#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৪
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
বিবর্ণ প্রত্যেকটা যন্ত্রণাময় প্রহর। ব্যথাতুর হাত নিয়ে কিছু করা যেন দায় হয়ে যাচ্ছে মাধুর্যের জন্য। এখানে তার প্রত্যেকটা প্রহর যে লড়তে হবে সে বেশ বুঝতে পারছে। তার ব্যথাতুর আর্তনাদেও কেউ সাহায্যের হাত বাড়ায় নি। সবাই একদফা হেসে আর ওই মেয়েটাকে উৎসাহ দিয়ে যে যার মতো কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে ।
আর সে! হাতে আর কোমড়ের ব্যথা নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছে। মাধুর্যের কান্না পাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। বাসার সবার কথা মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। সামনে থাকা দুইটা বেডের অচেনা মেয়েগুলোর চাহনী দেখে নিজেকে দমিয়ে রেখেছে সে।
লাগেজ থেকে একে একে সব বের করে হাতে পরিষ্কার করে নিলো সে।
সবকিছু গুছিয়ে বেডে বসতেই মোবাইলের আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে তার। জ্বলজ্বল করা স্ক্রিনে আবেশের নামটা ভেসে উঠতেই চোখ মুছে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুঁটিয়ে মোবাইল তুলে নিলো সে । ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে ভেসে এলো,
‘ ঠিক আছো তুমি ?’
আবেশের এহেন প্রশ্নে কী জবাব দিবে খুজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো মাধুর্যের। মিথ্যা বলবে না সত্যিটা বলবে সেটা নিয়ে দোটানা কাটিয়ে উঠার পূর্বেই আবেশ আবারো বলল,
‘ কথা বলছো না কেনো !’
মাধুর্য রিনরিনে কন্ঠে উত্তর দিলো, ‘ ভালো আছি।’
‘ মিথ্যা বলছো কেনো ?’
আবেশের প্রশ্নের মুখে চোরের ন্যায় মুখ করে বসে রইলো সে। লোকটা কী করে বুঝলো সে মিথ্যা বলছে?
মাধুর্য চুপ করে আছে। আবেশকে তার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,আমাকে নিয়ে যাবেন প্লিজ। নিঃশব্দ প্রত্যেকটা শব্দ আওড়াতে ইচ্ছা হলেও ভাবশূন্য হয়ে বসে রইলো সে। আবেশ নম্র কন্ঠে বলল,
‘ মন খারাপ ?’
‘ কিছুটা।’
‘ হাতে বেশি ব্যথা পেয়েছো?’
আবেশের উক্ত প্রশ্ন শুনে মাধুর্য আকাশ থেকে পড়লো যেন। উৎকন্ঠা নিয়ে বসে রইলো সে। আবেশ কি করে জানলো এই কথা?
প্রশ্নটা করার পূর্বেই আবেশ জবাব দিলো,
‘ তোমাদের হোস্টেল সুপার বিষয়টা দেখেই আমাকে ইনফর্ম করেছেন। আর ওই মেয়েটাকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টাও দেখছেন। তোমাকে আমি রেখে এসেছি ভেবো না দায়িত্ব ত্যাগ করেছি। তোমার ছোট ছোট জিনিস,প্রয়োজন,ব্যথা প্রত্যেকটা বিষয়ের প্রতি আমার নজর আছে এবং থাকবে।’
আবেশের বলা কথায় মাধুর্য ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আবেশ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকারছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে মাধুর্যের ক্রন্দনরত মুখশ্রী কল্পনা করতেই শিউরে উঠলো । হৃদয়ের গভীরতম স্থান থেকে নিঃসৃত হলো বেদনার রক্তপ্রবাহ। তার মাধবীলতা ভালো নেই ভাবতেই সূক্ষ্ম বেদনার রেশ হানা দিলো তার সর্বাঙ্গ জুড়ে।
তার রাজ্যে আজ দুঃখের আনাগোনা,কারণটা যে সাম্রাজ্যের রাণী।
আবেশ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে শীতল কন্ঠে বলল,
‘ তোমার লাগেজের লাস্টের চেইন খুলে দেখো কিছু মেডিসিন রাখা আছে।’
‘ মেডিসিন দিতে হবে না। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ কথা বাড়িয়ো না। আমার রাগ সম্পর্কে তোমার ধারণা নিশ্চয়’ই আছে মাধবীলতা।’
আবেশের ধমকের সুর মাধুর্য উপলব্ধি করতে পারলো খুব করে। বিনাবাক্য চেইন খুলে তার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো পেলো। সেই সাথে মান্থলীর যে সমস্ত উপকরণ আর মেডিসিন প্রয়োজন সে সমস্ত কিছু দেখে মাধুর্যের সমস্ত ব্যথা যেন নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে এলো।
আবেশ ইতিমধ্যে ফোন কেটে দিয়েছে। মাধুর্য বুঝতে পেরে হাসলো। এতোক্ষণ,এতোটা সময় পর তার শান্তি অনুভব হচ্ছে।
সে কাছে নেই তবুও দূরেও যে নেই।
________________
শীতের প্রকোপ শহুরে জীবনে খুব একটা বিচার করতে পারে না সেটা মাধুর্য এই দু’দিনে বুঝতে পারছে। তবে এই ভিন্ন পরিবেশের মানুষ গুলোও ভিন্ন। ক্লাস শুরু হবে কাল। আশেপাশের কতো মেয়ে তবুও যেন কেউ নেই। মাধুর্য পড়ার টেবিলে বসে সামনের বেডের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে।
মেয়েটার চেহারায় চেনা মানুষের কিছুটা ছাপ পাচ্ছে মাধুর্য । সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে যা মেয়েটার মুখে বিরক্তির আভা ফুঁটিয়ে তুলছে খনেখনে। মাধুর্য সে দিকে তোয়াক্কা না করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
মেয়েটা তার দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বইয়ে মনোযোগী হতেই মাধুর্য তার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ তুমি কি ফার্স্ট ইয়ার? জানো আমিও ফার্স্ট ইয়ার।’
মেয়েটার বিরক্তি সূচক চাহনী নমনীয় হলো মাধুর্যের কন্ঠের মিষ্টতায়। মাধুর্যের দিকে মুখে তুলে তাকিয়ে খানিক হাসির রেখা টেনে বলল,
‘ এই রুমের সবাই ফার্স্ট ইয়ার। যাইহোক দাঁড়িয়ে কেন! বসো এখানে।’
মাধুর্য অনুমতি পেয়েই বসে পড়লো। মেয়েটার মুখের দিকে না তাকিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে মুখের আদল চেনার খুব চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ সে। নির্বিকার ভাবে বসে রইলো। মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ মাধুর্যকে পর্যবেক্ষণ করে সুমিষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ নাম কী তোমার? ‘
মাধুর্য নীচুস্বরে বলল, ‘ মাধুর্য।তোমার নাম কি আপু।’
মেয়েটা স্বশব্দে হাসল। হাসতে হাসতেই বলল,
‘ আমার নাম প্রভাতি। আমাকে তুই করেই বলতে পারিস।এইবার দেখি তো হাত কতোখানি ইঞ্জুর হয়েছে।’
বলেই সে মাধুর্যের হাত টেনে নিয়ে আফসোসের শিষ তুললো। কন্ঠে রাগ এনে বলল,
‘ ওই হারামি টা এমন বেয়াদবি সব সময় করে। ইশ! কতোখানি কেটেছে।’
‘ ঠিক হয়ে যাবে মেডিসিন লাগিয়েছি আমি।’
‘ তুই চুপ। এইবার থেকে আমি বুঝবো।’
বলেই প্রভাতী হন্তদন্ত হয়ে উঠলো। যে মেয়েটার চোখেমুখে একটু আগেও বিরক্তি ছিলো কিছু মুহূর্ত পরেই ভালোবাসা দেখতে পাবে মোটেও ভাবে নি মাধুর্য।
এই শহরের মানুষ গুলা আদেও খারাপ না। এই বাক্যটা উচ্চারণ করেও করলো না মাধুর্য।
______________
এহসান বাড়ি সদরে আজও কুয়াশার পসরা বসেছে। ডাইনিং টেবিলের টুংটাং আওয়াজ হলেও সবাই চুপচাপ খাবার খাচ্ছে। শীতের দাপট সারা সিলেট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে । নজরুল সাহেব সবার মুখের দিকে তাকিয়ে উঠে যেতে যেতে বলল,
‘ মাধুর্য পড়তে গিয়েছে মারা যায় নি।’
উক্ত কথাটা কেমন কটূক্তিময় শোনালো সবার নিকট। মাহফুজা রাগান্বিত হয়ে বলল,
‘ এইটা কেমন কথা।’
‘ মেয়েটাকে উৎসাহ দেওয়ার বদলে তোমরা আরো ভেঙ্গে দিচ্ছো। আচ্ছা শোনো,সে যদি জানতে পারে তোমরা তাকে ছাড়া ভালো নেই । এইটা শোনার পর পড়ায় মনোযোগ দিতে পারবে সে ? তাই নিজেরাও হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো মাধুর্যকেও রাখো।’
বলেই নজরুল সাহেব চলে গেলেন। ইদানীং তার ব্যবহার কেমন অচেনা লাগছে সবার নিকট। আবেশ কিছুক্ষণ পর বলল,
‘ বাবা কিন্তু সঠিক কথাই বলেছেন। নাজিফা তুই ও আর মাধুর্যের কাছে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করবি না। মাথায় থাকে যেন ।’
________________
মার্চের শুরুর দিকে গরম আর কিছুটা শীতল পরিবেশ উপভোগ্য। সিলেট ছেড়ে আসার দেড় মাস যেন দেড় বছরের সমান মাধুর্যের কাছে। প্রতিনিয়ত ক্লাস আর ব্যস্ততা দিনে থাকলেও রাতে বেশ শূন্যতা অনুভব হয় তার।
প্রভাতীর সাথে সম্পর্কটা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে । মেয়েটাকে ভালো না বেশি ভালো বলা চলে। মাধুর্যকে নিজের বোনের মতো আগলে রাখে। ওই প্রথম দিনের ঘটনার পর কোনো ধরণের সমস্যায় পড়তে হয় নি তাকে আর।
তবে ইদানীং সিলেট যাবার জন্য আর আবেশকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে তার মন।
প্রভাতী তখনো বাইরে। হয়তো কোনো ইম্পোর্ট্যান্ট নোটস আনতে গিয়েছে।
পাশের বেডের মেয়েটা শিফট হয়েছে অন্য রুমে। ফাঁকা রুমে বেশ ভয়’ই লাগছে মাধুর্যের। পড়ায় মনোযোগ দিতে চাইলেও পারছে না। তারউপর সকাল থেকে জ্বর জ্বর লাগছে তার।
টেবিল ছেড়ে উঠে আবেশকে ফোন দিলো সে। আবেশকে বারবার ফোন দিয়ে না পেয়ে নাজিফাকেও ফোন দিলো সে।
নাজিফাও ফোনা না উঠালে মাধুর্যের ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। বাসার সবাইকে ফোন দিয়েও এক অবস্থা দেখে ভয়ে আরো শিউরে উঠলো সে।
চলবে……..
#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৫
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্য ভয়ে শিথিল হয়ে আছে। দম বদ্ধকর পরিবেশ যেন তার চারিপাশে নিঃশ্বাস আটকে আটকে আসছে। ভুবনে তখন সন্ধ্যার কাঁলচে আঁধার ছেয়েছে। প্রভাতী রুমে এসে মাধুর্যকে মেঝেতে বসে থাকতে দেখে ভড়কে গেলো।
দ্রুতগতিতে ছুঁটে এলো তার দিকে। অস্থির কন্ঠে বারংবার প্রশ্ন করলো, ‘ কী হয়েছে!’
মাধুর্য ঘন ঘন শ্বাস টেনে মোবাইলের দিকে দেখানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। তার সর্ব শরীর যেন অসাড় হয়ে আসছে। নানা ধরণের জল্পনাকল্পনায় গ্রাস করে আছে তার মস্তিষ্ক ।
সে ধরেই নিয়েছে বাসার কারো বড় ধরণের কিছু একটা হয়েছে। যার ফলাফল হিসেবে কেউ ফোন তুলছে না। প্রভাতী বুঝতে পারলো মাধুর্য হয়তো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত যার দরুণ প্যানিক হয়ে গিয়েছে। সে মাধুর্যকে বলল লম্বা লম্বা শ্বাস গ্রহণ করতে। মাধুর্য নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে সোজা হয়ে উঠে বসে প্রভাতীর হাত ধরে বলল,
‘ বাসার কেউ ফোন তুলছে না প্রভা। আমার যে বড্ড ভয় হচ্ছে।’
প্রভাতী আশ্বস্ত করে বলল,
‘ হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত। তুই আবার ফোন দে।’
মাধুর্য তটস্থ হয়ে বসে রইলো। মোবাইল কাছে নিয়ে আবেশকে ফোন করতে গেলে খুদেবার্তা নজরে পড়লো। যা এসেছে ইরার নিকট থেকে। সেখানে দুই লাইনের বার্তায় লেখা হয়েছে,
‘ মাধুর্য, নিজেকে সামলিয়ো ভেঙ্গে পড়বা না।তোমার মা মানে লতা আন্টি ইন্তেকাল করেছেন। আবেশের ফোন বাসায় ফেলে রেখেছে সাথে বাকি সবার। তাড়াহুড়োর মাঝে কী থেকে কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। আবেশ ঢাকা যাচ্ছে। নিজের মনোবল ভাঙ্গতে দিয়ো না।’
বার্তা টুকু মাধুর্যের ভেতর থেকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা নিয়ে যেন লেখা হয়েছে। নির্বাক হয়ে বসে আছে সে। লতা বেগমের মলিন মুখশ্রী ভেসে উঠলো তার নয়নে। রাব্বীর বলা সেই কথা বারবার ভেসে আসতে লাগলো,’ আমার মা’কে দেখে রাখিস।’
_________________
শুষ্ক প্রকৃতি। দূর আকাশ গাম্ভীর্যপূর্ণ আবহাওয়ার রেশ। কোথাও বিন্দুমাত্র মেঘের আনাগোনা নেই। বাতাসটাও যেন ভারী। মাধুর্যের যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেকে আবেশের কোলে মাথা রাখা অবস্থায় আবিষ্কার করলো। আবেশ গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে আধবোজা চোখে বসে আছে। আর ডান হাতে মাধুর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
আবেশ তখন নিজ চেতনায় বিভোর ছিলো। লতা বেগমের মৃত্যুর সংবাদটা সে যখন পেলো তখন সবেমাত্র সে অফিস থেকে ফিরেছে। লতা বেগমের পাশের বাসা থেকে খবর টা দেওয়া হয়েছিলো তাদের। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটার মৃত্যুর রহস্য উৎঘাটন হবার আগেই দাফনকাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। সিলেট থেকে ঢাকা আসার পথটুকুর মাঝেই সব কাজ যে সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে সেই বার্তাটা নাজিফা আবেশকে দিয়েছে।
আবেশে খবরটা পেয়ে দ্রুত ড্রাইভ করে মাধুর্যের হলে এসে স্পেশাল পার্মিশন নিতে গিয়েই আঁচ করে মাধুর্য অসুস্থ হয়ে জ্ঞানশূন্য অবস্থায় অডিটোরিয়ামের এককোণে অচেনা এক মেয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
আবেশের আর বুঝতে বাকি নেই কি অবস্থা গিয়েছে মাধুর্যের উপর দিয়ে। এইজন্যই সে বারংবার বারণ করেছিলো কোনো প্রকার সংবাদ যেন মাধুর্যের নিকটা না পৌছায়।
‘ মা’কী সত্যিই নেই আবেশ।’ মাধুর্যের কন্ঠে ব্যাকুলতা। সেই কন্ঠ যেন আবেশের পুরুষ হৃদয়ে তোলপাড় তুলতে বাধ্য।
আবেশ জবাব না দিয়ে মাধুর্যের মাথাটা নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘ প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এই আয়াতটুকু মানো তো মাধবীলতা ?’
আবেশের প্রশ্ন শুনে ক্রন্দনরত অবস্থায় মাধুর্য মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিতেই আবেশ আবার বলল,
‘ সেই হিসেবে লতা আন্টির সময় শেষ হয়ে এসেছে। তাকে যে তার নীড়ে ফিরতে হতোই। সেটা আজ হোক বা কাল। আমি তুমি সবাই আমাদের নিজস্ব নীড়ে ফিরে যাব বেলা শেষে। লতা আন্টির বেলা শেষ মাধু।’
‘ রাব্বী ভাইয়ার কথা…টা আবেশ। আমি রাখতে পারলাম না যে।’
‘ সে খুশি হয়েছে। সে উপলব্ধি করেছে,তার মায়ের শান্তির দরকার। তাই মৃত্যুর মাধ্যমেই তার মা শান্তি বেছে নিয়েছে।’
‘ রাব্বী ভাই এইটা বলেছেন?’
‘ হ্যাঁ , তাকে জামিন দিয়েছিলো আদালত। আন্টির জানাজা পড়ে আবার জেলে নেওয়া হয়েছে তাকে।’
মাধুর্য আবারো অস্থির হয়ে উঠলো। আবেশ তার অস্থিরতা বুঝতে পেরে মাধুর্যের কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে আদরমাখা গলায় বলল,
‘ আত্মার মাগফেরাত কামনা করো মাধুর্য। মৃত্যুর পর দুনিয়ার হাওয়া বাতাস তার জন্য আজাব। তাই কবরস্থ দ্রুত করাটাই শ্রেয় তাই নয় কী ? ‘
মাধুর্য আবেশের বুকে মুখ লুকিয়ে খুব করে কাঁদলো। লতা বেগম তার সাথে অন্যায় করলেও দিনশেষে একটু হলেও ভালোবাসা বিলিয়ে দিতো। মায়ের মতো আরেকটা মা হারালো সে আবার।
তার সাথেই কেন এমনটা হয়! এর উত্তর মিলবে কবে।
___________________
ধরণীতে তখন নিশুতি। চারদিকে সর্বকালের কালো আঁধার গ্রাস করে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই আছে শুধু নীরবতা। দূরের রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের টিমটিম হলদেটে আলো আঁধার ঘুচানোর সর্বোপরি চেষ্টায় মত্ত্ব।
নজরুল সাহেবের প্রতিটা পদক্ষেপ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে সে। তবুও জুতার সাথে মেঝের ঘর্ষণের আওয়াজটা বিকট।
তিনি ডান হাত দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে বাসার বাইরে বেরিয়ে এলেন। একবার পেছনে ফিরে তার বিশাল সাম্রাজ্য টা দেখে তৃপ্তির হাসি আঁটলেন মুখে। ঘোলাটে আলোয় বাসার নেমপ্লেটের চোখ বুলিয়ে মুখে চওড়া হাসি টেনে বারদুয়েক উচ্চারণ করলেন,
‘ এহসান মঞ্জিল,নজরুল এহসান,রোড নং…’
তার বাড়ি এইটা। তার স্বপ্নের সাম্রাজ্য। আজ সব উচ্ছেদ করে দিয়ে এসেছে সে। আর একজন বাকি তার পাপের হিসেবের খাতার একটা পৃষ্ঠা।
আর সেটা হচ্ছে রাব্বী । এরপর সকল পাপের হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে দিবে সে। ভাবতেই কেমন আনন্দের ঢেউ খেলে যাচ্ছে তার মন গহীনে।
সম্পত্তি পাওয়ার আশায় কতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো সে নিজেও জানে না। শুধু তার মনে হচ্ছে,সে যা করেছিলো এইটার মাঝেই সুখ নিহিত।
মাধুর্যের মায়ের থেকে সম্পত্তি নেওয়া এরপরে মাধুর্যের বাবাকে ভুল বুঝানো,রাব্বীকে বিপথে ঠেলে দেওয়া,মাধুর্যকে বিনা অপরাধে বহুদিন নরকীয় যন্ত্রণা দেওয়া সবকিছুই যেন তার কাছে নিছক একটা কাজ মনে হয়।
তার কোনো অনুশোচনা হয় না। তবে ভয় হয়। বড্ড ভয় হয়। সবকিছু আবেশ, ফয়েজ,নাজিফা,নাবিহা জানলে তাকে ভুল বুঝে ফেলে রেখে গেলে কী হবে!
এইজন্য সে সব প্রমাণ শেষ করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে আছে।
আর কিছুদিন এরপরেই তো সব সুন্দর মসৃণ হবে। ভাবতেই নজরুল সাহেব খুশিতে টগবগিয়ে উঠলেন।
গেট খুলে সামনে এগিয়ে গেলো সে।
‘ তুমি খাবার নিয়ে অবহেলা কেন করো? ‘
আবেশের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো মাধুর্য। কাল রাতে সিলেট এসে পৌছিয়েছে তারা। অত্যাধিক ক্লান্তির জন্য মাধুর্য কখন এসেছে বলতে পারবে না। মন বিষিয়ে আছে তার। শতহোক মানুষের স্মৃতি এতো সহজে ত্যাগ করা মুশকিল।
আবেশ খাবারের প্লেট নিয়ে মাধুর্যের সামনে বসে আবার বলল,
‘ মাধবীলতা।’
‘ হ্যাঁ….হ্যাঁ বলো।’
‘ হলে খাবার খাও না কেন।’
মাধুর্য উত্তর দিলো না। তার কান্না পাচ্ছে। তার মায়ের কথা মনে হচ্ছে। সেই সাথে লতা বেগমের মায়াময় মলিন মুখ।
আবেশ সবেই খাবারের প্লেটটা পাশে নামিয়েছে। মাধুর্য ঝাঁপিয়ে পড়লো আবেশের বুকে। খাঁমচে ধরলো আবেশের পিঠের শার্ট। ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে ভেঙ্গে আসা গলায় উচ্চারণ করলো,
‘ আবেশ আমাকে মেরে ফেলুন নয়তো ঘুমের ঔষধ দিন আমি খেয়ে এই যন্ত্রণাময় পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে চাই।’
‘ মাধবীলতা তুমি তো নরম নও। স্ট্রোং ছিলে । এখন কেন এতো ভেঙ্গে পড়ছো।’
‘ আমি পারছি না আবেশ। আপনি ভাবুন আমার জীবনটা নরক ছিলো। যেই আবার একটু ভালোবাসা খুজতেছি এর মাঝেই আবার চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে। ‘
আবেশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাধুর্যের মাথায় উষ্ণ চুম্বন ছুঁইয়ে বিরস কন্ঠে বলল,
‘ আমার সাম্রাজ্যের রাণী তো ভেতর থেকে মলিন ছিলো না। তার সাম্রাজ্য ঘিরে বেঁচে থাকার লড়াই ছিলো একার। আজ তার সাম্রাজ্য আমি থাকতেও কেন তার বেদনা। তবে কী আমি ধরে নিবো আমার ভালোবাসা তোমাকে ভালো রাখতে বৃথা ? ‘
চলবে………….