#মধ্যবিত্ত (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
মায়ের চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। মা আমাকে দেখে কান্না করে দিলো। অস্থির হয়ে বলে,“দেখ না শান্ত। তোর বাবা কেমন করছে?”
আমি ভালোভাবে লক্ষ্য করতে দেখলাম বাবা বুকে হাত দিয়ে কেমন একটা করছে। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মা এবং বোন বাবার এমন অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ছি। আমি তৎক্ষনাৎ গাড়ি ঠিক করতে চলে গেলাম। দ্রুত বাহির থেকে একটি গাড়ি নিয়ে এসে বাবাকে ধরে গাড়িতে তুললাম। মা এবং আমি বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম৷ বোনকে বাড়িতে রেখে গেলাম৷
বাবাকে হাসপাতালে নিলে জানা যায় প্রেসার বেড়ে গিয়েছে। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিলে কিছুটা সুস্থ হয়। তবুও ডাক্তার দুদিনের জন্য হাসপাতালে রাখার পরামর্শ দিলো। সেই অনুযায়ী আমরা হাসপাতালে ভর্তি করালাম। বাবা কিছুটা সুস্থ হওয়া পরও মা কান্না করছে। আমি এটা দেখে শান্ত গলায় বললাম,“বাবার কিছু হবে না৷ তুমি এভাবে কান্না করো না মা।”
“মানুষটাকে কত করে বললাম, এত চিন্তা করো না। এত চিন্তা করো না। তাও মানুষটা শুনে না৷ সারাদিন এই সেই চিন্তা করতে থাকে।”
এই কথা বলে মা মনমরা গলায় আমাকে বলে,“বাবা একটু দেখ না, একটা চাকরি যোগাঢ় করতে পারিস কি-না।তুই একটা চাকরি পেলে তোর বাবার চিন্তাটা কিছুটা কমতো। মেয়েটার বিয়ে নিয়েও প্রচুর ভাবে।”
“চেষ্টা করছি মা।”
এটা বলে আমি একপাশে চলে আসলাম। হাসপাতালের বিল, ঔষধ খরচ সব মিলিয়ে বেশ কিছু টাকা লাগবে। সোহানের মা এখনো বিকাশে কোন টাকা পাঠায়নি। তাই বাধ্য হয়ে আমি ফোন দিলাম। প্রথমবার কেটে দিলো। দ্বিতীয় আবার দিতে ধরে বললো,“কী সমস্যা?”
“আন্টি গত মাসের বেতনটা তো এখনো পেলাম না।”
আমি যথেষ্ট ভদ্র ভাষায় কথা বললাম। কিন্তু সে ভদ্র থাকলো না। বরং রাগান্বিত গলায় বাজেভাবে বললো,“বেতন? তোমাকে আমি বেতন দিবো? তুমি ওমন ব্যবহার করার পরও? অসম্ভব। বরং আমি তোমার নামে মানহানির মামলা করবো।”
এই কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি অনুরোধ করে বললাম,“আপনি মামলা করলে করেন। আপাতত অনুরোধ করছি দয়া করে আমার টাকাটা দিন। আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি।”
“তো? তোমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি তো আমি কী করবো? আমি কোন টাকা পাঠাতে পারবো না। তোমার মতো ছোটলোক একটা সন্তান জন্ম দেওয়ায় তোমার বাবার এভাবে হাসপাতালে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় ম রা প্রাপ্য ছিলো।”
এই কথা শুনে আমি রেগে গেলাম। তবুও নিজেকে সামলে ফোন কেটে দিলাম৷ আমি বুঝে গেছি, এত সহজে এখন তার থেকে টাকা পাওয়া যাবে না। তাই সময় নষ্ট না করে অন্য এক স্টুডেন্টের বাবাকে ফোন করলাম। সে ফোনটা ধরতে আমি বললাম,“আংকেল আমার বেতনটা বিকাশে পাঠালে ভালো হয়। আমার বাবা অসুস্থ, এখন টাকাটা প্রয়োজন।”
“এখন দিতে পারবো না।”
এই এক কথা বলে সে ফোন রেখে দিলো। বিষয়টি আমার হজম হলো না। আমি আবারও ফোন করলাম। এবার ফোন কেটে দিলো। তার এমন আচরণ দেখে আমি ভীষণ অবাক হলাম। মানুষ এত খারাপ? আমি তো আমার প্রাপ্য চেয়েছি। তাদের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা চাইনি। এরা এমন মানুষ যে টিউশন টিচারকে মানুষই মনে করে না। আমার মতো মধ্যবিত্ত টিচারকে তো একদমই নয়। এই দুনিয়ায় মধ্যবিত্ত হয়ে জন্ম নেওয়াটাই বোধহয় ভুল ছিলো। হ্যাঁ চরম ভুল ছিলো। আরও একজন স্টুডেন্ট রয়েছে। কিন্তু তাদের ফোন দিবো কি-না ভাবছি। যেহেতু দুজন স্টুডেন্টের অভিভাবকের থেকে এমন আচরণ পেয়েছি৷ তবে এই স্টুডেন্টের অভিভাবকের মনোভব ততটা খারাপ নয়। কখনো সেরকম কিছু অনুভব করিনি। তাই ভাবলাম একবার ফোন দিয়েই দেখি। ফোন দিলাম। কিন্তু ধরলো না। এবার সব টিউশনির টাকার আশা ছেড়ে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। হাসপাতালের বাহিরে এসে হতাশ হয়ে বসে পড়লাম। এই মূহুর্তে কী করবো ভেবে পাচ্ছি না। পকেটে মাত্র তিনশো বিশ টাকা আছে। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে বন্ধুদের কাছে ধার চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই মূহুর্তে ফোনটি বেজে উঠলো। ফোনে তৃতীয় স্টুডেন্টের অভিভাবকের কল দেখে কিছুটা আশার আলো খুঁজে পেলাম। ফোন ধরতে ওপাশ থেকে সাদিয়ার মা বলে,“স্যরি স্যার। তখন ফোনের পাশে ছিলাম না তাই ধরতে পারিনি।”
“না না সমস্যা নেই।”
আমি যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে কথাটি বললাম। সাদিয়ার মা বলে,“হ্যাঁ এবার বলুন তখন ফোন দিলেন কেন? কোন দরকার? সাদিয়ার পড়ালেখা নিয়ে কিছু বলবেন?”
“না। আসলে আমার বাবা হাসপাতালে ভর্তি৷ গত মাসের বেতনটা দিলে ভালো হতো৷ এখন বিকাশে পাঠালে আমার অনেক উপকার হতো।”
কোনরকম ভণিতা ছাড়াই কথাগুলো বললাম। এটা শুনে সাদিয়ার মা লজ্জিত হয়ে বলে,“ওহ। ইশ। স্যরি স্যার। আমার তো বেতনের কথাটা মাথাই ছিলো না। সাদিয়ার বাবাকে বলা হয়নি। তবে চিন্তা করবেন না, আমি এখনই সাদিয়ার বাবাকে টাকাটা আপনার নাম্বারে বিকাশ করতে বলছি।”
এই কথা শুনে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এতক্ষণে বোধহয় বুকের উপর দিয়ে একটা বোঝা নেমে গেল। সাদিয়ার মাকে ধন্যবাদ জানাতে সে বলে,“আপনার বাবা এখন কেমন আছে? কী হয়েছে?”
আমি সব কথা খুলে বললাম। সে আমার বাবার জন্য দোয়া প্রকাশ করলো৷ অতঃপর ফোন রেখে দিলো। তার কয়েক মিনিটের মাঝে ফোনে দুই মাসের বেতন এলো। এবার সাদিয়ার বাবা ফোন দিলো। আমি ফোনটা ধরতে সে বললো,“স্যার কেমন আছেন? বেতন পেয়েছেন?”
“হ্যাঁ। কিন্তু মনে হয় ভুল করে এক মাসের টাকা বেশি পাঠিয়েছেন।”
“না। ভুল হয়নি৷ আমি চলতি মাসের টাকাটা পাঠিয়ে দিলাম। শুনলাম আপনার বাবা অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন, কত কী লাগে বলা যায় না। তাই সাদিয়ার মা বললো এই মাসের টাকাটাও দিয়ে দিতে।”
সাদিয়ার বাবা, মায়ের এই আন্তরিকতায় আমি মুগ্ধ হলাম। এই পৃথিবীতে যেমন খারাপ মানুষ আছে তেমন ভালো মানুষও রয়েছে। এই সাদিয়ার বাবাও আমাদের মতো মধ্যবিত্ত। আমি যতদূর জানি, একসাথে দুই মাসের টাকা দেওয়ার মতো সার্মথ্য তার নেই৷ বরং এই টাকাটা দেওয়ায় তার সংসার চালাতে অসুবিধা হয়ে যাবে৷ তবুও কিছু না ভেবে এক মূহুর্তে দিয়ে দিলো। আর এই আমিই দুইজন স্টুডেন্টের অভিভাবকের থেকে টাকা না পেয়ে এদের নিয়েও নেতিবাচক চিন্তা করেছি। যদিও এখানে আমার দোষ নেই।দোষ আমার ভাগ্যের। যেটা হতাশ হয়ে , চিন্তিত হয়ে তাদের না চাইতেও খারাপ ভেবেছে৷ এটা আমার দোষ৷ তাইতো আস্তে করে বললাম,“স্যরি।”
অতঃপর ফোন রেখে টাকা তুলতে চলে গেলাম। হাসপাতালে যাবতীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করে মাকে বললাম,“শিমু বাড়িতে একা আছে৷ আমি যাই ওকে গিয়ে মামাদের বাড়ি রেখে আসি। নয়তো একা একা ভয় পেয়ে যাবে।”
মা সম্মতি জানালে আমি বাসায় চলে আসলাম৷ বোনকে মামার বাড়ি রেখে আবার হাসপাতালে চলে আসলাম।
___
পরবর্তী দিন সকালে অনেক আশা নিয়ে ফলাফল দেখলাম৷ প্রতিবারের মতো এবারও হতাশ হলাম। চাকরিটা এবারও হয়নি৷ এবারও আমি ব্যর্থ। এই ব্যর্থতাকে লুকাতে হাসপাতাল থেকে এক বন্ধুর বাড়ি চলে আসলাম৷ তার কাছে বসে জীবনের হতাশা নিয়ে কথা বললাম। এক পর্যায়ে বললাম,“ভালো জবের আশা এবার ছাড়তে হবে বুঝলি রতন। তুই দেখ, তোর সঙ্গে আমাকে কল সেন্টারে জব দিতে পারিস কি-না।”
রতন এই কথা শুনে কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেল। তার চিন্তিত মুখ দেখে আমি বললাম,“কী ভাবছিস?”
“এখানে অনেক ঝামেলা আছে রে। তুই সামলাতে পারবি? তাছাড়া বেতন কম। এই বেতনে চালাতে পারবি?”
“না। এজন্যই ভাবছি, টিউশনি ছাড়বো না। অফিস শেষে টিউশনি করিয়ে নিবো। সব মিলিয়ে পুষিয়ে নেওয়া যাবে।”
আমার এই কথায় রতন অদ্ভুতভাবে আমার মুখের দিকে তাকায়। তারপর শান্ত গলায় বলে,“সবটা এত সহজ হবে না। এই জব করার পর তোর আবার টিউশনি করার এনার্জি থাকবে না রে।”
“তুই চিন্তা করিস না৷ একটু জবের ব্যবস্থাটা করে দে। তারপর আমি সামলে নিবো। আমাদের মধ্যবিত্তদের এত ভাবলে চলে না রে। পারবো নাও বলতে নেই৷ আমাদের পারতেই হবে। এতদিন উল্টো ভালো জবের আশায় অন্যকোন জব না নিয়ে ভুল করেছি৷ এখন বুঝতে পারছি৷ বাবাকে এবার কাজ থেকে মুক্তি দিতে হবে। পুরো সংসারের দ্বায়িত্বটা বুঝে নিতে হবে।”
শান্তর মুখে এই কথা শুনে রতন মাথায় নাড়ায়। আসলেই তাদের মধ্যবিত্তদের সব মানিয়ে নিতে হয়। মানিয়ে চলতে হয়। তাই তো রতনও মানিয়ে চলছে।
’
’
চলবে,
(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন। লেখাটা হয়তো ভালো হয় নাই তেমন। বুঝতে পারছি।)