#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
নীরব প্রত্যুত্তরে উদাহরণ টেনে বলল,
-” সব কিছু বুঝতে এক্সপার্ট হতে হয় না। ধরো কেউ আ”গুনে হাত দেয়নি কখনও, তাই বলে কি সে আ”গুনের তাপ বুঝবে না? কিংবা জলে ডুবেনি বলে কি জানা যায় না ডুবে গেলে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে? একটা লোকের মুখভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি বুঝিয়ে দেয় তার মনের কথা। কোন দৃষ্টিতে শ্রদ্ধা, আর কোন দৃষ্টিতে শুধুই ভোগের ছায়া এতটুকু বোঝার ক্ষমতা উপরওয়ালা আমাকে দিয়েছেন।”
আত্মবিশ্বাস নিয়ে শেষোক্ত কথাটা বলে থামল নীরব। পরমূহুর্তেই ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
-” পচা গন্ধ চিনতে হলে— পচা হওয়ার সার্টিফিকেট লাগে না। এবার তোমার ভুল ধারণা ভেঙেছে? আমাকে সেইসব ‘ঠাণ্ডা শরবতের’ দলে মিলাবে?”
-” উঁহুম। মিলাবো না। বুঝতে পেরেছি।”
-” গুড।”
আকাশে থালার মতো মস্ত বড় চাঁদটা রুপোলি আলো ছড়াচ্ছে। বাস ছুটছে মনে হচ্ছে চাঁদটাও পাল্লা দিয়ে ছুটছে। প্রত্যাশা জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করল আলতো স্বরে,
-” ঘুমাবেন না?
-” হুম। প্রত্যাশা যা যা বললাম মনে যেনো থাকে। কোনো রং যেনো না হয়। দেখেশুনে থেকো। বাই।”
-” বাই।”
.
ঘন্টা তিনেক যেতে না যেতেই মাঝের সিটে বসা কোয়েল নড়েচড়ে উঠে বলল,
-” এইযে ম্যাডাম আপনি এখন উঠে এখানে আসুন। আমাকে একটু জানালার ধারে বসতে দিন।”
হ্যাপি করিডোরের সাথে লাগোয়া সিটে। বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছে। বাসের ঝাঁকুনিতে মাথাটা ওর এদিক-ওদিক ঢুলে পড়ছে। কানে এয়ারপড গুঁজে গান শোনায় মশগুল প্রত্যাশা। প্রত্যাশার সারা না পেয়ে কোয়েল হাত ধরে নাড়া দিতেই প্রত্যাশা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। কোয়েল কথাটা পুনরায় বলতেই প্রত্যাশা বলল,
-” যেখানে বসে আছিস সেখানেই থাক না। আবার সিট অদল-বদলের কী আছে?”
কোয়েল চাঁচাছোলা স্বরে বলল,
-” এই না না….চলবে না। অদল-বদল করে তিনজনই জানালার পাশে বসব। হ্যাপিও বসবে। এখন আপাতত আমি বসব।”
হ্যাপি হলে বিনা বাক্যব্যয়ে কথা শুনত। এই ঘাড়ত্যাড়া কোয়েল শুনবে না। তাই আর দ্বিরুক্তি না করে মাঝে বসল প্রত্যাশা। হ্যাপির মাথাটা ঠিক করে সিটের উপর আলতোভাবে রাখল। মাঝে বসে কেমন চিপায় পড়ার মতো লাগছে। যদিও সিটগুলো বড়বড়ই । তবুও জানালার ধারে বসার মতো মজা নেই। দুষ্টু বুদ্ধি আঁটে প্রত্যাশা। একহাতে মুখ চেপে বমি পাচ্ছে অ্যাক্টিং শুরু করল। কোয়েল চেঁচিয়ে উঠল,
-” ইয়া আল্লাহ! প্রত্যাশা কী সমস্যা? কী হলো তোর?”
প্রত্যাশা হাত দিয়ে মুখ চেপে ইশারায় বোঝাতে—‘ উম…উম’ শব্দ করল। এমন ভঙি করছে মনে হচ্ছে এই বুঝি কোয়েলের গা ভরে গলগল করে বমি করে দিবে। কোয়েল তড়িঘড়ি করে উঠে প্রত্যাশাকে জানালার পাশে বসতে দিতে দিতে বলল,
-” এই এই ওয়েট…ওয়েট। আমার গা ভরে বমি করে দিস না আবার। জানালা দিয়ে কর বোন আমার।”
প্রত্যাশা সিটে আয়েশ করে বসল। মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করল। হাসতে হাসতে বলল,
-” অ্যাক্টিংটা কেমন ছিলো দোস্ত?”
কোয়েল একহাতে প্রত্যাশার বাহুতে চাপড় মে’রে বলল,
-” ফা’জি’ল, হারামি একটা।”
এদের দু’টোর তাণ্ডবে হ্যাপির ঘুম ছুটে যায়। হ্যাপি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-” আহা! সিনেমার নায়িকা রে। অন্যকে হারামি বলছে।”
পরপর দু’জনকে উদ্দেশ্য করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
-” অ্যাই তোরা দু’জনে কী শুরু করেছিস বল তো? ষাঁড়ের মত গুঁতোগুতি করছিস ক্যান? আমার ঘুমটা দিলি ভেঙে।”
____________
নাস্তা রেডি করে নীরবের রুমে আসলেন নীহারিকা। নীরব রেডি হচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে বেল্ট লাগাচ্ছে। নীহারিকা গম্ভীর মুখে এসে বেডশিটটা ওয়াশের জন্য তুলে নতুন কাঁচা বেডশিট পারতে পারতে বললেন,
-” ছেলেদের বিয়ে দিয়ে মানুষ একটু আরাম-আয়েশে থাকে। ছেলের বউয়েদের উপর সংসারের দায়িত্ব দিয়ে সংসারের ঝামেলা থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু আমার হয়েছে পোড়া কপাল। তিন তিনটে ছেলের বউয়ের একটাও সংসারি না। একেকজন একেক ধাঁচের। মেঝোজনের কথা না হয় বাদই দিলাম। বড়জন আটটা পার হয়ে গিয়েছে এখনো জাগেনি। সেও যে সাংসারি না এত দিনে ঢের বুঝেছি। আর ছোটজনের কথা ভাবলে তো আমার ফাপর ঠেকে। ও মেয়ে যে কেমন সংসার করবে তা আমি আগেই বুঝে নিয়েছি।”
শর্মিলা বাবার বাড়ি ঘুরতে গিয়েছে। পরীটাও ছুটিতে। একাএকা এতগুলো মানুষের নাস্তা রেডি করা, তারপর সবকিছু গোছগাছ করে রাখতে নীহারিকা তিতিবিরক্ত হয়ে আক্ষেপ ঝাড়লেন। হতাশ শ্বাস ফেলে পরপর নীরবকে শুধালেন,
-” নীলা রাতে বলল প্রত্যাশা নাকি কুয়াকাটা গিয়েছে? তুই জানিস?”
-” হ্যাঁ।”
-” বাহ্! ভালোই। অতদূর একলা ছাড়লি। আবার আমাদেরকে জানালি না পর্যন্ত। জানাবি কেনো, মা তো বারণ করত। মা তো সকলের খারাপ চায়।”
নীরব মৃদুস্বরে বলল,
-” কলেজ থেকে সবাই যাচ্ছে। ওর শখ। আর স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি লাইফে সবাই পিকনিকে যেয়ে থাকে। এটাকে আমি খারাপ নজরে দেখি না।”
-” সে যায় ঠিক আছে। কিন্তু এখানে সমস্যা হলো প্রত্যাশাকে নিয়ে। কেমন তিড়িং বিড়িং করে চলাফেরা করে। বুদ্ধি শুদ্ধি একেবারেই কম। তাই দুশ্চিন্তা হয়।”
নীরব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে তাড়া দিয়ে বলল,
-” অফিসে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। নাস্তা করব।”
নীহারিকা সহসাই বলে উঠলেন,
-” এড়িয়ে যাচ্ছিস? শুনতে হয়তো খারাপ শোনাবে তবে তোর ভবিষ্যত নিয়ে খুব চিন্তা হয়। আমার এত শিক্ষিত, এত যোগ্য ছেলের সাথে তোর বাবা যে কী দেখে ওই অবুঝ মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে দিল। তা আমি আজও ঠাওর করতে পারি না। আদৌতেও ওর কোনোদিন বুদ্ধি শুদ্ধি হবে কী না আল্লাহ মালুম! সবাই ছোট বলে হেসে উড়িয়ে দিলেও, আমি তা পারি না। আমি জানি তুই যথেষ্ট বুঝদার মানিয়ে নিয়ে চলছিস। কোনো কথার সৃষ্টি হতে দিচ্ছিস না।”
নীরব মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,
-” মা তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো না তো। অমন কোনো সমস্যা নেই। প্রত্যাশা একটু বোকাসোকা, ইমম্যাচিউর। তবে খুব সহজ-সরল, ভালো মনের মেয়ে। তুমি দেখো বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুদ্ধি বাড়বে। ও এখনকার মতো পা’গ’লামি করবে না।”
মনের কথাগুলো মনেই রেখে দিলেন নীহারিকা। আর বাড়তি কথা বলেলেন না। তবে ওই মেয়েকে নিয়ে ভাবলেই ছেলের ভবিষ্যত অন্ধকার দেখেন নীহারিকা। একটা সংসারি মেয়ে হতে হলে, বুঝদার হতে হয়। আর ওই মেয়ে তো অবুঝপনার শীর্ষে। আচার-আচরণে ছেলেমানুষী।
_____________
আকাশটা মেঘলা মেঘলা। রোদের তেজ কম। সময়টা গ্রীষ্মকাল হওয়ায় ঝড় বৃষ্টির কথা বলা যায় না। টিচারেরা উদ্বিগ্ন। ওয়েদার ফোরকাস্ট অনুযায়ী বিকেলের দিকে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সাথে ঝড়ো হাওয়াও বইতে পারে। সব স্টুডেন্টদের বারবার সতর্ক করছেন, কেউ একা যেনো দূরে না যায়। আবহাওয়া এমন-তেমন দেখলেই সবাই যেনো হোটেলে উঠে পরে।
আশেপাশে নারকেল গাছের সারি। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা চারিপাশে। কেউ সমুদ্রের পানিতে ভিজছে, কেউ ভেজা বালুর উপর দিয়ে হাটছে। কেউবা ফটো তুলতে ব্যস্ত।
প্রত্যাশা সমুদ্রের পানির দিকে মুগ্ধ আঁখিযুগলে তাকিয়ে আছে। পানির খুব কাছে ও দাঁড়িয়ে। একটু পরপর পানি এসে পা ছুঁয়ে দিচ্ছে। পানিতে নামতে মনটা আঁকুপাঁকু করছে। তবে নীরবের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারছে না। আর এতএত লোকজনের ভিড়ে একটা মেয়ে ভেজা কাপড়ে না থাকাই সবদিক দিয়ে বেটার। তাই ইচ্ছেটাকে বিশাল খোলা আকাশের নিচে উড়িয়ে দিল।
কোয়েল আর হ্যাপি দাঁড়িয়ে ছিলো। রোহান একটানে টিশার্ট খুলে কোয়েলের হাতে ধরিয়ে বলল,
-” গোসল করব টিশার্ট ধর। ভিজে না যেনো।”
নাহিদও সেইম কাজ করল। নাহিদ পানিতে নামবে তখন চেঁচিয়ে বলল হ্যাপিকে,
-” ওই জুতো জোড়া দেখিস। কেউ যেনো চু’রি-টুরি না করে।”
হ্যাপি মুখ বারি মে”রে বলল,
-” আমার তো খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই আরেক জনের জুতো পাহারা দিবো। আর তোর ওই খড়ম মার্কা জুতো কে নিবে ভাই? ফ্রিতেও তো নিবে না।”
সাউন্ড বক্সে গান বাজছে। গোল হয়ে অনেকে দাঁড়িয়ে। মেয়েরা নাচ করছে। ছেলেরা এখন প্রায় সব কটাই গোসল করতে নেমেছে।
প্রত্যাশা হাঁটু ভেঙ্গে বসে। একহাতে ভেজা বালুর উপর আঁকিবুঁকি করছে অন্যহাতে ফোন কানে চেপে। নীরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওপাশ থেকে বলল,
-” যাক এভাবে বাকি সময়টা ভালো ভাবে কে’টে গেলেই হয়। খুব টেনশনে ছিলাম।”
-” এখন টেনশন হচ্ছে না?”
-” হচ্ছে। বাট একটু কম।”
দূর থেকে কোয়েল উচ্চ স্বরে বলল,
-” প্রত্যাশা আমরা ওখানে যাচ্ছি। ওরা ডান্স করছে। তুই কথা বলে আয় জলদি।”
প্রত্যাশা ব্যস্ত স্বরে ঘনঘন বলল,
-” শুনুন, এখন রাখছি। ওরা সব নাচছে ভিডিও করতে হবে। পরে কথা বলব।”
নীরব তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
-” শোনো ভিডিও করবে, নাচ দেখবে দ্যাটস এনাফ। ভুলেও জয়েন করবে না।”
-” কীহ? আমি তো নাচব বলে এতক্ষণ মনেমনেই প্র্যাক্টিস করলাম।”
-” প্র্যাক্টিসের মতো মনেমনেই ডান্স করে নাও।”
-” ধূর! তাই আবার হয় নাকি? ভেবেছি কুচু কুচু গানে ডান্স করব।”
-” কুচু কুচু সেটা আবার কোন গান?”
-” আরে আপনি দেখি কিছুই জানেন না। নোরা ফাতেহির দিলবার দিলবার গান।”
-” ডান্স করার খুব শখ হলে আমার সামনে করো। আমি মাইন্ড করব না। এখন এই শখ এখানেই খতম করো।”
প্রত্যাশা মুখটা শুকনো করে বলল,
-” ঠিক আছে ডান্স করব না। তবে দেখব এখন। রাখছি।”
-” ঠিক আছে।”
.
কুয়াকাটা গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড সি রিসোর্ট কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র ১-২ মিনিট হাঁটার দূরত্বে অবস্থিত। এটা বিলাসবহুল হোটেলের মধ্যে অন্যতম। হোটেলটায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, কনফারেন্স হল, নিজস্ব রেস্টুরেন্টসহ ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস রয়েছে। রুম থেকে সি-ভিউ উপভোগ করা যায়। সার্থকরা গতকাল এসে উঠেছে। প্রীতির চোখে রোদ চশমা। হাতে একটা ডাব। স্ট্রতে ঠোঁট ছুঁয়ে স্বাদ নিচ্ছে। সার্থকের গলায় ক্যামেরা। ক্যামেরায় সুন্দর সুন্দর দৃশ্য বন্দি করছে। অদ্রিকা মেয়েটি ভারি মিষ্টি আর মার্জিত বেশভূষায়। গায়ে শুভ্ররঙা থ্রি পিস। একহাতে পানি নেড়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” সার্থ শুধু কী প্রকৃতির ছবিই তুলবি? আমাদের চোখে ধরে না। জলদি সুন্দর করে দু-চারটে ছবি তুলে দে ।”
সার্থক মৃদু হেসে বলল,
-” ওয়েট।”
অদ্রিকা পোজ দিতে থাকে। পরপর বলল,
-” দাঁড়া, প্রীতিকে ডাক দেই।”
এই বলে একহাত উঁচিয়ে জোরে চিৎকার করে ডাকল,
-” এই প্রীতি এদিকে এসো।”
বাতাসে শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল। সার্থক ক্যামেরা তুলে ছবি নিবে, এমন সময় ভ্রু কুঁচকে গেল। ক্যামেরায় কাচ শব্দ হলো, ছবি উঠল। সার্থক ঘুরিয়ে দেখল। অবিশ্বাস্য ঠেকল। প্রত্যাশা যেতে বসে প্রীতি ডাকটা শুনে এদিকে ঘাড় ঘুরায়। সেই মূহূর্তে অদ্রিকার পাশ দিয়ে যাওয়া প্রত্যাশার ছবিও ক্যামেরায় বন্দি হয়। সার্থক ক্যামেরা ধরে রাখায় মুখটা পুরোপুরি দেখা যায় না। প্রত্যাশা ত্রস্ত পা চালিয়ে যাওয়ার দরুন অতটা খেয়ালও হয় না।
প্রীতি হাতের ডাব ছুঁড়ে এগিয়ে আসতে থাকে। প্রত্যাশাও যাচ্ছিল। ঠিক সামনাসামনি দু’জনে পরে। দু’জনের পা-ই থেমে যায়। দু’জন দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে রয়। প্রত্যাশা অবচেতনে আওড়ায়,
-” আরে প্রীতি জিন্টা যে।”
তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হাতে দুই গাল চাপ’ড়ে মনেমনে বলে প্রত্যাশা,
-” তওবা…তওবা। এএসপি সাহেব তো সম্মান প্রদর্শন করতে বলেছেন। অগোচরেও নাম ধরে বলতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
রোদ চশমটা কপালের উপর তুলল প্রীতি। সরু চাহনিতে কয়েক মূহুর্ত চেয়ে থেকে পরপর ঠোঁটে কোমল হাসি টেনে বলল,
-” কী আশ্চর্য! তুমি এখানে?”
প্রীতির মুখে হাসি, কোমল স্বর, সৌজন্যতা প্রত্যাশাকে বিস্মিত করল। মুখের দু’টো ভালো কথাই সেদিনের প্রীতি আর আজকের প্রীতির মাঝে বিস্তর ফারাক তৈরি করে মূহুর্তেই। প্রত্যাশা মুখে সরল হাসি নিয়ে বলল,
-” কলেজ থেকে ট্যুরে এসেছি। আপনি এখানে? ইচ্ছে…. ইচ্ছে কোথায়?”
-” আমি ভাইয়া আর ওর ফ্রেন্ডদের সাথে এসেছি। লং জার্নি, এতটা দূর তাই ইচ্ছেকে আনা হয়নি। ইচ্ছে বাসায়।”
প্রত্যাশার মুখের হাসি মিলিয়ে আসলো। ভাবল– বাপরে মেয়েকে রেখে ঘুরতে এসেছে। ভাবা যায়! প্রত্যাশার ভাবনার ছন্দপতন ঘটল মেয়েলি মিষ্টি কোমল কণ্ঠে,
-” প্রীতি, কী হলো দাঁড়িয়ে গেলে যে? তুমি চিনো ওনাকে?”
অদ্রিকা ক’কদম এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল। প্রীতি মিষ্টি হেসে প্রত্যাশাকে বলল,
-” চলো মিট করিয়ে দিই।”
পরপর অদ্রিকার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” অদ্রি আপি ও প্রত্যাশা। আমার বড় জা’য়ের বোন।”
প্রত্যাশার ভ্রুজোড়া কুঁচকে গেল। বিড়বিড় করল— আরে বড় জা’য়ের বোন না বলে সরাসরি ছোট জা বললেই তো হয়। কাছের সম্পর্ক রেখে দূরেরটা টানছে কেনো? আ’জ’ব তো!
প্রত্যাশার মুখের দিকে চেয়ে ভেঙে ভেঙে বলল প্রীতি,
-” ওর অবশ্য, আরেকটা পরিচয় আছে। সেটা হলো, এএসপি নীরবের বউ।”
প্রত্যাশা অবচেতনে আওড়ায় — যাক বাবা এবারে তাও ঠিক আছে। ওনার মনে আছে দেখছি। আমি ভেবেছিলাম ভুলে-টুলে গেছে মেবি।
অদ্রিকা মিষ্টি হেসে সৌজন্যতা করল। কথার ফাঁকে যখন শুনল ওদের এইচএসসি ব্যাচ এসেছে…আচমকা অদ্রিকা আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলে উঠল,
-” তুমি এবার এইচএসসি দিবে? তুমি দেখতেও তো আরো বাচ্চা আদুরে টাইপের। ওহ্ মাই গড! নীরব একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছে? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”
প্রত্যাশার রাগ হলো। মনেমনে ঝাড়ল– যেভাবে বলল মনে হচ্ছে আমি যেনো ফিডার খাওয়া বাচ্চা। কোনদিক দিয়ে আমাকে বাচ্চা লাগছে? আমার কয়েকটা ফ্রেন্ডেরও তো বিয়েথা হয়েছে। দুয়েকজন তো আবার বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করেও ফেলেছে। সেখানে এএসপি সাহেব আমাকে বিয়ে করলে তোদের কিসের এত সমস্যা!
প্রীতি বলল,
-” নীরবের বাবা মানে আমার শ্বশুরের থেকে প্রেশার ছিলো। তাই বোধহয় নীরব বিয়েতে দ্বিমত করেনি। শ্বশুর মশাই বয়স্ক তারপর অসুস্থ। বুঝতেই পারছো আপু।”
অদ্রিকা মাথা নেড়ে বলল,
-” ও আই সী।”
-” নীরব আপনাকে বলেছে এটা?” কথাটা জিভের ডগায় এলেও প্রত্যাশা কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিল। নীরব তো আবার তার ভাবি প্লাস পেয়ারের ফ্রেন্ডকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে বলেছে। তাই মনে জমা প্রশ্ন ঠেসে রাখল এক কোণে। প্রত্যাশা মুখটা ভার করে বলল,
-” আমি আসছি। আমার ফ্রেন্ডরা খুঁজছে হয়তো।”
প্রীতি তৎক্ষণাৎ বলল,
-” তুমি আমাদের সাথে থাকতে পারো। আমরাও তো ঘুরতেই এসেছি। একসাথেই না হয় ঘুরলাম-ফিরলাম।”
প্রত্যাশা ইতস্তত স্বরে বলল,
-” আসলে আমি ফ্রেন্ডদের সাথে এসেছি। ওদের ছাড়া ঘুরলে…ওরা মন খারাপ করবে। আর আপনারা আমার বড়। বড়দের ভেতর ছোট আমিটাকে বড্ড বেমানান লাগবে। যাইহোক আপু, বলার জন্য ধন্যবাদ।”
-” আচ্ছা ঠিক আছে। তবে তোমার সাথে যখন দেখা হলো এভাবে খালি মুখে কী করে ছাড়ি। তুমি পর নাকি আমার! এক সাথে না থাকলেও সম্পর্ক তো আর ধুয়ে যায় না। আর ছোট জা তো ছোট বোনেরই মতো। তাই জা নয় বড় আপু হিসেবে বলছি, আজকের লাঞ্চটা আমাদের সাথে করবে কেমন?”
মিষ্টি করে এতবার বলছে। প্রত্যাশা কীভাবে না করবে ভেবে পাচ্ছে না! দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে জড়তা নিয়ে বলল,
-” আ-আসলে আপু, সবার সাথে এসেছি। এভাবে একলা আপনাদের সাথে স্যার-ম্যামেরা এলাউ করবে না। একলা ছাড়বে না।”
প্রীতি ভাবুক ভঙিমায় বলল,
-” ওহহো। ঠিক আছে। তবে বিকেলে তো এদিকে থাকবেই। তখন দেখা করো।”
প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে বলল,
-” আচ্ছা।”
সার্থক কোণা চোখে একপল তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অদ্রিকা ঠিকই বলেছে মেয়েটাকে কেমন আদুরে আদুরে লাগে। সার্থক ভেবে পায় না এইটুকু একটা মেয়ের মধ্যে কী এমন দেখেছিলো? যে এতটা মায়ায় ফেসেছে!
এইযে চোখদুটো ফিরিয়ে নিলেও মনটা কী আদৌও ফিরাতে পেরেছে? উঁহু পারেনি। আর পারেনি বলেই প্রত্যাশার সরল মুখটা চোখের তারায় ভাসতে লাগল। সার্থক নিজেই নিজেকে ধ’ম’কিয়ে উঠল,
-” অন্যের শহরে যার বসবাস, তাকে নিয়ে ভাবাটা শুধুই দোষ নয়, বোকামি, অন্যায়।”
কিন্তু মন সে তো নীতিবাক্য সহজে মানতে নারাজ। কেমন উস্কিয়ে দিল। ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে গোপনে দু’টো ছবিও তুলল। ছবিটার দিকে তাকাতেই ব্যথাতুর হাসি ঠোঁটের কোণে ঠাঁই নেয় সার্থকের।
____________
হালকা মেঘলা আকাশ। সাথে ঝিরিঝিরি বাতাস। প্রত্যাশা, কোয়েল আর হ্যাপি খালি পায়ে হাঁটছে কুয়াকাটার ভেজা বালির ওপর দিয়ে। প্রত্যাশার পরনে কোমড় পর্যন্ত কফি কালারের টপস, আর নিচে স্কার্টের মতোন। লং বেল্টের ছোট ব্যাগটা কাঁধের একসাইড দিয়ে আড়াআড়ি করে কোমড়ের সাথে লেগে আছে। তিনজনের হাতে পেয়ারা। খাচ্ছে আর গল্প করছে। ওই তো অদূরে ছাতার মতো ছাউনীর তলায় গোল করে সাজানো কাঠের আর ক্যানভাসের তৈরি চেয়ারে বসে আছে প্রীতিরা তিনজন। বালির ওপরে রাখা আরামদায়ক চেয়ারগুলোয় শরীর হেলিয়ে, পা সামনে ছড়িয়ে ওরা কেউ ফোন স্ক্রল করছে, কেউ চুপচাপ সমুদ্রের ঢেউ দেখছে। মাঝখানে একটা নিচু টেবিল তাতে রাখা কোমল পানীয়।
প্রত্যাশার সাথে আবার দেখা হয়েছে। প্রীতি বসতে বললেও প্রত্যাশা এড়িয়ে যায়। আর প্রত্যাশারা একটু পরেই *****ঘুরতে যাবে। তারপর সূর্যাস্ত দেখে সন্ধ্যার পরপরই রওনা হবে। কিন্তু আকাশ মেঘলা থাকায় ওদের একটু মন খারাপ। মেঘটা কে’টে গেলেই ভালো হয়।
হ্যাপির চোখ সেই তখন থেকে আঁটকে আছে কালো সানগ্লাস চোখে, কালো টিশার্ট আর অফ হোয়াইট থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া ডক্টরের দিকে। হ্যাপি ওদিকে চেয়েই প্রত্যাশার কানের পাশে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” ও মাই আল্লাহ! ডক্টরটা এত হ্যান্ডসাম! এ রোগিকে সুস্থ করবে কী? এর কাছে গেলে তো রুগির হার্টবিট বেড়ে অ্যাটাক-ফ্যাটাকও হয়ে যেতে পারে। দেখেছিস তোর ডক্টর বেয়াইকে কী হ্যান্ডসাম! পুরাই চকলেট বয়।”
প্রত্যাশা ঝারি মে”রে বলল,
-” সর তো তুই…. ডক্টর-ফক্টর কে দেখার টাইম নেই আমার। আমার এএসপি বর কম হ্যান্ডসাম নাকি!”
এই বলে পেয়ারায় কামড় দিতে গিয়ে বেখেয়াল বশত নিম্নোষ্ঠের ডান পাশে কামুড় লাগে। প্রত্যাশা তক্ষুনি মৃদু আর্তনাদ করে উঠল,
-” আয়াআআআ। মা গো লাগল।”
হ্যাপি, কোয়েল একসাথে শুধাল,
-” কী হলো?”
প্রত্যাশা আঙুল দিয়ে কামড় লাগা স্থানটা আলতো করে ছুঁয়ে বলল,
-” কামুড় লেগেছে।”
কোয়েল হাসতে হাসতে বলল,
-” আহারেএএ। এইটুকুতেই এমন আর্তনাদ করলি। তাও আবার নিজের লাগা কামড়েই। বর যখন আদর করতে গিয়ে কামুড় দেয় তখন…তখন কী করিস শুনি?”
হ্যাপি ঠোঁট চেপে হাসছে। কোয়েলের বাহুতে চা’প’ড় মে’রে বলল প্রত্যাশা,
-” দিবো ক টা ফা’জিল একটা। আমার বর রাক্ষস নাকি যে কামড়-টামড় দিবে।”
-” আরে মাথা মোটা। এটা সে কামড় নয় রে। বরের দেওয়া কামড়কে বলে লাভ বাইট।”
প্রত্যাশা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
-” বাদ দে তো। আমাদের ওরকম কোয়ালিটি টাইম কাটানো হয়নি। তাই আই হেভ নো এক্সপিরিয়েন্স। আর আমার বর ওমন রাক্ষস-খোক্ষসের মতো কিছু করবে না, তার কেয়ারিংয়ের মতো তার আদরও হবে সফটলি।”
শেষের কথাগুলো বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে প্রত্যাশা। কোয়েল জোরালো গলায় বলল,
-” কী বললি কোনো এক্সপিরিয়েন্স নেই? আনবিলিভেবল।”
.
কিছুপল পর….হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ প্রত্যাশার পায়ের নিচে ধারালো কিছু একটা পড়তেই ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে এল। অস্ফুটে আর্তনাদ বেরোল। সাথে সাথে বাম পা-টা তুলতেই দেখল। গলগল করে র*ক্ত ঝরছে। পায়ের তলায় ভাঙা কাঁচ জাতীয় কিছু পড়েছিল। বাজেভাবে পা-টা কেটেছে। প্রত্যাশা চোখমুখ বন্ধ করে বলে—‘উফ্! মা গো খুব জ্ব’ল’ছে’।
হ্যাপি, কোয়েল ওদের চেঁচামেচি শুনে প্রীতিরা এগিয়ে যায়। পরপর প্রত্যাশাকে এখানে আপাতত বসতে বলে। প্রত্যাশা কাঠের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। সার্থক মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে পায়ের উপর ঢালল। পায়ের কাঁদা, বালু ময়লা ধুয়ে গেল। পানির সাথে র*ক্তও এক হয়ে বেয়ে পরছে এখনো। পকেট থেকে রোমাল বের করে শক্ত করে বাঁধতে লাগল। প্রত্যাশা ব্যথায় চোখমুখ খিচে বন্ধ করে হ্যাপির একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরল। প্রত্যাশার ব্যথাতুর মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্রিকার মায়া হলো। কণ্ঠে মায়া জড়িয়ে বলল,
-” ইশশ্! অনেকটা তো কেটেছে। ক্ষত হয়ে গিয়েছে। কী করে হলো? তুমি খেয়াল করোনি?”
প্রত্যাশা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে। সার্থক ব্যস্ত হয়ে বলল,
-” পায়ে ভর দিয়ে এসেছে চাপ পড়েছে, তারপর বালুও ঢুকেছে। এন্টিসেপটিক দরকার। ড্রেসিং করা জরুরী।”
প্রীতি দুই হাত বুকে গুঁজে কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে। অদ্রিকা মনে পড়ার মতো করে বলল,
-” অ্যাই সার্থ আমার কাছে তো ফার্স্ট এইড বক্স আছে। আমি অলওয়েজ ছোটখাটো প্রয়োজনীয় জিনিস রাখি। আমার ট্রাভেল ব্যাগের সাইডেই আছে।”
-” অদ্রি তাহলে টাইম ওয়েস্ট না করে জলদি আন।”
প্রীতি আগ বাড়িয়ে বলল,
-” আমি আনছি। তোমরা একটু ওয়েট করো। আমি আনতে যাচ্ছি।”
প্রীতি অনেকক্ষণ হলো গিয়েছে এখনো ফেরার নাম নেই। সার্থক একহাতে কপাল ডলে বিরক্ত হয়ে বলল,
-” প্রীতি করছে কী? এতক্ষণ লাগে নাকি।”
অদ্রিকা বলল,
-” প্রীতি বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না। আমি তো বললাম ব্যাগের সাইডেই আছে। ওয়েট, আমি কল করে দেখছি।”
হ্যাপি, কোয়েলের চোখেমুখে উদ্বেগ চিন্তার ছাপ। প্রত্যাশার মুখের দিকে তাকালেই হ্যাপির বুক ভার হয়ে আসছে। প্রত্যাশার একটা হাত মুঠোর ভেতর নিয়ে হ্যাপি বলল,
-” প্রত্যাশা ব্যথা করছে? কষ্ট হচ্ছে?”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” হুম।”
খানিকটা দেরি করেই প্রীতি আসল। সার্থক রাগি স্বরে বলল,
-” আমি তো ভেবেছিলাম তুই ঘুমিয়ে পড়েছিস? এত দেরি হলো কেনো?”
প্রীতি ভাইয়ের ঝাড়ি গায়ে মাখল না। বলল স্বাভাবিক ভাবে,
-” খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”
সার্থক ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। তারপর পেইন কিলার খুঁজে না পেয়ে বলল,
-” এখানে তো পেইন কিলার নেই দেখছি। আচ্ছা আশেপাশে ফার্মেসি আছে। আমি প্রয়োজনীয় মেডিসিন আনছি।”
ওদিকে হ্যাপি, কোয়েল বলল,
-” আমাদের ফ্রেন্ডরা ওইযে একেএকে বেরোচ্ছে। আমাদের এখন যেতে হবে। নইলে বাস আবার রওনা দিয়ে দিবে।”
সার্থক বলল,
-” পাঁচ মিনিট ওয়েট করো। আমি জলদি মেডিসিন এনে দিচ্ছি।”
এরমধ্যে প্রীতি সবার জন্য ডাব অর্ডার করল। প্রীতির হাতে থাকা ডাবটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা, উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল,
-” ইশশ্! খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়। একটু দেখে চলবে না। কতটা কে’টে গেল। মন খারাপ করো না। মেডিসিন নিলে ব্যথা সেরে যাবে। এই নাও ডাব খাও।”
প্রত্যাশা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। মুখটা ভারভার করেই হাতে নিল। ডাব কা’টা ছেলেটা বাকি সবাইকেও একএক করে দিল। প্রত্যাশা কাঠিতে ঠোঁট ছুঁয়ে এক ঢোক গিলতেই নাকমুখ সিঁটকিয়ে ফেলে। কেমন একটা উটকো গন্ধের মতো বেস্বাদ লাগল। প্রত্যাশা বলল,
-” সমুদ্রের পানি যেমন লবনাক্ত, তারপর শুনেছি এই অঞ্চলের খাবার পানিও কেমন একটা গন্ধযুক্ত। আমাদের ওইদিকের মতো মিঠা নয়। খেতে আলাদা একটা গন্ধ নাকে আসে। কিন্তু ডাবের পানিও যে আলাদা হয় এটা কখনো শুনিনি।”
অদ্রিকা বলল,
-” হোয়াট? ডাবের পনি আলাদা মানে?”
প্রত্যাশা বলল,
-” না মানে আমাদের ওইদিকের মতো অতো টেস্টি নয়।”
অদ্রিকা বলল,
-” আমার কাছে তো ভালোই লাগছে।”
হ্যাপি, কোয়েল একসাথে বলে উঠল,
-” ওর কথা, বাদ দিন তো আপু।”
কিছুক্ষণ পরই প্রত্যাশার মাথাটা ভারি ভারি হয়ে আসলো। মাথার মধ্যে ঝিম ধরে আসছে। হ্যাপি, কোয়েল বাস ছাড়ার কথা বলে তাড়া দেয়। প্রত্যাশা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে নিশ্চুপ থাকে। হ্যাপি হাত ধরে টেনে বলল,
-” অ্যাই প্রত্যাশা চল। আর দেরি হলে স্যারেরা ব’ক’বে কিন্তু। ঘোরার জন্য যে টাইম দিয়েছিল তা অভার। ওইযে ওরা দ্যাখ যাচ্ছে। আমাদেরও বাসের কাছে যেতে হবে। জলদি চল। এমন ঝিম ধরে আছিস ক্যান?”
প্রত্যাশা অগোছালো ভাবে বলল,
-” আ-আমি ঘুমাব। ঘুরতে যাব….যাব না।”
কোয়েল বিরক্ত হয়ে ঝারি মা’রল,
-” ফাজলামি করছিস নাকি? সবকিছু দেখার জন্য আসা। আর বলছিস যাবি না। না গেলি তুই। আমরা চললাম।”
প্রত্যাশা কোনো সারা দিল না। হ্যাপি বলল,
-” আরে থাম। ওর কিছু হয়নি তো। এভাবে কথা বলছে কেনো?”
-” জানিসই তো সবসময় ও ফাজলামো করে। এখনো করছে।”
প্রীতি ফুরফুরে মেজাজে আছে। বলল নরম সুরে,
-” আচ্ছা ও যেতে চাচ্ছে না। ও থাক আমাদের সাথে। তোমরা ঘুরে আসো। এমনিতেও ওর পায়ে আঘাত পেয়েছে। ঘুরতে গিয়েও তো হাঁটতে পারবে না।”
কোয়েল সায় দিলো। হ্যাপি রাজি হচ্ছে না। মামা শুনলে বকবে। তারপর একা ফেলে হ্যাপি যাবে না। কোয়েল হ্যাপির হাত ধরে টেনে একপাশ এনে বোঝাল,
-” আরে ওনারা তো প্রত্যাশার আত্মীয়। ওদের কাছে থাকলে সমস্যা কী গা”ধা? প্রত্যাশা ঘুরতে পারবে না কাটা পা নিয়ে। তারচেয়ে ওনাদের সাথে বিশ্রাম নিক। আমরা তো হোটেলে ফিরব। তখন প্রত্যাশাকে ফোন দিলে ওনারাই পৌঁছে দিবে।”
হ্যাপি রাজি নয়। তবুও কোয়েল জোর করে নিজের মতো বলল,
-” আচ্ছা আপু, তাহলে আমরা যখন সন্ধ্যায় ফিরব তখন ফোন দিবো প্রত্যাশাকে। আপনারা পৌঁছে দিবেন ওকে। ও তো কাঁটা পা নিয়ে ঘুরতেও পারবে না। আর ও দুপুরে এলার্জির ওষুধ খেয়েছে। তাই হয়তো ওর ঘুম পাচ্ছে।”
-” নিশ্চয় পৌঁছে দিবো। তোমরা চিন্তা করো না। ঘুরো, ইনজয় করো।”
প্রীতির ব্যবহারে ওরা দু’টো খুব মুগ্ধ হলো। প্রত্যাশাটার কত ভালো কপাল। কত ভালো বর, শ্বশুর শাশুড়িও শুনেছে ভালো। এখন তো জা-কেও সামনে দেখল। কত অমায়িক কথাবার্তায়!
কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই প্রত্যাশা বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে উঠল। অদ্রিকা চমকে উঠল। অদ্রিকা চিন্তিত বদনে জিজ্ঞেস করল,
-” তোমার ব্যথা করছে? কী সমস্যা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
আবার প্রত্যাশা কেমন হেসে ফেলল। ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো বলল,
-” আম্মুর কাছে যাব।”
হাবিজাবি উল্টা পাল্টা বলতে থাকল প্রত্যাশা। অদ্রিকা ভ’য় পেয়ে গেল। তবে প্রীতি নির্লিপ্ত। হঠাৎ গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। প্রত্যাশাকে নিয়ে হোটেলে ফিরতে ওদের দুটোর জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। হোটেলের গেট পেরিয়ে যেতেই প্রত্যাশা নিজের হাত এক ঝাঁকিতে ছাড়িয়ে নিল। আকাশের দিকে মুখ করে দুই হাত উঁচিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ধরার মতো বাড়াল। হাত দু’টো নাড়িয়ে বেসুরো গলায় বলল,
-” টিপটিপ বারছা পানি।”
হাত দু’টো উঁচুতে তোলায় টপস উপরের দিকে উঠে যায়। যার ফলে পেটের কিছু অংশ দেখা যায়। ওদিকে কত মানুষ আসা যাওয়া করছে। অদ্রিকা দ্রুত টেনে নামিয়ে দিল। প্রত্যাশা ঝট করে দুইহাত প্রীতির কাঁধের উপর রাখল। প্রীতি বিরক্তিতে হাত দু’টো ঝারি মে’রে সরাল। প্রীতির গাল দুটো শক্ত করে ধরে টিপে দিয়ে প্রত্যাশা। হাসতে হাসতে বলল,
-” পানি……আগ লাগা।”
প্রীতির যা রাগ হলো না। কী জ্বা”লা। এরমধ্যে সার্থক বৃষ্টি দেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলো প্রীতি আর অদ্রিকার খোঁজে। এখানে এহেন দৃশ্য দেখে বিস্ময় নিয়ে বলল,
-” কী হয়েছে ওর?”
প্রীতি প্রত্যাশার কাছ থেকে ফাঁকে আসল। সার্থকের পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,
-” ও দিনদুপুরে চোখে সর্ষে ফুল দেখছে বোধহয়। দ্যাখ না ব্রো। কেমন করছে। দু’জন মিলে ওকে রুমে আনতে হিমশিম খাচ্ছি।”
অদ্রিকা বলল,
-” যদিও আমি ভূত টূতে বিশ্বাসী নই। তবে ওর হঠাৎ পরিবর্তনে আমার কেমন জানি ভ’য় হচ্ছে।”
প্রত্যাশা স্কার্টটা একটু উঁচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” কতো পানি।”
অথচ নিচে পাকা জায়গা। যেখানে শুধু বৃষ্টির ছোট ছোট ফোঁটা পরে আছে। সার্থক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রত্যাশাকে পরখ করল। বলল সন্দিহান কণ্ঠে,
-” ও কী কোনো ভাবে উল্টাপাল্টা কিছু খেয়েছে। ওর সিমটম দেখে আমার তো তাই মনে হচ্ছে।”
প্রীতি সহসাই বলে উঠল,
-” ব্রো খেতে পারে। ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে আসছে। কত বাজে ছেলেপেলে থাকে না। ওদের থেকে খেয়েছিল বোধহয়।”
পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ ভিজে লাল হয়ে উঠেছে। সার্থক দেখে বলল,
-” পায়ে প্রেশার পরে ব্লিডিং হচ্ছে তো।”
অদ্রিকা কোনো রকমে প্রত্যাশার হাত টেনে ধরে আনল। ওরা পাশাপাশি দু’টো রুম নিয়েছে। এক রুমে সার্থক আরেক রুমে ওরা দু’জন। আরো দু’জন ফ্রেন্ডের আসার কথা থাকলেও পরবর্তীতে সমস্যার জন্য আসার আগ মুহূর্তে ক্যান্সেল করে। প্রত্যাশার পায়ের দিকে তাকিয়ে সার্থক বলল,
-” প্রীতি জলদি দরজা খোল। প্রত্যাশার পা দিয়ে…”
প্রীতি ব্যাগ হাতড়ে বলল,
-” ভাইয়া চাবি পাচ্ছি না তো।”
সার্থক দাঁত কটমট করে তাকাল। পাশ দিয়ে মানুষ যাচ্ছে আর সার্কাস দেখার মতো প্রত্যাশার দিকে তাকাচ্ছে। উল্টাপাল্টা কীসব বলছে, হাসছে। উপায়ান্তর না দেখে সার্থকের রুমেই প্রত্যাশাকে আনল। প্রীতি বলল,
-” ভাইয়া আমার রুমের চাবি তো পাচ্ছি না। সমস্যা হয়ে গেল। ওদের কাছে তো এক্সট্রা চাবি থাকেই। রিসিপশনে গেলাম জানাতে। অদ্রি আপি তুমিও চলো আমার সাথে।”
প্রীতি করিডোর দিয়ে হাঁটছিলো আর ওর ভেতরটা দা’উদাউ করে জ্ব’ল’ছিল। একটা কদম ফেলছিলো আর ভাবছিলো— ত্রিশ বছর আগে মাহবুব সিদ্দিকী যেমন একটা মেয়ের অনুভূতি, ভালোবাসাকে দাম দেয়নি। বরং প্রতারণা করেছে, ঠকিয়েছে। ঠিক ত্রিশ বছর পরেও সিদ্দিকী পরিবারের আরেকজন একটা মেয়ের অনুভূতিকে এক আনাও দাম দেয়নি। ভরা ক্যাম্পাসে প্রত্যাখ্যান করে ফ্রেন্ডদের সাথে হাসিঠাট্টা করেছিলো না। সেদিন মেয়েটির কতটা কষ্ট হয়েছিলো তা কেবল সেইই জানে। খান বংশের মেয়েরা কতটা মা’রা’ত্মক তা আবার জানবে সিদ্দিকী পরিবার। খানরা নিজের নাক কে’টে পরের যাত্রা ভঙ্গ করে।
প্রত্যাশা বেডে পা ঝুলিয়ে বসে। সার্থক ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে আবার ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো। পরপর বসা থেকে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়। রুম থেকে বেরিয়ে যাবে মনঃস্থির করে পা বাড়ায় সার্থক। এমন সময় ওর হাতে টান পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে প্রত্যাশা ওর হাত ধরে আছে। প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে বুঁজে আসা চোখের পাতা টেনে তুলার চেষ্টা করে বলল,
-” এএসপি সাহেব, তুমি খুউউউব ভালো। আমার কত্ত কেয়ার করো।”
সার্থক ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। প্রত্যাশার চুলগুলো হালকা ভিজে আছে। মুখে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে আছে। যা প্রত্যাশাকে আবেদনময়ী করে তুলেছে।
# চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
প্রত্যাশার কথা আচরণ বলে দিচ্ছে ও নিজের মধ্যে নেই। যা বলছে বেহুঁশে। তবুও হঠাৎ মেয়েলি স্পর্শে সার্থকের নিজেকে এলোমেলো লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে মৃদু কাঁপা হাতে নিজের কব্জি হতে প্রত্যাশার হাতটা ছাড়িয়ে নিতে থাকে। শুষ্ক খরখরে গলাটা ঢোক গিলে ভিজিয়ে কোনো রকমে শুধালো,
-” আর ইউ ওকে?”
প্রত্যাশা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে সশব্দে হেসে বলল,
-” ওকে-খোকে নয় টোকা-টুকি। ওই দ্যাখো দ্যাখো দেয়ালে টিকটিকি নাচছে!”
কথার কোনো মাথা-মুন্ডু নেই। সার্থকের ভুরু কুঁচকে যায়। বেহুঁশ মেয়েটাকে নিয়ে ফ্যাসাদে পড়ল বেচারা। তন্মধ্যে প্রত্যাশা এলোমেলো পা ফেলে সামনে এগোতে নিয়েই আরো বিপত্তি ঘটে। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যেতে নেয়। সার্থক ঝটপট দু’হাত বাড়িয়ে প্রত্যাশাকে আঁকড়ে ধরল। প্রত্যাশা এলিয়ে পড়ে সার্থকের বুকের উপর। বাচ্চাদের মতন খিলখিলিয়ে হেসে বলল,
-” এএসপি সাহেব, তোমার গায়ে তো ঝড়ের মতো সেফটি-নেট। ঠিক আমাকে ধরে ফেললে।”
সার্থক হকচকায়। ওর হৃদস্পন্দন লাগামহীন ছুটছে। কোনো রকমে নিজেকে সামলিয়ে ধীরেধীরে প্রত্যাশাকে ঠিকঠাক করে বিছানায় বসিয়ে দেয়। যেই সরে দাঁড়াবে আর অমনি হালকা টান খেলো টিশার্টে। প্রত্যাশার গলার সোনালী চেইনটা টিশার্টের উপরের বোতামে আটকে গেছে। প্রত্যাশা বাচ্চাদের মতো নাকমুখ কুঁচকে একহাতে চেইন ধরে টান দিতেই সার্থকের মাথাটা প্রত্যাশার দিকে আরেকটু ঝুঁকে এলো। সার্থক তৎক্ষণাৎ জড়ানো স্বরে বলে উঠল,
-” স্টে…স্টে স্টিল, আমি ছাড়াচ্ছি।”
সার্থক আঙুল গলিয়ে চেইনটা ছাড়াতে থাকে। ছাড়াতে গিয়ে রীতিমতো আঙুল কাঁপছে। বুঝল বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা চাইছে টা কি? নিজে তো হুঁশে নেই। আরেকজনের হুঁশেরও দফারফা করতে চাইছে। মেয়েটাকে ভালো লাগে। একটু-আকটু নয়। খুউববব বেশিই ভালো লাগে। দেখতে ভালো লাগে, তাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনাও বেহায়া, নির্লজ্জ মনে জাগে। চাইলেই আজ মেয়েটাকে কাছে টেনে নেওয়া যাবে। যেখানে জোরজবরদস্তি থাকবে না। সার্থকের এক সত্তা উস্কানিমূলক চিন্তা নিউরনে জাগাচ্ছে। বেসামাল করতে চাইছে। তবে বিবেক এসে দেয়াল তুলে দিল। একেতেই মেয়েটির উপর কোনো অধিকার নেই। তারওপর মেয়েটি অন্যকারো স্ত্রী। নিজের মনকে প্রসন্ন করতে, নিজের জীবনের প্রথম ভালোলাগা, ভালোবাসাকে পেতে বিবেক বিসর্জন দিলে, নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী কুকুরের থেকেও অধম হতে হবে। মনের আবেগে, রিপুর তাড়নে গা না ভাসিয়ে সার্থক বিবেক, মনুষ্যত্বের আহবানে সাড়া দিল। চেইনটা ছাড়ানো মাত্র সে এক ধাপ পিছিয়ে দাঁড়াল। ঝড়ো শ্বাস সামলাল। পিছুনে আর ফিরে না তাকিয়ে লম্বা পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
ঘরের এই ক্ষুদ্র ক্ষণগুলো কি কেবল কংক্রিটের চার দেয়ালের ভেতরেই আটকা পড়ে থাকবে? নাকি কোনো যন্ত্র ইতিমধ্যেই নিঃশব্দে গিলে নিয়েছে প্রতিটি মূহুর্ত?
______________
স্টুডেন্টরা বাসে উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সেই মূহূর্তে সে-কি বৃষ্টি। বৃষ্টির দরুণ***যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করা হয়। সবাই হোটেলে ফিরে আসে। বৃষ্টি থামলে সন্ধ্যার আগেই রওনা হবে, এবারে ফেরার যাত্রা। হাবিবুর রহমান হঠাৎ হ্যাপিকে একলা দেখে দায়িত্ববোধ থেকে প্রত্যাশার কথা জিজ্ঞেস করেন। হ্যাপি বলতেই ভাগ্নির উপর কিছুটা চড়াও হলেন। একা একা কোন আক্কেলে ছেড়ে এলো। দ্রুত ফোন দিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। কোন হোটেলে আছে। এ-ও বলেন স্বয়ং নিজে গিয়ে প্রত্যাশাকে আনবে।
ফোন দিলেও রিসিভ হচ্ছে না। এতক্ষণে সবার মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেল। প্রত্যাশাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিলকে তাল বানানোর মতো অবস্থাও হলো। কেউকেউ আজগুবি কথাবার্তা বলা শুরু করে দিল আড়ালে-আবডালে। দ্যাখো কোনো ছেলে-টেলের সাথে হাওয়া হলো না তো। আরো কত কি ফিসফিসানি চলতে থাকল।
বৃষ্টির বেগ কমলেও সকলের চিন্তা, উদ্বেগ বেড়েছে কয়েকগুণ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই রওনা দিবে। অথচ প্রত্যাশার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। হাবিবুর রহমানসহ আরেকজন টিচার হোটেলে খুঁজতে গেল।
কোয়েলের মুখ ভার। মাথা নুইয়ে অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে। হ্যাপির চোখের কোণ ভেজা। নাহিদ ফট করে হ্যাপির মাথায় চাটি মে”রে রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
-” দেবো ক ঘা চটকানি। হারামি কোথাকার! অ্যাই অ্যাই ছেমড়ি তোরা কোন আক্কেলে ওকে একলা ছেড়ে আসলি। আনার সময় তো উস্কিয়ে উস্কিয়ে বাড়িতে গিয়ে অবধি হ্যানোত্যানো বলে আন্টিকে কনভিন্স করালি। আর…”
হ্যাপি ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে উঠল। কোয়েল মিনমিনে স্বরে সহসাই বলে উঠল,
-” আ-আসলে ওতো সবসময় ফাজলামো করে। আমি ভেবেছিলাম ও ঘুরতে যাবে না জন্যই ঘুমের কথা মিথ্যে বলছে। দেখলি না আসতে পথে গাড়িতে কেমন বমির অ্যাক্টিং করল। তাই ভাবলাম ও বরং ওর আত্মীয়দের সাথেই সেফ-এ থাক। আমরা ঘুরে আসি। এখন যে ব্যাপারটা এমন হবে ভাবতে পারিনি। বিশ্বাস কর ওর খারাপ কিছু হোক সেটা কক্ষনো চাই না।”
রোহান তেতে উঠল। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-” ওকে ছেড়ে আসলি, কোন হোটেলে ওনারা উঠেছে ঠিকঠাক নামটাও বলতে পারছিস না। ওনাদের নামধামও জানিস না। এদিকে আরেকটু পরই সন্ধ্যা নামবে। অথচ এখনো প্রত্যাশার খবর নেই, ফোন ধরছে না। আন্টি আংকেল তো তোদের দু’টোকে পইপই করে বলেছিল ওকে সাথে সাথে রাখতে। তোরা কী করলি? ঘুরতে যাওয়াই তোদের কাছে আগে?”
-” বালের ঘুরতে যাওয়ার গুষ্টি উদ্ধার করি। শালার বন্ধুর থেকে ঘুরতে যাওয়া, সব দেখাই নাকি আগে। লজ্জা করছে না তোদের দুটোর? কেমন বন্ধু? বন্ধুর পায়ে ব্যথা ও হাঁটতে পারবে না, সাথে থাকলে নিজে দেখতে পারব না। এইজন্য অন্যর ঘাড়ে গুঁজে দিয়ে একলা ফেলে আসিস। মিরজাফর সব কোথাকার।
আরে তোরা একবার বলতিস আমি আর রোহান না হয় ওর সাথে থেকে যেতাম। তোরা দু’টো ম’রার ঘোরা ঘুরতি।”
হ্যাপি ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। একহাতে মুখ চেপে বলল,
-” আমি কোয়েলকে বলেছিলাম। ও শোনেনি আমার কথা। নিজের মতো বলে আমাকেও এক প্রকার জোর করে এনেছে।”
নাহিদ একহাত কোমড়ে রেখে অন্যহাতে কপাল ঘঁষে বলল,
-” উফ্! ওইটার আবার মাথার তার ছিঁড়া আছে। তারপর ফোন রিসিভ করছে না। তাই বেশি চিন্তা হচ্ছে।”
কোয়েল কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আফসোস আর অপরাধ বোধ মিশিয়ে বলল,
-” স্যরি! আমি একদম বুঝতে পারিনি। ওনারা ওর আত্মীয় তাই আমি অতো কিছু ভাবিনি। ভেবেছিলাম হোটেলে থাকা বা বাসে জার্নি করার চেয়ে ওনাদের কাছে নিরাপদে থাকবে। কিন্তু এখন প্রশ্ন প্রত্যাশা ফোন রিসিভ করছে না কেন?”
হ্যাপি নাক টেনে ভেজা গলায় বলল,
-” ওর কোনো বিপদ হয়নি তো? ও ঠিক আছে? ওনাদের সাথেই আছে তো?”
-” এখানে দাঁড়িয়ে সময় ন’ষ্ট না করে রোহান চল খুঁজে দেখি।”
নাহিদ আর রোহান দু’জনেই বেরিয়ে গেল।
____________
অফিশিয়াল কাজ শেষ করে বিকেলে নীরব ইচ্ছেকে দেখতে আসে। আচমকা আজ মনটা কেমন জানি বিক্ষিপ্ত লাগছে। ভালো লাগছে না। ভাবে ইচ্ছের সাথে দেখা করে তারপর একবার হসটপিটালেও যাবে। খান বাড়িতে এসে দেখে এত বড় বাড়ি ফাঁকা। কেমন ভূতুড়ে ভূতুড়ে। বুয়া দরজা খুলে দিতেই নীরব জিজ্ঞেস করল,
-” ইচ্ছে? ইচ্ছে কোথায়? ওকে ডেকে দিন।”
-” ইচ্ছে উপরে ঘুমায়।”
হাত ঘড়িতে সময় দেখে নীরব বলল,
-” ছ’টা বাজতে চললো এখনো ঘুমিয়ে আছে।”
-” হয় স্যার।”
এই বাড়িতে একমাত্র ইচ্ছের জন্যই আসা হয়। অন্যরা কে কোথায় এসব জানবার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। নীরব স্থির করে চলে যাবে। আবার কী মনে করে ভাবল–একপল দেখে যাই। গাম্ভীর্য বজায় রেখে শুধাল,
-” ইচ্ছে কোন রুমে থাকে?”
-” দুই তলায় উইঠা ডানে গিয়া মাঝখানে যে রুম আছে ওইডা।”
নীরব ত্রস্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠল। দরজার ফাঁক গলে দেখা গেল; ইচ্ছে জানালার গ্রিল দুহাতে ধরে কপাল ছুঁইছুঁই করে দাঁড়িয়ে। অদূর আকাশপানে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে নিজে নিজেই বলছে,
-” পাপা, তুমি জানো? কাল আমি ছাদ থেকে রংধনু দেখেছি। খুব মজা হয়েছে। তুমি থাকলে দেখতে। খুব মজা হতো….হি হি।”
তারপর হালকা মাথা দুলিয়ে অস্পষ্টে ফিসফিস করলো,
-” পাপা তুমি তো আছই। তাই না?”
পরমূহুর্তেই মুখ ভার হয়ে এলো,
-” তুমি নেই? মাম্মাটাও নেই। জানো পাপা মাম্মা আমায় উল্প আদর করে। এইটুকুন।”
শব্দগুলো বি’ষে’র মতো কানে বিঁধল নীরবের। ছোট্ট মেয়েটা একা একা কল্পনা করে আপনমনে কথা বলছে। এভাবে চললে মানসিক ট্রমা, বিচ্ছিন্নতার ভয় ইচ্ছের মনে জেঁকে ধরবে। নীরবের বুকটা ভারী হয়ে আসল। গলাটা নরম করে সস্নেহ ভরা কণ্ঠে ডাকল,
-” ইচ্ছে মামণি?”
ইচ্ছে আঁচড়ানো পাখির মতো ঘুরে তাকাল। চোখ দুটো চকচক করছে। মুখে অনাবিল হাসি ফুটে উঠল,
-” পাপা!”
দৌড়ে এসে নীরবের কোমর জড়িয়ে ধরল। নীরব এক ঝটকায় কোলে তুলে আদুরে গলায় বলল,
-” মামণি, একা একা কার সঙ্গে কথা বলছিলে?”
ইচ্ছে নিষ্পাপ স্বরে বলল,
-” আমি তো তোমার সাথেই কথা বলি পাপা। উমম! মাম্মা নেই। তাই কাল মাম্মার সাথেও বলিছি।”
ইচ্ছের গালে চুমু খেয়ে নীরব বলল,
-” তুমি একা মনা আন্টি কোথায়? বিকেলে ঘুরতে যাওনি?”
ইচ্ছে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” উহু! মনা নেয় না। জানো পাপা, আমি খেলতে বললেও মনা আমার সাথে খেলে না। বলে পরে। মাম্মা থাকলে খেলে। মাম্মা নেই, মনা ফোন টেপে।”
আকস্মিক নীরবের ক’দিন আগে নিউজফিডের একটা নিউজের কথা মনে পড়ল। বাবা-মা দু’জনেই চাকরি করে, ছোট্ট মেয়েটাকে বুয়ার কাছে রেখে যায়। মেয়ে বারবার বলত–‘আম্মু তুমি থাকো না, আমার ভ’য় করে।’ মা হেসে বলত–‘বুয়া তো আছে! ওর সাথে খেলবে, সময় কাটাবে।’ কিন্তু সেই বুয়া সারাদিন সিরিয়ালে ডুবে থাকত। মেয়েটা একাএকা খেলা করত, নিজেনিজে কথা বলত, হাসত। ধীরে ধীরে বাস্তব-অবাস্তব গুলিয়ে ফেলত। শেষমেশ বাচ্চাটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে যায়।
ড্রয়িংরুমের সোফায় নীরবের গা ঘেঁষে ইচ্ছে বসে টেডি নিয়ে খেলছে। মনা মাথা নুইয়ে ওড়নার আঁচল দুই হাতে মুঠো করে ধরে ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে। নীরব ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।
-” তোমাকে ইচ্ছের দেখভালের জন্যই রাখা হয়েছে। বাচ্চাটাকে সময় না দিয়ে তুমি সিরিয়াল দেখলে, ঘুমালে, তাহলে মাস শেষে যে বেতন পাও সেটা কি হালাল হয়? ইচ্ছেকে দেখাশোনা করা তোমার দায়িত্ব। ওকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়াও দায়িত্বের মধ্যে পরে। দায়িত্বটাকে দায়িত্বের মতো নাও।”
মনা নিজের সাফাই দিতে মিহি স্বরে বলল,
-” স্যার, ম্যাডাম দুইদিন নেই চব্বিশ ঘন্টা আমিই দেইখা রাখতাছি। এমনিতেও আমিই সবসময় খাওয়াই, গোসল করাই, সবটাই আমিই করি..”
-” তোমাকে ইচ্ছে্র দেখভালসহ ওকে সময় দেওয়ার জন্যই রাখা হয়েছে। এমনি এমনি তোমাকে রাখা হয়নি। তোমার কাজই এটা। এখানে আমিই করি এরকম বলার তো কিছু নেই।”
মনার মুখটা ভোঁতা হলো। আর একটাও দ্বিরুক্তি করল না। কৌতুহলবশত নীরব জিজ্ঞেস করল,
-” প্রীতি কোথায় গিয়েছে?”
-” ম্যাডাম, সার্থক স্যার আর ওনাদের বন্ধুরা কুয়াকাটা ঘুরতে গিয়াছে।”
নীরবের মাথায় কুয়াকাটা শব্দটা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ঝিনঝিন শব্দ তুলে বাজতে লাগলো। কপালে প্রগাঢ় ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,
-” কবে গিয়েছে ওরা?”
-“____”
নীরব জোরালো নিঃশ্বাস ফেলল। প্রত্যাশার সাথে তো দুপুরের আগেই কথা হয়েছে। এক জায়গা হলেই যে দেখা হবেই এমন নয়। আর প্রত্যাশারা একটা দিনের জন্যই গিয়েছে। এইতো সন্ধ্যায় ওরা ব্যাক করবে।
লাঞ্চ আওয়ারের পরে প্রত্যাশার দু’টো মিসড কল উঠেছিল। একটা মিটিংয়ে এটেন্ড করায় ফোনটা সাইলেন্ট ছিলো বিধায় দেখেনি নীরব। কাজ শেষে কল ব্যাক করে প্রত্যাশার সাড়া না পেয়ে নীরব ভাবে; ঘুরাঘুরি করছে হয়তো তাই খেয়াল করেনি। নীরবের এখন হঠাৎ টেনশন শুরু হলো। ফোন বের করে প্রত্যাশার নম্বরে লাগাতার কল করে চলল।
গোধূলির আকাশ মেঘে ঢাকা। দুশ্চিন্তার মেঘ নীরবের মনাকাশেও জমা হচ্ছে। প্রত্যাশাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। নীরব দুই আঙুলে কপাল চেপে আরেক হাতে ফোনটা কানে ধরে বিড়বিড় করল,
-” প্রত্যাশা পিক-আপ দ্যা ফোন। প্লিজ প্রত্যাশা….”
____________
সার্থক লেবুর শরবত জোগাড় করে অদ্রিকার হাতে দিয়ে বলল,
-” অদ্রি এটা প্রত্যাশাকে খাইয়ে দে। জোর করে হলেও খাইয়ে দিবি।”
অদ্রিকা দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ঢোক গিলে বলল,
-” আমি খাইয়ে দিবো?”
-” হুম। তোকেই তো বললাম। কেনো, কোনো সমস্যা?”
-” না মানে। ওর কথাবার্তা আর আচরণ দেখে কেনো জানি আমার খুব ভ’য় লাগছিল। আমার দিদুনের বলা ভূতুড়ে গল্প আমি আজ অবধি বিশ্বাস করিনি। তবে সেই মূহূর্তে একটা সুস্থ মেয়ের হঠাৎ চেঞ্জ দেখে আমার ছোটবেলায় শোনা ভূতুড়ে গল্পই মনে উঠেছিলো। দিদুন বলতো, মেয়েছেলেদের খোলা চুলে এখানে সেখানে নদীর ঘাটে ঘুরতে নেই। তালগাছ,নারিকেল গাছ, বড়বড় গাছে তেনারা থাকেন। তেনারা ঘাড়ে চাপেন। আর তেনারা ঘাড়ে চাপলে সেই মেয়েরা কেমন কেমন পা’গলের মতো আচরণ ক___”
অদ্রিকার কথা থামিয়ে সার্থক বিরক্ত গলায় বলল,
-” স্টপ অদ্রি। স্টুপিডের মতো কথাবার্তা বন্ধ কর। কী তেনারা তেনারা শুরু করেছিস? তুই একটা হাইলি এডুকেটেড মেয়ে হয়ে এসব কী বলছিস অদ্রি? গ্রামের বুড়ি মেয়েদের মতো কোনো মাথামুন্ডু নেই এমন লজিকলেস কথা! তেনারা ঘাড়ে চাপলেই মানুষ পা’গল হয়ে যায়। আর সেই তেনারা কারা? গোঁড়া চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। টাইম ওয়েস্ট না করে জলদি প্রত্যাশাকে শরবত খাইয়ে দে।”
অদ্রিকা মাথা কাত করে বলল,
-” ওকে।”
পরপর প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” প্রীতি চলো আমার সাথে।”
প্রীতি সাথে সাথেই বলল,
-” হ্যাঁ চলো।”
প্রীতিকে থামিয়ে দিতে সার্থক বলল,
-” প্রীতিকে একটু দরকার আছে আমার। অদ্রি তুই প্রত্যাশার কাছে ফাস্ট যা। ও রুমে একা আছে। আমি বাইরে থেকে লক করে এসেছি। না জানি রুমে একা কী করছে?”
অদ্রিকা বিস্মিত হয়ে বলল,
-” হোয়াট? প্রীতিকে দরকার? আমি একলা প্রত্যাশাকে সামলাব?”
সার্থক ভেবে বলল,
-” ইচ্ছে কান্নাকাটি করছে। প্রীতির সাথে কথা বলবে।”
-” ওহ্।”
সার্থক লক খুলে অদ্রিকাকে ইশারা করে রুমে ঢুকতে। সার্থক বলল,
-” সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিস।”
-” তুইও সাথে আয়।”
-” আমার একটু কাজ আছে।”
.
প্রীতি রুমে ঢোকার সাথে সাথে সার্থক দরজার নব ঘুরিয়ে লক করে দিল। প্রীতি রুমের মাঝে দুই হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে। প্রীতি কিছুটা আঁচ করেছে। এখন ওর ভাই একের পর এক জেরা করবে নিশ্চয়। সার্থক চোখমুখ কঠোর করে এগোল। প্রীতি ঠোঁটে হাসি টেনে ঠোঁট মেলবে, কিছু বলবে, ঠিক সেই মুহূর্তে ঠাস করে শব্দ হলো। প্রীতির একহাত গালে চলে গেল। বিস্ময়ে প্রীতির চক্ষু কোটর ছাড়ার জোগাড়। প্রীতি হকচকিত হয়ে বলল,
-” ভাই..য়…”
কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। মাথাটা সোজা করার আগেই আরেকটা থা’প্প’ড় পড়ল। সার্থক চোয়াল শক্ত করে বলল,
-” প্রীতি আমি জানি তুই ইচ্ছে করে এমন কিছু করেছিস। কারন প্রত্যাশার পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবধি ও ঠিকই ছিলো। অদ্রির ভাস্যমতে প্রত্যাশা বাকিটা সময় তোদের সাথেই ছিলো। অদ্রিকে আমি ভালো করে চিনি। আর তোকেও চিনি। তাই আমার বুঝতে এতটুকু বাকি নেই। বল কেনো প্রত্যাশার সাথে তুই এমন করছিস? কিসের শত্রুতা তোর ওর সাথে?”
প্রীতি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
-” ভাইয়া তুমি ভালো করেই জানো আমাদের শত্রুতা কার সাথে। আর এই মেয়েটা ওই পরিবারেরই একজন। সিদ্দিকী পরিবার তাদের বাড়ির বউকে খুব সম্মান দেয়, না? সবার সামনে তাদের বাড়ির বউকে ছোট করা মানে গোটা সিদ্দিকী পরিবারকে অপদস্থ করা।”
আসল আর প্রধান রাগ-ক্ষোভটা কৌশলে প্রীতি গোপন রাখল। সমস্ত রাগ-ক্ষোভ, রিভেঞ্জ পুরোনো শত্রুতার থেকে বলে চাপিয়ে দিল। সার্থক তপ্ত শ্বাস ফেলে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
-” প্রীতি পুরোনো শত্রুতার জের ধরে একটা নিরপরাধ, নিষ্পাপ, সহজ-সরল ভালো মনের মেয়ের ক্ষ’তি করা অন্যায়, পাপ। আর তুই দিন দিন চরম অ্যাগ্রেসিভ হয়ে যাচ্ছিস। যা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। প্রীতি এখনো সময় আছে, আমি বলছি থেমে যা।”
-“নো নেভার। ওরা আমার খালামণিকে আ’গু’নে পুড়িয়ে মে’রে’ছে। আমার মা নিভৃতে আজও কাঁদে। খালামণি যা পারেনি, আমাকে তা পারতেই হবে।”
-” উফ্! সেই সময় একচুয়েলি কী হয়েছিলো আমরা কিন্তু জানি না। আসলে কীভাবে কী ঘটেছিল তা আমাদের অজানা। এক পক্ষের মন্তব্য শুনে জাজ করা যায় না প্রীতি।”
-” খুব যে ন্যায়বান সাজচ্ছো। কিছুদিন আগেই তো ফোনে ওই মেয়েটাকে পেতে আমার হেল্প চাইলে। তারপর কী এমন হলো পাল্টি খেলে?”
-” প্রীতি সেটা আমার চরম বো’কামি ছিলো। একসময় নীরবের সাথে জিদ করে প্রত্যাশাকে নিজের করার কথা ভাবলেও, পরবর্তীতে বুঝতে পারি এটা অসম্ভব, আর নিম্নমানের চিন্তা। তাই আমি তোকে নিষেধও করেছি। আর তুই কী করছিস? বিবেক, মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে একটা পরিবারকে হেনস্তা, অপদস্থ করবি বলেই নীরিহ মেয়েটার ক্ষ’তি করতে চাইছিস।”
সার্থকের কণ্ঠে ঘৃণা ঝরল,
-” প্রীতি তুই নিকৃষ্ট মনের পরিচয় দিয়ে চলছিস। একবার নয় দুদুবার যা করলি, এতে তোকে আমার নিজের বোন বলতেও লজ্জা লাগছে।”
প্রীতি চেঁচিয়ে উঠল,
-” একটা সাধারণ মেয়ের জন্য তুমি আমার সাথে সম্পর্ক খারাপ করেছো। আজকে তো লিমিট ক্রস করে ফেললে। এই প্রথম, তাও একটা অতি সাধারণ মেয়ে, আমাদের শত্রুর বাড়ির বউয়ের জন্য আমার গায়ে হাত অবধি তুললে।”
প্রীতি বিড়বিড়িয়ে বলল— ওই মেয়ে আমার ব্রোকে চেঞ্জ করে ফেলছে। সিদ্দিকী পরিবারের উপর থাকা ঘৃ’ণাও আজ ভাইয়ার চোখে নেই। সেখানে আমার ভাইয়া আমাকেই ঘৃ’ণা করছে। এর প্রতিটি উত্তম জবাব কীভাবে ফেরত দিবো তা আমার জানা। প্রিয় মানুষের চোখে ঘৃ’ণা কীভাবে তৈরি করতে হয়, সেটাও আমার ভালোই জানা আছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
.
.
ফিঙ্গার লক এর মাধ্যমে ফোন আনলক করে অদ্রিকাকে দিয়ে ওদের ফ্রেন্ডসহ স্যারের সাথে কথা বলিয়ে দেয় সার্থক। বলে বাস রওনা হওয়ার সময় ঠিক পৌঁছে দিবে প্রত্যাশাকে, ওর পায়ে ব্যথা তাই রেস্ট করছে। নীরবের নম্বর থেকে একাধিকবার কল দেখে সেখানেও হটস অ্যাপে অদ্রিকা মেসেজ টাইপ করে। ফোন সাইলেন্ট ছিলো তাই কল খেয়াল করেনি বলে। এ-ও বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সব রওনা দিবে।
ওদিকে ছোট্ট মেসেজ দেখে চিন্তার পাহাড় মাথা থেকে সরতে থাকে নীরবের। প্রত্যাশা যে বাচাল মেয়ে দেখা হলে নিজ থেকেই ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতো। তাই নীরব আর ওদের কথা তুললো না। শুধু ছোট্ট করে একটা শান্ত কোমল মেসেজ পাঠাল।
-” Okay, understood. Wishing you a safe return. Fi Amanillah.”
প্রত্যাশা দু’বার বমি করে। লেবুপানি খেয়ে, চোখমুখে বারবার পানির ছিটা দিয়ে কিছুটা হুঁশে আসতেই ফিরবে বলে গোঁ ধরে। এখানে আসার পরের কথাগুলো ওর কিছুই মনে পড়ছে না। অদ্রিকা কিছু বলতে গেলেও সার্থক আঁটকে দিয়ে পায়ে ব্যথা হচ্ছিল তাই ওদের সাথে এনেছিল বলে পাশ কাটিয়ে দেয়।
সন্ধ্যার পর সার্থক নিজে ড্রাইভ করে প্রত্যাশাকে ওদের বাসে তুলে দিয়ে আসে।
__________
দু-তিন দিন পর। পড়ন্ত বিকেল। নীরবের এক বন্ধুর বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে দাওয়াত পড়েছে। বিবাহিত বন্ধুরা সবাই সঙ্গিনীসহ নিমন্ত্রিত। সকালেই নীরব ফোন করে প্রত্যাশাকে বলেছিলো যেন রেডি থাকে।
বাড়িতে ঢুকে অধরার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে সে সোজা প্রত্যাশার রুমের দিকে এগোয়। অধরা নাস্তার আয়োজন করতে ব্যস্ত।
ভেজানো দরজাটা একহাতে সরিয়ে দিতে না দিতেই নীরবের চোখ বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে যায়। প্রত্যাশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আঙুলের খাঁজে শাড়ির কুচি গুছিয়ে কোমরে গুঁজে নিচ্ছে। পরপর আঁচল বুকের ওপর টেনে আনতে গিয়েই মাথা হালকা ঘুরাতেই চোখে চোখ পড়ে নীরবের সঙ্গে। প্রত্যাশা চমকে একটু চেঁচিয়ে উঠল,
-” ইয়া আল্লাহ! আপনি কখন এলেন? আর ওখানে দাঁড়িয়ে ওভাবে তাকিয়ে আছেন যে! কী দেখছিলেন বলুন তো?”
নীরব ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি টেনে এগোল। দুই আঙুলে কপাল চুলকিয়ে দুষ্টুমির স্বরে বলল,
-” এই জন্যই তো সকালেই বলে রেখেছিলাম—রেডি হয়ে থাকতে। কিন্তু তুমি যে এমন দৃশ্য বানাবে, সেটা তো বলোনি। এখন বলো, এই অবস্থায় কোথায় যাই? বরং এখানেই খু*ন হয়ে যাই তোমার সৌন্দর্যে!”
প্রত্যাশা লজ্জায় চোখ বড়বড় করে বলে,
-” উফ্! কী সব আজেবাজে বলেন আপনি?”
নীরব দু’পা এগিয়ে খুব কাছাকাছি দাঁড়াল। ফিসফিসিয়ে বলল,
-” আজেবাজে না, একদম সত্যি।”
প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে রাগ দেখানোর ভান করে বলল,
-” একদম নাটক করবেন না। এখন বলুন, ঠিক কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন?”
নীরব ঠোঁটে জোরালো হাসি টেনে মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
-” তোমার চোখ আমার চোখে পড়ার আগ পর্যন্ত আমি সময়ের হিসেব ভুলে গিয়েছিলাম। এমনকি নিজেকে চিনতেও ভুলে যাচ্ছিলাম। তোমার রূপে, তোমার উপস্থিতিতে যেন এক মুহূর্তে সব কিছু থেমে গিয়েছিল।”
প্রত্যাশা চোখ নিচু করে লাজুক হাসি চাপতে চেষ্টা করল। কিন্তু দু’গালের লালচে আভা ওর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিল। নীরব দু’হাতে পেছন থেকে প্রত্যাশার কোমর জড়িয়ে ঘাড়ে থুতনি রেখে দুষ্টু স্বরে ফের বলল,
-” জানো, যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে স্বর্গসুখানুভূতি কেমন? আমি বলবো; এই তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কুচি গুঁজে নেওয়া একটা মেয়ের মতো।”
প্রত্যাশা কাঁধের আঁচল ঠিক করতে করতে বলল,
-” আপনাকে যতটা শান্ত, ভদ্র দেখায় আর আমিও আগে আপনাকে যেরকম ভেবেছিলাম, মোটেই আপনি তেমন নয়।”
প্রত্যাশার উন্মুক্ত গলায় নাক ঘষে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল নীরব,
-” তাহলে কেমন আমি? বলো, শুনি?”
প্রত্যাশার সারা শরীরে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হওয়ার মতো অনুভূতি হলো। পায়ের তালু অবধি শিরশিরানি দিয়ে উঠল। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলান। প্রসঙ্গ পাল্টাতে কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল,
-” চুপ! বেশি কথা বলবেন না। দূরে সরুন। আমি পুরো রেডি হইনি এখনো।”
প্রত্যাশা একহাতে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চুড়ি হাতে তুলে নিতেই আচমকা নীরব ওর হাত থেকে চুড়ি নিল। একটা একটা করে পড়িয়ে দিতে লাগল। আলতো ছোঁয়ায়, যত্ন সহকারে। সময়টা থমকে গেল।আয়নায় দু’জনের চোখাচোখি হতেই প্রত্যাশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দৃষ্টি নুইয়ে ফেলে।
.
নীরব সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রল করছে। সোফার এককোণে থাকা প্রত্যাশার ফোনটা ভোঁভোঁ শব্দ করে কাঁপছে। নীরব বলল,
-” তোমার ফোন এসেছে।”
প্রত্যাশা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলল,
-” সিম কোম্পানি হবে হয়তো। তাছাড়া এইসময়ে কল দেওয়ার কেউ নেই। আমার ফ্রেন্ডরা মেসেঞ্জারে মেসেজ আর হটস অ্যাপে কল দিয়ে থাকে। আপনি তো এখানেই। দেখুন আর আমার কথা মিলিয়ে নিন।”
শেষোক্ত কথাটা বলে চিরুনি হাতে দাঁত কেলিয়ে হাসে প্রত্যাশা। নীরব ফোনটা হাতে তুলতেই স্ক্রিনে ইংরেজি ফন্টে ডক্টর প্রিতম হাসান নামটা জ্বলজ্বল করতে থাকে। নীরবের শিথিল ভ্রু জোড়ায় কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। ফোনের স্ক্রিনে নীরবের ওভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে প্রত্যাশা এগিয়ে এসে বলল,
-” কী হলো, কে ফোন দিয়েছে?”
নীরব নিরুত্তর, মুখাবয়ব স্বাভাবিক থেকে কিছুটা কঠিন হলো। মুখে কিছুই না বলে ফোনটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে দিল। ফোনের দিকে তাকিয়ে প্রত্যাশা কিছু মনে পড়ার মতো করে বলে উঠল,
-” ওহহো, উনি ব্যাক করেছে। এ হে আপনাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। আপনি যে ব্যস্ত মানুষ, সারাদিন চোর-ডাকাতের ফাইল ঘেঁটে সময়পার করেন। রাতে আমার ভীষণ ঘুম পায় তখন আপনি কল করেন। বলার কথা খেয়ালই হয়নি। ওখানে আমার প্রীতি আপুদের সাথে দেখা হয়েছিল।”
একটু থেমে ফোনটা হাতে নিয়ে প্রত্যাশা সরল হেসে বলল,
-” যাই বলুন না কেনো আপনার বেয়াই কিন্তু কাইন্ড হার্টেট মানুষ। আমাকে অনেক হেল্প করেছিলেন। ওনাকে থ্যাংকস জানানো হয়নি। ছোট্ট একটা থ্যাংকস দিতে দুপুরে কল দিয়েছিলাম। তখন মেবি ব্যস্ত-ট্যস্ত ছিলো রিসিভ করেনি। এখন ব্যাক করেছে দেখছি। এক মিনিট আমি কথা বলে নিই।”
সামনের ব্যক্তির মুখাবয়ব লক্ষ্য না করেই এক নাগাড়ে ঘনঘন কথা বলে থামল প্রত্যাশা।
#চলবে