মধ্যবিত্ত পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
3

#মধ্যবিত্ত (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

কেটে গেল কয়েক দিন। এক মাস শেষ হয়ে নতুন মাসের আগমন ঘটলো। বাবার চাকরিটাও চলে গেল।সোহানের মাও টিউশনিটা বন্ধ করে দিলো। সেই সাথে গত মাসের বেতনও দেয়নি। সব মিলিয়ে এখন পুরো সংসারের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। তবে পকেট ফাঁকা। যদিও রতনের অফিসে চাকরিটা হয়ে গেছে। কিন্তু বেতন তো পরবর্তী মাসে পাবো। এখন এই মাসটা তো চলতে হবে। সেজন্য চিন্তা করলাম, কারো সাহায্য নিয়ে সোহানের মায়ের কাছে টাকাটা চাইতে যাবো। সরাসরি বাসায় যাবার আগে ফোনে একবার চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেও সমস্যা। সে ফোন দিলে সহজে ফোন ধরে না। যদিও বা ধরে টাকার কথা বললে কেটে দেয়। তবুও ভদ্রতা করে শেষবার ফোন দিলাম। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ধরলো। ফোনটা ধরে কঠিন গলায় বললো,“কী সমস্যা? বারবার ফোন দাও কেন?”

“আন্টি আমি আমার পাওনা টাকাটা নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছি।”
এই কথা শুনে সোহানের মা এক বাক্যে বলে দেয়, তোমার সঙ্গে আমাদের কোন লেনাদেনা নেই। অতঃপর ফোন কেটে দেয়। আমিও সেদিন বিকালে এক বড় ভাইকে নিয়ে তাদের বাসায় যাই। প্রথমে যদিও টাকা দিতে চাচ্ছিলো না। পরবর্তীতে আমি এই টাকার জন্য যেকোন পদক্ষেপ নিতে পারি, টুকটাক মামলার ভয় দেখালে বাধ্য হয়ে দিয়ে দেয়। টাকাটা দেওয়ার সময়ও সোহানের মা বলে,“ছোটলোক কোথাকার।”
আমি তার কথার প্রতিত্তোর না করে চলে গেলাম।

__
শুরু হলো ব্যস্ত এক জীবন। সারাদিন কল সেন্টারে কাজ। তারপর এসে দুইটা টিউশনি। সব মিলিয়ে হিমশীম খেয়ে যাচ্ছি। অফিস টাইমটা মোটেও ভালো যাচ্ছে না। প্রথম কয়েকদিন কাজ শেখালেও পরবর্তীতে কাজ শেখানোর চেয়ে বকা দেয় বেশি। আমার অবশ্য বকা কমা খাওয়া লাগতো, রতন এখানের সমস্ত বিষয়টি আমাকে বুঝিয়ে দিতো।

তবে এই কল সেন্টারে জব করে বুঝতে পারলাম, এখানে জব করা কত ধৈর্যের। এখানে সাধারণ মানুষ কল দিয়ে যতই রাগারাগি, যতই তেজ দেখাক সবার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে হবে। সবকিছুই মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু! এখানে অনেকে শুধু শুধু ফোন দিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলে। মানে এটা তাদের কাছে মজার মতো। তাদের এই মজা যে এদিকে আমাদের জন্য কতটা বিরক্তির এবং কষ্টের সেটা তারা একবারও উপলব্ধি করতে পারে না। একদিন তো একজন বাড়াবাড়ি করে ফেলে। ফোন দিয়ে যা বলে। সেসব শুনে আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। প্রত্যেক দিনের মতো কল ধরে আমি শান্তভাবেই বললাম,“হ্যালো স্যার। আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
সে তার কোন সমস্যার কথা তো বললোই না। উল্টো বাজে গালা গালি দিতে শুরু করেছে। সে যতই বাজে কথা বলছে আমি ততই শান্ত ভাবে বলছি,“প্লীজ স্যার আপনার সমস্যাটা আমাদের সাথে শেয়ার করুন। আমরা অতি দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করবো।”
আমার কোন কথা সে কানেই নিচ্ছে না। সে তার মতো গালি দিয়ে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে বাবা, মা তুলে গালি দিয়ে দেয়। আমারও মেজাজ হারিয়ে যায়। আমি উত্তেজিত হয়ে বলি,“বেয়াদব মুখ সামলে কথা বল।”

তৎক্ষনাৎ আমার পাশের জন আমার কথা শুনে আমাকে সরিয়ে দিয়ে ফোনটা সে নেয় কানে। আমাকে শান্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলে,“আমি দেখছি।”
আমি চুপ করে যাই। সেও তার সমস্যার কথা জানতে চায়। কিন্তু সেই লোকটা সমস্যা তো বলছেই না। উল্টো বাজে কথা বলেই যাচ্ছে। যেটা দেখে আমার কলিগ ফোনটা কেটে দেয়। অতঃপর আমাকে বলে,“কোন ক্লাইন্টের সঙ্গে এভাবে কথা বলা যাবে না। এটা ম্যানেজারের কানে গেলে সে খুব রাগ করবে।”

“মানে? সে যা বলেছে তাতে শান্ত থাকা যায়?”
আমার এই কথায় আমার কলিগ খুব ভালোভাবে বোঝালো। সে বললো,“প্রথম প্রথম তাই এমন হচ্ছে। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। যাই হোক এখানে জব করা যে বেশ ধৈর্যের তা তো এই ক’দিনে বুঝেছো। সেজন্য বলবো কথাবার্তা একটু বুঝে বইলো।”

আমাদের কথার মাঝে ম্যানেজার চলে আসে। ইতিমধ্যে তার কাছে কমপ্লেন চলে গিয়েছে। লোকটা অভিযোগ জানিয়ে দিয়েছে। ম্যানেজার এসে আমার কথা না শুনে খুবই চিৎকার চেঁচামেচি করে। তার এক কথা,“কাজ করতে না জানলে এখানে আসছো কেন? এটা তোমাদের বাড়ি পেয়েছো যে যা খুশি বলবে? কথাবার্তায় কোন প্রফেশনালিজম নাই।”
সে আমাকে ইচ্ছেমতো ঝাড়লো। রতন এসব শুনে এপাশে আসে। সে আমার হয়ে বলে,“স্যার ওকে ক্ষমা করে দিন। নতুন মানুষ তাই বুঝতে পারেনি।”
এটা শুনে ম্যানেজার রতনের উপরই চিৎকার শুরু করে। রতন তার কথা শুনে চুপ করে যায়। ম্যানেজার আমাদের কথা শুনিয়ে চলে যায়। সে চলে যেতে আমি নিজের ডেস্কে বসে বিরক্ত হলাম। এভাবে কেউ মজা করার জন্য, নিজের খুশির জন্য কাউকে ফোন দিয়ে এমন ব্যবহার করে? পরবর্তীতে যা শুনলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এখানে আমি ছেলে বলে বেঁচে গেছি। সত্যি বেঁচে গেছি। মেয়েদের জন্য এসব অহেতুক কল আরও বিরক্তির। তাদের ফোন দেওয়ার পর মেয়ে কন্ঠ পেলেই অনেকে নোংরা কথা বলা শুরু করে। এদের কথা শুনে তাও সবাইকে চুপ থাকতে হয়। এখানে তাদের অপরাধ অপরাধ নয়। কিন্তু যারা কাজ করে তাদের ব্যবহার খারাপ হওয়াটা অপরাধ।

এই চাকরির জীবনটা যে খুব খারাপ হতে চলেছে তা বুঝে গেলাম। এই চাকরির দোষ দিয়ে লাভ নেই। সব চাকরিতেই এমন বকাঝকা থাকে। সবগুলোতেই আমাদের মানিয়ে নিতে হয়। তাছাড়া দিনশেষে সবারই পরিবার আছে। সেই পরিবারকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য অবশ্যই চাকরি থাকাটা জরুরি। সেজন্য কর্মস্থলে এমন কিছু ব্যবহার না চাইতেও মেনে নিতে হয়।

রতন বেশ কিছুদিন ধরে অফিসে আসছে না। ফোনও ধরছে না। ম্যানেজার তার খোঁজ করছিলো আমার কাছে। ম্যানেজার তো সোজা বলে দিয়েছে,“এভাবে বন্ধ দিলে তাকে আর চাকরিতে রাখা যাবে না।” আমি এসব শুনে রতনের বাড়ি যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় হয়ে ওঠেনি। তার দু’দিন পর খবর এলো রতন আত্ম হত্যা করেছে। এই কথাটি শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রতনের সঙ্গে শেষ যেসময় দেখা হয়েছিলো সেই সময়ে তাকে মনমরা লাগছিলো। কিন্তু তাই বলে যে সে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেটা আমার কল্পনাতেও আসেনি। এই তো সেদিন রতন জীবন নিয়ে কত কথা বললো। আর সে কি-না এমন কাজ করলো। খবর পেয়ে দ্রুত রতনের বাড়ি যাই। রতনের মৃ তদেহ পড়ে আছে মেঝেতে, পাশে তার বাবা-মা কান্না করছে। তাদের কথা দ্বারা বুঝতে পারলাম, এখানেও একই সমস্যা। ছেলেকে এত পড়ালেখা করিয়েছে মাস শেষে হাজার দশেক টাকার বেশি টাকা দিতে পারে না। তাতে সংসার চলে? কেমন চাকরি করে সে? এটাকে তো বেকারই বলে। ঘরের মধ্যে রতন যে মানসিক অশান্তিতে ছিলো তা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। এভাবেই কিছু কিছু মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা ভাগ্যের কাছে হার স্বীকার করে চলে যায়। শান্তও যদিও এই ভুল করার কথা ভাবছিলো। কিন্তু শান্ত তা করেনি। এখন রতনের পরিবারকে দেখে শান্ত বুঝে গেছে, তাকে ভাগ্যের কাছে পরাজয় স্বীকার করলে চলবে না। তাকে লড়াই করে যেতে হবে। রতনের বাবা-মায়ের কথা শুনে শান্ত কিছুটা ভাবনা মগ্ন হলো। আজ রতনের বাবা বলছে,“ছেলেটা যা করছিলো তাই বেশ ছিলো। না খেয়ে তো থাকতাম না। কেন যে ছেলেটাকে ভালো জব, বেশি টাকা সংসারে দিস না কেন বলে কথা শুনিয়েছি? আমার ছেলের মৃ ত্যুর জন্য আমিই দ্বায়ী। আমার দোষ সব। আমি এসব না বললে আমার ছেলেটা বেঁচে থাকতো।”
আহা! জীবন কত গভীর! বেঁচে থাকতে কেউ জীবনের মূল্য বুঝে না। ম রে গেলে সবাই বুঝে। তাই না? একদম তাই।
___
পরিশেষে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের শেষ পরিনতি হয় রতনের মতো নয়তো এই সমাজে অধম্য লড়াই করে যেতে হয়। আমি লড়াইটাকেই বেছে নিয়েছি। দিন যায়, দিন আসে। পরিশ্রম করে সংসারটাকে টিকিয়ে রেখেছি। মাঝে মাঝে হঠাৎ করে চাকরি চলে যায়। তখন হতাশা, চিন্তায় ইচ্ছে করে রতন হতে। তবে পরিবারের সবার মুখগুলো মনে পড়লেই ইচ্ছেটা শেষ হয়ে যায়। তাই আবার লড়াই করতে হয়। নতুন চাকরি নেই, নতুনভাবে এগিয়ে যাই। এটাই মধ্যবিত্ত জীবন। যাদের এভাবেই লড়াই করে বাঁচতে হয় নয়তো ম রতে হয়। মধ্যবিত্তের এই লড়াই চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। এই গল্পও তেমনভাবে চলমান থাকে। মধ্যবিত্তদের গল্প কখনো শেষ হয় না।

(সমাপ্ত)