#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২১|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
কয়েক জোড়া প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি স্থির নীরবের দিকে। প্রত্যাশা ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে। বুক ভেঙে যাচ্ছে ওর বোবা কান্নায়। চোখের সামনে ইচ্ছের ওভাবে নীরবকে সম্বোধন করতে দেখা, যেন শিরায় শিরায় বি’ষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাগ-ক্ষোভ ঘৃ’ণার পারদ সীমাহীন বাড়ছে। মুক্ত দানার মতো অশ্রুবিন্দু অঝোরে গাল গড়িয়ে পড়তে লাগল। হাতের উল্টোপাশে সিক্ত গাল মুছে তড়াক উঠে দাঁড়াল ও। সহসাই ভেজা গলায় উঁচু স্বরে প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,
-” আপনাকে তো সবাই বিশ্বাস করে, একজন আদর্শবান মানুষ বলে জানে। আমিও তাদের ব্যতিক্রম ছিলাম না। আপনার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিলো, সম্মান করতাম। তাহলে এমনটা কেনো করলেন? বলুন, প্লিজ বলুন আমাকে? এত বড় একটা সত্য লুকিয়ে রেখে কেন বিয়ে করলেন আমাকে?”
দুপুরে ফোনে প্রত্যাশার কথা, এখনকার কথা, তারপর ইচ্ছে। তীক্ষ্ম বুদ্ধি সম্পন্ন নীরবের বুঝতে বাকি রইল না। বলল শান্ত কণ্ঠে,
-” তোমার উচিত ছিলো এ ব্যাপারে আমার সাথে আগে কথা বলা। তাহলে অন্তত এরকম সিনক্রিয়েট হয় ন___”
প্রত্যাশা কথা কেড়ে নিল। কণ্ঠ কাপল তবুও চেঁচিয়ে উঠল,
-” আপনার মনে হচ্ছে আমি সিনক্রিয়েট করছি। আপনার মতো একটা চিটারের সাথে কথা বলার ইচ্ছে আমার ছিলো না। তবে সবাইকে জানানো জরুরী। তাই… অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার মুখোমুখি হতে হলো।”
নীহারিকা, নীলা কিছুই ঠাওর করতে পারছে না। তবে প্রত্যাশার এভাবে কথা বলায় নীহারিকার বদনে রাগ-ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটাকে বে’য়াদব তকমা দিতে মন চাইছে। প্রত্যাশা গলায় আটকানো কান্না গিলে এক নাগাড়ে বলতে থাকে,
-” বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি খুব ভালো অভিনয় করতে পারেন।”
এক সেকেন্ড থেমে গলার চেইনটা শক্ত করে ধরে বলল,
-” নিশ্চয় এটা আমার জন্য ছিলো না। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমি দেখে ফেলায়, আপনি নাটক করে আমার গলায় দিলেন। যখন থেকে আপনার আর প্রীতির ছবি দেখেছি, তখন থেকে এটাকে আমার ফাঁসের দড়ি মনে হচ্ছে। দম আঁটকে আসছে। আপনার প্রতি তীব্র ঘৃ’ণা হচ্ছে এএসপি সাহেব।”
একটানে চেইনটা গলা থেকে খুলে ফেলে প্রত্যাশা। বল প্রয়োগ করায় ছিঁড়ে যায়। পরপর শেষের কথাটা বলতে বলতে ছুঁ’ড়ে ফেলে। নীরবের ঠিক পায়ের সামনে ফ্লোরে পড়ে। নীরবের কপালের রগ টনটন করে উঠল। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধ’ম’ক দিয়ে বলল,
-” থামবে তুমি….আমাকে বলতে দাও। আমার কথা আগে ফিনিশ করতে দাও। তারপর যত খুশি চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার করবে।”
নীলার চোখ ছানাবড়া। একহাতে চোখ ডলল। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে। নীহারিকা বিরক্তির শ্বাস ফেললেন। ধ’ম’কে ইচ্ছে কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল প্রত্যাশা নিজেও। ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে নীরব নিজের রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। প্রত্যাশা ফুপাতে ফুপাতে বলল,
-” আপনি ধ’ম’কিয়ে আমাকে থামাতে চাইছেন?”
এরমধ্যে মাহবুব সাহেব উপস্থিত হন। নীহারিকা অতীষ্ঠ চাহনিতে প্রত্যাশার দিকে চেয়ে বললেন,
-” আরে তুমি থামতো। আর নীরব কাহিনী কী বল? কী সমস্যা হয়েছে তোদের? প্রত্যাশা কী বলছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আর এই বাচ্চাটা কে?”
-” ইচ্ছে নীবিড় আর প্রীতির মেয়ে।”
নীহারিকা যেন একটা বড়সড় ধা’ক্কা খেলেন। বিস্ময়ে তাকালেন ইচ্ছের দিকে। ছোট্ট মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেছে, চেঁচামেচিতে আরও বেশি অস্থির। এক হাতে নীরবের শার্ট আঁকড়ে ধরেছে। আর অন্য হাতটি শক্ত করে চেপে আছে নীরবের হাতের মুঠোর ভেতর। নীহারিকা চোখমুখ শক্ত করে শুধালেন,
-” নীরব তুই ওদের সাথে যোগাযোগ রাখতিস?”
নীরব নির্বিকারভাবে ছোট করে জবাব দিল,
-” হ্যাঁ।”
প্রত্যাশা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-” নীবিড়…কে?”
মাহবুব সাহেব মুখ খুললেন,
-” আমার ছেলে। নীবিড় আর নীরব জমজ।”
প্রত্যাশা যেন জোরসে ঝটকা খেল। ভিতু চোখে নীরবের দিকে তাকাল। নীরবের ফরসা মুখে অমাবস্যা নেমে আছে। প্রত্যাশা আলগোছে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। জড়তা নিয়ে নিচু স্বরে বলল,
-” উনি কোথায়? আর….আর উনার কথা জানিই বা না কেনো? কখনো বলা হয়নি…”
নীহারিকা থমথমে মুখে বললেন,
-” বড়লোক শাশুড়ি আর বউয়ের আঁচলের তলায় থাকে। সেখানে থেকে উচ্ছন্নে গিয়েছে____।”
নীরব জোরালো শ্বাস ফেলল। নীহারিকাকে থামিয়ে দেয়,
-” মা…. প্লীজ থামবে।”
নীহারিকা ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন,
-” কেনো ভুল কিছু বলেছি আমি? কবেই তো ওর টাকাওয়ালা শাশুড়ির কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। দেখলি না, তোদের বাবার অসুস্থতার সময় একটিবারও দেখতে আসলো না। নিভান ব্লাড লাগবে বলে ফোন দিলো। বউকে দিয়ে ফোন ধরাল। বউ বলল, ওরা ট্যুরে গেছে আসা সম্ভব নয়। পরও তো পরের অসুস্থতার কথা শুনে দেখতে আসে। কিন্তু ও….ফিরেও এদিকে মুখ করল না।”
কথার মাঝে প্রত্যাশা প্রশ্ন করে উঠল,
-” ইচ্ছে আপনাকে পাপা ডাকে কেনো?”
নীরবের মসৃণ কপালে খাঁজ পড়ল। মেয়েটা এখনো সেই এক জায়গায় আঁটকে আছে। নীরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রত্যাশা মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
-” না মানে ও বলেছিল, নুপুর পাপা দিয়েছে। তারপর এখনো আপনাকে ডাকল…আপনি কিছুই বললেন না।”
পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আগে বউকে সামলাতে হবে। না হলে রণক্ষেত্রও হতে পারে। নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে শর্টকাটে বলল,
-” নীবিড় অসুস্থ। হসপিটালে আছে। নীবিড়ের অনুপস্থিতিতে ইচ্ছে মানসিক রোগে ভোগে। আমি যখন ফার্স্ট ওদের সাথে দেখা করতে যাই, ইচ্ছে আমাকে ওর পাপা ভেবেছিল। শুধরে দিলেও ও অবুঝ থাকে।_____”
পরপর সাইকিয়াট্রিস্টের বলা কথাগুলোও বলে নীরব। প্রত্যাশাও অল্প কথায় ভুল বোঝার কথাটা বলে। মাহবুব সাহেব নরম স্বরে বললেন,
-” প্রত্যাশা মা তোমার উচিত ছিলো প্রথমেই নীরবের সাথে কথা বলা। তোমার সন্দেহ হওয়া ভুল নয়। তবে বলব, নীরবের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলে এতটুকুও ভুল বোঝাবুঝি হয় না। যাক তবুও অল্পের উপর দি___”
নীহারিকা বেগম গম্ভীর মুখে বললেন,
-” ও যা করেছে ঠিকই করেছে। সবারই জানা উচিত ছিলো। আর এসব সন্দেহ যে কতটা ভয়ংকর, কতটা কষ্ট দেয় তা আমি জানি।”
শেষের কথাগুলো মনেমনে বললেন। তারপর নীরবের দিকে অসন্তুষ্ট চাহনিতে চেয়ে বললেন,
-” এই বাড়িতে আমার কথার বিরুদ্ধে প্রথমে নীবিড় গিয়েছে। তারপর তুইও দেখিয়ে দিলি; আগা নৌকা যেদিকে যায় পিছের নৌকাও সেদিকেই যায়। আমি কী পইপই করে বলেছিলাম না? ওই ফ্যামেলি থেকে দূরে থাকতে। আমার কথার অবাধ্য হয়ে তুই ওদের সাথে ঠিক যোগাযোগ রেখেছিস।”
নীরব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-” মা আমি আজও বুঝি না। তোমার একচুয়েলি প্রীতিকে নিয়ে সমস্যাটা কী ছিলো? শুরুতেই তুমি যদি ওদের বিয়েটা মেনে নিতে, তাহলে আজ এমন দিন আসতো না।”
-” ওই মেয়েকে বিয়ে করতে বারণ করেছিলাম। শোনেনি আমার নিষেধ, বারণ। সেদিন যদি বারণ শুনতো, তাহলে আমার সন্তান আজ আমার কাছেই থাকতো। আমার জোড়া সন্তান, আলাদা হতো না।”
নীরব কিছু বলবে, তার আগেই মাহবুব সাহেব ইশারায় নীরবকে থামতে বললেন। ইচ্ছে এত কথাবার্তার মাঝে ভ’য়ে চুপসে ছিল। প্রত্যাশা সন্তর্পণে ইচ্ছের হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিল। নীরব আড়চোখে দেখল। প্রত্যাশা ভেতরে ভেতরে ভ’য়ে আছে। নীরবের দিকে তাকানো সাহসে কুলাচ্ছে না।
নীলাশা ভাবছে–ইয়া আল্লাহ! শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের আরেক পুত্রকে ত্যাজ করে রেখেছেন। এত কাহিনী। আমিও তো কিছু জানি না। আর বিয়েই হয়েছে সবে পাঁচ মাস। তারমধ্যে আগে তো পড়াশোনার অজুহাতে ও বাড়িই বেশি থেকেছি।
এত কথাবার্তার মাঝে এতক্ষণে নীরবের খেয়াল হলো। আর খেয়াল হলো বলেই ফোনটা পকেট থেকে বের করতে করতে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল থমথমে স্বরে,
-” নিশ্চয় ইচ্ছেকে না জানিয়ে এনেছো। ওর মাম্মা বা বাসার লোকজন জানে তুমি ইচ্ছেকে এনেছো?”
প্রত্যাশা ফাঁকা ঢোক গিলল। জিভের ডগা দিয়ে নিম্নোষ্ঠ ভিজিয়ে মাথাটা দু’দিকে না বোধক নাড়ল। বলল মিহি স্বরে,
-” নাহ। ওকে দেখভাল করা মেয়েটা জানে শুধু।”
নীরব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে প্রীতির নম্বরে কল দিল। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে জবাব এলো,
-” বলো”
-” ইচ্ছে আমার কাছে আছে। আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ওকে দিয়ে আসবো।”
-” তার আর দরকার পড়বে না। আমি রাস্তায় আছি। দু মিনিটের মধ্যেই আসছি।”
নীরবও আর দ্বিরুক্তি করল না। খট করে কল কা’ট’ল। প্রত্যাশার গা ঘেঁষে ইচ্ছে। প্রত্যাশা হাঁসফাঁস করতে থাকল। নীরবের দৃষ্টি স্বাভাবিক ঠেকছে না। ঝ’ড়ে’র আগে পরিবেশ যেমন থমথমে থাকে, ঠিক তেমন নীরবের মুখাবয়ব। প্রত্যাশা দোয়া-দরুদ পড়ছে। যেন নীরব বেশি রাখঢাক না করে। একা পেলে কী করবে আল্লাহ মালুম! এইভেবে প্রত্যাশার হাত-পা জমে আসছে।
এরমধ্যে শর্মিলা আর আনিশা বাসায় এসে সবটা শোনে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইচ্ছেকে দেখতে থাকে। গাল ছুঁয়ে আদরও করেন। মাহবুব সাহেব এগিয়ে এলেন ইচ্ছের কাছে। ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে ডাকলেন,
-” আমার ছোট আপু, কেমন আছো তুমি?”
নীহারিকা ডায়নিংয়ে গেলেন। এদিকে আগ্রহ নেই তাই দেখাতে গুছানো টেবিল ফের গুছাতে থাকলেন। আর আড়চোখে চাইলেন এদিকে। নীরব একহাত পকেটে গুঁজে অন্যহাত কপালে স্লাইড করে অপেক্ষায় আছে। প্রীতিকে নিয়ে মা যেনো আবার সিক্রিয়েট না করে বসে। এই নিয়ে চিন্তায় আছে। প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে ছিলো ইচ্ছে। মাথায় আদুরে স্পর্শ পেয়ে গোল্লা গোল্লা চোখ করে তাকায়। প্রশ্ন করল,
-” তুমি?”
মাহবুব সাহেব একগাল হেসে বললেন,
-” আমি তোমার দাদুভাই।”
-” তুমি বুঝি পাপার পাপা?”
মাহবুব সাহেবের চোখ ভিজে ওঠে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
-” হ্যাঁ।”
সদর দরজাটা হালকা টানা ছিলো। সার্থক একহাতে ধাক্কা দিয়ে ইশারা করতেই প্রীতি ভেতরে পা রাখল। ক’পা দিতেই সোজাসুজি ড্রয়িংরুমে ইচ্ছেকে দেখতে পেল। উচ্চ স্বরে ডাকল,
-” ইচ্ছে।”
ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখেমুখে হাসি ফুটল,
-” মাম্মা!”
ইচ্ছে দৌড়ে গেল। প্রীতির সামনে দাঁড়িয়ে মুখে খুশির ঝিলিক ছড়িয়ে ফের ডাকল,
-” মাম্মা।”
উপস্থিত সবার নজর এদিকে পড়ল। ইচ্ছেকে দেখভাল করা মনা প্রত্যাশার দিকে তর্জনী তাক করে বলল,
-” ম্যাডাম…স্যার ওই মেয়ে। ওই যে ওই মেয়ে। ওই মেয়ে জোর করে ইচ্ছে সোনামণি রে নিয়া আইছে। আমি মানা করছি। শোনেনি। আমাকে পুলিশের ভয়-ডর দেখায়ছে। পুলিশের চৌদ্দ শিকে ভরার কথাও বলেছে, হ্যাঁ। বিশ্বাস না হলে জিগান। জিগান উনারে।”
প্রত্যাশা জড়সড় হয়ে দাড়াল। দৃষ্টি নুইয়ে ফেলল। শেষের কথাশুনে নীরবের মেজাজ চটল। বউ ভবিষ্যতে আর কত কী করে আল্লাহ জানে! ডা’কাতি করতে গিয়েও উল্টো পুলিশের ভ’য় দেখিয়ে করে আনতে পারে। এই মেয়েকে নিয়ে তা অসম্ভব নয়। প্রীতি এগিয়ে আসলো। তীক্ষ্ণ নার্ভ সম্পন্ন প্রীতি চিনে ফেলে প্রত্যাশাকে। ছবির এই সেই মেয়ে। প্রীতি এগিয়ে গেল। রাগি স্বরে বলল,
-” তোমার সাহস হয় কী করে আমার মেয়েকে এভাবে আনার? তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। ভাগ্যিস নীরবের বউ বলে এবারের মত বেঁচে গেলে। নইলে আমার অজান্তে আমার মেয়েকে চু’রি করে আনার অপরাধে তোমার নামে থানায় ডায়েরি করতে দু সেকেন্ড সময় নিতাম না।”
প্রীতি তেড়ে প্রত্যাশার কাছাকাছি যেতে নেয়। পিছুন থেকে ওর হাতে টান পড়ল। সার্থক ওর হাত টেনে ধরেছে। চোখ দিয়ে ইশারা করল। ফিসফিসিয়ে বলল,
-” প্রীতি কুল….কুল। হাইপার হোস না।”
প্রীতির মেজাজ চটল। অন্যর বউয়ের প্রতি ভাইয়ের আলগা দরদ দেখে পিত্তি জ্বলে উঠে ওর। নীহারিকা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,
-” তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমারই সামনে আমার বাড়ির ছোট বউকে মামলা দেওয়ার হুমকি দাও। ভ’য় দেখাচ্ছো?”
প্রীতি দুই হাত বুকে ভাঁজ করল,
-” না ভ’য় নয়, সতর্ক করছি।”
নীরব বলল,
-” প্রত্যাশা বলছিলো ও মনার কাছে এড্রেস দিয়ে এসেছে। তুমি এত হাইপার না হয়ে, ইচ্ছেকে নিয়ে টেনশন না করে আমাকে একবার কল দিলেই শিওর হওয়া যেতো। শুধু শুধুই বাড়তি টেনশন নিয়ে বিপি বাড়াতে হতো না।”
যাক শাশুড়ি, বর ওর পক্ষে কথা বলায় একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল প্রত্যাশা। তবুও নিজের ভুলের জন্য প্রত্যাশা বলল,
-” স্যরি! আমার এভাবে ইচ্ছেকে আনা ঠিক হয়নি। আমি এক্সট্রিমলি স্যরি।”
নীলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রীতিকে দেখছে। গায়ে কলাপাতা রঙের থ্রি পিস, ওড়নাটা কাঁধের একপাশ দিয়ে সামনে রাখা। চুলগুলো কাঁধের থেকে একটু নিচে। হালকা সোনালী রং করা। নীলার মুখ ভার হয়ে এল–ভেবেছিলাম এ বাড়ির একমাত্র সুন্দরী বউ আমিই। প্রত্যাশার থেকে পড়াশোনায় ভালো, গায়ের রং উজ্জ্বল। এখন তো দেখছি এ ওভার স্মার্ট আর একদম বলিউডের নায়িকার মতো দেখতে। ধূর, ভাল্লাগে না!
শর্মিলা কোমল স্বরে বলল,
-” বসো তোমরা।”
প্রীতি উত্তরে রুক্ষ স্বরে বলল,
-” এখানে বসতে আসিনি। আমার মেয়েকে নিতে এসেছি।”
নীহারিকা কণ্ঠনালীতে আসা শব্দগুলো গিলে নিলেন। ইচ্ছের হাত ধরে প্রীতি বলল,
-” ইচ্ছে চলো।”
ইচ্ছে হাত ছাড়িয়ে বলল,
-” মাম্মা দাঁড়াও, সবাইকে বাই বলি।”
মাহবুব সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে বলল,
-” বুড়া দাদু বাই।”
মাহবুব সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” আবার এসো দিদিভাই।”
পরপর নীহারিকার সামনে দাঁড়িয়ে ঝলমলে হেসে বলল,
-” তুমি আমায় খাইয়ে দিয়িছো। তুমি খুব খুউব মিষ্টি।”
এত আদুরে ভঙ্গিতে বলল। নীহারিকার শক্ত মনটাও কেমন কেমন করে উঠল। ছলছল চোখে মায়াময় মুখটায় চেয়ে রইলেন। প্রীতি এগিয়ে ইচ্ছের হাত ধরে টান দিয়ে- “চলো” বলে পা চালাল। ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বলল চেঁচিয়ে,
-” পাপা, আমি থাকব।”
ইচ্ছের অপর হাতটা সার্থক ধরল। দু’জনের মাঝে ইচ্ছে। ও মাথাটা এদিকে করে একভাবে চেয়ে রইল। নীহারিকা তিতিবিরক্ত কণ্ঠে বললেন,
-” দেখেছো তোমরা, ওই মেয়েটার হয়ে আমাকে বোঝাও। আজ সরাসরি দেখলে তো। এখানে শ্বশুর-শাশুড়ি বড়রা আছে কাউকে সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন বোধটুকু করল না। কেমন দাপট নিয়ে আসলো, আবার বেরিয়ে গেল।”
মাহবুব সাহেব রুমে চলে গেলেন। শর্মিলা একটু আগেই বাইরে থেকে এসেছেন। ফ্রেশ হওয়া জরুরী। বেশি কথা না বলে বলেন,
-” আপা বাদ দাও না। তবে আমাদের নীবিড়ের মেয়েটা কিন্তু ভারী মিষ্টি। একদম নীবিড়ের মতোই দেখতে।”
নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। শর্মিলাও নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল। ঠিক এমন সময় নীরব সামনাসামনি দাঁড়াল প্রত্যাশার। সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাতেই, প্রত্যাশার হাত-পা ভয়ে বরফের মতো জমে গেল। নীরব টু শব্দটি না করে প্রত্যাশার হাত ধরে এক প্রকার টেনে রুমে আনল। পরপর হাতটা ছেড়ে শব্দ করে দরজা লাগাল। দরজার ধাড়াম শব্দে প্রত্যাশা কেঁপে উঠল। নীরব নব ঘুরিয়ে দরজা লক করে দেয়। প্রত্যাশা শুকনো ঢোক গিলতে থাকে।
নীরব ওর দিকে এগোল। প্রত্যাশা ভয়ে ভয়ে দু’পা পেছাতেই ওর পিঠ দেয়ালে ঠেকল। প্রত্যাশার বুক ধড়ফড় করছে। ভাবল–ইয়া আল্লাহ! মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবলের হাবভাব তো কিছুই বুঝতে পারছি না। নিশ্চয় এখন রোমান্স করার জন্য দরজা লকড করেনি! আর নাতো চুমু খেতে কাছে আসছে।
এতটুকু ভেবেই আপনাআপনি ওর হাত দু’টো হাওয়াই মিঠাই এর মতো তুলতুলে গালে চলে গেল। মনেমনে ভাবে–ইয়া মাবুদ রক্ষে করো। দুইগালে ঠাডিয়ে চড় না পড়ে।
নীরব ওর চোখে চোখ রেখে দারাজ স্বরে প্রশ্ন করল,
-” দুপুরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিছু হয়েছে কী না! তখন বলোনি কেনো?”
প্রত্যাশা উত্তর দিতে পারল না। নীরব ফের বলল,
-” তখন যদি আমাকে বলতে তাহলে এতটা ঝামেলা হয় না।”
প্রত্যাশা সাহস সঞ্চয় করে বলল,
-” বাররে, আমার কী দোষ! আমি কী জানতাম নাকি আপনার টুইনস আছে! আমার জায়গায় আমি ঠিক আছি, হু।”
এইবলে প্রত্যাশা ডান দিকে দু’পা এগিয়ে গেল। দুইহাত বুকে ভাঁজ করে উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়াল। নীরব ওর বাহু ধরে একটানে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
-” এত কিছু ঘটানোর পরেও বলছো তুমি ঠিক আছো?”
-” হুম। কারনটা আপনি আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতেন। এটা একটা সেনসিটিভ ইস্যু। মেয়েদের কাছে স্বামীর বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। আর একটা মেয়ের কাছে বিষয়টা কতটা প্যাথেটিক তা কেবল তারাই জানে। পৃথিবীতে সবকিছু ভাগাভাগি করা গেলেও স্বামীর ভাগ মেয়েরা মানতে পারে না। আপনি জানেন ছবিটা দেখার সাথে সাথে আমার মাথায় আ’গু’ন ধরে গিয়েছিল।”
নীরব গাল ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,
-” থ্যাংক গড! রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা কিছু করোনি। থানায় গিয়ে মামলা দিয়ে বসোনি সেটাই তো বেশি দেখছি।”
প্রত্যাশা বিজ্ঞের মতন মুখ করে বলল,
-” হু।”
পরপর ঠোঁট কা’মড়ে হালকা হেসে আচমকা নীরবের শার্টের কলার চেপে ধরল। মুখটা টেনে নিজের দিকে নামাল। নীরব চমকে গিয়ে কিছুটা হতবাক। নীরবের মুখটা প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে। প্রত্যাশা এক আঙুল দিয়ে নীরবের গলা ছুঁয়ে হালকা করে টান দেওয়ার মতো করল। চোখেমুখে কপট রাগ মিশিয়ে বলল,
-” ভাগ্য ভালো যে আপনার গলায় ছু’রি চালাইনি।”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২২|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
-” ভাগ্য ভালো যে আপনার গলায় ছু’রি চালাইনি।”
নীরব ঠোঁটে প্রশ্রয়মাখা হাসি টেনে বলল,
-” তাই নাকি?”
প্রত্যাশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাব নিয়ে বলল
-” ইয়েস, মিস্টার।”
নীরব একহাতে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
-” বাহ! ভুল বুঝেও যে তুমি এতটা জেলাস আর ক্ষুব্ধ হবে সেটা আমার কাছে কল্পনাতীত ছিলো। কারন এখন অবধি কোনো কিছুতেই তোমার মধ্যে সিরিয়াসনেস দেখিনি। যাক একটা ব্যাপারে তবুও তো দেখলাম। আর যাইহোক না কেনো তুমি বরের ব্যাপারে সিরিয়াস!”
প্রত্যাশা একগাল হেসে সায় দিয়ে বলল,
-” হুম। অবশ্যই সিরিয়াস।”
পরমূহুর্তেই প্রত্যাশা নির্বিকার ভাবে বলতে লাগল,
-” আসলে বিয়ের আগে আপনার বুকশেলফের একটা বইয়ের ভাঁজে ছবি পেয়েছিলাম। তারপর সেদিন একেএকে সবটা এমনভাবে মিলে গেল, ভুল বোঝাটা অস্বাভাবিক নয়। তাই হয়তো একটু বেশিই রিয়েক্ট করে ফেলেছি। তবে এরজন্য আমি মোটেই ক্ষমাপ্রার্থী নই।”
শেষ কথাটা বলে দুই হাত এক করে আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুজে দুলতে দুলতে দাঁত কেলিয়ে হাসল প্রত্যাশা। নীরব প্রত্যুত্তরে নরম স্বরে বলল,
-” বুকশেলফে নীবিড়ের বইও আছে। ছবিটা নীবিড়ের বইয়ে ছিলো। এ ব্যাপারে তুমি রং, তোমার রাগ-ক্ষোভ রং, মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং সবটা অযুক্তিক আমি সেটা বলছি না। বিষয়টা কখনো এরকম হবে, সে ব্যাপারে আমার ধারনা ছিলো না। তবে তোমার উচিত ছিলো অ্যাট ফার্স্ট আমার সাথে কথা বলা। তোমার সন্দেহ হয়েছে ডিরেক্ট আমাকে বলা। দু’জনে কথা বললে ক্লিয়ার হওয়া যেতো।”
-” ওই মূহুর্তে আপনার সাথে স্বাভাবিক কথা বলার মুডে আমি ছিলাম না। শুধু রাগ আর রাগ….তরতর করে বাড়ছিলোই। আর সবসময় চোখের সামনে ওই কাপল পিকটাই ভাসছিলো। তাও আবার একহাতে জড়িয়ে ধরা, গালে গাল ছুঁয়ে থাকা। মাথায় আমার দ’পদপ আ’গুন জ্বলছিল…..।”
হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে প্রত্যাশা। ওর বলার ভঙি দেখে নীরব মুচকি হাসল। হঠাৎ আলতো গলায় প্রশ্ন করল,
-” ভালোবাসো আমাকে?”
আকস্মিক প্রশ্নে প্রত্যাশা হতবাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুখটা হা হয়ে যায় ওর। নিমিষেই কথার খেই যেন হারিয়ে ফেলল। নিশ্চুপ রইল। নীরব আরও কাছে এগিয়ে গাঢ় স্বরে ফের শুধাল,
-” বলছো না যে কিছুই? তাহলে বুঝি এখনো আমার প্রতি কোনো ফিলিংস জন্মায়নি তোমার? তারপরও এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলে?”
প্রত্যাশা ভ্রু ট্রু কুঁচকে ফেলল। গমগমে স্বরে বলল,
-” ফিলিংস-টিলিংস জন্মেছে কিনা জানি না! তবে শুধু এতটুকু জানি…..”
কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে থামল প্রত্যাশা। নীরব ডান ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় বোঝাল—‘কী’ প্রত্যাশা ঠোঁটে হাসি টেনে হুট করে দু’হাতে নীরবের গলা জড়িয়ে ধরল। অধিকার বোধ নিয়ে আবেগি স্বরে বলল,
-” আমি আমার বরের একমাত্র আদরের বউ হয়ে থাকতে চাই। তার লাইফের শুরু থেকে শেষ অবধি একমাত্র মেহবুবা আমিই হতে চাই। আমিই থাকতে চাই। এটা আমার স্যাটিসফিকেশন। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
নীরবের শার্টের বোতাম খোলা থাকায় বাতাসে শার্টের দু’পাশ উড়ছে। নীরব আলগোছে প্রত্যাশার একটা হাত ধরে ওর বুকের বাঁ পাশে রাখল। প্রত্যাশা কিঞ্চিৎ চমকাল। হাতটা বোধহয় একটু কাঁপলও। নীরব আলতো স্বরে বলল,
-” অনুভব করে বলো তো এখানে নীরবের মেহবুবা হিসেবে কাকে রেখেছে?”
প্রত্যাশা মুচকি হেসে বুকের উপর মাথাটা রাখল। চোখদুটো বুঁজে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল। কয়েক মূহুর্ত পর কোমল স্বরে বলল,
-” আপনার অর্ধাঙ্গিনী। নীরব মাহবুবের একমাত্র মেহবুবা….. শুধু আর শুধু মাত্র ইয়ানূর প্রত্যাশা।”
সারাদিনের ক্লান্তি, যেটুকু বিষন্নতা ছিলো সব যেন নিমিষেই উবে যায়। সেখানে নীরবের মুখে স্নিগ্ধ সতেজ হাসি বিরাজ করছে। নীরব আলতোভাবে প্রত্যাশার মাথায় একটা হাত রাখল। অন্যহাতটা প্রত্যাশার পিঠ পেঁচিয়ে ধরা।
কয়েক মূহুর্ত দু’জনের মাঝে নীরবতা চলল। নীরবতা ভেঙে প্রত্যাশা হঠাৎ মাথাটা উঁচিয়ে নীরবের মুখের দিকে তাকাল। ঘনঘন বলল,
-” আপনি জানেন ভুল বোঝার পর আমার কী কী মনে হয়েছিল?”
নীরব বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ কাটল। এই মেয়ে সুন্দর একটা মূহুর্তকে কখনো একটু লং করতে দিবে না। আবার শুরু করল। নীরবের থেকে উত্তরের অপেক্ষা না করেই প্রত্যাশা ওর মতো করে বলতে লাগল,
-” ভেবেছিলাম; ইয়া আল্লাহ! প্রীতি জিন্টার মতো এত সুন্দরী বউ রেখে আমাকে বিয়ে করার কারণ কী?”
প্রত্যাশার সব কথা শোনার ধৈর্য্য নীরবের হলো না। ও তাড়া দিয়ে বলল,
-” বাইরে থেকে এসেছি এখনো ফ্রেশ হইনি। শাওয়ার নিতে হবে।”
এই বলে নীরব শার্টটা খুলে বিছানার উপর রাখল। প্রত্যাশা ধপ করে বিছানার একপাশে বসল। পা দুটো দুলাতে দুলাতে বলল,
-” তবে যাই বলুন না কেনো….আপনার টুইন ভাইয়ের বউ প্রীতি জিন্টা কিন্তু হেব্বি দেখতে! দেখে বোঝাই যায় না অত বড় একটা বাচ্চার মা। আচ্ছা ওই প্রেম প্রীতির কেসটা কী একটু খুলে বলুন তো? না মানে কেমন কেমন করে দেমাগ নিয়ে কথা বলল। তারপর মা___”
নীরব বিরক্ত চোখে চাইতেই প্রত্যাশার কথা থেমে যায়। পরপর গাম্ভীর্য ভরা কণ্ঠে বলল,
-” প্রত্যাশা, প্রীতি তোমার সিনিয়র। শুধু বয়সেই সিনিয়র নয়, সম্পর্কের দিক থেকেও। কারো সামনে হোক কিংবা আড়ালে কখনোই অসম্মান দিয়ে কথা বলা উচিত নয়। সম্মান অর্জনের আগে সম্মান দিতে হয়। তুমি যেভাবে প্রীতিকে সম্বোধন করছো, তা আমার কাছে শোভনীয় লাগছে না। তুমি আমার স্ত্রী, আমার জীবনসঙ্গী, আমি চাই তুমি নিজের আচরণে এমন উচ্চতা রাখো যেন কেউ তোমার বিচার না করতে পারে। বরং অনুকরণ করতে চায়।”
-” স্যরি! আর হবে না। আসলে ওনার নামটাই ওরকম তো….তাই বলেছি।”
হঠাৎ প্রত্যাশার কিছু স্মরণ হতেই বিজ্ঞের মতোন চোখ করে তাকিয়ে বলল,
-” আচ্ছা, উনি সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার বড় হলে তো আপনারও বড় হওয়ার কথা। কারন আপনাকে দিয়েই আমার পরিচয়। তাহলে আপুকে যেমন ভাবি বলেন, আপনি করে সম্বোধন করেন। বাট উনাকে তো নাম ধরে তারপর তুমি করেই বলতে শুনলাম।”
নীরব তাকাতেই প্রত্যাশা মাথা চুলকিয়ে হালকা হাসার চেষ্টা করল। ফের বলল,
-” জাস্ট ফর কিউরিওসিটি থেকে বলে ফেলেছি।”
-” প্রীতি আমার ব্যাচমেট ছিলো। আগে থেকেই তুমি করে বলায় অভ্যস্ত থাকায়।”
-” ওও… তারমানে উনি আপনার ফ্রেন্ড ছিলো। আচ্ছা যা বুঝলাম ওই ডক্টরটা আপনার বেয়াই হয়। তবে সেদিন আপনাদের দু’জনের কথা শুনে কেমন যেনো একে অপরের শত্রু মনে হলো। তা আপনাদের দুই বেয়াইয়ের রেষারেষিটা কী নিয়ে? জমিজমা নিয়ে বিবাদের মতন একে অপরের চক্ষুশূল হলেন কীভাবে?”
নীরব উত্তর না দিয়ে ত্যাড়া সুরে বলল,
-” এত কিছুর মাঝেও ডক্টরকে ঠিক খেয়াল করেছো!”
-” না করার কী আছে? একটা জলজ্যান্ত মানুষকে চোখের সামনে দেখলাম…..খেয়াল করব না?”
-” কিছু কিছু জিনিস খেয়াল না করাই বেটার।”
প্রত্যাশা না বুঝে আড়ালে ঠোঁট উল্টাল। নীরব টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকবে। প্রত্যাশা হঠাৎ বলল,
-” তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিবেন। রাত হয়ে গিয়েছে। আমি বাসায় যাব।”
নীরব নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
-” বাসায় যাবে….যাও। বারণ করছে কে?”
-” কীহ?”
বলে প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে ফেলল। উঠে নীরবের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” কীভাবে যাবো?”
-” যেভাবে এসেছো।”
-” মাথা খারাপ আপনার? এসেছি একা।”
-” সেজন্য তো একাই যাবে। আসার আগে আমাকে তো জানাওনি।”
-” এখন রাত হয়ে গিয়েছে। দিন হলে সমস্যা ছিলো না। এমনিতেই টেনশনে আছি, আম্মু বকবে। আপু তো আসার পরই আম্মুকে জানিয়েছে, আমি এখানে।”
নীরব কপট রাগের ছাপ মুখে টেনে নেয়। বলল গম্ভীর স্বরে,
-” কিছুটা ব’কু’নি তুমি ডিজার্ভ করো।”
প্রত্যাশা একহাতে কপাল চাপড়ে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ! আপনি এটা বলতে পারলেন! আমার মতো মাসুম বাচ্চা বকুনি খাবে, আপনি এটা চাইছেন। আপনার একমাত্র পিচ্চি বউটা বকুনি খাবে, আপনার একটুও খারাপ লাগবে না। আপনার দিল এত কঠোর হলো কবে থেকে?”
ফাজলামির সুরে বলে ঠোঁট টিপে হাসে প্রত্যাশা। নীরব উত্তরে বলল,
-” আমার দেওয়া গিফট ওভাবে ছুঁড়ে ফেলার জন্য, কড়া করে কিছু বলতে গিয়েও বউয়ের ইন্নোসেন্ট ফেস, ভিতু দু’টো চোখ দেখে বলতে পারিনি। তাই ভাবছি, শাশুড়ি মার তরফ থেকে হলেও একটু-আকটু বকুনি খেলে তোমার মাথার উল্টাপাল্টা রিয়্যাকশন করা ভূত দূর হবে।”
চেইনটার কথা মনে হতেই শুকনো ঢোক গিলল প্রত্যাশা। ওটা তো কখনই সবার অগোচরে ব্যাগে তুলে রেখেছে। প্রত্যাশা সহসাই বলল,
-” এটুকুর জন্য অবশ্য স্যরি।”
নীরব প্রসঙ্গ বদলিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
-” স্কুটি আনোনি?”
প্রত্যাশা ঘাড় নাড়িয়ে না বোঝায়। নীরব বলল,
-” সেদিনের ন্যায় আবার ওটাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিতে আরেকজনের হেল্প লাগতো। এদিক দিয়ে কিছুটা সময় বাঁচল।”
গাল দু’টো অল্প স্বল্প ফুলিয়ে প্রত্যাশা বলল,
-” সেদিনের পর থেকে স্কুটি চালাইনি। আম্মু বারণ করেছে। আর আপনি নিজেও তো সেদিন কত কিছু বললেন, তাই আমিও আর জোর করিনি আম্মুকে।”
নীরব বলল,
-” স্কুটি চালানো খারাপ বা আমার অপছন্দ এমন কিছু আমি বলিনি, প্রত্যাশা। বরং আমার মনেহয়, এটা একধরনের উপকারী যান। সুবিধাজনকও বটে। একটা কথা শুনে রাখ; কারো পছন্দ-অপছন্দের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়া আমার নীতির মধ্যে পড়ে না। তুমি কী করবে, কীভাবে করবে? সেসব সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। আমি সেদিন যেটা বলেছিলাম আজও একই কথাই বলছি; স্বাধীনতা থাকবে, তবে সেটা যেন মিসইউজ না হয়।”
___________
রাত্রি একটা পার। চারপাশ নিঃস্তব্ধ। দূর থেকে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। ঠোঁটের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট চেপে মিজান সাহেব ছাদে উঠলেন। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দেখে হঠাৎ থমকে গেলেন। কাছে এগিয়ে দেখলেন বেঞ্চিতে নীরব। হাত দু’টো ছড়িয়ে, মুখটা আকাশের দিকে করে চোখ বুজে আছে। নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখতেই নীরব ঝট করে চোখ মেলে তাকাল।
-” ঘুমাওনি? এত রাতে ছাদে!”
নীরব মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টেনে বলল,
-” ঘুমাতে যাইনি। যাব। কিছু কাজ শেষে মাইন্ড রিফ্রেশ করতে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মাখতে ছাদে এলাম।”
আলতো করে ভাতিজার কাঁধ চাপড়ে বললেন,
-” গুড…গুড।”
স্ত্রীর থেকে লুকিয়ে ছাদে এসে সিগারেটে সুখটান দেওয়া মিজান সাহেবের নিত্যদিনের রুটিন। সেটা কম-বেশি বাড়ির সবাই জানে। হঠাৎ নীরব প্রশ্ন করে উঠল,
-” আচ্ছা চাচ্চু একটা কথা সত্যি করে বলবে?”
পাশে বসে কপালে কৌতুহলের খাঁজ ফেলে বললেন,
-” কী?”
-” আমার মনেহয় কিছুটা হলেও তোমার জানার কথা। বাবা আমাকে বলতে চাইছেন না। প্রশ্ন করেও উত্তর পাইনি। আমার ধারণা বাবা হয়তো বিব্রত বোধ করছেন। আর আমি জেনেশুনে বাবাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে চাই না। তাই জোর করে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তোমাকে বলছি, মায়ের প্রীতি বা প্রীতির পরিবার নিয়ে এক্সাক্টলি প্রব্লেমটা কী? তুমি কী কিছু জানো?”
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছোট্ট অংশটা নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষলেন। পরপর হতাশার শ্বাস ফেলে অতীতে ডুব দিলেন।
নীহারিকা বেগমের জীবনটা পুষ্প সজ্জিত ছিলো না। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে আশ্রয় হয় ফুপুর বাড়িতে। ফুপুর শাশুড়ি নীহারিকার প্রতি সহৃদয় ছিলেন না। উঠতে বসতে খোটা তো শুনতেই হতো, আবার ভারি ভারি কাজ করতে হতো। তবুও ফুপুর সস্নেহে জীবন চলছিলো দুই ভাইবোনের। তিক্ত ছোটবেলা থেকেই নীহারিকার গ্রামের চেয়ারম্যান খান বাড়ির প্রতি তীব্র ঘৃ*ণা ছিলো। নিরপরাধ বাবা-মা সেদিন ভোট দিতে গিয়ে লা’শ হয়ে ফেরে। শুধু মাত্র ওই চেয়ারম্যান বাড়ির ছেলের জন্য। প্রতিপক্ষের সাথে ভোট কেন্দ্রে সংঘর্ষ হয়। সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে বাবাকে ফের ক্ষমতায় রাখতে সংঘর্ষ বাধায়। সেদিন নীরিহ কয়েকজনের মধ্যে নীহারিকার বাবা-মা ও খান বাড়ির ছেলের হাতে গু”লি বিদ্ধ হয়। পাখির মতো ছটফট করতে করতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় উনারা।
নীহারিকা আর ওনার থেকে কয়েক বছরের বড় ভাই ফুপুর আশ্রয়ে বড় হতে থাকে। ফুপুর শহুরে পড়ুয়া সুদর্শন বড় ছেলের প্রতি নীহারিকার একটা দুর্বলতা ছিলো। তবে কখনো প্রকাশ করা হয়নি। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো একসময় খুশির বাঁধ নামে নীহারিকার। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে শখের মানুষটির সাথে বিয়ের কথা শুনে।
ফুপু তার মাস্টার্স পড়ুয়া ছেলেকে ডেকে ভাইঝির সাথে বিয়ের কথা বলতেই মাহবুব সাহেব সাথে সাথেই নাকচ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসাথে পড়ুয়া একটা মেয়েকে পছন্দ করেন। দু’জন-দু’জনকে পছন্দ করেন। তাই ওনার পক্ষে নীহারিকাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। মাহবুব সাহেবের মা মমতা যখন শুনলেন ওই মেয়ে খান বাড়ির মেয়ে; তক্ষুনিই তীব্র বিরোধিতা করে বসলেন। একমাত্র ভাই-ভাবীর খু*নি বাড়ির মেয়েকে কিছুতেই ছেলের বউ করবেন না। চেয়ারম্যানরা মানুষ ভালো না। খু*ন খারাবি, হানাহানি, কালো ব্যবসা সবকিছুতেই গ্রামে শীর্ষে। লোকজন আ’তং’কে থাকে তাদের ভ’য়ে। সেই বাড়ির মেয়ে যতই জ্ঞানী হোক না কেনো, র*ক্ত তো একই।
খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে অনশন করেন মমতা। মাহবুব সাহেবকে এক প্রকার জোর করেই নীহারিকার সাথে বিয়ে দেন। এসব অবশ্য নীহারিকার আড়ালে হয়। বিয়ের পরে জানলেন মাহবুব সাহেবের মনে আছে অন্য রমণী।
বিয়ের পর সংসার ভাগ্য সোনায় সোহাগা ছিলো না নীহারিকার। দু’জনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে ঢের সময় লাগে। যখন একটু একটু করে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হচ্ছিল, তখনই হঠাৎ করে আরেক ঝামেলার উদয় হলো। হঠাৎ করে ওনার ভাই বিয়ে করে আনলেন। তাও আবার খান বাড়ির সেই মেয়েকে। ওই মেয়ে মাহবুব সাহেবকে ঠক, প্রতারক হিসেবে ভাবত। প্রেম করে অন্য কাউকে বিয়ে করায় এক প্রকার প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে নীহারিকার ভাইকে কোনো এক জাদুবলে বশ করে বিয়ে করে আসে। ওনার মূলত উদ্দেশ্য ছিলো, মাহবুব সাহেবের জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করা। এক বাড়িতে থাকতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ভুলবোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে থাকে। যা ওই মেয়ে ইচ্ছে করে সৃষ্টি করতে থাকে। বুঝদার মাহবুব সাহেব সকল ঝামেলা এড়িয়ে চলতে চাইছিলেন, তবুও ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নিত্যনতুন ঝামেলা করত।
সময় থেমে থাকে না। এভাবে চলছিলো। হঠাৎ এক অম্যাবস্যার রাত্রি যেন কাল রাত্রি হয়ে এল। আকস্মিক ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট থেকে পুরো বাড়ি আ*গুনে পুড়ে ছাই হয়। সাথে দগ্ধ হয়ে প্রাণ যায় তিনজনের। শয্যাশায়ী মমতা, নীহারিকার ভাই আর খান বাড়ির মেয়ে। আয়ু থাকায়ই হোক আর ভাগ্য করে হলেও বেঁচে যান নীহারিকা আর মাহবুব সাহেব। নিভান তখন তিন মাসের ছোট্ট বাচ্চা। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় সেদিন সন্ধ্যায়ই সদরে ছেলেকে নিয়ে ভর্তি হোন। আর এটাই হয় ভুল বোঝাবুঝির শুরু।
খানরা ভাবেন মাহবুব সাহেব পরিকল্পিতভাবে তাদের মেয়েকে সরাতে আ*গুন লাগিয়েছে। না হলে আজ হাসপাতালে গেল, আর আজই আ*গু*ন লাগল। নিজে, বউ ছেলে দিব্যি সুস্থ থাকল। মাহবুব সাহেবের নামে মিথ্যা মামলা দেয় খানরা। মাহবুব সাহেবের জেল হয়। নীহারিকা কোলের ছেলেকে নিয়ে স্বামীকে ছাড়াতে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছেন। খানদের পা পর্যন্ত ধরেছেন। তবুও মন গলেনি। ওই মেয়ের জমজ বোন ছিলো তানিয়া। মূলত তার কথায়ই কেস করা হয় মাহবুব সাহেবের নামে। নীহারিকা কেঁদে বুক ভাসিয়ে তানিয়ার কাছে অনুনয় করে বলেছে। তবুও একটুও মন গলেনি। সেদিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নীহারিকাকে ও বাড়ি থেকে তানিয়া বের করে দিয়েছে।
মিজান সাহেব মেসে থেকে কলেজে পড়তেন। ভাবি আর ভাইপোর পাশে দাঁড়ান। জমিজমা বর্গা দিয়ে, তারপর টিউশনি করে পড়াশোনা করছেন আর ভাইয়ের আমানত রক্ষা করেছেন। বছর তিনেক জেলে থাকার পর নীহারিকা আর মিজান সাহেবের মিলিত প্রচেষ্টায় গ্রামের জমি বিক্রি করে শহরের বড় উকিল ধরেন। তারপর একপর্যায়ে মাহবুব সাহেব ছাড়া পান। গ্রামের পোড়া ভিটেয় আর কখনো যাওয়া হয়নি। শিক্ষিত হওয়ায় মাহবুব সাহেব সহজেই একটা বেসরকারি ফার্মে ভালো পদে চাকরি পান। এরপর থেকে একটু একটু করে নীহারিকার দুইহাতে গড়ে ওঠে শখের সংসারটা।
নীবিড় যখন প্রীতিকে বিয়ের কথা বলে নীহারিকা রাজিও ছিলেন। কিন্তু প্রীতিকে দেখতে গিয়ে অভিশপ্ত সেই মুখটা দেখে নীহারিকার পুরোনো বিষাদ, যাতনার কথা স্মরণ হয়ে তীব্র ঘৃ”ণা নিয়ে সেখান থেকেই ফিরে আসে। কিচ্ছুতেই ওই মেয়েকে বাড়ির বউ করবেন না বলে ঘোষণা দেন।
নীহারিকার ভ’য় হয়। আবার বুঝি ওই খান বাড়ির মেয়ে কোনো ষ’ড়যন্ত্র করতেই মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছে। ওই মেয়েকে ঘরে তুললে আবার তার কাগজের মতোন সাজানো, গুছানো সংসারটা হারিয়ে যাবে। এক সন্তানকে কাছ ছাড়া করলেও, বাকি দু’জনকে নিয়ে নীহারিকা আজও কঠোর হয়ে আছেন। সন্তানদের কাছে অতীতের কথা বলেননি বাবার প্রতি খারাপ ধারণা জন্মাতে পারে ভেবে। অতীতের কষ্ট স্মরণ করতে চান না, কাউকে জানাতেও চান না।
___________
দু-তিন দিন পর….
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে রাত এগারোটার ঘর ছাড়িয়েছে। প্রীতি ডিনারের জন্য সার্থককে ডাকতে আসে। দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডাকল,
-” অ্যাই ভাইয়া? ব্রো… শুনছো?”
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভেজানো দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবল— ‘গেছেটা কই?’ পরপর আলগোছে দরজা ঠেলে রুমে চোখ বুলিয়ে সার্থককে দেখতে না পেয়ে ব্যালকনিতে যায় প্রীতি। আধো অন্ধকারে ব্যালকনির দোলনায় একহাত আর পা দুটো ফ্লোরে ছড়িয়ে বসে সার্থক। হাতে হাইনেকেন ব্র্যান্ডের বিয়ারের ক্যান [অ্যালকোহল ফ্রি]। চোখবুঁজে ঢকঢক করে গিলল। প্রীতি নিঃশব্দে পাশে দাঁড়িয়ে কাঁধে একহাত রাখল।
-” চলো ডিনার করবে।”
-” মা ডিনার করেছে? ইচ্ছে ঘুমিয়েছে?”
-” মনা ঘুমিয়ে দিয়েছে ইচ্ছেকে। সবাই খেয়েছে। শুধু আমি আর তুমিই বাকি।”
আরেক ঢোক গালে নিয়ে গলাধঃকরণ করে বলল সার্থক,
-” সন্ধ্যার পর ক্লিনিকে একটা মিটিং ছিলো ওখান থেকে নাস্তা করেছি। আমার ক্ষুধা নেই। প্রীতি তুই খেয়ে নে।”
প্রীতি ভাইয়ের পাশে বসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,
-” তার বিরহে দেবদাস বনে যাচ্ছ নাকি? আমি বলি, এত চুপচাপ না থেকে, বিরহে কাতর না হয়ে কিছু একটা করো।”
সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
-” আমার প্রিয় জিনিস, যেটা হাতের নাগালের মধ্যে আছে, তবুও আমি আমার করছি না। তোর মনেহয়, এরকম কখনো করব আমি?”
প্রীতি ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,
-” বুঝলাম। তাহলে এতটা নির্লিপ্ত, নির্বিকার কেনো আছো। হাত গুটিয়ে বসে থাকার কারনই বা কী?”
একটু থেমে পরমূহুর্তেই প্রীতি সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
-” ব্রো, তুমি কী নীরবকে নিয়ে ভ’য় পাচ্ছো? নীরবের সাথে পারবে না ভেবেই কোনো স্কোপ নেওয়ার সাহস পাচ্ছো না।”
-” নীরবকে নিয়ে ভ’য় সার্থকের নেই। এখানে প্রথম সমস্যা মেয়েটা ম্যারিড। দ্বিতীয় সমস্যা জোর করে কী সবকিছু পাওয়া যায়?”
-” বাহ্! ব্রো চমৎকার! তুমি তো দেখছি খুব মহান। তবে আমি আবার এতটা মহান নই। যদি কারো জন্য আমার জীবন কষ্টে ভিজে যায়। আমি নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকব না। আমি এমন ঝড় তুলব, যাতে তার সুখের ছাদটাই উড়ে যায়। আমার চোখের এক বিন্দু জল, হারাম করবে তার চোখের ঘুম।”
সার্থকের কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ল। ও তীক্ষ্ণ চোখে প্রীতির দিকে তাকাতেই প্রীতি সশব্দে হো হো করে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল,
-” আরে… আরে এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো? তোমাকে ইন্সপায়ার করছি। মনটাকে এভাবে শক্তপোক্ত করে গড়ে নাও। আর একটা কথা মনে রাখবে, এভরিথিং ইজ ফেয়ার লাভ এন্ড ওয়ার।”
এরমধ্যে পাশে নামানো সার্থকের ফোনে ইংরেজি ফন্টে অদ্রিকা আহসান নামে সেভ করা নামটা জ্বলজ্বল করে উঠল। সার্থক রিসিভ করে কথা বলতে থাকল। অদ্রিকা কথা বলার এক পর্যায়ে বলল,
-” অ্যাই শোন একচুয়েলি যেজন্য তোকে ডিস্টার্ব করা। আমরা নেক্সট উইকে কুয়াকাটা যাচ্ছি। কোনো প্রকার না শুনতে চাই না, তুইও আমাদের সাথে যাবি। যাবি মানে যাবিই। আমি, মৌমিতা আর ভাইয়া মিলে প্ল্যান করেছি।”
-” স্যরি ইয়ার আমার হবে না। পেশেন্ট আছে, ব্যস্ত__”
কথা কেড়ে নিয়ে ওপাশ থেকে বলল,
-” ডক্টর তুই একা নোস, আমাদেরও পেশেন্ট আছে। আমরা সময় বের করতে পারলে, তোর এত প্রব্লেম কোথায়?”
-” অদ্রি আমাকে বাদ রাখ, প্লিজ।”
-” নো নেভার। তোর কোনো কথা শুনছি না আজ।”
আরো কিছু কথা বলার পর জিভ কে’টে বলে উঠল,
-” এইরে এত কথার মাঝে আন্টি, প্রীতি ওদের কথাই তো জিজ্ঞেস করতে বেমালুম ভুলে বসেছি। প্রীতি কোথায় থাকে এখন?”
-” প্রীতি আমাদের কাছেই থাকে। ধর প্রীতির সাথে কথা বল।”
পুরোনো বন্ধু, তারপর ভালো বন্ডিং হওয়ায় আগে থেকেই দুই পরিবারের সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রীতির দিকে ফোন বাড়িয়ে সার্থক বলল,
-” অদ্রি।”
প্রীতি হাসিমুখে কথা বলতে থাকে। কুশলাদি বিনিময় করার পর এক ফাঁকে প্রীতি বলল,
-” অদ্রি আপি বলো তো তোমার বিয়ের ইনভ্যাটিশন কবে পাচ্ছি?”
-” সেটা আর ইহজনমে হচ্ছে না।”
-” ও মাই গড! ও মাই গড….কেনো?”
-” কারন তোমার ভাইয়ের মতো হ্যান্ডসাম ডক্টর পাচ্ছি না।”
বলেই হেসে উঠল অদ্রিকা। প্রীতিও হাসল। বলল,
-” তুমি যে কিউট তোমার জন্য ডক্টর পাত্রের অভাব নাকি! এতএত ডক্টরের ভিড়ে চুজ করে নাও কোনো এক সহকর্মী ডক্টরকে। ঠিক মন মতো পেয়ে যাবে, দেখো অভাব পড়বে না।”
-” এতএত ভিড়ের মাঝেও মন মতো একজনের কিন্তু বড্ড অভাব থাকে।”
প্রীতির মুখের হাসি নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। মুখটা ম্লান হয়ে যায়। হতাশ শ্বাস ফেলে বলল,
-” হুম। একদম ঠিক বলেছো। আই নো।”
অদ্রিকা জোর করে প্রীতিকেও ওদের সাথে ট্যুরে জয়েন করতে বলে। অদ্রিকার এত করে বলা ফেলতে না পেরে প্রীতি রাজি হয়। অদ্রিকা বলল,
-” থ্যাংক ইয়্যু প্রীতি। তুমি রাজি না হলে তোমার কাঠখোট্টা ভাইকে রাজি করানো যেতো না। এবার একটু নিশ্চিন্ত হলাম সেও জয়েন হবে আমাদের জার্নিতে। আর ইচ্ছেকে সরাসরি দেখা হয়নি, এবার দেখতে….”
প্রীতি কথার মাঝেই বলল,
-” ইচ্ছেকে রেখে যাব। ইচ্ছে জার্নি করতে পারে না। ওর ভমিটিং এর প্রবলেম হয়। তারপর ইচ্ছেকে নিয়ে ঘুরাঘুরি হবে না।”
_____________
প্রত্যাশা আর ওর বন্ধুরা কলেজ প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর গোল হয়ে বসে আছে। গাছভরা টকটকে লাল ফুল। বাতাসে হালকা খসখসে শব্দ হচ্ছে। আশেপাশে আরো ছেলে-মেয়েরা বসে পিকনিক নিয়ে প্ল্যানিং করছে। ওদের এইসএসসি ব্যাচ কলেজ থেকে কুয়াকাটা যাচ্ছে। প্রত্যাশার মুখটা কিঞ্চিৎ ভার। মন মরা কণ্ঠে বলল,
-” ধূর ভাল্লাগে না। হ্যাপি যাচ্ছে কনফার্ম। কোয়েলও যাবে। আমি যাব কী না শিওর বলতে পারছি না। আব্বু আম্মু অতদূর একলা ছাড়বে কী না সন্দেহ!”
হ্যাপি বলল,
-” স্যারেরা তো বললই মেয়েদের সাথে গার্ডিয়ান এলাউ করা হবে। মেয়েদেরকে একলা ছাড়তে ইনসিকিওর গার্ডিয়ানেরা সাথে যেতে পারে।”
প্রত্যাশা মুখে ঘোর অন্ধকার নামিয়ে বলল,
-” তোর যেনো প্রফেসর মামা আছে সমস্যা নেই। আলাদা করে গার্ডিয়ান লাগবে না। আন্টি আংকেল নিশ্চিন্তে যেতে দিবে। আমাকে একা ছাড়তে রাজি হবে না। তারপর আব্বুর অফিস থেকে ছুটিও পাওয়া যাবে না। আম্মুর তো যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।”
পাশ থেকে কোয়েল বলল,
-” সমস্যা কী? তোর বরকে সাথে নিবি।”
-” ধ্যাত! বরকে নিয়ে পিকনিকে গেলে সব মজা মাটি। স্যার-ম্যাম তারপর সবার মাঝে বরের লেজ ধরে শো পিসের মতো থাকতে হবে। একটুও মজা করা যাবে না। সবাই চেয়ে চেয়ে থাকবে, কেমন লজ্জা লজ্জা লাগবে না।”
ওরা সবকটা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। প্রত্যাশা চোখ গরম করে তাকাতেই হাসি থামাল। রোহান বাদামের খোসা ছাড়িয়ে ফুঁ দিয়ে মুখে পুড়তে পুড়তে বলল,
-” আরে পিকনিক টিকনিক বাদ দে। আগে বল তোর বিয়ের দাওয়াত কবে পাচ্ছি। কব্জি ডুবিয়ে খাব জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,
-” পরীক্ষা নামক বাঁশ খাওয়ার পর। বোর্ড এক্সামের পর বিয়ের অনুষ্ঠান।”
ওরা এটাওটা মুখে দিচ্ছে আর প্ল্যান করছে কে কী ড্রেস পড়বে। প্রত্যাশার মুখ বেজার দেখে হ্যাপি বলল,
-” দোস্ত মন খারাপ করিস না। আন্টি-আংকেলকে রাজি করার দায়িত্ব আমার। আমি আম্মুকে বলব আন্টিকে কনভিন্স করতে। মামার কথা বললে আন্টি নিশ্চয় দ্বিমত করবে না। একটা দিনেরই তো ব্যাপার। রাতে রওনা হবে, ভোরে গিয়ে সূর্যোদয় দেখে, সারাদিন ঘুরা ঘুরি করে সন্ধ্যায় ফেরা।”
নাহিদ মুখে চরম বিরক্তির রেষ নিয়ে বলে উঠল,
-” ধূর! শা’লার যবর এক কাহিনী পায়ছে। সূর্যোদয় দেখতে নাকি এতো গুলা টাকা খরচ করে সেই কুয়ার মধ্যে যাওয়া লাগবে।”
হ্যাপি নাক সিটকে বলল,
-” কুয়ার মধ্যে কী হ্যা? ওটা জায়গার নাম। আর নামটা হলো, কুয়াকাটা।”
নাহিদ মাছি তাড়ানোর মতো বলল,
-” তা ওখানে গিয়ে কাজটা কী? সবাই ফ্রিতে কুয়া কাটে নাকি?”
আবার এক দফা হাসির রোল পড়ল। হ্যাপি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সিরিয়াস গলায় বলল,
-” গর্দভ একটা! ওটা পর্যটক স্পট। বললাম না সূর্যোদয় দেখে তারপর___”
হ্যাপির মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় নাহিদ,
-” এত বড় দামড়ি হয়েছিস সূর্যোদয় কখনো দেখিসনি। ভোরে ঘর থেকে উঠানে নামলেই সূর্য ওঠা দেখা যায়। এরজন্য বেহুদা কচকচে টাকা খরচ করে অতদূর যেতে হয়।”
কোয়েল ওদের দু’টোর ঝগড়া থামাতে বলল,
-” আরে আ’জাইরা ঝগড়া বাদ দে তো তোরা। যা বলা হচ্ছিল সেদিকে ফোকাস কর।”
কোয়েল বাদাম মুখে দিল। চিবুতে চিবুতে বলল,
-” আন্টিকে না হয় রাজি করানো গেল। বাট ওর বরেরও তো পারমিশনের ব্যাপার-স্যাপার আছে। বউকে একা ছাড়বে?”
প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
-” উনাকে নিয়ে টেনশন নেই। এতটুকু স্বাধীনতা দিবে। উনি নিজেই বলে জোর করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া ওনার নীতি বিরুদ্ধ। আশা রাখি উনি যাবার পারমিশন নিশ্চয় দিবে।”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
মাথার উপর থাকা বৈদ্যুতিক পাখাটা শাশা শব্দ তুলে ঘুরছে। প্রত্যাশা বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে, আঁখিযুগল বন্ধ, মুখ ভার। নিঃশব্দে, সন্তর্পণে পা টিপেটিপে কেউ একজন বিছানার পাশে আসল। আলগোছে মাথা ঝুঁকে মুখটা প্রত্যাশার খুব কাছে নিল। তারপর একদম প্রত্যাশার কানের পাশে মুখ এনে,
-” সারপ্রাইজ দোস্ত!”
হ্যাপি চেঁচিয়ে বলল। প্রত্যাশা ‘চ’ শব্দ করে আলস্য ভঙিতে উঠে বসল। প্রত্যাশার চাহনি যুগলে একফোঁটাও অবাক ভাব নেই। মুখটা ভারভার দেখে হ্যাপির ভ্রু কুঁচকে যায়।
-” অ্যাই প্রত্যাশা মন খা’রাপ নাকি? মুখটা এমন বান্ধা গরুর মত ঝুলে আছে কেন রে? বাংলা পাঁচও তো লজ্জা পাবে!”
-” ধূর ভাল্লাগে না।”
-” কী ভাল্লাগে না? আন্টি পিকনিকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না, তাই তো?”
-” আরে সেটা তো আছেই….”
-” তাহলে নতুন করে আবার কী হলো?”
-” মাই লাইফ মাই রুলসের যুগে এসেও, সামান্য চুলের উপরও আমার অধিকার নেই।”
হ্যাপি ফিক করে হেসে ফেলল। প্রত্যাশা বলতে লাগল,
-” হেয়ার স্টাইল আম্মুর পছন্দ হয়নি। চুল কে’টেছি জন্য আম্মুর কাছে ব’কুনি শুনেছি।”
কোমড় সমান চুল ছিলো, সেটা কে’টে পিঠের মাঝখান পর্যন্ত করেছে। আবার কানের দু’পাশে দু’গাছি করে কাঁ’টা। কলেজ থেকে ফেরার পথে বান্ধবীদের সাথে পার্লার থেকে কে’টে এসেছে। অতবড় চুল কে’টে খাটো করায় অধরা মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন।
.
ড্রয়িংরুমে অধরা আর হ্যাপির আম্মু হাবিবা বসে। মূলত হ্যাপি আম্মুকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখানে এনেছে। অধরা বললেন,
-” ভাবি সমস্যা হলো অতটা দূর, তারপর দুইটা রাত যাবে, প্রত্যাশাকে একলা ছাড়া রিস্ক। ওর আব্বুর অফিস থেকে ছুটি নেওয়াও মুস্কিল। আমি লং জার্নি করতে পারি না। অসুস্থ হয়ে পড়ি।”
হাবিবা বলল,
-” ভাবি আমার ভাই মানে হ্যাপির মামা ওদের কলেজের প্রফেসর। ভাইয়ের উপর নিশ্চিন্তে আমি মেয়েকে ছাড়তে পারি। তাই বলছি আপনি যদি ভরসা করতে পারেন! না মানে….আসলে হ্যাপি আর প্রত্যাশার গলায়-গলায় ভাব তো জানেনই। প্রত্যাশা যাবে না জন্য হ্যাপিরও মন খা’রাপ। আর পরীক্ষার পরই তো সব পড়াশোনার জন্য আলাদা হয়ে যাবে। কে কোথায় ভর্তি হয়। কখনো আবার এরকম একসাথে ঘুরার সুযোগ নাও আসতে পারে।”
অধরা ইতস্তত করে বলল,
-” আসলে প্রত্যাশাটা বয়সের তুলনায় একটু ইমম্যাচিউর আর বেশি চঞ্চল। তাই ওকে নিয়ে আমার সবসময় একটু বাড়তি চিন্তা থাকে। তারউপর এখন ও আমাদের কাছে অন্য এক বাড়ির আমানত। আমার গাফেলতির জন্য কোনো ভুলে তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হোক চাই না। তাই একটু সতর্ক থাকতে চাই। আবার নীরবকে জানানোর ব্যাপারও আছে।”
হাবিবা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,
-” হ্যাঁ… হ্যাঁ তা তো ঠিকই।”
এমনি ভালোমন্দ আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে, নাস্তা পানি শেষে হাবিবা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,
-” ভাবি আসি তাহলে। সময় করে যাবেন কিন্তু।”
অধরা মুখে হাসি টেনে বলল,
-” হ্যাঁ যাবো। আপনিও আবার আসবেন কিন্তু।”
ওদিকে প্রত্যাশার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হ্যাপি ফিসফিস করে বলল,
-” আন্টির কথা শুনে বুঝলাম, ভাইয়া যদি রাজি হয় তাহলে আন্টি দ্বিমত করবে না। যেতে দিবে তোকে। এখন তুই তোর বরকে ম্যানেজ কর। জলদি গিয়ে ফোন করে কথা বল।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,
-” উনি এখন অফিসে আছে। ব্যস্ত আছে। রাতে ফ্রি থাকবে। কাজের প্রেশারে না থেকে মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকবে তখন বলব।”
__________
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে রাত দশটার ঘর ছুঁয়েছে।
প্রত্যাশা পড়ার টেবিলে বসে। এক হাতে কলম কামড়ে ধরে, অন্য হাতে ফোনটা নিয়ে কল লিস্ট খুলল।
বিছানায় বসে ল্যাপটপ সামনে নিয়ে গভীর মনোযোগের সহিত অফিশিয়াল কিছু একটা করছে নীরব। ডানপাশে রাখা ফোনটা ভাইব্রেশনের মৃদু শব্দে কাঁপছে। মাথা ঘুরিয়ে প্রত্যাশার কল দেখে রিসিভ করল। ঘাড়টা কিঞ্চিৎ কাৎ করে ফোনটা কাঁধ দিয়ে কানের সাথে চেপে ব্যালান্স করে রাখল। ওপাশ থেকে কোমল গলায় লম্বা করে সালাম এল,
-” আসসালামুয়ালাইকুম।”
আজ নিজ থেকে আগেআগেই ফোন, তারপর লম্বা করে সুরেলা কণ্ঠে সালাম। কথায় আছে না — অতি ভক্তি চো’রের লক্ষণ। নীরবের কাছে আজ প্রত্যাশার ব্যাপারটাও অমন লাগল। প্রত্যাশা টুকটাক ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার পর আলতো স্বরে বলল,
-” শুনুন?”
নীরবের আঙুল ল্যাপটপের কিবোর্ডে। প্রত্যুত্তরে বলল,
-” শুনছি….বলো?”
-” কলেজ থেকে পিকনিকে কুয়াকাটা যাচ্ছে। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সব্বাই যাচ্ছে। সামনে তো এক্সাম। তারপর ভার্সিটি ভর্তি হয়ে কে কোথায়? কত দূর চলে যাবে। সবাই একসাথে ঘুরার আর কখনো এমন সুযোগ আসবে বলে মনে হয় না। আর একসাথে আনন্দ করাও হবে না। তাই বলছি, আমিও ওদের সাথে যাই?”
ধীরেধীরে কোমল কণ্ঠে আবদারের সুরে বলল প্রত্যাশা। মূহুর্তেই নীরবের আঙুল কিবোর্ডে স্থির হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে নীরব বলল,
-” যাওয়াটা কী খুব জরুরী?”
-” প্রায় সবাইই যাচ্ছে। তারপর জায়গাটাও দেখে আসা হবে। আগে কখনো তো দেখার সুযোগ হয়নি।”
-” প্রত্যাশা, চাইলে তোমার এক্সামের পর আমরা একসাথে কোথাও যেতে পারি। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একটা ট্রিপ প্ল্যান করব। তুমি আর আমি কুয়াকাটাতেই না হয় যাব। সাগরের ঢেউ, সূর্যাস্ত, সবকিছু একসাথে দেখব। একসাথে কোয়ালিটি টাইম কা’টা’ব। উমম! বলতে পারো হানিমুনটাও হয়ে যাবে।”
কথাগুলো প্রত্যাশার মন ছুঁতে ব্যর্থ হলো। ও রষকষহীন স্বরে বলল,
-” ধূর! বন্ধুদের সাথে কলেজ থেকে যাওয়ার এক মজা। আর আপনার সাথে আলাদা কথা। দু’টো এক হলো নাকি?”
নীরব কিছুক্ষণ ভাবল। কৌশলে জিজ্ঞেস করল,
-” তুমি বাসায় বলেছো? তুমি যেতে যাও জানিয়েছো?”
প্রত্যাশা গড়গড় করে বলতে লাগল— সব শেষে হ্যাপির মা’কে অধরার বলা কথাগুলোও বলল। নীরব নিম্নোষ্ঠের ডান পাশে দাঁত চেপে ধরে ভাবতে লাগল। প্রত্যাশা লাস্ট সুযোগটা নিতে বলল,
-” আপনিও না হয় চলুন আমার সাথে।”
-” অফিসের কাজে ব্যস্ত আছি। যে ডেট বলছো, সম্ভব হবে না।”
একটু থেমে পরমূহুর্তেই নীরব গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,
-” তোমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আমি কখনোই হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তুমি স্বাধীন, নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের জায়গা থেকে ভাবার অধিকার তোমার পুরোপুরি আছে। তুমি কী চাও! সেটা যেমন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি তোমার সেফটি আমার কাছে সবচেয়ে আগে। এতটা দূর যেতে হলে, নানা ঝুঁকি থাকে। বন্ধুরা যাবে, আনন্দ হবে সবই ঠিক আছে। কলেজ পিকনিক, বন্ধুদের সাথে আনন্দ আমি সব বুঝি। কিন্তু দূরের পথ, এতজন মিশ্র পরিবেশ, অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি। এইজন্য কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত আর টেনস আমি।”
প্রত্যাশা ভারি স্বরে বলল,
-” আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি যেহেতু চাইছেন না। থাক গে।”
নীরব জোরালো নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-” আমি না করলে তুমি যাবে না, সেটা আমি জানি। কোনো প্রকার বাকবিতন্ডা ছাড়াই আমার সিদ্ধান্ত তুমি মেনে নিবে। এতটুকু বিশ্বাস তোমার উপর আছে আমার। তবে এতে করে সুক্ষ্মভাবে আমার উপর তোমার একটা অভিমান, ভুল ধারণা জন্মাবে। আর সেটা হোক আমি চাই না। তুমি তোমার মতো করে ঘুরোফেরো নো প্রব্লেম। তবে সবটাই যেন লিমিটের মধ্যে থাকে।”
ভারিক্কি কথা শেষে নীরব গলার স্বর এবারে নরম করল। উপদেশ বাণী আওড়াল,
-” প্রত্যাশা তুমিও সবার সাথে যাবে। আমার তরফ থেকে বাঁধা নেই। তবে সাবধানে থেকো, কোনো ভুল যেনো না হয়। টিচারদের কথা ঠিকঠাক শুনবে। দেরি করে কোথাও থাকবে না। একা কোথাও যাবে না, সবসময় বন্ধুদের সঙ্গেই থাকবে। কেউ কিছু অফার করলে না বলবে, মজা হলেও সীমা যেন না ছাড়ায়। কারো সঙ্গে তর্কে না জড়িয়ে শান্ত থেকো। আর ফোনটা যেন সবসময় অন থাকে।”
প্রত্যাশা খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল,
-” ওকে….ওকে। থ্যাংক ইয়্যু।”
নীরব আলতো স্বরে ডাকল,
-” প্রত্যাশা?”
-” হুম?”
-” যা বললাম সবটা শুধু মনেই রাখবে না। ফলো করে চলবে। আর অলওয়েজ এটা মনে রাখবে; তুমি শুধু তোমার নিজের না, অন্য কারোর অনেক কিছু।”
প্রত্যাশা সরাসরি প্রশ্ন করল,
-” এই অন্য কেউটা….আপনি?”
-” সেটা বুঝে নিও।”
-” ওকে।”
আরো দুয়েকটা বাক্য বিনিময় শেষে কল কা’টার আগে নীরব বলল,
-” আল্লাহ হাফেজ।”
-” আল্লাহ হাফেজ।”
__________
দুপুরের রোদটা যেন আ”গুন হয়ে ঝরছে। ক্লাস শেষ করে কলেজ গেট পার হচ্ছিল প্রত্যাশা। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ, ঘামে ভেজা কপাল। এমন সময় হাতে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল নীরবের নাম। একটু থমকে ত্রস্ত কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত স্বর আসলো,
-” হ্যালো, প্রত্যাশা তুমি কোথায়?”
-” আমি কলেজে আছি। এই তো বের হচ্ছি বাসার পথে।”
-” তুমি কি টেন মিনিটস অপেক্ষা করতে পারবে? আমি আসছি।”
প্রত্যাশা কিঞ্চিৎ অবাক হলো। কৌতূহলী হয়ে বলে,
-” ওয়েট করবো, কিন্তু কেনো?”
-” একটু কষ্ট করে দাঁড়াও। কুইকলি, আ’ম কামিং।”
আর কিছু বলার আগেই নীরব কল কে’টে দিল।
.
বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার এক পাশে এসে দাঁড়াল প্রত্যাশা। রোদের তাপে চোখ সরু হয়ে আসছে। একহাতে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলল। মিনিট দশেক পেরোনোর আগেই একটা কালো বাইক এসে ঠিক সামনে ব্রেক চাপল। আরোহীর গায়ে হালকা আকাশী রঙের শার্ট, কালো গ্যাবার্ডিনের ওপর ছেড়ে পড়া। শার্টের হাতা ফোল্ড করা, পেশিগুলো টানটান, শার্টটা গায়ে আঁটসাঁট লেগে আছে। হেলমেটের গ্লাস নামিয়ে নীরব স্মিত হাসল। অপরাধীর সুরে বলল,
-” স্যরি, রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললাম বুঝি?”
প্রত্যাশা মুখে হাসি ফুটিয়ে হালকা মাথা নেড়ে বলল,
-” না না, ঠিক আছে। সমস্যা নেই। আপনি হঠাৎ এখানে?”
-” দরকার আছে।”
নীরব প্রত্যাশার আপাদমস্তক পরখ করল। গায়ে কলেজ ইউনিফর্ম; আকাশি কামিজ, সাদা পায়জামা আর কোমরে বাঁধা সাদা বেল্ট। চুলগুলো দুইভাগ করে রাবার দিয়ে বেঁধে সামনে রাখা। মুখের উপর একগাছি কা’টা চুল ঘামে লেপ্টে আছে। অপর পাশের কা’টা চুল গাছি কালো ক্লিপ দিয়ে ভেতরে আঁটকে রাখা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। রোদের আলোতে মায়াবী মুখটা উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। রাজ্যের মায়া যেন ফেসটায় ছড়িয়ে আছে। নীরব এক দৃষ্টিতে কিছুপল প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রত্যাশা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” উঁহুম… উঁহুম! কী হলো? কী দেখছেন এভাবে?”
নীরব মৃদু হাসল। পরপর এক আঙুলে কপাল চুলকে বলল,
-” লেটস গো।”
প্রত্যাশা বাইকে চেপে বসতেই নীরব একটা হেলমেট বাড়িয়ে দিল। প্রত্যাশা ত্রস্ত মাথায় সেট করে ফিতা বেঁধে নিল। ইঞ্জিন স্টার্ট করতে করতে নীরব বলল,
-” ঠিক করে বসো।”
প্রত্যাশা গা ঘেঁষে বসল। একহাতে নীরবের পেট পেঁচিয়ে ধরল। দুষ্টু হেসে বলল,
-” চলবে?”
নীরব বিনিময় নিঃশব্দে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। শো শো বাতাসের সাথে নীরবের জোরে বলা কণ্ঠস্বর আসলো,
-” বাসায় ফোন করে জানিয়ে দাও। নইলে টেনশন করবে।”
-” হুম।”
.
সোজা শপিংমলে এনে প্রত্যাশাকে ড্রেস চুজ করতে বলে। প্রত্যাশা গাউন আর টপস নিল। হঠাৎ একটা মেরুন কালারের শাড়ির দিকে নীরবের নজর পড়ল। শাড়িটাতে প্রত্যাশাকে কল্পনা করল। পরপর সেলস ম্যানকে শাড়িটা প্যাক করতে বলে। প্রত্যাশা ইতস্তত করে বলল,
-” আবার শাড়ি…..এত কিছুর দরকার ছিলো না।”
-” শাড়িটা আমার ভালো লেগেছে। তোমার পছন্দে কেনা ড্রেসেই তোমাকে বেশি সুন্দর লাগে? নাকি আমার পছন্দ করে নেওয়া শাড়িতে? এইজন্য শাড়িটা নেওয়া ইম্পর্ট্যান্ট।”
প্যাকেটগুলো একহাতে নিয়ে অন্যহাতে পকেট থেকে টাকা বের করে ক্যাশ কাউন্টারে টাকা দেয় নীরব। তারপর রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে প্রত্যাশাকে বাসায় ড্রপ করে।
.
বাসায় গিয়ে ব্যাগ থেকে ড্রেস বের করতে গিয়ে, একটা ব্যাগ থেকে হলুদ খাম পায় প্রত্যাশা। খাম দেখেই প্রত্যাশা বুঝে নেয়। সরাসরি হাতে না দিয়ে নীরবের টাকা দেওয়ার এই ইউনিক পদ্ধতিটা প্রত্যাশার ভালোই লাগে। তবে এবারে হলুদ খাম থেকে শুধু টাকাই নয়, সাথে সবুজ রঙের একটা চিরকুট বেরোল। প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে চিরকুটটা মেলে ধরল। গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা,
“ ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি রাখতে; যা মনে ধরবে, চোখে লাগবে নিয়ে নিও। কার্পণ্য করো না, দ্বিধাও নয়। সব কিছু পছন্দ করে নিও। আবার যদি কখনো আসে এমন কোনো সুযোগ। তখন না হয় আমরা দু’জনে মিলে
স্মৃতি রেখে আসব সমুদ্রের পাড়ে। ফেরার পথে কিছু স্মৃতি কুড়িয়ে আনব দু’জন একসাথে।”
— নীরব মাহবুব।
___________
রাত নয়টার দিকে শফিক সাহেব মেয়েকে এনে গাড়িতে তুলে দেন। স্যার-ম্যাডামের কাছে অনেক করে বলে দেন— প্রত্যাশার দিকে একটু খেয়াল রাখতে। হ্যাপির মামাকে বাস ছাড়ার আগ মুহূর্তেও হাত ধরে বললেন,
-” ভাই সাহেব মেয়েকে আপনার ভরসায় পাঠাচ্ছি। একটু লক্ষ্য রাখবেন। সহীহ সালামতে যেন সবার সাথে হাসি- খুশিতেই ফিরে আসে।”
প্রফেসর হাবিবুর রহমান অমায়িক কণ্ঠে বললেন,
-” ইনশা-আল্লাহ! ভাই চিন্তা করবেন না। প্রত্যাশা শুধু আমার ছাত্রীই নয়। হ্যাপি যেমন আমার আপন, প্রত্যাশাও তেমনই। মেয়েটা একটু চঞ্চল স্বভাবের, দুষ্টুমি করে। তবে ওর মনটা খুব ভালো। আমি খেয়াল করে দেখেছি ওই খুব সহজ-সরল, ভালো মনের মেয়ে।”
শফিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-” সেইজন্যই তো ওকে নিয়ে চিন্তা হয়। এখনকার সময়ে একটু চালাক-চতুর না হলে যে টিকে থাকা মুশকিল।”
.
দু’টো বাস। এক বাসে মেয়েরা, অন্য বাসে ছেলেরা। প্রত্যাশারা তিন বান্ধবী একসাথে তিনসিট থাকা আসনে বসেছে। বাস চলছে শহরের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ বাইপাসে আসতেই আচমকা বাস ব্রেক করল। ঝাঁকুনিতে কেউকেউ সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। কেউ আবার ব্যালান্স সামলে নিল। সামনের ছেলেদের বাস দিব্বি চলে গেল। এইটা হঠাৎ থামায়, বাসের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। শোনা গেল ট্রাফিক পুলিশ আটকিয়েছে। কিন্তু কেনো? একই প্রশ্ন সবার। তন্মধ্যে হেলপার ছেলেটা পলিথিনের কয়েকটা প্যাকেট হাতে করিডোরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলল,
-” বিজ্ঞান বিভাগের ইয়ানূর প্রত্যাশা কে?”
নিজের নাম শুনে প্রত্যাশা চমকাল। হাত দিয়ে কেউকেউ—‘ওইযে’ বলে দেখাল। প্রত্যাশা ভ’য়ে ভ’য়ে উঠে দাঁড়াল। হেলপার ছেলেটি এগিয়ে এসে প্যাকেটগুলো বাড়িয়ে বলল,
-” এগুলান আপনার?”
-” আমার? কে পাঠিয়েছে? কে দিল?”
-” গাড়ি থামাইয়া আমার হাতে ট্রাফিক পু’লিশ দিলো। আর আপনার নাম বইলা দিতে কইল। ওনাকে কে জানি দিতে কয়ছে।”
এমন সময় ফোনে মেসেজ আসায় ফোনটা কেঁপে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে নীরবের মেসেজ ভেসে উঠল,
” Look towards the side of the ***** plaza.”
প্রত্যাশা দ্রুত জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে তাকায়। আধো আলো অন্ধকারে নীরবকে স্পষ্ট দেখা গেল। দুইহাত জিন্সের পকেটে গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে। এদিকেই তাকিয়ে আছে। প্রত্যাশার মুখে হাসি ফুটল। চোখে চোখে দু’জনের বাক্য বিনিময় হলো। বাস চলতে শুরু করেছে। কোনো কথাই হলো না। তবুও কিছু কথা যেন চোখের ভাষায় হয়ে গেল। প্রত্যাশা বিদায় জানাতে হাত নাড়িয়ে বাই বলল। নীরব একহাত পকেট থেকে বের করে হাত নাড়াল। মূহুর্তেই বাস দৃষ্টি সীমার অগোচরে চলে যায়।
প্যাকেটে প্রাণ আপের বোতল ছয়টা, মিনারেল ওয়াটার, চিপস, চানাচুর, আরো হাবিজাবিতে ভরপুর। প্রত্যাশা হ্যাপি আর কোয়েলকে দিতে দিতে বলল,
-” ওই দুটোর তা রেখে দেই। না হলে পরে শুনলে মাথা খাবে আমার।”
গল্প করতে করতে হঠাৎ হ্যাপি বলল,
-” দেরি করে এসেও ভাগ্যিস পাশাপাশি তিন সিটের আসন পেয়েছি আমরা। মামা না রাখলে তো, একজনকে আলাদা বসতে হতো।”
প্রত্যাশা চিপস মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে বলল,
-” প্রফেসর মামা থাকলে, লেট করলেও ভালো আসন কনফার্ম! একটা কথা আছে না, জোর যার মুল্লুক তার।”
কোয়েল ঠোঁট বাঁকিয়ে ফোড়ন কে’টে বলল,
-” আর এএসপি বর থাকলে? গাড়িও থামে, প্যাকেটও আসে, বিদায়ও হয় সিনেমার সিনের মতো! সবই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার।”
ঠোঁট টিপে ওরা দু’জন হাসল। প্রত্যাশা একটু লজ্জা পেল। কিছুক্ষণ পর নীরব ফোন করল। কথা বলার এক পর্যায়ে নীরব আদেশের সুরে বলল,
-” প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় হটস অ্যাপে একটা করে মেসেজ সেন্ট করবে। তোমার মেসেজ দেখে আমি নিশ্চিন্ত থাকবো। টেনশন কম হবে।”
প্রত্যাশার কানে এয়ারপড গোঁজা। ও জানালার পাশে বসেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুচকি হাসল। হঠাৎ কিছু খেয়াল হতেই নীরব তড়িঘড়ি করে বলল,
-” ওহ শিট! একটা কথা তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি তো।”
-” কী?”
-” শোনো, একদম কিন্তু সমুদ্রের পানিতে নামবে না। পানিতে ভেজা তো দূর।”
ফোনের এপাশ থেকে প্রত্যাশা আর্তনাদ করে উঠল,
-” ইয়া আল্লাহ! কী বলেন? সমুদ্রের পানিতে গোসল করব এটা আমার ড্রিম। সমুদ্রের অত কাছে থেকেও সেই ড্রিমটা অপূর্ণ রাখব নাকি?”
নীরব তৎক্ষণাৎ কণ্ঠ চড়িয়ে কাটকাট গলায় স্রেফ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করল,
-” ভুলেও এই ড্রিম পূর্ণ করতে যাবে না। সমুদ্রে শতশত মানুষের সামনে গোসল করা, ভেজা জামাকাপড় পরিহিত মেয়েদের দিকে ছেলেরা বাজে নজরে চেয়ে থাকে। কিছু ছেলেরা তো এমন দৃষ্টিতে তাকায়; যেন এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত চোখের সামনে আছে, আর তারা রোজা রেখে ইফতারের আগ মুহূর্তের মতো তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টা খুবই নোং*রা আর ভ’য়ানক। সো বি কেয়ারফুল, প্রত্যাশা।”
-” আহা! আপনি কী করে জানলেন এসব? তাহলে আপনি নিশ্চয় এক সময় সেই ‘ঠাণ্ডা শরবতের দলেই’ ছিলেন? তাই এত এক্সপার্ট মতামত দিচ্ছেন?”
#চলবে