মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৩৭+৩৮

0
10

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

সাদা শার্ট কালো প্যান্টের ওপর গুছিয়ে ইন করে পড়া। হাতার স্লিভ গুটাতে গুটাতে ড্রয়িংরুমের দিকে আসছিল নীরব। ঠিক তক্ষুনি প্রত্যাশার উকুন তাড়ানোর অভিনব আইডিয়া শুনে মুখ ফুলিয়ে ফুস করে শ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল,

-” উফ্! সেমি পা’গ’লি বউ নিয়ে কী যে কপালে আছে আমার!”

তন্মধ্যে শর্মিলা নামিদামি একটা শপিং ব্যাগ প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে বলল,

-” এইযে মিষ্টি মেয়ে এটা আমার পক্ষ থেকে। খুলে দ্যাখো।”

ভেতরে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। শাড়িটা সিল্কের, আর তাতে ছোট ছোট ফুলের কাজ করা। প্রত্যাশা একগাল হেসে মুগ্ধ গলায় বলল,

-” থ্যাংক ইয়্যু ছোটমা। শাড়িটা খুব সুন্দর! তোমাকে এত্তগুলা ভালোবাসা।”

শর্মিলা মুচকি হেসে একটু মজার ছলে বললেন,

-” এমন মিষ্টি হাসি না দিলে গিফট বাতিল করতাম।”

প্রত্যাশা অমনই হাসি ঠোঁটে নিয়ে বলল,

-” ওমা তাই!”

নীরব তাড়া দিয়ে বলল,

-” তাড়াতাড়ি কেক কা”টা হোক। দেরি হচ্ছে তো।”

শর্মিলা কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,

-” একটু ধীরসুস্থেই যা। এত তাড়াহুড়ো কিসের? নীরব তোর তো সবেতেই তাড়া।”

ড্রয়িংরুমে রঙিন বেলুনে ভরা। প্রত্যাশা কেক কে”টে সবার মুখে এক টুকরো করে তুলে দিচ্ছে। আবির মোবাইলে ক্লিক করে একেকটা মুহূর্ত বন্দি করছে ক্যামেরায়। আকস্মিক গমগমে স্বরে বলে উঠল আবির,

-” সবাইকে খাওয়ালে, কিন্তু ছোট দাদানকে তো খাওয়ালে না নতুন ভাবি?”

প্রত্যাশা একটু থমকে গেল। মুখে লালচে লজ্জা ছড়িয়ে পড়ল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। আবির আবার কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই চোখ পড়ে নীরবের দিকে। নীরবের দিকে চোখ পড়তেই মুখটা আমসত্ত্ব হয়ে যায় আবিরের। নীরবের চোখে রাগের সুক্ষ্ম ঝলকানি। নীরব চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই আবির বাকি কথাগুলো ঝটপট গিলে নেয়। ঢোক গিলে ভাবে— এইরে কাকে নিয়ে ফা’জলামি করতে গিয়েছিলাম। ভুলেই গিয়েছিলাম বা”ঘ সামনেই আছে। থাবা মে*রে দাঁত ফেলেনি এইতো শুকরিয়া।

নিভান এসে হাসিমুখে রঙিন র্যাপিং কাগজে মোড়ানো একটা গিফট বাড়িয়ে বলল,

-” এইযে প্রত্যাশা, নাও গিফট। আজকের স্পেশাল গিফটা বোধহয় আমার তরফ থেকেই পাচ্ছো।”

নীলা ফোড়ন কা’ট’ল,

-” ধ্যাত! ওগুলো আবার দেয় নাকি! বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও যতসব হাবিজাবি দিতে গেলে।”

নিভান দু’টো চকলেট বক্স বাড়িয়ে বলল,

-” এগুলো তোমার আপুর পক্ষ থেকে। আর আমার দেয়া গিফটটা খুলে দ্যাখো।”

-” শিওর।”

প্রত্যাশা ঝটপট খুলল। রঙিন মোড়কের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা নরম গোলাপি কাপড়ে মোড়ানো ফটোফ্রেম। কাপড়টা সরাতেই চোখ ছানাবড়া। ভেতরে একটা ডিজাইনার ফ্রেম। চারটা ছবি একসাথে বসানো। বিয়ের দিনকার ছবি। সোফায় পাশাপাশি বসে ওরা। নীরবের গায়ে ইউনিফর্ম, প্রত্যাশা নীল শাড়িতে মোড়া। শাড়ির ঘোমটা বড় করে টানা। অন্য ছবিতে শফিক সাহেব মেয়েকে নীরবের হাতে তুলে দিচ্ছেন। সেখানে শুধু হাতের ছবিটুকু।

নিভানের গলা শোনে চমকে উঠল প্রত্যাশা,

-” কেমন লাগল? ইউনিক গিফট না?”

প্রত্যাশা এক্সাইটেড হয়ে বলল,

-” এই ছবিগুলো যে আছে, সেটা তো জানতামই না আমি! কে তুলেছিল?”

নিভান হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,

-” ঘোমটার আড়ালে কিছু দেখতে পাওনি তুমি। নীলাকে বারবার বললাম ঘোমটা তুলে দিতে। সে কানেই তুলল না। ছবিগুলো ফোনে আমি তুলেছিলাম।”

নীরব একহাত পকেটে গুঁজে অন্যহাতে শার্টের কলার ঠিক করার ভঙি করল। বলল মৃদুস্বরে,

-” বারো হাত শাড়ির তেরো হাত ঘোমটা টেনেছিল সেদিন।”

সবাই মিটমিট করে হাসতে থাকল। নিভানের কথার জবাবে নীলা বলে,

-” আরে আমার কি দোষ, ওতো কবুল পড়ার আগ মুহুর্ত থেকেই ঘোড়ার মতন কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল। বড়রা যখন ওকে ওখানে নিতে বলে, সেইসময় আম্মু ধ’ম’কিয়ে ওর কান্নার বেগ থামিয়ে পাঠায়। ওইটুকু সময়েই কেঁদেকেটে চোখমুখের অবস্থা নাজেহাল করেছিল। কাঁদছিল বিধায় বড় করে ঘোমটা দেয়া হয়।”

নীরবের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” আর আপনি? নিজে তো ঠাসঠাস কবুল পড়ে পাঁচ মিনিট না হতেই উধাও।”

মাহবুব সিদ্দিকী এসে দাঁড়ালেন। প্রত্যাশার মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন,

-” জন্মদিন মানেই শুধু আনন্দ নয় মা। দিন বাড়ছে, মানে হায়াত কমছে। তাই যেমন বড় হচ্ছো, তেমনি বুদ্ধি, ধৈর্য, সহনশীলতা এগুলোও বাড়ুক। আল্লাহ তোমায় হেদায়েত দিক। মানুষের মতো মানুষ হও, মা। আমরা শুধু দোয়া করতে পারি। দোয়া করি অনেক অনেক সুখী হও।”

বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে তিনটা এক হাজার টাকার নোট বের করে দিলেন। প্রত্যাশা নম্রস্বরে বলল,

-” বাবা আপনাদের দোয়াই সবচেয়ে বড় উপহার। এসব লাগবে না।”

মাহবুব সাহেব বললেন,

-” বুড়ো বাবার দেয়া সামান্য এটুকু রাখো মা। কিছু কিনে নিও।”

প্রত্যাশা ইতস্তত করছিলো, পাশ থেকে নীরব চোখের ইশারায় কিছু বোঝাল। প্রত্যাশা আর দ্বিরুক্তি না করে নেয়। সবশেষে নীহারিকা আসলেন। মুখে চিরচেনা গম্ভীরতার রেষ নিয়েই বললেন,

-” একটু একটু করে বয়স বাড়ছে, সেই হিসেবে বুদ্ধিও যেনো বাড়ে। আশাকরি ছেলেমানুষী স্বভাবটা কমিয়ে সবকিছুতে সিরিয়াস হবে। বিয়ে হয়েছে, সংসার করতে হবে আস্তে আস্তে সবটা শিখে-পড়ে নিবে। দোয়া করি সবসময় হাসিখুশি ভালো থেকো, সবাইকে ভালো রেখো।”

সবাইকে একদফা অবাক করে গলা থেকে স্বর্ণের চেইনটা খুলে প্রত্যাশার গলায় পড়িয়ে দিলেন নীহারিকা। প্রত্যাশা ভাষা হারিয়ে ফেলল। বারণ করলেও নীহারিকা ধ’ম’কিয়ে চুপ করে দিলেন ওকে। নীলার মুখটা পানসে হয়ে গেল। ভাবল—- মা যতোই উপরে উপরে প্রত্যাশাকে ধমকাধমকি করুক না কেনো। উনি আসলে ছোট ছেলের বউকেই বেশি ভালোবাসেন।

___________

সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরেধীরে গোধূলির আভায় মিশে যাচ্ছে। প্রত্যাশা চনমনে হয়ে কলিংবেল চাপল। অধীর আগ্রহে চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষায় ছিলেন অধরা। বেলের শব্দ কর্ণপটে পৌঁছানোর সাথেসাথেই দরজা খুলে দেন। কোনো কিছু ঠাহর করার আগেই প্রত্যাশা সেকেন্ডের ভেতর মায়ের গলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুখ গুঁজে আহ্লাদী ভঙিতে বলল,

-” আম্মুউউউ।”

অধরার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-” পা”গলী মেয়ে আমার। কেমন আছিস?”

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বলল,

-” আব্বুকে আর তোমাকে খুব মিস করছিলাম।”

নীরব এতক্ষণে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। শফিক সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,

-” আরে, আগে নীরবকে আসতে দাও। ভেতরে এসো বাবা।”

অধরা মেয়েকে ছাড়িয়ে নরম স্বরে বললেন,

-” প্রত্যাশা আম্মু আমার নীরবকে আগে রুমে নিয়ে যা। ফ্রেশ হবে।”

প্রত্যাশা মাথা নাড়ল। রুমে ঢুকেই বুক ভরে শ্বাস টেনে নেয় প্রত্যাশা। নিজের রুমের পরিচিত গন্ধটায় একধরণের পুরনো শান্তি এসে ভর করল।

.
.

হালকা নাস্তার পর প্রত্যাশার রুমের বেডে বসে নীরব ফোন স্ক্রল করছিল। ইনবক্স, নিউজ, অফিসিয়াল মেইল সব একটুখানি করে দেখে নিচ্ছিল। কয়েক সেকেন্ড পরেই নীরব ফোনটা পাশে নামিয়ে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল; দিনভর চাপা ক্লান্তির মতো।

প্রত্যাশা রুমে ঢুকে বেডের একপাশে বসল। কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে আস্তে করে শুধাল,

-” নীরব? শুয়ে আছেন যে, শরীর খারাপ লাগছে?”

নীরব চোখ বন্ধ রেখেই বলল,

-” তেমন কিছু নয়। একটু টায়ার্ড লাগছিল।”

-” বেশি খারাপ লাগছে?”

প্রত্যাশার উদ্বেগ, উদ্বিগ্নতা দেখে নীরব প্রসন্ন হাসল। পা’গলীটা যে এতটুকু চিন্তা করেছে এই অনেক। মাথার নিচে হাত ভাঁজ করে রেখে প্রত্যাশার দিকে তাকায় নীরব। বলল,

-” ডোন্ট ওয়ারি। একটু ক্লান্ত লাগছিল। বাট এখন ঠিক আছি।”

প্রত্যাশা প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসল। পরপর উঠে কাবার্ড খুলে কুর্তি আর প্লাজো বের করতে করতে বলল,

-” ড্রেস চেঞ্জ করব। এটা অনেক ভারী, ক্যারি করতে কষ্ট হচ্ছে।”

নীরব উঠে বসতে বসতে বলল,

-” প্রত্যাশা আমি এখন আসছি।”

-” আসছি মানে? এখনই যাবেন কেনো? আম্মু ডিনারের জন্য কত কী রান্না করেছে। ডিনার করে যাবেন।”

-” আজ নয়, অন্যদিন ডিনার করব। এখন যেতে হবে।”

-” আজকে কী সমস্যা?”

প্রত্যাশার হাতের ভাঁজে জামাকাপড়। নীরব সামনে এসে দাঁড়াল। চুলে ব্যাক ব্রাশ করে নিয়ে বলল,

-” তোমার পড়াশোনার ক্ষ’তি হোক, সেটা চাই না। আমার জন্য তোমার সময়গুলো ন*ষ্ট হচ্ছে। এর চেয়ে বরং তুমি পড়ো। ভালো করে প্রিপারেশন নাও। সমস্ত মনোযোগ পড়াশোনায় দাও।”

প্রত্যাশা ঠোঁট মেলে কিছু বলবে, তার আগেই ওর শব্দগুলো গলায় আঁটকে যায়। নীরব টুপ করে প্রত্যাশার সফট গালে চুমু খেয়ে বলল,

-” বায়।”

প্রত্যাশা ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

-” বায়।”

নীরব দরজা অবধি গিয়ে আবার কিছু মনে উঠতেই বলল,

-” প্রত্যাশা, আজকে কথাটা রাখতে পারলাম না, স্যরি।”

-” ব্যাপার না।”

-” পরশু তোমার পরীক্ষা, যদি আগামীকাল এক ঘন্টা সময় আমাকে দাও, খুব কী বেশি প্রব্লেম হবে?”

-” না না। কত সময় আমি এমনি ন’ষ্ট করে থাকি। বরং সত্যিটা জানলে মাথার ভেতর থাকা চাপা কৌতুহল, টেনশন সব দূর হবে। আর দূর হলেই আমি ফ্রি মাইন্ডে একটু পড়াশোনা করতে পারব।”

-” ওকে।”

______________

হোটেলের সেই বয়টার সঙ্গে নীরবের শেষপর্যন্ত ফোনে যোগাযোগ হয়। সরাসরি সব কিছু না বললেও, কথায় কথায় কিছু দরকারি তথ্য বের করে আনে নীরব। ওকে বুঝিয়ে বলে; সব সত্যি বললে কিছু হবে না, কিন্তু লুকোচুরি করলে মামলা হবে। শুনে ছেলেটা ভ”য় পায়, কারণ ক’দিন পরেই সে মালয়েশিয়া যাবে। এখন কোনো কেসে জড়িয়ে পড়লে ঝামেলায় পড়বে। তাই সে আর লুকায় না, সব কিছু খোলাখুলি বলে ফেলে।

প্রীতি একটা নামকরা বিদেশি প্রজেক্টে চাকরি করে। গতকাল তার ওখানে রাত দশটা পর্যন্ত প্রোগ্রাম ছিল। তাই বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। প্রীতির ফিরতে রাত হবে এটা জানার পরেই নীরব সিদ্ধান্ত বদলায়।

পরেরদিন…..

পড়ন্ত বিকেল। প্রত্যাশা বাড়িতে বলেছে — মাইন্ড রিফ্রেশ করতে একটু ঘুরতে যাবে। ঘন্টার আগেই ফিরবে। নীরব এদিক দিয়ে যাচ্ছিল গেইটে আছে।

কথাটা অবশ্য প্রত্যাশার নয়, নীরবের শেখানো কথাটা তোতা পাখির মতন বলে বেরিয়ে আসে প্রত্যাশা।

প্রীতির লম্বা সরু আঙুলগুলো ল্যাপটপের কিবোর্ডে থেমে থেমে চলছিল। নিখুঁত দক্ষতায় ফাইল তৈরি করছিল সে। এমন সময় বুয়া এসে বলল,

-” ম্যাডাম, ওই স্যার আসছে?”

-” ওই স্যার মানে?”

-” ওই যে পুলিশ অফিসার স্যার।”

প্রীতির মসৃণ কপালে কুঞ্চন পড়ে গেল। পাতলা ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,

-” নীরব? এই সময়ে?”

পরক্ষণেই ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি টেনে বলল,

-” ইচ্ছের সাথে দেখা করতে।”

বুয়া গলায় ভ”য় মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

-” ম্যাডাম, উনি আপনাকে ডাকতেছেন।”

ওড়নাটা কাঁধে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল প্রীতি। একগাছি চুল কাধের উপর দিয়ে সামনে টেনে আনতেই চোখ পড়ে নীরবের দিকে। হাত দুটো জিন্সের পকেটে গুঁজে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কফি রঙা টিশার্ট ফর্সা গায়ে আঁটসাঁট হয়ে আছে। প্রীতির মুখের ভাব এক মুহূর্তেই বদলে গেল, নীরবের পিছনে প্রত্যাশাকে দাঁড়িয়ে দেখে। ঠোঁট শক্ত হয়ে এল। তীব্র গলায় বলল,

-” ডেকেছো ক্যানো? কী দরকার? তোমাদের ফ্যামেলির কারো সাথেই তো আমার কোনো দরকার থাকার কথা নয়। তাহলে আজ হঠাৎ এএসপি নীরব মাহবুবের আমাকে কেনো দরকার পড়ল? তাও আবার এই অসময়ে!”

নীরবের জবাব দেয়ার ধরণ দেখে প্রত্যাশা আঁতকে উঠল। অবিশ্বাস্য ঠেকল নিজের চোখ-কানকে। প্রীতির গালে কষে একটা চ”ড় মা*রে নীরব। চারদেয়ালের মাঝে চড়ের শব্দ ধ্বনিত হতে থাকে। প্রত্যাশা অবিশ্বাস্য নয়নে ক’বার পলক ফেলল। নীরবের চোখমুখ কঠিন। প্রীতির গালে আপনাআপনি ডান হাতটা চলে আসল। প্রীতি গালে হাত রেখেই চোখে আ*গুন নিয়ে গর্জে উঠল,

-” নীরব, হাউ ডেয়ার ইউ?”

দাঁত কড়মড় করে নীরব আরেকটা চ’ড় বসাল প্রীতির অপর গালে। বজ্র কণ্ঠে বলল

-” তোমার মতো একটা মেয়েকে থা”প্পড় মা”রতেও আমার গা ঘিনঘিন করে। মনে হচ্ছে নিজের হাতটাই নোং/রা করে ফেললাম।”

মূহুর্তেই প্রীতির চোখে পানি টলমল করে উঠল। প্রতিটা শব্দ ছু/রি হয়ে বিঁধছিল প্রীতির বুকের ভেতর। চোখভরা এক প্রস্থ জল নিয়ে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল প্রীতি। নীরব প্রশ্ন ছুঁড়ল,

-” সত্যি করে বলো, কেনো প্রত্যাশার সাথে অমন করেছিলে? ক__”

প্রীতি কথা কেড়ে নিয়ে ভ”য়ে ঢোক গিলে বলল,

-” ক-কী করেছি আমি?”

নীরব দাঁত চেপে বলল,

-” নাটক বন্ধ করো। যা প্রশ্ন করব, সত্যি করে উত্তর দেবে। প্রত্যাশাকে কিভাবে অচেতন করেছিলে? কেনো হোটেলের বয়কে দিয়ে ছবি তুলালে? এতে তোমার লাভ কী?”

প্রত্যাশার শরীর শিউরে উঠল। প্রীতি মাথা নেড়ে অস্বীকার করল,

-” আমি কিছু জানি না।”

কথাটা শেষ না হতেই আরেকটা থা”প্পড় এসে পড়ল গালে। ঠোঁট কে”টে র”ক্ত গড়িয়ে পড়ল। নীরব রুক্ষভাবে বলল,

-” সিসিটিভি ফুটেজে তোমাকে স্পষ্ট দেখা গেছে। তুমি নিজ হাতে হোটেলের বয়কে টাকা দিচ্ছো। আর তার বয়ান আমি ফোনে রেকর্ড করে রেখেছি। শুনতে চাও?
তুমি একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের অচেতন অবস্থার সুযোগ নিয়েছো। তার ছবি তুলে পাঠিয়েছো তারই স্বামীর কাছে। তুমি শুধু একটা মেয়েই নও, পুরো নারী সমাজের লজ্জা তুমি, কলঙ্ক তুমি। এতটুকু মনুষ্যত্ব, মানবতা, এতটুকু বিবেকও তোমার ভেতরে নেই।”

রাগে-দুঃখ,কষ্ট অপমানে প্রীতির ভেতরটা ছিঁ”ড়ে যাচ্ছে। তবুও ও নিজের ভেতরকার অহং নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,

-” না বাঁধেনি। কারন যা হয়েছে এমন কিছু হওয়ারই ছিলো। এরজন্য কোনো না কোনোভাবে স্বয়ং তুমি দায়ী।”

নীরব ক্ষিপ্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল,

-” এতবড় একটা অন্যায়, পা”প করার পরও বড় গলায় কথা বলছো কীভাবে? এতটুকু লজ্জা নেই। লজ্জায় তো মাটির সাথে মিশে যাওয়ার কথা। একে তো অন্যায় করেছো তারউপর গলা চড়িয়ে কথা বলছো। শেইম অন ইউ।”

প্রীতি দৃঢ় গলায় চ্যাচানো সুরে বলল,

-” সবকিছুর জন্য পরোক্ষভাবে তুমি দায়ী।”

নীরবের রাগের পারুদ বাড়ল। কষিয়ে আরেকটা চ’ড় মা’র’ল। প্রীতি দু পা পিছিয়ে ফ্লোরে পড়ে। প্রীতির ফর্সা দুইগালে পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে র*ক্ত জমাট বাধতে শুরু করে। প্রত্যাশা ভ*য়ে জড়সড় দাঁড়িয়ে। নীরব ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,

-” প্রত্যাশার সাথে তোমার কিসের শ”ত্রুতা? একটা নিরীহ মেয়েকে কেনো বিপদে ফেললে? ওর সরলতার সুযোগ নিয়ে__”

রাগে কথা সম্পূর্ণ করতে পারে না নীরব। তানিয়া চেঁচামেচি শুনে এসেছে। প্রীতি ফ্লোরে দুইহাত রেখেই ভেজা গলায় উচ্চস্বরে বলল,

-” প্রত্যাশার সাথে আমার কোনো শ*ত্রুতা ছিলো না। বললাম না যা হয়েছে তোমার জন্য। তোমার চোখে ওকে খা*রাপ বানাতে ছবিগুলো তোলা। ওর ডাবের জলে ড্রা*গ মেশানো হয়। তারপর ছবি__”

নীরব একদলা থুতু ফেলে তিরস্কার, ধিক্কার জানিয়ে বলল,

-” বাহ্, বাহ্। প*শুর থেকেও হিং/স্র হয়ে এতবড় একটা অপরাধ করলে, এতটা নিচে নামলে। আবার বড় গলায় বলছো। লজ্জারাও তোমাকে দেখে লজ্জা পাবে। বাট এখন তো আমার ধারণা, আমার সন্দেহ প্রকট হচ্ছে, নীবিড়ের অসুস্থতার পেছনে তোমার হাত আছে‌। তুমি নিজেই?”

প্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-” নীরব, সেটা তো বলেছি আগেই, পারলে প্রুভ করে দেখাও। প্রীতির ভ’য় নেই সত্যি বলতে। প্রীতি কাউকে ভ’য় পায় না।”

নীরব কপালে আঙুল চেপে ধরল। বলল,

-” তোমার স্পর্ধা দেখে আমি স্তব্ধ। তুমি আমার বউয়ের সরলতার সুযোগ নাও।”

কথা শেষ করার আগেই আরেকটা থা’প্প’ড় দিতে দিতে বলল নীরব,

-” কেনো করেছো এসব? কি চাও তুমি?”

প্রীতি পড়ে যেতে নেয়। ঠিক তক্ষুনি দুটো বলিষ্ঠ হাত এসে আঁকড়ে ধরে। সার্থক দুহাতে আগলে ধরে। উপর থেকে সে সবটা না শুনলেও শেষের দিকের কথাবার্তা শুনেছে। প্রীতি রাগে কাঁপতে কাঁপতে গলা ফাটিয়ে বলল,

-” কারন আমি ত__”

প্রীতির কথা ঢাকা পড়ে সার্থকের কথায়। অকস্মাৎ সার্থক বলে উঠল,

-” কারন আমি। প্রীতি যা করেছে আমার কথায়।”

নীরবের কপালে প্রগাঢ় রেখার উদয় হয়। বলল,

-” হোয়াট?”

প্রীতিকে দাঁড় করিয়ে সার্থক নির্ভয় চিত্তে দু’কদম এগিয়ে বলল,

-” ইউ নো আমি প্রত্যাশাকে পছন্দ করতাম। প্রত্যাশাকে পেতে এটা আমার প্লান ছিলো। প্রীতির দোষ নেই ও আমাকে হেল্প করেছে। একজন বোন ভাইয়ের কথা ফেলতে পারেনি। প্রীতি যা করেছে সবটা আমার কথায়।”

প্রত্যাশার মাথা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। নীরবের মেজাজ বিগড়ে গেল সার্থকের শার্টের কলার চেপে ধরল। রাগে বিশ্রী গা/লি দিল,

-” ইউ বা/স্টা/র্ড। অন্যের বউকে পেতে তোরা নোং/রামি করিস। এত এত লেখাপড়া শিখে কী হলো? তোদের থেকে রাস্তার কু/কুরও ভালো।”

প্রীতি স্তম্ভিত। ও নিজে যখন একসময় ভাইকে ফাঁসাতে ভাইয়ের পুরনো সিম দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে সেখান থেকে নীরবের কাছে মেসেজ দিয়েছিল। আর আজ কী না তার ভাই নিরপরাধ হয়েও নিজের কাঁধে দোষ তুলে নিচ্ছে অবলীলায়। শুধুমাত্র বোনের দোষ ঢাকতে। প্রীতির বুক ফেটে আসলো দ্রুত নীরবের হাত ধরে বলল,

-” ছাড়ো, নীরব ভাইয়ার কলার ছাড়ো।”

প্রত্যাশা পাশ থেকে বলল,

-” নীরব মাথা ঠাণ্ডা করুন। প্লিজ ঠাণ্ডা মাথায় যা করার করবেন।”

নীরব তাচ্ছিল্য ভাবে হাতটা সরাল। আঙুল তুলে বলল,

-” সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। একটা মেয়েকে ড্রা*গ দিয়ে অবেচতন করার অপরাধে কী শা’স্তি হতে পারে জানা আছে তো? আমি তোমাদের দুজনকেই আজকের মধ্যে থানায় ভরব। উপযুক্ত শা/স্তি আইন দিবে। আমার হাত নোং/রা করতে চাই না।”

তানিয়া মুখ খুললেন। অনুনয় করে ব্যাকুল স্বরে বললেন,

-” নীরব বাবা ওরা দু’জনে খুব রাগি আর জিদি। একটা ভুল না হয় করেই ফেলেছে। এবারের মত ক্ষমা করে দাও। এসব ব্যাপার নিয়ে কেস কাচারী হলে লোক মুখে ঘটনা ছড়িয়ে যাবে। সেখানে দুই পরিবারেরই সম্মান হানি হবে।”

সার্থককে লেবুর শরবত নিয়ে যাওয়া, তারপর বয়টি বলেছে প্রীতি ছবি তুলতে বলেছিল। দূর থেকে জুম করে ছবি তোলা হয়। সেই হিসেবে সার্থকের দিক থেকে সব সন্দেহের তীর সরিয়ে নেয়া হয়। আর সার্থক যে প্রত্যাশাকে পছন্দ করে এটা তো নীরবের অজানা নয়। তাই বিষয়টা নীরবের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল না। তানিয়া আরো অনেককিছু অনুরোধ, অনুনয় করে বললেন। প্রত্যাশা পাশ থেকে নীরবকে বলল। এটা আর না বাড়াতে। তানিয়া মেয়েকে শাসিয়ে বললেন,

-” প্রীতি নীরব-প্রত্যাশার থেকে ক্ষমা চেয়ে নাও। সার্থ তুমিও।”

প্রীতি অনড়। সার্থক সবটা নিজের কাঁধে নেয়। বোঝাতে চায় প্রীতি শুধু তাকে সাহায্য করেছে। প্রত্যাশা নীরবকে বোঝাল,

-” নীরব, এটা নিয়ে কেস-কাচারি হলে বাসার সবাই জেনে যাবে। বিষয়টা বোধহয় ভালো হবে না। আপনি, আমি সত্যিটা জানি এটাই যথেষ্ট। আর ওনারা যেহেতু ভুল বুঝতে পেরেছেন। একটু মার্সি না হয় করলেন।”

তানিয়া হাত জোড় করে বললেন,

-” নীরব বাবা আমি আমার বাচ্চা দু’টোর হয়ে হাত জোর করে মিনতির সুরে বলছি, দয়া করে এটা নিয়ে মামলা করো না। এতে ওদের দুজনের ক্যারিয়ারের উপর প্রভাব পড়বে। স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়বে। বৃদ্ধা আন্টির উপর এতটুকু দয়া করো বাবা।”

নীরব ঘৃ*ণায় কিছুই বলতে পারল না। রাগটা দমিয়ে কোনো বাক্য ব্যয় না করে সোজা প্রত্যাশার হাত ধরে বেরিয়ে যায়।

.
.

প্রীতি রুমে গিয়ে বিছানা থেকে ল্যাপটপ তুলে ছুঁড়ে মা”রে। একেএকে সবকিছু ভাঙতে থাকে। ফ্লাওয়ার ভাজটা হাতে তুলে আয়নার উপর মা”রল। আয়নার কাঁচ সেকেন্ডেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়। একটা কাঁচ হাতে তুলে নেয়। হাতের শিরা কা*টতে শুরু করবে সেই সময় সার্থক চেঁচিয়ে আটকে দেয়। প্রীতির ইগো হার্ট হলে, প্রিয় মানুষের কাছ থেকে অপমানিত হলে ও যে নিজেকেই শেষ করে দিতে পারে। প্রীতিকে এতটুকু চেনে বলেই সমস্ত দায়ভার নিজের কাঁধে নেয় সার্থক। ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে দু’জনের হাতই কে”টে যায়। সার্থক বোনের মাথাটা বুকে চেপে বলল,

-” প্রীতি পা”গল হয়েছিস তুই?”

প্রীতি ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল,

-” ভাইয়া নীরব আমার গায়ে হাত তুলেছে। যা নয় তাই বলেছে। তাও ওই মেয়েটির সামনে। একটা সাধারণ মেয়ের জন্য নীরব আমাকে থা”প্পড় মে*রেছে।”

-” প্রীতি ওই মেয়েটা তোর কাছে সাধারণ লাগতে পারে। বাট মেয়েটা সবার কাছে সাধারণ নাও হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা মেয়েটা নীরবের স্ত্রী। আর তুই যা করেছিস, এরকম হওয়ারই ছিলো। রাগে তুই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিস। মনুষ্যত্ব জলাঞ্জলি দিয়েছিস। প্রীতি এখনো সময় আছে। নিজের ভুল শুধরে নে।”

.
.

ওদিকে রেস্টুরেন্টে বসে নীরব-প্রত্যাশা। নীরবের টেনশন হচ্ছে। মনে হচ্ছে বোকামি হয়ে গেল। আসলে ওই ছেলেটির সাথে গতকালই নীরবের কথা হয়েছিল। তাই প্রীতির মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। আবার প্রত্যাশাকেও জানানো উচিত। ওর সরলতার সুযোগ কীভাবে অন্যরা নেয়। মানুষ চেনা দরকার। যাতে পরবর্তীতে কোনো কাজ করার আগে একবার হলেও ভাবে। প্রত্যাশা বারবার বলছে— ঠিক আছে, সমস্যা নেই। ও এসব মাথা থেকে ঝেড়ে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করবে। অনেক কথাবার্তা শেষে প্রত্যাশা বলল,

-” নীরব, আপনি কাল পরীক্ষার আগে দেখা করবেন তো?”

-” নিশ্চয়।”

-” আমি কিন্তু হলে ঢোকার আগে আপনার অপেক্ষায় থাকব। আব্বু সাথে যাবে। তবুও আমি আপনাকেও চাই।”

অনেকক্ষণ কথাবার্তা শেষে পরিবেশটা স্বাভাবিক হয়। নীরব মাথা ঝেড়ে ফেলল। বলল,

-” আমি ঠিক টাইম মতো উপস্থিত হবো।”

___________

সকালে ইচ্ছে মায়ের রুমে যায়। মায়ের ফোনে গেইম খেলবে বলে। প্রীতির একহাত বেড ছাড়িয়ে নিচের দিকে ঝুলছে। ইচ্ছে বেডে উঠে ডাকল,

-” মাম্মা? মাম্মা ?”

প্রীতির নড়চড় নেই। ইচ্ছের চোখ গেল প্রীতির ঠোঁটের কিনারায়। ঠোঁটের কোণে ভেজা, ছ্যাপছ্যাপ কিছু চিকন রেখা হয়ে পড়ছে। ফ্রক তুলে ইচ্ছে ছোট্ট হাতে মুছে দিল মায়ের ঠোঁটের পাশটা। আবার ডাকল,

-” মাম্মা? তোমার ফোন?”

বারবার ডেকেও কোনা সাড়া না পেয়ে ইচ্ছে ভ’য় পেল। ছোট্ট মনে কার্টুনে দেখা দৃশ্যের কথা স্মরণ হলো। এক দৌড়ে মামার ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মামাকে ডেকে আনল।

-” মামা, মাম্মা কথা বলছে না।”

সার্থক উদ্ভ্রান্তের মতো আসে। প্রীতিকে অসাড় নিস্তেজ হয়ে বিছানায় দেখে বুকটা হাহাকার করে উঠলো। কাঁপা কাঁপা হাতে পালস চেক করলো। পাশের বেড টেবিলে স্লিপিং পিলের পাতা ফাঁকা। সার্থক চোখবুঁজে অসহায় হয়ে আওড়ালো— উফ্! যেই ভ”য়টাই পাচ্ছিলাম। সেটাই হলো।

.
.

কিছুক্ষণ পর,,

ইচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির টেলিফোন থেকে নীরবের কাছে কল করে। নীরবের নম্বর তার মুখস্থ। সেটা নীরব নিজেই করিয়ে গেছিল। শিখিয়ে দিয়ে বলেছিল—- তোমার কোনো সমস্যা হলেই তুমি আমাকে ফোন করবে।

নীরব শাওয়ার নিয়ে বের হয়। আগে যাবে প্রত্যাশার পরীক্ষা কেন্দ্রে তারপর অফিসে। এমন সময় ফোন বাজল, নম্বর দেখে ভ্রূ কুঁচকে যায়। রিসিভ করতেই কান্নার শব্দ এলো। নীরব ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

-” ইচ্ছে? ইচ্ছে সোনা, কী হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”

ইচ্ছের কান্নার বেগ থামছে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,

-” মাম্মা, মাম্মা কথা বলছে না। জানো পাপা মাম্মা চোখ খুলছে না।”

নীরব জিজ্ঞেস করল,

-” তুমি কান্না থামাও। কী হয়েছে?”

-” মাম্মা কথা বলছে না। আমি ডাকছি তাকাচ্ছে না। আমি জানি না। মনা নানুকে বলছে, মাম্মা ঘুম ঔষধ খেয়েছে। মাম্মার ঘুম ভাঙছে না। মাম্মা কী তারা হয়ে যাবে পাপা? আমি মোবাইলে দেখেছি, যাদের মাম্মা থাকে না, মাম্মাকে মিস করলে আকাশে তারা দেখে।”

নীরব জোড়াল শ্বাস ফেলে আওড়ালো,

-” ওহ্, শিট!”

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৮ প্রথম অংশ|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ইচ্ছে ফোনের ওপাশ থেকে রীতিমত কান্না করছে। সে মাম্মার কাছে যেতে চায়। নীরব ফোন বুয়ার কাছে দিতে বলে। বুয়া জানায়— ‘প্রীতি ঘুমের ঔষুধ খেয়েছে। তাকে সার্থক হসপিটালে নিয়েছে। সেই থেকে ইচ্ছে একটানা কাঁদছে।

নীরব ঘড়ির দিকে তাকাল। নয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। প্রত্যাশার পরীক্ষা শুরু হবে ঠিক দশটায়। কিছুপল দাড়িয়ে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করল নীরব — কী করবে? কী করা উচিত?

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিল।
ত্রস্ত পায়ে হেঁটে ড্রয়িংরুম পার হচ্ছিল। ঠিক তখনই মায়ের ডাক এলো,

-” নীরব? খেয়ে যাচ্ছিস না? না খেয়ে এভাবে কোথায় যাচ্ছিস?”

নীরব পেছন না ঘুরেই বলল,

-” এখন খাওয়ার সময় নেই মা। বাইরে কিছু খেয়ে নেব।”

নীহারিকা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,

-” এত তাড়াহুড়ো কেন রে বাবা? একটু ধীরে সুস্থে খেয়ে যা।”

নীরবের গলায় তাড়াহুড়োর ঝাঁজ,

-” বললাম তো মা, এখন খাওয়ার টাইম নেই।”

সকালে প্রত্যাশা ফোন দিয়ে দোয়া চেয়ে নিল। আজ থেকে পরীক্ষা শুরু জানেন নীহারিকা। তাই ভাবলেন, নিশ্চয়ই সেদিকেই যাচ্ছে নীরব। বলে উঠলেন,

-” সবে নয়টা বাজে, পরীক্ষা তো দশটায়। কিছু মুখে দিয়ে যা, দেরি হবে না।”

মায়ের কাছে প্রীতির ঘটনা আড়াল করে নীরব। অধৈর্য স্বরে শুধু বলল,

-” অন্য কাজ আছে।”

এতটুকু বলে ত্রস্ত হাতে দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যায়।

____________

প্রথম পরীক্ষার দিন কেমন একটা অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি হয়। কিছুটা উত্তেজনা কাজ করে, আবার নার্ভাসনেসও থাকে। ****কলেজে প্রত্যাশাদের পরীক্ষা কেন্দ্র।‌ প্রথম দিন একটু সময় হাতে নিয়েই এসেছে প্রত্যাশা। প্রত্যাশা বারবার হাতঘড়িতে সময় দেখছে। নয়টা চল্লিশ বাজে। নীরবের কোনো খোঁজখবর নেই। অথচ কথা ছিল নীরব প্রত্যাশার আগেই এসে উপস্থিত থাকবে। ফ্রেন্ডরা তাড়া দিচ্ছে। কোয়েল বলল,

-” অ্যাই প্রত্যাশা এভাবে গেইটে দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি? সবাই ঢুকছে, চল।”

প্রত্যাশা বারবার রাস্তা বরাবর চাইছে। ম্লান মুখে বলল,

-” তোরা যা আসছি আমি। আব্বু আছে সমস্যা হবে না।”

ফ্রেন্ডদের গার্ডিয়ান তাড়া দিতেই ওরা ভেতরে ঢুকল। শফিক সাহেব নরম গলায় বললেন,

-” প্রত্যাশা চল। সময় হয়ে আসছে যে মা।”

-” আব্বু তোমার ফোনটা একটু দাও তো।”

-” এখন ফোন? কোনো কিছু কী ফেলে এসেছো?”

প্রত্যাশা দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,

-” আরে না। ফোনটা দাও তো।”

শফিক সাহেব দ্বিরুক্তি না করে ফোন বের করে মেয়ের হাতে দিলেন। প্রত্যাশা একটু ফাঁকে গিয়ে নীরবের নম্বরে ডায়াল করল। রিং হয়ে কে”টে যাচ্ছে। দু’বার কল দিয়েই প্রত্যাশার মন ভার হয়ে গেল। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আব্বুর হাতে ফোন দিয়ে বলল,

-” চলো।”

.
.

পপুলার হাসপাতালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফটের সামনে ইচ্ছের হাত ধরে দাঁড়িয়ে নীরব। লিফটের তীর চিহ্নটা জানান দিচ্ছে, এটা এখন তিনতলায় উঠছে। নীরবের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। হাতঘড়িতে চোখ ফেলল; সময় এখন ঠিক নয়টা চল্লিশ। এক মুহূর্ত দেরি না করে ইচ্ছেকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় উঠে। কপাল বেঁয়ে নীরবের ঘাম ঝরছে। করিডোরে নজর বুলাতেই মনাকে পেল। ইচ্ছেকে নামিয়ে বড় কদমে এগোল। আইসিইউর দরজার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দু’হাতে ইচ্ছেকে উঁচুতে তোলে। দরজায় বসানো গোল কাঁচের ভিতর দিয়ে ঝাপসা দৃশ্য দেখা যায়; বেডে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে প্রীতি। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ইচ্ছে কাঁচের ওপরে ছোট ছোট হাত রাখে। কান্নাভেজা কণ্ঠে ডেকে ওঠে,

-” মাম্মা…আ..আ।”

শব্দটা যেন দেওয়াল ছুঁয়ে ফিরে আসে। নীরব আস্তে করে বারণ করতে বলল,

-” ইচ্ছে এভাবে শব্দ করো না।”

নীরব মনাকে জিজ্ঞাসা করল,

-” কী অবস্থা?”

মনা চোখ মুছে নেয় হাতের আঁচলে। নাক টেনে বলল,

-” আমি তো কইবার পারি না স্যার। সার্থক স্যারই তো সব জানেন। উনি ত এইখানেই আছিলেন। মনেহয় এখন উনার রুমে গেছেন। স্যারই ভালো কইবার পারবো। স্যার দেহেন ওনার চেম্বারেই আছে।”

নীরব কথা না বাড়িয়ে ইচ্ছেকে নিচে নামিয়ে দাঁড় করায়। তারপর করিডোরে থাকা নার্সের ডেস্কের দিকে এগিয়ে যায়।

-” ডিউটি ডাক্তার কোথায়?”

নার্সটি মাথা ঘুরিয়ে পাশের কেবিনের দিকে ইশারা করে।

-” ওখানে স্যার। ভেতরেই আছেন।”

নীরব গিয়ে কেবিনের দরজায় টোকা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। একজন ডাক্তার ফাইল লিখছিলেন। মুখ তুলে তাকালেন।

-” জি বলুন?”

নীরব দ্রুত স্বরে বলল,

-” আইসিইউতে যে পেশেন্ট আছেন। প্রিয়স্মিতা খান প্রীতি উনার কী অবস্থা?”

ডাক্তার ফাইল উল্টে পেছন দিকের পাতায় চোখ রাখলেন। ঠোঁট চেপে বললেন,

-” ওভারডোজ কেস। শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর হয়ে আসছিল, তাই তৎক্ষণাৎ অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হয়েছে। আমরা গ্যাস্ট্রিক ল্যাভেজ করে চারকোলও দিয়েছি। এখন আপাতত স্ট্যাবল। তবে এখনই কেবিনে ট্রান্সফার করছি না। প্রিতম স্যার রিস্ক নিতে চান না, তাই আইসিইউতেই পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।”

নীরব উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-” একটা ছোট বাচ্চা, ওর মাকে একঝলক দেখবে বলে কাঁদছে। পাঁচ মিনিটের জন্য ওকে ভেতরে যেতে দেয়া যাবে?”

ডাক্তার একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন,

-” পেশেন্ট এখনো আধচেতন। চমকে উঠতে পারে। তবে আপনি নিজে সঙ্গে থাকবেন, একদম শব্দ না করে। আর হ্যাঁ পাঁচ মিনিট কিন্তু?”

নীরব কৃতজ্ঞভাবে মাথা নাড়ল।

নীরব মনাকে বলে ইচ্ছেকে নিয়ে একঝলক প্রীতিকে দেখিয়ে আনতে। ইচ্ছের সামনে উবু হয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল নীরব,

-” ডোন্ট ক্রাই। তোমার মাম্মার কিছু হবে না। ঠিক হয়ে যাবে। আমি যাচ্ছি, তুমি গুড গার্ল হয়ে থাকবে। মনা যা বলে শুনবে? কেমন?”

ইচ্ছের চোখ মুছে দেয় নীরব। ইচ্ছে ছোট্ট করে ঘাড় কাত করল,

-” ওকে।”,

নীরব মনার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ইচ্ছের দিকে খেয়াল রেখো। চোখেচোখে রেখো।”

-” আইচ্ছা স্যার।”

নীরব সময় দেখল পঞ্চান্ন বাজে। সিঁড়ি বেয়ে ত্রস্ত নামতে লাগল। স্পিড বাড়িয়ে ঝড়ো বেগে বাইক ছুটে যাচ্ছে। অসুস্থ ভাইয়ের আমানত হওয়ার কথা ছিলো তার বউ- বাচ্চা। তবে প্রীতির আচরণে প্রীতির প্রতি সম্পর্কের নূন্যতম সম্মান, শ্রদ্ধাটুকুও আসে না নীরবের। বরং, ঘৃ*ণা হয় প্রচন্ড। তবুও একটা মানুষ যখন মৃ*ত্যু পথযাত্রী হয়, মৃ*ত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, তখন না চাইতেও কঠোর মনটা একটু হলেও মিইয়ে আসে। তবে তীব্র ঘৃ*ণা সাইডে রেখেই নীরব আসছে। ভাইয়ের আত্মা তার মেয়ে। সেই মেয়ের চোখের কান্না থামাতেই ছুটে আসা। তবুও সারাটাক্ষণ মাথার মধ্যে ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ঝিনঝিন শব্দ তুলে যাচ্ছে —- প্রত্যাশার সাথে দেখা করতে হবে।

.
.

সেন্টারের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই বিল্ডিংয়ের সামনে সাঁটানো পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বর তালিকার কাছে দাঁড়াল নীরব। চোখ বুলাতে বুলাতেই পকেট থেকে ফোন বের করল। স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই চোখ আটকে গেল; শফিক সাহেবের নম্বর থেকে আসা কলে। নীরব নিজের উপর নিজেই মেজাজ হারিয়ে বলল,

-” উফ্! ফোনটা সাইলেন্টেই ছিল দেখছি।”

প্রত্যাশা গতকাল রাতে মেসেজে রোল- রেজিঃ নম্বর দিয়েছিল। নীরব দ্রুত মিলিয়ে নেয়। ঘন্টা পড়েছে পাঁচ মিনিট খানেক হবে। নীরবের ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে এল,

-” ওহ্, শিট!শিট! আর পাঁচ মিনিট আগে এলেই হতো। এখন হলে ঢোকা সহজ হবে না। প্রটোকল ভেঙে যাওয়া তো মুশকিল।”

নীরব বিরক্ত শব্দ তুলে প্রথমে ইনভিজিলেটরের সাথে সাক্ষাৎ করে। নিজের পরিচয় দেয়। রিকোয়েস্টের সুরেই বলে নীরব,

-” আই নো, পরীক্ষাকেন্দ্রের পরিবেশে শৃঙ্খলা ও গোপনীয়তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্ব পালন ছাড়া ব্যক্তিগত কারনে একজন প্রশাসনিক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হলেও পরীক্ষা কেন্দ্রে সে এলাউ নয়। পরীক্ষাকক্ষে প্রবেশ আইনসম্মত নয়। তবুও আমি রিকোয়েস্ট করছি, কাইন্ডলি যদি আমাকে টু মিনিটসের জন্য হলেও এলাউ করতেন।”

ইনভিজিলেটর থম মে*রে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,

-” দুঃখিত! আমার পক্ষে প্রোটোকল ভেঙে ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেয়া ইম্পসিবল। আপনি সেন্টার ইনচার্জের সাথে কথা বলুন। লিখিত বা মৌখিক অনুমতি দেয়া হলে আমি ঢুকতে দিতে পারি।”

নীরব দ্রুত সেন্টার ইনচার্জের সাথে ফোনে কন্টাক্ট করে। ফোন রিসিভ হতেই নীরব সালাম দিয়ে বিনম্র, বিনীত কণ্ঠে বলল,

-” আমি এএসপি নীরব মাহবুব বলছি। *** পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে কর্মরত আছি। এটি একেবারেই ব্যক্তিগত ভিজিট, তবে অনুরোধটা মানবিক।”

সেন্টার ইনচার্জ হালকা বিস্ময় নিয়ে বললেন,

-” জী স্যার, বলুন।”

-” একজন এক্সামিনী এর গার্ডিয়ান আমি। ওর মানসিক অবস্থা নিয়ে একটু চিন্তিত। জাস্ট এক পলকের জন্য হলেও দেখা করা জরুরী। অলরেডি পরীক্ষা শুরু হয়েছে জানি। তাই প্রটোকলের বাইরে যাচ্ছি না। আমি শুধু দরজার গার্ডের সামনেই এক মিনিট দাঁড়িয়ে ওকে ইশারায় আশ্বস্ত করতে চাই, একদম কোনো শব্দ বা ব্যাঘাত সৃষ্টি করবো না।”

সেন্টার ইনচার্জ একটু ভেবে বললেন,

-” দেখুন স্যার, আমাদের দিক থেকে নির্দেশনা কড়া। তবে আপনার অনুরোধটা মানবিক। আপনি নিজেই সেন্টার প্রটোকল বুঝে শৃঙ্খলার বাইরে কিছু চাইছেন না দেখে আমি মৌখিক অনুমতি দিচ্ছি। আপনি যেহেতু প্রশাসনিক কর্মকর্তা সেহেতু আপনাকে পরীক্ষা পরিদর্শনের জন্য বলে অনুমতি দেয়া হলো।”

নীরব হাঁপ ছেড়ে বলল,

-” থ্যাঙ্ক ইয়্যু।”

বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা আজ। প্রত্যাশা ম্লান মুখে লিখছে। এমন সময় বেঞ্চের উপর থেকে কেউ একজন ওর প্রশ্নটা হাতে তুলল। কেন্দ্র ভিজিটর হবে হয়তো এইভেবে প্রত্যাশা নার্ভাস হয়েই মুখ তুলে তাকাল। এদিকে কক্ষ জুড়ে পিনপিনে নীরবতা চলছে। কেউ কোনো দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না, তবে দুএকজন আড়চোখে লক্ষ্য করছে। নীরবের উপস্থিতি পেয়ে প্রত্যাশার ভেতর হালকা একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেল। প্রত্যাশা চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে। সময় দেখল ঝটপট, দশটা পনেরো বাজে। নীরব প্রশ্নটা দুহাতে ধরেই একদম লো ভয়েজে বলল,

-” স্যরি ফর লেইট। একটু আঁটকে গিয়েছিলাম।”

নীরব প্রশ্ন ধরে আছে মনে হচ্ছে খুব মনোযোগ দিয়ে প্রশ্নটা পড়ছে সে। প্রত্যাশা আড়ালে ভেংচি কা’টল। নীরব খুব নিচু কণ্ঠে বলল,

-” মন দিয়ে পরীক্ষা দাও। একদম নার্ভাস হবে না। ভাববে উত্তর তুমি জানো, শুধু আত্মবিশ্বাসটা তোমার কলমে আনো। যদি কোনো প্রশ্ন না পারো, সেটার জন্য মন খা”রাপ করবে না। উত্তর না পারা মানে হে*রে যাওয়া নয়। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করাটাই আসল সাহস।”

প্রত্যাশা ভরসা পেল। একটুএকটু করে নার্ভাসনেসটাও কমতে থাকল। নীরব প্রশ্নটা নামাল। সবার অগোচরে থাম্বস আপ করে বোঝায়,

-” অল দ্য বেস্ট।”

প্রত্যাশা বিনিময়ে প্রসন্ন হাসি ঠোঁটে আনল। প্রত্যাশার হাসি দেখে নীরবের ভেতর ভালোলাগা কাজ করল। নীরব কেন্দ্র ভিজিট করার মতো কক্ষে এক রাউন্ড চক্কর দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কক্ষে ডিউটিতে একজন ছেলে টিচার আর অপরজন মেয়ে টিচার ছিলেন। খাতায় সিগনেচার করার সময় ম্যাডাম প্রত্যাশাকে কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল মৃদুস্বরে,

-” খানিকক্ষণ আগে যে অফিসার এসেছিলেন। কী হয় তোমার? রিলেটিভ?”

প্রত্যাশা উত্তরে ঝটপট বলল,

-” আমার হ্যাজবেন্ড।”

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৮ বর্ধিতাংশ|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

পরীক্ষা শেষ। ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। চারপাশে মৌমাছির ঝাঁকের মতো শব্দ, হালকা গুঞ্জন হচ্ছে। প্রত্যাশারা তিনজন আগপিছ করে সিঁড়ি ভেঙে নামছে। প্রত্যাশা বিরক্ত গলায় বলল,

-” যেখানে নিজের জন্ম সালই মনে থাকে না, সেখানে এসেছে রবীন্দ্রনাথের জন্ম সাল কবে। কাজী নজরুল, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রোকেয়া, সুফিয়া সবকটা জন্ম সাল ঠোঁটস্থ করেছিলাম। তবুও কেমন গুলিয়ে গেল। শেষে অনেকক্ষণ ভেবে মাথায় চাপ দিয়ে মনে করলাম, রবী ঠাকুর এদের চেয়ে বয়সে বড়। তাই সঠিক উত্তরটা দিতে পারলাম।”

থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে ওপরে তাকিয়ে ডাকল প্রত্যাশা,

-” অ্যাই হ্যাপির বাচ্চা এই টিকটা কী হবে? কী দিয়েছিস তুই?”

হ্যাপি ভ্রুকুটি করে বলল,

-” কোনটা?”

-” ওইযে উদ্দীপকে দেয়া ছিল, আলু, পটল সবজির মতো দরকষাকষি হচ্ছে বলতে কাকে বোঝানো হয়েছে। অপশনে তো___”

হ্যাপি গলায় প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলল,

-” তুই কোনটা দিয়েছিস?”

-” আরে কনফিউজড ছিলাম। একবার মনে হলো কল্যাণী, আবার মনে হলো আহ্লাদী। তাই দুটোর ঘরেই বৃত্ত ভরাট করেছি।”

হ্যাপি কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,

-” দু’টো বৃত্ত ভরাট করেছিস?”

-” কী করব! যেহেতু শিওর না, তবে এই দুজনের একজন সেটা তো শিওর। তাই একটা টিকে দু’টো বৃত্ত ভরাট করেছি। আল্লাহ রহম করো, কম্পিউটার যেন সঠিকটাই নেয়। নম্বর যেনো কা*টা না যায়।”

উপরের দিকে মুখ তুলে দোয়া করার মতো করে প্রত্যাশা। হ্যাপি বলল,

-” ওটা আহ্লাদী হবে।”

প্রত্যাশা কিছুটা রাগি স্বরে বলল,

-” তুই শিওর ছিলি তাহলে জিজ্ঞাসা করার পরেও বললি না কেনো? সেলফিশ একটা। দোয়া করি তোর কপালে যেনো আহ্লাদীর বর জগুর মতো একজন জোটে।”

হ্যাপি তড়িঘড়ি বলল,

-” আরে তুই যখন জিজ্ঞাসা করিস আমি তখন তোর মতোই কনফিউজড ছিলাম। পরে কিছুটা শিওর হই।”

কোয়েল ফোড়ন কাটল,

-” মিথ্যে বললে তোর কপালে জগুই জুটবে।”

হ্যাপি পাল্টা বলল,

-” আর আমি সত্যি বললে, তোর কপালে মির জাফরের পুত্র মিরন জুটবে। আর তোর___”

প্রত্যাশাকে উদ্দেশ্য করে যখন শেষের কথাটা বলতে নেয় হ্যাপি। ঠিক তক্ষুনি প্রত্যাশা বলে তড়িঘড়ি,

-” এই এই আমার কপালে নতুন করে আর কাউকে জুটার দরকার নাই। আমার বর আছে ভাই।”

ফ্রেন্ডরা ভুল বুঝে সেলফিশ বলায় হ্যাপির মুখ ভার হয়ে এলো। ওদের ভুল ভাঙাতে হ্যাপি বলল,

-” অ্যাই তোরা ভুল বুঝিস না। আমি সত্যিই বলছি, প্রথমে আমিও কনফিউজড ছিলাম। এইযে তোর চুল ছুঁয়ে বলছি। একদম সত্যি __”

এই বলে কোয়েলের চুল স্পর্শ করতে নেয় হ্যাপি। তক্ষুনি কোয়েল একলাফে একহাত দূরে সরে হইহই করে উঠল,

-” অ্যাই বোন থামথাম বিশ্বাস করেছি। তবুও আমার চুল ছুঁয়ে কিছু বলিস না। এমনিতেই চুল উঠে দিনদিন টাকলা হয়ে যাচ্ছি।”

ওরা দু’জন হো হো করে হেসে উঠল। কোয়েল চোখ রাঙিয়ে বলল,

-” আমি হাসির মতো কী বললাম যে তোরা দু’জন হাসছিস? মজার কিছু বলেছি নাকি? আমি তো দুঃখের কথাই বললাম। চুল পড়া একটা মেয়ের জন্য কতটা প্যাথেটিক, যার পড়ে সেই শুধু জানে, হুহ।”

কোয়েলের কপালে আঙুল দিয়ে মৃদু টোকা দিয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” টাকলা কথাটা শুনে হাসি পেল।”

হ্যাপি বলল,

-” বাই দ্য ওয়ে, এই কোয়েল একটা জিনিস খেয়াল করেছিস প্রত্যাশার চুল কিন্তু আগের থেকে বেশি সিল্কি আর ঘন হয়েছে। অ্যাই প্রত্যাশা তোর চুলের সৌন্দর্যের গোপন রহস্য কী? বল জলদি?”

-” ধূর, চুলে তেলই দিই না ঠিকমত। যা আম্মু জোর করে দেয়। শুধু শ্যাম্পুটা একটু ঘনঘন করি, ব্যস!”

কোয়েল জিজ্ঞেস করল,

-” কী শ্যাম্পু দিস?”

প্রত্যাশা ফাজলামোর সুরে বলল,

-” প্যান পড়া টিন। এবার তোরাই বুঝে নে।”

কোয়েল বুঝল না, হ্যাপি ঝটপট বলল,

-” প্যান্টিন?”

প্রত্যাশা হেসে মাথা ঝাকাল। শুধাল,

-” তুই?”

হ্যাপিও মজার ছলে বলল,

-” আমি সূর্যের ঝলক। আর মিরজাফরের পুত্র বধূ আপনি?”

ওমন সম্বোধনে কোয়েল চোখ পাকিয়ে তাকাল। পরপর জবাবে বলল,

-” তোদের মতো করেই উত্তর দিই; আমি ঘুঘু ইউস করি।”

কথা বলতে বলতে ওরা প্রায় গেইট অবধি চলে এসেছে। ওরা গল্পে এতটাই বিভোর যে আশপাশে লক্ষ্য নেই। কোয়েল আকস্মিক প্রত্যাশাকে পরখ করে বলল,

-” এই হ্যাপি, শুধু চুলের শাইনই না রে, প্রত্যাশাই আগের থেকে বেশি ঝকঝকে হয়েছে। মুখে একরকম টকটকে জ্যোতি। দেখেছিস? শুনেছি বিয়ের পর নাকি বরের আদরে মেয়েরা ঝলমল করতে থাকে। প্রত্যাশাও মনে হয় সেই ঝলমল দশায় আছে এখন।”

হ্যাপি তাল মিলিয়ে ঝটপট বলল,

-” হ্যাঁ, হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছিস।”

কোয়েল ভাঁজ করা ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল,

-” এখন তো সত্যিই মনে হচ্ছে বরের ছোঁয়াতে ফর্সা হওয়ার ক্রীমও হার মানবে। বর একবার কোলে তুলেছে আর আমাদের প্রত্যাশা বলিউড লুক পেয়ে গেছে। অসম্পূর্ণ বাসর সম্পূর্ণ হলে না জানি….”

প্রত্যাশা লজ্জায় হাঁসফাঁস করে উঠল। চোখ বড় করে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি থামিয়ে দিল,

-” অ’স’ভ্য মহিলা। থা”প্প”ড় খাবি একটা।”

কথাটা বলতে বলতেই স্বল্প দূরত্বে থাকা রাস্তার পাশে দাঁড়ানো নীরবের দিকে চোখ পড়ে প্রত্যাশার। বিস্ময়ে থ বনে যায়। সাথে সাথে প্রত্যাশা জিভ কে”টে আওড়ায়— এইরে এএসপি সাহেবর কানে এসকল কথা যায়নি তো আবার? কোয়েলের যে ফা’টা বাঁশের মতো গলা।

নীরব এক আঙুলে কপাল চুলকে মনেমনে ফিসফিস করল— এই জন্যই বলে, মেয়েমানুষের পেট কথার সেফ তো নয়, ওটা যেন ফাটা বাঁশের কভারবিহীন মাইক। বর কোলে তুলেছে এই তথ্যও বান্ধবীদের কাছে প্রচার করতে হয়? আর বান্ধবীও পারলে সেটা মাইক নিয়ে বলে। ও গড! এমন বউ নিয়ে মা”রা”ত্মক টেনশনে আছি। আজ বান্ধবীদের কাছে ‘কোলে তোলা’ রিলিজ হয়েছে। ভবিষ্যতে ‘বাসর-স্পেশাল’ এপিসোড রিলিজ হবে না, আল্লাহ মালুম।

নীরবের ভাবনায় ছেদ পড়ল প্রত্যাশার কথায়। প্রত্যাশা এগিয়ে এসে মিহি স্বরে বলল,

-” আপনি?”

নীরব মুখাবয়ব এমন করল যেনো তার কানে কিছুই ঢোকেনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” চলো। যেতে যেতে বলছি।”

প্রত্যাশা বিড়বিড় করে— যাক কোয়েলের কথা উনি শোনেনি বোধহয়। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল প্রত্যাশা। বান্ধবীরা এঁটে ধরেছিল, গল্পে গল্পে ওই একটু বলে ফেলেছিল মাত্র।

পাশের এক কফিশপে এসে বসল ওরা। শীতল ফেনা উঠা কোল্ডকফির ক্যাপে স্ট্র বসিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করল নীরব,

-” পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”

প্রত্যাশা একটা স্ট্র তুলে নাড়াতে নাড়াতে নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়েছে। আপনি হঠাৎ এখন আসলেন যে?”

-” সকালে ঠিক সময় মতো আসতে পারিনি। ভাবলাম দুপুরের কিছু সময় তোমাকে দেয়া উচিত। যাতে করে হলেও সকালের কথা রাখতে না পারাটা একটু হলেও পুষিয়ে দিব।”

প্রত্যাশা মৃদু হেসে বলল,

-” ওহ্। আব্বুর আসার কথা ছিলো। যদিও আমি বারণ করেছিলাম। একাই যাব।”

-” আমি আংকেলকে ফোন করে বলেছিলাম তোমাকে ড্রপ করে দিবো।”

-” আপনি জানেন সকালে আপনার উপর কতটা রাগ হয়েছিল? আপনি না আসলে আমি কথাই বলতাম না আর, হুঁ।”

-” স্যরি!”

-” ওকে ওকে। এখন তো ঘু”ষ দিয়ে রাগ, অভিমান গলিয়ে দিচ্ছেন।”

-” ভুল বললে ঘু*ষ নয়, পেয়ার দিয়ে গোস্বা ভাঙানোর চেষ্টা মাত্র।”

প্রত্যাশা ঠোঁট ভেঙিয়ে বলল,

-” ঢং।”

___________

দু’দিন পরেই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছে প্রীতি। একাকী নিঃসঙ্গ জীবনে আজ দু’দিন সঙ্গ দিচ্ছে ছোট্ট ইচ্ছে। যদিও এই একাকী থাকা সে নিজেই বেছে নিয়েছে। ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে কী বুঝে আল্লাহ জানে! মা যে অসুস্থ সারাটাক্ষণ মায়ের কাছ ঘেঁষে আছে। প্রীতি এপাশ থেকে ওপাশ হলেও ছোট্ট ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” মাম্মা তোমার কিছু লাগবে? তুমি পানি খাবে মাম্মা?”

ইশশ্! আদুরে ঠোঁট, মুখ নাড়িয়ে কথাগুলো যখন বলে না; প্রীতির বরফের মতো কঠিন, শক্ত মনটাও গলে আসে। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চার মায়ের প্রতি টান ভালোবাসা দেখে প্রীতি ক্ষণেক্ষণে স্তব্ধ হচ্ছে।‌ অবাক হচ্ছে এই আদুরে বাচ্চাটাকে সে পেটে ধরেছিল। সাথে লজ্জিত হচ্ছে, এই প্রাণটা পৃথিবীর আলো বাতাস দেখুক, তা সে কস্মিনকালেও চায়নি। একটা সময় তো অ্যাবরশন করার জন্যেও উঠেপড়ে লেগেছিল। শুধু মায়ের কথায় সেটা পারেনি।

অবসাদের ধোঁয়াটে চাদরে মোড়ানো প্রীতির হৃদয়টা। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় আরও ঘোলাটে ঠেকছে। শরীর যতটা না অসুস্থ, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্লান্ত, বিষণ্ণ মনটা। অন্তঃপুর যেন ঘন কুয়াশায় ঢাকা একটা মরুভূমি, নিঃসঙ্গ, নিঃস্ব। বেডের হেডে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল প্রীতি। গলাটা শুকিয়ে আসে। বেডটেবিলে হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিতে যাবে ঠিক তক্ষুনি কোল ঘেঁষে বসে থাকা ইচ্ছে বলল,

-” মাম্মা আমি দিই?”

না চাইতেও প্রীতির ঠোঁটে হাসি ফুটল। বলল,

-” আমি পারব।”

ইচ্ছে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,

-” তোমার হাতে ব্যথা নেই? ডক্টর ইঞ্জিন দিলো।”

প্রীতির ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো। মাথা নেড়ে বলল,

-” না ব্যথা নেই। মেডিসিন নিচ্ছি যে এখন একদম ঠিক আছি।”

-” ওহ্।”

প্রীতি পানি খেয়ে মাথাটা এলিয়ে চোখ বুজে নিল। ইচ্ছে আবদার করল,

-” মাম্মা তোমার ফোনটা নিই? কার্টুন দেখব?”

-” ওকে নাও।”

কার্টুন দেখতে দেখতে ইচ্ছে বলল,

-” মাম্মা পাপার সাথে কথা বলি?”

প্রীতি চোখ বুজেই দৃঢ় গলায় বলল,

-” নাহ, বলবে না।”

-” উল্প বলি?”

সেদিনের নীরবের করা অপমান, প্রতিটা কথা আজও বুকে সূচ ফোটানোর মতো বেঁধে— তোমাকে থা”প্প”ড় মা”রতেও আমার ঘে”ন্না হয়।….হাত নোং/রা করা।

যতটা না চড়ে আঘাত পেয়েছিল তার থেকে হাজার গুণ বেশি আহত হয়েছিল কটা কথায়। প্রীতি গর্জে উঠল,

-” ইচ্ছে…এএএএ।”

ইচ্ছের ছোট্ট শরীর কেঁপে উঠল। থরথরিয়ে কাঁপছে বাচ্চা মেয়েটা। প্রীতি বসে মেয়ের দুই বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,

-” বললাম না, তোমার কানে ভালো কথা গেল না?”

ইচ্ছে ফুঁপিয়ে উঠল,

-” স-স্যয়ি মাম্মা।”

ইচ্ছের ভীতু মুখটা দেখে মায়া হলো। আজকাল প্রীতির মনটাও নিজের সাথে বেঈমানি করছে। এইযে মেয়ের প্রতি তার কোনোকালেই টান ছিলো না বললেই চলে। মেয়েকে কাজের লোকের উপর ছেড়ে দিয়ে রেখেছিল। তবে হঠাৎ কী হলো, কে জানে? হাসপাতালে পাশে কেউ নেই, ছোট্ট মেয়েকে পেল। ভাইয়া ডিউটিতে ব্যস্ত। তবে দায়িত্ব সে পালন করেনি তা না। আর মা? চাইলে কী একটিবারের জন্যও যেতে পারত না? ছোট্ট মেয়ে কান্না করে মা’কে ছাড়া সে বাসায় যাবে না। হাসপাতালের ছোট বেডে পাশে শুতে চায়। বাচ্চাকে কোলের পাশে নিয়ে শুতে যে একটা শান্তি অনুভব হয়। সেটা প্রীতি জানত না। জানবে কী করে? কখনো তো সেভাবে স্নেহভরা চোখে মেয়ের দিকে তাকায়ইনি। তবে মৃ*ত্যু*র দোরগোড়া থেকে ফিরে এই পৃথিবীতে আপন বলতে একজনকেই আবিষ্কার করল। তার পেটের মেয়ে। যেখানে কোনো স্বার্থ ছিলো না। শুধুই ছিলো আত্মিক টান।

ইচ্ছের মাথা বুকে টেনে নিল প্রীতি। ইচ্ছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। প্রীতির কী হলো নিজেও জানে না। নিজের ইগো ধরে রাখতে, নাকি নিজের ভেতর সুক্ষ্ম পরিবর্তন থেকে বলে উঠল,

-” ইচ্ছে আমি নিজে তোমার পাপার কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো। আর তুমি প্রমিস করো আমায়, আমি যা বলব তাই শুনবে। আমি যাদের সাথে মিশতে বলব তুমি তাদের সাথেই মিশবে। যাদের সাথে কথা বলতে বারণ করব, তুমি বলবে না কথা তাদের সাথে। কথা দাও শুনবে?”

ইচ্ছে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক প্রত্যুত্তর দেয়।

.
.

পরেরদিন…

প্রীতি একজন নার্সের সাথে কথা বলছে। ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখছে। প্রীতি কণ্ঠে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,

-” *** নম্বর কেবিনের নীবিড় মাহবুবের সাথে দেখা করতে চাই।”

-” স্যরি, ম্যাম সম্ভব নয়।”

-” যেকোন ভাবেই হোক আমি দেখা করতে চাই। জাস্ট ফাইভ মিনিটসের জন্য হলেও। ব্যবস্থা করুন।”

প্রীতির কণ্ঠে সুক্ষ্ম আদেশ মেশানো। নার্সটি বলল,

-” ডক্টর খান আর পেশেন্টের গার্ডিয়ান যিনি ওনাকে এখানে এডমিট করেছেন তাদের থেকে বারণ আছে। ওনাদের পারমিশন ছাড়া কাউকে এলাউ করা হবে না। আপনি ফোন করে পারমিশন নিয়ে নিন।”

প্রীতি একটা নম্বর বের করে বলল,

-” আমি একটা নম্বর দিচ্ছি, আপনি একটু কষ্ট করে কল করে বলুন; ইচ্ছে দেখা করতে আসছে।”

নার্স নম্বর তুলতে তুলতে বলল,

-” পেশেন্টের কী হোন আপনি?”

প্রীতি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল,

-” আমি….আমি পেশেন্টের… পেশেন্টের ওয়াইফ।”

কল রিসিভ হতেই সালাম দিয়ে নার্স বলল,

-” পেশেন্ট নীবিড় মাহবুবের ওয়াইফ আর বাচ্চা দেখা করতে এসেছেন। স্যার কী করব?”

নীরব থম মে*রে ভাবতে থাকে। পরমূহুর্তে বলল,

-” দেখা করতে দিন।”

.

নার্স সাথে সাথেই আছে। প্রীতি বেডের থেকে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল,

-” মাম্মা ভালো লাগছে না। বাসায় চলো।”

বেডে নিস্তেজ শরীরটা লম্বালম্বি ভাবে পড়ে আছে। ঠোঁট দুটো নিঃশ্বাসের জন্য থেকে থেকে নড়ছে। প্রীতি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ইচ্ছে তুমি ভুল জানো, এটা তোমার পাপা।”

ইচ্ছে কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,

-” পাপা?”

-” হ্যাঁ, এটা তোমার পাপা। তোমার পাপা অসুস্থ।”

ইচ্ছে বেডের দিকে তাকাল। চুল এলোমেলো, দাঁড়ি গোঁফ বড় বড়। ইচ্ছের কেমন ভয়-ভয় লাগল। ও দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,

-” মাম্মা মিথ্যে বলছো, আমার পাপা সুন্দর। আমার পাপা ইত্ত কিউত।”

প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইচ্ছে কিছুতেই মানল না। প্রীতি জানালার পাশ ঘেঁষে এগিয়ে মা’কে ফোন করল। বলল,

-” মা, তুমি নীবিড়ের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করো। ওকে বিদেশে পাঠানোর জন্য যা করা দরকার তুমি তাই করবে।”

ওপাশ থেকে খানিকক্ষণ ভেবে ঠাণ্ডা মাথায় বলল,

-” তুমি ভেবে বলছো? নাহ মানে নীরব ওর ফ্যামেলি রাজি হবে? তুমি আগে নীরবের সাথে এ বিষয়ে কথা বলে নাও। তারপর না হয়।”

প্রীতির মাথার ভেতর রাগ চিড়বিড় করে উঠল। ক্ষিপ্র হয়ে বলল,

-” নীরবের সাথে কথা বলব না জন্য তোমাকে বলছি। আমি জানি না, তুমি কীভাবে নীরব বা ওর ফ্যামেলিকে ম্যানেজ করবে। তবে আমি চাই নীবিড় সুস্থ হয়ে উঠুক।”

-” প্রীতি আমি জানি তুমি রেগে আছো। আরেকটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে নিলে হয় না।”

-” প্লীজ মা আমার এই কথাটা অনন্ত শোনো। তোমার কোনো কথাই তো আজ পর্যন্ত ফেলিনি আমি। আমার এই একটা কথা রাখবে এতটুকু আশারাখি।”

-” আচ্ছা। তুমি বাসায় আসো।”

-” মা, আমার লাইফ হেল হলেও আমি আমার মেয়ের লাইফটা ন*ষ্ট করতে চাইছি না। মা, আমার মেয়ে অন্যের দায়িত্বে থাকুক আমি চাই না। যে কী না আমায় ঘৃ/ণা করে। তুমি জানো আমার দূর্বলতা শুধু একটা জায়গায়। এই দূর্বলতাটুকু না থাকলে প্রীতি ওর দিকে থুতুও ফেলতে ঘুরত না। প্রীতির রাগ-জিদ সম্পর্কে ওর আজও ধারণা হয়নি।”

প্রীতির গলা ধরে এল। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,

-” নীবিড় সুস্থ হলে, একহাতে ওর মেয়েকে দিবো। আরেক হাতে ডিভোর্স লেটার। যেটা আমি আগেই চেয়েছিলাম। শুধু তোমার কথা রাখতে পারিনি সেটা। তারপর আমি চিরদিনের জন্য বিডি ছাড়ব।”

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। প্রীতি ইচ্ছেকে বলল— চলো। আবার কিছু ভেবে বেডের দিকে একপল চাইল। ডান হাতটা নীবিড়ের কপালের উপর এলোমেলো পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতে বাড়াল। আবার পরমুহূর্তেই এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল প্রীতি। পিছু ঘুরে না তাকিয়ে গটগট পা ফেলে বেরিয়ে যায়।

_____________

এক সপ্তাহ খানেক পর…

শুক্রবারের পড়ন্ত বিকেল। ছুটির দিনের অলস বিকেলে বাসায় বোর হচ্ছিল নীরব। প্রত্যাশার সাথে কয়েকদিন দেখাসাক্ষাৎ নেই। ভাবে বিকেলটা ওখান থেকে ঘুরে আসা হোক। শ্বশুরবাড়িতে আসতে ছেলেদের আজন্মের একটা লজ্জাবোধ কাজ করে। তাই সময় সুযোগ থাকলেও খুব একটা আসা হয় না। প্রত্যাশার রুমের বেডে হাত দু’টো বিছানায় ঠেস দিয়ে গা-টা পিছুনে হালকা এলিয়ে বসে নীরব।‌ প্রত্যাশা নাস্তা রুমেই আনল। পাশের টেবিলে নামাতে নামাতে বলল,

-” নাস্তা করুন।”

নীরব নিরুত্তর রইল। প্রত্যাশা ফের বলতেই নীরব বলল,

-” কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”

-” অল্প করে খান।”

-” পরে খাব।”

প্রত্যাশা বিছানার মাথার কাছ বরাবর বসল। আকস্মিক বলে উঠল,

-” একটা কথা জিজ্ঞাসা করব করব করে করা হয়নি। আচ্ছা, নীরব আপনি কী করে জানতেন ওই ওই উনি..?”

নীরব কিছুটা রুক্ষ স্বরে বলল,

-” কী ওই উনি উনি করছো? স্পষ্ট করে বলো।”

প্রত্যাশা জড়তা নিয়ে বলল,

-” না মানে বলতে চাচ্ছি।”

নীরব কথা কেড়ে নিয়ে বলল,

-” সার্থক তোমাকে পছন্দ করে সেটা?”

প্রত্যাশা ওড়নার কোণা আঙুলে পেচাতে পেচাতে মাথা নাড়ল। নীরব গম্ভীর স্বরে বলল,

-” প্রীতির মাধ্যমে জেনেছিলাম। বাট তখন ওরা জানত না তুমি আমার বউ।”

-” ওহ্। উনারা যা করেছেন, প্রীতি মানে প্রীতি আপু উনার ভাইকে হেল্প করেছেন। এটাও অন্যায়। দু’জনেই সমান দোষী। তবুও মাঝেমাঝে মনে পড়লে আমার গা কাঁ”টা দিয়ে উঠে। দাবাং মা/র্কা পাঁচটা চ’ড় মে*রেছেন আপনার শ্রদ্ধেয় ভাবীর গালে। যার নাম নিয়ে একদিন একটু ব্যঙ্গ করেছিলাম বলে কতগুলো জ্ঞানের কথা শুনালেন।”

প্রত্যাশা যে একটু ঠেস দিয়ে বলল তা নীরব ঠিক বুঝতে পারল। নীরব বলল,

-” সে অন্যায় করেছে। আমি যেটা করেছি, ওটা তো তার অন্যায়ের সামান্য প্রতিবাদ। আসলে উচিত ছিল কঠোর শাস্তি দেওয়া।”

-” ওনার মা বৃদ্ধা মহিলা হাতজোড় করে রিকুয়েসট করলো। আর ক্ষমা তো মহৎ গুণ। দিলাম না হয় ওদের দুই ভাইবোনকে মাফ-সাফ করে।”

-” তোমার কথা ভেবে বাড়তি কোনো অ্যাকশন নেইনি। যতই হোক ওরা তো আবার তোমার আপনজন।”

প্রত্যাশা ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল,

-” আমার আপনজন মানে? ওনারা তো আপনারই রিলেটিভ।”

নীরব টিশার্টের গলা ফাঁক করে ফুঁ দিল। গরম লাগার ভঙি করে কথা ঘুরিয়ে বলল,

-” আমার রিলেটিভ হলেও দেখেছো কখনো সৌজন্যমূলক আচরণ করতে? অথচ তুমি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েও ওদের সাথে আড্ডা দিতে বসো।”

প্রত্যাশার মুখটা তেতো হয়ে এল। চিড়বিড়িয়ে রাগ উঠল। কিছুক্ষণ থম মে*রে থেকে বলে উঠল,

-” আমার না পার্সোনালি পু”লিশ-টুলিশ পছন্দ নয়।”

নীরব ভ্রু গুটিয়ে চেয়ে বলল,

-” কেনো?”

-” আমার এক বান্ধবীর বাবা পুলিশ। সে পরিবারকে না জানিয়ে সিরাজগঞ্জে ওনার পোস্টিং ছিলো। সেখানে আরেকটা বিয়ে করে সংসার পাতে। প্রতিবেশী এক আন্টির হ্যান্ডবেন্ডেরও প্রায় সেইম সেইম কেস। অনেক পুলিশকে দেখেছি দুই বিয়ে করতে।”

-” আমাকেও কী তোমার ওমন মনেহয় নাকি?”

-” না তা মনে হয় না। তবে পুরুষ মানুষকে নিয়ে বিশ্বাস নেই।”

-” এটা বাদ দিয়ে অন্য কোনো কারন থাকলে বলতে পারো। এখানে আমি লেটার মার্ক নিয়ে পাশ করে যাব, নো ডাউট।”

প্রত্যাশা জিভের আগায় ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,

-” একটা বিষয় দেখবেন সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশ নিয়ে পজেটিভের থেকে নেগেটিভ মনোভাবই বেশি। আর এইযে দেখুন না, বাংলা সিনেমায় মা*রামা*রি, ফা*টাফাটি র*ক্তার*ক্তি, লা*শ পড়ার পর শেষ দৃশ্যে এসে পু*লিশ হাজির হয়। যখন সবশেষ তখন আসে দায়িত্ব পালন করতে। আমার কাছে আপনাকেও তেমনই ঠেকছে। সবকিছু শেষে এসে আপনি সত্য উদঘাটন করেন। শুধু মাত্র আমার ক্ষেত্রেই দেখলাম ডিরেক্ট অ্যাকশন নিলেন। সেটাও আবার যাচাই-বাছাই না করে ভুল বুঝে। নিরীহ, অবলা আমিটাকে পেয়েছিলেন, সব রাগ একসাথে ঝাড়লেন।”

নীরব অপমানিত বোধ করল। কিছু বলার খেই হারিয়ে ফেলল। কিছুপল চুপচাপ থেকে মৃদুস্বরে বলল,

-” বলেছি তো ওই মুহূর্তে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি। মাইন্ড আউট হয়ে যায়, আমার বউয়ের গলায় আমার হাত দিয়ে পড়িয়ে দেয়া চেইন আমার শ”ত্রুর টিশার্টের বোতামে আটকায়। সে আবার যত্ন সহকারে ছাড়াচ্ছে। নিজের বউকে অন্যের সাথে এতটা ক্লোজড দেখলে কোনো পুরুষেরই মাথা ঠিক থাকবে না। হ্যাঁ, মানছি বেশি রুঢ় আচরণ করে ফেলেছি। স্যরি!”

ছোট করে শ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল নীরব,

-” আচ্ছা, এসব টপিক বাদ দাও। এখন বিয়ের প্রোগ্রাম নিয়ে তোমার প্লান বলো। বিয়েতে কী পড়বে, শাড়ি না লেহেঙ্গা?”

কথাটা বলতে বলতে নীরব বিছানায় শুয়ে মাথাটা রাখে প্রত্যাশার কোলের উপর। প্রত্যাশা মৃদু কেঁপে উঠল। বলল ছোট করে,

-” শাড়ি।”

-” ওকে। কী রঙের?”

-” ভাবিনি। ইউটিউব থেকে দেখে নিবো।”

-” আচ্ছা।”

প্রত্যাশা বলল,

-” নাস্তা করে নিন। ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।”

-” ঘুমাব।”

-” এখন? আরেকটু পরে আজান পড়বে তো। ছয়টা দশ বাজে অলরেডি।”

প্রত্যাশার কোমড় দুই হাতে জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজে বলল নীরব,

-” আজানের আগে ডেকে দিবে। এই পঁয়তাল্লিশ মিনিট একটাও শব্দ করবে না, না তো নড়াচড়া।”

-” আ’জ’ব কথা আমি নাকি স্ট্যাচু হয়ে এভাবে বসে থাকব। এখন এই অবেলায় আপনার ঘুম পাচ্ছে। রাতে কী করেছিলেন? না ঘুমিয়ে মশা তাড়িয়েছিলেন নাকি?”

#চলবে