#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ফোনটা আবার কেঁপে উঠতেই প্রত্যাশা ত্রস্ত রিসিভ করল। নীরব নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে সামনের ছোট্ট টেবিলের উপর থেকে ম্যাগাজিনের বইটা হাতে তুলল। প্রত্যাশা ফোনটা কানে নিয়ে হালকা গলায় বলল,
-” আসসালামু আলাইকুম।”
ওপাশ থেকে সার্থকের শান্ত,গম্ভীর গলা ভেসে এল,
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
একরাশ কৃতজ্ঞতা মেশানো সুরে বলল প্রত্যাশা,
-” সেদিন আপনি কতটা হেল্প করলেন, একটা ধন্যবাদও দেওয়া হয়নি। তাই দুপুরে ভাবলাম একটা ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু…”
কথার মাঝখানেই সার্থক থামিয়ে দিয়ে বলল,
-” ইট’স ওকে।”
পরপর একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে নরম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
-” তোমার পায়ের অবস্থা কেমন? ব্যথা আছে কি? কোনো প্রবলেম নেই তো?”
প্রত্যাশা হালকা মাথা নাড়ল। ঝটপট বলল,
-” না না, ব্যথা একদম নেই। এখন ভালো আছি।”
-” গুড।”
-” ওষুধ প্রেসক্রাইবের চার্জটা কিন্তু পান আপনি। আত্মীয় বলে আবার সৌজন্য করবেন না কিন্তু।”
প্রত্যাশার বোকাসোকা, সরল কথাটি শুনে সার্থক হেসে ফেলল। বলল,
-” এতটা ব্যবসায়ী হতে পারব না। আত্মীয়দের সঙ্গে হিসেবনিকেশ চলে না। আর আত্মীয়-স্বজনেরও তো অধিকার আছে। ওটা তোমার অধিকার ছিলো। সো এখানে চার্জের প্রশ্নই আসছে না।”
কথা বলতে বলতে আকস্মিক চোখের তারায় দীঘির জলের মতো ভাসাভাসা দু’টো চোখ, মায়াবী একখানা মুখ ভেসে উঠল। বেহায়া মন না জানি উস্কে দেয়, এই ভ’য়ে তটস্থ হলো সার্থক। আর হলো বলেই হঠাৎ কথার রেশ ছিঁড়ে প্রসঙ্গ বদলিয়ে বলে উঠল,
-” আচ্ছা, প্রত্যাশা আমি একটু বিজি আছি। এখন রাখছি। ভালো থেকো, বাই।”
ওদিকে নীরবের মুখ থমথমে। ভেতরে জমে থাকা রাগ ফুসফুস করে ফাটিয়ে উঠতে চাইছে। রাগে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। হাতের ম্যাগাজিনটা শব্দ করে টেবিলের উপর ফেলল। শব্দে প্রত্যাশা চমকে ফিরে তাকাল। ওদিকে তাকিয়েই মিহি স্বরে বলল,
-” ওকে।”
রাগটা কমাতে নীরব জানালার দিকে পিঠ করে দাঁড়াল। মেরুদণ্ড সোজা, হাত দুটো মুঠো করা, চোয়াল শক্ত। ভেতরের দাবানল প্রকাশ না করলেও শরীরের ভাষায় বোঝা যাচ্ছে কিছুটা রুক্ষ মেজাজে আছে। নীরবের অভিব্যক্তি প্রত্যাশা খেয়াল না করেই ও মনে পড়ার মতো করে সরল মনে বলে উঠল,
-” ওহহো যেটা বলছিলাম, কুয়াকাটায় প্রীতি আপুদের সাথে দেখা হয়েছিল। ওনাদের সাথে দেখা হওয়ার পরেই আমি আপনাকে কল দিই। কিন্তু তখন আপনি কল রিসিভ করেননি। তারপর বিকেলে যখন ঘুরতে গিয়েছিলাম, সমুদ্রের পানিতে খালি পায়ে হাঁটছিলাম তখনই পা কে”টে যায়।”
একটু থেমে শ্বাস নিয়ে আবার শুরু করল,
-” প্রীতি আপুকে যেমনটা আগে ভেবেছিলাম, সেদিন তো উনি আমার পুরো ধারনাই চেঞ্জ করে দিলো। উনাকে যতটা রুক্ষ মনে হয়েছিল, সেদিন কথা বলে তেমন মনে হলো না। আমার তো ওনাকে যথেষ্ট আন্তরিকই মনে হলো। প্রীতি আপু নিজে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এলেন। আর উনার ভাই ওষুধ প্রেসক্রাইব করে দিলেন। তারপর ব্যান্ডেজও উ___”
কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ নীরব ঘুরে দাঁড়াল। রুক্ষ, ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
-” তুমি কীভাবে চলো? ঘুরতে গিয়েও একটা না একটা ঘটনার জন্ম দিতেই হবে! এতজনের কারো কিছু হয় না, আর তুমি গিয়ে পা কে’টে নাও? আর সেই সুযোগে অন্যদের সাথে গল্প জমাও।”
প্রত্যাশা বিস্ময় আর বিরক্তির মিশ্র সুরে বলল,
-” আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো সবটা বলার আগেই আপনি ঝাড়তে শুরু করলেন। আর কে’টে গেলে আমারই বা কী দোষ? আমি কি ইচ্ছে করে করেছিলাম? আজব তো!”
প্রত্যাশা ঠোঁট ফোলাল। গাল দুটো অভিমানে ভারী হলো। প্রত্যাশার অভিমানি মুখের দিকে তাকাতেই নীরবের মুখের আদল মিইয়ে আসলো। গলার স্বর আগের তুলনায় নরম করল। তবুও সাবধানবাণী নামল প্রতিটি বাক্যে,
-” ওকে ওকে, এখন গাল ফুলিয়ে নাটক করো না। এখন আমাদের বেরোতে হবে। তবে শোনো, আগেও বলেছি, আবার বলছি; কিছু কিছু মানুষের সংস্পর্শে না যেয়ে দূরে থাকাই বেটার। আর সব মানুষের বাহ্যিক ব্যবহার দেখে পুরো বিশ্বাস করে ফেলো না। কারো সাময়িক আন্তরিকতায় নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দিও না। জীবনে চলতে গেলে বুদ্ধি খাটাতে হয়, চোখ খোলা রাখতে হয়। সবাই সবসময় যেরকম মনে হয়, আসলে কিন্তু সেরকমই হয় না।”
প্রত্যাশা কতটা গুরুত্ব দিলো বোঝা গেল না। ও বোঝার চেষ্টাই করল না। এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিলো। এরমধ্যে নীরবের ফোনটা বেজে উঠল। আন্নাউন নম্বর দেখে নীরব কপালে ভাঁজ ফেলে রিসিভ করল।
-” হ্যালো….?”
বলতেই ওপাশ থেকে পুরুষ গলা এল,
-” অফিসার নীরব বলছেন?”
নীরব ভ্রু গুটিয়ে জবাব দিল,
-” জ্বী। নীরব মাহবুব স্পিকিং।”
-” আমি ডিআইজি অফিস থেকে বলছি, সৎ, সাহসিকতা আর দক্ষতার পরিচয় দেওয়ার জন্য আপনাকে মেডেল দেওয়া হবে। অতি সত্বর হেড অফিসে চলে আসুন। এখানে….”
কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে নীরব রুক্ষ স্বরে বলল,
-” ফা’জলামো রাখ। নম্বর চেঞ্জ করলেই কি গলার স্বরও চেঞ্জ হয়?”
-” আরে ওইটাই তো চ্যালেঞ্জ ছিল। দেখলাম ধরতে পারিস কিনা। আচ্ছা দোস্ত কই তুই? সবাই তো পৌঁছে গেছে। তুই কোথায় শা’লা? বিয়ে করলি, জানালি না। দাওয়াতও দিলি না। এখন তো সবাই বউ নিয়ে এসেছে, তোর বউ আনবি না? না কি সবাই বউ দেখে ফেলবে বলে আসছিসই না?”
নীরব ঠোঁট শক্ত করে ছোট করে বলল,
-” ফাজলামো কথাবার্তা বলতে অন্য কাউকে খুঁজে নে,
ফাজলামি সাথে টাইম ন”ষ্ট করার মতো মুডে নেই আমি। আসছি।”
___________
ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি পালন কম একে বন্ধুদের গেট-টুগেদারই বলা যায়। ফয়সালের ল্যাভ ম্যারেজে বন্ধুদের অবদান অনস্বীকার্য। ক্লাসমেটের সাথে প্রেমের সূচনালগ্ন থেকে বিয়ে অবধি যেসব বন্ধু পাশে থেকেছে, যাদের সঙ্গে হৃদ্যতা আর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তাদেরই কয়েকজনকে সে আমন্ত্রণ জানিয়েছে নিজের নিরিবিলি ফ্ল্যাটে। সম্পর্কের পথচলার এই স্মরণীয় দিনে আপন মানুষগুলোকে সঙ্গে রাখতেই এমন ঘরোয়া আয়োজন।
ড্রয়িংরুমে বন্ধুদের হাসাহাসি আর গল্পের আসর জমেছে। এমন সময় একজোড়া দম্পতির আগমণ ঘটে। সবার চোখ তাদের দিকে। প্রত্যাশা নীরবের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে এলো। সোফায় বসা এক রমণীর ফরসা মুখের আদল বিবর্ণ, ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এতক্ষণের হাসি মুখটা নিমিষেই মিইয়ে আসলো। প্রত্যাশার গায়ে মেরুন রঙের শাড়ি। আঁচলটা ডান হাতের ফাঁক গলে সামনে এনে রাখা। একহাতে আলতো করে ধরে রাখা। নীরবের পরনে কফি কালারের শার্ট, অফ হোয়াইট ডেনিম প্যান্টের উপর ইন করে পড়া। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করে হালকা ব্যাক ব্রাশ করা। একজন উচ্চস্বরে বলল,
-” বন্ধু অবশেষে আসলা? বউ সবাই দেখে ফেলবে বলে গোপনে বিয়ে করছো।”
আরেকজন বলল,
-” আরে এএসপি তো কিপটামিও করছে, আমরা সব কবজি ডুবে খাব বলে, বিয়েতে অনুষ্ঠানই করেনি।”
নীরব বলল,
-” হুট করে হয়েছে সবাই জানিস, অহেতুক আজবাজে বলা বন্ধ রাখ।”
একজন লম্বা করে সালাম দিল,
-” আসসালামুয়ালাইকুম ভাবি।”
প্রত্যাশার লজ্জা লাগছে, ও এভাবে অভ্যস্ত না থাকায় আনইজি ফিল করছে। দৃষ্টিজোড়া ওর নত। ও মাথাটা তুলে মিহি স্বরে উত্তর দিতেই চোখ পরে প্রীতির দিকে। প্রীতি এদিকেই চেয়ে। প্রথমে বিস্মিত হলেও পরক্ষণে খেয়াল হয় প্রীতি নীরবের ফ্রেন্ড হলে এদেরও। মোবাইলে ডুবে ছিলো ইচ্ছে। মুখ তুলে তাকাতেই চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। একবার নীরবের দিকে তাকাল তো আবার প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” মাম্মা, পাপা! পাপা এসেছে!”
ইচ্ছে ঝট করে ওঠে এগিয়ে নীরবের সামনে দাঁড়ায়। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে প্রাণোচ্ছ্বল কণ্ঠে বলল,
-” পাপা!”
সবার মাঝে এভাবে বলায় প্রত্যাশার না চাইতেও কেমন জানি লাগলো। ইচ্ছের গাল ধরে নীরব বলল,
-” সুইট মামণি, কখন এসেছো?”
উপস্থিত কেউকেউ একটু অবাকই হলো। একজন হাসতে হাসতে মশকরা করে বলল,
-” আরে দ্যাখো দেখি কান্ড! ইচ্ছে বেবি কী নীরবকেই নীবিড় ভাবছে? আর টুইনস হলে ইচ্ছেরই বা কী দোষ। ও ছোট মানুষ। অত বুঝে নাকি।”
আরেকজন ঝট করে বলে ফেলল,
-” যেখানে স্বয়ং ইচ্ছের মা, আমাদের বলিউড সুন্দরী প্রীতি জিনটাই মিস্টেক করেছিলো। নীবিড়কে প্রপোজ করতে গিয়ে ভুলে তো প্রথমে নীরবকে প্রপোজ করে ফেলেছিল। সে নিয়ে কী এক কান্ড!”
পুরোনো ঘা টা দগদগ করে উঠল প্রীতির। সবাই যেটাকে মিস্টেক জানে, আদৌও কী মিস্টেক ছিলো? নাকি অপমানের বদলা, সাথে পুরনো প্রতিশোধের স্পৃহা থেকেই ঘটনার মোড় উল্টে দেওয়া হয়। মিথ্যে নাটক সাজানো হয়। প্রীতি প্রসঙ্গ পাল্টাতে, সবার মনোযোগ ঘুরাতে বলল,
-” আরে তোমরা সব পুরোনো কথা বাদ-ছাদ দাও তো। এতক্ষণ তো সবাই নীরবের বউ দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলে, তাকেই বরং দ্যাখো।”
পরপর প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” প্রত্যাশা দাঁড়িয়ে আছো কেনো, এসো বসো।”
প্রত্যাশা প্রীতির দিকে তাকিয়ে ফের নীরবের দিকে তাকাল। চোখের ভাষায় নীরবের সম্মতি পেতেই আলগোছে গিয়ে বসল। মেয়েরা একপাশের সোফায়। ছেলেরা অপর পাশে। সামনের টি-টেবিলে নাস্তায় ভরপুর। খেতে খেতে আড্ডা আবার জমে উঠল। ইচ্ছে নীরবের কোলের উপর বসে ফোনে গেম খেলছে। গল্পের এক পর্যায়ে একজন বলল,
-” এখানে উপস্থিত নীরব বাদে বাকিদের লাভ ম্যারেজ। তা নীরব আমাদের ছোঁয়া কেনো তোর গায়ে লাগলো না, বলতো? প্রেম-পিরিতে তোর এলার্জির কারনটা কী ছিলো?”
নীরব একটু কেশে বলল,
-” প্রেমের পরিণতি যদি বিয়ে না হয়, তবে তা আবেগই থাকে, অধিকার নয়। একটা কাগজে নাম মোহর হওয়া মানেই; দেয় হক, দেয় নিরাপত্তা, দেয় তাকে ছুঁয়ে রাখার অধিকার। সবার সামনে গর্ব করে বলা যায় সে আমার হালাল জীবনসঙ্গী।”
এক সেকেন্ড থেমে বলল,
-” প্রকাশ্যে, সম্মানে, দায়িত্ব নিয়ে আমার জন্য নির্ধারিত জনকে আমার পাশে রাখতে চেয়েছি। তাই প্রেম নয়, আমি হালাল সম্পর্ককে বেছে নিয়েছি। এটা আমার থট। তবে আমি এটাও মনে করি, সব কিছুই উপরওয়ালার লিখে দেওয়া, তাই এমনটাই হয়েছে। এছাড়া নাথিং।”
কিছুপল পর। সবাই কথা বললেও প্রত্যাশা চুপচাপ। একেতে অচেনা লোকজন, তারউপর সবাই অনেক সিনিয়র। ওর কিইবা বলার আছে। ইচ্ছের হাত ধরে প্রত্যাশা একটু দূরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। কয়েক মূহুর্ত পরেই পুরুষালি পরিচিত স্বর কানে এলো,
-” আনইজি লাগছে? বেশি খারাপ লাগছে তোমার?”
নীরবের দিকে ঘুরে তাকাল প্রত্যাশা। মাথা নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
-” হুম। বেশি না একটু….একটু কেমন কেমন লাগছে।”
প্রত্যাশার বলার ধরণ দেখে নীরব হেসে ফেলল। আশ্বস্ত করতে বলল,
-” আর একটু ওয়েট করো, আমরা চলে যাবো।”
ইচ্ছে মুখ তুলে নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” পাপা আমিও যাবো।”
এরমধ্যে প্রীতি ডাক দিলো,
-” ইচ্ছে, তোমার হেয়ার ব্যান্ড ওখানে খুলে পড়েছিল দেখছি। এসো লাগিয়ে দিই।”
ইচ্ছে ক’পা এগিয়ে প্রীতির শুভ্ররঙা থ্রি পিসের ওড়না টেনে ধরল। আহ্লাদি গলায় বলল,
-” মাম্মা আমি পাপার সাথে যাবো। পাপা ওকে নিয়ে যাবে।”
প্রত্যাশাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে। প্রীতি বিরক্তি নিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে জ্বালাবে না। একটু পর আমরা বাসায় ফিরবো। এখন চুপচাপ বাকিটা সময় থাকবে। কোনো কথা বলবে না।”
ইচ্ছে গাল ফুলাল। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসছে। নীরব এগিয়ে ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে অন্যদিন নিবো তোমাকে?”
ইচ্ছে জেদি স্বরে বলল,
-” নাহ…ইক্ষুন।”
প্রীতি চোখ রাঙিয়ে চাইল। ধ’ম’ক দিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নীরব বলল,
-” আচ্ছা, ঠিক আছে তোমাকে নিয়ে যাবো।”
পরপর প্রীতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে যেহেতু যেতে চাইছে ওকে নিয়ে যাই। কাল আমি দিয়ে আসবো। আশাকরি তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। আর অসুবিধা হওয়ার কিছু নেইও, কাজের লোকের কাছে থাকার চেয়ে আমাদের ওখানে যে একটু হলেও বেশি ভালো থাকবে ইচ্ছে, এটা আমি চোখবুঁজে বলে দিতে পারি।”
কথাগুলো পিঞ্চ মে”রে বলে নীরব তা প্রীতি ঢের বুঝল। তবে প্রত্যুত্তর দিলো না।
ডিনার না করেই সবাইকে বুঝিয়ে কিছু একটা অজুহাত দিয়ে নীরব চলে আসে। পার্কিংলটে পার্ক করা বাইকের কাছে আসতেই প্রত্যাশা শুধাল,
-” আগে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারপর ইচ্ছেকে নিয়ে যাবেন না?”
নীরব বাইকে বসতে বসতে বলল,
-” না।”
-” না মানে।”
-” না মানে তো না-ই হয়।”
-” হেঁয়ালি না করে ঝেড়ে কাঁশুন তো। সরাসরি বলুন।”
-” তুমিও আমাদের সাথে যাচ্ছো।”
-” আজ?”
-” হুম। আজ, এখন।”
নীরব আদেশের সুরে বলল,
-” বাড়তি কথা না বলে ঝটপট কাজ করো। ইচ্ছেকে তুলে দাও।”
ইচ্ছেকে মাঝে তুলে বসাতে গেলে নীরব চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,
-” সামনে দাও।”
-” চালাতে সমস্যা হবে তো?”
-” হবে না, যা বলছি তাই করো।”
অগত্যা ইচ্ছেকে সামনে বসিয়ে নিজে নীরবের পাশে বসল। বাইকের ইঞ্জিন চালু করতে করতে নীরব বলল,
-” শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক করে বসো।”
প্রত্যাশা শাড়ির আঁচল কোলের উপর তুলে একহাত কোলের উপর রাখল। অপর হাতে নীরবের পেট জড়িয়ে ধরল। ইচ্ছে ঘাড় বাঁকিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে চোখ সরু করে বলল,
-” তুমি সবসময় আমার পাপার সাথে থাকো কিনো?”
প্রত্যাশা দুষ্টু হেসে বলল,
-” তোমার এই পাপা আমার বর, তাই।”
___________
ইচ্ছেকে দেখে নীহারিকার ভেতরে ভেতরে ভালো লাগলেও প্রকাশ করলেন না। ওদিকে বাড়িসুদ্ধ লোক তো বলতো ইচ্ছেকে আনতে। সবাই প্রত্যাশা আর ইচ্ছেকে দেখে খুশিই হলো। নীহারিকা কোলের কাছে ইচ্ছেকে বসিয়ে, মাথায় মমতায় ভরা হাত বুলিয়ে গেলেন। প্রত্যাশা সবার সাথে সাক্ষাৎ শেষে শাশুড়ির পাশে বসল। নীহারিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালেন,
-” চুল কেটেছো?”
প্রত্যাশা ভড়কে গেল। এইরে শাশুড়ি মায়ের জহুরির চোখ। ঠিক খেয়াল করেছে। আম্মুর মতো উনিও বকা না দেয়, এই ভয়ে শুকনো ঢোক গিলল ও। নিচের ঠোঁট জিভের ডগায় ভিজিয়ে আমতা আমতা করল,
-” হ-হ-হু।”
-” বড়বড় চুলই বেশি ভালো লাগে। বড় চুলে তোমাকে বেশি সুন্দর লাগতো।”
বেশি কিছু না বলায় প্রত্যাশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এরমধ্যে নিভান এসে ইচ্ছের সাথে কথা বলতে লাগল। ইচ্ছের পাশে বসে আদুরে গলায় বলল,
-” সোনা মামণি তুমি চিনো আমায়?”
ইচ্ছে বড়বড় চোখে চেয়ে দু’পাশে মাথা নেড়ে ‘না’ বোঝায়। নিভান কিছু বলার আগেই প্রত্যাশা ঝটপট বলে উঠল,
-” ইচ্ছে উনি তোমার বড় পাপা।”
ইচ্ছে ভেঙে ভেঙে বলল,
-” বড়ো পাপা?”
নিভান একগাল হেসে স্নেহমাখা হাত ইচ্ছের মাথায় রেখে বলল,
-” হ্যাঁ সোনা।”
ফ্রেশ হয়ে ক্যাজুয়াল পোশাকে নীরব রুম থেকে বেরিয়ে এদিকে আসছিলো। প্রত্যাশার নজর পড়তেই ইচ্ছেকে দেখিয়ে তর্জনী তুলে বলল,
-” ইচ্ছে, আর ওনাকে আজ থেকে পাপা নয়, ছোটো পাপা বলবে, ক্যামন? উনি তোমার ছোটো পাপা হোন।”
ইচ্ছে নাক ফুলিয়ে বিরোধীতা করে উঠল,
-” পাপা।”
নীহারিকা আদর করে নরম স্বরে বলল,
-” ইচ্ছে, আপু আমার প্রত্যাশা ঠিকই বলেছে, তুমি ছোটো পাপা বলবে সোনা।”
ইচ্ছে ঘাড় ফুলিয়ে বলল,
-” পাপা ছোট না, পাপা অনেক বড়।”
উপস্থিত সবাই হেসে ফেললো। নিভান আশকারা দিয়ে বলল,
-” আহ মা বাদ দাও না। ছোটো বাচ্চা মেয়ে, ব্যাপার না। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
কিছুক্ষণ পর,
আনিশা ইচ্ছের সাথে বেশ গল্প জুড়ে দেয়। সবাইকে চেনাতে বড় অ্যালবামটা নিয়ে আসে। ইচ্ছেকে দেখাতে থাকে, এটা ওর বাবা। বাবা এখনো অফিসে। আত্মীয়দেরও দেখিয়ে বকবক করতে থাকে। তবে ইচ্ছের কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। ও নীরবের ফোন নিয়ে কার্টুন দেখতে লাগলো। পরীকে এককাপ ব্লাক কফি আনতে বলল নীরব। তবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যাশা ছবি দেখতে আরম্ভ করল। অ্যালবামটা প্রত্যাশার কোলের উপর। এক পাশে আনিশা, আরেক পাশে ইচ্ছে নীরবের গা ঘেঁষে। প্রত্যাশা আর আনিশার দৃষ্টি অ্যালবামের পাতায়। ছবির পাতা উল্টে উল্টে হঠাৎ একটা পাতায় এলেই, আনিশা খিলখিল করে হেসে বলে উঠল,
-” ছোট ভাবীমণি, এই দ্যাখো ভাইয়া লুঙ্গি পরে দাঁড়ায়ে আছে। ওরে বাবারে! ভাইয়ারে কে এভাবে তুলছে?”
প্রত্যাশা চোখ বড় করে তাকায় ছবিটার দিকে। আবিরের ছবি, গাল দুটো ফুলে আছে, পরনে ছাপের লুঙ্গি, আর সাদা গেঞ্জি। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সুন্নাতে খাতনার ছবি। প্রত্যাশা ভ্রু তুলে ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-” আরে আরে এই ছবি তো দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেয়াই প্লাস দেবরের ম্যানলি জার্নির শুরুর দিক।”
আবিরের দৃষ্টি টিভির পর্দায় থাকলেও এহেন কথায় বেশ লজ্জায় পড়ল। আরেক পাতা উল্টাতে না উল্টাতেই একদম ছোট বেলার ছবি আসলো। দুষ্টু পাকনি আনিশা বিজ্ঞের মতন গোলগোল চোখ করে চেয়ে বলল,
-” এইটা ভাইয়া। আমি জানি বড় দাদান বুলেছিল। এমা নেনটু ভাইয়া।”
একদম ছোটবেলার ছবি। ছবিটিতে আবিরকে বেশ নাদুসনুদুস লাগছে। গায়ে পোশাক না থাকলেও কপালের উপর কালো ইয়া বড় নজর টিকা। ফর্সা মুখে চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে। আনিশার কথা শুনে আবির ধ’ম’ক দিয়ে উঠল। পরপর শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে কাঁদো কাঁদো মুখ করে অসহায় কণ্ঠে বলল,
-” আম্মু এসব ছবিও রাখা লাগে নাকি? কী একটা অবস্থা। মানসম্মানের ফালুদা বানানোর জন্য কী সব ছবি জাদুঘরে সংরক্ষিত রাখার মতো, সংরক্ষণ করে রেখেছো। দিলে তো বারোটা বাজিয়ে।”
শর্মিলা হেসে রুমের দিকে যেতে যেতে জোরেশোরে বললেন,
-” ছেলেবেলার ছবি এগুলো, স্মৃতি হিসেবে রেখেছি। ছেলেবেলার ছবিতে মানসম্মান আবার কী বাবা?”
আবির অপ্রস্তুত ভঙিতে চোখমুখ কুঁচকে বসে রইল। প্রত্যাশা দ্রুত পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল,
-” দেখি দেখি সামনে এগোই। দেখি আর কারো ঐতিহাসিক ছবি-টবি পাওয়া যায় কী না।”
আচমকা আবির প্রশ্ন করে উঠল,
-” ছোট ভাবিমণি আর কারো বলতে তুমি কী ছোট দাদানকে বোঝাচ্ছো?”
প্রত্যাশা কথাটা কতটা বুঝল বোঝা গেল না। ও তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” হুঁ।”
সবে কফির মগে চুমুক দিয়েছিল নীরব। ওদের এমন কথোপকথনে গলায় বেষম লাগে তার। নীরবের খুকখুক কাশিতে প্রত্যাশার টনক নড়ে। ও ঝড়ো বেগে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” এই না না..আমি তা বলিনি।”
আবির হাসতেই নীরব চোখ পাকিয়ে তাকাল। নীরবের এক দৃষ্টিতেই বেচার হাসি বিদ্যুতের বাল্বের মতন ফিউজ হয়ে গেল। প্রত্যাশা লজ্জা পেয়ে অ্যালবাম রেখে ত্রস্ত উঠে গেল।
.
.
ঘড়ির কাঁটা রাত বারোটার ঘর ছুঁইছুঁই। ইচ্ছে নীহারিকার কাছে শুয়েছে। নীরব সোফায় বসে ল্যাপটপে মেইল চেক করে ফোনটা ওপেন করতেই হটস অ্যাপের নোটিফিকেশন নজরে এল। অ্যাপে ঢুকে মেসেজে ফটো এর নোটিফিকেশন দেখে কৌতূহল নিয়ে চেক করতেই মেঘ বিনা বাজের মতো স্তব্ধ হলো নীরব। ভাষা হারিয়ে গেল, বিমূঢ়, বিমূর্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে রইল। বেশ কয়েকটা ছবি। প্রত্যাশা সার্থকের বুকের উপর, সার্থক চেইন ছড়াচ্ছে সেই দৃশ্যর ছবি, নীরবের মাথায় র’ক্ত চড়ে গেল। চোখদুটো বুঁজে নিল।
প্রত্যাশা সবার সাথে গল্প-গুজব করে রুমে এসে নীরবকে অমন অসাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এগোল। ঠোঁট ফাঁক করে কিছু বলবে তার আগেই নীরব মুখে কিছুই না বলে ফোনটা সোজা প্রত্যাশার দিকে ধরল। স্ক্রিনে চোখ পড়তেই গোটা আসমান যেনো প্রত্যাশার মাথার উপর পড়ল। বুকটা ছ্যাত করে উঠল। মূর্ছা যাওয়ার মতন হলো।
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৮|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ঘরজুড়ে থমথমে নিস্তব্ধতা। প্রত্যাশা স্তব্ধ, হতবুদ্ধি, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আশঙ্কায় মেয়েটার চোখের পাতাগুলো কাঁপছে অনবরত, ঠোঁটজোড়া কেঁপে কেঁপে থেমে যাচ্ছে। গলায় শব্দ আটকে আছে। সবটা ঠাওর করতে পারছে না। নিচু স্বর, অথচ ছু’রি দিয়ে কাঁচে আঁচড় দেওয়ার মতো ধারালো স্বরে প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল নীরব,
-” এই ছবিগুলো দেখার পর আমি কী ভাবব, বলো? তোমার প্রতি আমার ধারণা ঠিক কোন খাতে গড়াবে?”
প্রত্যাশার বুকের ভেতরটা ধকধক করছে, হতবিহ্বলতায় মেয়েটা বাকশুণ্য। মুখ খোলার আগেই নীরব প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বজ্র কণ্ঠে ফের বলল,
-” হুয়াই আর ইউ সাইলেন্ট? টেল মি… হোয়াট একজ্যাক্টলি অ্যাম আই সাপোজড টু বিলিভ অ্যাবাউট ইউ আফটার সিইইং দিস?”
প্রত্যাশা ধ’ম’কে কেঁপে ওঠে। মূহুর্তেই চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। ভেজা, কম্পিত স্বরে বলল,
-” বিশ্বাস করুন… আমি… আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না ছবিগুলো কোত্থেকে এলো, কখন তোলা হলো, কে তুলেছে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা আমি। আমি কী করে..….?”
টসটসে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল প্রত্যাশার গাল বেয়ে। প্রত্যাশা ব্যাকুল নয়নে একবুক আশা নিয়ে নীরবের দিকে তাকায়—-নীরব ঠিক ওকে বুঝবে এই আশায়। প্রত্যাশার সে আশায় বুঝি গুড়ে বালি। নীরবের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি। চোখে অবজ্ঞার ঝিলিক নিয়ে বলল,
-” মানে বলতে চাইছো, ছবির এই মেয়েটা তুমি না? রাইট?”
বুকের ভেতর থেকে হাহাকার বেরুল প্রত্যাশার। কী বলবে, কীভাবে বুঝাবে? অস্থির চিত্তে ব্যাকুল স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করল,
-” আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না। আপনি বিশ্বাস করুন, আমি ছবির এই দৃশ্যগুলো কীভাবে ঘটেছে সেটাও মনে করতে পারছি না। আমি… আমি কিচ্ছু মনে করতে পারছি না। বুঝতেও পারছি না। বিলিভ মি।”
বলতে বলতে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল প্রত্যাশা। নীরব ত্যাড়া সুরে বলল,
-” বিকেলে তোমার ফোনে ওর কল এলো, সেটাও তুমি জানো না? এখন তো আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, তুমি কলেজ থেকে ট্যুরে গেলে, ওরাও সেইম জায়গাতেই ট্যুরে গেল, দেখাও হলো….এতটা কোইনসিডেন্স কী করে হয়? নাকি আমাকে আই ওয়াশ করা হয়েছে?”
প্রত্যাশা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চাহনিতে চেয়ে সহসাই বলল,
-” নীরব, আপনি এই ছবিগুলো দেখে এতদূর অবধি চলে গিয়েছেন। এত সহজেই ছবিগুলো দেখেই বিশ্বাস করে নিলেন। আমাকে একটুও বিশ্বাস করলেন না। আপনার মনেহয় আমি অমন?”
নীরব রাগে উচ্চ কণ্ঠে বলল,
-” তুমি কলেজ থেকে গিয়েছিলে, তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে তোমার থাকার কথা। সেখানে তুমি ওর সাথে কী করছিলে? তাও হোটেলের ফাঁকা রুমে! ছবিটাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এটা হোটেলের একটা লাক্সারি রুম। ছবিগুলো দেখতেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো। তারপরেও আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম এডিট করা কী না। কোনটা এডিট আর কোনটা রিয়েল, সেটা তফাৎ করার ক্ষমতা আমার আছে। ছবির তুমি সংজ্ঞাহীনও নয়। তাহলে বলো আমার কথাগুলো লজিকলেস, আমার মনে তৈরি হওয়া প্রশ্ন নিছকই?”
প্রত্যাশা ভেজা গলায় বলল,
-” নীরব, দয়াকরে আপনি আমার পুরো কথা আগে শুনুন। তারপর না হয় জাজ করবেন। প্লিজ শুনুন, একটু বোঝার চেষ্টা করুন।”
বাম ভ্রুটা কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে দারাজ স্বরে বলল নীরব,
-” ওকে বলো। এক্সপ্লেইন দাও।”
হাতের পিঠে গাল বেয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু মুছে নেয় প্রত্যাশা। মস্তিষ্কে চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করে। বলে,
-” আগেই বলেছি আমার ওনাদের সাথে দেখা হয়। আমার পা কে’টে যায়। সার্থক উনি নিজে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দেয়, মেডিসিন প্রেসক্রাইবও করে। তারপর আমার যতটুকু মনে আছে আমি ওনাদের সাথে সি-বিচের পাড়েই সময় কাটাতে থাকি। তারপর….. তারপরের কথা আমার ঠিকঠাক মনে পড়ে না। সার্থক আর ওনার ফ্রেন্ড, ওনার একটা মেয়ে ফ্রেন্ড ছিলো। ওনারা আমায় বলে ওষুধ নেওয়ার ফলে ঘুম পাচ্ছিল। আর…আর আমাদের ট্যুরের সবাই সেই মূহূর্তে ঘুরতে যাচ্ছিল। আমি অসুস্থ থাকায় ওনারা সাথে রাখে। আমার ফ্রেন্ডরাও একই কথা বলেছে। তারপর সন্ধ্যায় উনি আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসে। ব্যস! এতটুকুই। কিন্তু কখন, কীভাবে? এই….”
নীরব থামিয়ে দিল। স্ক্রল করে একটা ছবি প্রত্যাশার সামনে ধরল। ছবিটাতে প্রত্যাশা নিজে সার্থকের হাত ধরে আছে। ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে, চোখেমুখে মুগ্ধতা ছড়িয়ে। রাগে নীরবের মাথা ফেটে যাচ্ছে। গর্জে ওঠে বলল,
-” এখানে না তো অচেতন তুমি, আর না তো ঘুমের ছিটেফোঁটাও আছে।”
যে দৃশ্য দেখে নীরবের মাথা বিগড়ে গিয়েছে। সেই ছবিটা স্ক্রিনে এলো। দু’জনে খুব কাছাকাছি। প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে সার্থক টিশার্টের বোতাম থেকে চেইনটা ছড়াচ্ছে। ঘৃণা আর রাগে নীরব হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফট করে হাতের ফোনটা ছুঁ’ড়ে মা’রল। ফ্লোরে পড়তেই ফোনের গ্লাস ফেটে যায়। ঝাঁঝিয়ে ওঠা শব্দে প্রত্যাশার বুক কেঁপে ওঠে। নীরবের এমন কঠোর আচরণে প্রত্যাশার শ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছে। নীরব কপাল স্লাইড করে রাগ দমানোর চেষ্টা করল। অধৈর্য হয়ে বলল,
-” এখন মনে হচ্ছে আমার মা ঠিকই বলে। এগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে। তাহলে আমিও বোধহয় জেনেশুনে নীবিড়ের মতো আরেকটা ভুলই করলাম। আসলেই র*ক্ত কথা বলে। জিনেটিক বিষয়টা সহজেই উতরানো যায় না। জেনেশুনে তোমাকে দয়া দেখানোই আমার ভুল ছিলো।”
ঘোর তমসার মধ্যে নিভুনিভু এক চিলতে আলোর রেখা নীরবের —‘যদি সত্যি হয়ে থাকে’ কথাটায় পায় প্রত্যাশা। উনি ‘যদি’ বলছে, তারমানে এক্ষুনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি। তবে পরক্ষনেই প্রত্যাশার সেই আলো অজানা অন্ধকার গ্রাস করে নেয়। সাথে সবটা বুঝতেও ব্যর্থ হয়। মস্তিষ্ক ক্যাচ করল— র*ক্ত, জেনেটিক, দয়া দেখানো! প্রত্যাশা কিছুটা উঁচু স্বরে বলল,
-” নীরব আপনি আমাকে বলছেন বলুন। আপনি ভালো করে জানেন আমার আব্বু-আম্মু কেমন। জেনেটিক কথা তুলে ভুলেও তাদেরকে ছোট করে কিছু বলতে যাবেন না। আপনার রাইট নেই। আমি সহ্য করব না। আর দয়া, কীসের দয়া করেছেন আমাকে?”
রাগের বশে,মুখ ফস্কে কী বলতে বসেছিল তা ভাবতেই নীরব নিজেই নিজের উপর বিস্মিত হয়। হতাশায় চোখদুটো বুঁজে নিল। জোরালো শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলাল। গলার স্বর নামিয়ে বলল,
-” স্যরি। আমি ওভাবে বলতে চাইনি। তুমি আমার জায়গায় একবার নিজেকে কল্পনা করে দ্যাখো, আমার কীরকম লাগছে! আমার অবস্থাটা রিলাইজ করার চেষ্টা করো। যেখানে আমি সার্থকের সাথে তোমার সামান্য কথা বলাই টলারেট করতে পারি না। সেখানে এই দৃশ্যগুলো দেখার পর কীভাবে সহ্য করব?”
চোখে নোনতা পানির বহর নিয়ে, অনুনয় করে ব্যাকুল স্বরে বলল প্রত্যাশা,
-” দয়াকরে, আমায় একবার বিশ্বাস করুন। আমি যেমনই হই না কেনো, তবে সজ্ঞানে কখনো কোনো অন্যায়, পা”প করতে পারি না। এতটুকু আত্মবিশ্বাস আমার আছে।”
-” আচ্ছা আমাকে সত্যি করে বলো, তুমি বুঝতে পারোনি আমি সার্থকের সাথে তোমার কথা বলা পছন্দ করতাম না। সেদিন হাসপাতালে ওর চেম্বারে আমার আচরণ, কথা শুনে কিছুই বোঝোনি? এছাড়াও বাড়িতেও আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তারপরও তুমি ওর থেকে হেল্প নাও, ওর কাছে রেস্টের জন্য আশ্রয় নাও, আবার…..আবার আমারই সামনে থ্যাংকস জানাও। আমার যে বিষয়টা এলার্জি লাগে, তুমি সেটা স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে করে যাও। এগুলোর ব্যাখা কী? বাদ দিলাম ছবির কথা।”
প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-” উ-উনি আপনার আত্মীয়, সেই সুত্রেই আমি কথা বলেছি। আপনি যে ওনাকে অপছন্দ করেন। আমি সেটা বুঝতে পারিনি।”
নীরব চোয়াল শক্ত করে আচমকা প্রত্যাশার দুই বাহু শক্ত করে ধরল। রাগান্বিত হয়ে দাঁত কিড়মিড়ে বলল,
-” তুমি বুঝবে কী করে? তুমি তো সবসময় নিজেকেই প্রায়োরিটি দাও। অন্যকে নিয়ে কখনো ভেবেছো? নাহ, ভাবোনি। অন্যের বিরক্তলাগা, অন্যের খারাপ লাগাকে তুমি এক পয়সার দাম দাও না। তোমার যখন যা মন চায় তাই করো।”
প্রত্যাশার গা থরথরিয়ে কাঁপছে। কান্নার শব্দ গলায় আঁটকে আছে। অঝোরে আষাঢ়িয়া বর্ষণ কপোল বেয়ে নামছে অবিরত। নীরব আ”গুন চোখ নিয়ে, রাগ-ক্ষোভ ঝাড়ল,
-” তুমি ছোটো, অগোছালো কিশোরী, তোমার কাছ থেকে বেশি কিছু এক্সপেক্টেশন রাখা বোকামি। তাই আমি তোমার কাছে নূন্যতম এক্সপেক্টও রাখিনি। তুমি যেমন আমি তেমন তুমিটাকেই মেনে নিয়েছি। মাঝখানে তোমার কিছু ভুলকেও চোখবুঁজে মেনে নিয়েছি। তোমাকে কারো কাছে এতটুকু খাঁটো হতে দিইনি।”
প্রত্যাশার বুক ফেটে যাচ্ছে। ও অস্ফুটে কিছু বলতে চাইল,
-” নীরব.…এ___”
নীরব থামিয়ে দিল। প্রত্যাশার বাহু ছেড়ে দিল। ডান হাত উঁচু করে তুলে বলল,
-” লেট মি ফিনিশ।”
প্রত্যাশার নিজেকে খুব অসহায় ঠেকছে। নীরব হতাশা আর ক্ষোভ মিশিয়ে বলল রুঢ় স্বরে,
-” শুরু থেকেই তোমার পা’গলামি হাসিমুখে মেনে নিয়েছি, তোমার ছেলেমানুষী আচরণ ধৈর্য্য ধরে সহ্য করেছি। তোমাকে এতটুকু বুঝতে দেইনি। এবার তো তুমি লিমিট ক্রস করে ফেলেছো। এরকম দৃশ্য দেখার পরেও মেনে নেয়া যায়? তুমিই বলো যায়? পা’গলামি, অবুঝপনা মানা গেলেও চরিত্রের দোষ-ত্রুটি মানা সহজ নয়। আজকের পর থেকে তোমার আমার সম্পর্ক অনিশ্চিত। এই দৃশ্য দেখার পরেও তোমার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক কনটিউনু রাখা হবে বলে মনে হয় না।”
প্রত্যাশার পুরো পৃথিবী দুলে উঠল যেনো। বুকের ভেতরটা নিঃশব্দে র”ক্তাক্ত হলো। উল্টোদিক ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পা বাড়াল নীরব। প্রত্যাশা আকস্মিক নীরবের হাতটা টেনে ধরল। আহত কণ্ঠে বলল,
-” নীরব, প্লিজ এতবড় একটা অপবাদ দিবেন না। মানা যাচ্ছে না। আমি পারছি না মানতে।”
নীরবের টানটান পিঠের দিকে কাতর হয়ে চেয়ে প্রত্যাশা। নীরব ঘাড় ঘুরিয়ে একহাতে প্রত্যাশার হাত নিজের হাত থেকে ছাড়াল। বলল শান্ত কণ্ঠে,
-” লেট মি এলোন।”
ভেতরের ছোট্ট হৃদয় দুমড়েমুচড়ে গেল। তবুও নিজেকে সামলাতে, শক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করল প্রত্যাশা। ঝট করে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল বেয়ে পড়া জলের কণাগুলো মুছল। কান্না আটকিয়ে স্থির গলায় বলল,
-” আজ যা যা বললেন….যদি কখনো জানেন আমি সত্যিই নির্দোষ ছিলাম, তখন কী করবেন? ফিরিয়ে নিতে পারবেন কি আজকের এই কথাগুলো? পারবেন কি চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে, ‘ভুল করেছি’? জানেন তো, একটা কথা খুব শোনা যায়; বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি দুটোই একবার বেরিয়ে গেলে আর ফেরত নেওয়া যায় না। আজ আপনার কথাগুলোও ঠিক সেরকমই আ’ঘা’ত করেছে আমাকে। আপনার কথায় আজ যে ক্ষত তৈরি হয়েছে আমার মনে, সেটা শুধু গভীর না। সেটা এমন একটা দাগ, যেটা হয়তো সারাজীবনেও শুকাবে না। আপনি তো আজ সন্দেহ করলেন, অবিশ্বাস করলেন। অথচ আমি শুধু চেয়েছিলাম বিশ্বাসটুকু। এটুকু কি খুব বেশি ছিল?”
প্রত্যাশার বলা প্রতিটি শব্দ শাণিত তীরের মতন নীরবের বুকে বিঁধল। নীরব থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রত্যুত্তর দিয়ে পারল না। নিজেকে এলোমেলো লাগছে ওর। হতাশ শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। প্রত্যাশা হাঁটু ভেঙ্গে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল। দুই হাতে মুখ চেপে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে লাগল। চার দেয়ালের নিস্তব্ধতায় কান্নার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। কান্নার চোটে ফ্লোরে বসে থাকা ছোট্ট ভাঙা শরীরটা কাঁপছে অবিরাম।
রাতের অন্ধকারে নীরব ছাদে দাঁড়িয়ে। মাথার ভেতর তীব্র শব্দের মতো বাজছে প্রত্যাশার কথা। আবার না চাইতেও ওই ছবিগুলো চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে। তক্ষুনি রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে।
নিরিবিলি পরিবেশে নীরব ভাবতে লাগলো। নিজের উপরও তার কম রাগ হচ্ছে না। মনের এক কোণে নিজেকে নিয়েই প্রশ্নের উদয় হলো—উফ! খুব বেশিই রিঅ্যাক্ট করা হয়ে গেলো না তো? আরেকটু ধৈর্য্য ধরে সবটা যাচাই করা উচিত ছিলো নয় কী?
আসলে হঠাৎ করে এমন সেনসিটিভ ছবি দেখলে যে কারোরই স্বাভাবিক থাকার কথা নয়। মানুষ তো, রোবট নয় তো। আকস্মিক রিঅ্যাক্ট করা অস্বাভাবিক নয়। তবুও কিছুটা অপরাধবোধ কাজ করছে নিজের মধ্যে।
_____________
রাতে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে আসে। এক বুক ভারী কষ্ট নিয়ে পাশের সোফায় মাথা এলিয়ে দেয় প্রত্যাশা। হাতটা মাথার নিচে গুঁজে, ভাবনার ভাঁজে হারিয়ে যায়। কখন যে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে, টেরই পায় না। ওভাবেই একসময় ঘুমে ঢলে পড়ে।
নতুন ভোরের সূচনা হয় বিষাদে। জানালার ফাঁক গলে আসা একফালি রোদের আলো চোখমুখে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে প্রত্যাশা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে খুঁজে বেড়ায় কাঙ্ক্ষিত মুখটিকে। কোথাও নেই সে। এমন সময় ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ ভেসে আসলো। পর মূহুর্তেই খট করে দরজা খোলার আওয়াজ এলো। নীরব বেরিয়ে আসে। একঝলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় প্রত্যাশা। এদিকে সারাটা রাত যে নির্ঘুমে কেটেছে নীরবের। তা ওই লাল চোখদুটো প্রমাণ দিচ্ছে। নীরব টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল,
-” সাড়ে সাতটা বাজে অলরেডি। ইচ্ছেকে বাসায় দিয়ে আসতে হবে, ওর স্কুল আছে। তুমিও রেডি থেকো, তোমাকেও নামিয়ে দিয়ে যাবো। বাড়তি ঝামেলা করার থেকে একসাথেই ড্রপ করে দিবো।”
প্রত্যাশা ভেতরে ভেতরে তীর্যক হেসে মনেমনে বলল—এতটাই ঘৃ”ণা করেন যে চোখের সামনে থেকে সরাতে, এত সকাল সকাল বিদেয় করার তোড়জোড় শুরু করেছেন।
___________
খাবার টেবিলে এক লোকমা খাবার মুখে তুলে গলাধঃকরণ করতে খুব কষ্ট হচ্ছে প্রত্যাশার। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। ওদিকে নীরব তো আগেই মা’কে বলল— এত তাড়াতাড়ি সে ব্রেকফাস্ট করবে না। ইচ্ছেকে যেনো ফাস্ট রেডি করিয়ে দেয়। ওদেরকে দিয়ে অফিসে গিয়ে সে কিছু একটা খেয়ে নিবে। পানি দিয়ে মুখের খাবার কোনো রকমে গিলে প্রত্যাশা ঝট করে উঠে দাঁড়াল। ইচ্ছেকে চেয়ারে বসিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে মাছ বেছে বেছে গালে তুলে খাইয়ে দিচ্ছিলেন নীহারিকা। প্রত্যাশাকে খাবার রেখে উঠতে দেখে সহসাই শুধালেন,
-” সে কি খাবার রেখে উঠছো যে। কিছুই তো খেলে না।”
প্রত্যাশা অজুহাত দিয়ে বলল,
-” আসলে এত সকাল সকাল নাস্তা করার অভ্যেস নেই তো, তাই খেতে পারছি না।”
-” অল্প করে কিছু খাও। এগুলো ভালো না লাগলে বলো, পরীকে বলি অন্যকিছু বানিয়ে দিতে।”
প্রত্যাশা মাথা নাড়িয়ে বলল,
-” নাহ, মা। তার দরকার নেই। আমার এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।”
-” আচ্ছা তাহলে ফ্রুটস জুসটা নাও।”
শাশুড়ির এত মমতায় প্রত্যাশার চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল। আড়ালে কান্না লুকাল। বলল অপরাধীর মতো করে,
-” আসলে মা আমার শরীরটা একটু কেমন জেনো লাগছে। জোর করে কিছু খেতে গেলে বমি পাবে। আর আমাকে এত করে বলার কিছু নেই। আমার খেতে মন চাইলে আমি তো হাত দিয়েই নিয়ে খাই।”
নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে কথাগুলো বলে জোর করে ঠোঁটের কোণে হাসি টানে প্রত্যাশা। নীহারিকা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-” তোমার চোখের পাতা ভারী, তারপর চোখদুটোও লাল লাগছে। শরীর ঠিক আছে তোমার?”
অতিরিক্ত কান্নার ফলে এমন হয়েছে। প্রত্যাশা হেসে বলল,
-” ঠিক আছি। তেমন কিছুই না। ওই একটু মাথাটা ধরেছে তাই।”
শর্মিলা কিচেন থেকে বেরিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এলেন। বললেন,
-” মাথা ধরেছে তাহলে এত সকাল সকাল তোমার যাওয়ার কী তাড়া? ইচ্ছের নাহয় স্কুল আছে। মিস গেলে ওর মা আবার কথা তৈরি করবে। তুমি আজ থাকো। পরে পাছে যেও। নীরবকে বলি… তোমাকে যেনো কাল পরশু দিয়ে আসে।”
প্রত্যাশার বুক ভার হয়ে আসছে। তড়িঘড়ি করে বলল,
-” নাহ, ছোটো মা। বলবেন না, প্লিজ। আসলে আমার প্রাইভেট আছে, ক’দিন পরেই তো পরীক্ষা। প্রাইভেটে পরীক্ষা চলছে। আজ বিকেলেও আছে। মিস গেলে নিজেরই ক্ষতি।”
গড়গড় করে মিথ্যে বলার চেষ্টা করে প্রত্যাশা। যদিও অল্প ক’দিন পরেই পরীক্ষা। তবে পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস হওয়ার মেয়ে ও কোনোকালেই ছিলো না।
ইচ্ছেকে রেডি করে নীহারিকা বললেন,
-” প্রত্যাশা, নীরব দ্যাখো রুমে আছে। যাবেই যেহেতু তাহলে আর দেরি করার কী দরকার! ইচ্ছের স্কুলের টাইম হয়ে আসছে আবার। নীরবকে বলো, ইচ্ছে রেডি।”
প্রত্যাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইচ্ছের কাঁধে দুই হাত রেখে বলল,
-” ইচ্ছে, তোমার পাপাকে গিয়ে বলো আমরা রেডি।”
ইচ্ছে ঘাড় কাত করে জবাবে ‘আচ্ছা’ বলে।
.
.
নীরব ইচ্ছেকে মাঝখানে বসিয়ে দেয়। প্রত্যাশার সামনে ইচ্ছে তারপর নীরব। বাইক ছুটে চলেছে শোঁ শোঁ বাতাসের সাথে। প্রত্যাশার মনে হয়—-এই একদিনেই যেনো দু’জনের মাঝে চীনের মহাপ্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে। এই প্রাচীর ভাঙা কি আদৌ সম্ভব?
বাড়ির গেইটের সামনে বাইক থামায় নীরব। মুখে একটাও কথা নেই। প্রত্যাশা নেমে দাঁড়ায়। ইচ্ছের মাথায় হাত বুলিয়ে মুখে ম্লান হাসি নিয়ে বলে,
-” বাই, ইচ্ছে।”
নীরব সৌজন্যমূলক কিছু বলল না। প্রত্যাশাও অদ্ভুত এক জড়তায় চুপ করে রইল। পা বাড়াতে গিয়েও হঠাৎ থেমে যায় প্রত্যাশা। নীরব আচমকা বলে উঠল,
-” সুস্থ তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, অমনই সুস্থ তোমাকে রেখেও গেলাম। যেটা আমার দায়িত্ব ছিলো।”
প্রত্যাশার পা জোড়া থেমে গেল। ফিরে তাকিয়ে নীরবের চোখে চোখ রাখল। ভেতরের চাপা কষ্ট নিয়ে মিহি কণ্ঠস্বরে বলল,
-” আমি জানি, আমি অনেকের কাছেই বিরক্তিকর। তবুও আজ একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। আমি কি খুব বেশি উচ্ছৃঙ্খল? আমি কি খুব বেশিই বেপরোয়া?”
নীরব নিশ্চুপ, নিরুত্তর। প্রত্যাশার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। ও উত্তরের অপেক্ষাও করল না। প্রশ্নগুলো রেখে ওর মতো চলে গেল। বড় কদম ফেলে লহমায় চোখের আড়ালে।
___________
ইচ্ছেকে বাসায় দিয়ে অফিসে আসতে আসতে নীরবের নয়টা পার হয়ে যায়। নিজের অফিসকক্ষে চেয়ারে গা এলিয়ে চোখবুঁজে বসে নীরব। মনে মনে একের পর এক প্রশ্ন তৈরি করছে। একটা প্রশ্নেরও সঠিক উত্তর নেই। ভাবছে রীতিমতো—- ছবিগুলো সেন্ড করল কে? ছবির দৃশ্য যা বলছে তা কী সব সত্যি? নাকি আমাকে বিভ্রান্ত করতে কেউ এসব করেছে? আর কে সে? তার উদ্দেশ্যই বা কী?
ঘুরেফিরে একটা নামই মস্তিষ্কে সিগন্যাল দেওয়ার মতো বারবার আসছে। এসবের পিছনে কী— সার্থক?
কারন ওই তো প্রত্যাশাকে পছন্দ করতো। আর ছবিগুলোও তো ওরই সাথে।
নীরব সোজা হয়ে বসল। টেবিলের উপর হাত দু’টো নামাল। টেবিলের উপর থাকা অফিশিয়াল ফাইল খুলতে গিয়েও আজ এক পাশে ঠেলে রাখল। ফোন ওপেন করল। ফাটা গ্লাস কাল রাতের রাগ-ক্ষোভকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলো। নীরব সেই নম্বরে কল করল। ওপাশ থেকে মেয়েলি মিষ্টি গলা এলো,
-” দুঃখিত, কাংখিত নম্বরে সংযোগ প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর ডায়াল করুন।”
নীরব অবাক হলো না। কারন কাল রাতেও কল দিয়ে বন্ধ পেয়েছে। নীরব ত্রস্ত কল লিস্ট থেকে একটা নম্বরে কল লাগাল। রিসিভ হতেই আদেশের সুরে বলল,
-” আমি এখনই আপনাকে একটা নম্বর মেসেজ করব। দয়া করে যাচাই করে দেখবেন নম্বরটা কোন আইডির নামে রেজিস্টার করা হয়েছে, কখন কোথায় সিমটা একটিভ হয়েছে। সবকিছু বিস্তারিতভাবে আমাকে জানাবেন। রিপোর্টটা আমার চাই। আই নিড দ্য ফুল রিপোর্ট অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। দিস ইজ আরজেন্ট। নো ডিলেস, প্লিজ।”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |২৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
রাত্রি এগারোটা দশ। প্রত্যাশা জানালার গ্রিল দু’হাতে ধরে দাঁড়িয়ে। আকাশে কালো মেঘের ভেলা বাতাসের সাথে যেনো উড়ছে। মূহুর্তেই মিটিমিটি আলো ছড়ানো চাঁদটাকে গ্রাস করে নিল একদল মেঘেরা। প্রত্যাশার মনেও ঘনকালো মেঘ জমেছে। বিষণ্ণতায় ডুবে আহত হৃদয়ে ছলছল চোখে শুণ্যে তাকিয়ে মেয়েটা। কাল রাতে নীরবের বলা প্রতিটি কথা সূচের মতো বুকে বিঁধছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।
রুমের ভেতরটা অন্ধকার। ভেজানো দরজার ফাঁক ফোকর গলে আবছা আলো রুমে ঢুকছে। সেই আলোয় প্রত্যাশাকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখে অধরার ভ্রু বেঁকে যায়। একহাতে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই ঘরটা ফকফকা আলোয় ঝলমল করে ওঠে। চমকে ওঠে চকিতে ঘুরে তাকায় প্রত্যাশা। অধরা এগিয়ে এসে ভাতের প্লেট, গ্লাস বেড টেবিলে রেখে শুধালেন,
-” প্রত্যাশা? লাইট নিভিয়ে, ঘর অন্ধকার করে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
প্রত্যাশা তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছল। গলা সামলে আমতা আমতা করে বলল,
-” ই-ইয়ে মানে, জানালার পর্দা ঠিক করছিলাম।”
-” অন্ধকারে পর্দা ঠিক করতে গেলি?”
মা’কে কোনো কিছু বুঝতে দিতে চায় না প্রত্যাশা। তাই নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক দেখাতে মিথ্যে বলল,
-” শুতে যাচ্ছিলাম, তখন খেয়াল হলো। তাই…”
-” আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। এবার আয় তো খেয়ে নে। সেই দুপুরে কী একটু খেলি, দেখলাম না। আবার এখন বলছিস পেট ভরা, খাবি না।”
প্রত্যাশা মুখটা ছোট করে বলল,
-” আম্মু খা….”
অধরা কথা কেড়ে নিলেন। শাসিয়ে উঠলেন,
-” একদম বেশি কথা বলবি না। আয় আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তোর পছন্দের সর্ষে ইলিশ করেছি আজ। তোর না খুব পছন্দ!”
আম্মু শুনবে না তাই অগত্যা প্রত্যাশা বিছানার একপাশে চুপটি করে বসল। অধরা ভাত মাখিয়ে এক লুকমা তুলে গালের সামনে ধরলেন। মেয়ের মুখটা স্বাভাবিক লাগলো না। সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-” মুখটা ওমন শুকনো লাগছে, মন মরা ঠেকছে, কিছু হয়েছে কী? হ্যাঁ রে প্রত্যাশা সবকিছু ঠিক আছে তো?”
বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল প্রত্যাশার। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে বলতে ইচ্ছে করল— আম্মু সবকিছু ঠিক নেই। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। উনি আমায় বিশ্বাস করলেন না। কত কী বললেন। আমি সেসব মেনে নিতে পারছি না। আমার ভেতরটা কষ্টে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি কাউকে কিছু বলতেও পারছি না। ভ’য় হচ্ছে, সবাই আমাকেই দোষারোপ করবে, অবিশ্বাস করবে। কেউ আমায় বুঝবে না। আর আমি জানি না, আমি কীভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো? আমার কী করা উচিত আমি সেটাও বুঝতে পারছি না।
নিজেকে সামলাল প্রত্যাশা। কথাগুলো বলতে পারল না। সবটা দু’জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইল। দৃঢ় মনোবল আর বিশ্বাস নিয়ে মনটাকে শক্ত করল। কতটুকু শক্ত হলো জানে না। তবুও মন বলছে—- যেহেতু আমি জানি, আমি সজ্ঞানে কোনো অন্যায়, পাপ করিনি। তাই একদিন না একদিন সত্যিটা সামনে আসবেই। মিথ্যে বিলুপ্ত হবে। সেদিন অবিশ্বাস ভাঙ্গবে। তারপর ক্ষতও হয়তো শুকাবে। তবে শুকালেও ক্ষ’তের ফলে থেকে যায় যে একটা সুক্ষ্ম দাগ। সে দাগটা কী পুরোপুরি মিলানো সম্ভব?
পৃথিবীতে হাজারো কষ্ট-বেদনা, গুমরে ম*রা, ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, আড়ালে কান্নার স্রোত বয়ে ফেলা, এসব কিছুকে আড়াল করার একমাত্র হাতিয়ার—হাসি। হাসির আড়ালে সকল কষ্ট, যাতনা নিমিষেই অন্যদের অগোচরে রাখা যায়। সব কষ্ট ভেতরে ঠেসে প্রত্যাশা ফট করে ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে নিলো। বলল গমগমে স্বরে,
-” কই না তো, কিছু হয়নি তো। আর মন ম’রা লাগবে কেনো, এইতো আমি হাসছি, খাচ্ছি। ঠিকই তো আছে সব।”
নিজ হাত দিয়ে মায়ের হাতটা মুখের সামনে ধরল প্রত্যাশা। চটজলদি খাবার মুখে নিলো। অধরা হঠাৎ বললেন,
-” নীরব আজ ভেতরে এলো না যে? দেখা করেও তো যেতে পারতো।”
-” ইচ্ছে সাথে ছিলো। ইচ্ছেকে দিয়ে উনাকে অফিসে যেতে হবে। তাই নামলেন না।”
-” ওহ্।”
ফের কিছু মনে পড়ার ভঙিতে বললেন অধরা,
-” সেই সকালে এসে থেকে তোকে চুপচাপ দেখছি। বাইরেও বের হচ্ছিস না। আমি ভাবলাম ও বাড়ির কেউ কিছু বলেছে নাকি।”
প্রত্যাশা জোর করে মুখের হাসিহাসি ভাব ধরে রাখল। ব্যথাতুর হৃদয়টা ভেঙে যাচ্ছে নিঃশব্দে। তবুও বলল ভেঙে ভেঙে,
-” ও বাড়ির সবাই কত ভালো না? ওরা কিছু বলবে, আম্মু তোমার মাথা ঠিক আছে! ওনারা সবাই তো আমাকে কত আদর করে।”
অধরা প্রশান্তির সহিত হাসলেন। সায় দিয়ে বললেন,
-” হ্যাঁ নিভানদের ফ্যামেলিটা খুব ভালো। ছেলে ভালো, ফ্যামেলি ভালো, সবকিছু পজেটিভ দেখেই তো নিভানের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গেলাম। নইলে কী আমার পা’গ’লি মেয়েটাকে এত তাড়াতাড়ি পরের বাড়ি পাঠাতে রাজি হতাম?”
প্রত্যাশার মুখটা নিমিষেই মিইয়ে গেল। আকস্মিক মনে উঠল— নীরব কীসের দয়া দেখিয়েছে?
মনে মনে উত্তর সাজাল। নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেই আওড়ায় —-আমি কোনো দিক থেকেই উনার যোগ্য নই। শুধুমাত্র বাবার কথায় বিয়েটা করে দয়া দেখিয়েছেন, উনি হয়তো এটাই বলতে চেয়েছেন?
কথাটা প্রত্যাশার বুকের এফোঁড়ওফোঁড় বিঁধে আছে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে এলো।
.
প্লেট রেখে হাত ধুয়ে মেয়ের রুমে ফের এলেন অধরা। দরজার ওপার থেকেই হাঁক ছেড়ে বলতে বলতে আসলেন,
-” প্রত্যাশা দ্যাখ তো, কোন ডিজাইনটা তোর মনে ধরে।”
প্রত্যাশা বিছানার হেডে গা এলিয়ে বসেছিল। সোজা হয়ে বসে মায়ের দিকে প্রশ্নবোধক চাউনিতে তাকাল। অধরা পাশে বসে ফোনটা ধরলেন মেয়ের সামনে। একটা একটা পিক বের করলেন আর জিজ্ঞেস করলেন—কোন ডিজাইনটা বানাতে দিবেন। প্রত্যাশা নির্বাক। ও কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। অধরা উৎসুক চোখমুখে বললেন,
-” ছবির ডিজাইন দেখে বল। ভেবেছি দুএকদিনের মধ্যেই গহনা বানাতে দিবো। যেগুলো আছে সেসব কেমন পুরোনো ডিজাইন মনেহয়। নতুন করে একসেট না বানালে চলে? আর হাতে বেশি সময়ও নেই। এই তো পরের সপ্তাহ থেকে তোর পরীক্ষা শুরু। দেখতে দেখতে, চোখের পলকে পরীক্ষার দিনগুলো চলে যাবে। তারপরই তো বিয়ের অনুষ্ঠান। তখন তাড়াহুড়োর মধ্যে ভালো হবে না, তাই এক্ষুনি ধীরেসুস্থে সব এগিয়ে রাখছি।”
থেমে ফের বললেন,
-” কালকে নীলা আসবে। ওর সাথে স্বর্ণকারের কাছে যাবো। তুই এখন বল কোনটা পছন্দ হলো?”
ফোনের স্ক্রিনে চোখজোড়া থাকলেও মন আছে শুণ্যতায়। প্রত্যাশার এসব কিছু ভালো লাগছিলো না। যেখানে নীরব নিজে বলেছে, সম্পর্কটা অনিশ্চিত। সেখানে বিয়ের অনুষ্ঠান, গহনা-গাটি সবকিছু প্রত্যাশার কষ্টকে দ্বিগুণ করল। ফাপরে পরার মতো শ্বাস ফেলল। বলল অধৈর্য হয়ে,
-” আম্মু, যেকোন একটা চুজ করো তো। আমার ভালো লাগছে না।”
অধরা কিছুটা হতাশ হলেন। মুখ গোজ করে বললেন,
-” তোর জন্য গড়াচ্ছি, তুই নিজে পছন্দ করবি না?”
যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সেখানে এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করতে ইচ্ছে করল না। নিজেকে সামলে, বলল কোন রকমে,
-” এবারের মতো আমার পছন্দটা তোমার আর আপুর উপর দিয়ে দিলাম। তোমরা একটা পছন্দ করে নিও। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।”
অধরা বললেন,
-” আচ্ছা, ঠিক আছে। এইযে দেখালাম, হাজারবার পইপই করে বললাম। পাছে পছন্দ না হলে কিছু বলতে পারবি না কিন্তু।”
এই বলে অধরা উঠে দাঁড়ালেন। চলে যেতে শশব্যস্ত হলেন। তন্মধ্যে প্রত্যাশা শুণ্যে তাকিয়ে আচমকা অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠল,
-” আম্মু, একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে? যা বলবে ভেবে সত্যি করে।”
অধরা চিন্তিত বদনে চাইলেন।
-” হুঁ, বলবো। তবে কী কথা?”
-” রাগের সময় যা বলা হয়, সেসবই কী মনের কথা থাকে? মুখ ফস্কে সত্যিটাই কী বেরিয়ে আসে?”
অধরা মেয়ের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। কিছু বোঝার চেষ্টা করলেন। না বুঝলেও কিছু অনুমান করলেন। পর মূহুর্তে পাশে বসে ধীরে ধীরে শান্ত গলায় বললেন,
-” না মা, সব কথা ধরে নিতে নেই। রাগের সময় মানুষ অনেক কিছু বলে ফেলে; যা তার মনেও ছিল না, এমনকি যার অর্থ কী, সেটাও ভাবে না। তখন মাথা গরম থাকে, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। নিজের কথার ওজন বুঝে ওঠার মতো অবস্থায় থাকে না সে।”
একটু থেমে আদর করে প্রত্যাশার মাথায় হাত রাখলেন। মৃদু হেসে বললেন,
-” এইযে দেখিসই তো রাগ হলে ঝ’গড়ার সময় তোর আব্বুকে কীভাবে ঝাড়ি।”
থেমে সিরিয়াস ভাবে ফের বললেন,
-” তোর আব্বুকে রেগে অনেক কিছু বলে ফেলেছি জীবনে। কিন্তু তার মানে এই না, আমি সব সত্যি মনে করেই বলেছি। সম্পর্ক থাকলে রাগারাগি, ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়। যা রাগের মাথায় বলা সেসবই সত্যি নয়। রাগের মাথায় বলা কথা ধরলে এই পৃথিবীর ৯০% নারী পুরুষের সংসার টিকতো না। রাগের সময়কার কথা না ধরে, ভালো ভালো বিষয় বড় করে ধরতে হয়। দেখতে হয় সে শুধু রাগই করে, নাকি তার ভালো, যত্ন, আগলে রাখা এসব ব্যাপারও আছে। সব মিলিয়ে একজনকে বাছবিচার করতে হয়। তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হয়।”
নিজের জীবনের উদাহরণ টেনে মেয়েকে বুঝালেন অধরা। তবে জিজ্ঞেস করলেন না। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য হতেই পারে। কোনো সমস্যা হলে দুজনেই মিটমাট করে নিবে। মেয়ে যেহেতু নিজ থেকে কিছু বলছে না, তাই আগ বাড়িয়ে আর কিছু শুধালেন না। মেয়ের বুদ্ধি বাড়ুক, বুঝ আসুক, সুখে-শান্তিতে থাকুক — মনেমনে শুধু এই প্রার্থনাটুকুই করলেন।
প্রত্যাশার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল—-নীরবের কেয়ারগুলো। বিয়ের পর থেকে নীরবের এক্টিভিস্ট গুলো আওড়ালো। সেখানে সেই শুরু থেকে নীরবকে ওর প্রতি যথেষ্ট কনসার্ন কেয়ারিং পেয়েছে। সেদিন সবার সামনে নিজেকে খাটো করেছে, কথা শুনেছে। তবুও প্রত্যাশাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে দেয়নি।
প্রত্যাশার নিজের এক্টিভিস্টের খাতায় নিজেকে শুণ্যে পেলো। এখন অবধি নীরবের প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেছে কী? আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্ত্রী সুলভ আচরণটুকু কখনো শো করেছে কী? হয়তো ওভাবে সুযোগ আসেনি। তবে উনি যে সার্থককে পছন্দ করেন না তা বোঝানো হয়েছে, বলাও হয়েছে। তবুও প্রত্যাশা বোঝার চেষ্টাটুকু করা দূর আরো যেনো হেসে উড়ে দিয়েছিলো। ইশশ্! নীরবের সেই কথাটা শুনলেই তো আজ এতদূর আসে না। হয়তো এই সমস্যাটুকু আসতো না জীবনে।
_____________
রাত গভীর। বাড়ির সবাই ঘুমের অতলে তলিয়ে আছে। ঘুম নেই নীরবের চোখের পাতায়। হাতে কফির মগ। এইতো মাত্র সে নিজে বানিয়ে আনল। কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে। সিম সার্থকের এনআইডি দিয়ে খোলা। সিম বন্ধ থাকার জন্য সিমের মালিকের অবস্থান ট্্যাক করা যায়নি। তবে সিমটা সার্থকের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা থাকায় সমীকরণ দাঁড়াচ্ছে—- সার্থক নিজেই কী তবে নীরবকে খাটো করতে, নীরব-প্রত্যাশার সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ছবিগুলো পাঠিয়েছে?
যেহেতু সার্থক প্রত্যাশাকে পছন্দ করতো। তাই সবকিছুর নীল নকশাকারী স্বয়ং সার্থক হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। এখন কুয়াকাটায় সেদিন কী ঘটেছিল? কীভাবে ঘটেছিলো? ঘটানো হয়েছিলো? সব উত্তর জানতে কুয়াকাটা যাওয়া জরুরী। অতবড় নামকরা বিলাসবহুল হোটেলের কোণায় কোণায় নিশ্চয় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেসব চেক করে যদি কিছু পাওয়া যায়।
এদিকে অফিশিয়াল ডিউটি থাকায়। সামনের দু-তিন নীরব খুব ব্যস্ত থাকবে। তাই দু-তিনের মধ্যে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আবার এমন একটা ব্যাপার অন্যের উপর দায়িত্বও দেওয়া যায় না। নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারটা নীরব নিজেই দেখবে। হোক একটু দেরি।
মাথার মধ্যে ভনভন করছে দুশ্চিন্তা। নীরবের নিজেকে এলোমেলো লাগছে। ভালো লাগছে না কোনো কিছুই। কোনো কিছুতেই এক দন্ড শান্তি মিলছে না। কিছু একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। উফ্! প্রত্যাশার ক্রন্দনরত মুখটা চোখের সামনে ভাসছে বারবার।
ঠান্ডা, তেতো, স্বাদহীন শেষ কফিটুকু এক চুমুকে গিলে নেয় নীরব। চারিপাশের নিস্তব্ধতা গুমোট হয়ে মাথার ভেতর শব্দ তুলছে। আকস্মিক ভাবল প্রত্যাশার রেখে যাওয়া প্রশ্ন নিয়ে —–
-” উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া মেয়ের সংজ্ঞা কী?”
চোখ বন্ধ করে ভাবল। প্রত্যাশার মুখ ভেসে উঠল—
না, ওকে একেবারেই সেরকম বলা যায় না। ও চঞ্চল, আবেগপ্রবণ। বয়স অনুযায়ী একটু বেশিই ইম্যাচিউর বটে, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া বলা যায় না। বুঝিয়ে বললে ও শোনে। তবে নিজের প্রতিই ও সচেতন নয়। প্রত্যাশা খুব সরল। সরলভাবে দুনিয়া দেখে। আর দেখে বলেই সবসময় বিপদের মধ্যে হেঁটে যায়। বারবার বিপদে জড়িয়ে পড়ে।
প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ভাবে নীরব— ওর বয়স অল্প, কিন্তু অভিজ্ঞতার ঘাটতি যেমন অনেক। দুঃখের বিষয় ও কিছুতেই শিক্ষা নেয় না। নিজেই নিজেকে বিপদে ফেলতে উস্তাদ।
নীরব ক্লান্ত ভঙিতে চোখদুটো বুঁজে নিল। চেয়ারের হেডে কাঁধ এলিয়ে মনেমনে বলে ওঠে,
-” যদি সত্যিই ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়, তবু এক ফোঁটা দোষ হলেও ওর আছেই। আমি ওকে কতবার বলেছি, সাবধান হতে। বুঝিয়েছি ইভেন বলেছি সার্থকের থেকে দূরে থাকতে। আজ আমার এই কথাটা অন্তত শুনলে, আজ এতবড় অঘটন ঘটে না।”
এই কথাটা মনে উঠলেই নীরবের প্রচন্ড রাগ হয়। তখন পজিটিভ চিন্তাগুলোও কেমন দূর্বল হয়ে আসে। ভেতর থেকে রাগ-ক্ষোভ হতাশা আবার বেরিয়ে এল,
-” একটা মেয়ের বেসিক কিছু কমন সেন্স থাকে, যা প্রত্যাশার নেই। একটা ছেলের চোখের ভাষা মেয়েরা খুব সহজেই পড়তে পারে। এটা বোঝার একধরনের সহজাত প্রবৃত্তি থাকে মেয়েদের। এদিকে প্রত্যাশা মাত্রারিক্ত নির্বোধের পরিচয় দিয়ে থাকে। ওর নিজের প্রতি কোনো রকম সতর্কতা নেই। কোনো প্রটেকশন নেই। বরং প্রত্যাশা এমন পরিবেশ তৈরি করে ফেলে, যেখানে অপরপক্ষ আরও এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। একটু নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ থাকলেও আজ এই পরিস্থিতি আসত না।”
_____________
সকাল থেকেই আষাঢ়ের আকাশ ভারী মেঘে ঢাকা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল খাতায় স্বাক্ষর নিতে প্রত্যাশা কলেজে এসেছিলো। পরনে আকাশি-সাদা ইউনিফর্ম, পিঠে ব্যাগ, মাথার ওপর ব্যান্ড দিয়ে চুলগুলো ঝুঁটি করে বাঁধা। এক হাতে ছাতা ধরে ফুটপাত ধরে হাঁটছিল।
হঠাৎ ওর চোখ পড়ল— দেয়াল ঘেঁষে বসে থাকা এক পা’গ’লী মা তার কোলের ছোট্ট শিশুকে ছেঁড়া, ময়লা ওড়নার নিচে লুকিয়ে রাখছে। বৃষ্টির পানিতে যেন ভিজে না যায়। দৃশ্যটা হৃদয় ছুঁয়ে গেল। প্রত্যাশার মনে হালকা কষ্টের স্রোত বয়ে গেল। অস্ফুটে ‘আহারে’ বলে ছাতাটা পা’গ’লীর মাথার ওপর ধরে বলল,
-” এটা তুমি রাখো। একটু হলেও কাজে লাগবে।”
পাগ’লীটি কিছু বলতে পারল না, তবে তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ প্রশান্তি ও কৃতজ্ঞতার হাসি। একটু দূরের একটি টং দোকান থেকে প্রত্যাশা পাউরুটি আর কলা কিনে এনে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ফের হাঁটতে শুরু করল।
আজ দু-তিন হতে চলেছে না নীরব ফোন দিয়েছে আর না তো প্রত্যাশা। এরমধ্যে দুজনের দেখা, কথা কিছুই হয়নি। সবার সামনে স্বাভাবিক আচরণ করলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। নাম না জানা ব্যথায় হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে।
বিষণ্ণ চিত্তে হাঁটছে প্রত্যাশা। রিকশার দেখা মিলছে না। বৃষ্টির শব্দ ততক্ষণে তীব্র হয়েছে; গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির জায়গায় এখন ঝমঝমিয়ে ঝরছে। ভিজে যাচ্ছিল প্রত্যাশা, অবশেষে এক চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ করে উঠল। হঠাৎ চোখ পড়ল সাদা জুতোর দিকে, এক পায়ের ফিতেটা খুলে গেছে। হাঁটু মুড়ে বসে ফিতা বাঁধতে লাগলো প্রত্যাশা। এমন সময় রাস্তার পাশে জমে থাকা কাঁদা পানির উপর দিয়ে ছুটে এলো একটি বাইক। ছিটকে উঠে কাদা পানি প্রত্যাশার পোশাকে আর মুখে লাগে।
প্রত্যাশা রাগি দৃষ্টিতে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। বাইকে তিনজন হ্যাংলা-পাতলা ছেলে। বাইকটা সামনে গিয়ে থামল। তারা হুড়মুড় করে ছাউনির তলায় ঢুকে পড়ল। প্রত্যাশা রাগে গজগজ করলেও মুখে কিছু বলল না।
ছেলে তিনটেকে দেখতেই বখাটে লাগছে, একজনকে অবশ্য চেনে প্রত্যাশা। ওদের সাথেই পড়ে, তবে নামকা ওয়াস্তে পড়ে। বখাটেপনাই করে বেড়ায়। ছেলেগুলো ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে প্রত্যাশাকে স্ক্যান করতে থাকে। মূহুর্তেই সিগারেটের ধোঁয়ায় চারিপাশ ছেয়ে যেতে থাকল। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে একজন হেরে গলায় গান ধরল, আরেকজন সিটি বাজাতে লাগালো। প্রত্যাশা খুকখুক করে কাশল। ওর অস্বস্তি হচ্ছে।
.
নীরবকে সিভিল ড্রেসে পাঠানো হয়েছে একজন ব্যবসায়ীর সাথে দেখা করতে, যে কিনা গোপনে মা’দক পা’চারের সাথে জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্রে সন্দেহ করা হয়েছে। পু’লিশ সরাসরি গ্রেপ্তার না করে আগে প্রমাণ সংগ্রহ করতে চায়। নীরব ক্লায়েন্ট সেজে সেই ব্যক্তির সাথে কফিশপে কফি খেতে খেতে কথার ছলে সন্দেহভাজনের থেকে তথ্য জোগাড় করছে।
বিদায় নিয়ে কফিশপের থেকে বের হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নীরব। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কালো প্যান্টের উপর কালো শার্ট ছেড়ে দিয়ে পড়া। চোখে কালো সানগ্লাস। কানে এয়ারপড। হাতঘড়িতে সময় দেখে কানের এয়ারপডটা নাড়ল। ফিসফিসিয়ে কিছু বলল। শেষে বলল,
-” তিনটার দিকে*** এলাকায় পুলিশ ফোর্স পাঠিয়ে দিতে হবে। সব রেডি রাখতে হবে।”
-” ওকে স্যার।”
এরমধ্যে আচমকা নীরবের দৃষ্টিজোড়া খানিকটা দূরে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
.
প্রত্যাশা একপাশে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে। একজন হঠাৎ বলে উঠল,
-” কি আপু, বৃষ্টি ভালো লাগে? না কি ছায়া বেশি পছন্দ? নাকি ঝলমলে রোদ?”
আরেকজন ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
-” আপু কিছু বলছেন না যে, কী খাবেন বলুন? এক্ষুনি অর্ডার করছি।”
তৃতীয়জন বলল,
-” ঠান্ডার দিনে হট-হট কিছু দে রে। আপুও হট হোক আমরাও…..”
প্রত্যাশার মুখ লাল হয়ে যায় রাগে। গর্জে ওঠে,
-” ভদ্র ভাষায় কথা বলুন।”
ছেলেগুলো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে বলল,
-” ওরে ম্যাডাম রেগে গেছে দ্যাখ! আহারে।”
প্রত্যাশার ভীষণ খারাপ লাগলো। মনে হচ্ছে ভাগ্যই খারাপ। সবসময় সমস্যা ওর কাছে আসে না, ওই যেনো সমস্যার কাছে এগিয়ে আসে। কান্না পেল প্রত্যাশার এখানে এক মূহুর্তও দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না। বৃষ্টির মাঝে রাস্তায় নেমে পড়ল। লম্বা কদম ফেলে এগিয়ে যেতে নিয়ে হঠাৎ হাতে টান পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে…
#চলবে