মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৩৫+৩৬

0
9

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

রুমের দরজার চৌকাঠ পেরোতেই নীরবের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে এল। হাত সরিয়ে মেরুদণ্ড টানটান করে প্রত্যাশার দিকে গম্ভীর মুখে তাকাল। মুহূর্তেই প্রত্যাশার ভেতর একটা অজানা ভ’য় গেঁথে বসল— ওখানে নরম স্বরে কথা বললেও, এখন নিশ্চয় বকাঝকা করবে? সার্থকের সামনে কেনো গিয়েছি?

প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে উদয় হতেই ভয়ের ছায়া পড়ে প্রত্যাশার মুখেচোখে। নীরব নিঃশব্দে সেই ভীতু মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রত্যাশা জিভের ডগায় ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে জড়ানো স্বরে বলে উঠল,

-” আ-আসলে মা বললেন নাস্তা দিতে। না দিলে তখন আবার___”

প্রত্যাশার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নীরব বলল,

-” ইটস্ ওকে। ডোন্ট প্যানিক।”

শব্দগুলো প্রত্যাশার ভেতর থেকে দুশ্চিন্তার জালটা একটু একটু করে খুলে দিল। আপনাআপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোল। নীরব শান্ত গলায় বলল,

-” একটা সম্পর্ক ন*ষ্ট হতে তৃতীয় ব্যক্তির অনেক ভূমিকা থাকে। আবার সম্পর্ক ভাঙতে বাইরের মানুষ যেমন দোষী, তার চেয়েও বড় দোষ থাকে আমাদের। যখন আমরা তাদের সেই সুযোগটা দিয়ে ফেলি।”

একটু থেমে,

-” আশাকরি আমরা এমন কিছু করব না, যাতে কেউ আমাদের মাঝখানে ঢুকতে পারে। আর একটা সম্পর্কে বিশ্বাস খুব জরুরী। বিশ্বাসটুকুই হয় সম্পর্কের মূল শক্তি। একজন মানুষ পারফেক্ট হয় না, আমিও নই। তবে পূর্বের থেকে শিক্ষা তো নিতেই পারি।”

বাবা-মায়ের রুমের সামনে দিয়ে ড্রয়িংরুমে যেতে পথেই মায়ের কথা কানে আসে নীরবের। মা বাবাকে রাগি স্বরে বলছিলেন— ঘি রঙের পাঞ্জাবিটা তো আয়রন করে সোফাতেই রেখেছি। তুমি একটু চোখ দিয়ে দেখবে না। দেখা নেই শুধু পারে ডাকাডাকি। ওদিকে ইচ্ছেকে নিয়ে ওর মামা এসেছে। প্রত্যাশাকে নাস্তা দিতে বলে এসেছি। সে আবার কী করছে আল্লাহ জানে! তার কাজের উপর আমার বিন্দুমাত্র ভরসা নেই। কথাবার্তাই ঠিকঠাক শেখেনি___”

প্রত্যাশা নিশ্চুপ। নীরব প্রসঙ্গ ঘোরাতে বাম হাতে ধরা ফোনটা বাড়িয়ে দিল।

-” তোমার আম্মু ফোন করেছিলেন। কল ব্যাক করো।”

-” আমার ফোন দিয়ে করলেই তো হয়।”

এই বলে প্রত্যাশা এগিয়ে যেতে চাইলে নীরব ঠেকিয়ে দিল। কণ্ঠে আদেশ নামিয়ে বলল,

-” আমি কল দিয়ে দিয়েছি, রিং হচ্ছে। এই নাও।”

প্রত্যাশা দ্বিরুক্তি করার সুযোগ না পেয়ে ফোন নেয়। ভালো-মন্দ দুই-চারটা খোঁজখবরের পরপরই প্রত্যাশা ঠোঁট বাঁকিয়ে আহ্লাদী সুরে বলল,

-” আম্মু বাসায় যাবো।”

অধরা স্বভাবমতো বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, নরম গলায় কিছু উপদেশ দিয়ে কল কা’টেন। প্রত্যাশা ফোনটা বিছানায় রেখে পা ঝুলিয়ে বসে পরল। কয়েক মুহূর্ত পর নীরব ব্যালকনি থেকে রুমে আসতে আসতে বলল,

-” শাশুড়ি মায়ের কাছে দিলে তো আমাকে ভিলেন বানিয়ে।”

প্রত্যাশা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

-” মানে? কীভাবে?”

-” তোমার আম্মু নিশ্চয়ই ভীষণ দুশ্চিন্তা করছেন। কল রিসিভ করার সাথে সাথেই বাসায় যাওয়ার কথা বলেছো। শাশুড়ি মা ভাববে; ‘জামাই বুঝি ঠিকঠাক নয়। তাই মেয়ে থাকতে চায় না। একদিনেই চলে যাওয়ার বায়না ধরেছে।’ জামাই হিসেবে রেজাল্ট তো একদম ফেল।”

কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে প্রত্যাশা। পা দুটো দুলিয়ে আড়ালে ভেংচি কা’টল।

.
.

প্রত্যাশা যে এখানে আছে সার্থকের অজানা ছিলো। নীরবের এক্সিডেন্টের খবরও তার জানা ছিলো না। প্রীতির সাথে কথা বন্ধ হওয়ার পর থেকে বাড়িতে সে রাতটুকু ছাড়া থাকেই না বলা চলে। সার্থক বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নম্র গলায় বলল,

-” আন্টি আমি এখন উঠছি। ইচ্ছেকে নিতে রাতে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিবো।”

নীহারিকা আকস্মিক বলে উঠলেন,

-” আজই? মাত্র আসলো।”

নীহারিকার কথার অর্থ বুঝতেই সার্থক জড়তা নিয়ে বলল,

-” আ-আসলে আন্টি ওর স্কুল আছে।”

পাশ থেকে শর্মিলাও ইচ্ছের থাকার কথা বলল। বড়দের কথা ফেলতে না পেরে সার্থক বলল,

-” আচ্ছা, ঠিক আছে। আগামীকাল আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো। প্লীজ এবারে না করবেন না।”

ওদিকে প্রীতিকে নিয়ে ভ’য়। আসতে দিতে রাজী হচ্ছিল না। মেয়েকে কাজের লোকের কাছে রেখে দিবে, তবুও এদের ছায়াও যেনো মাড়াতে দিবে না। এমন ভাবসাব ওর।

___________

বেডের মাঝখানে ইচ্ছে বিভোরে ঘুমাচ্ছে। একপাশে নীরব অপরপাশে প্রত্যাশা। ইচ্ছে নীহারিকার কাছে শুবে, সেখানে প্রত্যাশা ইচ্ছে করে ইচ্ছেকে নিয়ে এসেছে। গল্প শোনাবে এটাসেটা বলে। নীরবের মনে হচ্ছে ইচ্ছেকে মাঝে দিয়ে একটা দেয়াল দিয়ে রেখেছে প্রত্যাশা। আচমকা হাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার হাতের কব্জি ধরে নীরব। প্রত্যাশা তখনও নির্বিকার। নীরব ফিসফিসিয়ে বলল, যাতে ইচ্ছের ঘুম না ভাঙে,

-” প্রত্যাশা এপাশে আসো।”

-” পারব না।”

নীরব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আফসোস নামিয়ে বলল,

-” মনে হচ্ছে তুমি সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স মেন্টালিটিতে চলে গেছ।”

-” মন্দ নয়, মাঝেসাঝে এমন দূরত্ব দরকার হয়।”

-” মাঝখানে ইচ্ছে আরেকপাশে তুমি, এপাশের আমি যেন দেয়ালের ওধারে বন্দী কয়েদি।”

প্রত্যাশা ঠোঁট টিপে হাসল। মৃদু আলোয় সে হাসি নীরবের দৃষ্টিগোচর না হলেও নীরব ঠিকই টের পেলো। বলল ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে,

-” প্রত্যাশা দ্য কুইন অব কিউট রিভেঞ্জ।”

-” কী আশ্চর্য! ঘুমানো বাদ দিয়ে এত কথা কেনো বলছেন? ঘুমান তো।”

তন্মধ্যে ইচ্ছে নড়াচড়া করতে লাগল। নীরব প্রত্যুত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেল।

__________

দু’দিন পর…

সন্ধ্যার পর সবাই ড্রয়িংরুমে বসে নাস্তা করছে। নীলা ফোন চাপছে মাঝেমাঝে মুখে পপকর্ন তুলছে। নিভান এসে পাশে বসতে বসতে বলল,

-” নীলাশা ঝালমুড়ি বানাও তো। অনেকদিন হলো ঝালমুড়ি খাই না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, এমন সন্ধ্যায় ঝালমুড়ি হলে মন্দ হয় না।”

নীলা একরাশ আলসেমি আর বিরক্তি মিশিয়ে বলল,

-” উফ্! আজকের মতো যা আছে, সেগুলোই খাও তো। এখন ঝালমুড়ি করলে সবাই ওটাই খাবে। তখন এতগুলো নাস্তা ওয়েস্ট হবে। কী আছে শুধু শুধু খাবার বাসি করার!”

আজন্মের আলসে আপু। পারবে না তা সরাসরি না বলে একটা অজুহাত দেখিয়ে দিল। প্রত্যাশা বিড়বিড় করে বলে সন্তর্পণে উঠে কিচেনে গেল। ছু•রি দিয়ে পেঁয়াজ কুচি করছিল। চায়ে চিনি কম হয়েছে জন্য আবির কিচেনে আসে চিনি নিতে। প্রত্যাশাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল,

-” নতুন ভাবি চিনির কৌটা কই?”

-” ওই যে।”

চামচে চিনি তুলতে তুলতে হঠাৎ মাথা উঁচু করে বলল আবির,

-” ব্যাড লাক আমার‌।”

প্রত্যাশা চমকে তাকাল,

-” ওমা! হঠাৎ ব্যাড লাক কেনো?”

আবির ভান করা আক্ষেপ নিয়ে মুখ টিপে হাসল,

-” ভাবির তো আর কোনো ছোট বোন নেই সেইজন্য। ধূর, ভাবির আরেকটা ছোট বোন থাকলে আমাকে আর এদিক-সেদিক গার্লফ্রেন্ড খুঁজে হয়রান হতে হয় না। ধরে নিতাম ছোটজন আমার জন্যেই বরাদ্দ। কী জমত বলো তো? তিন ভাই, তিন বোন , এক বাসা। জমজমাট ফ্যামিলি হতো না?”

প্রত্যাশা বিনিময় ঠোঁট টিপে হাসল। আবির চিনি মেশাতে মেশাতে ফাজলামির সুরে বলল,

-” ভাবির আপন বোন না থাক, তাতে কী! খালাতো, মামাতো, চাচাতো, ফুপাতো যে কোনো এক কাজিন বোনকে দেখিয়ে দিলেও চলবে। কাজিন আছে না? একটা রেফার করো। দেবরকে তো একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে, না?”

-” তোমার বউ পাওয়ার দায় আমার ঘাড়ে কেনো পড়ল বলো তো?”

-” ভাবির কাজ তো শুধু নাস্তা বানিয়ে খাওয়ানো না। দেবরের প্রেমজীবনকেও তো একটু সাজিয়ে দেওয়া উচিত। কী বলো উচিত না?”

-” অফকোর্স উচিত, কেনো নয়? আমি তোমাকে একটা টাস্ক দিচ্ছি। তুমি যদি সেটা করতে পারো, তাহলে… তাহলে আমি আমার কোনো এক কাজিন-টাজিনের সাথে তোমার প্রেমের বন্দোবস্ত করে দিবো।”

-” কী করতে হবে ফাস্ট বলে ফেলো?”

-” এইযে পেঁয়াজ কুচি দেখছো না, এখান থেকে এক টুকরো পেঁয়াজ কপালের উপর পাঁচ মিনিট ধরে রাখবে। চোখ বন্ধ করা যাবে না। তবে পলক ফেলতে পারবে। এভাবে যদি ফাইভ মিনিটস রাখতে পারো, তাহলে আমি আমার কোনো এক সুন্দরী কাজিনকে রেফার করবো, প্রমিস।”

-” প্রাঙ্ক করছো?”

-” উঁহু! আ’ম সিরিয়াস। এখনই ভ’য় পেলে নাকি?”

-” এ আবার এমন কী, এক্ষুনি করে দেখাচ্ছি। জাস্ট ওয়েট এন্ড সী।”

আবির মশা তাড়ানোর ভঙিতে গোল চাক করা একটুকরো পেঁয়াজ কপালের উপর রাখল। ভাব নিয়ে বলল,

-” নাও, কাউন্ট করো।”

প্রত্যাশা মুচকি হেসে কাঁচামরিচ কুচি করতে লাগলো। মিনিট খানেক হওয়ার আগেই আবিরের চোখ থেকে টপটপ অশ্রু ঝরতে লাগল। চোখে এত ঝাঁঝ লাগছে যা সহ্য করা সত্যিই কঠিন। ঝাঁঝের চোটে পানির নহর ছুটল চোখদুটোয়। চোখ বারবার বুঁজে আসতে চাইছে। একপর্যায়ে চোখের পানি নাকের পানি এক হয়ে গেল। মিনিট তিনেক হওয়ার আগেই আবির অতীষ্ঠ হয়ে এক ঝটকায় পেঁয়াজ ছুঁড়ে ফেলল। নাক টেনে বলল,

-” ও আম্মু গো, আমি শেষ।”

প্রত্যাশা হাসি আটকিয়ে দ্রুত বলল,

-” চোখেমুখে পানির ছিটা দাও।”

আবির কষে চোখ এঁটে রেখেছে। প্রত্যাশা নিজে আবিরের হাত ধরে বেসিনের সামনে নিয়ে ট্যাপ ছেড়ে দিল। আবির চোখে পানি নিতে লাগল। প্রত্যাশা দুইহাত বুকে ভাঁজ করে বলল,

-” সামান্য পেঁয়াজের ঝাঁঝ সইতে পারো না মিস্টার দেবর মশাই। আর বলো কী না ভাবির কাজিন নাই? দেবরের প্রেমের বয়স হয়নি, পেঁয়াজই দিলো তার প্রমাণ।”

আবিরের চোখদুটো লাল হয়ে গিয়েছে। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ ডলে বলল,

-” তুমি খুব মা’রাত্মক। জীবনে ছ্যাঁকা খেয়েও তো মনেহয় এতটা চোখের জল পড়বে না, আজ যতটা জল গড়ালো।”

চানাচুর বেশি করে দিয়ে সরিষার তেল দিয়ে ঝালমুড়ি মাখিয়ে ড্রয়িংরুমে যায় প্রত্যাশা। টি-টেবিলে নামিয়ে বলল,

-” মুড়ি খাও সবাই। খেতে ইচ্ছে হলো, তাই সবার জন্যেই বানালাম।”

নিভান হাতে তুলে মুখে চালান করে চিবুতে চিবুতে বলল,

-” উফ্! তোমার সাথে দেখছি আমার ইচ্ছেটা মিলে গেল। ধন্যবাদ শালিকা__”

মুখ ফস্কে পুরনো ডাকটা বেরিয়ে গিয়েছে। নীহারিকা সামনেই ছিলেন, অদ্ভুত চাউনিতে নিভানের দিকে তাকাতেই তার হুঁশ ফিরল। এইরে সম্পর্ক যে একটি পলকে পাল্টে গেছে, সে হুঁশ রাখতে হবে না। ছোট ভাইয়ের বউকে তো আর এভাবে শালিকা বলা যায় না। কেমন লাগে। নিভান অপ্রতিভ্য ভঙিতে সংশোধন করতে তড়িঘড়ি বলল,

-” ধন্যবাদ প্রত্যাশা।”

প্রত্যাশা মৃদু হাসি ঠোঁটে নিয়ে বসল। কয়েক মূহুর্ত পর প্রত্যাশা ডায়নিংয়ে যায় পানি খেতে। প্রত্যাশার চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে পিছনে আটকানো ছিলো। পিঠের উপর খোঁচা খোঁচা বিঁধছে। গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়লেও এক ফোঁটা গরম কমেনি। ঘাড়ের উপর চুল ছড়িয়ে থাকায় গরম লাগছিল। প্রত্যাশা ক্লিপটা দুই ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে চুলগুলো মুড়াতে থাকে। অদূরে কারো একজনের দৃষ্টি থমকে গিয়েছে, কারো নজর যে এদিকেই আটকে আছে, চোখের পলক যে নামছে না। সে খেয়াল প্রত্যাশার আছে? উঁহু! নেই। নেই বলেই প্রত্যাশা এক ধ্যানে নিজের কাজ করতে ব্যস্ত। প্রত্যাশা চুল পেঁচিয়ে মাথার উপর উঁচু করে ধরে পরপর ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নেয়। অতঃপর মুখের সাইডে থাকা কাটা একগাছি চুল কানের পিঠে গুঁজে নেয়, ঠিক তক্ষুনি নীরবের সাথে চোখাচোখি হয়।

বুকের ভেতর একটা মাতাল করা হাওয়া বইয়ে গেল নীরবের। দৃশ্যটা তাকে সম্মোহিত করে। নীরবের চাউনি নিষ্পলক, প্রত্যাশা চোখ সরিয়ে নিল। নীরব চুলে ব্যাক ব্রাশ করে একহাত পকেটে গুঁজে পা চালালো। পিছুন থেকে নীহারিকা ডেকে উঠলেন,

-” নীরব, কোথায় যাচ্ছিস?”

-” কাজ আছে একটু।”

-” এখনো ভালো করে সুস্থ হলি না আর কাজ আছে বলছিস। কাজ সারাজীবনই থাকবে। পায়ের উপর স্ট্রেচ ফেলানো ঠিক হবে না। এক্ষুনি বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। আরো দু’টো দিন যাক।”

নীরবের কপালে বিরক্তির ছাঁট পড়ল। বলল অধৈর্য স্বরে,

-” মা, ঠিক আছি তো। এখন কোনো প্রবলেম নেই। আমি একদম ঠিক আছি। আর কাল থেকে অফিসেও যাচ্ছি। টেনশন করো না, কিছুই হবে না। আ’ম ওকে।”

-” কিছু বললে তো শুনবি না। মা শুধুই প্যানপ্যান করে ভাববি। ছোট নোস যে আটকিয়ে রাখব। যা খুশি কর গে। আমি কিছু জানি না।”

নীরব বুঝিয়ে দু একটা কথা বলে যেতে নেয়। দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ জোরেশোরে বলে উঠল,

-” আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। তোমরা খেয়ে নিও। অপেক্ষা করার দরকার নেই শুয়ে পড়ো। আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে।”

‘তোমারা’ বললেও প্রত্যাশা ঢের অনুমান করল, তাকে উদ্দেশ্য করে বলতেই জোরেজোরে বলা। নীহারিকা বললেন,

-” ছাতাটা নিয়ে যা বাবা।”

______________

প্রত্যাশার তীব্র মন খারাপ হচ্ছে। বইটা হাতে ধরে মুখভার করে আছে। আম্মু-আব্বুর উপর খুব অভিমান, অভিযোগ জমেছে— কালকের দিনের কথা আম্মু-আব্বু কী করে ভুলে গেলো? একবার ফোন করেও তো কিছুই বলল না। বিয়ে দিয়ে মেয়েকে একদম পর করে দিয়েছে।

ঘড়িতে এগারোটার ঘর পার। নীরব ফেরেনি এখনো। ভাবল– একবার কল করে খোঁজ নিবে কী না? পরক্ষনেই স্থির করল, আরেকটু দেখি।

রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ফেরে নীরব। মেইন দরজা লক করে পা বাড়াতেই শর্মিলার গলা এল,

-” ভাবি এতক্ষণ তোর জন্য অপেক্ষা করে মাত্র রুমে গেল। নীরব খাবার বেড়ে দিবো?”

নীরব মুখে হাসি টেনে বলল,

-” না ছোট মা, ডিনার করতে একটু দেরি হবে।”

শর্মিলা জগ থেকে বোতলে পানি ঢেলে ক্যাপ আটকিয়ে নিলেন,

-” অপেক্ষা করব? তুই তো কখনো বেড়ে খাস না। ভাবিকে ডাকার দরকার নেই, আমি বরং এখানেই আছি।”

নীরব একটা বক্স শর্মিলার হাতে ধরিয়ে বলল,

-” এটা রেখে দিও। এটা সবার জন্যে। আর ছোট মা সমস্যা নেই, অপেক্ষা করতে হবে না। প্রত্যাশা খাবার রেডি করে দিবে।”

.
.

রুমে গিয়ে হাতের ব্যাগটা সোফায় নামিয়ে বিছানায় তাকাতেই এলোমেলো প্রত্যাশার দিকে নজর গেল। বইটা বালিশের উপর পরে আছে, ও নিশ্চিতে ঘুমে ডুবে। নীরব ফ্রেশ হয়ে এসে প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে দুই আঙুলে প্রত্যাশার কপালের উপর থাকা ছোটছোট চুল ঠেলে দেয়। প্রত্যাশা একটু নড়ে উঠল। টিশার্ট সরে পেট বেড়িয়ে আছে। নীরবের চোখ নিষিদ্ধ জায়গায় বিচরণ করল। শুকনো ঢোক গিলে সে প্রত্যাশার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

প্রত্যাশা আহ্লাদী ভঙিতে একটু নড়ল। তারপর মুখের উপর থাকা নীরবের হাতটা টেনে গলার সাথে ধরল। নীরবের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। নিজেকে সামলে ফের ডাকল,

-” প্রত্যাশা?”

ঘুম জড়ানো গলায় চোখবুঁজেই বলল প্রত্যাশা,

-” ঘ-ঘুমাব।”

.
.

নীরব খাবার খাচ্ছে প্রত্যাশা সামনের চেয়ারে বসে ঝিমুচ্ছে। ওর যা রাগ হচ্ছে, এই লোক রাত বারোটায় ফিরে এখন ঘুম থেকে জাগিয়ে খাবার বেড়ে নিল। কেনো আজ একটু বেড়ে খেলে কী এমন হতো?

প্রত্যাশার ঘুম ছুটছেই না। নীরব একবার ঘড়ির দিকে তাকাল ফের প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” রুমে সোফার উপর দ্যাখো একটা প্যাকেট আছে। সেখানে একটা ড্রেস আছে, যাও ফাইভ মিনিটসের মধ্যে পরে নাও।”

-” কীহ? এতরাতে আমি ড্রেস পাল্টাব, কেনো?”

-” উত্তর পরে, আগে যা বলছি সেটাই করো।”

-” পারব না, এখন আমি ঘুমাবো। ঘুমে চোখে দেখছি না।”

নীরব হতাশ শ্বাস ফেলে উঠে হাত ধুয়ে টাওয়েল দিয়ে মুছে নিল। প্রত্যাশা খাবার কোনো রকমে ঢেকে রুমে গিয়ে বিছানায় উঠতে নিবে, তার আগেই নীরব ওর হাত ধরে টেনে নিল। রাগি স্বরে বলল,

-” ড্রেস পড়তে বললাম, শুনলে না?”

-” কী আশ্চর্য! মাথা-টাথা গেছে আপনার? এতরাতে__”

ঘড়িতে বারোটা দশ বাজে। নীরব বিরক্ত শ্বাস ফেলে বলল,

-” ব্যালকনিতে আসো, দরকার আছে। এবারে দ্বিতীয় কথা যেনো বলতে না হয়।”

দরজা ঠেলে ব্যালকনিতে পা রাখে নীরব। প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে পিছুপিছু গেল। ব‌্যালকনিতে পা রাখতেই প্রত্যাশার চোখ ছানাবড়া। নীরব একেএকে ক্যান্ডেলগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। টেবিলের উপরে ছোট্ট গোল একটি চকোলেট কেক, উপরিভাগ চকোলেট গ্লেজে চকচক করছে। কেকের মাঝে লালচে ক্যান্ডি হার্ট বসানো। কেকের উপর ইংরেজি ফন্টে গোলাপি আইসিংয়ে লেখা,

“Happy Birthday My Misses”

চারপাশের ক্যান্ডেলের আলোয় কেকটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রত্যাশা আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল,

-” নীরব আপনি কী করে জানলেন?”

-” সিক্রেট।”

নীরব একটা বেলুন দুই হাতে ধরল, যেখানে লেখা—‘Sorry’ নীরবের পা•গ•লামী দেখে প্রত্যাশা হেসে ফেলল। নীরব তাড়া দিল কেক কা’টতে। প্রত্যাশা কেক কে’টে নীরবের মুখের সামনে ধরল। হাতটা ধরে ঘুরিয়ে প্রত্যাশার মুখেই কেকের টুকরো ধরল নীরব। ইশারায় হা করতে বলে। প্রত্যাশা হা করে মুখে নিতে নেয়, সেই সময় নীরব আরেকপাশ থেকে ছোট্ট করে বাইট দেয়। দু’জনের নাকে নাক ছুঁইয়ে যায়।

নীরব টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে প্রত্যাশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। প্রত্যাশা অবাক হয়, প্রত্যাশার অবাক আরেক দফা বাড়ে; যখন নীরব প্রত্যাশার পায়ের দিকে হাত বাড়ায়। প্রত্যাশা এক ঝটকায় দু’পা পিছাল। চেঁচিয়ে উঠল,

-” ইয়া আল্লাহ! পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো? জান মাফ-সাফ করে দিয়েছি। তাও এভাবে, প্লীজ না।”

মূহুর্তেই নীরবের মেজাজ চটল। একে নিয়ে চলা মোটেই সহজ নয়। ক্ষণে ক্ষণে এ জ্বালিয়েই মা’র’বে। কবে যে এর বোধবুদ্ধি হবে। নীরবের মুখের অভিব্যক্তি দেখে প্রত্যাশা ভীতু স্বরে বলল,

-” ভুলভাল বললে স্যরি।”

-” আল্লাহর ওয়াস্তে মুখটা একটু বন্ধ রাখবে, তাতেই চলবে।”

প্রত্যাশা বাধ্য মেয়ের মতন মাথা নাড়াল। প্রত্যাশার পা-টা হাঁটুর উপর তুলে নিয়ে নীরব জিন্সের পকেট থেকে পায়েল বের করে পড়িয়ে দিল। আলতো ছোঁয়ায় প্রত্যাশার শরীরে ভূমিকম্প বয়ে যায়। নীরব উঠে দাঁড়াল। ঠোঁটে হাসি টেনে হিম শীতল গলায় বলল,

-” আঠারো বসন্তের শুভেচ্ছা, মাই মিসেস। তোমার চোখের হাসিতে আমার দিন শুরু হোক, আর তোমার ঠোঁটের অভিমানে রাত থেমে যাক। আমার সবটুকু সুখ, সবটুকু প্রার্থনা, আজ থেকে কেবল তোমার হোক। তোমার জীবনজুড়ে যত রং থাকবে, তা আমার ভালোবাসা থেকে আসুক। শুভ জন্মদিন, আমার হৃদয়ের বোকারানি।”

প্রত্যাশার চোখেমুখে স্ফূর্ত হাসি ফুটল। বলল চঞ্চল কণ্ঠে,

-” শুকরিয়া… শুকরিয়া আমার এএসপি সাহেব।”

‘আমার এএসপি সাহেব’ কথাটা নীরবের কানে বাজতে থাকল। এক ঝটকায় প্রত্যাশাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে নীরব। প্রত্যাশা বুকে মুখ গুঁজল। কিছু সময় দু’জনের মাঝে নীরবতা চলল। প্রত্যাশা নীরবতার সুতো ছিঁড়ে আফসোসের সুরে বলল,

-” জানেন, আম্মু বলে আমি পূর্ণিমার রাতে জন্মে ছিলাম। আজ পূর্ণিমা না, অমাবস্যাও না। তবে আকাশে মেঘ থাকায় চাঁদ ঢেকে আছে। চাঁদ থাকলে বেশি ভালো হতো। মাঝরাতে চাঁদের আলোয় কেক কাটার জমাই আলাদা হতো।”

নীরব সোজা হয়ে দুইহাত পকেটে গুঁজে দাঁড়াল,

-” আকাশের চাঁদ মেঘে ঢেকেছে তাতে কী? জমিনের চাঁদ তো পাশেই আছে।”

কথাটা বুঝতে প্রত্যাশার কয়েক সেকেন্ড লাগে। আর বুঝতেই লজ্জা পেল। প্রত্যাশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীরব আচমকা প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

-” ইউ আর মাই মিডনাইট মুন।”

প্রত্যাশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়। প্রত্যাশার লজ্জা দূর করতে নীরব ঘুমানোর কথা বলে তাড়া দিল।

____________

ভোরের নরম আলো গাছের পাতার ফাঁক গলে ব্যালকনিতে আসছে। চারিপাশে পাখিদের কিচিরমিচির। আলস্য ভঙিতে ঘুম ভেঙে ব্রাশ হাতে ব্যালকনিতে আসে প্রত্যাশা। মুখে ব্রাশ নিয়ে ব্যালকনির দোরগোড়ায় পা রাখতেই নীরবকে দেখে মুখে হাসি টেনে বলল,

-” গুড মর্নিং।”

-” গুড মর্নিং।”

প্রত্যাশা এগিয়ে পাশে দাঁড়াতেই নীরব কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। প্রত্যাশা সেই নজর পড়ে নিল। আর নিলো বলেই বলল তড়িঘড়ি করে,

-” কী দেখছেন ওভাবে? শুনুন ভুল একবারই হয়, বারবার নয়। একবার ভুল করে আপনার ব্রাশ নিয়েছিলাম বলে যে আবারো অমন করব। সেটা ভাবলে সে গুড়ে বালি। কথায় আছে না ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। এখন আমি সিরিয়াস। ভুলটুল করে আপনাকে অযথা কথা শোনানোর সুযোগ দিচ্ছি না।”

ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে সটান দাড়িয়ে নীরব। একটু আগেই উঠেছে সে। নীরব ভেতরে ভেতরে মুচকি হাসল। তবে বলল নির্লিপ্ত ভঙিতে,

-” ভেরি গুড।”

হঠাৎ প্রত্যাশার নজর গেল ব্যালকনির ভেন্টিলেটরে। তুরন্ত গালের ফেনা গ্রিল দিয়ে থুথু করে ফেলল। একহাত উঁচিয়ে দেখিয়ে বলল,

-” ভেন্টিলেটরের মধ্যে খড়কুটো! পাখির বাসা দেখছি। ডিম-টিম আছে বুঝি? পাখির বাচ্চা আছে?”

-” তুমিও যেখানে আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে। তাই উত্তর আমারো অজানা।”

মাথা উঁচিয়ে ওদিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” একবার চেক করে দেখি?”

-” দ্যাখো।”

প্রত্যাশা ত্রস্ত রুমে এসে কুলি করে, মুখে পানির ছিটা দিয়ে টুল নিয়ে ব্যালকনিতে ছুটল। টুলের উপর দাঁড়াতে দাঁড়াতে নীরবকে জিজ্ঞেস করল,

-” টুল আনতে গিয়ে দেখলাম রাতের ওষুধটা ওখানেই আছে। খাননি তো। আমি না রেখে বারবার বললাম খেয়ে নিবেন। আপনি তো বললেন পরে খাবেন। সে পরে আর আসেনি।”

-” ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

-” ওহ্।”

বলে আবার কিছু মনে হতেই ব্যগ্র কণ্ঠে বলল প্রত্যাশা,

-” আচ্ছা এখন নাস্তা করে খেয়ে নিয়েন। ওষুধ তো আর বুঝবে না কোনটা রাত আর দিন! আজ রাতে একটু দেরি করে খাবেন। তাহলেই চলবে।”

টুলের উপর দাঁড়িয়ে হাত দু’টো উঁচু করে গ্রিল ধরে মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করে পাখির ডিম আছে কী না! প্রত্যাশার টিশার্ট উঠে যায়, মসৃন পেট বেরোয়। নীরবের দৃষ্টি মুহূর্তেই নিষিদ্ধ জায়গায় পরে। প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,

-” কতদিন আগে থেকে এখানে বাসা?”

নীরব না শোনার মতো করে বলল,

-” হুঁ।”

প্রত্যাশা বিরক্ত মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে,

-” শুনেননি? কী ভাবছেন যে__”

নীরবের দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ। দৃষ্টিতে ঘোর লেগে আছে। প্রত্যাশার হুঁশ হলো। দ্রুত হাত নামিয়ে টিশার্ট টেনেটুনে নামাতে ব্যস্ত হয়। রাগ দেখিয়ে বলল,

-” নীরব এভাবে এদিকে তাকিয়ে কী দেখছেন?

নীরব মুচকি হেসে মাথা চুলকিয়ে বলল,

-” কই কিছুই তো দেখিনি। কেনো তুমি কী কিছু দেখাতে চাও?”

প্রত্যাশা টেনে বলল,

-” নী…র..ব।”

নীরব হেসে দোলনায় বসল। ফোন বের করে স্ক্রল করতে থাকে। প্রত্যাশা সেটা দেখে আবার পাখির বাসার দিকে মনোনিবেশ করল। অল্পের জন্য ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না, ওইযে খড়কুটোর ভেতর মনে হচ্ছে সাদা সাদা ছোট্ট ডিম আছে, যা প্রত্যাশার কৌতুহল দ্বিগুন করল। ও দেখার জন্য ছাদের কার্নিশে দুইহাত রাখল। মাথা উঁচিয়ে চেষ্টা করল, হঠাৎ কী মনে করে নীরবের দিকে তাকাল। না নীরব এদিকে তাকিয়ে নেই, উনি ফোনে ডুবে আছে। তারপর প্রত্যাশার নিউরনে অদ্ভুত চিন্তার উদয় হলো। আর হলো জন্যই ঝটিকায় নেমে নীরবের সামনে আসে। একহাত কোমড়ে রেখে অন্যহাতে নীরবের ফোনটা কেড়ে নিলো। তারপর যেটা ভেবেছিল সেটা ভুল দেখে একটু লজ্জা পেল। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন নীরব মুচকি হেসে বলল,

-” তুমি ভেবেছিলে আমি ক্যামেরা অন করেছি, তোমার মসৃন পেট, পিঠের দৃশ্য ফোনের মেমোরিতে রাখছি?”

প্রত্যাশা সবেগে মাথা নাড়ল। না বোধক বুঝাল। নীরব অফার করল,

-” দেখতে পাচ্ছো না তো, আমি হেল্প করবো?”

-” হেল্প করবেন? কীভাবে?”

উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল প্রত্যাশা। নীরব বলল নির্বিকার ভাবে,

-” কোলে তুলে ধরে।”

প্রত্যাশার উচ্ছ্বাস দপ করে নিভে গেলো। না করে ভাব দেখিয়ে বলে— লাগবে না, সে একাই পারবে। টুলের উপর আঙুলে ভর দিয়ে সর্বোচ্চ উঁচু হয়ে চেষ্টা করতেই সফল হয় প্রত্যাশা। তবে আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই টুল নড়ছিলো। আচমকা ব‌্যালেন্স হারিয়ে ধপাস করে পড়ল মেঝেতে। কোমড়ে হাত দিয়ে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। নীরবের ভাবাবেগ হয় না, ও তখনও নির্লিপ্ত বসে। প্রত্যাশা মুখটা কাঁদো কাঁদো করে হাত বাড়িয়ে বলল,

-” বসে হা করে কী দেখছেন? আমার খুব লেগেছে, তুলুন আমায়।”

নীরব হাতটা বাড়াল। প্রত্যাশা হাতটা আরেকটু বাড়িয়ে নীরবের হাত ধরবে, সেইসময় নীরব হাত টান মে*রে সরিয়ে নেয়। প্রত্যাশা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। পরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীরব প্রত্যাশাকে কোলে তুলে নেয়। প্রত্যাশা হইহই করে উঠল,

-” সে কী, নামান। আপনার পায়ের ব্যথা।”

নীরব রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,

-” সেইজন্য তো বারবার সিডিউস করে মাথা খারাপ করে দেওয়ার পরেও ছাড় পাচ্ছো।

-” মোটেই সিডিউস করিনি।”

-” তাই?

-” হুঁ।”

প্রত্যাশাকে আলগোছে বিছানায় শুইয়ে দিল। প্রত্যাশা উঠে বসতে গেলে নীরব আঁটকে দেয়। প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকল। নীরবের চোখের ভাষা অন্যরকম ঠেকছে। প্রত্যাশা শুকনো ঢোক গিলল। মুখ খুলে কিছু বলবে,

-” নী__”

নীরব তর্জনী রাখল প্রত্যাশার ঠোঁটে। বলল আস্তে করে,

-” চুপ।”

প্রত্যাশার দিকে আরেকটু ঝুঁকল। খুব কাছাকাছি। প্রত্যাশার হার্টবিট লাগামহীন ছুটছে। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে। নীরব সম্মোহিত চাউনিতে চেয়ে প্রত্যাশার কপালে চুমু খেলো। প্রত্যাশা চোখ বুজে নিলো। নীরবের হাত প্রত্যাশার নরম তুলতুলে পেট স্পর্শ করে। প্রত্যাশা কেঁপে ওঠে পেটের উপর টিশার্ট টেনে দেওয়ার চেষ্টা করল। নীরব ফিসফিসিয়ে বলল,

-” টিশার্টটা তো একা একাই তোমার গায়ে থাকতে চাইছে না। অকারনে স্থানচ্যুত হচ্ছে, এত ঝামেলার চেয়ে আমি বরং একে একেবারেই তোমার গা থেকে সরিয়ে দিই। দিই?”

প্রত্যাশা মাথা নেড়ে বলতে চাইল— উঁহু। জোরেজোরে শ্বাস ফেলে চোখদুটো বুজে বলল,

-” নীরব আপনি খুব লজ্জা দেন।”

-” তোমাকে লজ্জা দেওয়া আমার অধিকার। স্বামীর লাইসেন্সে তোমাকে লজ্জা দেওয়া–নেওয়ার ছাড়পত্র আমার আগেই মঞ্জুর।”

প্রত্যাশা চোখ খিচে বুঁজে নিল। দম আটকে আসছে। কম্পিত স্বরে বলল,

-” নীরব স-সরুন।”

নীরব স্মিত হাসল। মুখটা প্রত্যাশার খুব কাছাকাছি এনে ওর ঠোঁটের কিনারায় দৃষ্টি রেখে বলল খুব আস্তে,

-” দু’দিন পরেই তোমার পরীক্ষা। এখন তোমাকে একটুও দুর্বল করতে চাই না। সত্যি বলছি, তোমার কাঁপা কাঁপা আদুরে ঠোঁটজোড়া; এতটা টানছে যে নিজেকে কন্ট্রোল করাটা কঠিন। তবুও, আজ শুধু; জাস্ট ওয়ান ডিপ কিস। ওনলি ওয়ান আই প্রমিস।”

কোনো কিছু ঠাওর করার আগেই নিঃশ্বাস আটকে এল প্রত্যাশার।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

পাখির কিচিরমিচির, সকালবেলার বাতাস সব যেন স্তব্ধ। রুমে শুধু তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ। নীরব আলতোভাবে প্রত্যাশার গালের পাশ থেকে ঠোঁট নামিয়ে আনল মেয়েটার ঠোঁটের উপর। নরম, কোমল ছোঁয়ায় প্রত্যাশার চোখ দুটো বুজে এলো। ভেতরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। হৃদস্পন্দন ছন্দহীন গতিতে ছুটছে। নীরবের ওষ্ঠ আরেকটু গভীর হলো, শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। দু’জনের আবেশ গাঢ় হলো। সময় গড়াতে থাকল নীরবের স্পর্শ বেহায়া হলো। প্রত্যাশার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। নীরবের ঠোঁট সরল ধীরেধীরে। আর সরতেই প্রত্যাশা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। গলায় আটকে থাকা নিঃশ্বাসটুকু হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল। লজ্জায় মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। কানে লজ্জার র*ক্তা*ভ আভা ছড়িয়ে পড়েছে। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিলো প্রত্যাশা। নীরব সেদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে নিজের ওষ্ঠ মুছতে মুছতে মিটমিট হাসল।

ঠোঁটজোড়া জ্বলছে। প্রত্যাশা অল্প-স্বল্প রাগি দৃষ্টিতে নীরবের দিকে তাকাল। নীরব সে রাগের পরোয়া না করে প্রত্যাশার ঠোঁটের দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে আঙুল দিয়ে আলতোভাবে প্রত্যাশার ঠোঁটে ছুঁয়ে দিল। হিম শীতল স্বরে বলল,

-” স্যরি! তবে এই ভুল বারবার করতে রাজি আছি।”

ঠিক এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। প্রত্যাশা দ্রুত দুইহাত নীরবের বুকে রাখল। নীরবের গা ঠেলে বলল তড়িঘড়ি করে,

-” সরুন! কেউ এসেছে।”

নীরব বিরক্ত গলায় কপাল কুঁচকে বলল

-” ধুর! সকাল সকাল ডিস্টার্ব করতে কে এলো? আমার রোমান্সটা কারো বুঝি সহ্য হচ্ছে না।”

দরজার ও পাশ থেকে পরী গলা ছাড়িয়ে ডাকল,

-” ছোডো ভাইজান, আপনের কালা কফি দেই?”

নীরবের কথা শুনে প্রত্যাশা ঠোঁট টিপে হাসতে থাকে। নীরব বিরক্ত মুখে উঠে বসে স্যান্ডেল পায়ে চাপল। পরপর নিচের ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। আচমকা প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকে দুষ্টুমির স্বরে বলল,

-” এই প্রথম সকাল মিষ্টি চুমুতে শুরু হলো। এরপর থেকে ব্লাক কফিতে পোষাবে না আমার। এখন থেকে তোমার মতো হট মর্নিং ব্রিউ আমার রোজ চাই।”

প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ মুখে বালিশ চেপে মুখ লুকিয়ে ফেলে। বালিশে মুখ গুঁজে বলল হাপুস নয়নে,

-” নীরব আপনি অসহ্য!”

-” সহ‌্য হয়ে যাবে।”

বলে টিশার্টের কলার ঠিক করতে করতে শিষ বাজিয়ে দরজা খুলতে গেল। দরজা খুলেই এক ধ’ম’ক লাগিয়ে দেয় নীরব,

-” এত সকাল সকাল এভাবে চিল্লাচ্ছিস কেনো? এভাবে ননস্টপ কড়া নাড়তে হয়?”

পরী বে’কুবের মতন চেয়ে ভাবল— ছোডো ভাইজানের আবার হইলো ডা কী? বেহুদা রাগ ঝাড়তাছে ক্যান? আগে না দেরি হইলে রাগ করতো। আজ ঠিক টাইম মতো আইসাও ধ’ম’কানি শুনতাছি। ইয়া আল্লাহ! কী করমু, ডানে গেইলেও দেহি দুষ, বামে গেইলেও দুষ।

নীরব কফির মগ হাতে নিয়ে কড়া গলায় ধ’ম’কের সুরে বলল,

-” এভাবে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস?”

পরীর ধ্যান ভাঙল। তটস্থ হয়ে বলল,

-” ক-কই কিছু না কো। নতুন ভাবির চা।”

নীরব আরেক হাতে প্রত্যাশার জন্য আনা গ্রীন টির কাপটা নিল।

.
.

নীরব কোমরে বেল্ট গুঁজছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাজ গুলো পরছে আর মাঝেমাঝে কোণা চোখে তাকাচ্ছে বিছানায় বসে থাকা প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশা দুই হাত পেছনে ঠেস দিয়ে বসে আছে। পা দুটো দোলাচ্ছে টুকটুক করে। মুখটা গোমড়া। ঠোঁট উল্টে বলল,

-” আমি বাসায় যাব।”

-” এটা বাসা না?”

-” আমার বাসায়।”

-” এটাই তো তোমার বাসা। বিয়ের পর মেয়েদের স্বামীর ঠিকানাই হয় আসল ঠিকানা।”

প্রত্যাশা মুখ ভার করে ফেলল। মাথাভর্তি ভেজা চুলে ব্রাশ চালাতে চালাতে বলল নীরব,

-” অল্প বয়সী বউ হলে এই এক সমস্যা। শুধু বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য প্যানপ্যান করতে থাকে।”

-” এই প্রথম আমি আম্মুকে ছাড়া এতদিন কোথাও থাকছি। তারপর আজ আমার জন্মদিন। আম্মুর হাতের পায়েস ছাড়া আমার চলবে না। আম্মু-আব্বু ফোন করেছিল একটু আগে, উইশ করেছে, তবে যাওয়ার কথা কিছু বলেনি। আপনার কথা ভেবে হয়তো আম্মু বলছে না। আপনি তো এখন সুস্থ। এইযে অফিস যাচ্ছেন, সব করছেন। সারাদিন ডিউটিতে থাকবেন। এখানে আমার থেকে আর কাজ কী? দরকারটাই বা কী? তাছাড়া আমার পরীক্ষা।”

গায়ে পারফিউম স্প্রে করে পরপর সার্ভিস রিভলবারটা কোমরে গুঁজে নিল। অকস্মাৎ দু’কদম এগিয়ে ভ্রু উঁচু করে বলল একটু দুষ্টু গলায়,

-” সারাদিন দরকার না পড়লেও, রাতে বউ লাগবে।”

প্রত্যাশা মুখ ঝামটা দিয়ে অন্যদিকে চাইল। নীরব হাতে কালো ঘড়িটা পড়ে বাইরে যেতে যেতে বলল,

-” যাওয়ার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে এখন নাস্তা করতে আসো।”

প্রত্যাশা অনলাইনে ঢুকতেই বন্ধুদের একগাদা মেসেজ আর টাইমলাইনে উইশ করা পোস্ট পেল।

____________

-” আবির খেয়ে যা বাবা।”

-” বাইরে থেকে খেয়ে নেবো আম্মু।”

বা হাতের ফাঁক দিয়ে পিঠের সাথে গিটার, পিঠে ব্যাগ, কেডসের ফিতে বাঁধতে বাঁধতে উত্তর দেয় আবির। শর্মিলা পেছন থেকে একরাশ হতাশা প্রকাশ করে বললেন,

-” একে তো ঠিকমতো খাস না, আবার যা খাস ফাস্টফুড। এভাবে চললে শরীর খারাপ হবে।”

আবির কথা কানে না তুলে ব্যস্ত ভঙিতে দরজার দিকে এগোয়। ঠিক তখনই গম্ভীর, ঠান্ডা, অথচ রাশভারি কণ্ঠে পা দুটো থেমে যায়।

-” আবির, ছোটো মা খেতে বলছে না? ব্যস্ততা দেখিয়ে যাচ্ছিস কই তুই?”

আবির ভ’য়ে ভ’য়ে আস্তে করে ঘুরে তাকায়। ছোটো দাদানের চিরচেনা কঠোর মুখভঙ্গি দেখে দৃষ্টি আপনাআপনি নুইয়ে এল। নীরব জিজ্ঞেস করল,

-” পিঠে গিটার কলেজ নেই আজ?”

আবির জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে বলল,

-” ই-ইয়ে মানে ছোটো দাদান, আজ একটু দেরিতে ক্লাস।”

-” মিথ্যে বলছিস তা তোর চো’রচো’র মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কলেজ বাদ দিয়ে গিটার নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? সত্যি করে বল, নইলে__”

অদূরে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা ভেংচি কে’টে আওড়ালো —- এ তো আচ্ছা লোক। বাচ্চা ছেলে এক আধ দিন কলেজ বাদ দিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ফিরতে যেতেই পারে। এভাবে জেরা করার কী আছে? পু’লিশের ডিউটি বাড়িতে পালন করছে। উফ্! যত্তসব!

শর্মিলা পাশ থেকে বলে উঠলেন,

-” আবির পড়াশোনায় খুব ফাঁকিবাজ হয়েছে। পড়াশোনা শৃঙ্গে উঠিয়ে সারাদিন শুধু বন্ধুদের সাথে ঘোরাফেরা, খেলাধুলা, গান শেখা, আর আড্ডা দেয়া। এই ওর কাজ। তোর চাচ্চুকে বলে ওর একটা বিহিত করতে হবে। দিনদিন কথা তো শুনছেই না। আরো বেশি খা’রাপ হচ্ছে।”

নীরব কড়া গলায় শাসনের সুরে বলল,

-” কয়েকদিন আমি লক্ষ্য করেছি, সন্ধ্যায় মোড়ের উপর বা’জে ছেলেদের সাথে তোকে আড্ডা দিতে। নেক্সট ওদের সাথে মিশতে না দেখি। সন্ধ্যার পর বাইরে তোর ছায়াও যেনো না পড়ে। কথাগুলো যেনো মনে থাকে।”

নীরবকে প্রশ্রয় দিতে বলল শর্মিলা,

-” এভাবে বললে ও শুনবে না। এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিবে। তুই পিটিয়ে ওর ছাল তুলে ফেলিস। আমি কিচ্ছুটি বলব না। শাসন না করলে ও মানুষ হবে না।”

নীরব আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,

-” গিটার নামা। নাস্তা করে কলেজে যা। আমি কিন্তু ফোন দিয়ে কলেজে শুনব, সব কটা ক্লাস করেছিস কী না।”

আবির মাথা নিচু করে দ্রুত কেডস খুলে গিটার রেখে সোজা ডায়নিংয়ে যায়। মনেমনে আওড়ায়— বড় দাদান কত সুন্দর সবসময় হাসি মুখে কথা বলে। আর ছোট দাদান ধ’ম’ক ছাড়া, শাসন ছাড়া ভালো কথা জানেই না।

প্রত্যাশা বেচারি একটু ভয় পেলো। আঁতকে উঠে ভাবে— উরি বাবা! আমার রেজাল্ট খা’রাপ হলে এএসপি সাহেব এরকম করে বকাঝকা করবে না তো?

চেয়ার টেনে বসে জগ থেকে পানি ঢেলে নিচ্ছিল নীরব। নীহারিকা বললেন,

-” একটু দাঁড়া বাবা, পরী ডিম ভাজছে। ভেজে রাখলে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কখন তোরা খেতে আসিস ঠিক নেই। তাই বলেছিলাম পরেই ভাঁজতে।”

পানির গ্লাস হাতে তুলতে তুলতে নীরব বলল,

-” সমস্যা নেই।”

নীহারিকা প্রত্যাশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

-” প্রত্যাশা তুমিও বসো, দাঁড়িয়ে আছো কেনো!”

প্রত্যাশা এগিয়ে নীরবের পাশের চেয়ারটায় বসল। নীরব মা’কে জিজ্ঞাসা করল,

-” বাবা, ভাইয়া সবাই খেয়েছে?”

-” হ্যাঁ ওরা সবাই নাস্তা করেছে। নিভান অফিসে চলে গিয়েছে। নীলাশা বোধহয় রুমে।”

নীরব মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” মা, প্রত্যাশাকে আজ বাড়ি দিয়ে আসবো। অফিস থেকে বিকেলে ফিরব। বিকেলের দিকেই ওকে রাখতে যাব।”

-” আজই?”

-” আসলে আর তো দুইদিন বাকী আছে ওর পরীক্ষার। ওখান থেকেই পরীক্ষা দিবে। আর আজ ওর জন্মদিন। আন্টি কাল ফোন দিয়েছিল, আমি বলেছি আজ দিয়ে আসবো।”

শর্মিলা নিঃশব্দে হাসতে হাসতে বলল,

-” সে কি নীরব তুই শাশুড়িকে এখনো আন্টি ডাকিস!”

নীরব বোধহয় একটু লজ্জা পেল। উত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অপ্রতিভ্য হেসে বলল,

-” আগে থেকে ওভাবে বলে এসেছি, এখনো অভ্যস্ত হইনি তাই।”

নীহারিকা বললেন,

-” আচ্ছা, আজ প্রত্যাশার জন্মদিন আগে কেনো জানাসনি?”

প্রত্যাশা মনে মনে বলল— কই নিজের ছেলেকে আজ কিছুই তো বলল না। অথচ আমাকে সেদিন কথা শোনাতে বাদ রাখেনি। মা শেখায়নি কাকে কী সম্বোধন করতে হয়? নীলার থেকেও তো শিখতে পারো। আদরের ছোট ছেলেকে তো একবারও বলল না; নিভানকে দেখেও তো শিখতে পারিস। নিজের ছেলের বেলায় সাত খু°ন মাফ। হাহ!

শর্মিলা মিষ্টি হেসে প্রত্যাশাকে বলল,

-” শুভ জন্মদিন মিষ্টি মেয়ে। আগে থেকো বলোনি কেনো রে? গিফট তো কিছু আনা হয়নি। থাক এক্ষুনি তোমার চাচ্চুকে ফোন করে বলছি।”

প্রত্যাশা অপ্রতিভ্য ভঙিতে মাথা নেড়ে বলল,

-” আরে ছোটমা, লাগবে না এত কিছু।”

___________

প্রত্যাশার গায়ে অফ হোয়াইট রঙের গর্জিয়াস গাউন। সূক্ষ্ম সাটিনের ছোঁয়া আর কোমল ফ্লেয়ারে তৈরি গাউনটা উজ্জ্বল শ‌্যামবর্ণ গায়ে রঙটা ঠিক যেন ঝিকিমিকি মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। কোমরের কাছে হালকা জড়ানো কাট, পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে শ্যাম্পু করা রেশমী চুল। ঠোঁটে গোলাপি রঙের লিপবাম, চোখে লেগে আছে অনুচ্চারিত আভা। নীরব ইউনিফর্মের বাটন খুলতে খুলতে বলল,

-” তোমার থেকে চোখ তো সরাতেই পারছি না। তোমাকে একদম হোয়াইট লিলির মত লাগছে।”

প্রত্যাশা লজ্জা পেয়ে বলল,

-” আপনি একটু বেশিই বলেন।”

-” মোটেই না।”

-” আচ্ছা কথা বাদ দিয়ে জলদি ফ্রেশ হয়ে একেবারে রেডি হয়ে আসুন। আম্মু বারবার ফোন দিচ্ছে। অনেককিছু রান্না করেছে, কেক বানিয়েছে। সব রেডি করে বসে আছে।”

প্রত্যাশা দরজা অবধি গিয়েও কিছু মনে করে ফিরে তাকিয়ে বলল,

-” নীরব?”

-” হুঁ।”

-” আপনি কিন্তু এখনো আমার কাছে ছবিগুলোর ব্যাপারে সবটা খোলাসা করেননি। আমিও জানতে চাই, ওই ছবিগুলো কে পাঠিয়েছে? কীভাবে তুলেছিল?”

-” আজকের মধ্যেই সব উত্তর পাবে। সবটা তোমার সামনেই প্রকাশ করা হবে। আর একটু ওয়েট।”

.
.

নীহারিকা নিজেও কেক বানিয়েছে। যতই হোক ছোট ছেলের বউ। আবার মেয়েটা অনেক ছোট। আজকের দিনে এমনিতেই কী করে ছাড়ে? তাই বলেছেন কেক কে’টে যাবে। বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের সাথেও কেক কা’টবে সমস্যা নেই। ওদিকে অধরা ফোন করে এ বাড়ির সবাইকে জানিয়ে আসতে বলেছিল। সবারই কিছু না কিছু ব্যস্ততা থাকায় না করে। এমনিতে জন্মদিন সেভাবে বড় করে করা হয় না। জাস্ট পরিবারের সদস্যরাই থাকে।

প্রত্যাশা গুটিগুটি পায়ে ড্রয়িংরুমে যায়। নীহারিকা ব্যস্ত ছিলো। হঠাৎ প্রত্যাশার দিকে চোখ পড়ল। গাউনটাতে ওকে বেশ সুন্দরই লাগছে। তবে ভেবেছিলেন আজ হয়তো শাড়ি পড়বে। নীহারিকা আকস্মিক বলে উঠলেন,

-” এখনকার মেয়েরা তো শাড়ি-টাড়ি তেমন পড়ে না। তাই বলছি, পাকিস্তানি থ্রি পিস পড়তে পারো। এসব পড়লে তোমাকে বেশি বাচ্চা বাচ্চা লাগে।”

প্রত্যাশা মুখে হাসি টেনে বলল,

-” জন্মদিন উপলক্ষে এটা আপনার ছেলে গিফট করেছে।”

-” ওহ্।”

বলে নীহারিকা আর বাড়তি কথা বলল না।

নীলাশা এসে সোফায় বসল। প্রত্যাশা পাশে বসতে বসতে বলল,

-” আপু বাসায় যাবে? আমাদের সাথে চল।”

নীলা রষকষহীন স্বরে বলল,

-” নাহ। ক’দিন পর যাব।”

নীলার নজর প্রত্যাশার পায়ের দিকে পড়ল, পায়ে রুপোর পায়েলটা চকচক করছে। ডিজাইনটাও নজরকাড়া। নীলা বলে উঠল,

-” পায়েলটা তো সুন্দর! কবে বানিয়েছিস?”

প্রত্যাশা একগাল হেসে বলল,

-” তোমার দেবর আমার বর মশাই গিফট করেছেন। তার বউয়ের জন্মদিনে।”

-” ওহ্।”

দু সেকেন্ড পরেই নীলাশা ঠোঁট বাঁকিয়ে ঠেস দিয়ে বলল,

-” আমার জন্য তোর কপাল খুলে গেছে রে প্রত্যাশা। আমার এ বাড়িতে বিয়ে হয়েছে বলেই, আমার অছিলায় এত ভালো বর, এত ভালো ঘর পেয়েছিস। এটা তো তোর সাত কপাল।”

প্রত্যাশা মুচকি হেসে চুলের গোছা কানের পিঠে গুঁজে বলল,

-” তোমার দেবরের কপাল ভালো ভালো, আমার মতো কিউট পিচ্চি বউ পেয়ে গেছে। আর এই বাড়ির লোকজন? উমম! আল্লাহ চাইলে তারাও একদিন বলবে; ‘ভাগ্য করে এমন বউমা পেয়েছি।’ আর তুমিও একদিন বলবে, কপাল করে তোর মতো একটা ছোট বোন পেয়েছিলাম। প্রত্যাশা রে চির কৃতজ্ঞ তোর কাছে।”

প্রত্যাশা মজা করে বলে দাঁত কেলিয়ে হাসল। নীলাশা সাথে সাথেই উপহাসের সুরে বলল,

-” হাহ, হাসালি! আমি বলব এমন কথা? জীবনেও না।”

-” কখন, কে, কীভাবে, কার কাছে ঠেকে বলা তো যায় না। তাই বেশি অহংকার ভালো নয়। হুহ।”

নীলা মশা তাড়ানোর ভঙি করল। উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। কয়েক মূহুর্ত পর। নীলা দুই আঙুলে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,

-” ধ্যাত, আজ দু’দিন মাথা চুলকাচ্ছে কেনো? উকুন-টুকুন হলো না তো। ইশশ্! এমন হলে বি’শ্রী হবে। সেই ক্লাস সেভেনে থাকতে একবার হয়েছিল। কী যে রাগ লাগতো।”

প্রত্যাশা উৎসুক হয়ে বলে উঠল,

-” উকুন তাড়ানোর গ্রেট আইডিয়া আমার কাছে আছে।”

-” কীহ?”

-” শোনো আপু, তোমার মাথার উকুন দূর করতে একটা ঝাক্কাস আইডিয়া দিই। দু থেকে তিনটে জন্মনিরোধক পিল গুঁড়ো করে তেলের সাথে মিক্সড করবে। দেন সেই তেলটা রাতে চুলে লাগিয়ে রেখে, সকালে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে নিবে।”

প্রত্যাশার আইডিয়া প্রথমে মনোযোগ দিয়ে শুনতে গেলেও পরের কথাশুনে নীলা থ হয়ে যায়। প্রত্যাশা একগাল হেসে দুই আঙুলে চুটকি বাজিয়ে বলল,

-” এরপর দেখবে উকুন বংশবিস্তার কীভাবে করে!”

নীলা রাগত চাউনিতে তাকাতেই প্রত্যাশা দুই হাতে কান ধরে ক্ষমা চাওয়ার অ্যাক্টিং করে বলল,

-” স‌্যরি, স্যরি। এমনিই মজা করেছি।”

#চলবে