মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৩৯+৪০

0
9

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৩৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

একে একে প্রত্যাশার সব পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ভেবেছিল — পরীক্ষা শেষে কোথায় একটু নিশ্চিন্তে আরামসে ঘুম দিবে, চিল করবে। কিন্তু হায়! সে স্বপ্নে এখন গুড়ে বালি। বেচারি এখন পড়ে আছে বিয়ের অনুষ্ঠানের হাজারটা ঝক্কি-ঝামেলায়।

পরশু শেষ প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে সোজা চলে গিয়েছিল শপিংয়ে। সাথে নীলা -নিভানও ছিলো। বিয়ের দিনের শাড়িটা কিনেছে নীরবের পছন্দে। ডিপ লাল-খয়েরি রঙের, ভারি কাজ করা। আর হলুদ, বউভাতের শাড়ি সবই প্রত্যাশার নিজের পছন্দে। নীলা তো ভেতরে ভেতরে খুব ক্ষে”পেছিল। সব যদি প্রত্যাশার পছন্দেরই হয় তাহলে ওকে আনার কী দরকার ছিলো? আর নীরব, বউ বলছে সেটাই শুনছে। অবশ্য নিভান তার বেহুদা রা”গ করা বউকে সামলে নিয়েছিল। ওদেরকে বুঝতে না দিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে বড় ভাবিকে গর্জিয়াস শাড়ি দিতে ভোলেনি নীরব। তারপর বাড়ির সবার জন্য হালকা-পাতলা কিছু নেয়া হয়।

বিকেলটা মেঘে ঢাকা, সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ঘরভর্তি স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়া। প্রত্যাশার মনটাও আবহাওয়ার মতো ম্যারমেরে হয়ে আছে। বালিশ বুকের নিচে রেখে ফোন স্ক্রল করছিল। ফোন ঘাঁটতেও ভালো লাগছে না। মাথায় চলছে কেমিস্ট্রির ফার্স্ট পেপার নিয়ে টেনশন। পিরিয়ডিক টেবিল থেকে মৌল শনাক্ত করার প্রশ্নে মা”রা”ত্ম”ক ভুল করে এসেছে সে। অথচ কী যত্ন করে মৌল শনাক্ত করে চিত্র এঁকেছিল, ইলেকট্রন বিন্যাস দেখিয়ে বর্ণনা করেছিল। পাতা ভর্তি করে ‘ঘ’ নম্বরে বিশ্লেষণ করল। সবই বিফলে গেলো। বাসায় ফিরে বই খুলে দেখা মাত্রই মাথায় হাত ওঠে। ‘গ’ আর ‘ঘ’ পুরোপুরি ভুল। এক ফোঁটা নম্বরও পাওয়া যাবে না। বাকি প্রশ্নের উত্তরও যে ভালো হয়েছে এমন নয়। সেকেন্ড পেপার অবশ্য মোটামুটি হয়েছে। তবুও এক অজানা টেনশন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে ভিতরটা। ফেল করবে এমন নয়। ফেল সে করে না, তবে রেজাল্ট যে ভালো হয় এমনও না। এবার শেষের দিকে এসে পড়াশোনায় একটু মনোযোগ দিয়েছিল। এসব ভুল দেখে বেচারি খুব হতাশ। এরমধ্যে ফোনটা কেঁপে উঠল। রিসিভ করে বলল,

-” হ্যাঁ, বলুন।”

ওপাশ থেকে গলার স্বর শুনেই নীরবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সন্দিহান কণ্ঠে শুধাল,

-” মন খারাপ?”

-” নাহ।”

-” গলার স্বর ভারী ভারী মনে হচ্ছে।”

-” উঁহু, তেমন কিছু নয়। অনেকক্ষণ হলো শুয়ে আছি তাই বোধহয়।”

-” ওহ্।”

-” আপনি কোথায়?”

-” অফিসে।”

-” বাসায় যাবেন কখন?”

-” দেরি হবে। রাত নটার পরে।”

-” এত দেরিতে কেনো? কাজ আছে বেশি?”

-” উঁহু। বাসায় বউ নেই তাই তাড়াতাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই।”

-” অফিসে সুন্দরী মেয়ে কলিগ আছে টাছে? এমনিতেও আপনাদের প্রফেশনের মেয়েদের ফিগার চোখে লাগার মতো হয়। ছুঁকছুঁকানি স্বভাব আছে নাকি?”

-” আসতাগফিরুল্লাহ।”

প্রত্যাশা ঠোঁট টিপে হাসল। নীরব হঠাৎ শুধাল,

-” গতকাল কেনাকাটার সময় তোমাকে অন্যমনস্ক লাগলো। ভাইয়া-ভাবী সাথে ছিলো বলে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। তুমি কী কিছু নিয়ে টেনস?”

-” আসলে পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে একটু-আকটু চিন্তিত। এর আগে কখনো এরকম হয়নি, এবারেই প্রথম হচ্ছে। রেজাল্ট খারাপ হলে…”

নীরব সাথে সাথেই বলল,

-” ডোন্ট ওয়ারি। এটা নিয়ে আর টেনশন করবে না। তুমি মন থেকে চেষ্টা করেছো, সেটাই অনেক বড় বিষয়। জীবনে যে জিততে চায়, তার আগে কিছু হেরে শেখা দরকার। রেজাল্ট কোনো ব্যাপার না। সামনে আরো সময় পড়ে আছে।”

প্রত্যাশা হতাশ স্বরে বলল,

-” জানেন, মানুষের দেখি ভুল করেও ঠিক হয়। আর আমার ক্ষেত্রে? পারা জিনিসটাও ভুল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, কী দিয়ে ঘষেঘষে যে এই ফাটা কপালটা বানানো হয়েছে। শুধু কি পরীক্ষায়? উঁহু! লাইফের প্রতিটা জায়গায় বাঁশ খাই আমি। দু’দিন ভালো গেলেই, তৃতীয় দিনে কোথা থেকে কোন প্রব্লেম এসে হাজির হয়। কে কাকে খোঁজে বুঝি না! আমি সমস্যা খুঁজি, না সমস্যা আমায় খুঁজে বেড়ায়?”

-” মাঝেমাঝে জীবনে একটু সমস্যা থাকাটা দরকার। যাতে করে আমরা শিখতে পারি, বুঝতে পারি; ভালো থাকাটা আসলে কতটা মূল্যবান। সবকিছু যদি সবসময় ঠিকঠাক চলত তাহলে সুখের আসল মূল্যটা কেউ বুঝত না। যাইহোক সবকিছুর জন্য ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়। উপরওয়ালার প্রতি বিশ্বাস রেখে চলতে হয়। অন্যায় না করলে তিনি নিশ্চয়ই উত্তম কিছুই দেবেন।”

-” হুম, সেটাই।”

-” আচ্ছা সব দুশ্চিন্তা দূর করে আনন্দ করো। পাছে আবার আমাকে দোষারোপ করে বসবে, এসব টেনশনে বিয়েতে মজা করতে পারোনি।”

প্রত্যাশা গমগমে স্বরে বলল,

-” পরে কী আমি তো এক্ষুনি বলছি; আমি পারছি না মন থেকে এসব টেনশন দূর করতে, আর এরমধ্যে ওদিকে আপনার বউকে ঘরে তোলার তাড়া লেগেছে। যেন এখনই বউ তুলে না আনলে মহাবিপদ হয়ে যাবে। অনুষ্ঠান ছাড়া কী যাইনি আমি? চারমাসে চৌদ্দবার আসা-যাওয়া হয়ে গেল ও বাড়ি। আর ক”টা দিন দেরি করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো শুনি! উফ্!”

নীরব কণ্ঠে ফাজলামো নামাল,

-” অপেক্ষা করার ধৈর্য্য নেই। অনেকদিন কষ্ট করে ধৈর্য্য ধরেছি। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য হলেও আমার বিয়ে করা বউ আমার বাসায় চাই। রোজ বাসায় ফিরে সারাদিনের ক্লান্তি, অবসাদ দূর করতে বউয়ের মিষ্টি মুখ দেখা জরুরী।”

এরমধ্যে অধরার গলা কানে আসতেই প্রত্যাশা বলল ঝটপট,

-” আম্মু ডাকছে। এখন রাখছি। রাতে কথা বলব।”

-” ওকে। আল্লাহ হাফেজ।”

-” আল্লাহ হাফেজ।”

ড্রয়িংরুমে বেশ শোরগোল হচ্ছে। কথাশুনেই বোঝা যাচ্ছে কোনো আত্মীয় এসেছে। প্রত্যাশা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অকস্মাৎ বিড়বিড় করল,

-” বাসা ভর্তি মেহমানের হৈচৈ একদন্ড শান্তিতে নিরিবিলি থাকার জো তো নেইই। আবার তাদের সাথে দেখা হলে প্রথম কথাই থাকে— ‘হ্যাঁ রে প্রত্যাশা পরীক্ষা কেমন দিলি?’ যদি বলি; ভালো হয়েছে। তাদের সেকেন্ড কথা; ‘কেমন ভালো দিলি রেজাল্টেই দেখা যাবে। জামাই অনেক শিক্ষিত, শ্বশুরবাড়ির মানসম্মান নৌকা ডোবানোর মতো ডুবাস না আবার।’ এমনিতেই রেজাল্টের চিন্তায় শুকিয়ে যাচ্ছি। তারউপর আত্মীয় স্বজনের এসব কথা শুনে বুকের ভেতর এমন ছ্যাঁকা লাগে। মনেহয় গরম চায়ের কাপটা হাতে না উঠে সরাসরি কলিজার ওপর পড়ে গেছে।”

স্লিপারে পা গলিয়ে এগোতে এগোতে ভাবল— কোন এলার্জি আত্মীয় যে এবার এল।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ। পরশু শুক্রবার বিয়ের অনুষ্ঠান কমিউনিটি সেন্টারে করা হবে।

.
.

টেবিলের উপর নারিকেল কুড়ানো ছিলো। আম্মু বোধহয় তেলে ভাজা পিঠা বানাবে। প্রত্যাশা ছোট বোলে নারিকেলের কুঁড়া, চিনি আর কিছু মুড়ি নিয়ে সোজা ব্যালকনিতে আসে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া বইছে। মনটা ফুরফুরে করতে চামচ দিয়ে মিক্সড করতে করতে গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠল প্রত্যাশা,

-” পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে উঠে॥
চেনাশোনার কোন্‌ বাইরে,যেখানে পথ নাই নাই রে সেখানে অকারণে যায় ছুটে॥
……………………….
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে
পা’গ’ল আমার মন জেগে উঠে।

চামচে তুলে মাত্র মুখে পুড়েছে প্রত্যাশা আর ঠিক তক্ষুনি নীলাশার গলা এল। হাতের ফোনটা প্রত্যাশার সামনে ধরে বেশ নম্র স্বরে,

-” এইযে প্রত্যাশা, নিন ওর সঙ্গে কথা বলুন।”

পরপর প্রত্যাশার দিকে ভ্রু নাড়িয়ে ইশারা করে ফিসফিসিয়ে বলল,

-” নে ধর ফোন। কথা বল।”

প্রত্যাশার গালভর্তি খাবার। ফোনের স্ক্রিনে একগাদা অপরিচিত মুখ। এখন খাবারই গিলবে নাকি কথা বলবে? অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করে উঠল। কোনো রকমে ফোনটা হাতে নিয়ে ফ্রন্ট ক্যামেরা পাল্টে ব্যাক ক্যামেরা অন করল। গালের খাবার দ্রুত গলাধঃকরণ করে নীলার দিকে রাগত চাউনি ছুঁ’ড়’ল। ফোনের স্পিকারে হাত চেপে রেখে ঠোঁট চেপে বলল,

-” আপু তোমার আক্কেল দাঁত উঠেনি?”

নীলাশার মেজাজ বিগড়ে গেল। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

-” মানে? কী বলতে চাইছিস?”

-” দেখোছো খাচ্ছি, হাতে খাবারের বোল। এরমধ্যে বলা নেই, কওয়া নেই দুম করে ফোন সামনে ধরলে। ভিডিও কল, তাও আবার শ্বশুরবাড়ির অপরিচিত লোকজন। গালে আমার খাবার, দেখেও বলে; কথা বল।”

-” আমি খেয়াল করিনি তোর মুখে খাবার। আর এখন বল।”

প্রত্যাশা আইগুই করে বলল,

-” ধূর, এদের চিনি না। কী বলব?”

-” তোকে কিছু বলতে হবে না। চুপচাপ হেসে হেসে হ্যা, হুঁ করিস। তাহলেই চলবে। আবার কী বলতে কী বলে ফেলবি উল্টাপাল্টা। তখন আমার সম্মানও যাবে।”

ওড়নাটা ভালো করে মাথায় টেনে মুখে হালকা হাসি নিয়ে প্রত্যাশা সালাম দিলো। ওপাশে আবিরের নানু জয়নব আরা সহ আরো বেশকজন আত্মীয়। ওনারা সব বায়না ধরেছে নতুন বউকে দেখবে। একজন অল্প বয়সী ভাবী টাইপের মহিলা হেসে হেসে দু চারটে কথা বলল। নীহারিকা এসে ফোন ধরলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে বললেন,

-” তোমার আম্মু কোথায়? কথা ছিলো একটু।”

-” একটু অপেক্ষা করুন, আমি আম্মুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”

প্রত্যাশা যেতে যেতে আরো দু একটা কথা বলল। জয়নব আরা হঠাৎ মশকরা করে পাশ থেকে বলে উঠলেন,

-” নিভানের মা তোমার বেয়াইনকে জিজ্ঞেস করো, মেয়েকে কী পাতিলের তলার পোড়া ভাত খাওয়াইছিলো নাকি? তাই এমন বৃষ্টি-বাদল দিনে বিয়া হইতাছে। বৃষ্টি থামনের নামই নিচ্ছে না।”

নীহারিকা কিছুই না বলে চুপ রইলেন। প্রত্যাশা ফট করে বলে উঠল,

-” বিয়ে কিন্তু শুধু মেয়ের মায়ের মেয়েরই হচ্ছে না। ছেলের মায়ের ছেলেরও হচ্ছে। তাহলে কেনো শুধু মেয়ের মায়েরই দোষ?”

এতক্ষণে প্রত্যাশা অধরার কাছে চলে এসেছে। অধরা চোখ রাঙালেন মেয়ের দিকে। ফিসফিসিয়ে বললেন,

-” তোকে নিয়ে আর পারি না। প্রতিটা কথারই উত্তর দিতে হবে? সেটাও পা”গলের মতো। কবে যে একটু বুদ্ধি শুদ্ধি হবে তোর।”

প্রত্যাশা ফোন দিয়ে গাল ফুলিয়ে রাখল। কী ভুল বলল? বুঝে আসছে না ওর। সব সময় দেখে আসছে, ভালোটা হলে ছেলের মায়ের দিকে প্রশংসার ঝুলি। আর ম’ন্দে’র বেলায় অযাচিতভাবে মেয়ের মা দোষী।

____________

নারিকেল দিয়ে মুড়ি খেয়ে প্রত্যাশার অ্যাসিডিটি বেড়ে বদহজম হয়েছে। রাত থেকে সকাল পর্যন্ত তিনবার গলগলিয়ে বমি করে ভাসিয়েছে। অধরা গ্লাসে স্যালাইনের পানি এনে মেয়ের সামনে ধরলেন। রাগ-ক্ষোভ মিশিয়ে চেঁচালেন,

-” ধর, স্যালাইন পানিটা খেয়ে নে। কিছু বললি তো শুনবি না। একটা না একটা অঘটন ঘটিয়ে ছাড়িস। কে বলেছিলো ওসব খেতে? রাতভর বমি করে ভাসালি। বেলা বারোটা বাজতে চলল কিছুই খাচ্ছিস না। পেট ফুলে আছে। এদিকে সন্ধ্যায় হলুদ, ও বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। এখন এভাবে বিছানায় পরে থাকবি। আমার হয়েছে যত জ্বালা। এখন তোর পিছনেই সময় দেবো, নাকি বাড়িভর্তি মেহমানদের দিকে নজর দিবো। আরো কাজ আছে আমার।”

দূর্বল হাতে স্যালাইনের গ্লাস হাতে নিয়ে চোখ বুজে এক ঢোক গিলে প্রত্যাশা। অধরা শুধালেন,

-” ঔষধ রেখে গিয়েছিলাম, খেয়েছিস?”

প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে ‘হ্যাঁ’ বোঝায়। অধরা ফের বললেন,

-” দেখো দেখি, এক বেলায়ই চোখমুখের কী হাল হয়েছে। চোখ ডেবে গর্তে ঢুকেছে।”

হা হুতাশ করে অধরা বেরিয়ে গেল। হ্যাপি, কোয়েল আজ সকালেই এসেছে। কোয়েল দুষ্টু হেসে বলল,

-” আমার তো তোর বরের জন্য মায়া হচ্ছে রে প্রত্যাশা।”

প্রত্যাশা প্রশ্নবোধক চাউনিতে তাকাল। কোয়েল কানের পাশে মুখ টেনে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” প্রথমবার বিয়ের চারমাস গেলেও বাসর অসম্পূর্ণ। এখন দ্বিতীয়বারের বাসরটাও না তার মাটি হয়। বউয়ের অসুস্থতার জন্য। তাড়াতাড়ি মেডিসিন খেয়ে সুস্থ হয়ে যা তো।”

-” তুই আসলেই লুচু মহিলা। আর দ্বিতীয়বার বিয়ে কী? এবারে শুধু রেজিঃ হবে। ধর্মীয়ভাবে তো বিয়ে হয়েছেই।”

আরো ক-ঢোক স্যালাইন পানি গিলে বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল প্রত্যাশা। মাথার উপর ঘূর্ণীয়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত ভঙিতে বলে,

-” ধূর! কাল শুধু শুধু কতগুলো টাকা খরচা করে ফেসিয়াল করে আসা হলো। একদিনেই চোখের নিচে কালি জমেছে। টাকাগুলো সব জলে গেল।”

হ্যাপি বলল,

-” ঠিকমতো খাবার খা, এখন একটু ঘুমা দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।”

কোয়েল বলল,

-” ব্যাপার না, আজ দুপুরে আবার ফেসিয়াল করতে যাবি। খরচ দিবে তোর বর, তোর এত চিন্তা কিসের? নাকি খুব হিসেবি বউ হবি তুই?”

এরমধ্যে নীলার স্বর আসে। রুমে ঢুকেই জিজ্ঞেস করল,

-” প্রত্যাশা, মেঝো মামার নম্বর আছে তোর কাছে? মামা বাজারে গিয়েছে। আম্মু বলল ফর্দে কয়েকটা জিনিস বাদ পড়েছে। মামাকে বলতে হবে।”

প্রত্যাশা ফোন দেখিয়ে বলল,

-” বালিশের পাশে ফোন দেখো সেভ করা আছে।”

-” লক খুলে দে।”

প্রত্যাশা লক খুলতে থাকে। নীলা বলে উঠল,

-” এ বাড়িতে এসে এক দন্ড স্বস্তি পাচ্ছি না। আসার পর থেকেই একটা না একটা কাজের উপরই আছি। আম্মুর আদরের মেয়ের বিয়েতে আমাকে দিয়ে খাটিয়ে নিচ্ছে।”

-” তুমি বরং তোমার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাও। সেখানে গিয়ে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে দেবরের বিয়ের কাজে লেগে পড়ো। একমাত্র বোনের বিয়েতে একটু কাজ করতেই তোমার হাজারটা অভিযোগ। দেবরেরটা মনের আনন্দে করো গিয়ে।”

নীলাশা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,

-” শুয়ে শুয়ে ফটর-ফটর কথা আসছে। ফোন দে। আম্মু ডাকছে।”

___________

মেয়ের বাড়ি থেকে হলুদের ডালা নিয়ে অল্প কজন এসেছিল সকালের দিকে। তাদের আপ্যায়ন তারপর অতিথিদের দেখভাল করতে গিয়ে নীহারিকার একটু জিরানোর ফুরসত নেই। সবসময় দৌড়ের উপর আছেন। ডায়নিংয়ে বসে গ্লাসের পানিতে ঠোঁট ভিজিয়েছেন মাত্র। অমনি একজন প্রতিবেশীর গলা এলো। পান চিবোতে চিবোতে বলল,

-” কী গো নিভানের মা, বাড়িভর্তি মেহমান। এত লোকজন। তা তোমার মেঝো বউমাকে আনোনি? কই তোমার নাতনি? ইদানিং মাঝেমধ্যে তাকে তো দেখি। শুনলাম হাসপাতালে তোমার অসুস্থ ছেলেকে তুমিও দেখতে যাও। ছেলে, নাতনিকে মেনে নিলে, পরের বাড়ির মেয়েটাকে মানতে পারলে না।”

আত্মীয়-স্বজন সহ পাড়া প্রতিবেশী এদের খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই। শুধু খোঁচাতে আসে। আত্মীয়রাও এই একই প্রশ্নে মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে। নীহারিকা উত্তর না দিয়ে বললেন,

-” বসুন।”

পরপর উঠে শর্মিলাকে বললেন,

-” ছোটো, মিষ্টি আর পান এনে দে।”

নীহারিকা কিচেনে। শর্মিলা ভয়ে ভয়ে বললেন,

-” ভাবী তুমি একবার ফোন করে বলবে। না মানে বাড়িতে এতবড় অনুষ্ঠান হচ্ছে। ওরা থাকলে বাড়িটা একদম পরিপূর্ণ হতো।”

ইচ্ছে মাঝে মাঝেই আসে। শর্মিলা আরো দুএকজনের বলায় প্রীতিদের ওখানেও কার্ড দেয়া হয়। নিভান গিয়েছিল। প্রীতি স্রেফ জানায়— ইচ্ছের দিদুন একদিন আমাকে দেখেই উঠে গিয়েছিল। আমার বাড়ির পানিটুকু না ছুঁয়ে। এ-ও বলেছিলেন, আমাকে ও বাড়ির বউ হিসেবে মানবেন না। সেই বাড়িতে শুধু একটা কার্ডের মাধ্যমে প্রীতির পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। ইচ্ছের দিদুনকেই এসে আমাকে যথাযথ সম্মান দিয়ে নিতে হবে।

এ কথা শুনে নীহারিকার মেজাজ গরম হয়। নিভানের উপর রাগঢাক করেন— ওখানে কার্ড দিতে হবে কেনো? কে বলেছে দিতে?

শর্মিলার কথার জবাবে নীহারিকা বললেন,

-” দ্যাখ ছোটো এখন কাজের সময় মাথা খারাপ করে দিস না। ওই মেয়ের বাড়ি কার্ড গেছে এই তো ঢের বেশি। আবার বলে কী না আমাকে গিয়ে তাকে মাথায় করে আনতে হবে।”

শর্মিলা সহসাই বলে উঠলেন,

-” ভাবি শুধু রাগ করলেই হবে না। এর আগে একবার ইচ্ছের জন্য আসলেও, ধরতে গেলে এবারই প্রথম স্বাভাবিক আসা হবে। সেখানে তুমি বাড়ির কর্ত্রী। তুমি যদি না বলো, ওই বা কীভাবে আসে? যাওয়ার কথা বাদ দাও, একবার ফোনেই না হয় বলো। ইচ্ছে আসলে কত খুশি হবে। ইচ্ছের জন্য হলেও না হয়।”

____________

সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা থাকলেও আর বৃষ্টি নামেনি। প্রত্যাশা এখন মোটামুটি সুস্থ। আর বমিটমি হয়নি। বিকেলে পুরোদমে মেহেন্দির আয়োজন চলছে। প্রত্যাশার গায়ে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। হাত দু’টো টানটান করে রেখেছে ও।‌ কোয়েল দক্ষহাতে সুনিপুণতার সহিত দারুণ করে হেনা আর্ট করছে। প্রত্যাশার হাতের মাঝে ইংরেজী ফন্টে নীরব-প্রত্যাশা নামটা জ্বলজ্বল করছে। প্রত্যাশার ফোনে ছবি তুলে ঝপটপ বলে হ্যাপি,

-” ছবিগুলো তোর বরের কাছে পাঠিয়ে দিলাম।”

প্রত্যাশা সবেগে মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। হ্যাপি থোড়াই কেয়ার করে পিক গুলো একেএকে হোয়াটসঅ্যাপ পাঠিয়ে দেয়।”

হ্যাপি বলল,

-” এবার দেখি রং কতটা গাঢ় হয়। মেহেদির রঙ যত গাঢ় হয় বরের ভালোবাসাও নাকি তত গাঢ়, গভীর হয়।”

প্রত্যাশা মুখ বাঁকিয়ে বলল,

-” ধূর, তাই আবার হয় নাকি। যতসব, আজগুবি কথাবার্তা। আমার তো কোনোকালেই রং গাঢ় হয় না।”

.
.

ছাদের চতুর্দিকে বিভিন্ন রঙের লাইট। যার আলোয় ঝিকমিক করছে চারপাশ। হলুদের স্টেজটা ঠিক মাঝ বরাবর। ফুলে আর মরিচবাতিতে সাজানো। ছোটবড় প্রায় সব মেয়েদের গায়েই হলুদ শাড়ি। হলুদে মুখরিত চারপাশটা। প্রত্যাশা হলুদ জামদানিতে মোড়া। বাঙালি স্টাইলে পড়ানো শাড়ি। বাম কাঁধের উপর দিয়ে আঁচলটা পিছুন হয়ে সামনে দিয়ে ডান কাধ দিয়ে তোলা। ফেসিয়াল আর প্রসাধনীর জাদুতে প্রত্যাশা একদম ঝলমল করছে।‌ গাভর্তি কাঁচা ফুলের গহনা। হলুদ গোলাপ, রজনীগন্ধা, আর লাল গোলাপ দিয়ে বানানো গয়না হাতে, গলায়, মাথায় টিকলিতে। ঠোঁটজোড়া রক্ত জবার ন্যায় টকটকে। লাল লিপিষ্টিক গাঢ় করে দেয়া। পায়ে লাল আলতা।

গায়ের হলুদ শাড়ি, হলুদ ফুলের সমাহারে প্রত্যাশাকে একদম জীবন্ত হলুদ গোলাপের মত লাগছে। হলুদ সাজে ভারী মিষ্টি লাগছে।

বড়দের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বাচ্চা পার্টিরা ছাদে ডিজে মিউজিক বাজাচ্ছে। প্রত্যাশার ফ্রেন্ডরা তো আছেই সাথে কাজিনরাও অ্যাড হয়েছে। বাচ্চা বাচ্চা কাজিনরা হৈ হুল্লোড়ে মেতেছে, নাচছে।‌ প্রত্যাশা বান্ধবীদের সাথে দেখছে আর হেসে হেসে গল্প করছে।

রোহান আর নাহিদ একের পর এক গান পাল্টাচ্ছে। একটা গানের দুইটা লিরিক্স হতে না হতেই আরেকটা। খোলা হাটের বালুচর থেকে শুরু করে, নোরা ফাতেহীর দিলবার পর্যন্ত বাদ পড়েনি। নাহিদ বলল,

-” এই ব্যাটা এখানে বসে আছিস ক্যান। যা তোর গার্লফ্রেন্ডের সাথে একটু কোমড় দুলিয়ে আয়।”

রোহান মশা তাড়ানোর ভঙিতে বলল,

-” ধূর।”

নাহিদ একপ্রকার জোড় করে নিজ থেকে গলা ফাটিয়ে বলল,

-” এটেনশন প্লিজ, একটা কপাল ডান্স হলে ভালো হয়। কোয়েল আর রোহান।”

সাথে সাথে সবাই সিটি বাজিয়ে উৎসাহ দিল। কোয়েল না না করলেও পরে যায়। বেজে উঠল,

-” Tere vaaste falak se main chaandi launga
Salah satrah sitaare sang baandh launga….”

গানের তালে তালে ওরা নাচছিলো। আবার যখন এই লাইনটা বেজে উঠল, রোহান প্রত্যাশার হাত ধরে টান দিয়ে আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,

-” Tere vaaste falak se main chaandi launga
Salah satrah sitaare sang baandh launga..”

পরের লাইন চললো। প্রত্যাশা মুচকি হেসে কোমড় দুলিয়ে রোহানের ঘাড় ধরে আকাশের দিকে তুলে বলল,

-” যা যা আগে নিয়ে আয় কতো পারিস।”

বলতে বলতে পরের লাইনে রোহান একগাল হেসে বলল,

-” Pehle Ishq Lada loon, Uske baaad launga।”

প্রত্যাশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। রোহানের গরম লেগে যায়। ও চলে যায়। এরপর এক পর্যায়ে হ্যাপি কোয়েল দু’জনেই নাচতে থাকে কালা চশমা গানে। ওদের চোখে কালো সানগ্লাস। প্রত্যাশার চোখেও পড়িয়ে দিল। একপর্যায়ে প্রত্যাশা ফ্রেন্ডদের সাথে যোগ দিয়ে উরাধূরা নাচতে থাকে।

ওদিকে মামী গিয়ে অধরাকে নালিশ করে,

-” দ‌্যাখো তোমার মেয়ে উপরে কী শুরু করেছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন নতুন বউকে অমন নাচতে দেখলে কী ভাববে!”

অধরা ছাদে এসে দেখার সাথে সাথেই মেয়েকে টেনে একপাশে নিয়ে, চোখ রাঙিয়ে শাসন করল।

-” এই প্রত্যাশা এমনিতেই তুই অসুস্থ। আবার এরকম লম্ফঝম্প শুরু করেছিস। আর এই, ও বাড়ি থেকে লোকজন চলে এলো বলে।‌ ওনারা দেখলে কী বলবে?”

প্রত্যাশা টমেটোর মতো গাল ফুলিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে ফ্রেন্ডদের বলল,

-” অ্যাই তোরা শোন, কিছুক্ষণ পর এএসপি সাহেব আসবে ফটোশুটের জন্যে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন থাকবে, সবার সামনে নিজে থেকে পোজ দিলে, তারা আবার ভাববে নতুন বউয়ের লজ্জা শরম কম। তাই তোরা বিভিন্ন স্টাইলে পোজ দেয়ার জন্য শুধু একটু বলবি। আর আমি অমনি…বুঝেছিস?”

উচ্চ ভলিউমে ‘একা একা গুগল গাটি’ গান বাজতে লাগলো। হ্যাপি চেঁচিয়ে উঠলো,

-” ওই টারে ওখান থেকে সরা তো কেউ। রুচি নাই কি সব গান বাজাচ্ছে। একটা গানও তো দু লাইন হতে না হতেই বদলাচ্ছে।”

কোয়েল বলল,

-” ওই নাহিদের বাচ্চা গান পাল্টা। একাএকা গুগল না ঘেঁটে বিয়ে করে কম্বলের তলায় বউ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কর।”

এরমধ্যে গান পাল্টে যায়। হঠাৎ প্রত্যাশার নজর পরে সিঁড়ির দরজার দিকে। চোখের কালো চশমা খুলে তাকায়। নীরব একহাত পকেটে গুঁজে অন্যহাতে চুলে ব্যাক ব্রাশ করে ঠোঁটে হাসি টেনে এগোল।

বাজতে থাকল…

-” আইলোরে নয়া দামান…..!!”

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

নীবিড়ের রুমটা ধুয়ে-মুছে একদম ঝকঝকে তকতকে করে তোলা হয়েছে। নতুন বিছানার চাদর, দরজা-জানালায় পর্দা। মনে হচ্ছে তালাবদ্ধ ধুলোভর্তি সেই ঘরটা মুহূর্তেই নতুন রূপ পেয়েছে। পরী সেই সন্ধ্যে থেকে রুমটা গোছগাছ করে মাত্র বেরোল। দুপুরে ইচ্ছে ভিডিওকলে দিদুনের সাথে কথা বলার সময় আসার জন্য আবদার করে। একমাত্র নাতনির আবদার রাখতে নীহারিকা রাগ-ক্ষোভ একপাশে ঠেসে প্রীতির সাথে ফোনে স্বাভাবিক ভঙিতেই বলেন— আসার কথা। যদিও কেউ ভাবেনি প্রীতি সত্যিই আসবে। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে প্রীতি এসেছে।

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে মুখ আকাশের দিকে তোলা প্রীতির। এসেছে মাত্র ক’ঘণ্টা। সবার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ করার চেষ্টা করছে, তবু নীরবের সঙ্গে অল্পের জন্য বড়সড় ঝগড়া বাঁধা এড়ানো গেছে। এই তো সবাই যখন বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইচ্ছে দৌড়ে নীরবের কাছে এল। নীরব পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে রুম থেকে বেরোচ্ছিল। ইচ্ছে বলে,

-” পাপা, আমাকে সুন্দর লাগছে?”

ইচ্ছের গায়ে হুলুদ শাড়ি। একদম সর্ষেফুলের মতো ঝিকিমিকি করছে। নীরব গাল টেনে বলল,

-” প্রিটি গার্ল, তোমাকে অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। মাশা-আল্লাহ! মাশা-আল্লাহ!”

-” ছোটো দিদুন পড়িয়ে দিয়েছে।”

শাড়ির দুই কোণা আঙুলে ধরে হেলতে হেলতে বলল ইচ্ছে। তন্মধ্যে প্রীতির গলা এল,

-” ইচ্ছে?”

ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই প্রীতি কয়েক পা এগিয়ে এসে মেয়ের গালে আঙুল ঢলে বলল,

-” মুখে এসব কী লাগিয়েছো? এত সস্তা ফাউন্ডেশন, লিপগ্লস। এসব তোমার সফট স্কিনের জন্য ক্ষ*তি হবে তো।”

প্রীতির বলার ভঙি তাচ্ছিল্য মেশানো খোঁচা। নীরবের মুখাবয়বের পরিবর্তন হলেও উপরে উপরে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। ইচ্ছে মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

-” মাম্মা, আনিশা যাচ্ছে, সব্বাই যাচ্ছে, আমিও যাবো।”

-” আমি যাচ্ছি না।”

-” আমি যাই?”

প্রীতি ঠান্ডা অথচ দৃঢ় গলায় স্রেফ বলল,

-” না, এখন তুমি কোথাও যাচ্ছ না। আমি যাচ্ছি না, আর তোমাকে কারও সঙ্গে পাঠাবও না।”

প্রীতি এখন অবধি একবারো নীরবের দিকে তাকায়নি। পাশে কেউ আছে দেখেও দেখছে না এমন ভাবভঙ্গি নিয়ে আছে।‌ ওদিকে সবাই বেরোতে ব্যস্ত। প্রীতিকে উপেক্ষা করে সরাসরি বলল নীরব,

-” ইচ্ছে, চলো।”

প্রীতি সাথে সাথেই বিরোধীতা করে উঠল,

-” ইচ্ছে যাবে না।”

নীরব উত্তর না দিয়ে ইচ্ছের হাত ধরল,

-” চলো।”

প্রীতিকে বারবার উপেক্ষা করায় মেজাজের পারদ আকাশ ছুঁলো। প্রীতি গলাটা শক্ত করে কণ্ঠে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলল,

-” নীরব, তোমার যা ইচ্ছে তাই তোমার পরিবারের ওপর প্রয়োগ করো। ভুলেও আমাদের ক্ষেত্রে নয়। আমার আর আমার মেয়ের উপর তো নয়ই। শোনো, আমি যাচ্ছি না, তাই ইচ্ছেও যাবে না। আর একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো; নেহায়েৎ ইচ্ছের দিদুন আসার জন্য অত করে বললেন। রিকোয়েস্টটা ফেলতে না পেরে বাধ্য হয়ে এসেছি। ভুলেও ভাববে না, তোমার বিয়ে খেতে নিজ ইচ্ছায় এসেছি। না তো এক ফোঁটা ইচ্ছে ছিল এখানে আসার।”

এখন প্রীতির সাথে তর্কাতর্কি করে মুড ন’ষ্ট করতে চাইছে না নীরব। তারউপর বাড়ি ভর্তি লোকজন। শোভনীয়ও দেখায় না। এরমধ্যে নিভান সবাইকে তাড়া দিচ্ছে। নীরব সেদিকে তাকিয়ে ডাকল,

-” ভাইয়া?”

নিভান এগিয়ে আসতেই নীরব নির্লিপ্ত ভঙিতে বলল,

-” ভাইয়া ইচ্ছেকে নিয়ে যাও তো। আমার একটু কাজ আছে। আমার বোধহয় যেতে একটু দেরি হতে পারে।”

-” আচ্ছা।”

বলে নিভান হেসে ইচ্ছের গাল টিপে নিয়ে গেল। প্রীতি ভিতরে ভিতরে রাগে অজগরের মতো ফোঁসফোঁস করল। মূলত যে উদ্দেশ্যে এ বাড়ি আসা সেই লক্ষ্যে স্থির থাকতে প্রীতি চুপচাপ সয়ে নিল। নীরব এগিয়ে যেতে গিয়েও দু’পা ফিরল। উল্টোদিক হয়েই শুধু বলল,

-” মাত্রারিক্ত রাগ, বেহিসাবি জেদ আর ফুলে ওঠা ইগো। কাউকে শেষ করে দিতে যথেষ্ট। তুমি যে ব্যবহার হয়েছো, এন্ড হচ্ছো, সেটা বোঝার সামান্য বুদ্ধিটুকু, ক্ষমতাটুকু কি আছে তোমার? যাইহোক, নিজেকে শুধরে নেয়ার লাস্ট সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে। এখনো টাইম আছে নিজের মধ্যে চেঞ্জেস আনো। আনলে নিজেরই ভালো, নইলে___”

প্রীতি ফুঁসে ওঠে ঠোঁট চেপে বলল,

-” নইলে..?”

-” ধ্বংস অনিবার্য, যা খুব খুব সন্নিকটে।”

প্রীতি তাচ্ছিল্য হাসল। মনেমনেই বলল— নতুন করে ধ্বং*স হওয়ার তো কিচ্ছু নেই। ধ্বংস তো আজ থেকে ক’বছর আগেই হয়েছি।

তখনকার কথাগুলো মনে উঠতেই শুণ্যে তাকিয়ে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোল প্রীতির। মেজাজটাও তিরিক্ষি হয়ে আছে। ও বাড়ি যাওয়ার কথা অনেকে বললেও অসুস্থতার কথা বলে এড়িয়ে যায় প্রীতি। প্রীতির কথা রাখতে তানিয়া নীহারিকার সাথে নীবিড়ের চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলেন ফোনে। নীহারিকা একদম স্রেফ জানিয়ে দেন,

-” যেভাবেই হোক না কেনো ছেলে ওটা তো আপনাদেরকে দিয়েই দিয়েছিলাম। কোনো খোঁজখবর রাখিনি, অবশ্য ছেলেও রাখেনি। এখন অসুস্থ ছেলেকে মা কী করে ছাড়ে? সন্তান মা’কে পর করতে পারলেও মায়েরা পারে না। আর বলছেন সুস্থতার কথা, আল্লাহ ছেলের হায়াত দারাস করলে এদেশের চিকিৎসাতেও ভালো হবে। আমাদের যতটুকু সামর্থ্য আছে ততটুকু দিয়েই ছেলের চিকিৎসা করাব। শাশুড়ির টাকায় ছেলেকে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দরকার নেই। শুধু মন থেকে দোয়াটুকু চাই। এতটুকু হলেই চলবে।”

নীহারিকার কথাটা মনে পড়তেই মাথায় রাগ চিড়বিড় করে উঠল প্রীতির। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আওড়ালো—- কথায় আছে না কু’কু’রের পেটে ঘি মজে না। এরাও ঠিক তেমন। সবকিছু ভুলে যখন তাদের ছেলে সুস্থ হোক চাইলাম। মা’কে অবধি রাজি করালাম। সেখানেও বাঁধ সাধল ওই ভদ্রমহিলা। ভদ্রমহিলা আর ওনার ছোটো ছেলে দুইটাই আমার জীবনটাকে হেল বানিয়ে ছেড়েছে। উফ্! যাইহোক আপাতত এখানে যে কটা দিন আছি। এদের মন যুগিয়ে, বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। আর নীরব? প্রতিটি থা”প্প”ড়ের জবাব ভালোবাসার ফুল হয়ে যাবে না। ব*ন্দুকের গু*লি হয়েও ফিরতে পারে।

প্রীতি একটা ডায়েরি বের করল। কথাগুলো সেদিন ডায়েরিতে লিখেও রেখেছিল সে। আজ আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দিল গোটা গোটা অক্ষরে লেখাটার উপরে।

-” ভালোবাসা তো শখ নয়… শ্বাসের মতো। আমার ভালোবাসা থামবে মানে তোমার নিঃশ্বাস বন্ধ।”

-” পুরো দুনিয়া বলবে…..’আদার্স ওয়ান সাইড লাভ ইট’স ওকে। বাট প্রিয়স্মিতা খান প্রীতি ইজ ডিফারেন্ট।’

প্রীতির চোখদুটো ছলছল করে উঠল। বুকের ভেতরটা তুষের আ*গু*নের মতো জ্ব”ল”তে লাগল।

__________

ও বাড়ি থেকে হলুদের ডালা নিয়ে সবাই আসার খানিকক্ষণ পরে নীরবের আগমন ঘটে। নীরবের পা ছাদে পড়তেই নাহিদ গান পাল্টে “আইলারে নয়া দামান” গানটা চালু করে দেয়। নীরবের সাথে আবির ছিলো। আবির এগিয়ে এসে একগাল হেসে বলল,

-” নতুন ভাবি কী খবর? দেবরের কথা মনে-টনে আছে নাকি? সেদিন যে কড়া টাস্ক দিলে। হাফ টাইম তো পেরেছিলাম, সেই হাফ টাইমের জন্য হলেও কী হাফ কিছুমিছু পাওয়া যাবে?”

নীরব ভ্রুকুটি করে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির ঝটপট বলল,

-” আরে ছোটো দাদান দেবর ভাবীর মধ্যে কথা হচ্ছে, তুমি কান দিচ্ছো ক্যান? তুমি বুঝবে না। আমার আর ভাবীর মধ্যে ডিল হবে।”

নীরব ঠোঁট চেপে বলল,

-” গালের উপর একটা পড়লে বুঝতে পারবি, আমি বুঝব কী, বুঝব না।”

প্রত্যাশা তড়িঘড়ি বলল,

-” আরে আরে আপনি শুধু শুধু ওকে ক্যানো বকছেন। ঠিকই তো বলেছে আবির। দেবর-ভাবীর মধ্যেকার সিক্রেট কথাবার্তা। আপনি কেনো শুনবেন?”

পাশ থেকে একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা সেভেন আপের বোতল হাতে নিয়ে আবিরের দিকে বাড়িয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” যদিও বলতে আমার এক সমুদ্দুর কষ্ট হচ্ছে, তবুও বলতে যে হচ্ছে; হাফ কিছুমিছুর আশা ছেড়ে সেভেন আপ খাও দেবরজি।”

.

প্রত্যাশা আর নীরব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হলুদ সাজে সজ্জিত বউকে কোণা চোখে দেখতে ব্যস্ত নীরব। হলুদ সাজে প্রত্যাশাকে মোহনীয় লাগছে। নীরবের পলক নড়ছে না। নীরবের গায়ে শুভ্ররঙা পাঞ্জাবী, উপরে কারুকার্য করা হলুদ কোটি। সাদা পাঞ্জাবিতে স্নিগ্ধ আর আকর্ষণীয় লাগছে নীরবকে। দু’জন যখন দু’জনের দিকে তাকিয়ে ঠিক তক্ষুনি নাহিদ ফা’জ’লা’মি করে গান পাল্টে ফেরদৌস, শাবনূরের সেই বিখ্যাত গান ছেড়ে দেয়। বেজে উঠল,

-” আসসালামুলাইকুম বেয়াইনসাব, ওয়ালাইকুম আসসালাম বেয়াই সাব। কেমন আছেন বেয়াইন সাব?”

এতটুকু বাজতেই প্রত্যাশা একহাতে মুখ চেপে ধরে হাসতে লাগল। নীরবও বোধহয় একটু অপ্রস্তুত হলো। প্রত্যাশা হাসি সামলে বলল,

-” আমার ফ্রেন্ডরা ফা’জ’লামি করে বাজাচ্ছে।”

-” বুঝতে পেরেছি। তোমার এখন কী অবস্থা বলো? আর বমি হয়নি তো? এখন কেমন ফিল করছো?”

-” নাহ আর বমি হয়নি। এখন বেটার ফিল করছি। আপাতত কোনো সমস্যা নেই।”

-” গুড।”

এরমধ্যে “শুভ হলুদ” লেখা হলুদের জন্য আনা কেকটা স্টেজে রাখা হয়। নীলা এসে ডাকল,

-” নীরব এসো কেকটা কাটতে হবে। তারপর ফটোশুটও তো বাকি। ওদিকে মা বারবার ফোন দিচ্ছেন। বেশি দেরি করতে বারণ করেছেন। তাড়াতাড়ি যাতে তোমাদেরকে ছাড়ি।”

নীরব মাথাটা কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে বলল,

-” শিওর।”

আবিরের গলায় ক্যামেরা। একের পর এক ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ছবি তুলছে সে। নীরব-প্রত্যাশা কেক কা”টে। দু’জন দু’জনের গালে দেয় সেই দৃশ্যও ক্যামেরায় বন্দি করা হয়। হলুদের গিফট হিসেবে নীরব পাঞ্জাবির পকেট থেকে রিং বক্স বের করে। আজ নীরব আসবে সেই হিসেবে এদিক থেকেও প্রস্তুতি নেয়া ছিলো।

ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে প্রত্যাশার বাম হাতটা আলতো করে ধরে নীরব। তারপর আলগোছে স্বর্ণের ডিজাইন করা রিং প্রত্যাশার অনামিকায় পড়িয়ে দেয়। নীলা বক্স খুলে প্রত্যাশার দিকে ধরে। প্রত্যাশা রিং নিয়ে নীরবের আঙুলে পড়িয়ে দেয়। তারপর কিছুক্ষণ ফটোশুট চলে।

কোয়েল হলুদের বাটি এগিয়ে বলল,

-” জিজু আপনার বউয়ের গালে ছুঁইয়ে দিন।”

নীরব সময় নিচ্ছিল। আবির তাগাদা দিল,

-” আরে ছোট দাদান তাড়াতাড়ি করো, এদিকে ক্যামেরা হাতে আমার হাত লেগে এলো।”

নীরব ইতস্তত বোধ নিয়েই দুই আঙুলে হলুদের প্রলেপ নেয়। আলতোভাবে প্রত্যাশার ডানগালে তারপর বাম গালে ছুঁইয়ে দেয়। লজ্জায় প্রত্যাশার চোখের পলক নুইয়ে যায়।

.
.

হালকা মিউজিক বাজছে, কেউ মগ্ন আড্ডায়, কেউবা নাস্তায় ব্যস্ত। প্রত্যাশা-নীরব একপাশে। পাঞ্জাবির কলার একটু সরিয়ে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিল নীরব। প্রত্যাশার দিকে চেয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে মৃদুস্বরে বলল নীরব,

-” উমম! গরম লাগছে, সাথে তেষ্টাও পেয়েছে। আমি নিচে যাচ্ছি। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো জলদি।”

প্রত্যাশার দৃষ্টি গেল খানিকটা দূরের টেবিলে। ঝটপট বলল,

-” ওই তো টেবিলেই শরবত রাখা আছে। একটু ওয়েট করুন…. আমি আনছি।”

নীরব ভ্রু কুঁচকে বিরক্তির সঙ্গে বলল,

-” এখানে গরম লাগছে। রুমে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসব।”

চারদিকে স্ট্যান্ড ফ্যান ঘুরছে। অতটাও গরম লাগার কথা নয়। প্রত্যাশা সরল মনে বলল,

-” এমা গরম লাগছে আপনার! চলুন ওপাশে ফ্যানের সামনে বসবেন। নয়তো আমি এক্ষুনি কাউকে বলছি, এখানে আরেকটা ফ্যান সেট করতে। ছোটো মামাকে ডাকছি। ওয়েট..”

নীরবের মে’জা’জ চটল। এতটা অবুঝ বউ হলে হয়? বলল চিবিয়ে চিবিয়ে,

-” এই তুমি কিছু বোঝো না? নাকি সবসময় না বোঝার অ্যাক্টিং করো?”

আর বাড়তি কথা না বলে নীরব বিরক্তির শ্বাস ফেলে গটগট করে নিচে নামে। কয়েক মূহুর্ত পর প্রত্যাশা উপায়ান্তর না দেখে পিছুপিছু নামল। ফ্রিজ থেকে বোতল বের করে ঠান্ডা পানির গ্লাস নিয়ে রুমে গেল। নীরবের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলল,

-” নিন পানি।”

নীরবের হাসি পেল। মেপে স্বল্প হাসল। প্রত্যাশার গ্লাস ধরা হাতের উপর হাত রেখে গ্লাসটা মুখের সামনে নিল। এক ঢোক নিয়ে তারপর গ্লাস নামাল। পরপর আচমকা একহাতে প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে কাছে আনল। প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,

-” মাত্র তো এক ঢোক খেলেন। এমন করে বললেন…মনে হলো এক সমুদ্দুর পিপাসা পেয়েছে। শুধু শুধু রাগ দেখালেন।”

ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে বলল নীরব,

-” হ্যাঁ, এক সমুদ্দুরই পিপাসা পেয়েছে। তবে পানির নয়, অন্যকিছুর‌।”

এই বলে নীরব অন্য হাতে পকেট থেকে বসুন্ধরা সুগন্ধযুক্ত টিস্যু বের করল। মুচকি হেসে প্রত্যাশার ঠোঁটে আলতো করে ঘষল। প্রত্যাশা হইহই করে উঠল,

-” এই এই কী করছেন?”

-” লিপিষ্টিক বেশি গাঢ় হয়েছে। এতটা গাঢ় হলে অন্যের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষ*তিক*র।”

-” আরে আ…”

প্রত্যাশার কথা থেমে গেল। নিজেকে নীরবের খুব কাছে আবিষ্কার করল। একটানে দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবায় নীরব। প্রত্যাশার চোখদুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ছাড়া পেয়েই প্রত্যাশা শ্বাস টেনে নিল। নীরব হাতের উল্টো পাশ দিয়ে ঠোঁট মুছল। প্রত্যাশা বাঁকা চোখে চেয়ে বলল,

-” বাহ! লিপস্টিকটা আপনি এমনভাবে মুছলেন, যেন ঠোঁটটা আপনার ব্যক্তিগত হোয়াইটবোর্ড!”

-” ভুল কিছু বলোনি। ব্যক্তিগতই। তুমি পুরোটাই আমার ব্যক্তিগত।”

প্রত্যাশা কোনো কথা কানে না ঢুকিয়ে আফসোস করে বলল,

-” ধূর দিলেন তো লিপিস্টিকটা ন’ষ্ট করে।”

বৃদ্ধা আঙুল প্রত্যাশার ঠোঁটে ছুঁইয়ে মুচকি হেসে বলল নীরব,

-” তোমার ঠোঁটে লিপস্টিকের রং না থাকলেও, আমার স্পর্শ তো রইল।”

প্রত্যাশা অল্প-স্বল্প মেকি রাগ করে তাকাল। প্রত্যাশার নাকে আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে নীরব আরেকটু ঝুঁকে প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশার গালের সাথে গাল ছুঁইয়ে গেল। খোঁচাখোঁচা দাঁড়ি সফট গালে শিরশিরানি বয়ে দিল। প্রত্যাশার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। নীরব মুখটা প্রত্যাশার কানের পাশে টেনে ফিসফিসিয়ে বলল,

-” পানসে মুখে কী করে যাই বলো? তাই হালকা একটু মিষ্টি মুখ করেই যাচ্ছি। আসছি, ফ্রেশ হয়ে আজ পর্যাপ্ত ঘুম দেবে। রাত জাগবে না, বুঝেছো? আগামীকালকের ঘুমটাও আজ পুষিয়ে নিবে। বাই।”

লাজে প্রত্যাশা চোখ নামিয়ে নিল। নীরব বউকে আর লজ্জা না দিয়ে বেরিয়ে যেতে নেয়। প্রত্যাশা হঠাৎ তড়িঘড়ি ব্যস্ত হয়ে বলল,

-” শুনুন?”

নীরব ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল। প্রত্যাশা নিজের গালে আঙুল ধরে ইশারা করে বলল,

-” আপনার গালে হলুদ লেগেছে। আমার গাল থেকে গিয়েছে। মুছে নিন।”

প্রত্যাশাকে অবাক করে নীরব বলল,

-” নো প্রব্লেম। থাকুক।”

_________

নীরব অধরার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। প্রত্যাশা রুম থেকে পানির গ্লাস হাতে বেরোতেই অধরা শুধালেন,

-” নীরবকে নাস্তা দিয়েছিলি? উপরে নাস্তা করেছিল? চলে গেল যে?”

-” নাস্তা করেনি তো। পানি চাইলো।”

অধরা মেয়ের উপর রাগঢাক করে বললেন,

-” তোকে নিয়ে আর পারি না। পানি চেয়েছে ঢ্যাঙঢ্যাঙ করে শুধু পানি নিয়ে দিয়েছিস। সাথে নাস্তা দিসনি ক্যানো? উপরে সবার মাঝে হয়তো লজ্জায় বসেনি। রুমে দিতে পারতি। কবে যে তোর বুদ্ধি শুদ্ধি হবে?”

প্রত্যাশা বিড়বিড় করে বলে—- ধূর! আম্মুকে কী বলি? তার জামাইয়ের পানিটানি কিছুই পিপাসা পায়নি।

-” আর নীলা কই? আত্মীয়-স্বজন সবাই ঠিকঠাক খেলো কী না ও একটু দেখবে না। কোথায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে ও? আমি একা কতদিক দেখব। ওই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না।”

অধরা প্যাঁচাল পারতে পারতে ওদিকে গেলেন। এরমধ্যে প্রত্যাশা সিঁড়িতে পা রাখবে তখুনি নিভানের গলা এলো,

-” প্রত্যাশা?”

-” হুঁ?”

প্রত্যাশা ঘুরে নিভানকে দেখে মুখে হাসি টেনে বলল,

-” জিজু কিছু দরকার?”

-” তোমার আপু কই?”

-” আপু? কী জানি? আমি তো এতক্ষণ রুমে ছিলাম। নিচে আপুকে দেখছি না উপরে আছে হয়তো।”

-” নীলাকে একটু পাঠিয়ে দাও তো। এক গ্লাস পানি আনতে বলো।”

পানির কথা শুনে আচমকা প্রত্যাশার বেষম খাওয়ার যোগাড় হলো। চোখ বড়বড় করে বলল,

-” পানি?”

-” হ্যাঁ একটু জলদি আনতে বলো।”

প্রত্যাশা শুকনো ঢোক গিলে বিড়বিড় করে —- লে বাবা, এদের ভাইদের দেখছি একই অবস্থা। বউকে দেখলেই ইস্ক উঠে গলা শুকিয়ে যায়। পানির অজুহাতে স্বার্থ হাসিল করা। তবে কি এএসপি সাহেবের মতো জিজুরও এখন সেইম প্রয়োজনে পানি চাই, থুক্কু চুমু চাই।

প্রত্যাশা নিজেকে তটস্থ করে বলল ফট করে,

-” রিল্যাক্স জিজু, আপনি রুমে গিয়ে বসুন। আমি এক্ষুনি আপুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

-” থ্যাংকিউ। আসলে ইচ্ছের ঝাল লেগেছে। ইচ্ছে ঝাল খেতে পারে না আমি জানতাম না। রুমে দেখছি পানি নেই।”

শেষ কথাগুলো শুনে প্রত্যাশা দাঁত দিয়ে জিভ কা”টে। এইরে সে কীসব ভাবছিল! ভেতরে ভেতরে লজ্জায় পড়ল। দ্রুত উপরে এসে আপুকে নিচে পাঠিয়ে দিল।

.
.

ঘড়ির কাঁটা ঠিকঠিক রাত এগারোটার ঘরে। প্রত্যাশা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কানে এয়ারপড গুঁজে নীরবের সাথে কথা বলছে। চারিদিকে হৈচৈ তো আছেই বান্ধবী দুটোর জন্য ব্যালকনিতে আসছে কথা বলতে। ওরা যা পাজি। সবসময় জ্বালিয়ে মা*রছে। প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,

-” কী করছেন?”

-” ছাদে বসে আছি।”

-” একলা?”

-” হুম। ভেতরে লোকজনের কোলাহল। বিরক্ত লাগছিল।”

-” ওহ্।”

-” আমি তো সময় কাউন্ট করছি। তবে সেকেন্ডগুলোকে আমার কাছে ঘণ্টা মনে হচ্ছে।”

প্রত্যাশা বিনিময় শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,

-” এতটা অধৈর্য হলেন কবে থেকে?”

-” শুরু থেকেই অধৈর্য। তবে তুমি ছোট ছিলে বলে, ছাড় দিয়ে এসেছি।”

-” তাই বুঝি?”

-” হুঁম।”

প্রত্যাশা আকস্মিক চঞ্চল গলায় বলে উঠল,

-” এএসপি সাহেব জানেন?”

-” না বললে জানব কীকরে?”

-” আমার না টুইনস বেবির খুব শখ। আমি অলরেডি ছেলে মেয়ের নামধাম ঠিক করে ফেলেছি। আমাদের ছেলে হলে নাম রাখব ‘নীড়’ আর মেয়ে হলে ‘প্রাপ্তি’ উফ্! দারুণ হবে না? টুইনস হলে একবারেই সব কষ্ট, ঝামেলা চুকে যাবে।”

নীরব নিঃশব্দে হাসল। বলল,

-” সবই ঠিক আছে। নীড়-প্রাপ্তি একসাথে না এসে আলাদা-আলাদা আসলেও প্রব্লেম নেই। তবে এক্ষুনি বেবি প্লানিং করছি না। আরো পাঁচ বছর পর।”

প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,

-” উঁহু।”

নীরব নরম-কোমল স্বরে বলল,

-” মাই লাভ তুমি এখনো ছোটো ইমম্যাচিউর। তোমাকে সামলাতেই আমি হিমশিম খাচ্ছি।”

প্রত্যাশা দুইহাত বুকে ভাঁজ করে বলল,

-” শুনুন আপনি বলছেন আমি ছোটো! তাহলে ছোট আমিটার কাছে আপনি ঘেঁষতে পারবেন না। ঠিক পাঁচ
বছর পরেই আমাকে ছোঁবেন। এর একদিন আগেও নয়, হুঁ। মনে থাকে যেনো?”

-” তাহলে তো ধৈর্য্যর উপর আমাকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করতে হবে।”

প্রত্যাশার হাসি চওড়া হলো। কিছু বলবে তার আগেই হুড়মুড় করে দুইটা হাজির হলো। অগত্যা ব্যস্ত হয়ে কল রাখল প্রত্যাশা।

____________

বিয়ের হলটা ঝকঝকে আলোয় আলোকিত। চারিদিকে রুচিশীল আভিজাত্যের ছোঁয়া চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। পুরো হল খুবই সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। চারিদিকে অনেক লোকজনের ভিড়। বরপক্ষ, কনেপক্ষ সবাই উপস্থিত। দোতলা থেকে প্রত্যাশা সিঁড়ি ভেঙে ধীরেধীরে নেমে আসছে। পাশে দুই বান্ধবী। ওদের পরনে লেহেঙ্গা, ভারী সাজগোজ। আশেপাশে আরো অনেকেই আছে। নীরব ফ্রেন্ডদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। গায়ে সাদা শেরোয়ানি, গলার কাছে সোনালী সুতোয় সুক্ষ্ম কারুকাজ করা। মাথায় সোনালী রঙের পাগড়ি। হঠাৎ নজর গেল সিঁড়ির দিকে। প্রত্যাশার গায়ে লাল-খয়েরি বিয়ের ভারী শাড়ি। মাথায় ইয়াবড় ঘোমটা। ঘোমটার আড়ালের মুখটা নীরব কল্পনা করল এক সেকেন্ড।

প্রত্যাশা ঘোমটার আড়াল থেকেই আবছা নীরবকে দেখল একপল। বর বেশে এএসপি সাহেবকে হ্যান্ডসাম লাগছে খুব। কিছু একটা ফেসে আলাদা লাগল। ও হ্যাঁ, ক্লিন শেভ করেছে। তবে মন্দ লাগছে না। ভালোই লাগছে। প্রত্যাশার ধ্যান ছুটল। কোয়েলের কথায়। কোয়েল বলল,

-” জিজু এখুনি বউয়ের মুখ দেখা বারণ আছে। আগে বিয়ে হবে, তারপর শালিকাদের ডিমান্ড পূরণ করে, দেন বউয়ের ঘোমটা সরাবেন।”

নীরব বিনিময় মৃদু হাসল।‌ অতঃপর প্রত্যাশার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,

-” চলো।”

চুড়ি পরা হাতটা নাড়াতেই টুং টুং ঝনঝন শব্দ হলো। প্রত্যাশা হাতের উপর হাত রাখতেই লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে আলগোছে আঁকড়ে ধরল নীরব। পরপর দু’জনে স্টেজে বসল।

লাল ভেলভেট ঢাকা টেবিলের ওপর রাখা রেজিস্ট্রার খাতা। পাশে রাখা কলমটা আলাদা নজর কাড়ছে। সোনালি গায়ে ময়ূরের খোদাই, লেজের পালক রঙিন পাথরে সাজানো। কলমটা হাতে নিলে মনে হয় যেন রাজকীয় কিছুতে সই করা হবে। নীরব মনোযোগ দিয়ে সুন্দর করে সই করল। দৃঢ় অথচ শান্ত হাসি নিয়ে সই শেষ করে কলমটা বাড়িয়ে দেয় প্রত্যাশার দিকে। প্রত্যাশা সোনালি গহনার ভারে নত, মাথায় বড় করে টানা ঘোমটার নিচে তার চোখ শুধু একটু উঁকি দিল। কোয়েল টিপ্পনি কে”টে বলল,

-” আস্তে কর। তাড়াহুড়ো নেই।”

প্রত্যাশার হাতটা মৃদু কাঁপল। নীরবের সইয়ের পাশাপাশি গোটাগোটা অক্ষরে সময় নিয়ে সই করল। সই শেষ হতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ পড়ল।

কোয়েলদের দাবি মেনে পনেরো হাজার টাকা ঘু*ষ দিয়ে বউয়ের ঘোমটা তোলার সুযোগ পায় নীরব। চারিদিকে লাইট ক্যামেরা অ্যাকশনের মতো অবস্থা। সবাই মুখিয়ে আছে। নীরব দুই হাতে প্রত্যাশার মুখের ঘোমটা আস্তে করে সরিয়ে দেয়। প্রত্যাশার থুতনি চিবুক ছুঁয়ে আছে। প্রত্যাশা ধীরেধীরে চোখের ঘন পল্লব তুলে তাকাতেই দুই জোড়া চোখে নীরব-প্রত্যাশার প্রকাশ্য দৃষ্টি মিলল। চোখে গাঢ় কাজলের টান, ঠোঁটে গাঢ় রঙ; যেন যত্নে আঁকা এক নিখুঁত ছবি। নীরবের ঠোঁটে মৃদু হাসি, চোখে এক ঝলক প্রশংসার দৃষ্টি নিয়ে অস্ফুটে বলল,

-” মাশা-আল্লাহ! আজ তো সত্যিই চোখ ফেরানো দায়।”

প্রত্যাশার গাল লাল হয়ে ওঠে, ঝট করে চোখ নামিয়ে ফেলে। গহনার নরম ঝনঝন শব্দে ওর লজ্জা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

___________

বিয়ের ভেন‌্যুতে না আসলে আবার কথার সৃষ্টি হতো, অগত্যা প্রীতিকে আসতে হয়েছে। এতটা সময় নিচে থাকলেও ভালো লাগছিল না। মনটা বিক্ষিপ্ত। দোতলায় করিডোর দিয়ে হাঁটছিল বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে। হঠাৎ আচমকা কটা কথা কানে আসে,

-” মেয়েটাকে পেলে পুষে মানুষ করেছিস, বিয়ে দিয়েছিস ভালো কথা। বিয়ে আগেই হইছে, এখন আবার বেহুদা এত্তগুলান টাকা পয়সা খরচা করে রংঢং করে অনুষ্ঠান করা লাগবো ক্যান? তোর ছেলে নেই। একটা মাত্র মাইয়া, শেষ বয়সে তোরা কী খাবি? সে হুঁশ আছেনি? খাইয়ে-দাইয়ে কাজকাম নাই, বেহুদা এত বড় অনুষ্ঠান করে মানুষ খাওয়াতে গেলি। বিয়ে হয়েছে বালাই গেছে। ভালো ঘর পায়ছে, ভালো জামাই পায়ছে সেইডা তারছিড়া মাইয়ার কপাল ভালো।”

#চলবে