ভেতরে বাহিরে পর্ব-৩৮

0
873

#ভেতরে_বাহিরে
পর্ব:৩৮
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি

মাধুর্য অসাড় দৃষ্টিতে ভাবশূন্যের ন্যায় কিয়ৎ মুহূর্ত আবেশের গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখমণ্ডলের দিকে পর্যবেক্ষণ কিছুটা জোরালো শব্দে হেঁসে উঠে বলল,’ফাজলামো করছো !’
আবেশের চোখমুখে তখনো গম্ভীর দ্বিরুক্তি বিদ্যমান। মাধুর্য নিজের মতো হেঁসে চলেছে। তার চোখের কোণে বিন্দুর ন্যায় অশ্রু একত্র হতে আরম্ভ হতেই আবেশের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,

‘ ফাজলামো করছো তাই না!’

‘ না।’

আবেশের উক্ত উত্তরে মাধুর্য থমকে গেলো। শিরদাঁড়া সোজা করে বসে বারদুয়েক শ্বাস টেনে নিলো নিজের ভেতর। অশ্রুসিক্ত চোখ তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করলো না। আবেশ মাধুর্যকে টেনে জড়িয়ে রাখলো নিজের বক্ষপিঞ্জরে। মাধুর্য গুটিসুটি মেরে মিইয়ে গেলো একদম। শুধু ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল,

‘ সত্যি বলছো তুমি ?’

‘ মিথ্যা বা ফাজলামো করার পরিস্থিতি এই সময় না সেটা খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি তুমি নিজেই করতে পারছো মাধুর্য।’

‘ আমি বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে আবেশ।’

‘ ভুল জানো তুমি।তোমার গোটা জীবনটাই ভুল মানুষ আর ভুলের আবরণ দিয়ে ভর্তি। যার বাহির স্পষ্ট তবে ভেতরে গেলেই হাজারো প্রশ্নের ছড়াছড়ি।’

‘ আমার যতোদূর মনে আছে আমি হবার পর তাদের …’

মাধুর্যের কথা শেষ হবার পূর্বেই আবেশ মাধুর্যের বাহু ধরে সোজা করে বসালো। মাধুর্যের নয়ন যুগলে তাকিয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব ধরে রেখেই বলল,

’ তোমার আমার জন্মের পূর্বে তোমার বোন এসেছে দুনিয়ায়।নাবিহা আপুকে নিশ্চয় তোমার জন্মের পর বড় দেখেছো।’

আবেশের কথায় মাধুর্য বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে অবতীর্ণ করলো যেন। উৎকন্ঠা সহিত কম্পয়মান কন্ঠে বলল,’ মা..নে..।’

‘ মানে নাবিহা আপু তোমার আপন বোন।’

‘ কি করে সম্ভব এইটা!’

‘ আম্মা আর আন্টি বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো সেটা আমরা সবাই জানি। তবে তাদের বন্ধুত্ব ছিলো বোনের থেকে বেশিকিছু। আম্মার যখন কোনো সন্তান হচ্ছিলো না আম্মা পাগলপ্রায় ছিলো। তখুনি নাবিহা আপু দুনিয়ায় আসে। তাকে নিজের মেয়ের মতো লালনপালন করা শুরু করে এবং আন্টি,আম্মু,সবাই এক বাসায় থাকতো। তখনি আম্মা সিদ্ধান্ত নেয় নাবিহা আপুকে এডপ্ট করবে। এইকথা আন্টিকে বললে আন্টি স্ব-ইচ্ছায় রাজি হয়ে যান। কারণ তোমাদের আর্থিক অবস্থা আর আন্টির পারিবারিক ঝামেলার জন্য। এই ব্যাপার টা আমরা কেউ জানি না এবং জানতাম না। গতকাল রাতে আম্মা আমাকে ডেকে এই গুলা বলে তোমাকে জানাতে বলেন।নাবিহা আপু জানেন না তার বাবা-মা কে। তাকে বলা হয়েছিলো কোনো এক গ্রামে থেকে তাকে আনা হয়েছে। আম্মা এখন অনুতপ্ত। কীভাবে সব জানাবে নাবিহা আপুকে। তাই সে চায় তুমি আপুকে বুঝাবে আর বড় বোনের মর্যাদা আরো গভীর ভাবে দিবে।’

মাধুর্য নির্বাক। ভাষাশূন্য প্রতিমার ন্যায় তাকিয়ে আছে। তার মনের কোণায় প্রভাতীর নামটা কিয়ৎ মুহূর্তের জন্য উঁকি দিয়েছে যা চরম সত্য। তবে নাবিহা আপু ! এইটা একবারো মনে হয় নি।
আবেশের দিকে তাকিয়ে মাধুর্য ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ আপনি জানেন ? আমি ভেবেছিলাম আমার মা জীবিত আছেন আর সে প্রভাতী আমার বোন।’

‘ প্রভাতির জন্মস্থান রাজশাহী। তার পিতামাতার জন্মলগ্নের সমস্ত তথ্য আমি সেদিন বের করেছি। তবে আফসোস প্রভাতি র সাথে তোমার কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। হয়তো তুমি তার ভালোবাসা পেয়ে তোমার মা’কে তার মধ্যে খুজে বেড়াচ্ছো।’

আবেশের যৌক্তিকতা শুনে মিইয়ে গেলো মাধুর্য। দীর্ঘশ্বাসে জর্জরিত হলো সে। নয়ন থেকে টুপটাপ ঝড়ে পড়লো অশ্রুজল। ধরণীর মাঝে সুখ পেয়েছে,দুঃখ পেয়েছে তবে আজ আবার নতুন ভাবে বাঁচার আকুতি নিজস্ব রক্তের টান খুজে পেয়েছে সে। এ যে সর্ব সুখ। তার বোন আছে,তার নিজের বোন।

__________________

ভোর পৌনে পাঁচটা। গোধূলি রাঙা প্রভাতের ঢের বাকি। পূর্ব আকাশে রঙ হলদে আর কমলা মিশ্রিত। ল্যাম্পপোস্ট নিভছে আর জ্বলে উঠছে।
প্রভাতের শীতল শিহরণ জাগানো হিমেল হাওয়া ছুটে চলেছে সিলেট নামক শহরের বুক জুড়ে।
চারতলা ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আবেশের হাত বেসামাল ভাবে ধরে মৃদু আর্তনাদ করে মাধুর্য বলল,

‘ গেইট কখন খুলবে।’

‘ এইদিয়ে বিশ বার উক্ত প্রশ্ন করে ফেলেছো।’

আবেশের ক্লান্তিজনিত কন্ঠ। ঘুমে জড়িয়ে আছে তার চোখ। মাধুর্যের জেদের কাছে হার মেনেই আবারো হাই স্পিডে ড্রাইভ করে সিলেট এসে পৌছিয়েছে তারা। গেটের দারোয়ান নেই। এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হবে আবেশ ভাবে নি।
মাধুর্য গেইটের তালা ধরে ঝাঁকিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল,

‘ মাহমুদ ভাইয়াকে ফোন দাও।’

‘ পাগল তুমি ! এই ভোররাতে ফোন দেওয়ার মতো বাজে কাজটা করতে পারবো না আমি। এইজন্যই বলেছিলাম সকালে আসি। তোমার হোস্টেল সুপার রুলস ব্রেক করার জন্য কী ধরণের কথা শোনাবে জানো,তুমি ?’

মাধুর্য অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,’ আর হবে না এমন।’

‘ আর হয়েই কি হবে যা হবার তো আজ হয়েই গিয়েছে।’ বিরবির করে বলল আবেশ। মাধুর্য ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেই আবেশের ব্লেজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মোবাইল বের করে নির্ভীক হাসলো। আবেশ রাগে কিছু বলার আগেই চোখ দিয়ে ক্ষমা চায়। আবেশ মাধুর্যের সরলতা দেখে চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসে।
মাধুর্য মাহমুদের নাম্বারে ডায়াল করে অপেক্ষা করলো। দুইবার রিং হতেই মাহমুদ ফোন উঠাতেই মাধুর্য হেয়ালি না করে অনুরোধ করে বলল,

‘ দুলাভাই নীচে এসে গেইট টা খুলে দিন,প্লিজ। আমি দাঁড়িয়ে আছি।’

ওইপাশের উত্তরের অপেক্ষা না করেই কেটে দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আবেশের হাতে মোবাইল দিয়ে বলল,

‘ নাবিহা আপু আমাকে মেনে নিবে তো আবেশ?’

মাধুর্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না আবেশ। সত্যিই তো নাবিহা আপু বিষয়টা কি ভাবে নিবে ?

নাবিহা নিস্তব্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। সম্পূর্ণ রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতার রেশ খেলা করছে। মেহরুনের আধোআধো সুর ভেসে আসছে বিছানা থেকে। আবেশ কাবার্ডের সাথে হেলে দাঁড়িয়ে ঘুম চোখে পর্যবেক্ষণ করছে সব।
মাহমুদ নিজেও নির্বাক। মাধুর্য মুখে হাত গুজে ক্রন্দনরত অবস্থাতেই হাঁটু মুড়ে বসে রইলো। নাবিহা কিঞ্চিৎ মুহূর্ত যেন অবাকতার রেশ কাটিয়ে উঠতে পেরেও পারছে না।
এতো বছর পর সে নিজের বাবা-মায়ের খোজ পেয়েও পেলো না । আবার তার সামনে তার আপন বোন দাঁড়িয়ে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এতোদিন যে মেয়েটার দুঃখ গুলো উপেক্ষা করে এসেছে সেই মেয়েটার সমস্ত দুঃখের ভাগীদার সে নিজেও।
মাধুর্যের সামনে বসে কিয়ৎক্ষণ তার কান্নার গতিবিধি লক্ষ্য করে আবেশের দিকে তাকালো নাবিহা। অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল,

‘ তোর বউকে বাসায় নিয়ে যা।’

আবেশের ঘুম মুহূর্তেই উবে গেলো। তীব্র মাথাব্যথা টনটন করে উঠলো। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,

‘ তুমি কিছু বলবে না ?’

নাবিহা উঠে দাঁড়ালো। মাহমুদের দিকে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো মায়াময় দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টির অর্থ মাহমুদ বুঝতে পারলো না। তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মেহরুনের দিকে খানিক সময় তাকিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে বিছানায় নীরব ভাবে বসে রইলো সে।
ক্রন্দনরত মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে সশব্দে হাসতেই মাধুর্য মুখ তুলে তাকাতেই নাবিহা বলল,

‘ ভালো আছিস তুই?’

মাধুর্য নাবিহার হুট করে করা প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায়। নাহিবা হাসছে। খুব করে হাসছে। রুমে উপস্থিত সমস্ত মানুষের চাহনী অবাকের রেশ ধরা পড়ছে।
নাবিহা মেহরুনকে তার খাবার দিয়ে মাহমুদকে বলল খাওয়াতে।
আবেশ গাম্ভীর্যতা ধরে রেখেই বলল,’ এমন উদ্ভট আচরণ কেন করছো আপু।’

নাবিহা উত্তর দিলো না। মাধুর্যের সামনে চুপ করে বসে রইলো। ডান হাত বাড়িয়ে তার চিবুকে হাত রেখে বলল,

‘ যদি জানতে পারিস তুই যাদের কাছে মানুষ হয়েছিস সেই মানুষ গুলোর মাঝের একজন তোর আপন মা’কে খুন করেছে এইটা জানার পর কেমন উপলব্ধি হবে তোর ? ভেবে দেখ নিজেকে আমার জায়গায় দাঁড় করিয়ে ভাব। ঠিক এইকথা ভাবার পর তোর যেমন অনুভূতি হচ্ছে ঠিক তেমন অনুভূতি হচ্ছে আমার।’

চলবে…..