#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:২৮
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
আকাশ জুড়ে সূর্যের উজ্জ্বল ঝলকানি। ঝিমিয়ে থাকা পরিবেশের সাথে তাল মিলাচ্ছে এহসান বাড়ির সদর।সবার চোখেমুখ চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। মাহমুদ দুইহাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। মাধুর্য সেদিকে তাকাতেই তার বুক ধ্বক করে ওঠলো। আবেশ তখন ফোনে কারো সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে ব্যস্ত। মাধুর্য ধীরপায়ে আবেশের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আবেশের হাতের ভেতর দিয়ে তার হাত দিয়ে হালকা পেঁচিয়ে ধরে অস্থির কন্ঠে বলল,
‘ মাহমুদ ভাইয়া কাঁদছেন।’
আবেশ মাধুর্যের শীতল কন্ঠ শুনে মোবাইল নামিয়ে বলল,
‘ আপাকে দুলাভাই বড্ড বেশি ভালোবাসেন। আমার আপা কেন বুঝলো না। মানুষটাকে কষ্টের মাঝে রেখে উধাও হয়ে গেলেন।’
‘ আপার দিক থেকে আপা যে প্রতিনিয়ত ভাঙ্গছিলো।সমাজের নিয়মের বেড়াজাল সহ্য করতে পারে নি।’
‘ চিন্তা করো না। আপাকে ঠিক ফিরিয়ে আনবো আমরা।’ আবেশ আশ্বস্ত করে বলল। তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে। গলা কাঁপছে। শুধু দূর্বলতা প্রকাশ করতে চাইছে না। উষ্কখুষ্ক চুলগুলোতে হাত দিয়ে ব্রাশ করে ফয়েজকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ ভাই আমি মোহসীনের সাথে যাচ্ছি। তুই তোর মতো কাজে লেগে যা। যে করেই হোক আপাকে ফিরিয়ে আনবো।’
‘ আমার মেয়ে অভিমানী। ও যদি নিজেকে শেষ করে দেয়।’ মাহফুজা আর্তনাদ করে বলল। নজরুল ধমকে উঠে বললেন,
‘ আমার ছেলেমেয়েদেরা লড়তে শিখেছে,মরতে নয়।নাবিহা বুদ্ধিমতী হয়ে সমাজ থেকে কী করে হেরে যেতে পারলো ! তাকে আমি এই শিক্ষা দেই নি।’
‘ আপু নিজের ভেতর নিজে গুমরে মরছিলো,বাবা।সেটা কেও উপলব্ধি করতে পেরেছিলে?’ নাজিফা কান্নারত সুরে বলল ।
মাধুর্য আবেশের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
‘ আপুকে আমরা সবাই একা করে দিয়েছিলাম। তার একরোখা স্বভাবের জন্য। যখন তাকে কেও বাচ্চা নিয়ে কথা শোনাতো সে ছুটে আসতো বাড়িতে। রাতভর কান্না করতো। তার কষ্টটা কেও বুঝি নি আমরা।’
মাধুর্যের কথা শোনে সবাই চুপ হয়ে গেলো। সবার দুনিয়া নিয়ে সবাই ব্যস্ত ছিলো মাঝে থেকে সে একাই লড়াই করে গিয়েছে। মাহমুদ সেইসব কথা শোনে বলল,
‘ বাঁচতে হলে আমার নাবিহাকে চাই। কোনো বাচ্চা না। এই সমাজ আমার চাই না। যারা যারা আমার অবর্তমানে ওকে কষ্ট দিয়েছে তাদের আমি দেখে নিবো। মুখ ফুঁটে সব না বলেই আমাকে ফেলে চলে গেছে। সে কী একটা বার আমার কথা ভাবলো না !’
মাহমুদের কন্ঠে বিষাদের ছায়া। বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য জানে,মাহমুদ কতোটা চায় তাকে। যখন প্রথম জানতে পারলো নাবিহার দূর্বলতার কথা,তখন কেউ তার পাশে ছিলো না । মাহমুদ একা হাতে সামলিয়েছে।
তার ভেতর পুড়ে কয়লা হচ্ছে। সে তো আর পাঁচটা স্বামীর মতো বলে নি,বাচ্চা চাই। তবে কেন ! নাবিহা তাকে ফেলে চলে গেলো। শুধুমাত্র সমাজের মানুষের কথায়? দরকার নেই তার এই সমাজের। যেখানে সে তার অর্ধাঙ্গিনীকে সাথে নিয়ে শান্তিতে নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না।
মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলো এহসান বাড়ি থেকে। নজরুল ফেরাতে চাইলে আবেশ খানিক গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ যেতে দেও বাবা। ভাইয়া পারবেন। আপার জন্য আমাদের থেকে তার ভালোবাসা বহুগুণ। আপার সাথে সে আছে এবং থাকবে।’
____________
নিয়মমাফিক ঘড়ির কাটা ঘুরে চলেছে। মাহমুদ ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ঢুকতেই বুকের ভেতর ব্যথার আভাস পেলো। তার সুবিশাল বাড়ি আজ ফাঁকা। বুকের ব্যথা তীব্রতর হতেই দু চোখ বেয়ে নেমে এলো কান্নারা। সারাদিন সব জায়গায় খুজেছে তার,নাবুকে। কিন্তু পায় নি।
তাদের রুমে ঢুকতেই কান্নারা হেঁচকি তে পরিণত হলো। সে খুব করে বুঝতে পারছে,হয়তো তার মা আবারো নাবিহাকে চলে যেতে বলেছেন। প্রায় আট বছরের সংসার তাদের। বিয়ের পর দুই বছরের মাথায় সুখের সংসারে ভাটা পড়ে,একটা রিপোর্টের জন্য। সেইথেকে হাসিখুশি নাবিহা হয়ে যায় রাগী,রগচটা। তবে,মানুষের কথার পৃষ্ঠে জবাব দেওয়াটা তার নাবু শেখে নি।
হন্তদন্ত হয়ে ফোন লাগালো,তার মায়ের নাম্বারে। ফোন রিসিভ হতেই রাগী কন্ঠে বলল,
‘ তোমার প্রতি আমার দায়িত্ব আছে মা। কিন্তু নাবিহা,ওর প্রতিও আমার দায়িত্ব। আমি জানি তুমি ওকে আবারো অপমান করেছো। যার জন্য আমার নাবু চলে গেছে।’
‘ ওই মেয়ের বুদ্ধি খুলেছে।হ্যাঁ করেছি অপমান। আমার বংশ ধরে রাখার ক্ষমতা যার নেই তার আবার কীসের সম্মান।’ মাহমুদের আচমকা কথায় ভরকালেন না নাজনীন। সে স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো ছেলের কথার পৃষ্ঠে। এতে যেন মাহমুদ রেগে গেলো আরো। রাগ ধরে রেখেই বলল,
‘ তুমিও একজন মেয়ে,এরপর মা। তোমার বিবেকে আটকায় নি।কেন করলে এমন।’
‘ তোর ভালোর জন্য।’ নাজনীন বেগম ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন। সমাজে মুখ দেখানো যায় না,এই মেয়ের জন্য তাকে আবার সম্মান দিবেন। সেদিন,রাস্তায় ইচ্ছামত কিছু কড়া কথা শুনিয়ে লাভ হয়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো ফোনের ওপাশে। তার ছেলেকে তিনি আবার বিয়ে দিবেন। সমাজের ভেতরের নিয়ম এইটা।মাহমুদের গলা কাঁপছে। রাগ নিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘ মা তোমায় আমি সম্মান করি,ভালোবাসি। নাবিহাকেও তাই। সে চলে গিয়েছে ভেবে আমি কিন্তু তাকে খোজা বাদ রাখি নি। দ্রুত তাকে খুজে পাবো আর তাকে নিয়ে হারিয়ে যাবো।’
বলেই ফোন কেটে দিলো মাহমুদ। সাথে সাথেই নাজনীন বেগম ফোন দিলেন দেখে হাসলো মাহমুদ। তার নাবিহাকে খোজা বাকি। তারপর সেই মেয়েকে সমাজ শেখাবে সে।তার ভালোবাসাটাকে হেয় করে চলে যাওয়ার জন্য তাকে বকবে,খুব বকবে।
মাহমুদ চিঠিটা বুক পকেট থেকে বের করে বিড়বিড় করে বলল,
‘ বাঁচার জন্য আমার তোমাকে চাই,তোমার দূর্বলতা না,নাবিহা।’
সাথে সাথেই ফোন এলো তার ফোনে। নাজনীন বেগম ভেবে,মোবাইল ছুড়ে মারতে গেলেই আবেশের নাম দেখে থমকায়। তড়িঘড়ি করে ফোন ধরতেই ওইপাশ থেকে আবেশ বলে উঠে,
‘ আমাদের বাসায় আসুন।আপাকে পেয়েছি।’
এই কথাটুকু যেন শীতলতার বর্ষণ করালো মাহমুদের মনে। আবেশকে পাল্টা প্রশ্ন না করেই গাড়ির চাবি হাতে দ্রুত ছুটে গেলো সে।
_____________
ঘরময় নিস্তব্ধতা।উত্তরের জানালা দিয়ে শিরশিরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে ঘরের মাঝে। ঘরের প্রত্যেক কোনাচেতে শুষ্ক মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার দৃষ্টি বিছানায় শুয়ে থাকা,অগোছালো মেয়েটির দিকে। চিৎকার করে কাঁদছে সে। তার চিৎকার চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে বারেবারে ফিরে আসছে।
নাবিহাকে আবেশ আর মোহসীন পাহাড়ি এলাকায় পেয়েছে। নিজের জীবন শেষ করার মতো সাহসীকতা সে আজ দেখিয়েছে। নাবিহা কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
‘ আমাকে কেন নিয়ে এলি আবেশ। আমি থাকতে চাই না। আমি থাকতে চাই না মাহমুদের কাছে। ওর জন্য অভিশপ্ত আমি।’
সবাই নির্বাক।নাহিবা হেঁচকি তুলে বলল,
‘ প্রতিদিন আমাকে ফেস করতে হয়। আমি বাড়ির বাইরে পা দিতে পারি না।সন্তান কেন নেই আমার,কেন! মা’য়ের ধারণা আমি তার ছেলেকে বঞ্চিত করছি।আমার বেঁচে থাকার অধিকার নেই..’
কথার মাঝেই মাহমুদ এসেই চড় বসিয়ে দিলো নাবিহার গালে।ফয়েজের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো মাহমুদের কাজে। কিছু বলতে গেলেই আবেশ থামিয়ে বলল,
‘ থামো ভাই।সামলাতে দেও।’
ফয়েজ থেমে গেলো।নজরুল আর মাহফুজা নির্বাকচিত্তে বেরিয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে রইলো আবেশ,মাধুর্য,ইরা,আর ফয়েজ।
মাহমুদের থাপ্পড়ে নাবিহা লুটিয়ে পড়লো মাহমুদের বুকে। মাহমুদ নিজে তাকে আঁকড়ে ধরে বলল,
‘ তোমাকে আমি ছেড়ে দিয়েছি?’
‘ না।’
‘ তবে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবলে কী করে নাবিহা ! আমি তোমার কাছে সন্তান চাই না। দিনের পর দিন আমাকে তুমি বুঝাতে চেষ্টা করেছো,সন্তান ছাড়া আমি তোমাকে ভালোবাসছি না। আমার ভালোবাসাকে তুমি অপমান করেছো নাবু।’ মাহমুদের কন্ঠে কষ্টের রেশ। নাবিহা মাথা তুলে বলল,
‘ আমি ভেবেছি,আমি চলে গেলি তোমার জীবনে শান্তি ফিরবে।’
‘ আমার তোমাকে চাই। এই সমাজ নয়,না কলুষিত মনের কাওকে।’
নাবিহা তার মাথা মাহমুদের বুকে এলিয়ে দিতেই মাধুর্য এগিয়ে গেলো। নাবিহার পাশে পড়ে থাকা হাতটা তার হাতে নিয়ে বলল,
‘ দিনশেষে বাহিরের মানুষের কথা ভুলে যাও আপা।অনেক ‘মা’ ‘বাবা’ সন্তান পেয়েও তাদের মূল্য দেয় না। তুমি যেমন একজন নতুন প্রাণের জন্য কাঁদছো তেমনি,অনেক বাচ্চা আছে মা-বাবাকে না পাওয়ার জন্য কাঁদে। তাদের একজন না হয় তোমাদের জন্য খুশি নিয়ে আসুক।’
মাধুর্যের কথায় কান্না থামিয়ে দিলো নাবিহা। সে এইভাবে ভেবে দেখে নি। শুধু কিছু বাইরের মানুষের কথা শুনেছে। নাবিহা থামতেই ফয়েজ আর ইরা সপ্তপর্ণে বেরিয়ে যায়। আবেশ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
‘ মাধুর্য আমার সাথে এসো টায়ার্ড লাগছে খুব।’
‘ আপার কাছে আরেকটু থাকি।’ মাধুর্য রিনরিনে গলায় বলল। আবেশ রক্তবর্ণ চোখে তাকাতেই মাধুর্য কোনো কথা না বলেই বেরিয়ে যায় সাথে আবেশ।
আবেশ বেরুতেই মাধুর্য দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আপাকে বুঝানোর উচিৎ ছিলো আমাদের।’
‘ মাহমুদ ভাইয়া আছেন।’ আবেশ ভ্রুকুটি করে বলল। মাধুর্যের কন্ঠে মন খারাপের রেশ টেনে বলল,
‘ আমাদেরও বুঝানো দরকার ছিলো। সবাই আপাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন এইজন্যই তো আপা রাতে কান্না করতো।’
আবেশ দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে যথাসম্ভব স্থির রেখে বলল,
‘ রুমে চলো।’
‘ আগে বলুন,কেন আমাকে থাকতে দিলেন না।’
মাধুর্যের কথা শোনে ক্লান্ত ভঙ্গিতেই আবেশ দুই আঙ্গুল কপালে ঘষে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে কোলে উঠিয়ে নিলো টেনে। মাধুর্য তার এহেন কাজে ভরকে গেলেও সামলে নিলো নিজেকে। অবাক চাহনীতে তাকাতেই আবেশ বিনম্র কন্ঠে বলল,
‘ এখন বুঝাবো সব ইন ডিটেলস।’
চলবে…
#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:২৯
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্যের হৃৎপিন্ডের গতি অত্যাশ্চর্য ভেবে বেড়ে চলেছে। কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,
‘ নামিয়ে দিন।’
‘ হুশ…।’ আবেশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল। তার চোখেমুখে রহস্যময় হাসি লুকায়িত।মাধুর্য তার শার্টের কলার মুচড়ে ধরে পিটপিট চোখে চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
‘ সবাই দেখে ফেলবে।’
‘ সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত।আর তোমার এতো না ভাবলেও চলবে।’
‘ আরে,আমাকে নিয়ে ব্যাপার। আমি না ভাবলে কে ভাববে!’ মাধুর্য রুক্ষভাষী হয়ে বলল। আবেশ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে রুমের দিকে এগিয়ে চলেছে।
তবে তাদের রুমের দিকে না গিয়ে ডান পাশের বড় বড় রুম গুলোর দিকে এগিয়ে গেলো। মাধুর্য আবারো অবাক হয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছেন! রুমে যাবো আমি।নামিয়ে দিন।’
‘ তোমাকে ছাদ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছি।’
আবেশের কথায় মাধুর্যের মাঝে পরিবর্তন হলো না। আবেশকে প্রশ্ন করে লাভ হবে না ভেবে চুপ করেই রইলো। আবেশ ডানপাশের কাচ ঘেরা রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে মাধুর্যকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
‘ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।’
‘ কোথায় যাচ্ছেন,আপনি !’
‘ অপেক্ষা করো।’ মাধুর্যের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জবাব দিয়ে আবেশ তালা খুলে ভেতরে চলে গেলো। সাথে সাথে হালকা ভেজিয়ে রাখলো দরজা। মাধুর্য বেশ অবাক হয়ে আছে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে এই রুম নিয়ে মাথা না ঘামালেও মাঝেমধ্যে রুমের ভেতর যাওয়ার ছোট একটা ইচ্ছা জাগ্রত হতোই। তবে সে ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়ার মতো কাজটা করার সময় হয়ে ওঠে নি তার। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে তবুও আবেশের বের হওয়ার নাম নেই দেখে কিছুটা ভয় আর অস্বস্তি লাগছে তার।
দরজায় হাত দিয়েও বারেবারে ফিরে যাচ্ছে। ভেতর থেকে সাড়াশব্দ ও পাওয়া যাচ্ছে না। মাধুর্য কাঁপা গলায় ডাক দিলো,
‘ আ..বে..শ। কোথায় আপনি !’
প্রত্যুত্তর এলো না। বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ ভেসে আসছে খোলা জানালা দিয়ে। রাতের গভীরতা বেড়েছে। মাধুর্য ভাবছে সে দরজা খুলবে কি’না !
সবকিছু ভেবেই ভয় নিয়ে দরজার হাতলে হাত রাখতেই দরজা খোলার শব্দ হয়। মাধুর্য ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে যেতেই আবেশ মৃদু হাসি মুখে টেনে বলল,
‘ অপেক্ষা করানোর জন্য,দুঃখিত।’
‘ এই রুমের ভেতরে কী আছে ?’ মাধুর্য বিলম্ব না করে প্রশ্ন করতেই আবেশ হেসে বলল,
‘ রুমের ভেতরে আরেকটা রুম আছে।’
‘ হেয়ালি করবেন না। আমি দেখেছি কাচ ঘেরা একটা রুম আছে ভেতরে। এমন কেন ?’
মাধুর্যের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হলো না আবেশ। সে ওইভাবেই ঠাই দাঁড়িয়ে আছে । কিছুক্ষণ বাদে মাধুর্যের হাত টেনে ধরে বলল,
‘ আমার সাম্রাজ্য চলো,আমার রাণী।’
মাধুর্য কিছু বলার পূর্বেই কাচ ঘেরা রুমের দরজা খুলে গেলো একাই।
রুমের দরজা খুলতেই মাধুর্য অবাক হয়ে গেলো। সম্পূর্ন কাচ ঘেরা ছোট একটা রুম। যার মাঝ বরাবর ছোট একটা বেড রাখা। তার পাশেই,বড় বড় দুটো বুক শেলফ। যাতে রাখা অজস্র ফাইল আর বই। পাশেই সাজানো গোছানো,টেবিল।
ঘরের মাঝে আর কিছু নেই। শুধু দুটো বড় বুক শেলফ ছাড়া। মাধুর্যের হাত ধরে আবেশ বলল,
‘ এটা হচ্ছে প্রশান্তি।যা তোমার আর আমার।’
‘ কিন্তু আপনার ওই রুম বেশি সাজানো গোছানো।’ মাধুর্য চারদিকে চোখ বুলিয়ে বলল। আবেশ হেসে বলল,
‘ এখন থেকে এই রুম তুমি সাজিয়ে রাখবে।’
মাধুর্য চারদিকে চোখ বুলাচ্ছে। আবেশ নির্বিঘ্নে মাধুর্যকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
___________
আকাশে তুলোরাশি গুচ্ছ ভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। নীল জুড়ে সাদার মেলা। তিরতির করে বাতাস বইছে। রোদের সূক্ষ্ম একফালি রশ্মি কুয়াশা ভেদ করে দোল খেলছে বারান্দায়।কেটে গেছে তিনমাস। মাধুর্য টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে আছে। ফজরের পরে নামাজ পড়ে পড়তে বসেছিলো সে। এর মাঝে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে টের পায় নি।
আবেশ প্রতিদিন নিয়ম করে হাটতে বের হয়। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। মাধুর্যের ঘুম ভাঙ্গলো খানিক বাদেই। ঘড়িতে সময় দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে।
বেশ সময় পর ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে বাসায় ঢুকতেই বিরিয়ানির ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো। সিড়ি দিয়ে উঠেও দু পা পিছিয়ে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে মুখে চওড়া হাসি ফুঁটে উঠলো তার।
আস্তেধীরে রান্নাঘরের দরজার সামনে হাতে হাত গুজে দাঁড়ালো সে ।মাধুর্য তখন ব্যস্ত চুলোর পাশে। দ্রুত কাজ করছে সে। কোমড়ে আঁচল গুজে রেখেছে নিবিড় ভাবে। আবেশ দরজায় টোকা দিতেই মাধুর্য থমকে দাঁড়ালো।
তার হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা শীতল হয়ে উঠলো। সবাই বারবার বারণ করা সত্বেও সে রান্নাঘরে এসেছে। আর মাস দুয়েক পরেই এডমিশন। এই জন্যই কড়া ভাবে পড়াশোনার জন্য জোর করা হচ্ছে তাকে। নাজিফা থেকে লতা বেগম সবাই।
লতা বেগম বেশ স্বাভাবিক হয়েছেন। রাব্বীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়েছে মার্চে। এখন চলছে,ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ২০১৩ সালের আর দুটো সপ্তাহ বাকি।
আবেশ মাধুর্যের কম্পন দেখে আবারো মুচকি হাসলো। তবে গলায় গাম্ভীর্যপূর্ণ রেশ টেনে বলল,
‘ রান্নাঘরে কী দরকার তোমার !’
‘ দ..দেখুন,সারাদিন পড়তে কার ভালো লাগে? রোবট ও এতো পড়াশোনা করে না যতোটা আপনি আমাকে দিয়ে করান।’ মাধুর্য শুকনো ঢোক গিলে বলল। আবেশ ঠাই দাঁড়িয়ে বলল,
‘ রোবটের সব টেকনোলজি আগে থেকেই সেট করা থাকে,তোমার ও কি তাই ? একটু আগের পড়াই তো মনে রাখতে পারো না।’
‘ অবশ্যই পারি।আপনার জন্য ভয়ে সব ভুলে যাই।’ মাধুর্য কাল বিলম্ব না করে জবাব দিলো। আবেশের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো। তবে মুখে এক চিলতে হাসি।
সে সটান দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো মাধুর্যের কাছে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলে দিয়ে বলল,
‘ তোমার সব সময় আছে,ঘরের মানুষের জন্য সময় বের করার সময় হয় না,তাই না ?’
‘ ঘরের সবার জন্য তো আমি সময় বের করি’ই। নাজিফার সাথে সকালে কোচিং এ যাই। দুপুরে আম্মু’মায়ের সাথে টুকটাক কাজ করি। বিকেলে সবাই মিলে আড্ডা দেই। ইরা ভাবীর কাছে পড়ার জন্য ও যাই। আন্টির সাথেও রাতে ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ সময় পার করি।’ মাধুর্য বিরিয়ানি দমে ফেলে একনাগাড়ে বলল ।
আবেশ তার পাশে দাঁড়িয়ে কিছুটা ঝুঁকে মাধুর্যের কানের কাছে গিয়ে বলল,
‘ আর কেউ নেই তোমার ঘরে?’
‘ আর কে থাকবে !’ মাধুর্য নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল। আবেশ মাধুর্যের কোমড়ে থাকা প্যাচ খুলে দিলো টান দিয়ে। সাথে সাথেই মাধুর্য কেঁপে উঠলো।
লাফিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো আবেশের দিকে। অবাক হয়ে বলল,’এমন করছেন কেন।’
‘ ঘরের মানুষ চোখে পড়েছে?’
মাধুর্য বুঝে চোখ দ্রুত নীচে নামিয়ে মুচকি হাসলো। আবেশ তাকে টেনে নিয়ে বলল,
‘ সব সময় ঘরের মানুষের কথা আগে ভাববে,বুঝলে? যদি না ভাবো তোমাকে খেয়ে ফেলবো।’
‘ দূ…রে যান তো। রান্না করতে দিন।’
‘ আগে দেখি আমার বউকে।’
আবেশের কথায় লজ্জায় বিমূর্ত ধারণ করলো মাধুর্য। আবেশ লজ্জারাঙা মাধুর্যকে দেখে আবেশে অধর ছুঁয়ালো তার কপালে।
মাধুর্য লজ্জায় চোখ বোজে ফেলতেই আবেশ আবারো ঠোঁট ছুঁয়াতেই দোতলা সিড়ির ঘর থেকে কেউ তীব্র চিৎকার করে উঠলো। মাধুর্য চমকে উঠলো। আবেশ সাথে সাথেই অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ কে চিৎকার করছে!’
‘ জা..জা জানি না।’ মাধুর্য উপরের দিকে তাকিয়ে বলল। বাড়ির সবাই ইতিমধ্যে উঠে গেছে। হই হট্টোগোল লেগে যেতেই,নাজিফা ছুটে আসে উপর থেকে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
‘ লতা আন্টি কোথায় ! সিড়ি ঘর থেকে উনার চিৎকার ভেসে এলো।’
সবাই ছুটে গেলো সেদিকে।গোঙ্গানোর আওয়াজ ভেসে আসছে সে দিক থেকে।
চলবে…