৷ চিন্তার ভাজ পড়লো কঁপালে তার ৷ আবেশের হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে দেওয়াতে ভড়কে গেলো মাধুর্য ৷ অস্থির কন্ঠে বলল,
‘ আপনি ঠিক আছেন! অসুস্থ লাগছে৷ গাড়ি থামিয়ে দিলেন কেন৷’
‘ তোমার লাস্টের কথা আবার রিপিট করো মাধুর্য ৷ ইকরা ভাবীর বাবাকে গায়েব করার ক্ষমতা রাব্বীর থাকলে মেহরুন আন্টিকেও রাব্বী গায়েব করতে পারে,মাধুর্য৷’
‘ কিন্তু কীভাবে! ও তখন ছোট ছিলো ৷ আপনার থেকে দুই বা তিন বছরের বড় হবে হয়তো৷ বাইশ বা বিশ বছরের ছেলে কীভাবে পারবে!’
মাধুর্য ভেবেচিন্তে উত্তর দিলো৷ আবেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ সে এতোটা খারাপ কী করে হলো! তার পেছনে মাস্টার মাইন্ড আছে ৷ যে সম্পূর্ণ কাজ নিখুঁতভাবে করেছে৷’
মাধুর্য ভাবলো৷ রাব্বী প্রায় বলতো তার মায়ের জীবন তার মা মেহরুন নষ্ট করে দিয়েছে৷ তবে কী? শাহেদ রাব্বী আর লতা বেগমকে আগে থেকেই চিনতো! মাধুর্যের জানামতে,মেহরুন হারিয়ে যাবার পর পরিচয় হয়েছে তার লতা বেগমের সাথে৷ মাথা ব্যথা করে উঠলো মাধুর্যের ৷ আবেশ মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ ঠিক আছো তুমি৷’
‘ হ্যাঁ,গাড়ি থামালেন কেন৷ দ্রুত চলুন৷’
আবেশ চালালো না ৷ গাড়ির হুইলে হাত দিয়ে বসে রইলো৷ ফাঁকা রাস্তা তাই চিন্তা নেই খুব একটা ৷ আর বৃষ্টির বেগ বেড়েছে ৷ ঝমঝম শব্দ তুলে নৃত্য করছে বৃষ্টিকন্যা৷ গাড়ির সাদা আলো বৃষ্টির সাথে খেলা করছে ৷ সাদা ধোঁয়ার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে বৃত্ত আঁকছে তারা ৷ আবেশ সিটবেল্ট খুলে ফেললো ৷ কঁপালে হাত ঠেকিয়ে বসে বলল,
‘ তোমার কিছু কথা জানা দরকার মাধুর্য৷’
‘ কী কথা?’ মাধুর্য জবাব দিলো৷ আবেশ চোখ বোজে বলল,
‘ শাহেদ আঙ্কেলের নিজের ছেলে রাব্বী৷’
‘ কীভাবে! রাব্বী নিজে বলেছিলো তার বাবা নেই৷’
‘ ভুল বলেছিলো৷ হয়তো রাগ বা ক্ষোভ থেকে ৷ আমি যতোদূর জানি মানে আম্মা বলেছে,শাহেদ আঙ্কেল তোমার নানা ভাইয়ের সম্পত্তির জন্যই রাব্বী আর আর তার মাকে ফেলে পালিয়ে আসে আন্টিকে নিয়ে ৷ তবে তোমার নানাভাই কঠোর মানুষ ছিলেন বলে তার উদ্দেশ্য সফল হয় নি ৷ তাই কোনো সম্পদ ও সে পায় নি। মেহরুন আন্টি তোমার বাবার সাথে পালিয়ে এসেছিলো বলেই হয়তো রাব্বী তোমাকে দেখতে পারতো না৷ আরেকটা কথা তারমানে,তোমার নানাভাইকে শাহেদ আঙ্কেল খুন করেছে পরে যখন আন্টির নামে সম্পত্তি লিখে দেন৷ এতো সহজ হিসেব আগে কেন ধরতে পারি নি,ড্যাম ৷ মাধুর্য শাহেদ আঙ্কেল খুনি ৷ এইজন্য হয়তো আন্টি পালিয়ে গিয়েছেন কোথাও৷’
মাধুর্য অবাক হয়ে আছে ৷ তার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না ৷ আবারো ঘুরেফিরে সম্পদের বেড়াজালে আটকে যায় সব৷ সব কিছুর মূলে সম্পত্তি ৷ মাধুর্যের চোখ জ্বলছে ৷ আবেশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি শাস্তি চাই,আবেশ ৷ আমি ভয় পাচ্ছি না আর পাবো না ৷ সব প্রমাণ জোগাড় করে তাকে আর তাদের শাস্তি দিন ৷ আমি নিজে স্টেটমেন্ট দিবো৷’
মাধুর্যের কথা শুনে কিছু বলল না আবেশ৷ সে ভাবছে,শাহেদ কোথায়! চিন্তিত স্বরে বলল,
‘ শাহেদ আঙ্কেল কোথায় তাহলে!’
‘ বাড়িতেই৷ তবে তার দেখা পাওয়া যায় না৷ তবে হ্যাঁ,পাওয়া যেত যখন আমাকে মারতে আসতো৷’
বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো মাধুর্য ৷ তার হাসিতে বেদনা লুকায়িত ৷ এক পশলা বৃষ্টির মতো কষ্ট আছড়ে পড়ছে মাধুর্যের কাছে ৷ তার মা কীভাবে পেরেছিলো অন্য একটা মায়ের সংসার ভেঙ্গে দিতে৷ জঘন্য লাগছে সেই মানুষটাকে ‘মা’ বলতে৷ কেও ‘মা’ হতে না পেরে কাঁদে আবার কেও সন্তানের জীবন হুমকিতে ঠেলে দেয় ৷ দুনিয়া বড্ড নিষ্ঠুর ৷ যার আঁচড় পড়েছে মাধুর্যের সুন্দর গোছানো জীবনে ৷
____________
ভোরের আলো ছুঁবে ছুঁবে করছে মাটির কোলে৷ আদুরে পরশে সিক্ততা পাচ্ছে প্রকৃতি ৷ গাছ-গাছালিতে ঘিরে থাকা রূপগঞ্জ ৷ পাখির কলতানে বিভোর পরিবেশ৷ ঘুম থেকে সদ্য উঠা পাখিরা নীড় ছেড়ে ডানা মেলছে উন্মুক্ত আকাশে ৷ মাধুর্য ঘুমিয়ে আছে৷ জানালার ফাঁক গলে শুভ্র আলো আদর মাখছে তার গালে৷ কাল রাতে লং ড্রাইভ করে এসেছে আবেশ ৷ শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করেছে তার ৷ গাড়ি লক করে মাঝে একবার জিরিয়ে নিয়েছিলো তবে এর পরেই হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে এসে পৌছিয়েছে রুপগঞ্জ সদরে ৷ গ্রামের রাস্তাযর মোড়ে থামিয়ে দিলো গাড়ি৷ চারদিকে আবছা হয়ে ফুঁটে উঠেছে সূর্য রশ্মি৷ নদীর পাড়ে গাড়ি দাঁড় করেছে সে ৷ অন্ধকার ছাঁপিয়ে পূর্ব আকাশে যখন গোধূলির মতো আলো ফুঁটে উঠলো তখন আবেশ ঘুরে তাকালো মাধুর্যের দিকে৷ ঘুমে আচ্ছাদিত হয়ে আছে সে ৷ ছোট ছোট চুল গুলো দোল খাচ্ছে হাওয়ার তালে ৷ সূর্য ওঠার সময় ঘনিয়ে এসেছে ৷ আবেশ মাধুর্যকে ডাক দিয়ে বলল,
‘ মাধুর্য..এই মাধুর্য উঠো৷’
‘ উঁহু,আমি ঘুমাবো আরেকটু৷’
‘ পরে ঘুমাবা৷ এখন উঠো একটা জিনিস দেখাবো৷’
‘ আপনি দেখুন ৷ আমি পরে আপনার চোখ থেকে দেখে নিবো৷’
মাধুর্য ঘুম কন্ঠেই বলল ৷ আবেশের কপাল কুঞ্চিত হয়ে গেলো৷ ওইদিকে সূর্য আকাশের কোল জুড়ে বিচরণ করা শুরু করে দিয়েছে ৷ আবেশ অধৈর্য হয়ে আবারো ডাক দিলো,
‘ মাধু! প্লীজ উঠো৷ একটু উঠো৷’
মাধুর্য বিরক্তিতে মুখ ঘুরিয়ে নিলো আবারো ৷ কাল রাত থেকে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা ৷ এতো ঘুম পায় কোথায় এই মেয়ে? সে নেমে গেলো একাই গাড়ি থেকে ৷
মাধুর্যের দরজার দিকে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিতেই মাধুর্য হেলে পড়ে যাচ্ছিলো সাথে সাথেই ৷ আবশ মুখ কুঁচকে দ্রুত ধরে ফেললো মাধুর্যকে ৷ এতেও ঘুম ছুটলো না মাধুর্যের ৷ আবেশ মাধুর্যকে ধরে একবার পূর্ব দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার মাধুর্যের দিকে ৷ বিড়বিড় করে বলল,
‘ সব ঘুম আজ ধরা দিয়েছে ওনার চোখে৷ উফ! কী মেয়েরে বাবা৷ রোম্যান্টিক মুহূর্তেও ঘুমাবে নাকি!’
মাধুর্য আবেশের ছোঁয়া পেয়ে দুইহাতে আঁকড়ে ধরলো আবেশকে ৷ মাধুর্যের হাতের ছোঁয়ায় কম্পন ধরে গেলো আবেশের ৷ ঘাম ছুটে যাচ্ছে ৷ কেমন শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে৷ তবে সব বাদ দিয়ে নীচু হয়ে কোলে তুলে নিলো তাকে ৷
মাধুর্য ঘুমের তালেই আঁকড়ে ধরলো আবেশের শার্ট৷ আবেশ তাকালো গভীর চোখে৷ মাধুর্য ঠোঁট কামড়ে ঘুমিয়ে আছে বাচ্চাদের মতো ৷
‘ এইভাবে ঠোঁট কামড়ে রেখেছো কেন!’ আবেশ আবারো বিড়বিড় করেই বলল ৷ নদীর পাড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে সে৷ সূর্যের কমলা রঙ তখন আকাশ জুড়ে আদর মাখছে ৷
আবেশের হাটার গতির জন্য দুলে উঠছে মাধুর্য ৷ ঘুম ছুটে গেলো অল্প অল্প৷ নিজেকে হাওয়ায় ভাসতে দেখে চিৎকার করে বলল,
‘ আবেশশ..কোথায় আপনি৷ আমি হাওয়ায় ভাসছি৷ এইই আবেশ ৷ আমাকে কেউ নিয়ে যাচ্ছে৷ আপনি কোথায়৷’
চলবে…
#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২১[#পরবর্তী_অংশ]
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্য ভয়ে চোখমুখ কুঁচকে আছে এখনো ৷ মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে আবেশের শার্ট ৷ আবেশ ক্রমেই ঝুঁকে যাচ্ছে মাধুর্যের মুখের উপর৷ আবেশ ধমক দিয়ে বলল,
‘ কে নিয়ে যাচ্ছে তোমায়! আমি ছাড়া কে আছে এখানে৷’
‘ আমি গাড়িতে ছিলাম হাওয়ায় ভাসছি কী করে! আবেশ..শ কোথায় আপনি৷’ মাধুর্য ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল ৷ রাগে আবেশের চোখেমুখ শক্ত হয়ে উঠেছে ৷ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ তুমি আমার কাছেই আছো৷ চোখ খুলে দেখো৷’
মাধুর্য আবেশের কথা শুনলো না ৷ চোখেমুখে তার উৎকন্ঠা৷ আবেশের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ছোট ছোট চোখে তাকানোর চেষ্টা করলো৷ আবেশ থমকে দাঁড়িয়ে আছে ৷ নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা সূর্যের দিকে ৷ সেইসাথে তাকাচ্ছে মাধুর্যের রক্তিম আলোয় লালাভ হয়ে উঠা মুখশ্রীর দিকে ৷ মাধুর্য দেখলো,আবেশের বিমুগ্ধ চোখ যা তাতে আর সামনে নিবদ্ধ ৷ আবেশ মাধুর্যকে নামিয়ে দিলো কোলে থেকে ৷ নিজেই মাধুর্যের কোমড়ে হাত রেখে সামনে মুখ ফিরিয়ে দিয়ে মাধুর্যের কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে বলল,
‘ একটি সুন্দর সকালের সূর্য তোমার নামের খাতায় তুলে দিলাম,আমার মাধবীলতা৷’
আবেশের এমন ফিসফিস আওয়াজে ঝিমিয়ে থাকা মনের কোঠা প্রজাপতি ডানা মেলে গেলো মাধুর্যের ৷ সে বিভোর চোখে সামনে তাকালো৷ আবেশের হাতজোড়া ধরে রেখেছে তার কোমড় ৷ সেইদিকে মাধুর্যের হুঁশ নেই এখন ৷ সে ব্যস্ত আকাশ জুড়ে বিস্তার করা সুন্দর ভোর দেখতে ৷ নদীর শীতল বাতাসে নিজেকে মেলতে ৷ দুইহাত বাড়িয়ে দিয়ে সূর্যকে কাছে টানতে ৷ একঝাঁক উড়ো পাখি সূর্যের ঠিক নীচ দিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে ৷ মাধুর্য দুইহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ কতো সুন্দর!’
‘ এখন ঘুমাও৷ তোমার দেখতে হবে না৷’ আবেশ মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে বলল ৷ মাধুর্য বুকভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
‘ সূর্যের কিরণ স্নিগ্ধতা ছড়াচ্ছে,আবেশ৷ দেখুন অনেক সুন্দর ৷ স্রোতশূন্য নদীতে আচ্ছাদিত হচ্ছে৷’
‘ চলো আবার ঘুমাবে৷’
‘ কেন!’ মাধুর্য বিস্ময় নিয়ে বলল৷ আবেশ হেয়ালি করে বলল,
‘ এতো ঘুম কোথা থেকে পাও তুমি৷’
মাধুর্য আধখোলা চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে বলল,
‘ মোটেও আমি এতো ঘুমোই না৷ চোখ লেগে গিয়েছিলো একটু৷’
‘ কীহ..ওহ মাই গড ৷ ওইটাকে চোখ লেগে যাওয়া বললে ঘুম কাকে বলে!’
আবেশ খানিকটা জোরে চিৎকার করে বলল৷ মাধুর্য কানে হাত দিয়ে বলল,
‘ এতো জোরে কেউ চিৎকার করে!’
‘ তোমায় যদি আমি নদীতে ছুড়ে মারতাম তবুও তোমার ঘুম ছুটতো না৷’ আবেশ মৃদু হেসে বলল৷ মাধুর্য ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
‘ তারমানে আপনি আমাকে ছুড়ে দিতে নিয়ে এসেছেন!’
মাধুর্যের কথা শোনে আবেশ বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ এতো সুন্দর একটা ভোর উপভোগ করানোর জন্য কষ্ট করে লাভ কী হলো! তার বোকা বউ তো উল্টো তাকে ভুল বুঝে যাচ্ছে৷
মাধুর্যের কোমড়ে হাত রেখেই তাকে সামনে ঘুরালো আবেশ ৷ চোখ বড় বড় করে বলল,
‘ আমাকে নিয়ে তোমার এইসব লেইম চিন্তাধারা হয়!’
‘ আপনি নিজেই তো বললেন,তোমাকে ছুড়ে ফেললে৷ এই কথার মানে কী দাঁড়ায়! আপনি আমাকে ছুড়ে ফেলতে নিয়ে এসেছিলেন৷’
মাধুর্য অভিমান করে বলল ৷ আবেশের মনের কোণে সুপ্ত ইচ্ছা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে আর সেটা হলো,’আবেশ তুই নিজেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়৷’
‘ এ..ই..এই আপনি ভুলেও আমায় ছুড়ে মারার চেষ্টা করবেন না৷ যদি করে থাকেন তাহলে আমি…’
‘ তাহলে কী তুমি!’ আবেশ কঁপাল কুঞ্চন করে বলল৷ মাধুর্য কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
‘ তাহলে আমি নিজেই পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বো৷’
মাধুর্যের মুখ দেখে আবেশ ভাষা শূন্য হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো৷ তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে গম্ভীর স্বরেই বলল,
‘ রিডিউকুলাস৷ আমি তোমার যুক্তি দেখে জাস্ট স্পিচলেস৷’
‘ কে জানে হয়তো আমাকে আপনার ও বোঝা মনে হয়৷’
‘ মাধুর্য স্টপ!আর একটা ফালতু কথা বললে সত্যি সত্যি ফেলে দিবো৷’
আবেশ হুমকির স্বরে বলল ৷ মাধুর্য মুখ কাচুমাচু করে চুপ হয়ে রইলো ৷ আবেশ মাধুর্যকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ চলো,দেরি হয়ে যাচ্ছে৷’
বলেই আবেশ নদীর পাড় বেয়ে উপরে উঠে দাঁড়ায় গাড়ির সামনে ৷ নদীর বাতাস আলগা হয়ে ছুঁয়ে দিলো মাধুর্যকে ৷ সুর তুলে বলল,
‘ মাধুর্য কাজটা ঠিক করিস নি৷ এইবার রাগ সামলা৷’
___________
মাইলের পর মাইল রাস্তার ধারে সুউচ্চ গাছের সারি৷ তার পাশের বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত ৷ সূর্যের চিকন আলোক রশ্মি স্নেহের পরশে সিক্ত করছে তাদের ৷ কাঁচা মাটির রাস্তার ফলে গাড়ির ঝাঁকি তে বেহাল অবস্থা ৷ মাধুর্য চুপ করে বসে আছে৷ সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য আবার রুপগঞ্জে কাটানো বিষাক্ত অতীতের কথা মনে হতে৷
আবেশ রোদচশমা খুলে দিলো৷ জানালার পুরো কাচ নামিয়ে দিলো ৷ রাশিরাশি ভালোলাগা জড়িয়ে নিলো তাকে ৷ রুপগঞ্জ! তার ভালোবাসার নাম৷ যেখান থেকে শুরু হয়েছিলো একটা গল্প৷ অজানা অনুভূতির গল্প ৷ যার নাম ছিলো মাধবীলতা৷ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো তার মন ৷ সামনেই পুরোনো বাড়ি যেখানে তারা ঘুরতে আসতো ৷ সব ভেসে উঠছে চোখে ৷ ওইতো ফয়েজ আর মাধুর্য আবেশকে রেখেই দৌড়ে যাচ্ছে৷ মাধুর্যের দুই বেণি হাওয়ায় দোল খাচ্ছে বাতাসে ৷
তখনো তার মনে কোনো অনুভূতির সঞ্চার হয় নি৷ তবে আজ অনুভূতি সাজিয়ে সেই ছোট মাধুর্য তার পাশেই বসে আছে ৷ এইকথা ভেবে সে আড়চোখে তাকালো মাধুর্যের দিকে ৷ মাধুর্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে দ্রুত চোখ ফিরিয়ে মুখে কাঠিন্য ভাব আনার চেষ্টা চালালো৷
মাধুর্য ভয়ে ভয়ে ডাক দিলো,
‘ শুনছেন!’
‘ আমার কান খোলাই আছে৷’ আবেশ কাট কাট গলায় জবাব দিলো৷ মাধুর্য শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ আপনি আমার সাথে রাগ করে আছেন?’
‘ রাগ করার মতো কিছু করেছো তুমি?’
‘ অবশ্যই! তখন..’
‘ তখন কী?’ আবেশ না বোঝার মতো বলল ৷ মাধুর্য ওড়নায় আঙুল পেঁচাচ্ছে ৷ বারবার বলতে চেয়েও আটকে যাচ্ছে তার মুখে ৷ অনেকটা সময় বসে থেকে বলল,
‘ তখন আমি কতো সুন্দর একটা মুহূর্ত নষ্ট করে দিলাম৷’
‘ তুমি মুহূর্ত গুলাও বুঝো!’ আবেশ তাচ্ছিল্য করে বলল ৷ মাধুর্য মাথা নীচু করে বলল,
‘ আমি দুঃখিত৷’
‘ গাড়ি থেকে নামো৷’
‘ মানে! গাড়ি থেকে নামবো কেন৷’ মাধুর্য অবাক হয়ে বলল ৷ আবেশ গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ স্কুলে এসে পড়েছি,তাই৷’
আবেশা গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল৷ মাধুর্য চারপাশে তাকালো ৷ তার স্কুল! যেখানে সে স্বস্তি পেতো ৷ পুরোনো ভবন গুলো নেই৷ নতুন করে উঠানো হয়েছে সব৷ চাকচিক্যের ভেতর মাধুর্য তবুও শেকড়ের টান অনুভব করলো ৷ তার রেজাল্ট হাতে পেলেও একটা সার্টিফিকেট রয়ে গেছে স্কুলে৷
কলেজের প্রিন্সিপাল কীভাবে ম্যানেজ করেছিলো মাধুর্য জানে না৷ তবে বলেছিলো,কখনো সুযোগ পেলে স্কুল থেকে উঠিয়ে নিতে ৷ এতো বছর পর সেই সুযোগ পাবে ভেবে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকালো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আবেশের দিকে তাকিয়ে৷
‘ কোলে করে নামাতে হবে,তোমাকে?’ আবেশে গাড়ির কাচে টোকা দিয়ে বলল ৷ মাধুর্য ভাবনায় বিভোর ছিলো আবেশের কথা শুনে তাড়াহুড়ো করে বলল,
‘ ন.ন..না আমি নামছি৷’
বলেই মাধুর্য নেমে দাঁড়ালো ৷ শাঁই করে ভালোলাগা ছুটে এলো মাধুর্যের কাছে৷ উত্তেজনায় চেপে ধরলো আবেশের হাত ৷ আবেশের অন্তর কাঁপিয়ে উঠলো এই ছোঁয়া ৷ চুপিসারে নিজেও আঁকড়ে ধরলো মাধুর্যের হাত৷
মাধুর্যের চোখেমুখে উঁপচে পড়ছে খুশি৷ স্কুলে মাধুর্যকে নিয়ে আসার পর এতোটা খুশি হবে আবেশ ভাবতে পারে নি৷ আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে তাদের দিকে৷ সবাই অচেনা৷ তবে এই অচেনা মানুষের ভীড়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে মাধুর্য ৷
___________
রাত আনুমানিক ১০ঃ৩৪৷ নিকষ আলো ছাপিয়ে আকাশের মাঝে চন্দ্র তার হাসি বিলাচ্ছে৷ গোল হয়ে গোলাকার বৃত্ত তৈরি করেছে কালো আঁধারে ডুবে থাকা আকাশে ৷ সারাদিনের জার্নি শেষ করে মাধুর্য ক্লান্ত৷ তবে আবেশ একদম ঠিকঠাক৷ রুপগঞ্জের সব কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে এইটাই অনেক৷ তবে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তাদের ৷ আবেশ গাড়ি পার্ক করে এসে মাধুর্যের পাশে দাঁড়ালো৷
মাধুর্য তখন নিজের জামা ঠিক করছে ঝুঁকে৷ আবেশ দুই পা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ৷ মাধুর্য মাথা তুলতেই তার পিঠ গিয়ে ঠেকলো আবেশের বুকের উপর৷মাধুর্য ভড়কে যায় ৷ আবেশ নিজের পকেটে হাত গুজে বলল,
‘ আমি রেগে আছি৷ আর সেই রাগ কমার নয়৷’
‘ আবারো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন৷’
‘ আমি থাকতে ভয় কীসের তোমার৷’ আবেশ বিড়বিড় করে বলতেই মাধুর্য পেছনে মাথা ঘুরিয়ে বলল,
‘ কিছু বললেন?’
‘ হ্যাঁ,তোমার সকালে কাজের জন্য আমি প্রচন্ড রেগে আছি৷’
‘ বলে আবার কে রাগ করে?’
‘ এই আবেশ এহসান করে৷’
বলেই শিষ বাজিয়ে এগিয়ে যায় সামনে আবেশ৷ ঠিক ছোট বেলার মতো৷ মাধুর্য বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে নির্বাক চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে৷
চলবে…