#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৬
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
মাধুর্যের চেহারার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো না আবেশের উক্ত কথায়। সে চুপ করে বসে রইলো। খানিকবাদে আবেশের বুকে থেকে মাথা উঠিয়ে বলল,
‘ একটা কথা বিশ্বাস করবেন আবেশ? ‘
আবেশ মাথা কাত করে সম্মতি দিতেই মাধুর্য বলল,
‘ প্রভাতী ওকে আমার মায়ের মতো দেখতে লাগে কিছুটা। আপনি খেয়াল করেছেন? ‘
আবেশ কিছুটা সময় প্রভাতীর মুখ মনে করার তীব্র চেষ্টা করেও বৃথা হলো। মাধুর্য উত্তেজনা নিয়ে বলল,
‘ আমি প্রথম দিন থেকে ওর মুখের আদল মায়ের ছাপ পাই তবে ধরতে পারি নি। কারণ বহুকাল মা’কে দেখি না তবে কাল ওই মুহূর্তে মিল খুজে পেয়েছি।’
‘ তোমার ভুল ধারণা। হয়তো মিল আছে বাট ওইটা এমনি মিল। এইটা নিয়ে ভাবার কি আছে ! ‘
‘ ও যদি আম্মুর কেউ হয়? বা আম্মুর কোনো খোজ জানে?’
‘ এইটা কী করে সম্ভব মাধুর্য! আর মোটকথা কাল লতা আন্টির চলে যাবার শোক কাটাতে পারছো না বলেই এমন চিন্তা মাথায় আসছে।’
মাধুর্য চুপসে গেলো। আবারো উদাস হয়ে বসে রইলো। কোনোভাবে যদি তার মা আবার ফিরে আসতো, যদি কোনো ভাবে কালকের দিনটা গায়েব করে দেওয়া যেত, যদি কোনো ভাবে সব সুখের হতো।
অসম্ভব সব। চোখ তুলে আবেশের দিকে তাকিয়ে শ্লেষমিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল,
‘ আমি ঠিক আছি।’
আবেশ কিছুটা স্বস্তি পেলো মাধুর্যের উক্ত বাক্যে । মাধুর্যের হাতে নিজের হাত রেখে অম্লান কন্ঠে বলল,
‘ আমি সর্বক্ষণ,সর্বসময় তোমার জন্য আছি৷’
মাধুর্য হাসলো৷ তার চোখে দুঃখের পসরার হাতছানি থাকলেও অধরে শান্তির হাসি৷
______________
প্রফুল্লচিত্তে রৌদ্দুরের ঝলকানি কার্ণিশ বেয়ে খেলা করছে৷ মৃদু হাওয়ার তালে কম্পয়মান বৃক্ষের সবুজের আরণ্য। সুউচ্চ ডালে শালিক পাখির কিচকিচ আওয়াজে বিমোহিত হয়ে উঠেছে। খসখস আওয়াজ শুকনো পাতার। মাহমুদ ঘুরে তাকিয়ে বলল,
‘ দাঁড়িয়ে পরলে যে!’
নাবিহার মুখে বেদনার ছায়া আবার উদয়ন হচ্ছে। মাহমুদ হাত বাড়িয়ে ডাকলো আবারো। নাবিহা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে মাহমুদকে বলল,
‘ ভেবে দেখো।’
‘ আমার ভাবার আর কিছু নেই নাবিহা । যা ভাবার ভেবেই বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি।’
’ তাই বলে অন্যের সন্তান! মানতে পারবে তো মাহমুদ?’
নাবিহার উক্ত প্রশ্নে ক্ষিপ্র হয়ে উঠলো মাহমুদ। দুই কদম এগিয়ে এসে নাবিহার হাত কিছুটা শক্ত ভাবে ধরে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
‘ কি বলতে চাইছো তুমি!’
নাবিহা বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো নীরবে। কম্পিত কন্ঠে বলল,
‘ তুমি বিয়ে করো মাহমুদ। বা সারোগেসির মাধ্যমে তোমার সন্তান আনার ব্যবস্থা করো।’
‘ বারবার এক কথা কেন বলছো নাবিহা।’
‘ আমি সত্যি বলছি। যেটা একদম চির সত্যি। ওই এতিম বাচ্চাটাকে এনে সমাজ আর পরিবারের চাপের মুখে আমি রাখতে চাই না। তাকে এখন তুমি ভালোবাসলে কিছুদিন পর ফয়েজ,আবেশের বাবার মতো আমাকে যেমন দূরে সরিয়ে রাখতো অবহেলা করতো তুমিও যদি তেমনটা করো ! ওই বাচ্চাটা সহ্য করতে পারবে না মাহমুদ একদম পারবে না। বাবা-মায়ের অবহেলা সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে সবাই জন্মায় না আমার মতো।’
মাহমুদ নাবিহার হাত ছেড়ে দিয়ে চুলে আঙ্গুল চালালো কিছুক্ষণ। কালো রঙের পাঞ্জাবিটা টেনে ধরে শান্ত স্বরেই বলল,
‘ ভালোবাসা বলতে কি বুঝো নাবিহা ? সংসার, নিজের সন্তান এইগুলাই তো ?’
নাবিহা উত্তর দিলো না। মাহমুদ আবার বলল,
‘ আমি ভালোবাসি নাবিহা। ভালোবাসি তোমার প্রতিটা হাসি,প্রতিটা দুঃখ,প্রতিটা কষ্ট,প্রতিটা সুখ। তুমি যেভাবে খুশি থাকবে আমি সেই উপায় টাকে ভালোবাসি,বুঝলে? ‘
নাবিহা ঢুকরে কেঁদে উঠলো। এই লোকটার ভালোবাসা প্রকাশের ভঙ্গিমা বরাবর সবার থেকে ভিন্ন একদম ভিন্ন।
মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ তোমার বাবা-মায়ের সন্তান হচ্ছিলো না দেখে তোমাকে এডপ্ট করেছিলো। এর দুই বছর পর ফয়েজ হবার পর তোমার দায়িত্ব,তোমার সুখ,দুঃখের পরোয়া করে নি। তারা তাদের নিজস্ব, নিজের রক্ত নিয়ে ব্যস্ততার ভীরে তোমাকে ভুলে একা করে দিয়েছিলো । আর সমাজ তোমাকে দেখতো এতিম হিসেবে। তোমার প্রতিটা দুঃখের কথা আমি জানি নাবিহা। তোমার পরিবারের প্রতি তোমার ভেতরের ক্ষোভ টা আমি জানি। তোমার মতো আরেকটা মেয়ে আনবো নাবিহা। যার জীবনটা তোমার মতো দুর্বিষহ হবে না। হবে আমার ভালোবাসার মতো পবিত্র। যতোটা ভালোবাসলে তুমি সুখে থাকবে ঠিক ততোটা ভালোবাসবো। কারণ আমি তোমার সুখ,দুঃখ,কষ্ট সব মিলিয়ে তোমাকে ভালোবাসি।’
মাহমুদের ভোকাল কর্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখ লাল হয়ে আছে। নাবিহা বারংবার এই মানুষটার প্রতি অন্যায় করে। সে জানে মাহমুদের ভালোবাসার গভীরতা তবুও কেন ভালোবাসার প্রশ্ন তুলে।
নিজের প্রতি রাগ লাগলো। হাত দিয়ে চোখ মুছে মুখে হাসি টেনে বলল,
‘ ওইইই জামাইইইই… আমি না তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।’
মাহমুদ নাবিহার ডাক শুনে হেসে দিলো। টেনে নিলো নাবিহাকে তার বুক পিঞ্জরে। শান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ আমার রাজকুমারী কে ঘরে তুলতে হবে তো রাণী। আর দেরি করা যাবে না।’
নাবিহা সম্মতি দিলো। আজ তারা প্রত্যন্ত গ্রামের এক এতিমখানায় যাচ্ছে। যেখানে মা মরা এক মেয়ের খোজ দিয়েছেন মাহমুদের এক কলিগ। ছোট দুই বছরের মেয়েটার কেউ নেই। তারা’ই না-হয় তার সব হবে এবার।
মাধুর্যের হলে ফেরার দিন কাল। এই কয়েকটা দিন বাসার প্রতি মায়া একদম আলিঙ্গন করে ফেলেছে তাকে। লতা বেগমের মৃত্যু শোকটা কিছুটা লাঘব পেলেও অনুশোচনা আঁকড়ে ধরে মাঝেমধ্যেই। ইদানীং মাধুর্যের সাথে নাবিহার সম্পর্কটা অনেকখানি গভীরতায় ছেয়ে আছে। মাধুর্য রেডি হয়ে বসে আছে আবেশের অপেক্ষায়। নাবিহাদের বাসায় যাবে। কারণটা মেহরীন মানে নাবিহার মেয়ে।
মাধুর্যের প্রচন্ড খুশি খুশি লাগছে। ওই মেয়েটা মাহমুদ আর নাবিহার মতো বাবা-মা পাবে ভেবে।
অবশেষে নাবিহার বেদনা মুছবে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো।
এগিয়ে গেলো সিড়ির দিকে। কিছুটা দূর যাবার পরেই নজরুল সাহেবের মুখোমুখি হতেই মাধুর্য অগোছালো ভাবে বলল,
‘ বাবা নাবিহা আপুর বাসায় যাবেন না ?’
নজরুল সাহেব তার চিরচেনা হাসি দিয়ে বলল,
‘ না মা। তোমরা যাও।’
মাধুর্য নজরুল সাহেবের মুখের দিকে তাকালো। তাকে দেখলেই কেমন শ্রদ্ধা আসে। নজরুল সাহেব কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে ঢুকেই উচ্চ শব্দে দরজা আটকিয়ে দিতেই মাধুর্য কিছুটা ভড়কে যায়।
হুট করে কী হলো বুঝতে না পেরে দরজায় টোকা দিতে চেয়েও দেয় না। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে সামনে পাঁ বাড়ায়।
__________________
বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কন্যারা টুপটাপ ঝড়ে পড়ছে। গাছের ডগায় ডগায় শিশিরের মতো জমে ভারী বৃষ্টির ফোঁটার সাথে মাটির বুকে ঝাপাৎ ঝাপাৎ শব্দে নৃত্য করে চলেছে। তাদের যেন বিরাম নেই। ভিজে উঠা প্রকৃতিতে শীতলতার হাওয়া বহমান। কিছুটা ঠান্ডায় যেন জমে উঠাছে চারিপাশ। আজ মাধুর্যের চলে যাবার দিন হলেও বাহানা করে সে যায় নি।
আবেশ উক্ত বিষয় নিয়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়ে গিয়েছে অফিসে যাবার পূর্বে।
মাধুর্য খোলা বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছন্দ দেখছিলো।
মোবাইল হাতে নিয়ে আবেশের নাম্বারে ছোট একটা বার্তা প্রেরণ করে মুখে চাপা হাসি নিয়ে সামনে তাকিয়ে রইলো।
সাথে সাথেই টুংটাং আওয়াজ হলো মেসেজ বারে। সেখানে খুব সুন্দর ভাবে লেখা,
‘ নিজেকে সামলাতে পারে না সে আবার বাচ্চার মা হবে। বলি কি ! পড়ালেখাতে এইভাবে ফাঁকিবাজি চলবে না। ওয়েট করো আজ বাসায় আসি আমি। তোমার উদ্ভট চিন্তা একদম খোলা বারান্দা দিয়ে ছুড়ে মারবো।’
আবেশের হুমকিতে বড়সড় একটা শুকনো ঢোক গিলে চেয়ারে বসে পড়লো সে। ইদানীং আজব একটা স্বপ্নের জন্যই সে নির্লজ্জভাবে উল্টাপাল্টা বার্তা প্রেরণ করে লজ্জিত হয়ে মূর্তরূপ হয়ে আছে।
আবেশ বাসায় ফিরলে তার কী হবে ভাবতেই উচ্চশব্দে আওড়ালো,
‘ আমি হলে ফিরতে চাই।’
চলবে……
রি-চেক দেওয়া হয় নি।