মধ্যবিত্ত পর্ব-০১

0
1

#মধ্যবিত্ত (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

টিউশনিতে আগের দিনের বাসি খাবার নাস্তা হিসাবে দিয়ে যায় স্টুডেন্টের মা। এটা দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগলো। তাই মনের কষ্ট আড়াল করতে না পেরে স্টুডেন্ট সোহানকে বললাম,“এখানে আমি পড়াতে আসি নাস্তা খেতে না। তোমাকে পড়ানোর বিনিময়ে আমি সম্মানী পাই। তাই তোমাদের আলাদা করে নাস্তা দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।”
সোহান আমার কথা শুনে মাথানত করে বসে রইলো। এই খাবারটা যে বাসি সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কিছুটা গন্ধও করছে। তাছাড়া গতকাল সোহানকে পড়ানোর সময় জেনে গিয়েছিলাম, তাদের বাড়িতে বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। এটা নিয়ে তারা ভাই-বোনরা খুব খুশি। এই বিরিয়ানি গতকাল রান্না হলো অথচ তারা গতকাল দেইনি। তবে আজ দিলো। কারণ হয়তো এই খাবারটা এখন খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে।

সোহানের মাথানত করা দেখে আমি তাকে শান্ত গলায় বললাম,“পড়ায় মনোযোগ দাও।”
সোহান মাথা নাড়িয়ে পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। বাসি বিরিয়ানির দিকে দ্বিতীয়বার আমার চোখ পড়তে মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো। নিজেকে অনেকটা ছোট মনে হ’তে লাগলো। টিউশনি করাই বলে কী মানুষ নই? আত্মসম্মান নেই? একজন গৃহশিক্ষক তাদের কাছে এতটা নিচু যে বাসি খাবার তাকে নাস্তা হিসাবে দেওয়া যায়? এসব চিন্তা মাথায় আসতে শুরু করলো। এই মূহুর্তে ইচ্ছে করছে টিউশনি ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু সেটাও পারবো না। মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া আমির কাছে এই টিউশনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো, নিজের অসম্মান হচ্ছে জেনেও টিউশনি ছাড়ছি না। এসব ভাবনার মাঝে সোহান বললো,“স্যার স্যরি।”
আমি সোহানের দিকে তাকাতে দেখলাম সে কাঁদো কাঁদো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখজুড়ে তার মায়ের আমার সঙ্গে করা ব্যবহারের অপরাধবোধ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। এটা দেখে ভালো লাগলো। সে যে তার বাবা-মায়ের মতো হয়নি। এটা শিক্ষক হিসাবে ভালো লাগার। সোহানের মুখে ফুটে ওঠা অপরাধবোধ এটাই জানান দিচ্ছে, সে জানে এই বাসি খাবারটার যোগ্য তার শিক্ষক নয়। তবে সোহানের মুখে এই অপরাধবোধটা দেখতে ইচ্ছে করছিলো না। তাই দ্রুত তাকে পড়ানো শেষ করে বের হয়ে আসলাম। সোহানদের ঘর থেকে বের হবার সময় শুনতে পেলাম সোহান উচ্চশব্দে তার মাকে ডাকছে।

___
আমি বাড়ি ফিরতে বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্তি নিয়ে বললেন,“এই মাসে ঘরে কোন টাকা দিবে না?”
বাবার এই কথা শুনে আমি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বললাম,“টিউশনি থেকে এখনো বেতন পাইনি। পেলে দিয়ে দিবো।”

“ওহ। তা টিউশনি করে সারাজীবন কাটাবে নাকি?”
বাবার এই কথার জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। এই মূহুর্তে জবাব দিলে আবার সেই একই কথা শুনতে পাবো। তবে আমি চুপ করে থেকেও বিশেষ লাভ হলো না। বাবা পিছন থেকে রাগান্বিত গলায় বলে,“কোন কথা বললে জবাব দাও না। খুব বড় কিছু ভাবো নাকি নিজেকে? ভাববাই তো? এত এত খরচ করে তোমাকে পড়ালেখা শেষ করালাম। এই আশায় যে শেষ বয়সে আমার পাশে দাঁড়াবে। ফলাফল কী? সেই তো গত তিন বছর ধরে বেকার ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছো। কয়েকটা নামমাত্র টিউশনি করিয়ে মাসে হাতে দাও কোনরকম দুই পয়সা। এতবড় একটা সংসার টেনে নিয়ে যেতে আমার যে কত কষ্ট হচ্ছে বা হয় এটা বোঝ? এখন তো মনে হয়, তোমাকে এত কষ্ট করে মাস্টার্স পাশ না করিয়ে ছোটবেলা কাজে দিয়ে দিলে অন্তত আমার দুটো লাভ হতো। অন্তত আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পয়সা, অন্ন নষ্ট হতো না।”
বাবা একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। আমি বিরক্ত হয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেই। মা ভেতর ঘর থেকে বাবার এসব কথা শুনে বুঝতে পারেন আমি এসেছি। তাই মা ছুটে আসে। বাবাকে থামায়। মা শান্ত গলায় বলে,“তুমি একটু চুপ করো। রোজ রোজ একই কথা বলে পাও কী?”

“রোজ রোজ এক কথা বলি তাও তো তোমার ছেলের কানে যায় না। সারা দুনিয়ার মানুষ চাকরি পাচ্ছে, তোমার ছেলে পাচ্ছে না কেন? ওর ক্লাসের রাজুর সঙ্গে দেখা হলো। ছেলেটা গর্দভ ছিলো। সেই ছেলেও সরকারি চাকরি পেয়েছে, তোমার ছেলে করছে টা কী? এই নাকি ক্লাসে টপার ছিলো?”
এই কথা শুনে মা বারবার বাবাকে থামতে বলছে। বাবা চুপ করছে না। অন্যদিকে আমি ঘরের মধ্যে কানে তুলো গুজে রেখেছি। কী করবো? এত ভালোভাবে সবগুলো চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার পরও ভাইভা থেকে রিজেক্ট হচ্ছি। এখানে আমার কী দোষ? চাকরি যে একেবারে পাচ্ছি না তা নয়। কিন্তু যেগুলো পাচ্ছি সেগুলোতে বেতন কম। সেই সঙ্গে সম্মানও নাই। এত পড়ালেখা শেষে এমন এক চাকরি মেনে নিতে পারছি না। একদিকে ভালো চাকরির ইন্টারভিউতে অসফল হচ্ছি, অন্যদিকে ঘরের মধ্যে বাবার কথা। সব মিলিয়ে জীবনটা শেষ। আমার আর ভালো লাগছে না। এমন সময় সোহানের মায়ের নাম্বার থেকে কল আসে। তার কল দেখে কিছুটা অবাকই হলাম। কলটি রিসিভ করতে সোহানের মা বলে উঠলো,“কাল থেকে আর এসো না। আমরা সোহানকে অন্য স্যারের কাছে দিয়েছি।”

“মানে? কিন্তু কেন? আন্টি আমি কী কোন ভুল করেছি?”
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এই মূহুর্তে একটি টিউশনি বাদ মানে অনেককিছু আমার কাছে। সবচেয়ে বড় কথা সোহানের বাবা বেশ ভালো অবস্থানে চাকরি করতেন। বেতনটাও মোটা অংকের দিতেন। এই টিউশনি চলে যাওয়া মানে আমার অনেক লস হওয়া। এটা হারালে নতুন টিউশনি খুঁজে পেতে প্রচুর বেগ পেতে হবে। সেই সাথে ঘরেও টাকা দিতে পারবো না। বাবা টাকা না পেলে আরও কথা শোনাবে। সব মিলিয়ে বেশ সমস্যায় পড়তে হবে আমাকে। এসব ভাবনার মাঝে সোহানের মা বলে,“তোমার মতো ছোটলোক দিয়ে আমি আমার ছেলেকে পড়াবো না। কত ভালোবেসে নাস্তা দেই আর তোমাদের মতো কিছু ছোটলোক থাকে সেই নাস্তার বদনাম করে।”
এই কথা শুনে আমি হতবাক হলাম। আমি তো তেমন কিছুই বলিনি। বুঝতে পারলাম আমি চলে আসার পর হয়তো সোহান এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছে। তাই আমি আন্টিকে বোঝাতে বললাম,“আন্টি আমি তো কিছুই বলিনি। দেখুন আন্টি এই টিউশনিটা আমার ভীষণ প্রয়োজন। দয়া করে এভাবে হুট করে আমাকে বাদ দিয়ে দিবেন।”

“তোমাদের মতো ছোটলোকের টিউশনিও দরকার আবার স্টুডেন্টের কাছে তার বাবা, মাকে ভিলেন বানানোও জরুরি।
খেতে পাও না। তাই দয়া করে মাঝে সাজে খেতে দেই। সেটা নিয়েও কমপ্লেন। তুমি ভাবলে কিভাবে তোমার মতো ছোটলোকের কাছে আমি আমার ছেলেকে পড়াবো? জীবনেও না। পড়ে দেখা যাবে আমার ছেলেও তোমার মতো ছোটলোক হয়েছে।”
সোহানের মায়ের এত বাজে কথা শোনার পরও আমি করুণ গলায় বললাম,“আন্টি প্লীজ এভাবে মাঝপথে আমাকে বাদ দিবেন না। আমার টিউশনি প্রয়োজন। তাছাড়া মাঝপথে নতুন টিচার দিলে সোহানেরও অসুবিধা হবে।”

“সোহানের অসুবিধা আমি বুঝে নিবো। তোমার বিকাশে গতমাসের বেতনটা পাঠিয়ে দিবো। কাল থেকে আর আসার প্রয়োজন নেই।”
একটু থেমে এবার সোহানের মা যা বলে তা শুনে আমারও মাথা গরম হয়ে যায়। সে বলে,“তোমাদের মতো ছোটলোকদের এতদিন বাড়িতে ঢোকার সুযোগ দিয়েছি এই অনেক আর নয়। আমি চাই না টাকা নেওয়ার বাহানায় হলেও তোমার মতো ছোটলোকের আমার বাসায় পা পড়ুক। তাই বিকাশে সব টাকা মিটিয়ে দিবো।”

আমি এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। সেই সাথে বুঝে গিয়েছি, তারা আমাকে আর রাখবেও না। যেখানে টিউশনিটা থাকবে না সেখানে এভাবে অপমানিত কেন হবো? তাই রাগ নিয়ে বললাম,“ভদ্র ভাষায় কথা বলবেন। ছোটলোক ছোটলোক বলে বারবার আপনি নিজের নিচু মনের পরিচয় দিচ্ছেন। নেহাৎ আমার টিউশনি প্রয়োজন তাই আমি চুপ করে ছিলাম। তারমানে এটা নয় আপনি একজন টিচারের সঙ্গে যা তা ব্যবহার করবেন। যেই খাবারটা আপনাদের বাড়িতে কারো খাওয়ার উপযোগী হয় না সেটা আপনি টিউশন টিচারকে দিবেন। আপনার বাড়িতে চাকরের কাজ করতে যাই না যে এমন আচরণ করবেন। তাছাড়া একজন চাকরের সঙ্গেও এই আচরণ করা ভদ্র মানুষের পরিচয় নয়। এই আপনাদের মতো কিছু নিচু মানসিকতার বাবা, মায়ের জন্যই তাদের সন্তানরা সঠিকভাবে মানুষ হতে পারে না। আপনাদের জন্য তাদের জীবনটাও নষ্ট হয়। আমার তো এখন নিজের উপর লজ্জা হচ্ছে যে দারিদ্র্যতা এবং বেকারত্ব আমাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে যে আমি আপনাদের বাড়িতে এতদিন অব্দি সব সহ্য করে টিউশনি করিয়ে গিয়েছি। আমি….।”
আমার কথা সমাপ্ত করতে না দিয়ে সোহানের মা ফোন কেটে দেয়। হয়তো প্রচন্ড রাগ হয়েছে তার। তবে তার রাগ নিয়ে আমি ভাবছি না। বরং খুশি লাগছে৷ মনের মধ্যে জমে থাকা কিছু কথা যে তাকে বলতে পেরেছি, এটা ভেবেই খুশি লাগছে। যদিও সবটা বলতে পারিনি। আজ বেকার বলেই তার সবকিছু সহ্য করে পড়িয়ে গিয়েছি। নয়তো সেদিনই টিউশনি ছেড়ে দিতাম যেদিন দেখলাম সোহানের মা তার বাড়িতে অতিথির জন্য ভালো রান্না হয়েছে বলে গেট থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিলো। ভেতরে ঢুকতে অব্দি দেয়নি। সে সেদিন বলছিলো,“সোহান অসুস্থ আজ পড়বে না। তুমি যাও।”
আমি ভাবছিলাম অসুস্থ যেহেতু সেহেতু দেখে যাই। কিন্তু তিনি ভেতরে যেতে দেননি। পরবর্তী দিন সোহানকে পড়াতে গিয়ে আসল ঘটনা জানতে পারি। সেদিন আত্মসম্মানের কথা ভেবে চাইলেই ছেড়ে দিতে পারতাম। ইচ্ছেও ছিলো। কিন্তু বাড়িতে আসতে যখন শুনলাম ঋনের টাকা শোধ করা নিয়ে বাবা, মা বেশ চিন্তিত। তারা চিন্তিত এজন্য যে আমার চাকরি নেই। এত ঋন কতদিনে তারা শোধ করতে পারবে। মাস শেষে আমার দেওয়া কয়টা টাকাই তাদের ভরসা। অন্তত কিছু সাহায্য হয়। এই কথা জানার পরই অপমান নিজের মনের মধ্যে গিলে নিলাম। চুপচাপ পরেরদিন টিউশনিতে গেলাম। যাই হোক, সোহানের টিউশনি বাদ হওয়ায় বেশ কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সেই সাথে আগামীকাল একটি চাকরির পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়ার কথা। সেটা নিয়েও মনের মধ্যে আশা জাগছিলো। সব ভালোই হয়েছে। এখন জানি না ফলাফলে আমার ভাগ্যে কী লেখা আছে? এসব নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়তে সেই মূহুর্তে মায়ের চিৎকার কানে ভেসে এলো। মা চিৎকার দিয়ে বলছে,“শান্ত!”


চলবে,