মজিলো_প্রেম_সখার_সনে পর্ব-৩৫ এবং শেষ পর্ব

0
395

#মজিলো_প্রেম_সখার_সনে

®️ রিয়া জান্নাত

| অন্তিমপর্বঃ- ৩৫ |

অ্যাম্বুলেন্স থেকে সাদা কাপড়ে আবৃত ফিরোজের লাশ বের করে। মুহূর্তের মধ্যে সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো প্রাক্তন এমপি ফাহিম খানের ছেলে ফিরোজ খান আজ সকাল সাড়ে নয় ঘটিকায় সড়ক দুর্ঘটনায় ইন্তেকাল করিয়াছে। চারদিক থেকে সকল লোক ছুটে ধেয়ে আসছে এমপি সাহেবের বাড়ির দিকে।

মায়া খান ছেলের ডেড বডি দেখার সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যায়। যেই অ্যাম্বুলেন্স করে ফিরোজের লাশ নিয়ে এসেছে। সেই অ্যাম্বুলেন্স করে মায়া খানকে হসপিটালে নিয়ে যায় সিয়াম খান। ফাহিম খান ছেলের ডেড বডি ধরে নিদারুণ চোখের জল ফেলছে। ফুয়াদ খানের কানে এই খবর যাওয়া মাত্র অফিস থেকে ধেয়ে আসছে বাড়ির দিকে। জেবা খান ফিহার মা ফাতেমা বেগমকে সামলাচ্ছে। সঙ্গে দুজনেই গলা ধরে কাদতেছে।

” ফিহা ফিরোজের ডেডবডি ধরে বলছে। এই তুমি শান্ত হয়ে আছো ক্যান? দেখছো না সবাই কাঁদতেছে। একটু উঠে সবাইকে ডাক দিয়ে বলোনা তুমি ঠিক আছো? ফিহা ফিরোজের বুকে কান রেখে বলে এই তোমার হৃদপিণ্ড ধরাস ধরাস করছে না কেনো? আর হলে আমি কাছে আসাতেই তোমার হৃদপিণ্ড ধরাস ধরাস করে। শুয়ে থেকে তোমার বুকে কান রেখে আমি তা উপভোগ করি। আজ কেনো তুমি চুপ? আমার উপর রাগ করছো সখা? দেখো সখা তোমার প্রেয়সীর প্রতি এতো কাঠিন্যে হলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে ? কিগো তুমি উঠছো না কেনো? হঠাৎ ফিরোজের কপালের ফাটা অংশ দেখে ফিহা চিৎকার দিয়ে উঠে ডক্টর আপনারা কোথায়? আমার সখার কপাল ফেটে রক্ত বেড়াচ্ছে ব্যান্ডেস করতে হবে? ফিহা বামদিকে চেয়ে বলে বাবা কাঁদছেন কেনো? যান না ডক্টরকে ফোন করুন। সখার অনেক রক্ত পড়ছে। শশুড়ের কোনো শব্দ না পেয়ে পাশে থাকা তিহাকে বলে শাফখাত ভাইয়া কই তিহা? ”

” তিহা অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিহার দিকে তাকিয়ে ফিহাকে বুকে টেনে ধরে বলে সে আসছে? ”

” তুই কাঁদতেছিস ক্যান? দেখ না তোর স্যার চুপ করে শুয়ে আছে। রক্ত বেড়াচ্ছে প্রচুর। এমপি সাহেবকে আসতে বল ডক্টরের কাছে নিতে হবে সখাকে। ”

” তিহা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে স্যার আর নেই ফিহা। স্যারা মারা গেছে। ”

” তিহার গালে থা’প্প’র দেয় ফিহা। খবরদার এসব কথা বলবি না নাহলে তোকে আমি মেরে ফেলবো? আমার সখার কিছু হয়নি। আমাদের জীবনের অনেক পথচলা বাকি। গতকাল রাতেই তো মানুষ টার সঙ্গে অনেক কথা বলেছি? ”

” তিহা ফিহাকে কিছু না বলে অঝোর ধারায় চোখের পানি ফেলে। ফিহার জন্য কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার। এমনিতে বেষ্ট ফ্রেন্ড তার উপর বড় ভাবী। এই মেয়েটার কষ্ট কিভাবে সহ্য করবে তিহা। তাইতো নিদারুণ চোখের পানি ফেলছে তিহা। ”

” লাশের অন্যপাশে থাকা ডিলনাসিন, পারিজাতকে যেয়ে বলে তোমরা বলোনা আমার সখার কিছু হয়নি। তিহা মিথ্যা কথা বলছে। ”

” ডিলনাসিন পারিজাত চিৎকার করে কেঁদে দিয়ে বলে ভাবী ভাইয়া আর নেই। ”

” ফিহা ওদের দুজনকে চটজলদি ফেলে দিয়ে লিটুকে বলে ভাইয়া আপনি বলুন না সখার কিছু হয়নাই? ”

” লিটু বামহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলে লিটুর আম্মাকে ইশারা করে ফিহাকে এইখান থেকে নিয়ে যেতে। ”

” লিটুর মা আর তিহা ফিহাকে এসে ধরে বলে চল উপড়ে যাবি। ”

” ফিহা বলে তোরা সবাই কাঁদতেছিস ক্যান? আমার সখার ওইখানে একটু কেটে গেছে? ব্যান্ডেস করলেই সেন্স ফিরে আসবে? আর আমি সখাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা। ”

ততক্ষণে গ্রামবাসীর লোক ছড়িয়ে পড়ে খান বাড়িতে। সবাই বলাবলি করছে আহারে কয়েকদিন আগেইতো বিয়ে হলো মেয়েটার। এই বয়সে বিধবা হলো? এখন মেয়েটির কি হবে? ছেলেটি এমন কি দোষ করেছিলে তারজন্য এতো আগে তুলে নিলো আল্লাহ।

গ্রামবাসীর এসব কথা শুনে ফিহা সেন্স হারিয়ে ফেলে। তিহা ও লিটুর মা ধরে ধরে ফিহাকে ঘরে নিয়ে আসলো?

” শাফখাত বাড়িতে এসে পাগলের মতো ফিরোজের লাশের কাছে ছুটে এসে বলে ভাইয়া এই তুমি কি করলে? ক্যান যে আমি গেলাম না দাদা ও দাদিকে আনতে? আমি গেলে তোমার সঙ্গে এসব ঘটতো না। ”

” পাশে থাকা ফাহিম খান বলে উঠে শাফখাত তোমার বাবা আমাকে যেতে বলেছিলো। কিন্তু শরীর খারাপের কথা বলে ছেলেটার মৃত্যুর কারণ হয়ে গেলাম? হে আল্লাহ আমার ছেলেকে নেওয়ার আগে আমাকে নিলে না কেনো? ”

লিটু এসে ভরসার কাঁধ বাড়িয়ে দিয়ে বলে শাফখাত, বাবা, ভাইয়ার ডেডবডি কষ্ট পাচ্ছে? এমনিতেও সে অনেক কষ্ট পেয়েছে তাকে দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে।

” দাফনের নাম শুনে ভেঙে পড়ে শাফখাত আর ফাহিম। ফুয়াদ ছুটে এসে ব্যাগটা ফ্লোরে ফেলে দেয়। এরপরে মেয়ের জামাইয়ের চোখে মুখে হাত দিয়ে বলে বাবা তুমি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবা তাহলে আমার মেয়েটাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলানা ক্যান? আমি এই বয়সে মেয়ের বিধবা রুপ দেখবো কিভাবে? ”

বাড়ির সবাই কাঁদতেছে। জেবা আর মায়া কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলেছে। পারি আর ডিল অতীতের স্মৃতিচারণ করছে। বিভিন্ন কথা বলে কাঁদতেছে। মায়া খানকে হসপিটালে স্যালাইন লাগিয়ে সিয়াম খান বাড়ি ফিরছে। কিছুক্ষণ পর শাফখাতের ড্রাইভার দ্বারা দাদা দাদিকে এনেছে। ওদেরকে আনার সঙ্গে সঙ্গে নাতির মৃত্যু মুখ দেখেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। শাফখাতের রুমে ফাহমিদুল আর জাদেজাকে পানি ঢালছে। শাফখাতের দলের লোক।

” সিয়াম, লিটু আর লিটুর বাবা শক্ত হাতে কবর তৈরি করলো । শাফখাত দাফনের কাপড় আনলো। এরপরে ফিরোজের ডেডবডিকে গোসল করালো। এরপরে সাদাকাপড় পড়িয়ে মসজিদ থেকে বহন করা লাশের খাটিয়ায় ফিরোজের ডেডবডি রাখলো। ”

” অন্যদিকে ফিহার জ্ঞান ফিরিয়ে শরীর থেকে ফিরোজের দেওয়া গহনাগুলো খুলে দিলো। এরপরে সাদাকাপড় পড়িয়ে দিলো ফিহাকে। ফিহা শুধু শক্ত কাঠের পুতুলের মতো বসে রইলো। কাউকে কোনোকিছু বললো না। ”

” জানাযার আগে ডিলনাসিন কাঁদো কাদো স্বরে ফিহাকে বলে ভাবী ওরা ভাইয়াকে নিয়ে যাচ্ছে। শেষবারের মতো তাকে দেখবা না। ”

” তিহা বুকে নিয়ে আছে ফিহাকে। ফিহার কন্ঠ দ্বারা কোনো শব্দ উচ্চারিত হলোনা। এই অবস্থা যে দেখবে সেই তাঁকেই জীবন্ত লাশ বলবে। পাশে বসে আছে ফাতেমা আর জেবা। কাঁদতে কাঁদতে ওদের গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেড়াচ্ছে না। এই অবস্থা দেখে লিটুর মা ডিলকে বলে বউমা তুমি ফিরোজের লাশকে নিয়ে যেতে বলো। ”

” ডিল চলে গেলো। ফিরোজের লাশের খাটিয়া বহন করলো শাফখাত, ফাহিম,ফুয়াদ,সিয়াম,মাঝখানে লিটু ও লিটুর বাবা ধরে বহন করলো। বাবার কাঁধে ছেলের লাশ। এইরকম অবস্থা আর যেনো কারো কোনো বাবার সৃষ্টি না হয়। বড় মসজিদ মাঠের সামনে ভার্সিটির সব স্টুডেন্ট তাদের প্রিয় স্যারের জানাযায় অংশগ্রহণ করলো এবং ভার্সিটির সব শিক্ষকগণ। জানাযার আগে সবাই মূর্ধার উদ্দেশ্য গন্যমান্য ব্যাক্তিগণ কিছু কিছু কথা বলে জান্নাতবাসী হওয়ার দোয়া চাইলো। ”

” জানাযা শেষে ফিরোজের লাশ দাফন করে সবাই মলিনমুখে ফিরলো বাড়িতে। ”

★★★

আজ ফিরোজ মারা যাওয়ার তিনদিন হলো এ পযন্ত বাড়িতে কোনোকিছু রান্না করা হয়নি । খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করেনাই। লিটুর বাড়ি থেকে দুইবেলা যে খাবার দিতো সবাই গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করতো? কিন্তু ফিহাকে এ পযন্ত কেউ কিছু খাওয়াতে পারেনাই। ফিরোজ মারা যাবার পরে ফিহা কারো সঙ্গে কথা বলেনা। রুমের মাঝে দরজা বন্দি করে থাকে। কখনো কাঁদে কখনো আবার হাসে। একদম পাগল প্রায় অবস্থা ফিহার।

আজ ফিরোজের মৃত্যুর তিনদিন উপলক্ষে মিলাতের ব্যবস্থা করানো হয়েছে। বাড়িতে অনেক মাওলানা মুন্সি একত্রে হয়ে দোয়া পড়ালো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে মুন্সি মাওলানা গণ বাড়িতে ফিরলো। তিহা একটা বাটিতে খাবার নিয়ে আসলো ফিহার রুমে। ফিহা এককোনে ফিরোজের অ্যালবাম নিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে।

তিহা ফিহার বুক থেকে ফিরোজের ছবিখানা টেনে নিয়ে বলে,,,

” আয় তোকে ভাত খাইয়ে দিই? তুই এভাবে না খেয়ে থাকলে মারা যাবি? ”

“ফিরোজের মৃত্যুর তিনদিন পর ফিহা দন্ত কেলিয়ে উচ্চস্বরে হাসে। এরপরে পাগলীর মতো চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে দুহাত দ্বারা টেনে বলে আমিও মরতে চাই। এই খাবার আমার জন্য বিষ। তুই এখান থেকে চলে যা। তিহাকে ধাক্কা দেয় তিহা পড়ে যেতেই শাফখাত এসে ধরে নেয়। শাফখাতের পিছনে পিছনে ফাতেমা ও জেবা দৌড়ে আসে। ফিহার এইরুপ দেখে ফাতেমা এগিয়ে এসে বলে? মা তুই না খেলে কিন্তু আমি মরে যাবো। ”

” ফিহা এই কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে বলে তো মরো? তোমাকে বাঁচতে বলেছে কে? ”

” জেবা মুখটা করুন করে বলে বউমা আজকে তোমার শাশুড়ী বাড়িতে ফিরছে? ও কিন্তু তোমাকে খাইয়ে ছাড়বে? তিনদিন হলো এখন একটু স্বাভাবিক হওনা? ফিরোজের স্বপ্নগুলি নিজের মধ্যে লালিত করে বাকিটা জীবন পার করো? ”

” মূহুর্তের মধ্যে ফিহা কেঁদে ফেলে। এরপরে বলে ছোটমা আমি কার জন্য খেয়ে বাঁচবো? ”

” আমাদের জন্য? আমাদের ভালো রাখার জন্য? ”

” ফিহা দাঁত কেলিয়ে বলে তাহলে দাও খাই। ”

” ফিহার এই আচরণ দেখে শাফখাত ডক্টর কল করে। ”

” ফাতেমা ফিহার মুখে খাবার দিতেই ওয়াক ওয়াক করে বের করে দিয়ে সেন্সসিলেন্স হয়ে যায়। ”

★★★

ডক্টর এসে ফিহাকে দেখে বাড়ির সবাইকে বলে পেসেন্ট মা হতে চলেছে?

এই শোকের বাড়িতে এইভাবে আনন্দের খবর পাওয়াতে সবাই একটুখানি খুশি হয়। মায়া খান বাড়িতে ঢোকা মাত্রই এই কথা শুনতে পেয়ে কিষ্তিৎ খুশি হয়ে বলে,, যাক আল্লাহ আমার ছেলেকে নিয়ে ছেলের অংশকে পাটাচ্ছে ।

ডক্টর আবার বললো এই পেসেন্ট তার মানসিক অবস্থা হারিয়ে ফেলছে বলতে গেলে পাগল প্রায়। তাই এই সন্তানকে পৃথিবীতে সুস্থ অবস্থায় আনা অনেক রিস্ক? তাকে ট্রোমার ডক্টর দেখান দ্রুত? আর পেসেন্টকে খাওয়া দাওয়া করাবেন ঠিকমতো?

” মায়া খান নিজে দায়িত্ব নেয়। ডক্টর কে বলে ছেলেকে হারাইছি। ছেলের বউ আর তার অংশকে হারাতে চাইনা। ”

” ডক্টর চলে যায়? ”

বাড়িতে এই চটজলদি আনন্দের খবর মূর্ছায় থেকে যায়। ফিহাকে অনেক তোষামোদি করে তিনবেলা তার শাশুড়ী খাওয়াও। এবং ফিহার কাছেই থাকে। ফিহার সম্পূর্ণ দায়িত্ব মায়া নিজ হাতে সামলায়।

★★★

আজ ফিরোজ মারা যাওয়ার নয় মাস নয়দিন হলো। ফিহার কোল আলো করে একটা ফুটফুটে বাচ্চা এলো । ছেলেবাবু হইছে ফিহার। ফিরোজ ও ফিহার নামের মিল রেখে ফাহিম ও মায়া খান তাদের নাতির নাম রাখলো মোস্তাফিজ। বাড়িতে আজ অনেক খুশি বিরাজ করার পরেও সবার মুখে হাসি নাই। কারণ তাদের হাসিগুলে আগেই ফুরিয়ে গেছে? ফিরোজ মারা যাওয়ার পর ফিহাকে অনেক ট্রমার ডক্টর দেখানো হয়েছিলো। কিন্তু ফিহার কোনে উন্নতি নাই? সারাদিন রাত ফিহা শুধু ফিরোজের পাঞ্জাবি শার্টগুলো জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। সে যে মা হয়েছে এই সম্পর্কে তার কোনো ধারনাই ছিলো না।

ভাগ্যিস মায়া খান পাশে ছিলো বলে আজও ফিহা আর ফিহার বাবু সুস্থ আছে।

” অন্যদিকে তিহা ৭ মাসের অন্তসর্তা। সেই উপলক্ষ্যে আজকে বাড়িতে স্বাদের অনুষ্ঠান রাখা হয়েছিলো। ”

সবমিলিয়ে এখন গভীর রাতের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

| সমাপ্ত |