মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৩০+৩১+৩২

0
8

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ঘাড় ঘুরিয়ে নীরবকে দেখে এক সেকেন্ডের মধ্যে বিস্ময়ে জমে গেল প্রত্যাশা। অবিশ্বাস্য চোখে একবার হাতের বাঁধনের দিকে চাইল, পরপর মুখ তুলে নীরবের মুখের দিকে। কোনো কিছু ঠাহর করার আগেই নীরব এক ঝটকায় টান দিয়ে প্রত্যাশাকে ছাউনীর তলায় নেয়। নীরবের গায়ের কালো শার্ট ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। ভেজা চুল থেকে টুপটাপ পানি ঝরছে। নীরব প্রত্যাশার হাত ছেড়ে চুল ঝাড়তে লাগল।

রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ চারদিক ঢেকে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু ছেলেগুলোর ভেতরকার শয়’তানি যেন মেঘের গর্জনের মতো গুঁড়গুঁড় করে উঠছে। একজন চোখমুখ কুঁচকে হেসে বলল,

-” এইযে ম্যাডাম একটু আগেই না খুব ভাব দেখালেন। আরে আমরা তো কেবল মুখ দিয়ে একটু ইয়ার্কি করেছিলাম মাত্র, এখন যে আরেকজন সোজা হাত ধরল। তাও কিছুই বললেন না। তখন যে খুব ভালো সেজে চেতে উঠলেন।”

সাথে সাথে প্রত্যাশাদের সাথে পড়া ছেলেটা বলে উঠল,

-” আরে মনেহয় ছোঁয়াতে সুখ পেয়েছে। আর এ বলবে কী! যে কী না কলেজ থেকে ট্যুরে গিয়ে হারিয়ে যায়। নাগরের সাথে সারাদিন কাটিয়ে…..”

প্রত্যাশা অস্বস্তি, অপমানে জড়সড় হয়ে দৃষ্টি নুইয়ে নিল। এরমধ্যে ঠাস, ঠাস শব্দে চারিপাশ কেঁপে উঠল। নীরব দুটোর গালেই সজোরে চ’ড় বসায়। চ’ড় খেয়ে কথা হারিয়ে ছেলেটি ধড়ফড় করে একপাশে কাত হয়ে পরে। আরেকজন গালে হাত দিয়ে রা’গি দৃষ্টিতে তাকায়। সামনাসামনি বুক চওড়া করে নীরব দাঁড়াল। চোখদুটো রাগে লাল টকটক করছে, চোয়াল কঠিন করে বলল,

-” আরেকটা শব্দ বলবি তো দাঁত ভেঙে ফেলবো। মেয়ে দেখলেই তোদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, না? অ’শ্লী’ল বলার জন্য জিভ লকলক করে? জিভ টেনে ছিঁড়ে মেয়েদের টিজ করার সাধ মিটিয়ে দিবো।”

তৃতীয়জন বুক টানটান করে এগিয়ে এসে বলল,

-” এই আপনে সাহস পান কই থেকে? আমার বন্ধুদের চ’ড় মারেন। কথা নাই বার্তা নাই গায়ে হাত তুলেন। আবার শাসাচ্ছেন, হিরোগিরি দেখাচ্ছেন?”

কফিশপের সামনে থেকে প্রত্যাশাকে লক্ষ্য করে নীরব। ছেলেগুলো যে টিজ করছিলো বোঝাই যাচ্ছিলো। দ্রুত আসে, এদিকে প্রত্যাশা কোনোদিকে না তাকিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই চলে যেতে নেয়।

ছেলেটা সাহস দেখিয়ে তেড়ে আসতে নিতেই নীরব নাক বরাবর দিল এক ঘু’ষি। মূহুর্তেই গলগল করে র”ক্ত বেরোল। ছেলেটি একহাতে নাক চেপে ধরল। চোখ থেকে কালো সানগ্লাস খুলে শার্টের সাথে গুজল নীরব। তারপর কলার চেপে ধরে বলল,

-” ওকে নিয়ে মজা নিচ্ছিলি, না? টিজ করছিলি। এখন এই মুহূর্তে ওর পা ধরে ক্ষমা চাইবি। স্টুডেন্ট মানুষ তাই দয়া করে জেলে পুরলাম না। এবারের মতো দয়া করলাম।”

এই বলে কলার ধরেই প্রত্যাশার পায়ের কাছে ফেলল। প্রত্যাশা তো চমকে উঠে দু’পা পিছাল। নীরব বাকি দুটোর দিকে তাকিয়ে আঙুল নাচিয়ে ইশারা করে, ছুঁড়ে ছুঁড়ে বলল,

-” তোরা দু’টো দাঁড়িয়ে কেনো? বে’য়াদবির জন্য পা ধরে মাফ চা। বাঁচতে হলে যা বলছি ফাস্ট তাই কর।‌ কুইক।”

দু’জনের একজন শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে এক পা এগিয়ে কণ্ঠে তেজ নিয়ে বলল,

-” কোন হে চ্যাটের বা’ল তুমি? তোমার কথা শুনতে হবে। তিনজন মিলে ধরলে না পালানোরও সুযোগ পাবে না।”

নীরব শান্ত ভঙিতে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল। পরপর আইডি কার্ড বের করে সামনে ধরতেই ওদের গলা শুকিয়ে আসে। চৌদ্দ শিকে যাওয়ার ভয়ে প্যান্ট ভিজে যাওয়ার জোগাড় হলো। নীরব ধ’ম’কিয়ে উঠল,

-” সে স্যরি… ফাস্ট, বিফোর আই লুজ মাই পেইশেন্স।”

ধ’ম’কে কেঁপে ওঠে ওরা তিনজন হাঁটু মুড়ে প্রত্যাশার সামনে বসল।‌ মাথা নুইয়ে বলল,

-” স্যরি আপু, ভুল হয়েছে।”

নীরব কাটকাট গলায় বলল,

-” এভাবে নয় পা ধরে।”

নীরবের কথায় প্রত্যাশা স্তম্ভিত। ও ইতস্তত করছে। ছেলেগুলো নিরুপায়। পুলিশ ধরলে রক্ষে নেই, পুলিশের বারির কথা স্মরণ হতেই আত্মা শুকিয়ে এলো। সময় ন’ষ্ট না করে তিনটেই একসাথে হাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার পা ধরতে গেলে প্রত্যাশা চট করে পিছিয়ে যায়। বলল তড়িঘড়ি করে,

-” এই থাক থাক পা ছুঁতে হবে না।”

নীরব এক হাত পকেটে গুঁজল। অন্যহাতে চুল ব্যাক ব্রাশ করতে করতে বলল,

-” উঁহু! এভাবে কোমল স্বরে আপু বলে স্যরি বললে চলবে না। মুখটা সর্বোচ্চ অসহায় বানিয়ে বল– আম্মা ভুল করেছি, মাফ করে দিন।”

প্রত্যাশার চোখ ছানাবড়া। নীরব নির্লিপ্ত। প্রত্যাশা একবার নীরবের দিকে তাকিয়ে ফের ছেলেগুলোর দিকে তাকাল। ওরা অসহায় মুখ বানিয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে আপু থেকে আম্মাতেই আসলো,

-” আম্মা, মাফ করে দ্যান। ভুল হয়েছে আমাদের। দয়াকরে তাড়াতাড়ি মাফটা দিয়ে দিন।”

প্রত্যাশা হাত নেড়ে বলল,

-” হয়েছে হয়েছে, আর মাফ-টাফ চাইতে হবে না। করেছি মাফ।”

তিনটেই ঘাড় তুলে শুকনো ঢোক গিলে নীরবের দিকে তাকাল। একদম মিহি স্বরে ভ’য়ে ভ’য়েই বলল,

-” স্যার এবার যাই।”

-” যা। তবে আজকের কথা যেনো মনে থাকে। নেক্সট কখনো কোনো মেয়েকে অসম্মান করতে দেখলে সোজা লকআপে ভরব। আর হ্যাঁ, আজকের থেকে শিক্ষা নিবি।”

ছেলেগুলো মাথা কাত করে সায় দিয়ে দ্রুত ওঠে দাঁড়ায়। তারপর তুরন্ত তিনজন বাইকে চেপে মূহুর্তেই প্রস্থান করে।

প্রত্যাশা রাস্তা বরাবর তাকিয়ে ছিলো, এরমধ্যে নীরব টিস্যু পেপার প্রত্যাশার সামনে ধরে। প্রত্যাশা প্রশ্নাত্মক চাউনিতে তাকায়। নীরব বলল শান্ত কণ্ঠে,

-” মুখটা মুছে নাও।”

মুখের ডানপাশে তখনকার কাঁদা পানি শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। প্রত্যাশা মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। নিঃশব্দে টিস্যুটা নিলো। প্রত্যাশার অবচেতন মনটা বলে উঠল— আসলেই উনাকে বোঝা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। আমার দেওয়া ওনাকে মিস্টার আনপ্রেডিক্টেবল নামটা যথার্থ।

নীরব ত্রস্ত কল লিস্ট থেকে কল লাগাল। রিসিভ হতেই ব্যস্ত স্বরে বলল,

-” তানভীর তুমি কোথায়?”

-” স্যার, আমি তিন রাস্তার মোড়েই আছি।”

-” আচ্ছা, তুমি যেহেতু ওখানে আছোই। আমার একটা হেল্প লাগবে। যত দ্রুত সম্ভব একটা অটো বা সিএনজি***** পাঠিয়ে দাও।”

-” ওকে স্যার।”

-” থ্যাংকস।”

কোনো এক অদৃশ্য জড়তায় প্রত্যাশা কিছুই বলতে পারল না। নীরবও কিছুই না বলে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো। প্রত্যাশার তীব্র মন খারাপ হলো। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো— এখানে আমি ছাড়া অন্য মেয়ে থাকলেও কী উনি একই রকম আচরণ শো করতেন? পাশে দাঁড়াতেন? নাকি আমি ওনার বউ বলে ওই ছেলেগুলোকে শা”স্তি দিলো! যদি এটাই হবে উনি কিছুই বলছেন না যে।

অভিমানী মন ভাবল — এখনো হয়তো ঘৃ’ণা করেন আমায়। তাই তো কিছুই বলছেন না।

এরমধ্যে একটা সিএনজি আসল। নীরব প্রত্যাশাকে ইশারা করে বলল,

-” যাও, ওঠো।”

তারপর ভাড়া মিটিয়ে দিলো নীরব। প্রত্যাশা সিএনজিতে উঠে বসল। নীরব ড্রাইভারকে আদেশ স্বরুপ বলে পরপর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে— ঠিকঠাক যেনো পৌঁছে দেয়। কোনো সমস্যা হলে খবর আছে। নীরব এপাশে সরে প্রত্যাশার দিকে একপল তাকাল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তন্মধ্যে ভারী স্বরে হঠাৎ বলে উঠল প্রত্যাশা,

-” ঘৃ’ণাই যখন করেন, তখন এত ভালোবাসা দেখানোর কি দরকার ছিলো? এ__”

প্রত্যাশার কথার মাঝেই নীরব বলল,

-” ভালোবাসা দেখাইনি তো, এটা আমার দায়িত্ব ছিলো।

-” বাকিটা জীবন আমি কী শুধুই আপনার দায়িত্ব হয়ে রয়ে যাবো?”

-” যেদিন এই সম্পর্কটা থাকবে না, সেদিন আমার দায়িত্বটুকুও থাকবে না।”

প্রত্যাশার বুক কেঁপে উঠল। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল।এরমধ্যে সিএনজি চলতে শুরু করে।

নীরব ফোন বের করে অনলাইনে টিকিট কাটল। আজ রাত বারোটার গাড়িতে কুয়াকাটা যাবে সে। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়। তারপর সূত্র ধরে সবটা প্রুভ করা। ঠান্ডা মাথায় ভেবে নীরব একটা কথায় স্থির হয়— প্রত্যাশা সহজ-সরল, বোকাসোকা। তাই ওকে দিয়ে যে কেউ অনায়াসেই নিজের স্বার্থ হাসিল করে নিতে পারে।

নীরব এ-ও মনেমনে ভাবে—- প্রত্যাশার একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। ওর সাথে এখনই মিশে গেলে, ও সব ভুলে যাবে। আদর পেলে মানুষ পূর্বের খুঁটিনাটি সব ভুলে যায়, কিন্তু অবহেলা শেখায় কোথায় ভুল হচ্ছিল, কারনটা কী ছিলো! ঠিক যেমন ঘা না লাগলে কেউ শরীরের দুর্বল জায়গাটুকু টের পায় না।

______________

আষাঢ়িয়া বারিতে গাছগাছালি সিক্ত। গাছের সবুজ পাতা বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ করে পড়ছে। নীলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, এক হাতে গ্রিল খুটছে আর অন্য হাতে ফোন ধরে কথা বলছে। নীলার মন ভার। ওপাশ থেকে নিভান বলল,

-” নীলাশা তুমি এত আপসেট কেনো হচ্ছো? এক্ষুনি টেনশনের কিছু হয়নি। আমাদের সামনে আরো দীর্ঘ সময় পরে আছে।”

-” ধূর, এবারে আশা করেছিলাম কিছু একটা হবে। তেমন কিছুই হলো না। এ মাসেও হতাশ হলাম।”

-” ব্যাপার না সামনে হবে।”

-” শোনো, আমি ভেবেছি আজকে আমরা ডক্টরের কাছে যাবো। চেকাপ করাবো।”

-” নীলা আরেকটু দেখি?”

নীলা তেতে ওঠে বলল,

-” না, না, নাহ। আমি আর দেখতে-টেকতে পারব না। তুমি তো দুপুরে আসছোই। সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবে। ব্যস!”

নিভান শান্ত গলায় বুঝিয়ে বলল,

-” নীলা শোনো, আমি আমার এক ডক্টর ফ্রেন্ডের সাথে আলোচনা করেছিলাম, সে গাইনোকোলজিস্ট। ওর কথায় যা বুঝলাম, অনেকে কোনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছাড়াই প্রথম দিকেই কনসিভ করে। আবার অনেকের ছয়-আট মাস বা তারও বেশি সময় লেগে যায়। এটা নরমাল রেঞ্জের মধ্যেই পড়ে। এমনকি মেডিকেলি ধরা হয়; নিয়মিত ইন্টিমেট এবং কনট্রাসেপশন ছাড়াই এক বছরের মধ্যে যদি গর্ভধারণ না হয়, তখন সেটা ইনফার্টিলিটি হিসেবে ভাবা যায়। আমাদের তো বিয়ে হয়েছে সাত মাসও হয়নি। তাই এই মুহূর্তে চিন্তা করার বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আরেকটা মাস দেখে নিই। তারপর যদি না হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা পরবর্তী ধাপে যাবো। কেমন?”

বান্ধবী তারপর ভাবি-টাবিদের থেকে শুনেছে নীলা বরেরাই বাচ্চা বাচ্চা করে পা’গল বানিয়ে দেয়। নীলা অধৈর্য হয়ে ভাবল — নিভান এর কোনো হেলদোল, আগ্রহ নেই। আর অধৈর্য হলো বলেই ঝারি মে’রে বলল,

-” কেমন গো তুমি, তোমার কোনো শখ আহ্লাদ নেই। তোমার ছোট এক ভাইয়ের পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ে। নীরব প্রত্যাশার কখন জানি খবর আসে; বাচ্চা হবে। এদিকে তুমি বড় হয়ে আঁটকুড়ে হয়ে থাকো। প্রত্যাশা মা হোক আমি হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।”

নিভান খুকখুক করে কেশে উঠল।‌ সামলে বলল,

-” নীলা তুমি কীসব বাচ্চামো কথাবার্তা বলছো! আশ্চর্য! কনসিভ করা নিয়েও তুমি মনেমনে প্রত্যাশার সাথে কম্পিটিশনে নেমেছো।”

নীলা কাটকাট গলায় বলল,

-” আমি অতশত জানি না। তুমি আসছো, আর আজই আমরা ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। দ্যাটস ফাইনাল।”

নিভান হাসল। হেসে বলল,

-” ওকে ওকে জান। তবে আমার কী মনেহয় জানো?”

-” কী?”

নিভান ফাজলামির সুরে বলল,

-” ডক্টরের উচিত প্রেসক্রিপশনে মোটা দাগে লিখে দেওয়া —- আপনার বরকে বেশি বেশি আদর করার সুযোগ দিন। যখন আবদার করবে, না করা চলবে না। তাহলেই অতিসত্বর আপনি মা হতে পারবেন….”

নীলার গাল লজ্জায় লাল হলো। লজ্জা আড়াল করতে রাগ দেখিয়ে বলল,

-” নিভান, আজেবাজে কথা বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে আসো।”

-” নিশ্চয় জান। তুমি কিন্তু রেডি থেকো।”

-” ফা’জি’ল একটা।”

নিভানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নীলা কল কা’ট’ল।

.
.

লাঞ্চ আওয়ারে শফিক সাহেব বাড়ি এসেছেন। অটো থেকে নেমে বাসায় ঢুকতে গিয়ে হালকা ভিজে গিয়েছেন। অধরা তোয়ালে এনে দিলেন। শফিক সাহেব তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন,

-” প্রত্যাশা কী করে?”

নীলা টিভি দেখছিলো। বিড়বিড় করল— এসেই ওর কথা জিজ্ঞেস করা লাগে। যত্তসব, আদিখ্যেতা। আব্বু-আম্মুকে দেখে মনেহয় আমিই কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। আর প্রত্যাশাই ওদের আপন পেটে ধরা মেয়ে।

অধরা ঘড়ির দিকে একবার তাকালেন তারপর দরজার দিকে। কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন,

-” প্রত্যাশা কলেজে গিয়েছে। এখনো ফিরল না। এত বৃষ্টি হচ্ছে, মেয়েটা কোথাও আটকে আছে না তো। একবার ফোন দিয়ে দেখো তো কোথায় আছে?”

শফিক সাহেব পকেট থেকে ফোন বের করলেন। চুলোয় তরকারি থাকায় অধরা ত্রস্ত কিচেনে গেলেন। কল দিবেন এমন সময় নীলা বলে উঠল,

-” ওইযে এসেছে।”

দরজাটা খোলা ছিলো। প্রত্যাশা বিবর্ণ মুখটা নিয়ে এগিয়ে আসছে। কপালের উপর থাকা ছোট ছোট চুলের ডগা বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে। শফিক সাহেব মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-” প্রত্যাশা মা ভিজে গেছো দেখছি। যে বৃষ্টি হচ্ছে আসতে কোনো সমস্যা হয়নি? রিকশা পেয়েছিলে? বৃষ্টির দিনে রিকশা, অটোদের তো আবার হাইপ বেড়ে যায়। খালি বসে থাকবে, ভাড়া তো দ্বিগুণ বলবেই তারপরও তোষামোদ করতে হয়।”

প্রত্যাশা শুকনো হেসে বলল,

-” না আব্বু সমস্যা হয়নি।”

-” জলদি মাথা মুছে নাও। নইলে আবার জ্বর সর্দি হবে। সামনে পরীক্ষা এখন জ্বর-টর হলে বিপদ।”

তোয়ালে বাড়ালেন মেয়ের দিকে। প্রত্যাশা পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে সোফায় রাখল। তোয়ালে নিয়ে মাথা মুছতে লাগলো। শফিক সাহেব আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলেন,

-” প্রত্যাশা পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন? আজ ক’দিন তো সবসময় বই নিয়েই বসে থাকতে দেখি। তা এবারে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে তো।”

প্রত্যাশা উত্তর দিলো না। বাবার গা ঘেঁষে বসল। হঠাৎ বলে উঠল,

-” আমি জানি এই পরীক্ষার রেজাল্ট খুব ভালো হবে না। কারন আমি আগে কখনোই সিরিয়াস হইনি। তবে আব্বু আমি কথা দিচ্ছি এরপর থেকে পড়াশুনায় মনোযোগ দিবো, খুব খুব সিরিয়াস হবো। আমি পাবলিকে চান্স পাবো না, আমার সে মেধা নেই। আব্বু তুমি কী আমাকে প্রাইভেটে ভর্তি করাবে? আমি দূরে ভালো কোথাও ভর্তি হতে চাই। সেখানে আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ দিবো, চেষ্টা করব। চেষ্টা করলে নাকি মানুষ সব পারে। আমি সেই চেষ্টাটুকু করতে চাই। কিন্তু প্রাইভেটে তো খরচ বেশি।”

নীলা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল খোঁচা মে”রে,

-” এ আমি কী দেখছি। মনে হচ্ছে ভূতের মুখে রাম রাম শুনছি। ইয়া আল্লাহ! পড়াশোনায় সিরিয়াস হবি তুই? যেখানে আম্মু ছোট থেকে পিটিয়েও পারেনি। যেটুকু পড়েছিস ফেল ঠ্যাকাতে, ক্লাস বাই ক্লাস উঠতে। সে নাকি এখন শেষকালে এসে সিরিয়াস হবে। হাউ ফানি!”

শফিক সাহেব বির’ক্ত মুখে বললেন,

-” আহ্ নীলা মা হাসার কী হলো! আর ছোটবোনকে কোথায় আরো উৎসাহ দিবে, তা না হাসিঠাট্টা করছো।”

নীলা হাতের রিমোট দিয়ে টিভি বন্ধ করল। ঘুরে বসে সিরিয়াস গলায় বলল,

-” শোনো আব্বু আমার কথা মিলিয়ে নিয়ো। প্রত্যাশাকে প্রাইভেটে ভর্তি করে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করা ছাড়া কিছুই হবে না। ও পড়বে, সেই পড়া দিয়ে কিছু করবে? ওকে অক্সফোর্ডে ভর্তি করলেও লাভ হবে না। কথায় আছে না যে লাউ সেই কদু। প্রত্যাশাটা আজীবন অমনই থাকবে।”

প্রত্যাশার চোখ ভিজে এলো। অধরা খুন্তি হাতে রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জোরেশোরে বললেন,

-” এসএসিতে গোল্ডেন, ইন্টারে প্লাস, অনার্স – মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে তুই মনেহয় খুব কিছু করে ফেলেছিস। প্রথমবার বিসিএস দিতে গিয়েই প্রিলিমিনারি থেকেই আউট হলি। এখন তো সেসবের চেষ্টাও বাদ দিয়ে সংসার করবি বললি। সেই সংসারটাও কতটুকু মন দিয়ে, সবার সাথে মিলেমিশে, সবার মন জয় করে করছিস শুনি?”

নীলার মুখটা ভোঁতা হলো। অধরা প্রসঙ্গ বদলিয়ে শফিক সাহেবকে বললেন,

-” শুনছো, বিরিয়ানির মসলা দেখছি নেই। একটু এনে দিবে তাড়াতাড়ি।”

শফিক সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন,

-” নীলা মা ছাতাটা এনে দাও তো।”

নীলা মুখ কালো করে বলল,

-” প্রত্যাশার কাছেই তো ছাতা আছে। এখন ওরটা নিয়েই যাও।”

প্রত্যাশা বলে উঠল,

-” আমার ছাতা টা তো নেই।”

নীলা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,

-” নেই মানে। সকালেই তো নিয়ে বেরোলি।”

প্রত্যাশা আমতা আমতা করে বলল,

-” ওটা একজনকে দিয়েছি।”

সবশুনে শফিক সাহেব বললেন— ঠিক আছে, ভালো করেছো। অধরা ভেতর থেকে আরেকটা ছাতা আনতে গেলেন। নীলা নাকমুখ কুঁচকে বলল,

-” অন্যের টাকার কেনা জিনিস তো, কোনো দরদ নেই। তোর কী, একটা দিলে আব্বুকে বললে আরেকটা নতুন পাবি। অন্যের টাকা পয়সা দিয়ে হাতেম তাঈ সাজার অভ্যেস তোর যাবে না। নিজের কিছু দান করে দেখিয়ে দিস।”

প্রত্যাশা বলল,

-” আমার নিজের বলতে তেমন কিছুই নেই। তবে থাকলে, কেউ চাইলে আমি নিশ্চয় দিবো। যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে।”

নীলা ভেংচি কে’টে বলল,

-” আচ্ছা, আচ্ছা আজ যে বড় করে বললি, কোনোদিন সময় এলে দেখবো। দেখবো কতটা উদার আর মহৎ তুই।”

অধরা ছাতা স্বামীর হাতে দিয়ে দু’টোকে ধমক দিলেন। সবসময় তর্কাতর্কি। শফিক সাহেবকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন,

-” বড় জামাইকে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছো। ছোট জামাইকে আবার বলেছো তো? নাকি খেয়াল নেই!”

-” হ্যাঁ, দু’জনকেই ফোন করে বলেছি। তবে নীরব বলল— ও ডিউটিতে আছে। খুব ব্যস্ত। তাই আসা সম্ভব হবে না।”

কথাটা বলতে বলতে শফিক সাহেব বেড়িয়ে গেলেন। প্রত্যাশা ব্যাগ হাতে তুলে রুমে যাবে বলে দাঁড়িয়েছে। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে—- ওনাকে তো একটু আগেই ক্যাসুয়াল ড্রেসে দেখলাম। হয়তো আসবে না বলেই ডিউটির অজুহাত দিয়েছে।

____________

একদিন পর..

মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে প্রত্যাশার। অস্থির ঠেকছে। অস্থিরতায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ গেছে। প্রচন্ড তেষ্টা পাচ্ছে। রুমের ওয়াটার বোতলটা ফাঁকা দেখে ডাইনিংয়ে আসে। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে নজরে এলো, নীলা আম্মু-আব্বুর রুমের দরজার সামনে। ওদিকে চেয়ে গ্লাসটা হাতে নেয় প্রত্যাশা। নীলা কম্পিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠল,

-” আ-আম্মু, আব্বু নিভান ফোন দিয়েছিলো।”

অধরা এগিয়ে এসে চোখেমুখে চিন্তার ছাপ ফেলে শুধালেন,

-” নীলা, কী হয়েছে? এত রাতে, কারো কোনো সমস্যা হয়েছে? নিভান ফোন দিয়েছিলো তোর শ্বশুরের কিছু হয়েছে? ভদ্রলোক ঠিক আছেন তো?”

প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে ওদিকে চেয়ে। বোঝার চেষ্টা করছে। নীলা জোরেজোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। ও বলল কোন রকমে,

-” আম্মু, নীরবের এক্সিডেন্ট হয়েছে।”

কথাটা শ্রবণ হতেই প্রত্যাশার মাথাটা যেন চক্কর দিলো। হাতটা কেঁপে ওঠে, হাত খসে গ্লাসটা ফ্লোরে পড়ে যায়। মূহুর্তেই কাঁচ ভেঙে মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পরে। শব্দ শুনে অধরা আর নীলা একসাথে ডায়নিংয়ে তাকায়।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩১|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ভোর চারটে পঞ্চাশ বাজে। হাসপাতালের করিডোর কাঁপছে ছুটে আসা স্ট্রেচারের চাকার শব্দে। মাথা থেকে র*ক্ত ঝরছে, আকাশি রঙের শার্ট লাল রঙে ভিজে একাকার। নীরবের নিথর দেহখানা পরে আছে। চোখের পাতা নিভুনিভু কিন্তু জ্ঞান নেই। দূর থেকে র*ক্তে মাখা নীরবকে দেখেই প্রত্যাশার মাথা ঘুরে গেলো। মূহুর্তে বুকের ভেতর গুমোট চিৎকার জমাট বাঁধে। এক হাতে মুখ চেপে ধরে, অন্য হাত আঁকড়ে ধরে পাশের চেয়ারের হেড। চোখ থেকে টপটপ করে জলের ফোয়ারা বইতে থাকে অবিরাম।

কুয়াকাটা থেকে ফিরছিলো নীরব। হঠাৎ ড্রাইভারের অসতর্কতায় দু’টো দূরপাল্লার বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মূহুর্তেই বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা রাস্তা। ধাতব টুকরো, তাজা লাল টকটকে র*ক্ত। সব মিশে ছড়িয়ে পড়ে পিচঢালা রাস্তাজুড়ে। ঘটনাস্থলেই দু’জনের প্রাণ যায়, গুরুতর আহত হয় অনেকে। স্থানীয়দের সহায়তায় পুলিশ দ্রুত উদ্ধার কাজ শুরু করে। নীরবের কাছে এএসপি পরিচয়ের আইডি কার্ড পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গেই জানানো হয় ****পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখান থেকে যোগাযোগ করা হয় নীরবের পরিবারে। অ্যাম্বুলেন্সে করে নীরবকে শহরের নামকরা হাসপাতালে আনতে আনতে ফজর পেরোয়। ভোর আর অন্ধকারের মাঝখানে, আজ নীরব জীবন আর মৃ•ত্যুর এক সূক্ষ্ম রেখায় দাঁড়িয়ে।

প্রত্যাশা ঝরঝরিয়ে কেঁদে পাশে দাঁড়ানো অধরার দিকে একপল তাকিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে শুধু বলল,

-” আম্মু, নীর….”

কথাটুকু সম্পুর্ন না করেই ছুটে যেতে নেয়। তক্ষুনি অধরা হাত ধরে আটকিয়ে দেয়।

নীহারিকা বেগম এতক্ষণ ওয়েটিং চেয়ারে বসে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছিলেন, প্রলাপ করছিলেন। ছেলেকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার পথে পা’গলের মতো দৌড়ে গেলেন। গিয়ে ছেলের বুকের উপর পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। স্ট্রেচার ধরা বয়েরা থেমে যায়। ওখানে নিভান ছিলো। সে আর ছোট চাচ্চু রাস্তায় দাঁড়িয়েই অস্থিরতায় পায়চারি করছিলো। নীরবের র*ক্তে মাখা মুখখানায় মমতায় মাখা হাতটা বারবার বুলাতে বুলাতে প্রলাপ করলেন,

-” আমার ছেলে, আমার বুকের ধন। আমার নীরব। ইয়া আল্লাহ, আমার জান নাও, তবুও আমার ছেলের জান ফিরিয়ে দাও। আমার সব আয়ু আমার ছেলেকে দাও। ইয়া মাবুদ, আমার বুক খালি করো না। আমার বুকের মানিক। আমার আব্বাটা।”

বলেই ছেলের র*ক্তে মাখা মুখেই চুমু খেতে লাগলেন। চাচ্চু নিভানকে ইশারা করে বললেন,

-” নিভান, ভাবিকে সরা।”

নিভানের চোখ ভেজা। বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে। দুইহাতে মায়ের কাঁধ ধরল, বলল ভেজা গলায়,

-” মা…মা শক্ত হও কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু হবে না নীরবের। আমাদের নীরব আমাদের কাছেই ফিরে আসবে।”

নীহারিকার হৃদয় যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে। ছেলেগুলো তার কলিজার টুকরো যে। নীবিড় পর হওয়ার পরেও নীরব থাকায় অতটা বুঝতে পারেননি। নীবিড়ের ঘাটতি যে নীরবই পূর্ণ করেছে। নীহারিকা শাড়ির আঁচল তুলে নীরবের মুখের জমাট বাঁধা র*ক্ত মুছতে মুছতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

-” নীরব, নীরব বাবা আমার চোখ খোল। মা ডাকছে বাবা, কথা বল। কথা বল সোনা। আমার হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছে যে, আমি পারছি না।”

নীহারিকার চুলের খোঁপা খুলে পিঠে এলোমেলো ছড়িয়ে পরেছে। নিভান মা’কে টেনে সরানোর চেষ্টা করে বলল,

-” মা সরো। নীরবকে ডাক্তার দেখবে, যেতে দাও।”

প্রত্যাশা এক ঝটকায় মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটে যেতে লাগল। পরনে হালকা মিষ্টি রঙের কামিজের উপর সাদা পাজামা আর সাদা ওড়না। ছুটতে গিয়ে মাথার উপর থাকা ওড়না পড়ে গেল। প্রত্যাশা এসে থামল স্ট্রেচারের সামনে। কম্পিত ঠোঁটজোড়া দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। সুক্ষ্ম অভিযোগ নিয়ে মনেমনে আওড়ালো,

-” হে খোদা, এসব কি হচ্ছে? রাতের স্বপ্নের মতো আজকের ভোরটা মিথ্যে হতে পারে না? হে আল্লাহ! ওনার সাথেই কেনো এমন হলো? ওনাকে সুস্থ করে দাও। পরিবারের কাছে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে দাও। জানটুকু ভিক্ষে দাও। আর কিছুই চাই না।’

প্রত্যাশা আচমকা নীরবের পরে থাকা হাতটা ধরল। হিম-শীতল ঠান্ডা হাতটা ধরতেই প্রত্যাশার কান্নার বেগ বাড়ল। নীরবকে আঁকড়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করল,

-” নীরব আপনি না বলেছিলেন আপনার আমার সম্পর্ক যতদিন থাকবে, ততদিন আপনার আমার প্রতি দায়িত্ব থাকবে। নীরব আমাদের সম্পর্কটা তো এখনো আছে। তবে কেনো আপনি আমার দায়িত্ব পালন থেকে পালাতে চাইছেন? শুধু দায়িত্ব থেকে হলেও আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। নীরব আমার যে আপনাকে অনেক কিছুই বলা হয়নি। আপনি কেনো এতবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটালেন? প্লিজ, কিছু বলেন। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে।”

নিভান মা’কে টেনে সরাল। নীহারিকা নিভানকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। নীলা পাশে দাঁড়িয়ে বারবার চোখ মুছছে। ডিউটি ডক্টর এসে পালস রেট চেক করে বললেন,

-” পালস রয়েছে, তবে অত্যন্ত ক্ষীণ। হেমোরেজিক শকে চলে যাচ্ছে পেশেন্ট। এক্সেসিভ ব্লিডিংয়ের কারণে ব্লাড প্রেসারও র‌্যাপিডলি ড্রপ করছে। ফাস্ট ওটি রেডি করতে হবে। ইমিডিয়েট সার্জারির প্রিপারেশন দরকার। স্যারের সাথে কথা হয়েছে, উনি রাস্তায় আছেন। যেকোনো মুহূর্তে পৌঁছে যাবেন। ব্লাড গ্রুপ অনুযায়ী ইমিডিয়েট ব্লাড অ্যারেঞ্জ করুন। এবং প্লিজ, আতঙ্কিত হয়ে কান্নাকাটি করে পরিবেশ আরও টেনসড করবেন না। বরং সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করুন। এটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”

স্ট্রেচার টান দিলো। নীরবের হাতটা তখনো ধরে থাকায় প্রত্যাশা টান খেলো। নীরবের হাত থেকে নিজের হাতটা ধীরেধীরে ছুটে আসল। নীরবের হাতটা ঝুলতে থাকল। প্রত্যাশা সেদিকে অশ্রু সিক্ত নয়নে তাকিয়ে। অবচেতনে বলে ওঠে,

-” আপনি সুস্থ হোন। আমি আগের আপনাকে ফিরে পেতে চাই। আপনি বাঁচুন নীরব, আর আমি বাঁচতে চাই কেবল আপনাকে ঘিরেই।”

শফিক সাহেব এগিয়ে মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই প্রত্যাশা বাবার বুকের উপর মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো।

চেয়ারে বসে মাহবুব সাহেব বারবার চোখের পানি মুছছেন আর বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পাঠ করছেন। বুড়ো মানুষটা শোকে পাথর বনে গিয়েছে।

অধরা সান্ত্বনা দিচ্ছে নীহারিকাকে। মায়ের মন যে মানছে না। মায়ের বুক ফাটা আহাজারিতে হাসপাতালের করিডোর ভারি হয়ে যায়। প্রত্যাশা হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। ওয়েটিং চেয়ারে ওরা সব বসে। এরমধ্যে নিভান সকল ফর্মালিটিজ পূরণ করে এসে প্রত্যাশাকে ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

প্রত্যাশার কানে পৌঁছাল না। নীলা জিজ্ঞেস করল,

-” নিভান কিছু দরকার?”

নিভান মাথা নেড়ে না বোঝাল। পরপর প্রত্যাশাকে ফের ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

ক্রন্দনরত মুখটা তুলে প্রশ্নাতুর চোখে চাইল প্রত্যাশা। নিভান হাত বাড়িয়ে বলল,

-” নীরবের ফোন আর ওয়ালেট। রাখো তোমার কাছে।”

একটু আগেই নীরবকে সাথে আনা একজন নিভানের হাতে এসব দেয়। মাহবুব সাহেব ওপাশ থেকে শুধালেন,

-” নিভান, র*ক্ত জোগাড় হয়েছে রে।”

-” হয়ে যাবে। চাচ্চু দিচ্ছে, আমি দিবো। আপাতত দুই ব্যাগ রেডি রাখি। তারপর আরো লাগলে লোক আছে।”

শফিক সাহেব বললেন,

-” নিভান, আমার পরিচিত লোক আছে, আরো লাগলে বলো আমি ফোন দিবো। আমি বললে তাদের সবাইই ছুটে আসবে।”

-” আপাতত দেখা যাক। লাগলে বলবো। আচ্ছা আমি এখন ব্লাড ব্যাংকে যাচ্ছি। এখানে সব ফর্ম পূরণ করেছি। নীরবকে ওটিতে নেওয়া হয়েছে। তোমরা চিন্তা করো না। ইনশা-আল্লাহ… সব ঠিক হয়ে যাবে।”

প্রত্যাশার চোখে এখনো ভাসছে নীরবের র•ক্তা•ক্ত শরীরটা। অল্প দিনের সম্পর্ক হলেও পবিত্র সম্পর্কের যে এতটা টান তা আগে বোঝেনি। আজ মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে যাচ্ছে, আত্মা ছটফট করছে। বুকের ভেতর কেমন এক ব্যথা দলা পাকিয়ে বসে আছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিভানের বাড়িয়ে দেওয়া ফোন আর ওয়ালেট দু’হাতে আঁকড়ে ধরল। মনে হচ্ছে এখানে মানুষটার স্পর্শ লেগে আছে। চোখের অঝোর বারিধারা কয়েক ফোঁটা ফোনের উপর পড়ল। প্রত্যাশা হাতটা বুকে চেপে ধরল। চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে নিঃশব্দে তার প্রাণ বায়ু, তার সুস্থতাটুকু উপরওয়ালার কাছে চাইল শুধু।

____________

সার্জারি শেষ হতে হতে আটটা বেজে যায়। নিভান আর শফিক সাহেব ওটির সামনেই ছিলেন। সিনিয়র দু’জন সার্জনের সাথে ডিউটির সেই ডক্টরও বেরোয়। বাকিরা গটগট বেরিয়ে গেলেও ডিউটির ডক্টর থেমে বললেন,

-” সিচুয়েশন এখন স্ট্যাবল। মাথার ডান পাশে কপালের ওপরে কাঁচের টুকরো ঢুকে একটা গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল। মস্তিষ্কের মেমব্রেনে হালকা স্ক্র্যাচ পড়েছিল, তবে ব্রেইন টিস্যুতে কোন স্থায়ী ক্ষ”তি হয়নি। এটাই সবচেয়ে রিলিভিং দিক। পায়ের হাঁটুর নিচে হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়েছে। সেটা প্লেট দিয়ে সেট করা হয়েছে। দুটো অপারেশনই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।”

নিভান কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞাসা করল,

-” ডক্টর, আমার ভাই একদম সুস্থ হবে তো। কোনো সমস্যা হবে না তো?”

ডক্টর অমায়িক কণ্ঠেই বলল,

-” দেখুন দু’টো অপারেশনই সাকসেস। আপাতত টেনশনের কিছু নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পেশেন্টকে কেবিনে শিফট করা হবে। পেশেন্টকে এখন শুধু পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। পেশেন্টকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে, যাতে ব্রেইন সম্পূর্ণ রেস্টে থাকে। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে, হতে পারে ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা বা তার বেশি। তবে এখনি কোনো আ’তঙ্কের কিছু নেই।”

____________

ঘড়ির কাঁটা চারটের ঘরে। দশটার পরেই অতো লোকজনের ভিড় কমাতে দুএকজন থেকে বাকিদের যেতে বলা হয়। নিভান, নীহারিকা আর প্রত্যাশা আছে। দুপুরে অধরা খাবার রান্না করে স্বামীকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন। তবে কারোরই খাওয়া হয়নি। যদিও চিন্তার কিছু নেই, তবুও অসুস্থ মানুষকে সামনে নিয়ে গলা দিয়ে খাবার নামে? আবার শর্মিলাও খাবার নিয়ে এসেছেন। বাড়ি ফাঁকা থাকে জন্য তখন আসতে পারেনি, অবশ্য ফোনে খোঁজখবর নিয়েছেন।

নীরবের কপালে ব্যান্ডেজ, পায়ে প্লাস্টার। স্যালাইনের ক্যানোলা বাঁ হাতে সেট করা। প্রত্যাশা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে। কেবিন জুড়ে নীরবতা। শর্মিলা এসে এটাওটা বললেন। তবে শাশুড়ি মা এখন পর্যন্তও কিছু বলা তো দূর তাকায়ওনি। প্রত্যাশার নিজেকে অপয়া মনে হচ্ছে। আচ্ছা, শাশুড়িও কী তাকে এমনই ভাবছে?

কেবিনের পিনপিনে নীরবতা ভাঙল দরজা খোলার শব্দে। সবাই একসাথে বিস্ময়ে প্রশ্নবোধক চাউনিতে চাইল। প্রীতি নম্র স্বরে সালাম দিলো। শর্মিলা মনে মনে আওড়ালো— বাবা আজ সূর্য কোন দিকে উদয় হয়েছে? ভুল করে পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয় হয়নি তো?

ইচ্ছে দৌড়ে এলো। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” দিদুন তুমি?”

সাথে সাথে বেডে নজর পড়তেই মুখটা ছোট করে বলল,

-” পাপা, পাপার কী হয়েছে? মাম্মা বলল পাপা অসুস্থ।”

এইবলে বেডের দিকে এগোল। নীরবের হাত ধরবে তার আগেই প্রীতি মেয়েকে টেনে নিল। ইচ্ছে ভেঙে ভেঙে জিজ্ঞেস করল,

-” মাম্মা, পাপার কপালে সাদা কী বাঁধা, পাপা ঘুমিয়ে কেনো?”

প্রীতি কিছু বলার আগেই শর্মিলা আদর করে কাছে টেনে বলল,

-” পাপার একটা ছোট্ট এক্সিডেন্ট হয়েছে সোনা। আঘাত লেগেছে, তাই ব্যান্ডেজ করা।”

প্রীতি নিজ থেকেই বলে উঠল,

-” আমার এক ফ্রেন্ড ফোনে নীরবের এক্সিডেন্টের কথা বলল। বাড়িতে নীরবের দূর্ঘটনার কথা বলতেই ইচ্ছে বায়না ধরলো, সে এক্ষুনি যাবে। ইচ্ছের জিদ তো আবার সাং•ঘা•তিক।”

নীহারিকা শুনল উত্তর করলো না। ইচ্ছে নীহারিকার শাড়ির আঁচল টেনে বলল,

-” দিদুন, পাপাকে ঘুম থেকে তোলো। পাপাকে বলো আমি আসছি।”

-” পাপা অসুস্থ সোনা। ইচ্ছে তুমি তো নিষ্পাপ, মাছুম বাচ্চা। তুমি একটু দোয়া করো তো। পাপা যেনো দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।”

নীহারিকার কথায় ইচ্ছে ঘাড় কাত করে বলে,

-” আচ্ছা।

ইচ্ছে আর আনিশা কেবিনের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে ছুটাছুটি করতে লাগলো। প্রীতি বেডে একপল চেয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকায়। শর্মিলা প্রীতির সাথে টুকটাক কথা বলল। প্রীতি খুবই নম্রভাবে কথাবার্তা বলল।

নীরবের বেডের পাশে টুলে বসে নীহারিকা। শর্মিলা কাঁধে হাত রেখে বলল আস্তে করে,

-” ভাবি, বলছি বাড়ি চলো। আমার সাথে গিয়ে গোসল করে আবার আসবে। তোমার দেবরকে বলবো পৌঁছে দিতে।”

-” ছোটো পা’গল হয়েছিস তুই? আমার ছেলেটা এখনো চোখ খুলল না, আর আমি বাড়ি যাই।”

-” ডাক্তার তো বলেছে চিন্তার কিছু নেই। জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে। বারো ঘন্টার বেশিও লাগতে পারে। গোসল না করলে তোমার তো আবার মাথা ছিঁড়ে যায়। এমনিতেই সেই রাত থেকে কান্নাকাটি করছো। তারউপর খাওয়া-দাওয়া নেই। এভাবে থাকলে তুমি না অসুস্থ হয়ে পড়ো। অসুস্থ হলে ছেলেকে আবার দেখবে কী করে? তোমাকেই তো আবার টানতে হবে। তাই বলছি চলো আমার সাথে।”

-” নীরবকে একা রেখে আমি কী করে যাই। না না না আমি যাব-টাব না। বাদ দে তুই।”

-” প্রত্যাশা আছে, নিভান আছে। ওরা থাকবে তো।”

হঠাৎ পাশ থেকে প্রীতি বলে উঠল,

-” মা, আমি সন্ধ্যা পর্যন্ত আছি। আপনি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। ফ্রেশ হলে বেটার লাগবে।”

এই প্রথম প্রীতির মুখ থেকে মা ডাক শুনলেন। বিস্মিতই হলেন নীহারিকা! তবে বুঝতে না দিয়ে নির্বিকার রইলেন। বাইরে নিভান ছিলো সেও এসে মা’কে বোঝাল। অবশেষে রাজি হলো। তবে নিভানকে পইপই করে বলল,

-” নিভান খেয়াল রাখিস। এক মুহুর্তের জন্যও চোখ সরাস না বাবা। কোনো সমস্যা হলে বুঝতে পারলে সাথে সাথেই ডাক্তারকে ডাকবি।”

-” চিন্তা করো না তো মা আমি আছি।”

পরপর ‘আমি রিকশা দেখছি’ বলে নিভান নিচে যায়। বাসা এখান থেকে বেশি দূর নয়। শর্মিলা বের হবে তার আগে প্রত্যাশার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-” প্রত্যাশা আর কান্নাকাটি করো না সোনা। কিছুই তো খেলে না। তোমার আম্মু তো প্রয়োজনীয় জিনিস পাঠিয়েছে, ফ্রেশ হয়ে নিও ক্যামন?”

প্রত্যাশা কিছুই বলতে পারল না। প্রত্যাশার গালে হাত রেখে আশ্বাস, ভরসা দিয়ে বলল,

-” উফ্! বিপদ-আপদ তো আর বলে কয়ে আসে না মা। শুধু মনে করো আল্লাহ না করুক বেশি কিছু হয়নি, এই তো হাজার শুকরিয়া। তবুও যে অল্পের উপর দিয়ে গিয়েছে।”

তারপর প্রীতির দিকে তাকিয়ে অমায়িক গলায় বললেন,

-” প্রীতি তুমিও যেহেতু আছো দেখো একটু। প্রত্যাশা তো ছোটো, তুমি বড়। প্রত্যাশা অত বুঝতে নাও পারে। তুমি একটু বুঝিয়ে দিও, আর লক্ষ্য রেখো। নিভান তো আছেই।”

প্রীতি উত্তরে মৃদুস্বরে বলল,

-“ছোটো মা টেনশন করবেন না। মা না আসা পর্যন্ত আমি থাকব। আর নিশ্চয় খেয়াল রাখব।”

নীহারিকা সাথে সাথে বলে উঠলেন,

-” ছোটো এত জনেজনে আমার ছেলেকে দেখার কথা বলতে হবে না। যেই আল্লাহ বড় বিপদ কাটিয়ে দিয়েছেন, তিনিই আমার ছেলেকে রক্ষা করবেন, ভালো রাখবেন।”

এই বলে পা বাড়াতে গিয়ে আবার থামলেন। প্রত্যাশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,

-” এভাবে সবসময় সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না। হাতে ধরে দেখিয়ে বারবার যেনো বলে দিতে না হয়। তোমার স্বামীর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব সবার আগে তোমার, পরে বাকিদের। কেবল চোখ ভিজিয়ে কিছু হয় না। বুঝে-শুনে একটু চালাক-চতুর হয়ে বুদ্ধি নিয়েও চলতে হয়।”

থেমে গলার স্বর একটু মিইয়ে ফের বললেন,

-” নীরবের পাশে থেকো, লক্ষ্য রেখো। নীরবের অসুবিধে হচ্ছে বুঝতে পারলে নিভানকে ডেকো। সিস্টাররা তো আসা-যাওয়া করছেই।”

প্রত্যাশা কলের পুতুলের মতন ঘাড় কাত করে বলল,

-” ঠিক আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।”

নীহারিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-” খেয়ে নিও তুমি। এমনিতেই হ্যাংলা পাতলা না খেয়ে প্রেশার লো হয়ে আবার মাথা ঘুরে পরে যাবে। সন্ধ্যায় বেয়াইকে আসতে বলো, রাতে বাড়ি গিয়ে থাকবে। তোমার তো আবার এক সপ্তাহ পরেই পরীক্ষা।”

শাশুড়ি মাকেও বুঝে উঠতে পারে না প্রত্যাশা। এই ঝারি মে”রে বলেন তো আবার মমতা আদর ঢেলে।

কেবিনে প্রীতি আর প্রত্যাশা। ইচ্ছে নিভানের সাথে করিডোরে হাঁটছে। এরমধ্যে একজন সিস্টার এসে প্রীতির দিকে তাকাল। প্রীতির পড়নে জলপাই রঙের থ্রি পিস। সুন্দর করে ওড়নাটা গায়ে জড়ানো। প্রীতির সামনে এগিয়ে সিস্টার বলল,

-” পেশেন্টের বাড়ির লোক? কী হোন পেশেন্টের?”

প্রীতি কপালে বিরক্তির ছাঁট ফেলে বলল,

-” হুম পেশেন্টর বাড়ির লোক। জ্বী বলুন…”

-” পেশেন্টের কী হোন?”

প্রীতি রুক্ষ স্বরে বলল,

-” বললাম তো পেশেন্টের বাড়ির লোক। কী বলবেন বলুন তো?”

নার্স এগিয়ে স্যালাইন নেড়েচেড়ে দেখল। কিছু বলতে গিয়ে থেমে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” আপনিও পেশেন্টের বাড়ির লোক?”

প্রত্যাশা মিহি স্বরে বলে,

-” জ্বী, আমি উনার ওয়াইফ।”

নার্স বলল,

-” ওহ্। তাহলে আপনাকেই বলছি। পেশেন্টের জ্ঞান ফিরলে জানাবেন। জ্ঞান ফেরার পর একটা ইনজেকশন পুশ করতে হবে। যদিও আমি কিছুক্ষণ পর পর এসেই চেক করে যাব জ্ঞান ফিরেছে কী না।”

-” ওকে।”

ফাইলটা হাতে তুলে বলল,

-” সন্ধ্যার মধ্যেই জ্ঞান ফিরলে রাতে খাবার দিতে পারবেন। স্যুপ জাতীয় তরল খাবার।”

-” থ্যাংকস।”

প্রীতির ফোন আসায় ব্যালকনিতে যায় কথা বলতে। প্রত্যাশা বেডের পাশে টুলে বসা। এক হাতে আলতো করে নীরবের ক্যানোলা পড়ানো হাতটা ধরে আছে। আর ভাবছে— নীরব বাড়িতে বলেছে কোনো একটা অফিশিয়াল কাজে সে কুয়াকাটা যাচ্ছে। প্রত্যাশার মনে প্রশ্নের উদয় হয়; এটা কী সত্যি? নাকি নীরবের কুয়াকাটা যাওয়ার কারন প্রত্যাশা?

প্রত্যাশার ভাবনার ছেদ হয় আকস্মিক অনুভবে। হঠাৎ খেয়াল হলো, ছুঁয়ে থাকা নীরবের হাতটা কিঞ্চিৎ নড়ল বোধহয়। প্রত্যাশা চোখের ভারি পাতা তুলে নীরবের দিকে তাকায়। নীরব পিটপিট করে তাকাতে গিয়ে কোথাও একটা টান লেগে ব‌্যথায় চোখমুখ কুঁচকে নেয়। পরপর সামনে তাকাতেই দেখে একটা নিষ্পাপ ক্রন্দনরত মুখ। সাদা ওড়না মাথায়, গোলগাল মুখটা ফ্যাকাসে বিবর্ণ হয়ে আছে। নীরব ব‌্যথায় কুঁচকানো মুখচোখেই নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল সেদিকে।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩২|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

নীরবের হাতের উপর আলতো করে ছুঁয়ে রাখা হাতটা প্রত্যাশা চটজলদি সরিয়ে নিল। ঘন সিক্ত পাপড়িগুলো তিরতির করে কাঁপছে। নীরবের শান্ত দৃষ্টিজোড়া প্রত্যাশার নিষ্পাপ ক্রন্দনরত ফোলা ফোলা চোখের দিকে। কিছু বলবে ভেবে প্রত্যাশা মুখ খুলতে গিয়ে…আবার কী ভেবে ঠোঁট দুটো এক করল।

নীরব মস্তিষ্কে প্রেশার দিয়ে একেএকে সবটা মনে করার চেষ্টা করল। অবশ্য এক্সিডেন্টের পরের মূহুর্তগুলো তার অজানা। নার্সের বলা কথা মনে হতেই তড়াক ওঠে দাঁড়াল প্রত্যাশা। নিভান ভাইয়াকেও বলতে হবে। দরজা টেনে করিডোরে গলা বের করতেই নিভানকে ওয়েটিং চেয়ারে পেল। ইচ্ছের সাথে গল্প করছে।

-” জিজু?”

-” সমস্যা প্রত্যাশা? কিছু কী হয়েছে?”

-” উঁহু। জিজু ওনার জ্ঞান ফিরেছে। নার্স এসে বলেছিলো জ্ঞান ফেরার পর ইনজেকশন আছে। একটু জা___”

কথা কেড়ে নিয়ে বলল নিভান,

-” যাক, আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা এক্ষুনি বলেই আসছি।”

ব্যালকনি থেকে কেবিনে আসতেই বেডে নীরবের দিকে চোখ পড়ল প্রীতির।‌ স্বস্তির নিঃশ্বাস আপনাআপনি বেরোল দুই ঠোঁট গলে। নীরব চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই প্রীতির দিকে নজর পরে। প্রীতি সাথে সাথে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। সহসাই বলে উঠল,

-” নীরব, হাও আর ইউ ফিলিং নাউ? ফিলিং এনি প্রব্লেমস?”

প্রত্যাশা এসে দাঁড়াল। নীরব চোখ ঘুরিয়ে নিল। নিরুত্তাপ থাকল। এরমধ্যে নিভান এসে জিজ্ঞেস করল,

-” নীরব ভাই আমার, কোনো সমস্যা হচ্ছে কী? খারাপ লাগছে?”

নীরব মাথাটা কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে ‘না’ বোঝাল। প্রীতি ভেতরে ভেতরে আহত হলো, অপমানিত বোধ করল। ইচ্ছে খানিকক্ষণ পটর পটর করল। নীরব মুখে হাসি নিয়ে আস্তে আস্তে দু-একটা কথা বলল। নিভান ফোন করে সবাইকে জানিয়ে দিলো। প্রত্যাশার মনে হচ্ছে এতক্ষণে বুকের উপর থেকে দুশ্চিন্তার পাথরটা নামল। তবে এ ক’দিনে দু’জনের মাঝে গড়ে ওঠা দেয়াল টপকে কথা বলতে পারল না।

.
.

হাসপাতালটা নামিদামি আভিজাত্যপূর্ণ। রোগীর বেডটা মাঝখানে, একপাশে একটা একক সোফা, তার সামনেই ছোট্ট একটা গোল টেবিল। অন্য পাশে অ্যাটেনডেন্টের জন্য আলাদা আরামদায়ক কাউচ। জানালার পাশে ঝুলানো সাদা দামি পর্দা, যেখান দিয়ে ব্যালকনির দিকের আলো এসে পড়ে। চারপাশটা ঝকঝকে, ছিমছাম। রাত বারোটা পনেরো বাজে। নীহারিকা ছেলের মাথার পাশে বসে চুলের ভাঁজে আস্তে আস্তে আঙুল চালাচ্ছেন। নীরব বলল মৃদুস্বরে,

-” মা ঘুমিয়ে পড়ো। বেশি রাত জাগলে তোমার বিপি বাড়বে।”

-” সমস্যা নেই আমি ঠিক ঘুমিয়ে পড়বো। তুই আগে ঘুম আয়। আমাকে নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না বাবা। আমি অসুস্থ না, তুই অসুস্থ। তাই যা বলছি শোন, কথা না বলে চোখ বন্ধ কর। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমানোর চেষ্টা কর বাবা।”

থেমে পরমূহুর্তেই শুধালেন,

-” আলো নিভিয়ে দিবো?”

-” না থাক।”

নীরবের চোখ ঘুরেফিরে বারবার সোফায় বসে ঝিমানো প্রত্যাশার দিকে যাচ্ছে। নীরব নড়াচড়া করে উঠে বলল,

-” মা আমার ফোন? ফোন কী আছে? নাকি..”

নীহারিকা জিভে বিরক্তি সূচক ‘চ’ শব্দ তুলে বললেন,

-” এতো নড়াচড়া, ছটফট করছিস কেনো বল তো? বারবার পা নড়াচ্ছিস। ডাক্তার রেস্টে থাকতে বলেছেন। পা-টা এক্ষুনি এতো মুভমেন্ট করতে বারণ করেছেন। কিন্তু তুই তো দেখছি বাচ্চা হয়েছিস। কোনো নিষেধ-বারণই শুনতে চাইছিস না।”

-” উফ্, মা। আমার মনে হচ্ছে তোমরা সবাই মিলে আমাকে বাচ্চা বানিয়ে রেখেছো। আর কিছুই হবে না, এত টেনশন করো না। ডক্টরের সাথে কথা বলে দ্রুত বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করো। বাসায় গেলেই একদম সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নীহারিকা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,

-” ডাক্তারকে বলব তোকে যেনো তাড়াতাড়ি রিলিজ না দেয়। রিলিজ দিলেই তো ঠিক করে সুস্থ হওয়ার আগেই আবার অফিসে ছুটবি। শুরু হয়ে যাবে কাজ নিয়ে ব্যস্ততা, দৌড়াদৌড়ি। তারচেয়ে বরং এখানেই ক’দিন আরামে থাক।”

-” ব্যস্ততা দৌড়াদৌড়িও বেটার, হসটপিটালে শুয়ে থাকার চেয়ে। এখানে এভাবে শুয়ে সময় যেনো যেতেই চাচ্ছে না।”

দু-তিন সেকেন্ড পরেই নীরব মা’কে মনে করাতে আবার বলল,

-” মা ফোন কী পেয়েছিলে? যদিও পাওয়ার কথা নয়। তবে পকেটেই তো ছিলো।”

-” ও হ্যাঁ। ফোন আছে তো। প্রত্যাশার কাছে।”

এই বলে ঘাড় ফিরিয়ে ডাকলেন,

-” প্রত্যাশা?”

প্রত্যাশা ঝিমুচ্ছিল। একটু ধড়ফড়িয়েই উঠে, অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

-” হু-হ্যা।”

-” নীরবের ফোন তোমার কাছে আছে না? রেখেছিলে কী?”

-” হুঁ।”

প্রত্যাশা উঠে সামনের টেবিলে রাখা টোট ব্যাগটার ভেতর থেকে ফোন বের করে বলল,

-” এইযে ফোন।”

-” নীরব চাইছে।”

প্রত্যাশা ত্রস্ত ওয়ালেটও বের করল। বেডের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবের দিকে বাড়িয়ে মিহিস্বরে বলল,

-” এইযে।”

নীরব মুখে কিছু না বলে নিল। ওয়ালেট মাথার পাশে নামাতে নামাতে বিড়বিড় করল—এটা চেয়েছিলাম নাকি? ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ফোনে মেসেজ টাইপ করল। হাতে স্যালাইনের নল নেই, ক্যানোলা আছে ইনজেকশন দিতে হয় জন্য।

বাইরে ওয়েটিং চেয়ারে গা এলিয়ে নিভান। বউয়ের সাথে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত। নীলার নাকি ভ’য় করছে। এই প্রথম ও বাড়িতে নিভানকে ছাড়া একলা রুমে আছে। তাই একটু কেমন কেমন ভয়-ভয় অনুভূতি হচ্ছে জন্য ঘুম আসছে না। নিভান রিপ্লাইয়ে লিখলো,

-” আইডিয়া! সমাধান পেয়েছি। তোমার ঘুমানোর দরকার নেই, মেসেজে কথা বলি। তোমার ভ’য়ও দূর হবে, এদিকে এভাবে বসে বসে ঘুমানোর চেয়ে আমার সময়টাও বেটার কা’টবে।”

নীলা তাতে অ্যাংরি রিঅ্যাক্ট দিলো। নিভান হেসে কিছু লিখবে তার আগেই নীরবের মেসেজ এলো। সীন করে নিভান আস্তে করে কেবিনে ঢুকে বলল প্রত্যাশাকে,

-” প্রত্যাশা চলো তোমাকে বাসায় রেখে আসি।”

হঠাৎ নিভানের কথায় প্রত্যাশা একটু অবাকই হলো। প্রত্যাশা মুখ খোলার আগেই নিভান বলল,

-” এখন তো নীরব বেটার আছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে টেনশনের কিছু নেই। আমি আছি, মা আছে। তুমি ছোট মানুষ কষ্ট করে এভাবে থাকবে, তারচেয়ে বরং তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।”

চোখে থাকা ঘুমের আবেশ, ঝিমানো মূহুর্তেই উড়ে গেল প্রত্যাশার। তড়িঘড়ি বলল,

-” জিজু , আমি ঠিক আছি। কোনো প্রব্লেম নেই।”

নিভান আর কিছু বলল না। নীরবের দিকে তাকাল। নীরব মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” মা এখানে এভাবে ঘুমানো অসুবিধে হবে। তোমরা বরং বাসায় যাও। ভাইয়া তোমাদের রেখে আসবে। এখনো বেশি রাত হয়নি।”

নীহারিকা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,

-” থাম তোরা। এক-আধদিন না ঘুমালে মানুষ ম*রে যায় না। বিপদের সময় একটু-আকটু কষ্ট সহ্য করতেই হয়। আমার বাচ্চাদের জন্য এটুকু কিছুই না। আমি ঠিক আছি।”

থেমে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-” প্রত্যাশা তুমি কাউচে শুয়ে পড়ো।”

প্রত্যাশা ইতস্তত বোধ করে বলল,

-” মা ওখানে আপনি শোবেন…আমি এখানে ঠিক আছি।”

নীহারিকা শাসিয়ে উঠলেন,

-” যা বলছি তাই করো।”

এবার নিভানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ত্যাড়া সুরে বললেন,

-” আর নিভান তুই বাসায় যা। দ্যাখ তোর বউ বোধহয় ভ’য় পেয়ে এতক্ষণে জ্ঞান-ট্যান হারিয়ে ফেললো।”

এইরে মা ভেবেছে আমি বাসায় যাওয়ার জন্যেই বোধহয় প্রত্যাশাকে বাসায় যাওয়ার কথা বলতে এসেছি। নিভানের এটা ভেবে নীরবের উপর রাগ উঠল। বলল নীরব দোষ হচ্ছে তার, আর তার বউয়ের। নীরবের দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকায় নিভান। নীরব অবশ্য নির্বিকার।

____________

পুরো বাড়ি নিস্তেজ, নিস্তব্ধতার চাদরে মোড়ানো। ড্রয়িংরুমের দেয়াল ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ গা ছমছমে ভূতুড়ি আবহ দিচ্ছে। এরমধ্যে একটা ছায়ামূর্তি ধীরেধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। বিষন্ন মন নিয়ে ওয়াটার বোতলটা হাতে ধরে প্রীতি ডায়নিংয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে জগ থেকে বোতলে পানি ঢালছিলো। তন্মধ্যে হুইলচেয়ারের চাকায় আঙুল চালিয়ে তানিয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

-” রাতে ডিনার করেছো?”

-” না।”

-” আসার পর একবারো দেখা করলে না যে।”

-” এমনিই।”

-” নীরব কেমন আছে? কী অবস্থা?”

-” আছে মোটামুটি। মাথার ডান পাশের সাইড ঘেঁষে কপালে আঘাত লেগেছে আর পায়ে। ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী চললে দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”

-” ওহ্।”

কয়েক সেকেন্ড থেমে ফের কথা তুললেন,

-” তোমার মেয়ে তো রাতে কান্নাকাটি করে ঘুমিয়েছে। সে তো দু’দিন মিশেই এখন ও বাড়ির সকলের ন্যাওটা হয়ে গেছে। দাদু বাসায় যাবে, বড় পাপা, পাপা তাদের সাথেই থাকবে।”

-” নিভান উনি খুব মিশুকে। বিকেলে ওনার সাথে ঘুরেছে গল্প করেছে। তাই হয়তো।”

প্রীতি রোবটের মতো দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। তানিয়া আকস্মিক বলে উঠলেন,

-” র*ক্ত বলে কথা। র”ক্তের মানুষদের দু’দিন দেখেই, তাদের ছাড়া এখন কিচ্ছু বুঝছে না। কী করবে এখন?”

প্রীতি বুঝতে পারল না। তাই পাল্টা প্রশ্ন করল,

-” কী করব মানে?”

-” ক’দিন মেয়েকে কাঁদিয়ে জোর করে আটকে রাখবে? ও তো এই বাড়িটাকে জেলখানা মনে করে। ওখানে যাওয়ার জন্য যা শুরু করেছে কান্না। আমি বিরক্ত হচ্ছি।”

-” পাঠিয়ে দাও ওকে।”

-” আর তুমি?”

-” কেনো, আমাকেও কী এখন ওর সাথে ও বাড়ি যেতে বলছো?”

-” মনে পড়বে না?”

-” জানি না।”

-” প্রীতি শোনো আমি বলি, ওদের র*ক্ত, ওদের বংশের প্রথম সন্তান। ওরা নেওয়ার জন্য এক পায়ে রাজি হবে। তুমি চাইলে আমি পুরনো সবকিছু ভুলে ক্ষমা চাইব। তোমাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে নিতে বলব।”

প্রীতি সোফায় বসতে বসতে বলল,

-” প্লিজ মা এরকমটা করতে যেয়ো না। ভুলেও না। ও বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে আমার অসহ্য লাগে। বিশেষ করে…..”

কথার মাঝেই তানিয়া বলল,

-” আমি জানি, কারনও অবশ্য অজানা নয়। তাহলে বলো আজ কেনো নিজ থেকেই গেলে?”

-” সেটাও তোমার অজানা থাকার প্রশ্নই আসে না।”

এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রীতি দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে নিলো। তানিয়া মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম স্বরে বললেন,

-” একটু সহ্য করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর। আর একবার না হয়…”

মুখ থেকে হাত দু’টো সরিয়ে প্রীতি রুক্ষ গলায় বলল,

-” সেই তো মানিয়ে নেওয়া মানে অ্যাক্টিং করা। আমি আজ ছয়টা বছর অভিনয়ের মাঝে থেকে অতীষ্ঠ হয়ে গেছি। আমার নিজেকে খুব টায়ার্ড লাগছে। আমি ভীষণ টায়ার্ড মা। আমি সত্যিই ভীষণ টায়ার্ড।”

তানিয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-” আমি জানি মা, তোর কষ্ট বুঝি না এমন নয়।”

প্রীতি এক ঝটকায় মাথা থেকে তানিয়ার হাত ফেলে দিল। রাগ-ক্ষোভ মিশিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,

-” না তুমি বোঝো না, তুমি জানোও না। কিচ্ছু জানো না তুমি। যাকে কখনো ভালোবাসিনি, এক ফোঁটা ভালোবাসা জন্মায়নি তার স্পর্শ সহ্য করা কতটা কষ্টের তা তুমি জানো না। কেবল আমি জানি সেটা। দিনের পর দিন সেই মূহুর্তগুলো আমার কাছে মিনি দোজখ লেগেছে। একা একা নিঃশব্দে ভেতরে ভেতরে গুমরে ম”রেছি।”

প্রীতির গলা ধরে এল। কয়েক মূহুর্ত পর ধরা গলায় বলল,

-” জানো মা, ঘুম হলো মানুষের বড় শান্তি, প্রশান্তি। অথচ সিল্পিং পিল হলো আমার রোজকার সঙ্গী। আজকাল মেডিসিনও আমাকে প্রশান্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমি কতটা কষ্টে আছি, ডিপ্রেশনে আছি, এবার তুমি দেখতে পারছো? এখন অবধি যা যা ভাবা হয়েছে, সব উল্টো হয়েছে। কিচ্ছু চাওয়া মতো হয়নি। অথচ আমি কী পেলাম? ঘৃ’ণা ছাড়া কিছুই না, বাড়ছে বৈ কমছে না। মাঝে মাঝে আমার নিজেকেই শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।”

দুই হাতে মুখ চেপে ধরে প্রীতি ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। লাস্ট এভাবে কেঁদেছিল ক’বছর আগে। তারপর আর কান্না করেছে বলে মনে পড়ে না। সেই থেকেই অনুভূতিহীন, জড় মনে হয় নিজেকে। সেদিন মনে হয়েছিল প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সেই যেনো প্রতিশোধের বলি হয়ে যাচ্ছে। রাত তিনটে….ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে ঝর্না ছেড়ে ভিজতে থাকে প্রীতি। শরীরে পানির ছোঁয়া লাগতেই জ্বলছিলো। তবে সেই জ্বলন হৃদয় স্পর্শ করল কই? গায়ের ব্যথা মনের ব্যথার কাছে সেদিন অতি তুচ্ছ হয়েছিল। হৃদয়টা দা’বানলের মতো পুড়ছিলো। পুরুষের ফার্স্ট স্পর্শ, হওয়ার কথা ছিলো স্বর্গীয় সুখানুভূতি। কিন্তু যাকে ভালোবাসেনি, মেনে নিতে পারেনি তার স্পর্শ আ”গুনের মতো লাগছিলো। সেদিন তিন ঘন্টা পানিতে ভিজে নীরবে কাঁদতে থাকে। শাওয়ারের পানি, চোখের পানি এক হয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো।

প্রীতি ছোট থেকেই খুব দাম্ভিক, অহংকারী আর জিদি, বদমেজাজি ছিলো। কলেজ, ভার্সিটিতে কোনো ছেলে ফ্রেন্ড ওর হাত ভুল করেও স্পর্শ হলে ও ক্ষেপে যেতো। বান্ধবীদের কাছে ফলাও করে বলতো —- প্রীতিকে ছোঁয়ার রাইট শুধু তারই হবে। প্রীতি যাকে দেবে।

আর একটা কথাও বেশ কনফিডেন্ট নিয়ে বলতো— প্রীতির যাকে ভালোলাগবে, ভালোবাসবে তাকেই বিয়ে করবে। আর সেই পাবে সেই অধিকার।

সেদিন ছিলো মেঘমেদুর দিন। গোধূলি লগ্নে ভার্সিটির লাইব্রেরী থেকে একজন ফ্রেন্ডের সাথে বেড়িয়ে হাঁটছিলো। হঠাৎ একটা ফুটবল এসে পেছনে লাগে। প্রীতি ধাক্কা খেয়ে নিজেকে সামলে ঘুরে দাঁড়াল আ’গুন চোখে। বলটা পা দিয়ে চেপে ধরল। প্রীতি ওভার স্মার্ট, আ”গুন সুন্দরী। চোখ ঝলসানো রুপ। হালকা বাদামি চোখের মণি বিদেশিদের মতো করে তোলে ওকে। চালচলনে অহমিকা, দাম্ভিকতা চুইয়ে চুঁইয়ে পরে। প্রথম বর্ষের হলেও মাত্র কমাসেই ওর রুপ আর এটিটিউডের কথা পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়ে পরে।

প্রীতি বলটা পা দিয়ে চেপে পা ঘুরাল। দাঁত কটমট করে ঠান্ডা গলায় বলল,

-” কে মে’রেছে বল? আনসার মি?”

বলটা নীবিড় মে*রেছিলো। ও বেচারা ভ’য় পেয়েছে। বন্ধুরা এটাসেটা বলে আরো ভীতু বানাল। মেয়েটা ওদের ব্যাচেরই। একজন বলল— বড় লোকের মেয়ে, খুব রাগি। সেদিন এক ক্লাস মেট প্রপোজ করায় ঠাস করে চ’ড় মে”রেছে। ভিসির নাকি আত্মীয় হয় কেউ সাহস পায়নি কিছু বলার।

সবার ভিড় ঠেলে সামনে দাঁড়াল লম্বা চওড়া তাগড়া যুবক। উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো। ঘাড় উঁচু করে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে দাঁড়াল। পরনে ফিটিং কালো টিশার্ট, হালকা ধূসর ট্রাউজার, কোমরের কাছে হাত গুঁজে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল প্রীতির দিকে। তেমনই ঠাণ্ডা শান্ত গলায় নির্ভীক চিত্তে বলল,

-” স্যরি, বলটা দাও।”

ছোট্ট বাক্যটা প্রীতির কাছে অদ্ভুত ঠেকল। ক্ষমা চাচ্ছে বটে, কিন্তু আদেশের সুরে। প্রীতির চোখ থমকে গেল ওর মুখে। এক মুহূর্তের জন্য শীতল রাগের ভাঁজে কাঁপন ধরল। যে অভ্যস্ত ছিল সবাইকে দমিয়ে দিতে সে নিজেই যেন আজ দমে গেল। ছেলেটার দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিলো, যা প্রীতিকে ঘায়েল করে। প্রীতি কিছুই বলল না, তবে বলটা হাত দিয়েও দিলো না। ডপ করে পা দিয়ে কিক মে’রে দেয়। নীরব দক্ষ হাতে সেটা ধরে নেয়।

প্রীতি ছেলেটি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে শুনল ছেলেটিও তাদের ব্যাচের, কেমিস্ট্রি বিভাগের। প্রীতির অভার কনফিডেন্স ছিলো, কেউ তাকে রিজেক্ট করতে পারে এই ধারণা তার ছিলো না। রিজেক্ট হওয়ার পর প্রীতির ইগো হার্ট হয়।

_____________

দু’দিন পর….

বিকেলের নরম রোদ ব্যালকনি দিয়ে কেবিনে ঢুকে হুটোপুটি খাচ্ছে। প্রত্যাশা নিঃশব্দে পা টিপে টিপে হাঁটছে। গতকাল দুপুরে বাসায় গিয়েছিলো। আজকে মাত্র আসলো। সামনে ওর পরীক্ষা তাই সবাই বারণই করেছে আসতে। তবে মনটা আঁকুপাঁকু করছিল আসতে। আবার অধরাও বলেন—জামাই হসপিটালে মেয়ে এভাবে এ বাড়ি থাকলে কথা হবে। ওরা না বললেও আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীর মুখ তো ধরে রাখা যাবে না। কখন আবার বলে ফেলে। আর ভালোও দেখায় না।

শফিক সাহেব মেয়েকে নিয়ে আসেন। প্রত্যাশার হাতে ব্যাগ ভর্তি মাল্টা, আপেল। সেগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখে। নীরব ঘুমিয়ে আছে। তাই আর শফিক সাহেব ডাকলেন না। আজ শুক্রবার বিধায় নিভান মা’কে বাসায় পাঠিয়ে এতক্ষণ ও ছিলো। প্রত্যাশা আসায় চলে গেল নিশ্চিন্তে। এমনিতেও কাল নীরবকে ছাড়বে। আজকের রাতটুকু শুধু।

দুপুরে খাওয়ার পর নিভানের সাথে গল্প করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙে গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছিলো। নীরব বেডের সাইডের টেবিল র‌্যাকের উপর মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাত বাড়িয়ে নিতে যায়। শুয়ে থাকায় নাগাল পাচ্ছিল না, আরেকটু সরে হাত বাড়াল। ঠিক তখনি প্রত্যাশা বোতলটা নিল। প্রত্যাশা এতক্ষণ ব্যালকনিতে ছিলো। প্রত্যাশা কিছুটা ঝুঁকে আছে, দু’জনের চোখে চোখ পড়ল। প্রত্যাশা চোখ নামিয়ে নিলেও নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল নীরব। প্রত্যাশা বোতলের ক্যাপ খুলে মৃদু কণ্ঠে বলল,

-” পানি…”

নীরব দৃষ্টি সরিয়ে পানির বোতল নিল। বেডের হেডে হেলান দিয়ে পানি পান করল। বোতল রাখতে যাবে তখন প্রত্যাশা হাত সামনে ধরল। প্রত্যাশার হাতে বোতলটা দিতে গিয়ে দু’জনের আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে যায়। প্রত্যাশা অপ্রস্তুত হয়ে বোতলটা রাখল।

নীরব ফোন স্ক্রল করছে। প্রত্যাশা আড়চোখে নীরবকে দেখে চুপচাপ সোফায় বসে ফোন অন করল। দু’জনের মধ্যে কোনো কথাই হচ্ছে না। যতটুকু প্রত্যাশা এই হেল্প করতে গিয়ে বলেছে, ব্যস! এতটুকুই। প্রত্যাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

এরমধ্যে তানভীর দেখা করতে আসে। সেদিনও অবশ্য এসেছিল। আজকে নীরবই ডেকেছিল অফিসিয়াল কথাবার্তা বলতে। ওরা অফিশিয়াল কথাবার্তা বলছে দেখে প্রত্যাশা ব্যালকনিতে গেলো। তানভীর বিদায় নিবে সেই মূহূর্তে নীরব বলল,

-” তানভীর একটা হেল্প লাগবে?”

-” জ্বী, স্যার বলুন।”

নীরব টাকা বের করে বাড়িয়ে বললো,

-” দুইটা ভ্যানিলা আইসক্রিম আনবে। আর তুমি নিচ থেকে চা অর কফি খেয়ে নিও।”

তানভীর কিঞ্চিৎ মাথা নুইয়ে হাসল। বলল অমায়িক গলায়,

-” না না, স্যার। টাকা লাগবে না। আমি আইসক্রিম এনে দিচ্ছি।”

তবুও নীরব জোর করেই টাকা গুঁজে দিল।

প্রত্যাশা সোফায় বসে মুখভার করে ফোন টিপছে। তানভীর নক করে আসতেই নীরব বলল,

-” ওগুলো প্রত্যাশাকে দাও।”

প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে তাকাল। তানভীর হেসে ভ্যানিলা কোণ আইসক্রিম বাড়িয়ে বলল,

-” ভাবী নিন।”

স্যার আসি, ভাবী আসি— বলে পরপর সালাম দিয়ে প্রস্থান করে। প্রত্যাশা আইসক্রিমের দিকে একপল তো আবার নীরবের দিকে একপল তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,

-” যাক, আলহামদুলিল্লাহ। ওনার সব মনে-টনে আছে। নাম যেহেতু একবার বলেছে, তখন আমি যে উনার বউ সেটাও খেয়াল আছে। গত পরশু থেকে মাঝেমধ্যেই হুতুম পেঁচার মতো চোখ করে আমার দিকে তাকাতে দেখছি।”

ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে ব্যঙ্গ করে আওড়ায় মনেমনে,

-” ওপার বাংলা সিরিয়ালে যেমন মাথায় বারি খেয়ে সব স্মৃতি থাকে, শুধু বিয়ে করেছে, বউ আছে সেই স্মৃতিটুকু মুছে যায়। ভাবলাম এরো আবার তাই হয়নি তো? ছোট থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত সব স্মৃতি বারি খেয়েও যায় না, শুধু যায় বিয়ে আর বিয়ের পরের সময়গুলো। চৌদ্দ গুষ্টি, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে চেনে। শুধু বউকে চেনে না। এনার হাবভাব দেখে আতংকে ছিলাম; উনি না আবার সিরিয়ালের মতন কখন যেনো অমন বলে বসে— আপনি কে? আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।”

#চলবে