মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-২৩+২৪

0
10

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

মাথার উপর থাকা বৈদ্যুতিক পাখাটা শাশা শব্দ তুলে ঘুরছে। প্রত্যাশা বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে, আঁখিযুগল বন্ধ, মুখ ভার। নিঃশব্দে, সন্তর্পণে পা টিপেটিপে কেউ একজন বিছানার পাশে আসল। আলগোছে মাথা ঝুঁকে মুখটা প্রত্যাশার খুব কাছে নিল। তারপর একদম প্রত্যাশার কানের পাশে মুখ এনে,

-” সারপ্রাইজ দোস্ত!”

হ্যাপি চেঁচিয়ে বলল। প্রত্যাশা ‘চ’ শব্দ করে আলস্য ভঙিতে উঠে বসল। প্রত্যাশার চাহনি যুগলে একফোঁটাও অবাক ভাব নেই। মুখটা ভারভার দেখে হ্যাপির ভ্রু কুঁচকে যায়।

-” অ্যাই প্রত্যাশা মন খা’রাপ নাকি? মুখটা এমন বান্ধা গরুর মত ঝুলে আছে কেন রে? বাংলা পাঁচও তো লজ্জা পাবে!”

-” ধূর ভাল্লাগে না।”

-” কী ভাল্লাগে না? আন্টি পিকনিকে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে না, তাই তো?”

-” আরে সেটা তো আছেই….”

-” তাহলে নতুন করে আবার কী হলো?”

-” মাই লাইফ মাই রুলসের যুগে এসেও, সামান্য চুলের উপরও আমার অধিকার নেই।”

হ্যাপি ফিক করে হেসে ফেলল। প্রত্যাশা বলতে লাগল,

-” হেয়ার স্টাইল আম্মুর পছন্দ হয়নি। চুল কে’টেছি জন্য আম্মুর কাছে ব’কুনি শুনেছি।”

কোমড় সমান চুল ছিলো, সেটা কে’টে পিঠের মাঝখান পর্যন্ত করেছে। আবার কানের দু’পাশে দু’গাছি করে কাঁ’টা। কলেজ থেকে ফেরার পথে বান্ধবীদের সাথে পার্লার থেকে কে’টে এসেছে। অতবড় চুল কে’টে খাটো করায় অধরা মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন।

.

ড্রয়িংরুমে অধরা আর হ্যাপির আম্মু হাবিবা বসে। মূলত হ্যাপি আম্মুকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখানে এনেছে। অধরা বললেন,

-” ভাবি সমস্যা হলো অতটা দূর, তারপর দুইটা রাত যাবে, প্রত্যাশাকে একলা ছাড়া রিস্ক। ওর আব্বুর অফিস থেকে ছুটি নেওয়াও মুস্কিল। আমি লং জার্নি করতে পারি না। অসুস্থ হয়ে পড়ি।”

হাবিবা বলল,

-” ভাবি আমার ভাই মানে হ্যাপির মামা ওদের কলেজের প্রফেসর। ভাইয়ের উপর নিশ্চিন্তে আমি মেয়েকে ছাড়তে পারি। তাই বলছি আপনি যদি ভরসা করতে পারেন! না মানে….আসলে হ্যাপি আর প্রত্যাশার গলায়-গলায় ভাব তো জানেনই। প্রত্যাশা যাবে না জন্য হ্যাপিরও মন খা’রাপ। আর পরীক্ষার পরই তো সব পড়াশোনার জন্য আলাদা হয়ে যাবে। কে কোথায় ভর্তি হয়। কখনো আবার এরকম একসাথে ঘুরার সুযোগ নাও আসতে পারে।”

অধরা ইতস্তত করে বলল,

-” আসলে প্রত্যাশাটা বয়সের তুলনায় একটু ইমম্যাচিউর আর বেশি চঞ্চল। তাই ওকে নিয়ে আমার সবসময় একটু বাড়তি চিন্তা থাকে। তারউপর এখন ও আমাদের কাছে অন্য এক বাড়ির আমানত। আমার গাফেলতির জন্য কোনো ভুলে তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হোক চাই না। তাই একটু সতর্ক থাকতে চাই। আবার নীরবকে জানানোর ব্যাপারও আছে।”

হাবিবা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললেন,

-” হ্যাঁ… হ্যাঁ তা তো ঠিকই।”

এমনি ভালোমন্দ আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে, নাস্তা পানি শেষে হাবিবা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,

-” ভাবি আসি তাহলে। সময় করে যাবেন কিন্তু।”

অধরা মুখে হাসি টেনে বলল,

-” হ্যাঁ যাবো। আপনিও আবার আসবেন কিন্তু।”

ওদিকে প্রত্যাশার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হ্যাপি ফিসফিস করে বলল,

-” আন্টির কথা শুনে বুঝলাম, ভাইয়া যদি রাজি হয় তাহলে আন্টি দ্বিমত করবে না। যেতে দিবে তোকে। এখন তুই তোর বরকে ম্যানেজ কর। জলদি গিয়ে ফোন করে কথা বল।”

প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,

-” উনি এখন অফিসে আছে। ব্যস্ত আছে। রাতে ফ্রি থাকবে। কাজের প্রেশারে না থেকে মন-মেজাজ ফুরফুরে থাকবে তখন বলব।”

__________

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে রাত দশটার ঘর ছুঁয়েছে।
প্রত্যাশা পড়ার টেবিলে বসে। এক হাতে কলম কামড়ে ধরে, অন্য হাতে ফোনটা নিয়ে কল লিস্ট খুলল।

বিছানায় বসে ল্যাপটপ সামনে নিয়ে গভীর মনোযোগের সহিত অফিশিয়াল কিছু একটা করছে নীরব। ডানপাশে রাখা ফোনটা ভাইব্রেশনের মৃদু শব্দে কাঁপছে। মাথা ঘুরিয়ে প্রত্যাশার কল দেখে রিসিভ করল। ঘাড়টা কিঞ্চিৎ কাৎ করে ফোনটা কাঁধ দিয়ে কানের সাথে চেপে ব্যালান্স করে রাখল। ওপাশ থেকে কোমল গলায় লম্বা করে সালাম এল,

-” আসসালামুয়ালাইকুম।”

আজ নিজ থেকে আগেআগেই ফোন, তারপর লম্বা করে সুরেলা কণ্ঠে সালাম। কথায় আছে না — অতি ভক্তি চো’রের লক্ষণ। নীরবের কাছে আজ প্রত্যাশার ব্যাপারটাও অমন লাগল। প্রত্যাশা টুকটাক ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করার পর আলতো স্বরে বলল,

-” শুনুন?”

নীরবের আঙুল ল্যাপটপের কিবোর্ডে। প্রত্যুত্তরে বলল,

-” শুনছি….বলো?”

-” কলেজ থেকে পিকনিকে কুয়াকাটা যাচ্ছে। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সব্বাই যাচ্ছে। সামনে তো এক্সাম। তারপর ভার্সিটি ভর্তি হয়ে কে কোথায়? কত দূর চলে যাবে।‌ সবাই একসাথে ঘুরার আর কখনো এমন সুযোগ আসবে বলে মনে হয় না। আর একসাথে আনন্দ করাও হবে না। তাই বলছি, আমিও ওদের সাথে যাই?”

ধীরেধীরে কোমল কণ্ঠে আবদারের সুরে বলল প্রত্যাশা। মূহুর্তেই নীরবের আঙুল কিবোর্ডে স্থির হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড পর কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে নীরব বলল,

-” যাওয়াটা কী খুব জরুরী?”

-” প্রায় সবাইই যাচ্ছে। তারপর জায়গাটাও দেখে আসা হবে। আগে কখনো তো দেখার সুযোগ হয়নি।”

-” প্রত্যাশা, চাইলে তোমার এক্সামের পর আমরা একসাথে কোথাও যেতে পারি। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একটা ট্রিপ প্ল্যান করব। তুমি আর আমি কুয়াকাটাতেই না হয় যাব। সাগরের ঢেউ, সূর্যাস্ত, সবকিছু একসাথে দেখব। একসাথে কোয়ালিটি টাইম কা’টা’ব। উমম! বলতে পারো হানিমুনটাও হয়ে যাবে।”

কথাগুলো প্রত্যাশার মন ছুঁতে ব্যর্থ হলো। ও রষকষহীন স্বরে বলল,

-” ধূর! বন্ধুদের সাথে কলেজ থেকে যাওয়ার এক মজা। আর আপনার সাথে আলাদা কথা। দু’টো এক হলো নাকি?”

নীরব কিছুক্ষণ ভাবল। কৌশলে জিজ্ঞেস করল,

-” তুমি বাসায় বলেছো? তুমি যেতে যাও জানিয়েছো?”

প্রত্যাশা গড়গড় করে বলতে লাগল— সব শেষে হ্যাপির মা’কে অধরার বলা কথাগুলোও বলল। নীরব নিম্নোষ্ঠের ডান পাশে দাঁত চেপে ধরে ভাবতে লাগল। প্রত্যাশা লাস্ট সুযোগটা নিতে বলল,

-” আপনিও না হয় চলুন আমার সাথে।”

-” অফিসের কাজে ব্যস্ত আছি। যে ডেট বলছো, সম্ভব হবে না।”

একটু থেমে পরমূহুর্তেই নীরব গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,

-” তোমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় আমি কখনোই হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তুমি স্বাধীন, নিজের পছন্দ-অপছন্দ, নিজের জায়গা থেকে ভাবার অধিকার তোমার পুরোপুরি আছে। তুমি কী চাও! সেটা যেমন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি তোমার সেফটি আমার কাছে সবচেয়ে আগে। এতটা দূর যেতে হলে, নানা ঝুঁকি থাকে। বন্ধুরা যাবে, আনন্দ হবে সবই ঠিক আছে। কলেজ পিকনিক, বন্ধুদের সাথে আনন্দ আমি সব বুঝি। কিন্তু দূরের পথ, এতজন মিশ্র পরিবেশ, অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতি। এইজন্য কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত আর টেনস আমি।”

প্রত্যাশা ভারি স্বরে বলল,

-” আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি যেহেতু চাইছেন না। থাক গে।”

নীরব জোরালো নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-” আমি না করলে তুমি যাবে না, সেটা আমি জানি। কোনো প্রকার বাকবিতন্ডা ছাড়াই আমার সিদ্ধান্ত তুমি মেনে নিবে। এতটুকু বিশ্বাস তোমার উপর আছে আমার। তবে এতে করে সুক্ষ্মভাবে আমার উপর তোমার একটা অভিমান, ভুল ধারণা জন্মাবে। আর সেটা হোক আমি চাই না। তুমি তোমার মতো করে ঘুরোফেরো নো প্রব্লেম। তবে সবটাই যেন লিমিটের মধ্যে থাকে।‌”

ভারিক্কি কথা শেষে নীরব গলার স্বর এবারে নরম করল।‌ উপদেশ বাণী আওড়াল,

-” প্রত্যাশা তুমিও সবার সাথে যাবে। আমার তরফ থেকে বাঁধা নেই। তবে সাবধানে থেকো, কোনো ভুল যেনো না হয়। টিচারদের কথা ঠিকঠাক শুনবে। দেরি করে কোথাও থাকবে না। একা কোথাও যাবে না, সবসময় বন্ধুদের সঙ্গেই থাকবে। কেউ কিছু অফার করলে না বলবে, মজা হলেও সীমা যেন না ছাড়ায়। কারো সঙ্গে তর্কে না জড়িয়ে শান্ত থেকো। আর ফোনটা যেন সবসময় অন থাকে।”

প্রত্যাশা খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল,

-” ওকে….ওকে। থ্যাংক ইয়্যু।”

নীরব আলতো স্বরে ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

-” হুম?”

-” যা বললাম সবটা শুধু মনেই রাখবে না। ফলো করে চলবে। আর অলওয়েজ এটা মনে রাখবে; তুমি শুধু তোমার নিজের না, অন্য কারোর অনেক কিছু।”

প্রত্যাশা সরাসরি প্রশ্ন করল,

-” এই অন্য কেউটা….আপনি?”

-” সেটা বুঝে নিও।”

-” ওকে।”

আরো দুয়েকটা বাক্য বিনিময় শেষে কল কা’টার আগে নীরব বলল,

-” আল্লাহ হাফেজ।”

-” আল্লাহ হাফেজ।”

__________

দুপুরের রোদটা যেন আ”গুন হয়ে ঝরছে। ক্লাস শেষ করে কলেজ গেট পার হচ্ছিল প্রত্যাশা। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ, ঘামে ভেজা কপাল। এমন সময় হাতে থাকা ফোনটা কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল নীরবের নাম। একটু থমকে ত্রস্ত কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত স্বর আসলো,

-” হ্যালো, প্রত্যাশা তুমি কোথায়?”

-” আমি কলেজে আছি। এই তো বের হচ্ছি বাসার পথে।”

-” তুমি কি টেন মিনিটস অপেক্ষা করতে পারবে? আমি আসছি।”

প্রত্যাশা কিঞ্চিৎ অবাক হলো। কৌতূহলী হয়ে বলে,

-” ওয়েট করবো, কিন্তু কেনো?”

-” একটু কষ্ট করে দাঁড়াও। কুইকলি, আ’ম কামিং।”

আর কিছু বলার আগেই নীরব কল কে’টে দিল।

.

বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তার এক পাশে এসে দাঁড়াল প্রত্যাশা। রোদের তাপে চোখ সরু হয়ে আসছে। একহাতে কপালের ঘামটুকু মুছে ফেলল। মিনিট দশেক পেরোনোর আগেই একটা কালো বাইক এসে ঠিক সামনে ব্রেক চাপল। আরোহীর গায়ে হালকা আকাশী রঙের শার্ট, কালো গ্যাবার্ডিনের ওপর ছেড়ে পড়া। শার্টের হাতা ফোল্ড করা, পেশিগুলো টানটান, শার্টটা গায়ে আঁটসাঁট লেগে আছে। হেলমেটের গ্লাস নামিয়ে নীরব স্মিত হাসল। অপরাধীর সুরে বলল,

-” স্যরি, রোদের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললাম বুঝি?”

প্রত্যাশা মুখে হাসি ফুটিয়ে হালকা মাথা নেড়ে বলল,

-” না না, ঠিক আছে। সমস্যা নেই। আপনি হঠাৎ এখানে?”

-” দরকার আছে।”

নীরব প্রত্যাশার আপাদমস্তক পরখ করল। গায়ে কলেজ ইউনিফর্ম; আকাশি কামিজ, সাদা পায়জামা আর কোমরে বাঁধা সাদা বেল্ট। চুলগুলো দুইভাগ করে রাবার দিয়ে বেঁধে সামনে রাখা। মুখের উপর একগাছি কা’টা চুল ঘামে লেপ্টে আছে। অপর পাশের কা’টা চুল গাছি কালো ক্লিপ দিয়ে ভেতরে আঁটকে রাখা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। রোদের আলোতে মায়াবী মুখটা উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। রাজ্যের মায়া যেন ফেসটায় ছড়িয়ে আছে। নীরব এক দৃষ্টিতে কিছুপল প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রত্যাশা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” উঁহুম… উঁহুম! কী হলো? কী দেখছেন এভাবে?”

নীরব মৃদু হাসল। পরপর এক আঙুলে কপাল চুলকে বলল,

-” লেটস গো।”

প্রত্যাশা বাইকে চেপে বসতেই নীরব একটা হেলমেট বাড়িয়ে দিল। প্রত্যাশা ত্রস্ত মাথায় সেট করে ফিতা বেঁধে নিল। ইঞ্জিন স্টার্ট করতে করতে নীরব বলল,

-” ঠিক করে বসো।”

প্রত্যাশা গা ঘেঁষে বসল। একহাতে নীরবের পেট পেঁচিয়ে ধরল। দুষ্টু হেসে বলল,

-” চলবে?”

নীরব বিনিময় নিঃশব্দে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। শো শো বাতাসের সাথে নীরবের জোরে বলা কণ্ঠস্বর আসলো,

-” বাসায় ফোন করে জানিয়ে দাও। নইলে টেনশন করবে।”

-” হুম।”

.

সোজা শপিংমলে এনে প্রত্যাশাকে ড্রেস চুজ করতে বলে। প্রত্যাশা গাউন আর টপস নিল। হঠাৎ একটা মেরুন কালারের শাড়ির দিকে নীরবের নজর পড়ল। শাড়িটাতে প্রত্যাশাকে কল্পনা করল। পরপর সেলস ম্যানকে শাড়িটা প্যাক করতে বলে। প্রত্যাশা ইতস্তত করে বলল,

-” আবার শাড়ি…..এত কিছুর দরকার ছিলো না।”

-” শাড়িটা আমার ভালো লেগেছে। তোমার পছন্দে কেনা ড্রেসেই তোমাকে বেশি সুন্দর লাগে? নাকি আমার পছন্দ করে নেওয়া শাড়িতে? এইজন্য শাড়িটা নেওয়া ইম্পর্ট্যান্ট।”

প্যাকেটগুলো একহাতে নিয়ে অন্যহাতে পকেট থেকে টাকা বের করে ক্যাশ কাউন্টারে টাকা দেয় নীরব। তারপর রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চ করে প্রত্যাশাকে বাসায় ড্রপ করে।

.

বাসায় গিয়ে ব্যাগ থেকে ড্রেস বের করতে গিয়ে, একটা ব্যাগ থেকে হলুদ খাম পায় প্রত্যাশা। খাম দেখেই প্রত্যাশা বুঝে নেয়। সরাসরি হাতে না দিয়ে নীরবের টাকা দেওয়ার এই ইউনিক পদ্ধতিটা প্রত্যাশার ভালোই লাগে। তবে এবারে হলুদ খাম থেকে শুধু টাকাই নয়, সাথে সবুজ রঙের একটা চিরকুট বেরোল। প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে চিরকুটটা মেলে ধরল। গোটা গোটা অক্ষরে সুন্দর করে গুছিয়ে লেখা,

“ ঘুরতে যাওয়ার স্মৃতি রাখতে; যা মনে ধরবে, চোখে লাগবে নিয়ে নিও। কার্পণ্য করো না, দ্বিধাও নয়। সব কিছু পছন্দ করে নিও। আবার যদি কখনো আসে এমন কোনো সুযোগ। তখন না হয় আমরা দু’জনে মিলে
স্মৃতি রেখে আসব সমুদ্রের পাড়ে। ফেরার পথে কিছু স্মৃতি কুড়িয়ে আনব দু’জন একসাথে।”

— নীরব মাহবুব।

___________

রাত নয়টার দিকে শফিক সাহেব মেয়েকে এনে গাড়িতে তুলে দেন। স্যার-ম্যাডামের কাছে অনেক করে বলে দেন— প্রত্যাশার দিকে একটু খেয়াল রাখতে। হ্যাপির মামাকে বাস ছাড়ার আগ মুহূর্তেও হাত ধরে বললেন,

-” ভাই সাহেব মেয়েকে আপনার ভরসায় পাঠাচ্ছি। একটু লক্ষ্য রাখবেন। সহীহ সালামতে যেন সবার সাথে হাসি- খুশিতেই ফিরে আসে।”

প্রফেসর হাবিবুর রহমান অমায়িক কণ্ঠে বললেন,

-” ইনশা-আল্লাহ! ভাই চিন্তা করবেন না। প্রত্যাশা শুধু আমার ছাত্রীই নয়। হ্যাপি যেমন আমার আপন, প্রত্যাশাও তেমনই। মেয়েটা একটু চঞ্চল স্বভাবের, দুষ্টুমি করে। তবে ওর মনটা খুব ভালো। আমি খেয়াল করে দেখেছি ওই খুব সহজ-সরল, ভালো মনের মেয়ে।”

শফিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-” সেইজন্যই তো ওকে নিয়ে চিন্তা হয়। এখনকার সময়ে একটু চালাক-চতুর না হলে যে টিকে থাকা মুশকিল।”

.

দু’টো বাস। এক বাসে মেয়েরা, অন্য বাসে ছেলেরা। প্রত্যাশারা তিন বান্ধবী একসাথে তিনসিট থাকা আসনে বসেছে। বাস চলছে শহরের রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ বাইপাসে আসতেই আচমকা বাস ব্রেক করল। ঝাঁকুনিতে কেউকেউ সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। কেউ আবার ব্যালান্স সামলে নিল। সামনের ছেলেদের বাস দিব্বি চলে গেল। এইটা হঠাৎ থামায়, বাসের মধ্যে হইচই পড়ে গেল। শোনা গেল ট্রাফিক পুলিশ আটকিয়েছে। কিন্তু কেনো? একই প্রশ্ন সবার। তন্মধ্যে হেলপার ছেলেটা পলিথিনের কয়েকটা প্যাকেট হাতে করিডোরে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলল,

-” বিজ্ঞান বিভাগের ইয়ানূর প্রত্যাশা কে?”

নিজের নাম শুনে প্রত্যাশা চমকাল। হাত দিয়ে কেউকেউ—‘ওইযে’ বলে দেখাল। প্রত্যাশা ভ’য়ে ভ’য়ে উঠে দাঁড়াল। হেলপার ছেলেটি এগিয়ে এসে প্যাকেটগুলো বাড়িয়ে বলল,

-” এগুলান আপনার?”

-” আমার? কে পাঠিয়েছে? কে দিল?”

-” গাড়ি থামাইয়া আমার হাতে ট্রাফিক পু’লিশ দিলো। আর আপনার নাম বইলা দিতে কইল। ওনাকে কে জানি দিতে কয়ছে।”

এমন সময় ফোনে মেসেজ আসায় ফোনটা কেঁপে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে নীরবের মেসেজ ভেসে উঠল,

” Look towards the side of the ***** plaza.”

প্রত্যাশা দ্রুত জানালা দিয়ে মাথাটা বের করে তাকায়। আধো আলো অন্ধকারে নীরবকে স্পষ্ট দেখা গেল। দুইহাত জিন্সের পকেটে গুঁজে সটান দাঁড়িয়ে। এদিকেই তাকিয়ে আছে। প্রত্যাশার মুখে হাসি ফুটল। চোখে চোখে দু’জনের বাক্য বিনিময় হলো। বাস চলতে শুরু করেছে। কোনো কথাই হলো না। তবুও কিছু কথা যেন চোখের ভাষায় হয়ে গেল। প্রত্যাশা বিদায় জানাতে হাত নাড়িয়ে বাই বলল। নীরব একহাত পকেট থেকে বের করে হাত নাড়াল। মূহুর্তেই বাস দৃষ্টি সীমার অগোচরে চলে যায়।

প্যাকেটে প্রাণ আপের বোতল ছয়টা, মিনারেল ওয়াটার, চিপস, চানাচুর, আরো হাবিজাবিতে ভরপুর। প্রত্যাশা হ্যাপি আর কোয়েলকে দিতে দিতে বলল,

-” ওই দুটোর তা রেখে দেই। না হলে পরে শুনলে মাথা খাবে আমার।”

গল্প করতে করতে হঠাৎ হ্যাপি বলল,

-” দেরি করে এসেও ভাগ্যিস পাশাপাশি তিন সিটের আসন পেয়েছি আমরা। মামা না রাখলে তো, একজনকে আলাদা বসতে হতো।”

প্রত্যাশা চিপস মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে বলল,

-” প্রফেসর মামা থাকলে, লেট করলেও ভালো আসন কনফার্ম! একটা কথা আছে না, জোর যার মুল্লুক তার।”

কোয়েল ঠোঁট বাঁকিয়ে ফোড়ন কে’টে বলল,

-” আর এএসপি বর থাকলে? গাড়িও থামে, প্যাকেটও আসে, বিদায়ও হয় সিনেমার সিনের মতো! সবই ক্ষমতার সদ্ব্যবহার।”

ঠোঁট টিপে ওরা দু’জন হাসল। প্রত্যাশা একটু লজ্জা পেল। কিছুক্ষণ পর নীরব ফোন করল। কথা বলার এক পর্যায়ে নীরব আদেশের সুরে বলল,

-” প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় হটস অ্যাপে একটা করে মেসেজ সেন্ট করবে। তোমার মেসেজ দেখে আমি নিশ্চিন্ত থাকবো। টেনশন কম হবে।”

প্রত্যাশার কানে এয়ারপড গোঁজা। ও জানালার পাশে বসেছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুচকি হাসল। হঠাৎ কিছু খেয়াল হতেই নীরব তড়িঘড়ি করে বলল,

-” ওহ শিট! একটা কথা তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি তো।”

-” কী?”

-” শোনো, একদম কিন্তু সমুদ্রের পানিতে নামবে না। পানিতে ভেজা তো দূর।”

ফোনের এপাশ থেকে প্রত্যাশা আর্তনাদ করে উঠল,

-” ইয়া আল্লাহ! কী বলেন? সমুদ্রের পানিতে গোসল করব এটা আমার ড্রিম। সমুদ্রের অত কাছে থেকেও সেই ড্রিমটা অপূর্ণ রাখব নাকি?”

নীরব তৎক্ষণাৎ কণ্ঠ চড়িয়ে কাটকাট গলায় স্রেফ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করল,

-” ভুলেও এই ড্রিম পূর্ণ করতে যাবে না। সমুদ্রে শতশত মানুষের সামনে গোসল করা, ভেজা জামাকাপড় পরিহিত মেয়েদের দিকে ছেলেরা বাজে নজরে চেয়ে থাকে। কিছু ছেলেরা তো এমন দৃষ্টিতে তাকায়; যেন এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত চোখের সামনে আছে, আর তারা রোজা রেখে ইফতারের আগ মুহূর্তের মতো তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টা খুবই নোং*রা আর ভ’য়ানক। সো বি কেয়ারফুল, প্রত্যাশা।”

-” আহা! আপনি কী করে জানলেন এসব? তাহলে আপনি নিশ্চয় এক সময় সেই ‘ঠাণ্ডা শরবতের দলেই’ ছিলেন? তাই এত এক্সপার্ট মতামত দিচ্ছেন?”

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

নীরব প্রত্যুত্তরে উদাহরণ টেনে বলল,

-” সব কিছু বুঝতে এক্সপার্ট হতে হয় না। ধরো কেউ আ”গুনে হাত দেয়নি কখনও, তাই বলে কি সে আ”গুনের তাপ বুঝবে না? কিংবা জলে ডুবেনি বলে কি জানা যায় না ডুবে গেলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে? একটা লোকের মুখভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি বুঝিয়ে দেয় তার মনের কথা। কোন দৃষ্টিতে শ্রদ্ধা, আর কোন দৃষ্টিতে শুধুই ভোগের ছায়া এতটুকু বোঝার ক্ষমতা উপরওয়ালা আমাকে দিয়েছেন।”

আত্মবিশ্বাস নিয়ে শেষোক্ত কথাটা বলে থামল নীরব। পরমূহুর্তেই ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,

-” পচা গন্ধ চিনতে হলে— পচা হওয়ার সার্টিফিকেট লাগে না। এবার তোমার ভুল ধারণা ভেঙেছে? আমাকে সেইসব ‘ঠাণ্ডা শরবতের’ দলে মিলাবে?”

-” উঁহুম। মিলাবো না। বুঝতে পেরেছি।”

-” গুড।”

আকাশে থালার মতো মস্ত বড় চাঁদটা রুপোলি আলো ছড়াচ্ছে। বাস ছুটছে মনে হচ্ছে চাঁদটাও পাল্লা দিয়ে ছুটছে। প্রত্যাশা জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল আলতো স্বরে,

-” ঘুমাবেন না?

-” হুম। প্রত্যাশা যা যা বললাম মনে যেনো থাকে। কোনো রং যেনো না হয়। দেখেশুনে থেকো। বাই।”

-” বাই।”

.

ঘন্টা তিনেক যেতে না যেতেই মাঝের সিটে বসা কোয়েল নড়েচড়ে উঠে বলল,

-” এইযে ম্যাডাম আপনি এখন উঠে এখানে আসুন। আমাকে একটু জানালার ধারে বসতে দিন।”

হ্যাপি করিডোরের সাথে লাগোয়া সিটে। বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসের ঝাঁকুনিতে মাথাটা ওর এদিক-ওদিক ঢুলে পড়ছে। কানে এয়ারপড গুঁজে গান শোনায় মশগুল প্রত্যাশা। প্রত্যাশার সারা না পেয়ে কোয়েল হাত ধরে নাড়া দিতেই প্রত্যাশা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। কোয়েল কথাটা পুনরায় বলতেই প্রত্যাশা বলল,

-” যেখানে বসে আছিস সেখানেই থাক না। আবার সিট অদল-বদলের কী আছে?”

কোয়েল চাঁচাছোলা স্বরে বলল,

-” এই না না….চলবে না। অদল-বদল করে তিনজনই জানালার পাশে বসব। হ্যাপিও বসবে। এখন আপাতত আমি বসব।”

হ্যাপি হলে বিনা বাক্যব্যয়ে কথা শুনত। এই ঘাড়ত্যাড়া কোয়েল শুনবে না। তাই আর দ্বিরুক্তি না করে মাঝে বসল প্রত্যাশা। হ্যাপির মাথাটা ঠিক করে সিটের উপর আলতোভাবে রাখল। মাঝে বসে কেমন চিপায় পড়ার মতো লাগছে। যদিও সিটগুলো বড়বড়ই । তবুও জানালার ধারে বসার মতো মজা নেই। দুষ্টু বুদ্ধি আঁটে প্রত্যাশা। একহাতে মুখ চেপে বমি পাচ্ছে অ্যাক্টিং শুরু করল। কোয়েল চেঁচিয়ে উঠল,

-” ইয়া আল্লাহ! প্রত্যাশা কী সমস্যা? কী হলো তোর?”

প্রত্যাশা হাত দিয়ে মুখ চেপে ইশারায় বোঝাতে—‘ উম…উম’ শব্দ করল। এমন ভঙি করছে মনে হচ্ছে এই বুঝি কোয়েলের গা ভরে গলগল করে বমি করে দিবে। কোয়েল তড়িঘড়ি করে উঠে প্রত্যাশাকে জানালার পাশে বসতে দিতে দিতে বলল,

-” এই এই দ্বারা। আমার গা ভরে বমি করে দিস না আবার। জানালা দিয়ে কর বোন আমার।”

প্রত্যাশা সিটে আয়েশ করে বসল। মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করল। হাসতে হাসতে বলল,

-” অ্যাক্টিংটা কেমন ছিলো দোস্ত?”

কোয়েল একহাতে প্রত্যাশার বাহুতে চাপড় মে’রে বলল,

-” ফা’জি’ল, হারামি একটা।”

এদের দু’টোর তাণ্ডবে হ্যাপির ঘুম ছুটে যায়। হ্যাপি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

-” আহা! সিনেমার নায়িকা রে। অন্যকে হারামি বলছে।”

পরপর দু’জনকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

-” অ্যাই তোরা দু’জনে কী শুরু করেছিস বল তো? ষাঁড়ের মত গুঁতোগুতি করছিস ক্যান? আমার ঘুমটা দিলি ভেঙে।”

____________

নাস্তা রেডি করে নীরবের রুমে আসলেন নীহারিকা। নীরব রেডি হচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে বেল্ট লাগাচ্ছে। নীহারিকা গম্ভীর মুখে এসে বেডশিটটা ওয়াশের জন্য তুলে নতুন কাঁচা বেডশিট পারতে পারতে বললেন,

-” ছেলেদের বিয়ে দিয়ে মানুষ একটু আরাম-আয়েশে থাকে। ছেলের বউয়েদের উপর সংসারের দায়িত্ব দিয়ে সংসারের ঝামেলা থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু আমার হয়েছে পোড়া কপাল। তিন তিনটে ছেলের বউয়ের একটাও সংসারি না। একেকজন একেক ধাঁচের। মেঝোজনের কথা না হয় বাদই দিলাম। বড়জন আটটা পার হয়ে গিয়েছে এখনো জাগেনি। সেও যে সাংসারি না এত দিনে ঢের বুঝেছি। আর ছোটজনের কথা ভাবলে তো আমার ফাপর ঠেকে। ও মেয়ে যে কেমন সংসার করবে তা আমি আগেই বুঝে নিয়েছি।”

শর্মিলা বাবার বাড়ি ঘুরতে গিয়েছে। পরীটাও ছুটিতে। একাএকা এতগুলো মানুষের নাস্তা রেডি করা, তারপর সবকিছু গোছগাছ করে রাখতে নীহারিকা তিতিবিরক্ত হয়ে আক্ষেপ ঝাড়লেন। হতাশ শ্বাস ফেলে পরপর নীরবকে শুধালেন,

-” নীলা রাতে বলল প্রত্যাশা নাকি কুয়াকাটা গিয়েছে? তুই জানিস?”

-” হ্যাঁ।”

-” বাহ্! ভালোই। অতদূর একলা ছাড়লি। আবার আমাদেরকে জানালি না পর্যন্ত। জানাবি কেনো, মা তো বারণ করত। মা তো সকলের খারাপ চায়।”

নীরব মৃদুস্বরে বলল,

-” কলেজ থেকে সবাই যাচ্ছে। ওর শখ। আর স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি লাইফে সবাই পিকনিকে যেয়ে থাকে। এটাকে আমি খারাপ নজরে দেখি না।”

-” সে যায় ঠিক আছে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো প্রত্যাশাকে নিয়ে। কেমন তিড়িং বিড়িং করে চলাফেরা করে। বুদ্ধি শুদ্ধি একেবারেই কম। তাই দুশ্চিন্তা হয়।”

নীরব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে তাড়া দিয়ে বলল,

-” অফিসে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। নাস্তা করব।”

নীহারিকা সহসাই বলে উঠলেন,

-” এড়িয়ে যাচ্ছিস? শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে তবে তোর ভবিষ্যত নিয়ে খুব চিন্তা হয়। আমার এত শিক্ষিত, এত যোগ্য ছেলের সাথে তোর বাবা যে কী দেখে ওই অবুঝ মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দিল। তা আমি আজও ঠাওর করতে পারি না। আদৌতেও ওর কোনোদিন বুদ্ধি শুদ্ধি হবে কী না আল্লাহ মালুম! সবাই ছোট বলে হেসে উড়িয়ে দিলেও, আমি তা পারি না। আমি জানি তুই যথেষ্ট বুঝদার মানিয়ে নিয়ে চলছিস। কোনো কথার সৃষ্টি হতে দিচ্ছিস না।”

নীরব মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,

-” মা তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো না তো। অমন কোনো সমস্যা নেই। প্রত্যাশা একটু বোকাসোকা, ইমম্যাচিউর। তবে খুব সহজ-সরল, ভালো মনের মেয়ে। তুমি দেখো বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুদ্ধি বাড়বে। ও এখনকার মতো পা’গ’লামি করবে না।”

মনের কথাগুলো মনেই রেখে দিলেন নীহারিকা। আর বাড়তি কথা বলেলেন না। তবে ওই মেয়েকে নিয়ে ভাবলেই ছেলের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখেন নীহারিকা। একটা সংসারি মেয়ে হতে হলে, বুঝদার হতে হয়। আর ওই মেয়ে তো অবুঝপনার শীর্ষে। আচার-আচরণে ছেলেমানুষী।

_____________

আকাশটা মেঘলা মেঘলা। রোদের তেজ কম। সময়টা গ্রীষ্মকাল হওয়ায় ঝড় বৃষ্টির কথা বলা যায় না। টিচারেরা উদ্বিগ্ন। ওয়েদার ফোরকাস্ট অনুযায়ী বিকেলের দিকে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাথে ঝড়ো হাওয়াও বইতে পারে। সব স্টুডেন্টদের বারবার সতর্ক করছেন, কেউ একা যেনো দূরে না যায়। আবহাওয়া এমন-তেমন দেখলেই সবাই যেনো হোটেলে উঠে পরে।

আশেপাশে নারকেল গাছের সারি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা চারিপাশে। কেউ সমুদ্রের পানিতে ভিজছে, কেউ ভেজা বালুর উপর দিয়ে হাটছে। কেউবা ফটো তুলতে ব্যস্ত।

প্রত্যাশা সমুদ্রের পানির দিকে মুগ্ধ আঁখিযুগলে তাকিয়ে আছে। পানির খুব কাছে ও দাঁড়িয়ে। একটু পরপর পানি এসে পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। পানিতে নামতে মনটা আঁকুপাঁকু করছে। তবে নীরবের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারছে না। আর এতএত লোকজনের ভিড়ে একটা মেয়ে ভেজা কাপড়ে না থাকাই সবদিক দিয়ে বেটার। তাই ইচ্ছেটাকে বিশাল খোলা আকাশের নিচে উড়িয়ে দিল।

কোয়েল আর হ্যাপি দাঁড়িয়ে ছিলো। রোহান একটানে টিশার্ট খুলে কোয়েলের হাতে ধরিয়ে বলল,

-” গোসল করব টিশার্ট ধর। ভিজে না যেনো।”

নাহিদও সেইম কাজ করল। নাহিদ পানিতে নামবে তখন চেঁচিয়ে বলল হ্যাপিকে,

-” ওই জুতো জোড়া দেখিস। কেউ যেনো চু’রি-টুরি না করে।”

হ্যাপি মুখ বারি মে”রে বলল,

-” আমার তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই আরেক জনের জুতো পাহারা দিবো। আর তোর ওই খড়ম মার্কা জুতো কে নিবে ভাই? ফ্রিতেও তো নিবে না।”

সাউন্ড বক্সে গান বাজছে। গোল হয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে। মেয়েরা নাচ করছে। ছেলেরা এখন প্রায় সব কটাই গোসল করতে নেমেছে।

প্রত্যাশা হাঁটু ভেঙ্গে বসে। একহাতে ভেজা বালুর উপর আঁকিবুঁকি করছে অন্যহাতে ফোন কানে চেপে। নীরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওপাশ থেকে বলল,

-” যাক এভাবে বাকি সময়টা ভালো ভাবে কে’টে গেলেই হয়। খুব টেনশনে ছিলাম।”

-” এখন টেনশন হচ্ছে না?”

-” হচ্ছে। বাট একটু কম।”

দূর থেকে কোয়েল উচ্চ স্বরে বলল,

-” প্রত্যাশা আমরা ওখানে যাচ্ছি। ওরা ডান্স করছে। তুই কথা বলে আয় জলদি।”

প্রত্যাশা ব্যস্ত স্বরে ঘনঘন বলল,

-” শুনুন, এখন রাখছি। ওরা সব নাচছে ভিডিও করতে হবে। পরে কথা বলব।”

নীরব তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,

-” শোনো ভিডিও করবে, নাচ দেখবে দ্যাটস এনাফ। ভুলেও জয়েন করবে না।”

-” কীহ? আমি তো নাচব বলে এতক্ষণ মনেমনেই প্র্যাক্টিস করলাম।”

-” প্র্যাক্টিসের মতো মনেমনেই ডান্স করে নাও।”

-” ধূর! তাই আবার হয় নাকি? ভেবেছি কুচু কুচু গানে ডান্স করব।”

-” কুচু কুচু সেটা আবার কোন গান?”

-” আরে আপনি দেখি কিছুই জানেন না। নোরা ফাতেহির দিলবার দিলবার গান।”

-” ডান্স করার খুব শখ হলে আমার সামনে করো। আমি মাইন্ড করব না। এখন এই শখ এখানেই খতম করো।”

প্রত্যাশা মুখটা শুকনো করে বলল,

-” ঠিক আছে ডান্স করব না। তবে দেখব এখন। রাখছি।”

-” ঠিক আছে।”

.

কুয়াকাটা গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড সি রিসোর্ট কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র ১-২ মিনিট হাঁটার দূরত্বে অবস্থিত। এটা বিলাসবহুল হোটেলের মধ্যে অন্যতম। হোটেলটায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, কনফারেন্স হল, নিজস্ব রেস্টুরেন্টসহ ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস রয়েছে। রুম থেকে সি-ভিউ উপভোগ করা যায়। সার্থকরা গতকাল এসে উঠেছে। প্রীতির চোখে রোদ চশমা। হাতে একটা ডাব। স্ট্রতে ঠোঁট ছুঁয়ে স্বাদ নিচ্ছে। সার্থকের গলায় ক্যামেরা। ক্যামেরায় সুন্দর সুন্দর দৃশ্য বন্দি করছে। অদ্রিকা মেয়েটি ভারি মিষ্টি আর মার্জিত বেশভূষায়। গায়ে শুভ্ররঙা থ্রি পিস। একহাতে পানি নেড়ে চেঁচিয়ে বলল,

-” সার্থ শুধু কী প্রকৃতির ছবিই তুলবি? আমাদের চোখে ধরে না। জলদি সুন্দর করে দু-চারটে ছবি তুলে দে ।”

সার্থক মৃদু হেসে বলল,

-” ওয়েট।”

অদ্রিকা পোজ দিতে থাকে। পরপর বলল,

-” দাঁড়া, প্রীতিকে ডাক দেই।”

এই বলে একহাত উঁচিয়ে জোরে চিৎকার করে ডাকল,

-” এই প্রীতি এদিকে এসো।”

বাতাসে শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল। সার্থক ক্যামেরা তুলে ছবি নিবে, এমন সময় ভ্রু কুঁচকে গেল। ক্যামেরায় কাচ শব্দ হলো, ছবি উঠল। সার্থক ঘুরিয়ে দেখল। অবিশ্বাস্য ঠেকল। প্রত্যাশা যেতে বসে প্রীতি ডাকটা শুনে এদিকে ঘাড় ঘুরায়। সেই মূহূর্তে অদ্রিকার পাশ দিয়ে যাওয়া প্রত্যাশার ছবিও ক্যামেরায় বন্দি হয়। সার্থক ক্যামেরা ধরে রাখায় মুখটা পুরোপুরি দেখা যায় না। প্রত্যাশা ত্রস্ত পা চালিয়ে যাওয়ার দরুন অতটা খেয়ালও হয় না।

প্রীতি হাতের ডাব ছুঁড়ে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রত্যাশাও যাচ্ছিল। ঠিক সামনাসামনি দু’জনে পরে। দু’জনের পা-ই থেমে যায়। দু’জন দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে রয়। প্রত্যাশা অবচেতনে আওড়ায়,

-” আরে প্রীতি জিন্টা যে।”

তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হাতে দুই গাল চাপ’ড়ে মনেমনে বলে প্রত্যাশা,

-” তওবা…তওবা। এএসপি সাহেব তো সম্মান প্রদর্শন করতে বলেছেন। অগোচরেও নাম ধরে বলতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।”

#চলবে