#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২২
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
আবেশের চোখমুখ লাল হয়ে আছে ৷জানালার একটুকরো ফাঁক গলে রৌদ্দুর ছুটে উষ্ণ পরশে ভরিয়ে দিলো মাধুর্যের মুখ৷ সেইদিকে তাকিয়ে নিজের চুলে আঙুল চালিয়ে দিয়ে বলল,
‘ ঘুমকন্যা এতো ঘুম কোথাথেকে আসে তোমার৷’
মাধুর্যের সাড়াশব্দ আজও নেই ৷ শীতল বাতাসে কেঁপে উঠছে সে৷ ভোরের হিমশীতল হাওয়া বড্ড লাগামছাড়া৷ মাধুর্য ঘুমের মাঝেই কিছু একটা খুজছে৷ আবেশ সেইদিকে লক্ষ্য করে উঠে কাঁথা টেনে দিলো মাধুর্যের উপর ৷ টেনে দেওয়ার আগে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো মাধুর্যের ক্ষতস্থান গুলো ৷ কাল রাতে ফিরে মাধুর্য ঘুমিয়ে গেলেও ঘুমায় নি আবেশ৷ নজরুল সাহেব কাজের সূত্রে তাদের ফেরার আগে অফিসে গিয়েছেন৷ তাই আর দেখা হয় নি।
আবেশ ছুঁয়ে দিলো মাধুর্যের কালো হয়ে যাওয়া বিভিন্ন জায়গা গুলো ৷ রাগে তার কপালের রগ ফুলে উঠেছে৷ কাল সারারাত ধরে সে অফিসের জমে থাকা কাজ গুলো করেছে ৷
তবে ভোর হতেই কাজ ফেলে মাধুর্যের ঘুমিয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ ফর্সা গালে একটা লম্বা দাগ পড়েছে মাধুর্যের ৷ হয়তো রাব্বী বা শাহেদের আঘাতে ৷ আবেশ খানিকটা ঝুঁকে ছুয়ে দিলো মাধুর্যের গাল ৷ সাথে সাথেই মাধুর্য কেঁপে উঠলো ৷ সেই সাথে কেঁপে উঠলো তার বোজে থাকা চোখের পাতা ৷
আবেশের ঘোর লেগে যাচ্ছে ৷ সুপ্ত এক ইচ্ছা জাগ্রত হতেই এগিয়ে যায় মাধুর্যের চুলে ছেয়ে থাকা কপালের দিকে ৷ কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে ঠোঁট বসালো মাধুর্যের কপালে৷ সেই উষ্ণ পরশ অতি পবিত্র,অতি নিষ্ঠুর৷ যা সুন্দরতম উষ্ণতার জাগরণে কাঁপিয়ে দিলো আবেশের ভেতর৷ সে কতোক্ষণ তার ঠোঁটজোড়া ছুঁইয়ে রেখেছিলো মাধুর্যের কপালে সে জানে না ৷ সূর্যের অমোঘ চক্রের আয়োজনে ভালোবাসায় মন্ডিত করলো আবেশের হৃদয়৷ মাধুর্য ঘুমের মাঝেই নড়ে উঠতে চোরের মতো দ্রুত সরে যায় আবেশ৷
বিরবির করে বলল,
‘ প্রথম পরশের অনুভূতি আমি একা গ্রহণ করতে চাই নি মাধবীলতা তবে,নিজেকে সংযত করতেও পারি নি৷ কথা দিলাম,তোমার ওই অধরযুগল যেদিন আমার নামে লিখিত হবে সেদিন সব শোধ করে দিবো৷’
‘ আপনি উঠে গেছেন৷’ মাধুর্য শুয়ে থাকা অবস্থায় প্রাশ্ন করলো৷ আবেশ উত্তর না দিয়ে মাথার পেছনে হাত দিয়ে চুলে হাত বোলাচ্ছে৷ চোখেমুখে উঁপচে পড়ছে ধরা পড়ে যাবার রেশ৷ মাধুর্য আবার বলল,
‘ আবেশ..’
‘ ব..বলো৷ কী বলবে?’আবেশ খানিক মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল ৷ মাধুর্য কী তার পরশ বুঝতে পেরেছে! তার অনুমতি ব্যতীত কাজটা করা একদম ঠিক হয় নি৷ আবেশকে অগোছালো দেখে ভড়কে গেলো মাধুর্য ৷ ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত স্বরে বলল,
‘ আপনার কি পেটে ব্যথা করছে!’
‘ হোয়াট.. পেটে ব্যথা করবে কেন৷’ আবেশ খানিক চেঁচিয়ে বলল৷ মাধুর্য জ্ঞানী অভিব্যক্তি দেখিয়ে বলল,
‘ আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে,দুই বছরের বাচ্চার পেটে ব্যথা করছে আর তার মা না বুঝে খাওয়াচ্ছে৷’
মাধুর্যের কথা শোনে নির্বাক চিত্তে দাঁড়িয়ে রইলো আবেশ ৷ সে ভয় পাচ্ছিলো চুমুটা নিয়ে আর এই মেয়ে তার পেট ব্যথা নিয়ে পড়ে আছে ৷ আবেশ মজা করে,
‘ তোমার যুক্তি গুলো দিয়ে বই পাবলিশড করলে হাজার কপি বিক্রি হবে,রিডিকুলাউস৷’
আবেশের বলা কথার মানে বুঝতে না পেরে বিছানায় হেলায় দিয়ে চুপ করে বসে রইলো মাধুর্য। থুতনিতে হাত দিয়ে বলল,
‘ আপনি কিছু করছেনে তাই না? যার জন্য পালাই পালাই করছেন।’
‘ মা..মানে ক..কী করবো।’ আবেশ না চাইতেও তোতলামি করছে।তার কেমন অদ্ভুত লাগছে। সে চায় না মাধুর্য তাকে ভুল বুঝক তাই হয়তো!
‘ কিছুতে ফেল টেইল করেছেন ক্লাস গণিতে সেভেনের মতো? সেবার সব বিষয়ে হায়েস্ট পেয়ে গণিতে দশ পেয়েছিলেন। তারপর এইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন আম্মুমার সামনে৷’ বলেই মাধুর্য খিলখিল করে হেসে উঠলো৷ সদ্য আসা ভোরের নম্র আলো চিকচিক করে উঠলো মাধুর্যের হাসির সাথে ৷ এলোমেলো আধখোলা চুল গুলো হাওয়ায় দুলছে হাসির তালে৷ আবেশ তাকিয়ে আছে৷ যার দৃষ্টির অর্থ,একরাশ মুগ্ধতা৷ আবেশ পা বাড়িয়ে মাধুর্যের সামনে এসে দাঁড়ালো৷ মাধুর্য তখনো হাসিতে মত্ত৷ তার হাসির সাথে চোখ হাসছে ৷ আবেশ মাধুর্যের দুইপাশে হাত দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ গণিতে ফেল করেছিলাম বলে খুব হাসা হচ্ছে তাই,না?’
‘ আপনি যে গণিতে ভয় পেতেন সেটা আমার থেকে আর কে ভালো জানে?’ মাধুর্য পেটে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলল ৷ আবেশ বিনম্র কন্ঠে বলল,
‘ তুমি আমার ভেতরে বাহিরে সবটাই পরখ করে রেখেছো,তাই না!’
‘ অবশ্যই৷ আমি আপনাকে খুব করে জানি৷’
‘ তাহলে কেন আমার মনের কথা বুঝতে পারছো না,মাধবীলতা! কেন,তোমার অনুভূতিতে কেন ভাটা পড়ে আছে৷’
আবেশের কন্ঠে ব্যাকুলতা৷ মাধুর্য মুহূর্তেই হাসি থামিয়ে দিয়ে প্রশ্নসূচক চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ মানে!’
‘ সময় হোক মানে বুঝাবো৷’ আবেশ ওইভাবে ঝুঁকে থেকেই জবাব দিলো৷ আবেশকে এতো কাছাকাছি দেখে দ্রিম করে উঠলো মাধুর্যের হৃৎপিন্ড৷ আজও পেছানোর জায়গা না পেয়ে শুকনো ঢোক গিলে বলল,
‘ আমার খিদে পেয়েছে আমি নীচে যাবো৷’
আবেশ কিছু না বলে আজ সহজ ভাবেই উঠে দাঁড়ালো ৷ বিরবির করে বলল,
‘ সব সহ্য করতে পারবে তবে আমি কাছে গেলেই তার খিদে পায়,কান্না আসে৷ কী কপাল তোর আবেশ৷’
______________
মাধুর্য ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো নাবিহার রুমের দিকে ৷ বাইরে তখন দুপুরের কড়া রোদ খাঁখাঁ করছে ৷ তপ্ত গরমে ঝিমিয়ে আছে পরিবেশ৷ বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে শরীরে৷ কাক টা তারস্বরে ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে কারেন্টের তারের উপর নিরলস ভাবে বসে আছে৷ মাধুর্য বা হাত দিয়ে কঁপালে জমে থাকা ঘাম মুছে দাঁড়ালো নাবিহার রুমের সামনে৷
ভেতরে উঁকি দিতেই পেছন থেকে ভেসে এলো,
‘ কাকে খুজছিস বুড়ি!’
‘ কাওকে না ফাজ ভাইয়া৷’ মাধুর্য নিজেকে সামলে পেছনে ফিরে বলল৷ ফয়েজ হাটতে বের হয়েছে রুম থেকে৷ হাতে দুটো ভর দেওয়ার লাঠি৷ মাধুর্য ফয়েজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোমার কষ্ট হচ্ছে তাই না!’
‘ না সয়ে গেছে৷ এইগুলা মাঝেমধ্যেই ফেস করতে হয়৷’
মাধুর্য কিছুক্ষণ ভেবে হুট করে প্রশ্ন করলো,
‘ নাবিহা আপু কোথায়!’
‘ বাসায় চলে গেছে কাল৷ বাদ দে! আগে বল,কোচিং এ ভর্তি হয়েছিস?’
‘ হ্যাঁ ভাইয়া৷’ মাধুর্য নম্র ভাবে উত্তর দিলো৷ ফয়েজ আর কিছু বলার আগেই পেছনের কাচ ঘেরা রুমে আওয়াজ হতেই চমকে তাকায় তারা ৷
মধ্যবয়স সাদা পাঞ্জাবি পরা শ্যাম বর্ণের একটা লোক বের হতেই ফয়েজ বলল,
‘ বাসায় এসেও কাজ ৷ এতো শক্তি পাচ্ছো কোথায়,বাবা৷’
ভদ্রলোক পান চিবুচ্ছেন৷ মুখে তার লম্বা গোঁফ৷ গোঁফ দেখেই মাধুর্যের বুঝতে ভুল হলো না উনি নজরুল সাহেব৷ মাধুর্য ওড়না টেনে দিলো মাথায়৷ ফয়েজের আবডালে দাঁড়িয়ে রইলো চুপটি করে৷ নজরুল সাহেব রুমে তালা দিয়ে বললেন,
‘ আবেশ একা সব সামলায়৷ তুমি আর্মিতে জয়েন দিয়ে আমাদের দুই বাপ ব্যাটাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছো৷’
ফয়েজ মাথা চুলকিয়ে বলল,
‘ ওইসব ব্যবসা আমার দ্বারা হবে না৷’
নজরুল সাহেব হাসলেন ৷ মাধুর্য কীভাবে কথা বলবে খুজে পেলো না৷ নজরুল সাহেব তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এলেন৷ ফয়েজ সরে দাঁড়াতেই মাধুর্যের হাত ধরে কেঁদে উঠলেন ভদ্রলোক৷ কন্ঠে কাতরতা এনে বললেন,
‘ মাধুর্য মা আমার! আমার মা৷’
নজরুল সাহেবের এমন ডাক শুনে মাধুর্যের ভেতরে শীতলতা বয়ে গেলো ৷ না চাইতেও চোখ পানিতে ভরে উঠলো৷ নজরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ আসসালামু আলাইকুম,ভালো আছেন৷’
‘ তোমাকে কতো খুজেছি জানো! অবশেষে যখন পেলাম তখন তুমি নরকে বন্ধ৷ মা আমায় ক্ষমা করো৷ আমি বাবা হিসেবে ব্যর্থ৷ তোমার জীবনের অনেক গুলা বছর আমার ব্যর্থতার জন্য ওই জালেমদের কাছে কেটেছে৷ শাহেদ এতো নিম্ন আমি ভাবি নি৷’
মাধুর্য নজরুলের স্নেহ মাখা কন্ঠে ডুকরে কেঁদে উঠলো আরো৷ ভেজা গলায় বলল,
‘ আপনার দোষ নেই৷’
‘ সব দোষ আমার৷ তোমার আমানত আমার কাছে৷ সেই আমানত আমি তোমায় দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাই৷’
‘ আমানত!’ ফয়েজ পাশে থেকে অবাক সুরে বলল৷ নজরুল হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল,
‘ হ্যাঁ আমানত৷ আবেশ অফিস থেকে আসলেই আমি আমার দায় থেকে মুক্ত হবো৷’
___________
এহসান মঞ্জিল আজ স্তব্ধ৷ সন্ধ্যায় রাঙা হয়েছে বাইরের প্রকৃতি৷ বড় ড্রয়িংরুমে আজ সব সদস্য উপস্থিত৷ কেন্দ্রবিন্দু নজরুল সাহেব৷
মাধুর্য গুটিয়ে আছে মাহফুজার সাথে৷ মাহফুজা ভয়ে সিটিয়ে আছেন ছেলে মেয়ের মুখপানে চেয়ে৷ নজরুলের কথা শোনে তারা কী ভাবে নিবে সবটা তা ভয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে মাহফুজার মন৷ আবেশ সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেই বিরক্ত হয়ে বসে আছে ৷ বারবার শার্টের কলার ধরে ফুঁ দিচ্ছে৷ এখন কীসের সমাবেশ বসালো তার বাবা? বিরক্তিকর!
ইরা,ফয়েজ,আর নাজিফা বসে আছে ডাবল সোফায়৷ তাদের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস৷
নজরুল সাহবের চোখে পানিতে পরিপূর্ণ। ইরা প্রশ্ন করতেই তিনি থামিয়ে দেন তাকে। এতো বছরে কেউ কখনো নজরুল সাহেবকে কাঁদতে দেখেন নি। আজ হ্ঠাৎ তার চোখে পানি দেখে সবাই বেশ অবাক হয়েছে। অবাক হয়েছে মাধুর্য!নজরুল সাহেব চোখে পানি নিয়ে বললেন,
‘ আমি আর তোদের মা অন্যায় করেছি,মাধুর্যের সাথে।’
তার এই কথা যেন বিস্ময়ে ঠেলে দিলো সবাইকে। মাধুর্য বাদে সবার চোখেমুখে এখন বিস্ময়।আবেশ খানিক উচ্চগলায় বলল,
‘ মানে! আপনি আর আম্মা কেন অন্যায় করবেন? অন্যায় করে থাকলে শাহেদ আঙ্কেল আর রাব্বী নামক হারামি করেছে।’
‘ তাদের অন্যায় পুলিশের কারাগারে শুধরে যাবে তবে আমি আর তোর মা মাধুর্যের জীবনের কারাগারের আসামি।’
‘ বাবা কী বলছো তুমি! আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারছি না।’
নজরুল সাহেব ফয়েজের প্রশ্নে বিরক্ত বোধ করলেন। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ এইযে সব প্রাচুর্য দেখছো এইসব মাধুর্যের।তার মা মেহরুন আমার হাতে তুলে দিয়েছিলো সব ।হারিয়ে যাবার আগে।তবে বলে গিয়েছিলেন,মাধুর্যকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে। তবে আমি আর তোমাদের আম্মা চেয়েও পারি নি মাধুর্যকে আমাদের কাছে নিয়ে আসতে।আমরা যদি তাকে নিয়ে আসতাম তবে শাহেদ তার জীবন নরক বানাতে পারতো না।’
সবাই অবাক হয়ে আছে। বিমূর্ত হয়ে বসে আছে। মাহফুজা ছেলেদের মুখের দিলে তাকিয়ে আছেন। সে যা ভয় পাচ্ছে তা হলে তার ছেলেমেয়ে তাদের ছেড়ে চলে যেতে এক মিনিট ও ভাববে না। কারণ তাদের ব্যক্তিত্ব প্রচুর। ভয়ে তার বুক দুরুদুরু করছে। অসহায় চোখে তাকালেন নজরুলের দিকে। নজরুল আশ্বাস দিলেন ইশারায় ‘কিছু হবে না’।
তিনি থেমে আবার বললেন,
‘ আমি চাই তোমাদের সামনে মাধুর্যের সম্পদ তাকে ফিরিয়ে দায়মুক্ত হতে।’
‘ কিন্তু বাবা..’ আবেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল। নজরুল এই ছেলেকে বড্ড মানেন।আবেশের চোখেমুখে আজ রাগ দেখতে পেয়ে খানিক ভয় পেলেন। আবেশ আবার বলল,
‘ সব কিছু মেহরুন আন্টি তোমাদের কাছে দিয়ে গেলে আন্টি কোথায়? যেদিন সব দিয়ে গিয়েছিলো সেদিন কেন মাধুর্যকে সাথে আনে নি! আর কোথায় উনি। তোমরা কী দেখো নি কোথায় গিয়েছিলেন উনি।’
‘ মাধুর্যকে সাথে আনে নি কারণ মেহরুনকে শাহেদ আটকিয়ে রেখেছিলো। মেহরুন সেখানে থেকে পালিয়ে এসেছিলো আমাদের কাছে। মেহরুন আমার কাছে কাগজ তুলে দিয়ে কোর্টে যাচ্ছিলো সাইন করার জন্য আমি আর তোর আম্মা তার সাথে যেতে চাইলে নেয় নি আমাদের। তবে এরপরে মেহরুনকে আমরা কেউ আর দেখি নি। তবে…..’
‘ তবে কী বাবা! উনি হ্ঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলেন তাই তো! এইটা অসম্ভব। মেহরুন আন্টি বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন।’ ফয়েজ বলল। নজরুল বললেন,
‘ রাব্বী তাকে মেরে ফেলেছে। তার মায়ের সংসারে ভাগ বসানোর জন্য মেরে দিয়েছিলো মেহরুন কে।সেইদিন মেরে দিয়েছিলো যেদিন আমাদের এখানে এসেছিলো।আজ রিমান্ডে রাব্বী এই স্টেটমেন্ট দিয়েছে। তাকে পুলিশ আজ ধরেছে।’
নজরুল থামলেন বলে। মাধুর্য এতোক্ষণ নির্বাক ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো। মেহরুনের মৃত্যুর কথাটা শুনে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সে এটা কখনো চায় নি তার মায়ের মৃত্যু হোক। মনের মাঝে একটা আশা নিয়ে ছিলো হয়তো মেহরুন আসবে সে তাকে প্রশ্ন করবে,কেন রেখে হারিয়ে গিয়েছিলো সে! তবে আজ….তার মা নেই শুনে দুমড়ে মুচড়ে গেলো তার ভেতর। ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে।
চলবে…….
#ভেতরে_বাহিরে
পর্বঃ২৩
লেখিকাঃ #রুবাইদা_হৃদি
গুমোট অন্ধকার আচ্ছন্নতা ঘিরে আছে সর্বদিকে৷ মাধুর্য আবেশের বুকে মাথা দিয়ে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে আছে৷ হাত দুটো আবেশের বলিষ্ঠ হাতজোড়ায় নিবদ্ধ৷ আবেশের গলা কম্পয়মান৷ কেঁপে উঠা গলায় আবারো বলল,
‘ মাধু..মাধবীলতা..আমার মাধবীলতা চোখ খুলে তাকাও৷’
‘ আবেশ ওকে দ্রুত হসপিটালে নিতে হবে বিপি ফল করেছে৷ হার্টবিট একদম স্লো৷’ ইরা পাশ থেকে বলল৷ আবেশ নজরুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ সবটা আগে তোমার আমাকে বলা উচিৎ ছিলো,বাবা৷ আমি ওকে যতোটা ঠিক করার চেষ্টা করছি কেউ না কেউ এসে ঠিক তার থেকে বেশি ভেঙ্গে দিয়ে যাচ্ছে৷’
ইরা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ কথা বাড়িয়ো না আবেশ৷ আমি গাড়ি বের করছি তুমি মাধুর্যকে নিয়ে আসো৷’
‘ মাধুর্যের সবকিছু জানতে হবে,মানতে হবে সব সত্যি ৷ আর পাঁচটা পরিবার বা তার জীবন সহজ ছিলো না৷ তাই সব সহজ করতে হলে সবটা তাকে জানতে হবে৷’ বললেন নজরুল সাহেব৷ তার চোখেমুখেও স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। আবেশ তার কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বলল,
‘ আমাদের এতোদিন কেন জানাও নি এইসব মাধুর্যের৷ ঘোর অন্যায় করেছো৷ তোমাদের অন্যায়ের শাস্তি মাধুর্য পেয়েছে৷’
‘ ভুল বলছিস আবেশ৷ তুই নিজে খোজ করিস নি৷ তবে আমি আর আম্মা প্রায়শই রুপগঞ্জ যেতাম মাধুর্যকে খুজতে৷ শাহেদ আঙ্কেল অতিরিক্ত চালাক মানুষ বলেই রুপগঞ্জ ছেড়ে মুয়াপাড়া গিয়ে থেকেছেন তারপর এসেছেন সিলেট৷’ ফয়েজ বলতেই আবেশ ভাবলো৷ সে সত্যি কোনো খোজ নেয় নি ওই চিঠিটা পাবার পর৷ নজরুল সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
‘ রাব্বীর স্টেটমেন্ট নিয়ে অফিসার কাল বা পরশু আসবে৷ এখন দেরি না করে মাধুর্যকে নিয়ে হসপিটালে যাও৷’
মাধুর্যের শীতল হাতের স্পর্শ আবেশের ভাবনায় ভাঁটা ফেলে৷ মাধুর্যের কান্না গুলো শুকিয়ে আছে গালে৷ ঠোঁট ফ্যাকাসে হয়ে আছে৷ আবেশের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠে ৷ দ্রুত মাধুর্যকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় ৷
নাজিফা স্তব্ধ হয়ে আছে সেই সাথে ফয়েজ ৷ নজরুল বলেছিলেন এইসব তার দাদাবাড়ীর সম্পদ বিক্রি করে তৈরি করেছেন ৷ তবে সব যে মাধুর্যের সেটা মোটেও বুঝতে পারে নি তারা ৷ ফয়েজের নিজেকে ছোট লাগছে ৷ তার বাবা-মা লোভ সামলাতে পারে নি খুব করে বুঝতে পারছে সে! রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ বাবা,তুমি চাইলে মাধুর্যকে খুজে বের করতে পারতে ৷ ইচ্ছা করেই করো নি,তাই না? আমি আর আম্মা চুপিচুপি খোজ করতাম৷ তুমি ইচ্ছা করে চুপ থেকেছিলে৷’
‘ আজ যে জায়গায় আছিস সে জায়গায় থাকতে পারতি যদি আমি এইসব ধরে না রাখতাম!’ নজরুল ঠান্ডা স্বরে বললেন ৷ মাহফুজা নজরুলের কথার পৃষ্ঠে বলল,
‘ আমি মানছি আমাদের অন্যায় ছিলো ৷ কিন্তু তোর বাবা মাধুর্যের নামেই সব উইল করে রেখেছে ৷’
‘ সেটা আরো আটবছর আগে মাধুর্যকে বাসায় নিয়ে এসে ভালো জীবন দেওয়ার মাধ্যমেও পারা যেত৷ শাহেদ আঙ্কেল সম্পদের লোভে মেহরুন আন্টিকে বিয়ে করেছেন,যখন সম্পত্তি পেলেন না তখন মাধুর্যের জীবন দুর্বিষহ করে তুললেন ৷ আর রাব্বী! সে তার মায়ের জীবনে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের শাস্তি দিলো মাধুর্যকে ৷ সবাই সবার দিক থেকে প্রতিশোধ আর সম্পদের লোভে আকৃষ্ট ছিলো তবে সব কিছুর শুরু আর শেষে মাধুর্যের জীবনের কতগুলো বছর নষ্ট হয়ে গেছে৷ আর সেটা দায়ভার তোমার বাবা ৷’ ফয়েজের কন্ঠে রাগ ঝরছে৷ মাহফুজা কী বলবেন খুজে পেলো না৷ নজরুল গলার স্বরে কাঠিন্য ভাব এনে বললেন,
‘ রাব্বী আর শাহেদ তাদের শাস্তি পাবে ৷ তবে আমার শাস্তি আমি মাধুর্যের হাতে তুলে দিবো৷ এর বাইরে আর একটা কথাও আমি তোমাদের থেকে শুনতে চাই না ৷’
ফয়েজ রাগ নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো ৷ তার বাবার সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব ধারণ করেছিলো তারা ৷ যে ব্যক্তিত্বে মিথ্যা বা প্রতারণা ছিলো না ৷ তবে আজ ফয়েজ ভালো করে বুঝে গেছে,এই ব্যক্তিত্বের আড়ালে সত্য লুকায়িত ছিলো ৷ যে সত্য হচ্ছে,তার বাবা মাধুর্যের সাথে অন্যায় করেছে ৷ এই বাড়িতে একটা মুহূর্ত থাকতে ইচ্ছা হচ্ছে না তার ৷ মাধুর্যের প্রতি আরো খারাপ লাগার সৃষ্টি হলো তারমনে৷
নাজিফা নখ কামড়াচ্ছে ৷ নজরুল সাহেব চুপ করে বসে আছেন সোফায়৷ নাজিফা সরল গলায় বলল,
‘ এইসব কিছু ছোট ভাবীর ৷ তাকে সব ফিরিয়ে দাও বাবা৷ আমাদের কিছু লাগবে না৷ ভাবী সুন্দর জীবন পাক আমি সেটা চাই৷’
নজরুল সাহেব নাজিফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ হ্যাঁ মা৷ তোমার বাবা এতোটাও নিষ্ঠুর না যতোটা তোমার বড় ভাই ভাবছে ৷ আমি সবকিছু তোমার ভাবীকে ফেরত দেওয়ার জন্যই এতোকাল অপেক্ষা করেছি৷’
নাজিফা তারা বাবার মুখপানে তাকিয়ে হাসলো৷ সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তারা বাবা কখনো ভুল করতে পারে না ৷
_____________
আঁধার ছুঁয়েছে ভুবন ভরে৷ শিরশিরে বাতাসের সাথে ফিনাইলের গন্ধ ভারী করছে পরিবেশ৷ সাদা পর্দা হাওয়ার তালে উড়ো উড়ি করছে ৷ কেবিনের প্রত্যেকটা জায়গায় বিভিন্ন মেডিকেলের চার্ট টাঙানো৷ মাধুর্যের হাতে স্যালাইন লাগানো হয়েছে ৷ ইরা মাধুর্যের ফর্মালিটি পূরণ করেই ঘন্টা তিনেক পূর্বে নিজের ডিউটি তে চলে গেছে ৷
মাধুর্যের হাত নিজের কপালে ঠেকিয়ে বসে আছে আবেশ ৷ জর্ণজীর্ণ চেহারায় ফুঁটে উঠেছে আকুতি৷ কোমল কন্ঠে বলল,
‘ জানি না সামনে কী হবে,মাধুর্য৷ তবে কথা দিচ্ছি তোমায় আর কাঁদতে দিব না৷’
‘ ম..মা আমি চাই নি তুমি আমায় ছেড়ে যাও৷ মা প্লীজ আমায় রেখে যেয়ো না৷’ মাধুর্য ঘুমা কাতুরে কন্ঠে জেগে উঠে অস্থিরচিত্তে বলল।
‘ মাধুর্য..’ আবেশ শ্লেষাত্মক কন্ঠে ডেকে উটলো তাকে। মাধুর্য চোখ খুলে তাকালো ৷ নজরুল সাহেবের বলা কথার পর তার আর কিছু মনে নেই ৷ শুধু মনে আছে রাব্বী তার মা’কে মেরে ফেলেছে ৷ উঠে বসার চেষ্টা করতেই আবেশ থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ রিলাক্স কিছু হয় নি মাধুর্য৷সব ঠিক আছে৷’
‘ কিছু ঠিক নেই আবেশ৷ আমার মা’কে মেরে ফে..ফেলেছে৷ ওই রাব্বী আমার মা’কে মেরে ফেলেছে৷’
মাধুর্য কান্নারত অবস্থায় বলল৷ আবেশ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ৷ মাধুর্য হাতের স্যালাইনের নল টানছে ৷ আবেশ চটজলদি উঠে মাধুর্যকে থামানোর চেষ্টা করেও বৃথা হলো ৷ আবেশ মাধুর্যের দুই হাত ধরে রেখে বলল,
‘ মাধুর্য পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে শেখো ৷ তুমি এতো বছর ধোঁয়াশায় ছিলে,আন্টিকে নিয়ে সে আদেও বেঁচে আছে কী’না সেটাও জানতে না৷ তবে আজ কেন মানতে পারছো না ! তোমায় মানতে হবে,সেই সাথে রাব্বীকে শাস্তি দিতে হবে৷’
‘ আমি পারবো না আবেশ ৷ কিচ্ছু পারবো না! আমাকেও মেরে ফেলতে বলুন,রাব্বীকে ৷ আমি আমার মায়ের কাছে যেতে চাই ৷’
মাধুর্যের এতো টুকো কথা শোনে আবেশ পাগলপ্রায় হয়ে উঠলো ৷ সব সংকোচ দূরে ঠেলে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে ৷ তার মাথায় নিজের থুঁতনি ঠেকিয়ে বলল,
‘ বি স্ট্রোং মাধুর্য৷ তোমায় লড়তে হবে এবং সেটা বেঁচে থেকে ৷’
মাধুর্য আবেশের বুকে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
‘ আমি পারবো না আবেশ৷’
‘ তুমি পারবে৷ আমি আছি তো তোমার সাথে৷’
মাধুর্য দুইহাতে শক্ত করে ধরলো আবেশকে ৷ সম্পূর্ণ ভর আবেশের উপর ছেড়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে৷ আবেশের ভেতরে শিহণের আন্দোলন তুলেছে ৷ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে যাচ্ছে অনুভূতির হিমেল হাওয়া ৷ মাধুর্য তখন ভরসার আশ্রয় খুজতে ব্যতিব্যস্ত৷ আর আবেশের মনে আন্দোলনের ঝড়ো হাওয়ার দাপটে প্রত্যেক ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসার মজবুত ভীত তুলতে ব্যস্ত৷
‘ সর্যি সর্যি রং টাইমিং৷ আমি কিছু দেখি নি৷’ ইরা দরজা দিয়ে ঢুকে ফাইল দিয়ে মুখ ঢেকে বলল ৷ আবেশ মাধুর্যকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না৷ ‘ থাক কিছু অনুভূতিতে তৃতীয় ব্যক্তি সাক্ষী,এতে ক্ষতি কী?’
আবেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ রং টাইমিং নয় ভাবী৷ ভেতরে আসো৷’
‘ জো হুকুম,দেবরজি৷’ ইরা মেকি হাসি টেনে বলল ৷ নজরুল সাহেবের বলা কথাগুলোতে সেও অপ্রস্তুত৷ এতোদিন যেটাকে নিজেদের বাড়ি ভেবে এসেছিলো সেটা এই ছোট মেয়েটার ৷ আর যার জন্য তার জীবন আজ দুর্বিষহ ৷ ভেবে মন খারাপের রেশ নিয়ে আবেশকে বলল,
‘ মেডিসিন গুলো..’
‘ আমি হ্যান্ডেল করতে পারবো৷ তোমার ডিউটি আওয়ার শেষ হলে চলে যাও।ভাই নিজেও তো অসুস্থ৷’
‘ তুমি পারবে?’
‘ অফকোর্স ভাবী৷ ভরসা করতে পারো৷’ আবেশ মাধুর্যের মাথায় হাত রেখে বলল ৷ ইরা মেডিসিন গুলো রেখে যেতে যেতে বলল,
‘ আজ থাকতে হবে এখানে৷ টেনশন নিয়ো না আমি একটা নার্স রেখে যাচ্ছি৷’
আবেশ সম্মতি দিতেই ইরা চলে যায়৷ আবেশ সরে যেতে চাইলে মাধুর্য আরো আঁকড়ে ধরলো ৷ আবেশ মৃদু হাসলো ৷ তার প্রতি মাধুর্যের মনে ভরসা জন্মাচ্ছে দেখে স্বস্তি পেলো ৷
‘ মাধুর্য?….’
‘ বলেন৷’ মাধুর্যের কান্নাভেজা গলা৷ আবেশ মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টেনে বলল,
‘ আমায় জাস্ট দু সেকেন্ডের জন্য ছাড়ো,আমি এখুনি আসছি৷’
‘ না..আপনি এখানে থাকুন৷ যাবেন না আমায় ছেড়ে৷’
আবেশ কী বলবে খুজে পেলো না৷ ওইভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই পকেট থেকে ফোন বের করে রিসেপশনে ফোন দিলো৷ রিসিভ হতেই গম্ভীর ভাবে বলল,
‘ ডক্টর মিসেস ইরা এহসান ৩০২ নাম্বার কেবিনে যাকে পাঠাতে বলে গেছেন তাকে কাইন্ডলী একটু পাঠিয়ে দিন৷’
ওইপাশে থেকে উত্তর আসার পূর্বেই আবেশ কল কেটে দিয়ে বিছানায় বসে নিজে থেকে মাধুর্যকে জড়িয়ে ধরলো ৷
সাথে সাথে মাধুর্য আরো মিশে গেলো আবেশের সাথে ৷ আবেশ তার মনে প্রশান্তি অনুভব করছে৷
‘ আমার কিছু চাই না আবেশ৷ আপনি আঙ্কেল কে বলে দিয়েন,আমার শুধু শান্তি চাই৷ যেখানে আমি ভয় ছাড়া বাঁচতে পারবো৷’ মাধুর্য আবেশের শার্ট তার হাতের মুঠোয় আগলে রেখে বলল ৷ আবেশ বলল,
‘ তোমার প্রাপ্য যেগুলো সবটা তুমি পাবে৷’
‘ আসবো স্যার৷’ দরজায় টোকা দিয়ে অচেনা এক নারীকন্ঠ অনুমতি চেয়ে বলল৷ আবেশ গলার স্বর একটু উঁচিয়ে বলল,
‘ জ্বী আসুন৷’
মেয়ে নার্স রুমে ঢুকেই ভড়কে যায় আবেশকে দেখে৷ সাথে আবেশের ও বিরক্তি চোখেমুখে ছেয়ে যায়৷ এইটা সেদিনের সেই মেয়ে নার্স । যেদিন ফয়েজকে দেখতে এসেছিলো সে আর এই মেয়ে তার দিলে তাকিয়ে ছিলো। মাধুর্য আবেশের বুকে মাথা রেখে চোখ বোজে আছে৷ মেয়েটা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
‘ ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,আমি আপনাকে একটা কোয়েশ্চেন করতে পারি?’
‘ ইয়াহ!’ আবেশ বিরক্তি মাখা গলায় জবাব দিলো৷ মেয়েটা এখনো মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ আবেশ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ কিছু বলবেন? না বললে আমায় মেডিসিন গুলো দিতে হ্যাল্প করে এখান থেকে চলে যান৷’
‘ আপনি কী উনার ভাইয়া?’মেয়েটা হড়বড় করে বলতেই আবেশ কেঁশে উঠলো ৷ নিজেকে ঠিক রেখে বলল,
‘ না ছাইয়া৷’
মেয়েটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল চোখ করে তাকিয়ে আছে ৷ মাধুর্য সব শুনে নির্বাক হয়ে আছে৷ আড়চোখে তাকালো নার্সের দিকে ৷ বিরবির করে বলল,
‘ উনি বোধহয় আপনাকে পছন্দ করে৷’
আবেশ তাকালো মাধুর্যের দিকে ৷ মাধুর্যকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখে মৃদু হাসলো ৷ সেই সাথে নার্সের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল,
‘ মেডিসিন গুলো দিন৷’
‘ দ…দ.দিচ্ছি৷’ নার্স ভগ্নহৃদয় নিয়ে বলল৷ আবেশের অস্বস্তি লাগছে৷ এইদিকে মাধুর্য শান্ত হয়ে সব পর্যবেক্ষণ করছে ৷
_____________
‘ হাটতে পারবে?’ আবেশ চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করলো৷ মাধুর্য সম্মতি জানি বলল,’ হ্যাঁ পারবো৷’
বলেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়৷ রাত আনুমানিক দু’টোর উপরে হবে৷ মাধুর্যের হসপিটালে দমবন্ধ লাগছিলো বললে আবেশ সাথে সাথে কোনোকিছুর পরোয়া না করে নিয়ে আসে মাধুর্যকে ৷
মাধুর্য ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
‘ কাল সকালে আমি জেলে যেতে চাই,আবেশ৷’
‘ রাব্বীকে রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে,মোহসীন ফোন করে বলল৷’ আবেশ দ্রুত পায়ে মাধুর্যের পাশাপাশি এসে বলল৷ মাধুর্য ক্লান্তিকর কন্ঠে বলল,
‘ আর তাকে?’
‘ শাহেদ আঙ্কেল?’ আবেশ প্রশ্ন করতেই মাধুর্য থেমে গেলো ৷ শুকিয়ে উঠলো মুখ৷ আবেশের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আমি বিষয়গুলো ভেবে দেখি নি আবেশ!’
‘ কী বিষয়?’
‘ মা’কে বা লতা বেগমকে উনি ভালোবাসেনি৷ লতা বেগম তার স্ত্রী হওয়ার পরেও সম্পদের জন্য আমার মায়ের জীবনে আসেন ৷ উনি জঘন্য মানুষ৷ না উনি রাব্বীর বাবা হওয়ার যোগ্য না আমার৷’ বলতেই মাধুর্যের গলা কেঁপে উঠলো ৷ সাথে সাথেই কোমড়ে হাত দিয়ে নীচে ঝুঁকে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো৷ আবেশ বুঝতে পারলো মাধুর্যের কষ্ট হচ্ছে৷ সাথে সাথেই তাকে দুইহাতে ধরে বলল,
‘ এতো কথা বলো কেন! আমার কাছে এসো৷’
‘ না..আমি পারবো৷’ মাধুর্য জেদ দেখিয়ে বলল৷ আবেশ তাকে জোর করেই কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘ তুমি আমি মিলে আমরা ৷ তাই আমাদের দায়িত্ব আমাকেই নিতে দেও৷’
মাধুর্য নিজেকে ছাড়াতে একফোঁটাও চেষ্টা করলো না৷ তার জীবনের সুতোটা সে ছেড়ে দিবে দূর আকাশে৷ হয় উড়বে নয়তো ভেসে যাবে হাওয়ার তালে…
চলবে….
[ কেমন লাগছে জানাবেন৷]