#মধ্য_রাতের_চাঁদ |১১|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
সময়টা রোদঝলমলে দুপুরবেলা। বেশ কয়েকজন আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করা হয়েছে। মেহমানদের প্রাণবন্ত আলাপ আর বাচ্চাদের কোলাহলে ড্রয়িংরুমের দিকটা সরগরম। প্রত্যাশা গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দূর থেকেই চোখে পড়ল; টেবিলে শরবতের গ্লাস, বেশ কয়েকটা অচেনা মুখ। নীলা হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করছে। প্রত্যাশা খানিক দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। আচমকাই শর্মিলা ডাক দিলেন,
-” প্রত্যাশা! ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো, পরিচয় করিয়ে দিই।”
প্রত্যাশা হালকা হাসি ঠোঁটে এনে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন নীহারিকা। চোখে একরাশ কঠিন দৃঢ়তা। দারাজ স্বরে বললেন,
-” দাঁড়াও।”
প্রত্যাশা থেমে, কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে নীহারিকার দিকে তাকাল। বুঝে ওঠার আগেই নীহারিকা ওর কব্জি চেপে ধরলেন। গলায় আদেশমাখা কর্কশতা নিয়ে বললেন,
-” আমার সঙ্গে চলো।”
প্রত্যাশা হঠাৎ নীহারিকার এরুপ আচরণ ঠাহর করতে পারল না। নীহারিকা শক্ত হাতে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের রুমে। পরিস্থিতিটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে প্রত্যাশা চুপচাপ হেঁটে গেল। শর্মিলা কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবলেন–আপার আবার কী হলো? হুটহাট আপার যে কী হয় না। বুঝতে পারি না। মেয়েটা কোনো ভুলটুল করেনি তো। এসব ভেবে বেশ চিন্তায় পড়ে যান শর্মিলা। নীলা একটু মনেমনে খুশিই হলো– প্রত্যাশা বোধহয় কিছু একটা আকাম করেছে। তাইই মা এখন ওকে ব’কবে।
প্রত্যাশার আপাদমস্তক পরখ করলেন নীহারিকা। পরনে হাঁটু অবধি টপস, লেডিস জিন্স। কিছু চুল পেঁচিয়ে প্রজাপতি ব্যান্ড দিয়ে একপাশে আটকানো। একদম বাচ্চা-বাচ্চা লাগছে।
-” এইটা কী পরেছো তুমি? এত বড় মেয়ে হয়ে কীসব বাচ্চাদের ফ্রক পড়েছো! তারউপর বাড়িতে মেহমান এসেছে।”
-” বড় আন্টি এইটা তো টপস, ফ্রক নয়।”
নীহারিকা আলমারি খুলে খুঁজে খুঁজে শাড়ি, প্রয়োজনীয় জিনিস আর গহনা বক্স বের করে বিছানায় নামালেন।
-” বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। উনারা এ বাড়ির ছোট বউকে দেখতে চাইছেন, তাই বউয়ের মতো হয়ে যাও। এখন জলদি এই শাড়ি আর গহনাগুলো পড়ে তৈরি হয়ে নাও।”
নীহারিকা এই বলে চলে যেতে নিচ্ছিল। প্রত্যাশা মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে উঠল,
-” আমি তো শাড়ি ঠিকঠাক পড়তে পারি না।”
কয়েক মূহুর্ত নিরুত্তর থেকে ইশারায় দেখিয়ে বললেন,
-” ওগুলো পড়ে আসো। আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
প্রত্যাশা হাসিমুখে প্রয়োজনীয় জিনিস হাতে নেয়। নীহারিকা ফের বললেন,
-” লম্বায় তো আমার সমানই। পেটিকোটের সাইজ ঠিকই হবে আশাকরি। আর.. ব্লাউজটা তোমার গায়ে একটু ঢিলা হতে পারে। যদিও এটা অনেক আগের ব্লাউজ ছিলো, গায়ে লাগেনি বিধায় পড়া হয়নি। তবুও রেখে দিয়েছিলাম।”
.
.
নীহারিকা সিল্কের লাল রঙের শাড়িটা হাতে তুলে নিলেন। প্রত্যাশা চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
-” শাড়িটাও বুঝি আগে পড়েননি। নতুন ভাঁজ খুলছেন দেখছি।”
নীহারিকা প্রত্যুত্তর না দিয়ে ভাঁজ খুলে কোমরের চারপাশে জড়াতে শুরু করলেন। এক কোণা যখন কোমরে গুঁজতে নিলেন, প্রত্যাশা হঠাৎ নড়াচড়া করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। নীহারিকা কপালে ভাঁজ ফেলে প্রত্যাশার দিকে চাইল। চোখের ভাষায় বোঝালেন–কী সমস্যা? প্রত্যাশা নড়াচড়া করতে করতে বলল,
-” উফ্! বড় আন্টি সুড়সুড়ি লাগছে তো!”
নীহারিকা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। একে নিয়ে চলা মুশকিল। বা’নরের মতো নড়তে থাকল প্রত্যাশা। নীহারিকা বিরক্তি নিয়েই কোনো রকমে গুঁজে দিলেন। পরপর কুঁচি দিতে দিতে গম্ভীর স্বরে বললেন,
-” তোমার মা কিছুই শেখায়নি বুঝি? শাড়ি পড়া, তারপর কাকে কী সম্বোধন করতে হয়? এসব শেখায়নি?”
প্রত্যাশা দাঁত কেলিয়ে বলল,
-” শিখিয়েছে তো। তবে আম্মু বলেছে, ‘সব আগেভাগে শিখে ফেললে শাশুড়ি শিখাবে কী? তখন তো তারা ভাববে, বউ আবার আমাদের চেয়ে বেশি জানে।’ তাই কিছুটা খালি রেখেছে, আপনার স্পেশাল ক্লাসের জন্য!”
আঁচলটা গুছিয়ে কাঁধে পিনআপ করতে করতে নীহারিকা বললেন,
-” শোনো, এই ‘বড় আন্টি’ বলে ডাকা বন্ধ করো। নীলাশা যেভাবে সম্বোধন করে এরপর থেকে তুমিও সেভাবে..”
-” ঠিক আছে বড় আ…”
এতটুকু বলেই জিভে কা’মুড় দেয় প্রত্যাশা। শুধরে নিয়ে বলল,
-” অপসসস স্যরি মা!”
নীহারিকা নিজ হাতে গহনা আর বালা জোড়া পরিয়ে দিলেন প্রত্যাশার হাতে। প্রত্যাশা কিছুটা সংকোচে বলল,
-” এত কিছুর দরকার ছিল না। না মানে গহনা তো হয় খুব শখের। এগুলো নিশ্চয় আপনার খুব শখের। যদি না বুঝে কোনোটা হারিয়ে ফেলি। তাই…”
-” এগুলো আজ থেকে তোমার। অনেক আগেই গড়ে রেখেছিলাম–আমার নীরবের বউয়ের জন্য। নীলাশার টা ওর বিয়ের দিনই দিয়েছিলাম। তোমাদের বিয়ে তো হঠাৎ করে হয়ে গেল। তাই দেওয়া হয়ে ওঠেনি।”
এটুকু থেমে,
-” হারিয়ে ফেলা এটা ভালো কথা নয় মা। সবকিছু যত্ন সহকারে আগলে রাখতে হয়। আগলে রাখাটাই ক্রেডিট। হারিয়ে ফেলা নয়। ঠিক গহনার মতো বর, সংসারকেও আগলে রাখতে হয়।”
______________
ড্রয়িংরুমে অপরিচিত মানুষের ভিড়ে প্রত্যাশার ভালো লাগছিলো না। লাঞ্চ করে অল্প সময় কাটিয়েই রুমে চলে আসে। লাঞ্চ করতে বসে তো একজন জিজ্ঞেস করে বসলেন–নীরব কখন আসবে? প্রত্যাশা সরল মনে জানি না বলে। এটা নিয়ে অন্যজন তো আবার ঠেস দিতে বাদ দিলেন না–ওমা, সে কি কথা। বর কখন আসবে জানো না। আবার বর ছাড়াই আগেভাগে লাঞ্চ করতে বসেছো। মহিলার ভাগ্য ভালো প্রত্যাশা মুখ খোলার আগেই নীহারিকা বেগম বলেন–আমিই ওকে বসতে বলেছি। নীরব ডিউটাতে ব্যস্ত থাকে…তাই অযথা বারবার ফোন দেওয়া ওর পছন্দ নয়।
নীরব ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যাওয়ার পর প্রত্যাশা সারা ঘরে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছে। কিন্তু কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। প্রত্যাশা ভেবে নেয়–ওমন রসকষহীন পুলিশের প্রেমিকা আছে এটা ভাবা বিলাসিতা বৈ কিছু নয়। ব্যাটার কপালে তো বউই টিকতো না। আমি ছাড়া অন্যকেউ হলে, এই এক সপ্তাহও হতো না, হুঁ।
ভাবনার মাঝে পরী দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে লন্ড্রি থেকে দেওয়া নীরবের শার্ট-প্যান্ট প্রত্যাশার হাতে দিয়ে বলে– খালাম্মা সব তুইলা রাখতে কয়ছে। প্রত্যাশা কাবার্ড খুলে তুলে রাখল। হঠাৎ সাদা শার্টের দিকে তাকাতেই মাথায় দুষ্টুমি চাপল। সাদা শার্টটা গায়ে জড়াল। শার্টের বোতামগুলো খোলা, ওর শরীরের সঙ্গে আলগা হয়ে উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। এদিক-ওদিক বাঁকা হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় প্রত্যাশা। দুষ্টু হেসে লাল রক্ত জবার ন্যায় রঙিন করা ঠোঁটজোড়ার ছাপ ফেলে শার্টের কলারে। সেদিন এই সাদা শার্টটা পড়েই বুঝি শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল জনাব। প্রত্যাশা ভাবে–লোকটা গম্ভীর, রষকষহীন হলেও, দেখতে হেব্বি আছে। হ্যান্ডসামের বউ হতে পারা চারটিখানি কথা নয়। ফ্রেন্ডদের সামনে বেশ ভাব নিয়ে বরকে প্রেজেন্ট করা যাবে। এসব ভেবে ওর ভালোই লাগল।
ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নীরবের সানগ্লাস হাতে নেয় প্রত্যাশা। আয়নার দিকে চেয়ে চোখ টিপে চশমাটা চোখে দিয়ে সুর করে গাইল,
-” হ্যায় ও হ্যান্ডসাম সোনা সাবসে, মেরে দিল কো গ্যায়া লে কার…
গাইতে গাইতে প্রতিটি পায়ে যেন ছন্দ জড়িয়ে যায়। ধীরে সুস্থে ঘূর্ণি দেয় মাথায়, পরপর দুইহাত এক করে গালের এপাশে আবার ওপাশে ধরে গায়,
-” মেরি নিন্দ চুরা নে উসনে, ওর খ্বাব গ্যায়া দে কার…”
চোখে-মুখে ছেলেমানুষি দুষ্টুমি নিয়ে,
-” আব ইয়ে নয়না বোলে ইয়ার, বলো ইয়ে হি লাগাতার…”
শরীর বাঁকিয়ে একপাশে হেলে পড়ে,
-” কউই চাহে কিতনা রোকে কারুঁংগি প্যায়ারআরআর…”
কোমড় দুলিয়ে দু’পাশে হাত নাড়িয়ে,
-” মেরে সাঁইয়া সুপারস্টার, মেরে সাইয়া সুপারস্টার ম্যায় ফ্যান হুয়ি উনকি ও মেরে সাঁইয়া সুপারস্টার। ম্যায় ফ্যান হুয়ি উনকি মে’রেএএ…”
একহাত কোমড়ে অন্যহাত গালে রেখে ঘুরতে গিয়ে, গলার স্বর আঁটকে যায়, চোখ দু’টো বড়বড় হয়ে যায়। দরজার ফাঁকে নীরব দাঁড়িয়ে। প্রত্যাশার মুখে ঝট করে লজ্জার ছায়া ছড়িয়ে পড়ে। চশমাটা খুলে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে। শার্টটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে দুপা পেছনে সরে যায়। ত্রস্ত চোখ নামিয়ে নেয়। ফোনে কিছু একটা করে নীরব নির্লিপ্ত ভঙিতে ভেতরে এগিয়ে আসে। প্রত্যাশা মূক বনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। বিছানায় বসে, পায়ের উপর অপর পা তুলে নীরব মোজা খুলতে খুলতে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। বলল,
-” ডান্স স্টেপস সুন্দর হচ্ছিল। থামলে কেনো? সুপারস্টার এর সাথে কো-স্টার হিসেবে তোমাকে মানাবে কী না! এইজন্য হলেও পুরোটা দেখা দরকার ছিলো।”
প্রত্যাশা তড়িৎ মাথা তুলে চাইল। বলল,
-” শুনুন, এটা জাস্ট গান। আপনি আবার ভেবে বসবেন না, আপনাকে ভেবে গেয়েছি। আর না তো গানের লাইনগুলো আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলা।”
নীরব হালকা হাসে, চোখে একটু কৌতুকের ঝিলিক। বলল,
-” আরে না না, আমি তো এমন কিছু ভাবিনি। তবে গানের লাইনগুলো তুমি এত মন দিয়ে গাচ্ছিলে যে, মনে হচ্ছিল কাউকে ভেবেই। এখন তুমি যদি এক্সট্রা সিরিয়াস হয়ে আমাকে ডিসক্লেইমার দাও, তাহলে তো আমার সন্দেহ জাগে; সত্যিই কি আমি ছিলাম না তোমার সাঁইয়া সুপারস্টার এ?”
নীরবের থেকে খানিকটা দূরত্বে বিছানায় বসল প্রত্যাশা। দুইহাত বিছানায় ঠেস দিয়ে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলল,
-” উঁহু! ছিলেন না। ওইযে বললাম জাস্ট গান।”
লাল শাড়ির উপর সাদা শার্ট। নীরব চেয়ে চেয়ে দেখছে। প্রত্যাশার দিকে তাকিয়েই বিজ্ঞের মতন মুখাবয়ব করে বলল,
-” ওহ্।”
-” হুম।”
প্রত্যাশা হেসে বলল। নীরব নিটোল চাহনিতে প্রত্যাশার হাসিটা দেখল। পরপর ফ্রেশ হতে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল। কিছু ভেবে পিছুনে তাকাল। প্রত্যাশা শার্ট খুলতে ব্যস্ত। নীরবের ঠান্ডা স্বরে প্রত্যাশার হাত থেমে গেল,
-” প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশা চোখ তুলে চাইল। এই প্রথম নীরবের মুখ থেকে নিজের নামটা শুনল। আগে শুনেছে বলে মনে করতে পারল না। ডাকটা শান্ত, অথচ কেমন গাঢ় স্বরে ছিলো। প্রত্যাশা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
-” হুঁ।”
ঠোঁটের পাশে স্মিত হাসি ছড়িয়ে নীরব বলল,
-” হাসলে তোমাকে সুন্দর লাগে!”
বাদ্যযন্ত্রের সুরের মতোই বাক্যটি রিনিঝিনি করে বাজতে থাকল প্রত্যাশার কানে। নীরব দ্বিতীয় কথা না বলে ফ্রেশ হতে যায়। ‘হাসলে ওকে সুন্দর লাগে’ এটা আব্বু-আম্মু ছাড়া কেউ বলেছে বলে মনেহয় না। যদিও তাঁদের বলা কথাগুলো বরাবরই সান্ত্বনার মতো লাগত। কারণ বেশিরভাগ মানুষই বলে–হাসলে ডান পাশের গজ দাঁতটা স্পষ্ট দেখা যায়। আর এই গজ দাঁত নাকি সৌন্দর্যের অপূর্ণতা।
এইতো, কিছুক্ষণ আগেই এক অতিথি হইচই করে বলে উঠেছিলেন–‘আরে, নতুন বউয়ের তো দেখি গজ দাঁত!’
বলবার ভঙ্গিটা এমন ছিল যেন এটা কোনো বড় দোষ!
অবচেতনেই মনটা ভার হয়ে এসেছিল প্রত্যাশার।
তবে এই মুহূর্তটা আলাদা। চিরচেনা সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অপূর্ণতার জায়গায় এবার এক অপ্রত্যাশিত প্রশংসা যেন নিঃশব্দে এসে বসে গেল। নীরবের ছোট্ট মন্তব্যে, প্রত্যাশার মনটা ভরে উঠল অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে।
___________
রাত্রি এগারোটা বাজতে চলেছে। প্রত্যাশা বিছানায় আধশোয়া, হালকা পেটব্যথায় চোখে ঘুম নেই। নীরব আর নিভান কিছুক্ষণ আগেই এয়ারপোর্ট থেকে বাবাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরেছে। চোখবুঁজে ছিলো প্রত্যাশা হঠাৎ শব্দ পেয়ে চোখ মেলে নীরবকে দেখে উঠে বসল। কয়েকটা প্যাকেট বিছানার ধারে নামিয়ে রাখল নীরব। বলল,
-” মেয়েদের পছন্দ সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। জানি না, এগুলো তোমার পছন্দ হবে কিনা। তবুও আজকের মতো নিজের রুচিটাই তোমার উপর আরোপ করলাম। পরে না হয় পছন্দ মতো করে নিও।”
প্রত্যাশা অবাক হলো। প্রত্যাশাকে আরেক দফা অবাক করে নীরব ছোট্ট হলুদ খামটা পকেট থেকে বের করে বলল,
-” এটা রাখো। তোমার পছন্দ মতো শপিং করে নিও।
প্রত্যাশা ভ্রু গুটিয়ে প্রশ্ন করল,
-” এটা বুঝি বউয়ের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব থেকে দিচ্ছেন।”
নীরব একটু হাসল। পরপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
-” বর হিসেবে তোমার সবটুকু চাওয়া পূরণ করাটাই তো আমার ন্যূনতম দায়িত্ব। উমম! এটাকে ভরণ-পোষণ বললে আমার তেমন আপত্তি নেই। তবে আমি বলবো, একধরনের অভ্যাস করতে চাইছি। এখন থেকেই অভ্যস্ত হতে চাইছি। তোমার দেখভাল করার অভ্যাসে নিজেকে অভ্যস্ত করতে চাইছি। আশাকরি তুমি সুযোগটা দিবে।”
প্রত্যাশা ভাবল–এএসপি সাহেব খুব ধূরন্দর। ঠিক এমনভাবে বলল, যাতে আমি না করতে না পারি।
.
.
.
.
নীরব ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন স্ক্রল করছে। এমন সময় প্রত্যাশার ফোনটা বেজে উঠল। জেনারেল মোডে ছিলো। ঘরের নিরাবতা চিঁড়ে রিংটোনে সেট করা–Main to sheher di thandi Shabnam haan. Gulshan ka itar churau… গানটা বাজতে লাগল। রিংটোনে এমন গান শুনে নীরবের গলায় কফি আঁটকে আসার জোগার। কোনো রকমে খুকখুক কেশে গলাটা ঠিক করল নীরব। প্রত্যাশা ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে রিসিভ করল। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হ্যাপি প্রশ্ন করল,
-” এই প্রত্যাশা কই তুই? কলেজ আসলি না। বিকেলে প্রাইভেটেও তো আসলি না। গ্রুপেও দেখছি না। হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে গেলি রে?”
-” শ্বশুর বাড়িতে।”
হ্যাপি বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল,
-” শ্বশুড় বাড়ি? হোয়াট?”
-” আপুর শ্বশুরবাড়ি।”
-” ওহ, তাই বল। এমনভাবে বললি..আমি তো ভেবেছিলাম। আচ্ছা যাক গে…শোন কেমিস্ট্রি স্যার তো খাতা দিয়েছে। সেদিন পরীক্ষা নিলো না..কী হয়েছে জানিস? স্যার তো আমাদের উপর খুব চটেছে। সে কী হম্বিতম্বি করলেন। বলেছেন, তোদের পাঁচ জনের খাতায় সেইম সেইম উত্তর।”
প্রত্যাশা এক হাতে পেট চেপে তেতে উঠল,
-” সেইম উত্তর হবে না তো আলাদা উত্তর হবে। আরে বলতে পারলি না, স্যার আপনি কী আমাদের পাঁচজনের আলাদা আলাদা প্রশ্ন দিয়েছেন? যে উত্তর আলাদা হবে আশা করছেন।”
-” আরে ধূর। বুঝলি না তুই। স্যার বলেছেন–তোরা পাঁচজন একেবারে কপি পেস্ট করে খাতায় তুলেছিস। ভুল গুলোও সেইম। তোরা পাঁচজন একেঅপরকে টুকলি করে লিখেছিস। তাই তোদের এবার নম্বর দেইনি। ফেইল তোরা। খাতা তোদের বাবা-মার কাছে যাবে।”
-” ওওও..”
অপ্রস্তুত গলায় বলে প্রত্যাশা। হ্যাপি ভুলগুলো বলছিলো। এক সময় হাসতে হাসতে বলল,
-” শোন দোস্ত, স্যার তো পুরা আ’গুন! বললেন–তোরা মৌল চিনতে পারিস না। ভুলভাল মৌল মিশিয়ে এমন বিক্রিয়া লিখছিস। খাতায় দেখে মনে হচ্ছে পরীক্ষাগারে করলে তো তখুনি ব্লাস্ট হতো।”
আরো কিছু কথা শেষ করে প্রত্যাশা ফোনটা বিছানায় নামিয়ে রাখে। পেটের ব্যথাটা ক্রমশ অসহনীয় রূপ নিচ্ছে। বিছানায় বসে দুইহাতে কোমর চেপে ধরে। মাথাটা নিচু করে একরাশ যন্ত্রণায় মৃদুস্বরে বলে ওঠে প্রত্যাশা,
-” উফ্ফো।”
নীরব কফির মগ রেখে এদিকেই আসছিল। প্রত্যাশার কষ্টময় মুখ দেখে ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কাছে এসে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” প্রত্যাশা, কোনো সমস্যা?”
প্রত্যাশা কিছু বলতে পারে না, শুধু মাথা নেড়ে না বোঝায়। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যথায় কপাল কুঁচকে যাচ্ছে ওর। নীরব পাশে বসে ওর দুই বাহু আলতো করে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। কপালে ঘাম জমে উঠেছে প্রত্যাশার, মুখমণ্ডলে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। নীরবের মন দুশ্চিন্তায় ভরে উঠল।
-” কী হয়েছে বলো? ডক্ট..”
বাক্যটা শেষ করার আগেই প্রত্যাশা অস্পষ্ট স্বরে বলে,
-” তেমন কিছু নয়।”
তবে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা কিছুতেই খুলে বলছে না। নীরব একটু ভেবে নিয়ে নিচু স্বরে সাবধানে জিজ্ঞেস করে,
-” মেয়েলি সমস্যা?”
প্রত্যাশার মুখ লজ্জায় রঙ হারায়। কিছু বলতে পারে না। চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে হালকা করে সম্মতি জানায়। মাত্র কয়েকদিন হলো বিয়ে হয়েছে, সম্পর্কটাও এখনো সাবলীল হয়ে ওঠেনি। এমন ব্যক্তিগত বিষয়ে লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। নীরব আর কোনো প্রশ্ন করে না। এক মুহূর্ত দেরি না করে ফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
.
.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রত্যাশা চোখেমুখে পানি দিয়ে একটু স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। তন্মধ্যে নীরব হন্তদন্ত পায়ে রুমে ঢোকে। হাতে একটা ফার্মেসির প্যাকেট। নিঃশব্দে সেটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে দেয়। তারপর আরও একটা ছোট প্যাকেট হাতে দিয়ে নরম গলায় বলে,
-” এখানে পেইন কিলার আছে। এক্ষুনি খেয়ে নাও। ডোন্ট ওরি, দ্য পেইন উইল ইজ সুন।”
প্রত্যাশা কিছু বলতে পারে না। লজ্জা, কৃতজ্ঞতা আর অস্বস্তির এক অদ্ভুত মিশেলে ও শুধু প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখল। নীরব ওর অবস্থাটা বুঝে, যেন কিছুই না ঘটেছে এমন ভঙ্গিতে ব্যালকনিতে চলে যায়। যেন ওর লজ্জাটা আর না বাড়ে। নীরবের পিঠের দিকে প্রত্যাশা তাকিয়ে রইল। প্রত্যাশার বুকটা একটু হালকা লাগল। এতটা কেয়ার, এতটা বুঝে চলা দেখে প্রত্যাশার মনের ভিতর একফোঁটা কৃতজ্ঞতা জমে উঠল। সাথে ভালোও লাগল বটে।
প্রত্যাশা বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে। ঘুমের অভিনয় করে আছে। নীরব নিঃশব্দে এসে বিছানার পাশে দাঁড়াল। ফ্যানের বাতাসে কয়েকটা চুল প্রত্যাশার মুখের উপর উড়াউড়ি করছে। নীরব ঝুঁকে একহাত দিয়ে চুলগুলো সরাতে নেয়। এমন সময় প্রত্যাশা ঝট করে চোখ মেলে তাকায়। নীরব অপ্রস্তুত ভঙিতে হাত থামিয়ে নেয়। তারমানে ঘুমায়নি ও। নীরব মুখাবয়ব স্বাভাবিক করে সাফাই দিতে জড়তা নিয়ে বলল,
-” ভ-ভাবলাম চুলগুলো তোমায় ডিস্টার্ব করছে..তাই সরিয়ে দিতে।”
প্রত্যাশা মনেমনে হাসল। হঠাৎ প্রশ্ন করল কৌতুহল নিয়ে,
-” আচ্ছা আব্বু তো সকাল হলেই আমাকে নিয়ে যাবে। চলে যাওয়ার পর.. এএসপি সাহেব কী বউকে মিসটিস করবে?”
নীরব উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নেয়। শুধালো,
-” হাউ আর ইউ ফিলিং নাউ?”
-” বেটার। থ্যাংকস।
_____________
পরেরদিন…বিকেল বেলা। প্রীতিদের ড্রয়িংরুমে নীরব বসে। হাঁটুতে কনুই রেখে দুইহাত মুখের কাছে ধরে গভীর ভাবনায় মশগুল– তার ভাইয়ের এত পরিবর্তন কী এমনি এমনি হয়েছে? নাকি সে যেটা ধারণা করে সেটাই সঠিক? প্রশ্নের উত্তর অজানা। আজও সবটা ধোঁয়াশা।
পরিবারের কেউই নীবিড়ের বিয়ের পর যোগাযোগ রাখেনি ওর সাথে। জমজ ছিলো ওরা দুইভাই। একসাথে সবসময় থাকা, একই স্কুলসহ একই ভার্সিটিতে পড়েছে। তবে সাবজেক্ট ভিন্ন ছিলো। হলে একসাথে থেকেছে। প্রীতি ওদের ব্যাচমেট। নীবিড় প্রেমে জড়াল, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার আগেই বিয়ে নিয়ে এক মহা ঝামেলা হলো। তারপর আরো ঝামেলা মিলে পরিবারের সবার সাথে নীবিড়ের যোগাযোগ না হলেও, নীরবের সাথে মাঝেমাঝে হতো। কিন্তু দেড় বছর ট্রেনিংয়ের ব্যস্ততার জন্য দুইভাইয়ের আর যোগাযোগ হয়নি। ট্রেনিং শেষে চাকরিতে জয়েন করতে এসে খবর এলো–নীবিড় গভীরভাবে ড্রা’গে আ’সক্ত হয়ে পড়েছে। আচরণ পুরো বদলে গেছে—রাগী, রাগ হলে ভাঙচুর করা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। মেয়ে ইচ্ছে ছিলো নীবিড়ের প্রাণ। প্রীতি বিদেশি প্রজেক্টে চাকরি করত। মেয়েকে সময় দিতোই না বলা চলে। ছোট থেকেই নীবিড়ই ইচ্ছেকে বেশি দেখভাল করত, খেলা করত, আদর করত, খুব বেশিই মিশতো। ইচ্ছেও বাবার নেওটা ছিলো। ড্রাগের প্রতিক্রিয়ায় খুব তাড়াতাড়িই নীবিড় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বসে। নীরব ট্রেনিং শেষে এসে এসব শুনে হতভম্ব। কিছু সন্দেহ তীব্র হয়। তারপর নিজে নীবিড়ের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
এদিকে বাবার অনুপস্থিতিতে ছোট্ট ইচ্ছের মানসিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটে। কারো সাথে কথা বলতো না, হাসতো না। ছোট্ট চঞ্চল ইচ্ছের চঞ্চলতা হারিয়ে যায়। নীরব যখন ইচ্ছেকে দেখতে আসলো। ইচ্ছে তখন নীরবকেই বাবা ভেবেছিলো। নীরব ভুল ভাঙিয়ে দেয়। তবুও অবুঝ ইচ্ছে পাপাই ভাবতো। এদিকে মেয়ের মানসিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটায় প্রীতি সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেয়। সাথে নীরবও ছিলো। ডক্টর বলেন,
-” ইচ্ছে বাবার অনুপস্থিতিতে RAD রোগে ভুগছে। এরকম চলতে থাকলে ওর সমস্যা বাড়বে। ইচ্ছে যেহেতু আপনাকে বাবা ভাবছে। আর আপনার সংস্পর্শে থাকলে কথা বলে, হাসে, অনুভূতি প্রকাশ করে। তাই বাচ্চাটিকে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক হাসিখুশি রাখতে কিছুদিন ওর সাথে অভিনয় করবেন। এটাও একটা থেরাপি। ধীরে ধীরে ইচ্ছে বড় হবে। যখন স্বাভাবিক হবে। তখন…”
ডক্টর আরো কিছু পরামর্শ দেন। নীরবের ভাবনার ছেদ ঘটে ইচ্ছের ডাকে।
-” পাপা…”
ইচ্ছের জন্য আনা চকলেট বক্স দেয় হাতে। প্রীতি উপর থেকে নেমে আসে মেয়ের পিছুপিছু। সিঙ্গেল সোফায় বসল। ইচ্ছে নীরবের কোলের উপর বসে চকলেট খাচ্ছে। টেবিলের উপর একটা খাম। নীরব সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-” ইচ্ছেকে স্কুলে ভর্তির ফরম এনেছি। ফরমটা ফিলাপ করে রাখবে। আমি ফ্রি টাইমে এসে নিয়ে জমা দিবো।”
প্রীতি কিছু না বলে কোন স্কুল, সেসব দেখার জন্য খামটা হাতে নেয়। টেবিল থেকে খামটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ একপাশে থাকা অপর একটা প্যাকেট পরে যায় ফ্লোরে। পরার সাথে সাথে একটা ছবি ফ্লোরের উপর জ্বলজ্বল করতে থাকে। নীরবের দৃষ্টি যায় সেদিকে। ছবিটিতে চেনামুখ দেখতেই কপালে ভাঁজ পরে নীরবের। নীরব ঝুঁকে ছবিটা মাটি থেকে তুলল। কোলে বসা ইচ্ছে খুশিতে ঝুমঝুম করে বলে উঠল,
-” জানো পাপা, মামা বলেছে এটা মামী হবে।”
নীরবের চোখমুখ সেকেন্ডেই শক্ত হয়ে যায়। সাথে হাতের আঙুল আপনাআপনি মুষ্টিবদ্ধ হয়।
#চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |১২|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
নীরব ছবিটা হাতে নিয়ে গভীরভাবে তাকিয়ে ছিল। চেনা মুখ, অপ্রত্যাশিতভাবে এখানে দেখে ওর দৃষ্টিতে বিস্ময়ের ঝলক খেলে যায়। পরপর ইচ্ছের কথা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন নীরব মুহূর্তেই আন্দাজ করে কিছুটা। অনুমান করতেই ওর আঙুলের গিঁটগুলো শক্ত হয়ে যায়। হাত মুষ্টি করে কিছুক্ষণ থম মে’রে রইল। মেয়ের কথা শ্রবণ হতেই প্রীতি তাকাল। নীরবের হাতে ছবিটা দেখে নিজ থেকেই বলল,
-” ভাইয়া পছন্দ করেছে ছবির মেয়েটিকে। ছবি দেখে মায়েরও পছন্দ হয়েছে। আর বড় কথা ভাইয়া নিজে যেখানে পছন্দ করেছে সেখানে আমাদের অপছন্দের কারন নেই। দ্রুতই পাকা কথা বলতে হবে মেয়েটির বাড়িতে।”
এরমধ্যে প্রীতির দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে পি করবে বোঝাতেই প্রীতি মনাকে ডেকে ওয়াশরুমে নিতে বলে। অনুমানটা এখন দিঘির স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার নীরবের কাছে। নীরব একটা জোরালো শ্বাস ফেলল। তারপর চুপচাপ, অদ্ভুত শীতলতা নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসল। চোখদুটি সরাসরি প্রীতির দিকে স্থির করে ঠান্ডা গলায় বলল,
-” তোমার ভাইকে বলবে…”
এক মুহূর্ত থেমে, আঙুলের ফাঁকে ছবিটা ধীরে ধীরে ঘুরাতে ঘুরাতে কণ্ঠটা আরও জমাট করে বলল,
-” তোমার ভাইকে বলবে, অন্যের বউয়ের দিকে তাকানোর আগে আয়নায় নিজের কপালটা দেখে নিতে।”
প্রীতির কপালে ভাঁজ পড়ল। ও কিছুটা রুক্ষ স্বরে বলল,
-” হোয়াট ডু ইউ মিন? ক্লিয়ার করে বলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অন্যের বউ?…তারপর তাকানো.. মানে? কী বলতে চাইছো তুমি?”
-” ডক্টর সাহেবকে বলবে, সে ভুল জায়গায় নজর দিয়েছে। অন্যের বউকে নিজের করার কথা ভাবছে। আই থিংক, সে জানে না। তাই এমনটা হয়েছে। তাকে ক্লিয়ার করে বলে দিবে..”
বলতে বলতে নীরব এবার সোজা হয়ে বসল। পিঠ টানটান। হাতের ছবিটা সামনে বাড়িয়ে আঙুলের মাথা ছবির উপর রেখে এক গাঢ় অথচ ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” সী ইজ ইয়ানূর প্রত্যাশা।”
এক মুহূর্ত থেমে চোখদুটো সংকুচিত করে খুব স্পষ্ট গলায় বলল,
-” মিসেস প্রত্যাশা নীরব। মাই মিসেস। মাই ওমেন। ক্লিয়ার?”
মেঘ বিনা বাজ পড়ার মতোই অবাক হলো প্রীতি। সুশ্রী চেহারা বিস্ময়ে ঠাসা হয়। পাতলা আকর্ষণীয় ঠোঁটজোড়া নেড়ে বিস্ময় ঝরল কণ্ঠস্বরে,
-” তুমি বিয়ে করেছো?”
-” প্রশ্নটা ফুলিশের মতো হলো না?”
পাল্টা প্রশ্নে প্রীতি থতমত খায়। হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” না মানে জানতাম না…তাই!”
নীরব উঠে দাঁড়াল। টি-টেবিলের উপর রাখা বাইকের চাবি হাতে তুলল। পরপর আঙুলের ডগায় চাবিটা ঘুরাতে ঘুরাতে সতর্ক করতে সাবধানী বাণী আওড়াল,
-” ডাক্তার সাহেবকে আমার হয়ে বলে দিবে….বলে দিবে তাকে; ফারদার অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিলে, তার পরিণতি খুব মিষ্টি হবে না। বিলিভ মি। টেল হিম টু ফিক্স হিজ আইজ… বিফোর হি লুজেস দেম ফরএভার।”
আর একটাও টু শব্দটি না করে নীরব গটগট পা ফেলে চলে যায়। ভাইকে থ্রেট দেওয়ায় প্রীতির রাগ মূহুর্তেই সপ্তম আকাশ ছুঁলো।
.
.
.
.
সাঁঝ নামার সাথেসাথে ধরণী অন্ধকারের মোটা চাদরে মুড়িয়ে গিয়েছে। বিশাল রাজকীয় বাড়িটির ড্রয়িংরুমে হঠাৎ করেই ছ্যাঁৎ করে ওঠে কাঁচ ভা’ঙার বি’কট শব্দ। সার্ভেন্টরা আত’ঙ্কে থমকে যায়। ছোট্ট ইচ্ছে টিভির সামনে বসে কার্টুনে মগ্ন ছিল। শব্দের তীব্রতায় ভ’য়ে লাফিয়ে উঠে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে।
সার্থক ততক্ষণে ঘরে ঢুকেছে, মুখে এক ধরনের খসখসে অন্ধকার। চোখ দুটো জ্ব’লছিল রা’গে। বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে প্রত্যাশার বাবার সাথে কথা বলতে পাঠায়। কালকে তাদের মেয়েকে বড় ঘর থেকে দেখতে আসবে। ভদ্রলোক শোনার সাথে সাথে না করে দেন। স্পষ্ট বলেন– এইতো ক’দিন আগেই তাদের মেয়ের আকদ হয়েছে।
এই খবর লোক মারফত শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না সার্থক। প্রচন্ড রা’গ হচ্ছিল। নিজেকে হেল্পলেস লাগছিলো। তারপর বাড়ি ফেরার সাথে সাথে প্রীতি নীরবের দেওয়া থ্রেটসহ সবটা বলে। নীরবের থ্রেট শুনেই মাথায় র’ক্ত চড়ে যায়। রাগে, হতাশায় আর অসম্মানে পু’ড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। রাগে-ক্ষোভে কাঁচের টি-টেবিলে পা তুলে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লা’থি মা’রে। শব্দ করে উল্টে যায় কাঁচের দামি টেবিলটি। পরপর পাশের ফুলদানি ছুড়ে ফেলতেই–সব চূর্ণবিচূর্ণ। কাঁচের ঝনঝন শব্দ যেন সারা ঘর জুড়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ। দূরে হুইলচেয়ারে বসে থাকা তানিয়া খাঁন মনাকে ইশারা করেন। মনা তৎপর হয়ে ইচ্ছেকে কোলে তুলে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়। তানিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-” সার্থ বাবা, শান্ত হ। মেয়েটার যখন আকদ হয়ে গিয়েছে। ছেড়ে দে। তোর জন্য আরও সুন্দরী, আরও যোগ্য মেয়ে খুঁজে আনব রে বাবা।”
সার্থক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরটা যেন আ’গুনে ঝ’লসে যাচ্ছে। চুলের মুঠো ধরে গভীর শ্বাস নিতে থাকে, নিজের রাগ সামলাতে। প্রীতি দু’পা এগিয়ে এল। আলগোছে সার্থকের কাঁধে হাত রাখল। সার্থক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই প্রীতি চোখের ইশারায় আশ্বাস দিল। বলল,
-” কুল ব্রো, কুল। হাইপার হোস না। আমি তোর ফিলিংসটা পুরোপুরি বুঝতে পারছি।”
তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি এনে বলল,
-” মন থেকে যদি একবার কাউকে ভালো লেগে যায়। মা, তখন আর ‘এর থেকেও সুন্দরী’, ‘এর থেকেও ভালো’। এক কথায় তার থেকেও বেটার কাউকে দিয়ে হয় না। তার মতো কাউকে দিয়েও হয় না। যায় না সেই জায়গটা পূরণ করা। সেই জায়গাটা আজীবন অপূর্ণই থেকে যায়। আই নো ওয়েল।”
তানিয়া হতাশ শ্বাস ফেললেন। ভালো করেই জানেন; এরা কম রাগি আর জিদি নয়। ছোটবেলা থেকেই এদের যা পছন্দ সেটাই চাই। চাই মানে চাইই।
____________
সিটি কেয়ার ক্লিনিকের কনফারেন্স রুমে মালিক ডা. রশীদ। যিনি একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। সাথে ক্লিনিকের কয়েকজন ডিউটিরত ডক্টর, স্টাফসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত। নীরবের দুই পাশে সেদিনের দুইজন অফিসার। এএসআই তানভীর নীরবের হাতে কিছু কাগজ দিলো। পুরোরুম জুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নীরব টেবিলের উপর কিছু কাগজ রাখল। বলল,
-” এই রিপোর্টগুলোতে যে ইনফেকশনের কথা বলা হয়েছে, ময়নাতদন্তে তা পাওয়া যায়নি। ভূয়া রিপোর্ট বানানো হয়েছে। ভুল চিকিৎসায় রোগী প্রাণ হারিয়েছে। এটা কার কাজ?”
ডা. রশীদ মুখ শক্ত করে বললেন,
-” অফিসার আপনি পু’লিশ। আইনি ক্ষমতা আছে আপনার। তাই বলে হাসপাতালের ভেতরের ব্যাপারে এত বাড়াবাড়ি করা আপনার কাজ নয়। ভুল তো মানুষেরই হয়। ভুল হয়…”
নীরব থামিয়ে দিল,
-” ভুল যদি একটা জীবন কেড়ে নেয়, সেটা ভুল না, সেটা অপরাধ। আমি জানতে চাই, এই রিপোর্টে কার স্বাক্ষর?”
ড. রশীদ দম্ভ নিয়ে বললেন,
-” পুলিশ হয়ে ডাক্তারদের রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা শোভন নয়। ভুল তো মানুষেরই হতে পারে। রিপোর্ট দেখে কি আপনি চিকিৎসা বুঝবেন?”
-” ভুল যদি রোগীর জীবন নিয়ে খেলে, সেটা বোঝার জন্য চিকিৎসক হতে হয় না। পু’লিশ হিসেবে দায়িত্ব আমার। এখন জানতে চাই, কার স্বাক্ষরে এই রিপোর্ট ছাড় হচ্ছে?”
ড. রশীদের কণ্ঠ এবার কিছুটা থিতু হয়ে এল,
-” দেখুন, বেসরকারি ক্লিনিকে অনেক সময় দ্রুত রোগী সামলাতে রিপোর্টে সামান্য হেরফের হয়ে থাকে। রোগীকে সন্তুষ্ট রাখতে কিংবা হাসপাতালে রাখতে হয়, বুঝতেই পারছেন..”
নীরব চাহনি কঠিন করে বলল,
-” সন্তুষ্ট রাখতে রোগীকে মে”রে ফেলার লাইসেন্স দেয়নি কেউ। এসব রিপোর্টের নামে যেটা চলছে, সেটা চিকিৎসা নয়, ব্যবসা। আর সেই ব্যবসার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ডা. রশীদ বললেন,
-” আপনাদের এই তদন্ত ক্লিনিকের সুনাম ন”ষ্ট করছে। রোগীরা আ”তঙ্কিত হচ্ছে। সাধারন একটা মিস্টেক নিয়ে আপনারা বাড়াবাড়ি করছেন।”
নীরব হেসে বলল,
-” সুনাম তো তখনই থাকবে, যখন এখানে মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরবে। ম’র্গে নয়। ক্লিনিকের সুনাম যদি ভু’য়া রিপোর্ট আর কমিশনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, সেটা ভাঙা দরকার।”
তারপর চোখমুখ কঠিন করে প্রগাঢ় রুক্ষ স্বরে বলল,
-” গত এক মাসে ৫ জন রোগী ভু’য়া রিপোর্টের ভিত্তিতে ভুল চিকিৎসায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একজন মৃ°ত্যু মুখেও পতিত হয়েছে। এরপরও আপনার বলতে লজ্জা করছে না, সাধারণ একটা মিস্টেক। আমাদের কাছে আরো প্রমাণ আছে, কিছু ডাক্তারের সাথে কমিশনের চুক্তি আছে। রিপোর্টে ইনফেকশন লিখে অতিরিক্ত টেস্ট করানো হয়।”
নীরব উঠে দাঁড়াল। বলল,
-” অভিযোগ আর প্রমাণের উপর ভিত্তি করে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হলো। তানভির অ্যারেস্ট হিম।”
তানভির ত্রস্ত উঠে দাঁড়িয়ে,
-” জ্বী, স্যার।”
বলে মালিকের হাতে হ্যান্ডকাফ পড়াল।
.
.
.
.
হঠাৎ পাকা আমের ঘ্রাণে মাছিরা যেমন ভনভনিয়ে আসে, ঠিক তেমনি কই থেকে কয়েকজন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক ছুটে এল। নীরব তখন পু’লিশ সুপারের কার্যালয়ের গেট দিয়ে প্রবেশ করছিল। ওকে ঘিরে ধরে ক্যামেরা, মাইক, ফ্ল্যাশ ঝ’লসে উঠল। একজন সাংবাদিক তাড়াতাড়ি মাইক এগিয়ে বলল,
-” স্যার, সিটি কেয়ার ক্লিনিকের বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নীতির প্রমাণ কীভাবে সংগ্রহ করলেন?”
নীরব ভারিক্কি গলায় সংক্ষেপে বলল,
-” দুর্নীতির গন্ধ ছড়িয়ে গেলে, তার সূত্র ধরে পৌঁছানো কঠিন নয়।”
আরেকজন সাংবাদিক গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” আমরা কি খুব শিগগিরই দো’ষীদের শাস্তি দেখতে পাব?”
নীরব থামল না, এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
-” আইন নিজের পথে হাঁটছে। অপেক্ষা করুন।”
এক মহিলা রিপোর্টার কৌতূহল নিয়ে বলল,
-” স্যার, আগেও সিটি কেয়ার ক্লিনিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। ভূয়া রিপোর্ট, ভুল চিকিৎসার। তখন তো ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল! এবারও কি সেই পরিণতি?”
নীরব থমকে দাঁড়াল। চোখ দুটো কঠিন হল, গলা ভারী,
-” এবার যারা চাপা দিতে আসবে, তাদেরও জবাবদিহি করতে হবে।”
আগেরজন হঠাৎ প্রশংসার সুরে বলল,
-” স্যার, আপনি সত্যিই অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিলেন! যেখানে আগেও অভিযোগ আসলেও, টাকার কাছে সত্য চাপা পরে যায়। সেখানে আপনি একজন সৎ অফিসার হিসেবে নিজেকে প্রুভ করলেন।”
নীরব একঝলক তাকিয়ে হালকা মাথা নেড়ে মৃদু গলায় বলল,
-” এটা আমার দায়িত্ব। দায়িত্ব পালন করেছি। ধন্যবাদ।”
তারপর আর কোনো দিকে না তাকিয়ে দৃঢ় কদমে ভেতরের দিকে এগিয়ে গেল নীরব। পেছনে ভাসতে থাকল ক্যামেরার ঝলকানি আর চাপা প্রশংসার গুঞ্জন।
.
.
.
.
মাথার নিচে দু’টো কুশন রেখে সোফায় শুয়ে প্রত্যাশা। পা দু’টো সোফার উপর দিয়ে দেওয়ালে ঠেকিয়েছে। একহাতে টিভির রিমোট অন্যহাতে পপকর্ন তুলে মুখে পুড়ছে। বিকেলটা অলস কা’টছে। একবার কার্টুন দেখছে, তো আবার চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। এমন সময়***টিভিতে গিয়ে চোখ দু’টো বিস্ময়ে কোটর ছাড়ার জোগাড়। তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসল। দুই হাতে চোখ ডললো। নাহ ঠিকই দেখছে; ওইতো স্পষ্ট এএসপি সাহেবকে দেখা যাচ্ছে। ঝট করে হেডলাইন পড়ল। নীরবের শেষের কথাগুলো শুনল। রিপোর্টারদের লাইভ থেকে পুরো বিষয়টটা বুঝে নিল প্রত্যাশা। মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবলকে টিভিতে দেখাচ্ছে তড়িৎ আব্বু-আম্মুকে ডেকে বলল। উনারা সেকি প্রশংসা শুরু করল! প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে পপকর্ন হাতে নিয়ে রুমে চলে গেল।
কাল সকালে আব্বুর সাথে বাড়ি ফিরে এসেছে প্রত্যাশা। আসার পর আর কোনো কথা হয়নি। হঠাৎ প্রত্যাশার মনে হলো, এএসপি সাহেবকে ফোন দিবো..কী বলব? উমম..একটা থ্যাংকস জানানোর উসিলায় আজকে তো ফোন দেওয়াই যায়। এইভেবে প্রত্যাশা দ্রুত আব্বুর ফোনটা এনে নম্বর তুলতে থাকল। অদ্ভুত ব্যাপার… নম্বর তুলতে গিয়ে লক্ষ্য করল। এই নম্বর থেকে তো কাল রাতে কল এসেছিলো। ডিনার করে রুমে এসে দেখে দুইবার মিসড কল উঠে আছে। আন্নাউন নম্বর দেখে প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে ভাবে–যার দরকার সে আবার দিবে। দুইবার কেনো দুইশো বারও দিবে।
এইভেবে রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এটা যে নীরবের নম্বর জানা ছিলো না। যাক এএসপি সাহেব নিজ থেকে কল দিয়েছিলো। খোঁজ নিতে..এটাদেখে প্রত্যাশার ভালোই লাগল। ঠোঁটে হাসি টেনে প্রত্যাশা বিছানার হেডে গা এলিয়ে কল দিল।
নীরব একটা ফাইল দেখছিলো। টেবিলের উপর থাকা ফোনে ‘Prottasha’ নামটা ভেসে উঠতেই রিসিভ করল। কয়েক সেকেন্ড পার হলেও ওপাশ থেকে কোনো শব্দ এলো না। ফাইলটা বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে বসল নীরব। বলল,
-” প্রত্যাশা?”
এবার ওপাশ থেকে গমগমে স্বর আসলো,
-” যাক এটা যে আমি…আপনি জেনেশুনেই কল দিয়েছিলেন দেখছি। ভুল করে নয়। আমি ভাবলাম ভুল করেও কাল রাতে কল আসতে পারে।”
নীরব প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
-” কেমন আছো তুমি?”
-” ভালো। আচ্ছা বলুন তো আমায়…আমার নম্বর কীভাবে পেলেন? কার কাছ থেকে নিয়েছেন?”
এই মেয়ে বাড়তি কথা বলে নীরব তা এ কদিনে বুঝে নিয়েছে। বি’রক্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-” নম্বর জোগাড় করা, এটা কঠিন কিছু নাকি?”
পাল্টা প্রশ্নে প্রত্যাশা মুখ বাঁকাল। সোজা কথা এই লোক বলতে জানে না। কিছুটা ত্যাড়া জবাব থাকবেই। প্রত্যাশা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,
-” কঠিন নয়। তবুও তো..কারো না কারো কাছ থেকে নিতে হয়েছে।”
রাতের কথা মনে পড়ল নীরবের। প্রত্যাশার সাথে আগে কখনো ফোনে কথা হয়নি। তারপর বাড়িতে থাকাকালীন ফোন নম্বর নেওয়াও হয়নি। কাল রাতে নিভানের কাছে প্রত্যাশার নম্বর চাইতেই; নিভান মজার ছলে বলে– বউ তোর, আর তোর বউয়ের নম্বর কি-না আমার কাছে চাইছিস!
জবাবে নীরব বলে–আমার বউয়ের নম্বর চাইছি না, তোমার সিস্টার ইন ল এর নম্বর চাইছি। থাকলে ঝটপট দাও তো।
নিভান হেসে বলেছিল–কেনো আমার শালির সাথে প্রেম করবি নাকি?
নীরব চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে–শুধু প্রেম নয়। পটিয়ে আরেকবার বিয়ে করব। হয়েছে?
নিভান হো হো করে হাসতে হাসতে নম্বর দিয়েছিল। কিন্তু ম্যাডাম তো রাতে কল তুললেন না। নীরব উত্তরে বলল,
-” ভাইয়ার কাছ থেকে।”
-” ওও।”
কয়েক মূহুর্ত থেমে প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,
-” লাঞ্চ করেছেন?”
-” নাহ। দুপুরে ব্যস্ত ছিলাম। বাসায় যেতে পারিনি। হাতের কাজ শেষ করে একটু পরই বেরুবো।”
ব্যস্ত শব্দটা শুনেই তখনকার কথা মনে উঠল। এতক্ষণ তো ভুলে বসেছিল। প্রত্যাশা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
-” অভিনন্দন অফিসার।”
নীরব নিঃশব্দে হাসল। ঠান্ডা গলায় বলল,
-” থ্যাংকস।”
-” আপনাকে টিভিতে যখন দেখাল আমার কীযে ভালো লাগলো না! তারপর আপনার নামের পাশে একজন সৎ, সাহসী অফিসার ট্যাগ দেখলাম….. উফ্! আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না!”
মেয়েটা খুব সহজ-সরল আর ভালো মনের। প্রত্যাশার সুন্দর মনের অভিব্যক্তি দেখে নীরবের খুব ভালো লাগলো। নীরব বলল,
-” ওটা আমার ডিউটি প্রত্যাশা। এমন কিছুও নয়।”
হঠাৎ কিছু ভেবে প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করে উঠল,
-” আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো; কাল রাতে যে ফোন দিয়েছিলেন। সেটাও কী শুধুই দায়িত্ব থেকেই? না মানে আপনি তো আবার খুব দায়িত্ববান…তাই বলছি আরকি।”
-” পৃথিবীতে তো আরো হাজারো মেয়ে আছে…কই তাদের কাছে তো ফোন দিলাম না। ফোন দেওয়া তো দূর, দেওয়ার কথা ভুলেও মনে হয়নি কখনো।”
-” সেটাই তো বলছি…এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরাসরিই বলুন না।”
-” কিছু কথার উত্তর সরাসরি দেওয়ার থেকে, অপর পক্ষের বুঝে নেওয়াতে আলাদা একটা ফিলিংস থাকে।”
প্রত্যাশা বুঝল এই লোক সরাসরি বলবে না। প্রত্যাশা হাল ছেড়ে দিলো। তবে আর কথা খুঁজে না পেয়ে বলল,
-” আচ্ছা, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাসায় গিয়ে খেয়ে নিয়েন। আল্লাহ হাফেজ।”
-” হুম। টেক কেয়ার। আল্লাহ হাফেজ।”
___________
দু’দিন পর…
থানার ভেতর যেন এক অস্থির সমাবেশ বসেছে। এককথায় মাছের হাট বললে ভুল কিছু হবে না। একপাশে ছেলে আর মেয়েপক্ষ উত্তপ্ত তর্কে লিপ্ত, অন্যপাশে প্রত্যাশা আর বন্ধুরা ক্ষোভে ফুঁসছে। মস্ত কালো বোরখা ও হিজাবে মোড়ানো প্রত্যাশার একমাত্র দৃশ্যমান অংশ ওর গভীর, কালো চোখের মণি। সদর থানার বয়স্ক কনস্টেবল বারবার উত্তেজিত দুইপক্ষকে থামতে বলছেন। হাত জোড় করে অনুরোধও করছেন–পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে কোনো একটা কেসের তদন্তের জন্য অফিসার এসেছে। দাড়োগা বাবুর সাথে কথা বলছে। একটু চুপচাপ থাকুন। দারোগাবাবু এসে দেখবেন। ভেতরে হইচই এর শব্দ যাচ্ছে। স্যারেরা রেগে যাবেন কিন্তু। ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ কথা চলছে। একটু অপেক্ষা…
নাহ হাজারো অনুনয়, বিনয়ের সুরে অনুরোধ করেও লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। দুইপক্ষ শুধু হাতাহাতি বাকি রেখেছে। মুখ দিয়ে যেন পারো মানবিক বোমা ব্লাস্ট করছে।
বাবা কোয়েলের বিয়ে ঠিক করেছিলো। এইজন্য কোয়েল কেঁদেকেটে একশা। ফ্রেন্ডরা পাশে আছি বলে সাহস দিলো। প্রেমিক রোহানও সাহস দেখিয়ে বলেছিল–বিয়ে সমস্যার সমাধান বিয়ে দিয়েই করতে হবে। চল বিয়ে করে, সব ঝামেলা চুকে ফেলি। একবার বিয়ে হলে আংকেল একসময় না একসময় মেনে নিবে। আর জোর করে তো তোকে বিয়ে দিতে চাইবে না। কারন এক গ”রুর কয়বার গলা কা’টে।
বন্ধুরা সবাই উৎসাহ দিলো। লুকিয়ে কাজি অফিসে গিয়েছিলো ওদের গ্রুপ। প্রত্যাশার গায়ে ইয়া বড় বোরখা বয়স্ক খালাম্মা টাইপের একজন সাক্ষী হতে। কিন্তু সমস্যা বাঁধল। কই থেকে কোয়েলের বাবা খবর পেয়ে ঠিক সময় মতো কাজি অফিসে হাজির। ওদিকে রোহানের পরিবারও হাজির। ওখানে এক দফা ঝগড়া হলো। কোয়েলের বাবা কেস করবেন বলেন। ওনার অবুঝ মেয়েকে ফুঁসলিয়ে বিয়ের জন্য ইন্সপায়ার্ড করায়। সব কটার নামে মামলা করবেন। এই বাদড় বন্ধুগুলাকেও আজ দেখে ছাড়বেন। এদের জন্যই মেয়ের ডানা গজিয়েছে। পালিয়ে বিয়ে করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। আজ উনিও এদের সব কটাকে দেখে ছাড়বেন।
কাজী অফিস থেকে ঝগড়া এখন থানায় এসে পৌঁছেছে। ঝাঁকড়া চুলে আঙুল চালিয়ে একরাশ হতাশা নিয়ে নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গলার স্বর ভরে উঠল আক্ষেপে,
-” ধূর ছাই! তোদের কথায় কান দিয়ে কী এক মাইনকার চিপায় ফাইসা গেলাম! কত স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হবো। মুখ উজ্জ্বল করব। এখন যদি একটা মামলা ঠুকে দেয়, তাহলে…!”
নাহিদের কথা শুনে প্রত্যাশা বাঁকা চোখে চাইল। কথার মাঝেই দুই হাত এক করে বলল,
-” ভাই, এবার একটু চুপ কর তুই। আল্লাহর ওয়াস্তে মুখটা বন্ধ রাখ। এমনিতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে, তার ওপর তোর এই বেহুদা কথাবার্তা মাথার ভেতর আ”গু”ন ধরিয়ে দিচ্ছে। মুখ উজ্জ্বল করার এতই শখ হলে বল, তোকে ভালো একটা নাইট ক্রিম সাজেস্ট করি। দেখবি, একেবারে ফকফকা হয়ে যাবি!”
হ্যাপি ঠোঁট চেপে হাসতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত শব্দ করে হেসে ফেলল। নাহিদের কটমট দৃষ্টি পড়তেই মেয়েটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তর্জনী তুলে নীরব ক্ষমা চেয়ে নিল। লাল টকটকে বেনারসীতে মোড়ানো কোয়েল, পাশে সাদা পাঞ্জাবিতে রোহান–দু’জনের মুখেই স্পষ্ট উদ্বেগের ছাপ। নাহিদ ওদের দিকে তাকিয়ে অসন্তুষ্ট স্বরে বিড়বিড় করল,
-” শালা প্রেম-প্রীতির গুষ্টি কিলাই!”
প্রত্যাশার চোখ পড়তেই নাহিদের মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল। কোয়েল দু’কদম এগিয়ে এসে প্রত্যাশার হাত মুঠোয় নিল, কণ্ঠে অনুনয়ের সুর,
-” দোস্ত, কিছু একটা কর। আব্বু যা শুরু করেছে, তাতে আমি হেব্বি ভ’য় পাচ্ছি। যদি সত্যি সত্যি রোহানসহ তোদের নামে কেস ঠুকে দেয়, তাহলে?”
নাহিদ ক্ষেপাটে সুরে বলল,
-” ঠিক মামলা করে দিবে তোর স্বৈরাচারী বাপ। বাল্যবিবাহে সাহায্য করতে গিয়ে আগামীর একজন ভবিষ্যৎ বিসিএস ক্যাডারের স্বপ্ন ভেঙ্গে হবে চুরমার। একবার নামের সাথে মামলা-ফামলা ঢুকলে আর সরকারি চাকরি হবে না ইহজন্মে।”
কোয়েল মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” আরে আব্বু মিথ্যে বলছে তো। আমার আসল বয়স আঠারো বছর সাত মাস চলছে। জন্মনিবন্ধনে দু’বছর কম দেওয়া আছে। জানিসই তো পড়াশোনায় কেমন আমি, তাই আব্বু নিজেই বয়স কমিয়ে দিয়েছিল।”
শেষ কথাটা মিনমিনে স্বরে বলে কোয়েল। প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,
-” অফিসারের সামনে এটা বলতে পারবি তো? নাকি আঙ্কেলের ধ’ম’ক শুনে___”
কথার মাঝেই নাহিদ বলল,
-” আরে ওরটা না হয় হলো। কিন্তু ওই ভাদাইম্যার কী হবে? ভাদাইম্যার বয়স আঠারো থেকে কীভাবে টেনে একুশে আনবো। শালার চুল-দাঁড়ি গজায় নাই , অথচ বিয়ে করার শখ জাগছে।”
রোহান বি’র’ক্ত চোখে তাকিয়ে সাফাই গাইতে বলল,
-” আরে আমাকে এভাবে বলছিস ক্যান। আঙ্কেল পায়েলের অন্যত্র বিয়ে ঠিক করতে যাচ্ছিল বিধায়ই তো এরকম একটা ডিসিশন নিলাম। এখন যে পরিস্থিতিটা এমন হবে! কে জানত?”
ওপাশের ঝগড়া ঝাটি, হম্বিতম্বি যেন ক্রমশ বাড়ছিলোই। মূহূর্তেই জলদগম্ভীর স্বরে পুরো থানা নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
-” স্টপ! দিস ইজ আ পুলিস স্টেশন, নট আ ফিশ মার্কেট।”
কণ্ঠ শুনে ঘাড় ফিরাতেই প্রত্যাশার চক্ষু চড়কগাছ। শুকনো ঢোক গিলে মনেমনে আওড়াল,
-” ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! এ এখানে কী করছে? যেখানে বা’ঘের ভ’য় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। কথাটা একেবারে খাপেখাপ দেখছি। এর আবার আজকেই এখানে আসার ছিলো। ধূর! টাইমিংটা…. ওহ্, শিট! শিট! শিট!”
কয়েক সেকেন্ড পরে, সামনের অফিসারের দৃষ্টি এক সেকেন্ডের জন্য প্রত্যাশার দৃষ্টিতে মেলে। প্রত্যাশা তড়িৎ দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হ্যাপির দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” অ্যাই দ্যাখ, দ্যাখ তো। আন্টির আলখেল্লার মত ইয়া বড় বোরখা আর হিজাব গায়ে আমাকে চেনা যাচ্ছে কী না? বুঝা যাচ্ছে কী? শুধু তো চোখদুটো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তারপরও কী___”
হ্যাপি চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রত্যাশার আপাদমস্তকে নজর বুলায়। হঠাৎ আঁতকে ওঠে হায় হায় করে বলে উঠল,
-” ইয়া আল্লাহ! আম্মুর নতুন বোরখা ছিল এটা। একদিনও আম্মু পড়েনি। ছিঁ’ড়ল কী করে? কোথায় বাঁধিয়ে ছিঁড়ে ফেললি। আম্মু দেখলে তো আমার পিঠে তাল পড়বে। নিজে পড়ার কথা বলে আজকের জন্য নিয়েছিলাম।”
প্রত্যাশা অতিষ্ঠ চোখে চাইল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” আরে আন্টির মা’রের চিন্তা পরে করিস। এখন এখান থেকে সহিসালামতে কীভাবে বেরোবি তাই ভাব। পুলিশের ডা’ন্ডার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা আগে ভাব।”
পুলিশের ডান্ডার কথা শুনে হ্যাপির মুখটা ভ’য়ে এইটুকুন হয়ে আসে। আপাতত মায়ের ব’কুনির কথা মাথার একপাশে সরিয়ে রাখে। ভ’য়ে হ্যাপির আত্মা শুকিয়ে আসছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মিনমিন করে বলল,
-” প্রত্যাশা রে, অ্যাই প্রত্যাশা সত্যি সত্যিই জেলে চালান টালান করে দিবে না তো। বাল্যবিবাহে উৎসাহিত করে, দেন সাহায্য করার জন্য মামলা দিয়ে দিবে না তো। অফিসারকে দেখে তো আমার খুব কড়া মনে হচ্ছে।”
প্রত্যাশা আড়চোখে অফিসারের দিকে চাইল। ঠোঁট নেড়ে বলল,
-” ব্যাটা বেশি হম্বিতম্বি করলে খবর আছে। ব্যাটা নিজে বাল্যবিবাহ করেছে। আমাদের নামে কেস দিলে, উল্টো ওনার নামে মামলা দিয়ে দিবো। শেষে নিজের চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হবে, হু।”
হ্যাপি বিস্ময় নিয়ে শুধাল,
-” তুই চিনিস ওনাকে?”
#চলবে