মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-১৩+১৪

0
9

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |১৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

হ্যাপির প্রশ্নে প্রত্যাশা থতমত খায়। জড়তা নিয়ে বলল,

-” হ-হ্যা চিনি মানে…ওইযে বলেছিলাম না..আপুর দেবর এএসপি। উনিই সে…”

হ্যাপি বিস্ময় আর খুশিতে উত্তেজিত হয়ে বলল,

-” ওয়াও রিয়েলি! উনি তোর বেয়াই হয়? তাহলে এখন ঝটপট ওনাকে বল..আমাদেরকে হেল্প করতে।”

প্রত্যাশা চোখ গরম করে বলল,

-” মাথা খারাপ হয়েছে তোর? পা’গল নাকি যেচে পরিচয় দেই। আর উনি বাসায় আব্বু-আম্মুর কানে খবর দিক…তাদের মেয়ে থানায়। আম্মু জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে।”

হ্যাপির উচ্ছ্বসিত মুখটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। ঠোঁট উল্টে বলল,

-” ওও।”

জলদগম্ভীর স্বরে এক মূহুর্তের জন্য চারিপাশ স্তব্ধ হলেও, আবার চাপা ফিসফিসানি শুরু হলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজে সদর থানায় এসেছিল নীরব। এসআই এর রুমে বসে কথা বলার শুরুতেই বাইরে থেকে হট্টগোল, হৈচৈয়ের শব্দ আসছিল। এক প্রকার রাগে বেড়িয়ে আসে। ফিসফিসানি থামাতে বজ্রকণ্ঠে রুঢ় স্বরে বলল,

-” ইনাফ! হোয়াট’স গোয়িং অন হিয়ার? ইজ দিস আ পুলিশ স্টেশন অর আ লোকাল সার্কাস? চুপ করুন সবাই! একবারে চুপ!”

সবাই থেমে যায়। একজন থেমে যায় অন্যজনের চোখের দিকে চেয়ে। ওরা পাঁচজন জড়সড় হয়ে দাড়াল। এর মধ্যে কোয়েলের বাবা একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে এসে শুরু করলেন অভিযোগের পর্ব,

-” স্যার, আমার মেয়ে ছোট। নাবালিকা। এইসব বখাটে ছেলে আর তার বন্ধুরা ফুঁসলিয়ে, কিডন্যাপ করে কাজি অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি না গেলে তো কাজই হয়ে যেত!”

ওপাশ থেকে রোহানের বাবা মুখ শক্ত করে বললেন,

-” আরে ভাই, বখাটে কারে বলছেন? আপনার মেয়ে যদি এতই নিষ্পাপ হইতো, তাহলে ছেলেরে নিয়ে পালায় কেন? আমার ছেলেকে ফাঁসায়া এখন আমারে বখাটের বাপ বানাচ্ছেন!”

নীরব কঠিন স্বরে বলল,

-” প্লিজ, স্টপ। ঝগড়া ঝাটি বন্ধ করুন। আর কী হয়েছে ধীরসুস্থে বলুন?”

এসআই মনেমনে একটু স্বস্তি পেল। কই থেকে এতগুলো উজবুক এসেছে। এদের ঝামেলার সুরাহা করতে সারাদিন তো লাগবেই, সাথে মাথা ধরে যাবে নিশ্চিত।

ওদিকে প্রত্যাশা চোরাচোখে বারবার নীরবের দিকে তাকাচ্ছে। মনেমনে প্রে করছে, নীরব যেনো চিনতে না পারে। আর সহিসালামতে যেনো এখান থেকে বেরুতে পারে। একে তো নেকাব পড়ার অভ্যাস নেই। তারপর বাধাও টাইট হয়েছে। যত সময় যাচ্ছে প্রত্যাশার দম বন্ধ হয়ে আসছে।‌ হাতের পার্সটা পাশের চেয়ারে নামাল। হাত দিয়ে নেকাব সামান্য টেনে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে হ্যাপির দিকে রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

-” কী টাইট করে বেঁধে দিয়েছিস, ভাই। মনে হচ্ছে এইবারই যদি নাকটা একেবারে বোচা হয়ে যায়। আমার কোনো মতো চলনসই নাকটা এবারে, চায়নিজদের মতো বোচা হয়ে যাবে দেখছি।”

কোয়েলের বাবা আবার শুরু করলেন তার অভিযোগ। এসআই মেয়ের বয়ান নিতে কোয়েলকে ডাকল। কোয়েল প্রত্যাশাকে বলল–ওর সাথে, কাছাকাছি থাকতে। ভুল বললে সুধরে দিতে। প্রত্যাশা তো গ্যাড়াকলে পড়ল। নীরবের থেকে দশহাত দূরত্বে থেকেই ওর হার্টবিট অস্থিরতায় বেড়ে গিয়েছে। কাছে গেলে কী হবে আল্লাহ মালুম!

কোয়েল ভ’য়ে ভ’য়েই মিনমিনে স্বরে সবটা বলল– বন্ধুরা কেউ জোর করেনি। বাবা বিয়ে ঠিক করেছিলো। রোহানকে পছন্দ করে তাই নিজ ইচ্ছেতেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ-ও বলে, আসল বয়স এইট্টিন প্লাস। বার্থ সার্টিফিকেটে কম দেওয়া।

মেয়ের সাহস দেখে কোয়েলের বাবা বিস্মিত! ভাবেননি মেয়ে তার উপর দিয়ে কথা বলবে। থমথমে হয়ে যায় ভদ্রলোকের মুখ। ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে নীরব গম্ভীর স্বরে বলল,

-” নিজেই মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। আবার বলছেন নাবালিকা। আর সার্টিফিকেটে বয়স কমিয়ে দেওয়া এটাও তো ঠিক নয়।”

কোয়েলের বাবা কেশে উঠে বললেন,

-” মানে…মানে, ওইটা তো তখনকার একটা…পরিস্থিতি ছিল।”

নীরব হালকা হাসল,

-” তাহলে তো মিথ্যা জন্মনিবন্ধনের দায়ে, তারপর মেয়েকে বিয়ের জন্য জোর করায় আপনাকে আগে গ্রেফতার করা উচিত। আপনি জানেন এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ?”

ভদ্রলোককের মুখে আর ‘রা’ নেই। রোহানের বাবা বললেন,

-” স্যার, আপনি একদম ঠিক বলছেন। কিন্তু আপনি একটা ব্যাপার বুঝুন; ছেলেমেয়েরা হুজুগে পড়ে গেছে। আসলে তারা এতটাও খা’রাপ না।”

নীরব একটু ভারিক্কি সুরে বলল,

-” ছেলেমেয়েরা হুজুগে পড়ে না। অভিভাবকদের উদাসীনতায় পড়ে।”

থেমে নীরব এবার কোয়েল-রোহান আর ওদের বন্ধুদের দিকে তাকাল। বলল,

-” তোমরা সবাই এখনো অনেক ছোটো। এটা আবেগের বয়স, ভুল করা খুব সহজ, কিন্তু সেই ভুল থেকে শিখে না নিলে ভবিষ্যত গড়া কঠিন হয়ে পড়ে। তোমরা কেউ খারাপ না, কিন্তু দায়িত্বজ্ঞান থাকা খুব জরুরি। ভালোবাসা মানেই পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং সাহস করে পরিবারকে জানানো। যোগ্যতা গড়ে তোলো, যাতে একদিন সেই ভালোবাসাকে সবাই সম্মান দিতে পারে।”

তারপর বন্ধুবান্ধবদের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” আর তোমরা… বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছ, বুঝি বন্ধুর বিপদে পাশে থাকাটা বন্ধুত্ব। কিন্তু চোখ বন্ধ করে নয়। বন্ধুর ভুলে সায় দিলে, তোমরাও সেই ভুলের অংশীদার হয়ে যাও। সত্যিকারের বন্ধু সেই, যে সঠিক পথ দেখায়। এমন ভুল সিদ্ধান্তে উৎসাহ দিলে সেটা বন্ধুত্ব নয়, অপরাধে সহযোগিতা। মনে রেখো–বাল্যবিবাহ কোনো রোম্যান্স নয়, এটা এক ধরনের সামাজিক অপরাধ। বন্ধুকে সাপোর্ট দাও, কিন্তু সঠিক পথে।”

প্রত্যাশা আড়ালে মুখ বাঁকাল–আসছে উপদেশ দিতে…আরেএএ নিজে বাল্যবিবাহের রোল মডেল হয়ে বসে আছে। আবার বলে বাল্যবিবাহ অপ…. হুঁ।

কালো বোরখা পরিহিত মেয়েটার দিকে নজর পড়তেই নীরবের কপালে ভাঁজ পড়ল। গাঢ় চোখদুটো ধীরে ধীরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্ক্যান করে বোরখায় মোড়ানো মেয়েটিকে। মেয়েটার বারবার আড়চোখে তাকানো, একবার মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া, আবার কিছুটা তাকিয়ে দেখা; সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। যা বুদ্ধিদীপ্ত নীরবকে ভাবাচ্ছে।

সবশেষে দুই পক্ষের উদ্দেশ্যে হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে নীরব বলল,

-” দেখুন আমার মনেহয়, এটা কোর্ট-কাচারির বিষয় নয়। তাতে সবার সম্মানই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং দুই পরিবার মিলে বসুন, শান্তভাবে কথা বলুন। ছেলেমেয়ের কথা শুনুন, তাদের পছন্দটা বোঝার চেষ্টা করুন। সম্মান আর বোঝাপড়া থাকলে সমাধান এমনিতেই বেরিয়ে আসে।”

অফিসারের যুক্তিসম্মত কথায় দুইপক্ষই কিছুটা নরম হলো। উত্তপ্ত পরিবেশটা শীতল হয়ে আসলো। আরো কথাবার্তা শেষে তারা দুই পরিবার বসে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়।

.
.

একেএকে সবাই প্রস্থান করতে থাকে। কোয়েল পরিবারের লোকের সাথে, রোহান বাবার সাথে। নাহিদ আগেভাগেই বেরিয়েছে। প্রত্যাশা আর হ্যাপি ছিলো পিছে। থানার চৌকাঠ পেরোবে, এমন সময়

-” এইযে, বোরখাওয়ালি ম্যাডাম? ওয়েট, ওয়েট…”

প্রত্যাশা যেন হিমালয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বরফে জমে গেল। বুকের ভেতর ধুকপুকুনি শুরু হলো। নীরব ডান ভ্রু খানিকটা তুলে ঠান্ডা অথচ হুকুমের সুরে বলল,

-” আপনি কোথায় যাচ্ছেন? একটু এদিকে আসুন তো।”

প্রত্যাশার আত্মা যেন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মনে মনে প্রমাদ গুনল–এইরে এর মতলব কী? সবাই যাচ্ছে। আমাকে বাঁধা দিচ্ছে কেনো? সবাইকে ছেড়ে মাস্টার প্ল্যান করা আমাকে লকাপে পুড়বে না তো! ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! রক্ষে করো।

নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, মুখ গম্ভীর করে, যতটা সম্ভব দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেল প্রত্যাশা। বাইরের চেহারায় সাহসের মুখোশ, ভিতরে রীতিমতো ভূমিকম্প। গলার স্বর শুনলেই তো…তাই যথাসাধ্য কণ্ঠটা মোটা ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে করার চেষ্টা করল। চোখ নিচু করে গলা ভারী করে বলল,

-” জ্বী, আমাকে বলছেন?”

নীরব একহাত পকেটে গুজে দাড়াল। চোখে নিখুঁত পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

-” জ্বী ম্যাডাম, আপনাকেই বলছি।”

প্রত্যাশা আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। হাত জোড়া করে কচলাতে কচলাতে থুতনি নামিয়ে দেয় বুকে, দৃষ্টি নামিয়ে রাখে মেঝেতে। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে এক গাল কৃত্রিম অনুনয়ের ছায়া মেখে বলে,

-” সবাইকে ছেড়ে আমাকে আলাদা করে ডাকলেন কেন ভাই? বিশেষ খাতির যত্নের কিছু আছে বুঝি? চা-বিস্কুট..মানে নাস্তার অফারটাই কি করতে যাচ্ছেন?”

‘ভাই’ শব্দটা বোরখাওয়ালির মুখে শুনে নীরবের মুখ থমকে যায় মুহূর্তেই। ফর্সা চেহারায় ছায়া নামে। এদিকে প্রত্যাশা নিজের ছন্দেই বলে যাচ্ছে,

-” এরকম কিছু হলে…আগেই বলছি; আজ সময় নেই, অন্যদিন‌।”

বোরখাওয়ালি ফটর ফটর করছে তবে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। এর উল্টাপাল্টা ফটর ফটরের ধরণ, আর চোরচোর ভাবসাব দেখে নীরবের তীব্র সন্দেহ এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁকা হাসি টেনে ঠান্ডা গলায় বলল নীরব,

-” ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে, কথাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে, চোখে চোখ রেখে বললে ভালো হয়… তাই না?”

প্রত্যাশা মনে মনে একগাদা গা’লি বর্ষণ করল। এই ব্যাটা কিছুমিছু টের পেয়ে গেছে নাকি! চোখে চোখ পড়লে এক্কেবারে চিনে ফেলবে তো! কিছু ভেবে গলা খাঁকারি দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

-” আস্তাগফিরুল্লাহ! আপনি কী বলছেন? আমি কি দেখতেই পাচ্ছেন না? আমি যথেষ্ট পর্দানশিন। পরপুরুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা তো পাপ, ভাইজান! আমার লেবাস দেখে আপনার বোঝা উচিত ছিলো, আমি কেমন। কোন আক্কেলে এমন একটা কথা বলে ফেললেন আপনি? ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!”

নীরবের এবার সত্যিই হাঁপিয়ে ওঠার জোগাড়। বউয়ের মুখ থেকে ‘পরপুরুষ’ তারপর ‘ভাইজান’ সম্বোধন শোনার জন্য নীরব মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। কোনো রকমে নিজেকে সামলাল। একে এখানে বেশিক্ষণ রাখলে মান সম্মানের ফালুদা করে দিবে। তাই নীরব আর রিস্ক নিল না। তড়িঘড়ি করে ইশারায় টেবিলের দিকে দেখিয়ে বলল,

-” ওটা বোধহয় আপনার। ফেলে যাচ্ছিলেন।”

চেয়ারের উপর রাখা পার্সটা সত্যিই ভুলে গিয়েছিল প্রত্যাশা। তাড়াতাড়ি হাতে তুলে নিল সেটা। এরপর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ পিছনে ফিরে একবার তাকাল। দু’জনের চোখে চোখ। নীরব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কপালের মাঝখানে একরেখা ভ্রুকুটি। সেই দৃষ্টির মধ্যেও অদ্ভুত এক স্থিরতা। প্রত্যাশার মাথায় দুষ্টুমির ভূ’ত চাপল। হঠাৎ ডান চোখটা টিপ মে’রে একটা দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

নীরব কিছু মুহূর্ত স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। তারপর নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক অনামা হাসি।

____________

দুপুর থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা চলছে। ঘড়ির কাঁ’টা চারটার ঘর ছুঁইছুঁই। বাসায় ফিরে দেড়-দুই ঘণ্টা বিছানায় গড়াগড়ি করে, ফোনে রিলস দেখে পার করে প্রত্যাশা। আম্মু এসে গালে তুলে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছে। আর কতবার করে বলেছে তাড়াতাড়ি গোসল করতে। ফোন হাতে নিলে কোন দিক দিয়ে সময় যায়, বোঝাই যায় না। মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরোল প্রত্যাশা। বাইরের আকাশ ঘন হয়ে আসছে। দমকা হাওয়ায় জানালার পর্দা বারবার উড়ছে। তার ছায়া ঘরের মেঝেয় লেপ্টে পড়ে কেমন এক রহস্যময় ছায়া সৃষ্টি করেছে। প্রত্যাশা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। গুনগুন করে গান ধরেছিল হালকা গলায়,

-” দিল গালতি কার বেটা হে গালতি কার বেটা হে দিল….বল হাম_____”

হঠাৎই গলার স্বর থেমে গেল। আয়নায় চোখ পড়তেই বুকটা ধ্বক করে উঠল। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে–সোফায় বসে আছেন তিনি। পায়ের উপর পা তুলে, দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে বসা, চোখে সেই চিরচেনা স্থির দৃষ্টি। আয়নায় চোখাচোখি হলো। প্রত্যাশা তড়িৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বুকে থুতু ছিটিয়ে বলল,

-” আ-আপনি?”

নীরবের দৃষ্টি প্রত্যাশার দিকে। ছোট করে বলল,

-” হুম।”

প্রত্যাশার বিস্ময়ের ঘোর কা’টেনি। বলা নেই, কওয়া নেই! এই লোক হুট করে এখানে! ওর কাছে এখনো মনে হচ্ছে চোখের ভ্রম।

প্রত্যাশার বিস্ময় কাটাতে নীরব ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এল সামনে। প্রত্যাশা এখনো ঠাঁই ওভাবে দাড়িয়ে। নীরব কাছাকাছি আসতেই ওর হুঁশ ফিরল। আচমকা বুকটা কেঁপে উঠল। একহাতে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে ভাব নিয়ে বলল নীরব,

-” হুম, ম্যাডাম… আমি। কেনো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না?”

প্রত্যাশা কথা হারিয়ে ফেলে। এরমধ্যে আচমকা আরেক ধাপ এগিয়ে আসে নীরব। ওর এত কাছে যে প্রত্যাশার নিঃশ্বাস এবার গলায় আটকে এল। নীরবের দৃষ্টিটা হঠাৎ অন্যরকম ঠেকল। নীরব আয়নার দিকে পলকহীন তাকিয়ে। কয়েক মূহুর্ত পর…নীরবের ডান হাতটা প্রত্যাশার পিঠ স্পর্শ করল। প্রত্যাশার শরীর শিরশির করে উঠল। প্রত্যাশা কিছু বুঝে উঠার আগেই; নীরব ধীরে একহাতে ওর টপসের জিপার তুলে দিল। প্রত্যাশা চোখ বন্ধ করে ফেলল, নিঃশ্বাস বন্ধ। জিপারের ‘ঝুপ’ শব্দে বুকের ভিতরটা ছটফট করল। বুকটা রীতিমত দুরুদুরু কাঁপছে। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,

-” আপনি… কখন এলেন? হঠাৎ?”

নীরবের দৃষ্টি সদ্য শাওয়ার নেওয়া স্নিগ্ধ, সতেজ মুখটায়। সেদিকে নিষ্পলক চেয়েই নীরব মৃদুস্বরে বলল,

-” এই তো… কিছুক্ষণ আগে।”

বাইরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। প্রতিটি ফোঁটার শব্দ যেন এক একটি সুরের রাগিণী। জানালার পর্দা দুলে উঠছে হাওয়ার ছোঁয়ায়, আর সেই ঠান্ডা বাতাস দুজনকে বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে নিঃশব্দে। ঘন মেঘে শহরের আকাশ এমনভাবে ঢেকে গেছে, যেন আগেভাগেই রাত নেমে এসেছে আজ। ঘরের কৃত্রিম সাদা আলোয় প্রত্যাশাকে অপার্থিব সুন্দর লাগছে। চুলের ভেজা ছায়া, চোখের গভীরতা, আর মুখের কোমল আলো; সব মিলিয়ে এক মোহনীয় উপস্থিতি। নীরব চোখ ফেরাতে পারছে না।

-” ওহ্।”

তিরতিরিয়ে কাঁপা ঠোঁট জোড়া নেড়ে এক শব্দ উচ্চারণ করে প্রত্যাশা। প্রত্যাশা কী বুঝতে পারছে? ওর এই কম্পিত ঠোঁটজোড়া সামনের মানুষটার বুকে ঝড় তুলেছে! তাকে সম্মোহিত করছে! এলোমেলো করে তুলছে। নীরব হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙি করে বলে উঠল,

-” তখন কী বলছিলে যেন? আমি পরপুরুষ? আমার চোখের দিকে তাকানো পাপ? তা এখন সেই তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো।”

থেমে, আচমকা একহাতে প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে কাছে আনে। প্রত্যাশা স্তব্ধ হয়ে যায়। বুকের কম্পন লাগামহীন। নীরব ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

-” তাও একদম কাছাকাছি। এখন বলো…”

প্রত্যাশা লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলল। মিহি স্বরে বলল,

-” আমি তো মজা করেই বলেছিলাম… তবে শেষের দিকে বুঝতে পেরেছিলাম আপনি ধরে ফেলেছেন… আমি।”

থেমে কিছু ভেবে প্রত্যাশার কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। প্রশ্ন করে উঠল,

-” আচ্ছা, আপনি আম্মুকে এসব বলে দিতে আসেননি তো আবার?”

নীরব মুখ শক্ত করে বলল,

-” হুম।”

প্রত্যাশা সঙ্গে সঙ্গে নাক-মুখ কুঁচকে তাকাল। চোখ দুটো বড়বড় করে রাগি রাগি দৃষ্টিতে চাইল। নীরব ঠোঁট ছড়িয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠল। বুকের পাশে একটা হাত রেখে অ্যাক্টিং করে বলল,

-” উফ্! এভাবে তাকিও না তো।”

নীরবের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। প্রত্যাশা চোখ নামিয়ে ফেলল। কেমন অস্বস্তি শুরু হলো। নীরব নরম কোমল সুরে ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

-” হুম?”

প্রত্যাশা দৃষ্টি নুইয়ে রেখেই উত্তর দেয়। নীরব প্রগাঢ় স্বরে বলল,

-” এখন যদি আমি কোনো গালতি করি, তুমি কী রাগ করবে?”

প্রত্যাশা মুখ তুলে নির্বোধের মতন শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কিছু বলার আগেই নীরব মুখটা এগিয়ে আনল ধীরে ধীরে। নীরবের গাল ছুঁয়ে গেল প্রত্যাশার নরম তুলতুলে গালে। নীরবের খোঁচা খোঁচা দাড়ি গালে লাগতেই প্রত্যাশার শরীরে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হলো যেন। শিরশিরে এক অনুভূতি ছড়িয়ে গেল গাল-গলা পেরিয়ে সারা শরীরে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। নীরবের নিঃশ্বাস ঘন হয়। গরম নিঃশ্বাস প্রত্যাশার গলায় আঁছড়ে পড়ছে। শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ আফিমের মতো মাদ’কতার সৃষ্টি করেছে। প্রত্যাশার গা থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। নীরব আবেশে চোখ বুজে নেয়। কোমরের পেঁচিয়ে রাখা হাতটা আরেকটু দৃঢ় হলো।

প্রত্যাশা শক্ত হাতে জামা মুঠো করে ধরে। গালে নীরবের দাঁড়ি লাগছে ওর কেমন কেমন লাগছে। প্রত্যাশা হঠাৎ ব্যাঙের মতো নড়ে উঠল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,

-” উফ্! ছাড়ুন তো। সুড়সুড়ি লাগছে…. ছাড়ুন না। আপনার দাঁড়ি খুব জ্বালাচ্ছে। কেমন খোঁচা খোঁচা বিঁধছে।”

অনুভূতিতে টালমাটাল নীরব থমকে যায়। এমন মূহুর্তে…এটা নাকি বউয়ের কথা। ইমম্যাচিউর মেয়ে বিয়ে করলে যা হয় আরকি। এইভেবে নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নীরব গম্ভীর মুখে বলল,

-” এই মুহূর্তে এমন ডায়লগ… সত্যিই? তোমার দাঁড়াই পসিবেল।”

প্রত্যাশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল,

-” এই মিষ্টি কিলবিল টাইপ সুড়সুড়ি কোথা থেকে আসে আপনার দাড়িতে!”

এই বলে একহাত রাখল নীরবের গালে। নীরব সেই হাতের দিকে একপল তাকাল তো আবার প্রত্যাশার মুখের দিকে। রোমান্টিক মুডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে। পিচ্চি বউ নিয়ে ভবিষ্যতে মহা ঝামেলা আছে…তা ঢের অনুমান করল নীরব।

এরমধ্যেই হঠাৎ ফোনে অফিসিয়াল কল আসায় নীরব দ্রুত বেরিয়ে যায়।
.
.
একটা প্রোগ্রাম শেষে এদিক দিয়ে বাসায় ফিরছিল নীরব। হঠাৎ কিছু মনে করে থামে। এমনিতেই সবাই বলে বউয়ের খোঁজখবর নেয় না। তাই ভাবল একবার দেখা করে যাওয়া যাক। অধরা লাঞ্চের কথা বলতেই নীরব বলে–একটা প্রোগাম ছিলো, ওখানে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিলো। মাত্র খেয়ে এসেছে। অধরা আর জোর না করে বলেন– প্রত্যাশা রুমেই আছো। ভেতরে যাও বাবা।

শাশুড়ি মা স্পেস দিতেই প্রত্যাশার রুমে আসে নীরব। রুমে পা রাখতেই ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসে। সোফায় অপেক্ষারত ছিলো নীরব। সদ্য শাওয়ার নেওয়া, কিছুটা খোলামেলা প্রত্যাশাকে দেখে নীরব যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সেই ঘোর তার ইমম্যাচিউর বউয়ের ইমম্যাচিউটিতে কে’টে যায়। তারপর তো ফোন আসতেই বিদায় নিতে হলো।

____________

দু-তিনদিন পর,,,

সময়টা সন্ধ্যার পরপর। দুই পাশে আব্বু-আম্মু মাঝে গোমড়া মুখ করে প্রত্যাশা বসে। আব্বু আম্মুর চোখেমুখে উদ্বেগ আর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। প্রত্যাশার অবশ্য কোনো চিন্তা হচ্ছে না। শুধু মাঝেমাঝে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে আহ্, উহ করছে। পা স্লিপ কে’টে ওয়াশরুমে পরে হাতটা বারি লেগেছিল দেওয়ালে। কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত চিনচিনে ব্যাথা করছে। একপাশে তো ফুলে র”ক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গিয়েছে। বিকেল থেকে ব‌্যথা বাড়ায় শফিক সাহেব জোর করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এলেন। শফিক সাহেব স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,

-” ও বাড়িতে বলেছো? নীরবকে?”

অধরা কর্কশ গলায় বলল,

-” এতো বড় মেয়ে ধাড়াম করে ওয়াশরুমে পড়ে হাত ভেঙেছে। এটা শ্বশুর বাড়িতে দেবার মতো খবর? শুনলে উল্টো কথা হবে। এতবড় মেয়ে কীভাবে চলাচল করে?”

শফিক সাহেব মুখটা কাঁচুমাচু করে সোজা হয়ে বসলেন। অধরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন,

-” দুপুর বেলা আম গাছে উঠতে চেয়েছিল। আম ভর্তা করে খাবে। উঠতে দেইনি, সেই রাগ নিয়ে গজগজ করতে করতে গোসল করতে ঢুকেছে। অন্য মনস্ক ছিলো..আর অমনি পড়েছে। ওই পড়াই পড়ত গাছ থেকে। আল্লাহ তাও বাঁচিয়েছেন। অল্পের উপর দিয়ে গেছে। গাছ থেকে পড়লে তো পা সহ কোমড় ভাঙত।”

মায়েদের খালি বাড়তি কথা। কিছু হলেই এটার না ওটার দোষ। জ্বর আসলেও ফোনের দোষ। সব কিছুতেই খালি দোষ আর দোষ। প্রত্যাশা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

-” আহ্ আম্মু থামবে..”

.

বেশ কয়েকজন রোগির পর ওদের সিরিয়াল আসল। দরজার পাশে বড়সড় নেমপ্লেট,
ডঃ প্রিতম হাসান সার্থক [মেডিসিন বিশেষজ্ঞ]

নিচে আরো ডিগ্রি লেখা আছে। প্রত্যাশা অতোকিছু দেখল না। শুধু নামটা পড়ল। মনেহলো এই নামটা আগে কোথাও দেখেছে। তবে মনে করতে ব্যর্থ হলো। এরমধ্যে শফিক সাহেব কাঁচের দরজা টেনে ইশারায় মেয়েকে আগে ঢুকতে বলল। ভেতরে পা রাখতেই প্রত্যাশার ভ্রু কুঁচকে যায়।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |১৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

চেম্বারের ভেতরটা ঠান্ডা আর ধবধবে পরিষ্কার। বাতাসে মৃদু এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ। ডেস্কের ওপরে ডাক্তারদের চেনা জিনিসগুলো সাজানো; ডিজিটাল ব্লাড প্রেশার মেশিন, থার্মোমিটার, গ্লুকোমিটার, একটা ছোট প্লাস্টিকের ট্রেতে কয়েকটা স্যাম্পল ইনজেকশন, স্যানিটাইজার, টিস্যু আর প্রেসক্রিপশন প্যাড। চেয়ারে বসে থাকা ডাক্তারটির কালো শার্টের উপরে সাদা এপ্রোন পরা, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলছে। ডান হাতে ফোন, ভ্রু কুঁচকে কথা বলছিল কারো সঙ্গে। কাঁচের দরজার ধাতব শব্দে একটু বিরক্ত মুখে তাকাল। আর ঠিক তখনই…প্রত্যাশা ভেতরে পা রাখতেই ওর চোখ পড়ল লোকটার মুখে। সার্থক থমকে গেল। সেই চেনা মুখ। সেই চোখ, সেই ভ্রু। সময় যেন এক মুহূর্তে আটকে গেল। ফোনটা কানে থাকলেও কথাগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। চোখ সরাতে পারল না। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল শুধু।

প্রত্যাশা মনেমনে ভাবল–বাবা গো এ তো দেখছি সে দিনের স্কুটিতে ধা’ক্কা মা’রা ব’জ্জাত ডাক্তারটা।

সিরিয়াল ডাকা স্টাফ ছেলেটা বলে উঠল,

-” পেশেন্টের সাথে একজন যেতে পারবেন, শুধু একজন।”

শফিক সাহেব মাথা নেড়ে অধরার দিকে ইশারা করলেন। অধরা মুখ শক্ত করে এগিয়ে এল। সার্থক সম্বিৎ ফিরে পেতেই ফোন রেখে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে আন্তরিকতার সহিত বলল,

-” আসুন ভেতরে। প্লিজ টেক সিট।”

কে পেশেন্ট? এটা ভাবতে ভাবতে সার্থক প্রেসক্রিপশন প্যাড টেনে নিল। কলমটা হাতে নিয়ে প্যাডে কলম চালু করতে করতে বলল,

-” পেশেন্টর নাম?”

-” ইয়ানূর প্রত্যাশা।”

সার্থক এক সেকেন্ডর জন্য চোখ তুলে প্রত্যাশার দিকে চাইল। পরপর নজর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” বয়স?”

-” ১৭ বছর ৯ মাস সামথিং।”

অধরা বিরক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকাল। সরাসরি আঠারো বললেই হতো–ও পারলে বার, তারিখ, সময়ও যেনো বলে ফেলে। সার্থক কলম নামিয়ে হাত দু’টো এক করে টেবিলের উপর রাখল। প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বেশ ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করল,

-” কী সমস্যা?”

এবারে প্রত্যাশা মায়ের মুখের দিকে চাইল। চোখের ভাষা বলছে–আম্মু তুমি বলো। অধরা সবটা বলল। সার্থক প্যাডে কিছু নোট নিল। তারপর আলতো গলায় বলল,

-” এই পাশে এসে বসুন, হাতটা দেখি।”

মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি আর বিরক্তি নিয়ে উঠে পাশে রাখা চেয়ারে বসল প্রত্যাশা। সার্থক আলতো করে প্রত্যাশার কনুইয়ের কাছে মৃদু চাপ দিল। এটা ওর পেশা, দায়িত্ব; তবুও এই প্রথম ওর হাতটা কেমন কাঁপল। অজান্তেই হৃদস্পন্দন একটু যেন তীব্র হলো। কোথাও একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হলো। সার্থক জোড়াল শ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল। হাতটা একটু ঘোরাতেই প্রত্যাশা মুখ কুঁচকে বলল,

-” উফফ্… ব্যথা করছে।”,

সার্থকের দৃষ্টি আটকে গেল সেই কষ্টে বাঁকা মুখটায়। এই সেই মুখ, যেটা ভুলে যেতে চাইছিল এ কদিন। এই সেই চোখ, যেটা রাতে ঘুমের ভেতরেও ছায়া ফেলে। আজ সেই চোখ, সেই মুখ… নিজেই এসে বসেছে সামনে। সার্থক নিজেকে সামলে নিল। হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসে গলা পরিষ্কার করে বলল,

-” এক্স-রে করাতে হবে। কিছু ফ্র্যাকচার বা মাইক্রো-ক্র্যাক হলে বুঝতে পারব। আমি রেফার করছি…।”

তারপর সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারকমে চাপ দিয়ে স্টাফ বয়কে ডাকল। আদেশের সুরে বলল,

-” এই পেশেন্টকে এক্স-রেতে নিয়ে যাও, রিপোর্ট আসা পর্যন্ত ওনাদের হেল্প করো। আর হ্যা আমার কথা বলবে.. রিপোর্ট তাড়াতাড়ি তৈরি করতে বলবে।”

.
.

ওয়েটিং চেয়ারে প্রত্যাশা বসে উসখুশ করছে। যেখানে টেস্টের জন্য আগে থেকেই রিসিপশনে লাইনে দাঁড়ানো অনেকে। লাইন ফলো না করেই তাদেরটা আগে হলো। শুধু তাই নয়। এক্সরে রুমেও একই কান্ড। পরে গিয়েও তার নাম আগে ডাকা হলো। প্রত্যাশা দেওয়ালে টানানো পোস্টার দেখে জিজ্ঞেসও করেছিলো বয়টিকে– এক্সরের জন্য তো ****এত টাকা ফিক্সিড করা। তাহলে তাদের কাছ থেকে কম নিচ্ছে কেনো? উত্তরে বলেছিল– প্রিতম স্যার কমিশন লিখে দিয়েছেন। তাই।

এই নিয়ে প্রত্যাশার সেকি ভাবনা– ডক্টর প্রিতম হাসান সার্থকের কোনো স্বার্থ নেই তো? নাকি ব্যাটার দয়ার শরীর! সবাইকে এরকম দয়া দেখিয়ে বেড়ায়!

এরই মধ্যে এক্স-রে রিপোর্ট প্রস্তুত হয়। ডাক পড়ে তাদের। রিপোর্টে বড় কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। কনুইয়ের কাছে রগে আঘাত লেগে র’ক্ত জমেছিল। সার্থক নিজে সিরিঞ্জ দিয়ে জমা র’ক্ত বের করে দেয়। সে সময় প্রত্যাশা মুখ কুঁচকে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে ছিল। পরবর্তীতে হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়। সব শেষে প্রেসক্রিপশন সম্পূর্ণ করে সার্থক শান্ত কণ্ঠে বলল,

-” এই ওষুধগুলো আপাতত চালিয়ে যান। চিন্তার কিছু নেই। তবে কয়েকদিন হাতটা যেন বেশি নাড়াচাড়া না হয়। তিন দিন পর ব্যান্ডেজ খুলতে আবার দেখাতে আসবেন। ওষুধ বদলাবো।

.
.

সিএনজিতে আব্বু-আম্মুর মাঝে বসে আছে প্রত্যাশা। বাড়ি ফিরছে তারা। প্রত্যাশা ক্লান্ত শরীরটা হেলিয়ে দিয়েছে মায়ের কাঁধে। অধরা একবার মেয়ের ক্লান্ত, শান্ত মুখটার দিকে তাকাল। আবার চোখ তুলে তাকাল দূরের আকাশে; পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে, তার ম্লান আলো ধরণীতে ছড়িয়ে পড়েছে। হাইওয়ে ধরে সিএনজি চলছে দ্রুত। দু’পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ, তার মাঝে অন্ধকার আর নিঃস্তব্ধতা। আচমকা অধরার মনে পড়ে গেল সেই রাতটার কথা। সেই মধ্যরাতের এক স্মৃতি, যেদিন ওর জীবনে অন্ধকারের মাঝেও এক টুকরো আলো নেমেছিল।

সেদিনও ছিল পূর্ণিমা। হাসপাতালের কৃত্রিম আলো ঝলমল করছিল। বাইরে ঝরছিল চাঁদের মায়াবী আলো। কিন্তু অধরার ভেতরটা তখন ভারি বিষণ্ণ। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। চোখ বুঁজলেই মনে পড়ছিল সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে কন্যা শিশুর মুখ। আগের রাতেই, ঠিক এই সময়ে… দ্বিতীয় বার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে; মৃ”ত কন্যা শিশুর জন্ম দিয়েছিল অধরা। দশ মাসের যত্ন, বুকে জমে থাকা হাজার স্বপ্ন। সব শেষ হয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তেই। কী নিদারুণ যন্ত্রণা! একজন মা-ই জানে, কতটা নিঃস্ব করে দেয় এমন অভিজ্ঞতা।

এমন সময় করিডোরে ভেসে এলো বাচ্চার কান্নার শব্দ। চেনা, চিরচেনা সেই কান্না যেন মাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। অধরা দ্রুত বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। যতই এগোয়, ততই কান্নার তীব্রতা বাড়ে।

এক নার্সের কোলে ছোট্ট এক নবজাতক; কাপড়ে মোড়ানো, মুখখানা লাল হয়ে আছে কাঁদতে কাঁদতে। নার্সের মুখে বিরক্তির ছাপ, জোরে জোরে বাচ্চাটিকে দোলাচ্ছে। পাশে আরেকজন নার্স ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,

-” কোথা থেকে যে আসে এরা! যত্তসব ঝামেলা!”

নার্সের রাগে-ভরা মুখ আর কথায় ভেসে উঠছিল সমাজের নির্মম বাস্তবতা। অধরা এগিয়ে এসে জানতে চাইল,

-” কাঁদছে কেন?”

নার্স সোজাসুজি বলল,

-” কার না কার পাপ! জন্ম দিয়ে ফেলে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে… তাই কাঁদছে। এখন একে কে দুধ কিনে এনে খাওয়াবে। যত্তসব।”

অধরা ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে ফের জিজ্ঞেস করতেই নার্সটা নাক-মুখ সিঁটকে বলল,

-” পেপারে পড়েন না? কখনো হোস্টেলের পাশের ডাস্টবিনে, কখনো হাসপাতালের করিডোরে বাচ্চাদের ফেলে যায়। এই মেয়েটাও তেমনি। সন্ধ্যাবেলায় এক গর্ভবতী এল। সরকারি হাসপাতাল তো, কে কতটা খোঁজ রাখে? জন্ম দিয়ে মা উধাও। পাপের ফল ফেলে গেল এখানে।”

বাচ্চাটির কান্নায় অধরার মন গলে যায়। এমন নিষ্পাপ মুখ, এমন ক্ষুধার্ত আর্তনাদ, মনটা টনটন করে উঠল। ব্লাউজ চুপচুপে হয়ে ছিল তখনও, বুকের দুধে ভিজে। নিয়তিই যেন ওকে তৈরি রেখেছিল। অধরা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল, বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। এক সময় মুখটা ধরে ফিড করাতে শুরু করল। কান্না থেমে গেল সেকেন্ডেই। তৃষ্ণার্ত শিশুটি দুধ পান করতে লাগল। একসময় ধীরেধীরে চোখ বুজে এলো বাচ্চাটির। অধরা বাচ্চাটির তুলতুলে হাত ধরতেই, বাচ্চাটি শক্ত করে ওর আঙুল আঁকড়ে ধরল।

সাদা গায়ের রং, টকটকে লাল ঠোঁট, আর মিষ্টি সেই মুখখানা হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মত। শোনা যায়, নবজাতকের গায়ের রং বদলাতে থাকে সময়ের সাথে। শিশুটিও ধীরে ধীরে রঙ বদলাতে শুরু করে। ফর্সা রংটি গিয়ে গায়ে ধরা দেয় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছায়া।

____________

দু’দিন পর…

ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতটার ঘরে। নীরব ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে হাত-মুখ মুছতে ব্যস্ত। তন্মধ্যে দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নীহারিকা হালকা কেশে বললেন,

-” নীরব..বাবা।”

-” হ্যা…মা ভেতরে আসো।”

মায়ের হাতে কফির মগ দেখে নীরব সাথে সাথে বলে উঠল,

-” মা..তুমি কষ্ট করে কফি আনতে গেলে কেনো? পরীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হতো।”

নীহারিকা উত্তর দিলেন না। বেড টেবিলের উপর মগটা নামিয়ে বিছানার দিকে এগোলেন। কাঁথাটা হাতে তুলে ভাঁজ করতে করতে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন,

-” তার হাতের কী অবস্থা এখন? ব‌্যথা আছে নাকি কমেছে?”

নীরব মৃদু হাসল। কফির মগ হাতে নিতে নিতে বলল,

-” কমেছে। ওষুধ খাচ্ছে…ব‌্যথা নেই এখন।”

-” যাক, আলহামদুলিল্লাহ।”

পরশু রাতে নীরব ফোন দেওয়ার পর….. প্রত্যাশা হসটপিটাল থেকে বাসায় ফিরছি বলতেই; নীরব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে– কী হয়েছে? প্রত্যাশা সবটা বলতেই, নীরবকে না জানানোর জন্য অল্প-স্বল্প রাগ করে। তারপর কিছু উপদেশ বাণী দিয়ে ফোন রাখে। ফোনে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল–কোন হসটপিটাল? কোন ডক্টর? প্রত্যাশা ঘুমঘুম চোখে হামি দিয়ে বলেছিল– ডক্টর প্রিতম, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। সার্থকের নিক নামেই ও অভ্যস্ত থাকায়, নীরব অতটা বুঝতে পারে না। আর একই নামে এই শহরে কতকত ডাক্তার।

পরের দিন সকাল সকাল অফিস যাওয়ার আগেই প্রত্যাশাকে দেখতে যায় নীরব। বলে আসে– ব্যান্ডেজ খোলার দিন, ও নিজে নিয়ে যাবে প্রত্যাশাকে।

নীরব সোফায় বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিল। নীহারিকা সামনে দাঁড়ালেন। নীরব বলল,

-” কিছু বলবে মা?”

নীহারিকা ছেলের পাশে বসলেন। বললেন,

-” হুম…বলতে তো চাই অনেক কিছুই। বললে তো তোদের কাছে আবার খারাপ মা হয়ে যাব রে বাবা। এমনিতেই একজনের কাছে ভালো মা হতে পারিনি। ওইযে তার ভুল গুলো মানিনি।”

-” এখনো কারো কোনো ভুলই তোমাকে মানতে হবে না, মা। তুমি নিসংকোচে বলো তো।”

-” আসলে আমি জানি, প্রত্যাশা ছোট। তারপর দ্যাখ এতটাও ছোট নয়। ও যেভাবে চলাচল করে, আমার মোটেই পছন্দ নয়। বেয়াই সাহেবকে সেদিন বলতে চেয়েছিলাম, তবে মেহমান হয়ে আসছেন; বললে কেমন দেখাত। তাই বলতে পারিনি। তুই উদাসীন না হয়ে, প্রত্যাশার বাচ্চামো গুলোকে সাপোর্ট না করে; ওকে বলিস। স্কুটি চালাতে বারণ করিস। একটু ম্যাচিউরিটি নিয়ে যেন চলাচল করে। কীরকম এখনো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়।”

নীরব মায়ের কথায় হালকা করে হাসল। কফির মগটা এক পাশে রেখে মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,

-” মা, প্রত্যাশা একটু চঞ্চল এটা ঠিক। কিন্তু এই বয়সেই তো ওর চঞ্চলতা থাকার কথা। আর জানোই তো, যাকে শুরু থেকে যদি শুধু ‘এই করো না’, ‘ওটা করো না’ বলে আটকানো হয়; তাহলে সে নিজের মতো করে ভাবার সুযোগ পায় না। বরং উল্টো রিঅ্যাক্ট করে বসে। ওর মধ্যে আমি খা’রাপ কিছু দেখি না, মা। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই ও নিজে থেকে শিখে নেবে, বুঝে যাবে। আমরা যদি পাশে থেকে ওকে একটু ধৈর্য ধরে গাইড করি, তবেই না ও আমাদের কথা মন থেকে গ্রহণ করবে। নিষেধের চেয়ে বোঝানোটা অনেক বেশি কার্যকর, তাই না মা?”

নীহারিকা কিছু না বলে মুখটা গোমড়া করে রাখলেন। নীরব আলতো হেসে বলল,

-” সময়ের সাথে সাথে একসময় ও ঠিক বুঝদার হবে। টেনশন নিও না মা।”

নীহারিকা অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,

-” যা ভালো বুঝিস কর। আমার মনেহলো তাই বললাম। এখন তুইও যদি ওভাবে গা ছাড়া ভাবে চলিস, তাহলে আর কিছু বলার নেই আমার। বুঝবি… যেদিন একটা অঘটন ঘটবে। সেদিন মায়ের কথা হাড়ে হাড়ে টের পাবি। ওইযে একজন পাচ্ছে তো।”

-” মা সামনের মাসে তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। তোমাকে অবশ্য কথা দিতে হবে। যেখানেই নিই না কেনো তুমি রিঅ্যাক্ট করতে পারবে না।”

-” কোথায়? আগে বলবি তো?”

নীরব হেঁয়ালি করে বলল,

-” সিক্রেট।”

___________

সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। নীরব ফোন করে প্রত্যাশাকে রেডি হতে বলেছে। কি একটা কাজে ব্যস্ত ছিলো। তাই এখন সরাসরি অফিস থেকেই এখানে আসছে। নীরবের দেওয়া ড্রেস গুলোর মধ্যে থেকে একটা পড়েছে প্রত্যাশা। দুধ-সাদা রঙের ফিটিংস টপ। টপের গলার কাছে সুন্দর করে গাঁথা একটা স্টাইলিশ বো-টাই। যেটা অভিজাত, কোমল আর আকর্ষণীয় করেছে প্রত্যাশার চেহারায়। টপ কোমড় ছাড়িয়ে অল্প নিচে, কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি সাদা-কালোর মিশেলে হালকা ঢেউ তোলা স্কার্ট। আয়নায় প্রত্যাশা নিজেকে দেখে নেয়। মন্দ লাগছে না, বেশ সুন্দরই লাগছে! লোকটার পছন্দ আছে বলতে হবে।

নীরব বাসার সামনে বাইক থামিয়ে ফোন দিতেই প্রত্যাশা এক প্রকার দৌড়ে বেরোতে থাকে। অধরা ধ’ম’কিয়ে মেয়ের হাতে মেডিকেল ফাইল তুলে– আস্তে ধীরে যেতে বললেন।

অধরা দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রত্যাশা চপল পায়ে এগিয়ে এল। পায়ের শব্দে নীরব তাকাল। রাতের কৃত্রিম সাদা আলোয় সাদা ড্রেসে প্রত্যাশাকে খুব সুন্দর লাগছে। মুখে ঝলমলে হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়াল প্রত্যাশা। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

-” আ’ম রেডি।”

নীরব চোখের পলক নেড়ে বলল,

-” হু।”

পরপর মৃদুস্বরে আরো বলল,

-” স্যরি একটু লেট হয়ে গেল, বুঝি।”

-” ব্যাপার না।”

তারপর স্কার্টের দুই কোণা হাত দিয়ে ধরে, ঠোঁট চওড়া করে হেসে, ভাব নিয়ে প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,

-” দেখুন তো আপনার পছন্দে কেনা ড্রেস গায়ে, আমাকে কেমন লাগছে?”

নীরব থাম্বস আপ করে দেখিয়ে বলল,

-” অসাম!”

-” আপনার পছন্দ খুব সুন্দর!”

-” তোমার পছন্দ হয়েছে?”

-” হুঁ, খুব খুব।”

নীরব স্মিত হেসে ইশারা করতেই প্রত্যাশা বাইকের পিছে উঠে বসল। একহাতে কোলের উপর মেডিকেল ফাইল রাখল। অন্যহাতটা দিয়ে নীরবের পেট পেঁচিয়ে ধরতে ধরতে বলল,

-” সেদিন বলেছিলেন, এরপর থেকে তোমার ইচ্ছেয় রিস্ক নিবো। তাই আমি বলছি, আমি কোনো রিস্ক-টিস্ক নিতে চাই না। তাই আগেভাগেই ধরে বসলাম।”

.
.

নামিদামি প্রাইভেট হাসপাতালের চকচকে লিফটে উঠে সোজা ছয়তলায় এল ওরা। প্রত্যাশার হাতে ধরা মেডিকেল ফাইলে উপরে বড়বড় করে শুধু হাসপাতালের নাম, ভেতরে প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট আর মূল ফাইল। নীরব চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ওয়েটিং চেয়ারগুলোর দিকে ইশারা করল।

-” তুমি বসো। আমি দেখি কত নম্বর চলছে।”

প্রত্যাশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক বলে বসল। ডাক্তারের চেম্বারের পাশের ডেস্কের ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেল নীরব।

-” কত নম্বর চলছে এখন? ইয়ানূর প্রত্যাশা নামে একটা সিরিয়াল আছে, চেক করে দেখবেন?”

বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পড়ল ডাক্তারের নেমপ্লেটের দিকে। মুহূর্তেই কপালে ভাঁজ পড়ল নীরবের। ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল। ডেস্কের ছেলেটা বলল,

-” ভেতরের পেশেন্ট বেরোলেই ডাকব ম্যাডামকে। আপনি বসুন প্লিজ।”

চোখে ঠাণ্ডা আ”গুন নিয়ে প্রত্যাশার পাশে গিয়ে বসল নীরব। মুখ থমথমে। বলল,

-” তুমি একে দেখিয়েছো?”

-” হ্যাঁ।”

-” আর ডাক্তার পাওনি?”

-” মানে?”

নীরব কিছু না বলে সোজা হয়ে বসল। গম্ভীর মুখে বসে রইল। কিন্তু ওর ভেতরটা যেন পু’ড়তে লাগল রাগে। চেম্বারে ডাক পড়ল। ভেতরে ঢুকতেই সার্থকের সাথে চোখে চোখ। একজনের চোখে আ”গুন অন্যজনের চোখ ঠান্ডা। সার্থক একটুও অবাক হলো না। মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। ঠোঁটে খেলে গেল এক ঠাণ্ডা হাসি।

-” ওহ, বাহ! আজ স্বয়ং এএসপি সাহেব যে! দেশের নিরাপত্তার পরে, এখন বউয়ের সিকিউরিটিও নিজে নিজে দেখতে আসছেন নাকি এএসপি সাহেব?”

নীরব দাঁত কটমট করে বলল,

-” হ্যাঁ, নিজের জায়গায় অন্য কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না। তাই।”

সার্থক বসতে অফার করল। তারপর আরো বলল,

-” হস্তক্ষেপ? আরে ভাই, চিকিৎসা তো করছি। অন্যায় তো আর করছি না।”

নীরব ঠোঁট দুটো শক্ত করে বলল,

-” শুধু অন্যায় নয়, অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধেও আমি একই রকম স্পষ্ট।”

এরমধ্যে সার্থক ইন্টারকমে কফি অর্ডার দেয়। জবাবে বলল,

-” এটা আমার দায়িত্ব।”

-” ওয়েল, তবে সেটার পেছনে স্বার্থ থাকলে ব্যাড।”

সার্থক প্রত্যাশাকে জিজ্ঞেস করে– কোনো সমস্যা আছে কী না? প্রত্যাশা বেচারি একটু অবাকই, এরা দুজন আগে থেকেই পরিচিত নাকি? তবে কথাবার্তা এমন দা-কুমড়া কেনো?

প্রত্যাশার হাতটা নিজের একহাতে ধরে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল সার্থক। নীরবের দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। ঠোঁট আঁটসাঁট করে রেখেছে, দাঁত কিঞ্চিৎ কটমট করছে। চোখের সামনে এহেন দৃশ্য সহ্য হচ্ছিল না কিছুতেই। হঠাৎ ইচ্ছে হল প্রত্যাশার হাতটা টেনে সরিয়ে নিতে। কিন্তু নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখল নীরব।

সার্থক পরপর নতুন করে প্রেসক্রিপশন লিখল। এতক্ষণে কফি এসে যায়। সার্থক কফি নিতে বলল। নীরব কোনো কথা না বলে সোজা উঠে দাঁড়াল। তারপর আচমকা একহাতে প্রত্যাশার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে, আরেক হাতে ফাইল তুলে নিল। বলল,

-” নো থ্যাংকস।”

সার্থক বেল চাপতেই বয় ছুটে এল। সার্থক ভিজিট রাখতে বারণ করল। নীরব প্রত্যাশার হাতে ফাইল দিয়ে ত্রস্ত টাকা বের করে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে সার্থকের উদ্দেশ্য বলল,

-” সাহায্য করার হলে, রাস্তায় মানুষের অভাব হবে না। সেখানে গিয়ে সাহায্য করো। নীরবের বউয়ের জন্য, নীরবই এনাফ। ক্লিয়ার?”

ভিজিট ধরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল। নিচ থেকে ওষুধ কিনে বাইকের কাছে যেতে যেতে রাগের মাথায় প্রত্যাশাকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে ফেলে নীরব। বলল,

-” শহরে বুঝি ডক্টরের অভাব পড়েছিলো! এখানেই আসতে হলো। এই হসটপিটালেই তো কত অভিজ্ঞ ডাক্তার ছিলো। সব রেখে…”

প্রত্যাশা নির্বোধের মতন বলল,

-” কী সমস্যা? ডক্টরটা তো ভালোই…কত আন্তরিক। আর দেখতে শুনতেও তো ভালোই। আমি বুঝলাম না আ___”

নীরবের রাগি চোখদুটো দেখে মুখের কথা থেমে যায় প্রত্যাশার। নীরবের রাগের আ”গুনে কেরোসিন তেল ঢেলে দেয়….. প্রত্যাশার কথাগুলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল নীরব,

-” সে দেখতে শুনতে ভালো….তাকে দেখতেই আসছিলে বুঝি?”

-” এ মা….আপনি আমার কথাটা এভাবে মিন করছেন কেনো? আর উনি কীসের শ’ত্রু আপনার? বুঝঝি না তো। চিনেন ওনাকে?”

রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে নীরবের। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে। বাইকে বসে রাগ ঝাড়তে লাগল,

-” এত বড় মেয়ে হয়ে কীভাবে পড়ো শুনি? আর সেদিন ডক্টরের নাম জিজ্ঞেস করলাম। পুরো নামটাও বলতে পারলে না। আগে জানলে… উফ্! ডক্টর দেখাতে আসলে, একবারও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না।”

প্রত্যাশার এবার কান্না পাচ্ছে। উনি শুধু শুধু বকছে। আম্মুই তো প্রথমে বলতে দেয়নি। ওর কী দোষ! স্পিডে বাইক চালায় নীরব। আর একটিও কথা বলে না।

.
.

সার্থক ঘোষণা দিয়ে দেয়—বাকি পেশেন্টদের চলে যেতে বলো। আজ আর একটাও পেশেন্ট দেখব না। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে ফোন করল। ওপাশ থেকে রিসিভ করে বলল,

-” হ্যা ব্রো, বলো।”

-“*******___”

প্রীতি নীরবে শুনল। সার্থক ফের বলল,

-” যা করার তুই করবি।”

-” আমি….আমি কী করে?”

-” অসির চেয়ে মসি বড়। কথাটা জানিস না? মস্তিষ্ককে কাজে লাগা।”

____________

প্রত্যাশা মুখটা ভার করে বাসায় ঢোকে। নীরব পাশাপাশি। এতক্ষণের রাগটা প্রত্যাশার ম্লান মুখ দেখে নিমিষেই মিইয়ে আসল। নীরব গিল্টি ফিল করল। শুধু শুধু রাগের মাথায় প্রত্যাশাকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। নীরবকে বসতে বলে অধরা নাস্তা আনতে যায়। প্রত্যাশা ধীর পায়ে নিজের রুমে ঢোকে। হঠাৎ করেই হাতে টান পড়ল। পিছু ঘুরে দেখল। নীরব সরু চোখে চেয়ে, হাত ধরে। প্রত্যাশা কিছু বলার আগেই, নীরব দু’পা এগিয়ে এল। তারপর অপরাধীর সুরে বলল,

-” স্যরি। আমি খুব স্যরি…তখন তোমার সাথে রুঢ় আচরণ করা একদমই উচিত হয়নি। আসলে তখন কী হয়েছিল আমার! আমি নিজেও জানি না।”

প্রত্যাশার মুখের মেঘ কাটতে থাকল। নীরব এক অবাক কান্ড করল। ধরে রাখা প্রত্যাশার হাতটা তুলে, হাতের উল্টো পাশে ঠোঁট ছোয়ায়। পরপর মুখ উঁচু করে বলল,

-” স্যরি বলছি তো। প্লিজ আর মুখ ভার করে রেখো না। এভাবে বিদায় নিলে…. অশান্তি লাগবে। প্লিজ, স্মাইল।”

এভাবে বলায় প্রত্যাশার এবার সত্যিই হাসি পেল। এক চিলতে হাসি ওর ঠোঁটে ফুটে উঠল। নীরব মৃদু হেসে বলল,

-” এবার ঠিক আছে।”

তারপর– ঠিকমতো ওষুধ খেয়ো। আরো কয়েকটা উপদেশ দিয়ে নীরব বলল,

-” টেক কেয়ার… বাই।”

প্রত্যাশা জবাবে মিষ্টি হেসে বলল,

-” বাই।”

নীরব আচমকা আরেকটু এগিয়ে এল। একদম কাছাকাছি। তারপর…. তারপর স্লো ভয়েজে বলল,

-” উমম! এবার আমাকে ফলো করে মিষ্টি একটা বিদায় দাও।”

প্রত্যাশার ভ্রু কুঁচকে যায়। ভ্রু বাঁকিয়ে ইশারায় বোঝায়,

-” মানে?”

নীরব দুই আঙুলে আলতো করে প্রত্যাশার গালে মৃদু চাপ দেয়। বলল,

-” ওয়েট…”

তারপর আরেকটু ঝুঁকে…ডান চোখটা টিপল। পরপর টুপ করে প্রত্যাশার ডান গালে চুমু খেল। প্রত্যাশার চোখ কপালে উঠল। ঠোঁটের কোণে হাসির ছটা রেখেই নীরব ভাব নিয়ে বলল,

-” নাউ, ইউর টার্ন।”

#চলবে