মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
2

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪১|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

প্রীতির মাথার মধ্যে বলের মতো ঢপ পারছে কয়েকটা কথা। ভাবছে বারংবার— প্রত্যাশা ওনাদের নিজের মেয়ে নয়? তাহলে প্রত্যাশার আসল পরিচয়? আর এটা কী সবাই জানে? নীরব? নীরবের পরিবার?

বৃদ্ধা মহিলার গলা স্পষ্ট শোনে প্রীতি। অধরা অবশ্য তখনিই মহিলাকে থামিয়ে দিয়ে রাগঢাক করেন। এতে সুচতুর প্রীতির সন্দেহ তীব্র হয়। তারমানে —- এই চরম সত্যিটা আসলে সকলে জানে না।

আঙুলের খাঁজে আঙুল গুঁজে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে প্রীতি একমনে ভাবতে থাকে; যদি সত্যিই নীরবের ফ্যামেলি না জেনে থাকে, তাহলে জানার পর রিঅ্যাকশন কেমন হবে? এতবড় একটা বিষয় আড়াল করে বিয়ে দেয়া মানে তো ঠকানো। বিশেষ করে শাশুড়ি মা সমন্ধে একটু হলেও জানে প্রীতি। ঠকানোর দায়ে শাশুড়ি মা কী কোনো স্টেপই নিবে না? চাল চুলোহীন, না জানি কোন নিচু পরিবার, নিচু মানুষের র*ক্ত। এমন একটা মেয়েকে আদরের ছোট ছেলের বউ হিসেবে কস্মিনকালেও নীহারিকা মানতে চাইবেন না। এটা ভাবতেই প্রীতির মনে পৈ’শা’চি’ক আনন্দ অনুভব হয়।

ওদিকে বিদায় মূহুর্ত ঘনিয়ে এসেছে। প্রীতি ঠোঁট চেপে ভাবতে থাকে কী করবে? এক্ষুনি সবাইকে জানিয়ে দিবে?

নিজের মাথায় অদৃশ্য হাতে চাটি মা*রে প্রীতি। নিজেকে আশ্বস্ত করে ভাবল— রিল্যাক্স প্রীতি, রিল্যাক্স। সবুরে মেওয়া ফলে। এত অধৈর্য হলে চলে? এটাই সুবর্ণ সুযোগ। আগে শাশুড়ি মায়ের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। ওনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। তারপর সময়-সুযোগ মতো যা করার করতে হবে। আর প্রত্যাশা? তোমার মতো একটা থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য নীরব আমাকে চ’ড় মে*রে*ছে না। তখন খুব উপভোগ করেছিলে বুঝি? সবকিছু সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয়া হবে।

___________

চারদিকের হাসি-আনন্দ ক্ষীণ হয়ে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ। শফিক সাহেব ধীরপায়ে এগিয়ে এসে প্রত্যাশার হাত ধরে নীরবের হাতে তুলে দিলেন। কণ্ঠ ভেজা হলেও দৃঢ়ভাবে বললেন,

-” মেয়েটা আমার একটু বেশিই অবুঝ বাবা। তোমার হাতে তুলে দিলাম। ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব তোমার। যত সমস্যা, দুঃখ-কষ্টই আসুক, মেয়েটাকে যেন কখনো একা মনে না হয়। সবসময় পাশে থেকো।”

নীরব মাথাটা কিঞ্চিৎ নুইয়ে নম্রস্বরে আশ্বস্ত করতে উত্তর দিল,

-” আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বাবা। প্রত্যাশাকে নিয়ে কোন টেনশন করবেন না। আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে সর্বদা চেষ্টা করবো ওকে ভালো রাখার।”

-” তোমার উপর আমার বিশ্বাস ভরসা আছে বাবা। তবুও অবুঝ মেয়েটাকে নিয়ে একটু বাড়তি চিন্তা হয়।”

প্রত্যাশার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। এতক্ষণের আঁটকে রাখা কান্না বাঁধ ভাঙার যোগাড় হলো। আর হতেই প্রত্যাশা আর সামলাতে পারল না। বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। শফিক সাহেবের চোখ ভিজে উঠল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

-” কাঁদে না মা আমার। কান্না করলে মাথা ধরবে। তারপর তোমার আম্মুর আমার বেশি খা’রাপ লাগবে যে।”

প্রত্যাশার কানে কোনো কথাই ঢুকছে না। মনে হচ্ছে সব বুঝি পর করে চলে যাচ্ছে। হৃদয়টা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে কষ্টে। বাবার কাছে যত আবদার আহ্লাদ ছিলো তা বুঝি আর আগের মতো রাখা হবে না। বিয়ে শব্দটাই মেয়েদেরকে কেমন বাবার বাড়ি থেকে পর করে দেয়। প্রত্যাশা বাবার পিঠের পাঞ্জাবী খামচে ধরে বুকে মুখ গুঁজে শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

-” আব্বু আমি কোথাও যাব না।”

নীরব ভ্যাবাচ্যাকা খেল। সব তো ঠিকঠাকই ছিলো। হঠাৎ বিদায়ের সময় কী হলো? বন্ধু বান্ধব, কলিগরা ভাববে— বউ মনেহয় বিয়েতে রাজি ছিলো না। না হলে এত ম*রা কান্না কেউ করে? আবার হেঁচকি তুলে ডিরেক্ট বলে— ‘আব্বু আমি কোথাও যাব না।’

নীলার পাশে দাঁড়িয়ে নিভান ফিসফিসিয়ে বলল,

-” আরে তোমার বোনকে একটু বোঝাও। আমার বেচারা ছোট ভাইটার ফেস দেখে বোঝা যাচ্ছে সে টেনশনে পড়েছে। যে সে টেনশন নয়, মহা টেনশনে।”

নীলা ঝারি মে’রে বলল,

-” বাদ দাও তো। ওর ঢং।”

চোখের পানিতে শফিক সাহেবের পাঞ্জাবি ভিজিয়ে ফেলল প্রত্যাশা। মাহবুব সাহেব এগিয়ে এসে বললেন,

-” প্রত্যাশা মা কাঁদে না। তুমি যদি এভাবে কাঁদো তোমার বাবা-মায়ের বেশি খা’রাপ লাগবে। তাদের কথা একবার ভাবো। আর মা তোমার যখন মন চায় তুমি বাবা-মায়ের কাছে আসবে যাবে। নীরব নিয়ে যাবে, কোনো অসুবিধা হবে না। তাছাড়া দূরত্বও তো বেশি নয়। এতে মন খা’রা’প করার কিছু নেই মা। নীলাশা আছে, দুইবোন একসাথে মিলেমিশে থাকবে। তুমি তো হেসে হেসে যাবে, যা দেখে তোমার বাবা মায়ের ভালো লাগবে।”

অধরা কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ প্রায়। অবুঝ, সরল বাচ্চা মেয়েটাকে শ্বশুড় বাড়ি পাঠাতে একটু বেশিই কষ্ট হচ্ছে। অধরাকে সামনে আনতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল। মা-মেয়ে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। বড় মামা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,

-” থাম তোরা। ওদিকে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে। আর এত কান্নাকাটির কী আছে। কালকেই তো আবার ফিরনি আসবে।”

মামী এসে প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে বললেন,

-” আচ্ছা, এবার থামো। আর দেরি করো না। মুরুব্বীরা তাড়া দিচ্ছেন।”

_________

বাড়ির খানিকটা আগ থেকে রাস্তার দুইধার সজ্জিত করা। দু’পাশে রঙিন আলো, ফুলের সাজ, টিপটপ পরিবেশ। টিপটপ বাতিগুলো সাজানো স্বপ্নের মতো ঝলমল করছে। মেইন ফটক রাজকীয় ভাবে সাজানো। মেইন গেইট পেরিয়ে গাড়ি নীরবদের আলোকসজ্জিত বাড়ির ঠিক সামনে থামল। গাড়িতে নীরব একটাও কথা বলেনি প্রত্যাশার সাথে। প্রত্যাশা এখনো নাক টেনে যাচ্ছে। নীরব পকেট থেকে টিস্যু বের করে বাড়িয়ে দিল। না তাকিয়ে বলল,

-” গাড়ি ঘোরাতে বলব?”

-” ম-মানে?”

-” তোমাকে রেখে আসি। তুমি তো আর নিজ ইচ্ছায় আসতে চাওনি। জোর করে তুলে দেয়া হয়েছে। তাই ভাবছি রেখে আসি।”

প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বিড়বিড় করল— শ্বশুর বাড়িতে আবার নিজ ইচ্ছায় কেউ আসে নাকি।

নীরব ভ্রুকুটি করে শুধাল,

-” কী বলো, রেখে আসব?”

প্রত্যাশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

-” আপনার তো আর বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে হয়নি। তাই আপনি আমাদের মেয়েদের কষ্টটা বুঝবেন না। এটা শুধু মেয়েরাই জানে, হুঁ।”

বাড়িতে বড়রা ছিলেন। ছোটরাও দৌড়ে গিয়ে জড় হয়। ড্রাইভার গাড়ির গেট খুলে দিতেই নীরব নামতে নেয়। শর্মিলা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন,

-” এই নীরব একটু বস। একসাথে নামতে হবে। দাঁড়া ভাবী আসছে, মিষ্টি মুখ করাতে হবে আগে।”

নীরব বিরক্ত স্বরে বলল,

-” এত রিচুয়াল।”

শর্মিলা একগাল হেসে বললেন,

-” তুই বিরক্ত হোস জন্য তো অনেক রিচুয়ালই বাদ দেয়া হয়েছে। এটুকু কোনো ব্যাপার না।”

নীহারিকা এগিয়ে আসলেন। কাঁটা চামচে এক টুকরো মিষ্টি তুলে ছেলের সামনে ধরলেন,

-” হা কর বাবা।”

নীরব মুখে নিতেই পরপর প্রত্যাশার দিকে মিষ্টি বাড়িয়ে বললেন,

-” প্রত্যাশা নাও।”

প্রত্যাশা অল্প করে একটু নেয়। নীহারিকা আরেকটু সাধতেই প্রত্যাশা মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। নীহারিকা প্রত্যাশার হাতে সালামি দিয়ে নরম গলায় বলল,

-” প্রত্যাশা মা, এ বাড়িটা তোমারও বাড়ি। যেদিন থেকে আমার নীরবের বউ হয়েছো, সেদিন থেকেই এ বাড়ির সম্মান তুমি। তোমার সাথে আমার ছেলের, আমার বাড়ির মানসম্মান জড়িয়ে আছে। নিজের সম্মান, বাড়ির সম্মান কীভাবে রক্ষা করে চলতে হয় আশাকরি এতটুকু বোধবুদ্ধি নিয়ে চলবে। আমার দিন তো ফুরিয়ে আসছে, তোমরা সংসারটাকে যত্ন করে, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। আশাকরি সময়ের সাথে সাথে সব শিখে পড়ে যাবে। শুধু মন থেকে শেখার চেষ্টাটুকু রাখবে।”

এক সেকেন্ড থেমে ফের বললেন,

-” শাশুড়ি-শ্বশুর বলে কিছু নেই, আমরা সবাই তোমার আপনজন। তবে একটা কথা মনে রেখো, সংসার মানেই মান-অভিমান, টানাপোড়েন। এসব কিছু থাকবেই। সবকিছু বুদ্ধি আর ধৈর্য দিয়ে সামলাতে হয়। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, সুখে থেকো, আমার কলিজার টুকরো ছেলেকে সুখে রেখো। তোমাদের জীবন অনাবিল সুখ প্রশান্তিতে ভরপুর থাকুক।”

দৃষ্টি নুইয়ে প্রত্যাশা কলের পুতুলের মতন চুপচাপ সবটা শুনল।‌ আরো দুএকজন মিষ্টি মুখ করানোর পর বর-বউ একসাথে ভেতরে ঢোকে। দুইপাশ থেকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে ওয়েলকাম জানানো হয়।

.
.

চারিদিকে লোকজনের কোলাহলে প্রীতির বিরক্ত লাগছিল। ও রুমে যাচ্ছিল এমন সময় আবির সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে কস টেপ আর কাঁচি। ব্যস্ত স্বরে বলল,

-” এইযে মেঝো ভাবী, তোমাকেই খুঁজছি?”

প্রীতি কিছুটা অবাক স্বরে বলল,

-” আমাকে? কিন্তু কেনো?”

-” ছোট দাদানের রুমে চলো। একটু হেল্প লাগবে। এখনো বাসরঘর সাজানো কমপ্লিট হয়নি। এদিকে নতুন ভাবি ড্রয়িংরুমে বসে আছে। ছোট দাদান রাগ করছে, ভাবি ফ্রেশ হবে। দ্রুত রুম ছাড়তে বলছে আমাদের। তুমি একটু হাতে হাতে সাহায্য করবে?”

সেকেন্ডের মধ্যেই প্রীতির মেজাজের পারদ আকাশ ছুঁলো।‌ রাগে হিসহিস করল। তবে বাইরে প্রকাশ না করে স্রেফ বলে দিল,

-” আমার কাজ আছে, আমি পারব না।”

আবির নাছোড়বান্দার মতো বলে,

-” আরে তোমারই তো দেবরের বাসরঘর, তোমারও তো একটা দায়িত্ব আছে। যাও বেশি কিছু না তুমি অনেক লম্বা আছো, শুধু অর্কিডগুলো দেয়ালে সেট করে দিবে।”

প্রীতি কাটকাট গলায় বলল,

-” আমার মাথা ধরেছে। আই নিড রেস্ট। নীলাশাকে ডেকে নাও।”

নীহারিকা এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থেমে গিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন,

-” নীলাশা এ বাড়ির বড় বউ। বয়সে তোমার ছোট হলেও সম্মানে বড়। আশাকরি এরপর থেকে সেভাবে সম্মান দিয়ে কথা বলবে।”

শর্মিলা হাসি মুখে বলল,

-” প্রীতি যাও না, নীলাশাও যাচ্ছে। দেবরের বিয়েতে ভাবিরা এসব ব্যাপারে একটু কাজ করবে এটাই স্বাভাবিক।”

প্রীতির ফর্সা মুখে অমাবস্যা নামল। উপায়ান্তর না পেয়ে অগত্যা গেল।

__________

শাওয়ার নিয়ে ভেজা চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করতে করতে ব্যস্ত হয়ে নীরব ড্রয়িংরুম দিয়ে বাইরে যাচ্ছিল। প্রত্যাশা ড্রয়িংরুমে বসে, পাশে জয়নব আরাও আছেন। এতক্ষণ আত্মীয়-স্বজন বউকে ঘিরে রেখেছিল। এবারে অবশ্য একটু ভিড় কমেছে। বুড়িটার কথায় প্রত্যাশা খুব বি’র’ক্ত হচ্ছে। নীরবকে দেখে প্রত্যাশা তড়িঘড়ি ডেকে উঠল,

-” নীরব?”

নীরব সাথে সাথেই ফিরে তাকিয়ে ভ্রু নাড়িয়ে ইশারায় প্রত্যুত্তর দেয়। প্রত্যাশা উঠে দাঁড়ালো, সাথে গায়ের গহনা শাড়ির শব্দ ঝনঝন করে উঠল। হাতের ফোনটা বাড়িয়ে বলল,

-” আপনার ফোন। কেউ বোধহয় কল দিচ্ছে।”

নীরব ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,

-” ওহ্। কথা বলেছো?”

ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক প্রত্যুত্তর দেয় প্রত্যাশা। শফিক সাহেব খানিকক্ষণ আগে নীরবের নম্বরে কল দিয়েছিলেন। নীরব কথা বলে প্রত্যাশার কাছে দেয়। নীরব যেতেই পাশে বসা আবিরের নানু মুখ কালো করে বলে উঠলেন,

-” এই মাইয়া জানো না কিছু? স্বামীর নাম মুখে নেওয়া লাগে না। আমরা এতকাল সংসার করেছি, চুলে পাক ধরেছে তাও কোনোদিন ভুলেও স্বামীর নাম মুখে আনি নাই। আর এইটুকু বাচ্চা মাইয়া হইয়া একদিনেই স্বামীরে নাম ধরে ডাকো।”

মান্ধাতার আমলের চিন্তা ধারার মানুষ জয়নব আরা। বৃদ্ধার কথায় প্রত্যাশার বদনখানি বিরক্তিতে ঠাসা হলো। বিড়বিড় করল,

-” আরেব্বাস…. এই তো একটু আগেই ফিসফিস করে নীরবের বাচ্চার মা হওয়ার ট্রিপস দিচ্ছিল। দ্রুত বাচ্চা নেয়ার পরামর্শ ফ্রিতে দিচ্ছিল। তখন আমাকে বাচ্চা মেয়েটি মনে হয়নি? এখন বরের নাম ধরে ডাকাতে ঠিকই বাচ্চা মেয়েটি মনে হলো। উফ্! যত্তসব!”

মুখে বলল প্রত্যাশা,

-” ও খেয়াল ছিলো না। দুঃখিত নানু।”

প্রীতির অসহ্য ঠেকছিলো। ও রুম থেকে বেরোনোর ফাঁকফোকর খুঁজছিলো। চালাকি করে অফিশিয়াল জরুরী কল এসেছে বলে বেরিয়ে আসে।

___________

জানালার সাদা পর্দা হালকা বাতাসে দুলছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলো জানালার ফাঁক গলে রুমে ঠিকরে পড়ছে। রুম জুড়ে তাজা ফুলের ঘ্রাণ ম-ম করছে। বিছানার চারপাশ জুড়ে তাজা গোলাপ আর রজনীগন্ধার গন্ধ ছড়িয়ে। বেডের মাঝখানে লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লাভ আঁকা। দেয়ালে ঝুলছে অর্কিডের তোড়া। চতুর্দিকে রাখা সুগন্ধি ক্যান্ডেলগুলো রুমের সৌন্দর্য কগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রত্যাশা বেডের একপাশে চুপচাপ বসে। গায়ে গোলাপি রঙের সিল্কের সফট শাড়ি। ফ্যানের বাতাসে চুলগুলো এতক্ষণে শুকেছে প্রায়। শাওয়ার নিয়ে সবার সাথে অল্প কিছু খেয়েছে। তখন রুমে ঢুকতে আবির আর এক কাজিন নীরবের থেকে বাসর সাজানোর বখশিস দশ হাজার নিয়েছে।

ঘড়িতে রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। ডিনার টেবিলে নীরবের সাথে দেখা হয়েছিল এরমধ্যে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। উনি নাকি বাইরে ফ্রেন্ডদের সাথে আছেন। ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই মেসেঞ্জারে মেসেজ নোটিফিকেশন এল। গ্রুপে ঢুকতেই ফ্রেন্ডদের মেসেজে সয়লাব। প্রত্যাশাকে দেখেই হ্যাপি মেসেজ পাঠাল,

-” oi tui online a ki korchis?”

কোয়েল সেখানে হা হা দিলো। ফাজলামি করে গানের লাইন লিখলো,

-” আমার বুক কাঁপে যে দুরুদুরু মনে লাগে ভ’য়, জানি না তো আজ নিশিতে কী জানি কী হয়!”

রোহান সেখানে রিপ্লাই দেয়,

-” আমার ইচ্ছে করে ময়ূরপঙ্খি নায়ে চড়িয়া, তোমায় নিয়ে প্রেম যমুনায় যাব ভাসিয়া, আমি যাব ভাসিয়া ঘরের বাত্তি নিভাইয়া।”

হ্যাপি আঙরি রিয়েকট দিয়ে লিখলো,

-” fazil dui ta. Ak lathi diye grp theke ber kore dibo. Ai duitar Jonno poribesh nosto.”

নাহিদ লিখলো,

-” মামু এভাবেই চলবে কী তবে? ওদের হয়েছে কবে আমাদেরও হবে।”

আবার মেসেজ দিল নাহিদ,

-” শা”লার মিঙ্গেলদের মাঝে নিজেকে একেবারে এতিম এতিম লাগছে।”

ওদিকে প্রত্যাশা নীরবদর্শক হয়ে এদের মেসেজ দেখে যাচ্ছে। নাহিদ এবার একটু অবাক হওয়ার ইমুজির সাথে লিখলো,

-” অ্যাই তুই বাসর ঘরে না থেকে অনলাইনে কী করছিস?”

প্রত্যাশা লিখলো,

-” mosquito martichi.”

কোয়েল লিখলো,

-” তোর বরকে বিড়াল মা*রতে বলিস।”

প্রত্যাশা চট করে এক কাজ করে বসল। ফট করে গ্রুপ থেকে লিভ নেয়। আগামী এক সপ্তাহ আর গ্রুপে জয়েনটয়েন হবে না। ওরা সবকটা যা ফা’জি’ল। লজ্জা দিয়ে মে*রে ফেলবে।

দরজা ঠেলে নীরব রুমে প্রবেশ করে। বিছানায় একপল তাকায়। প্রত্যাশা শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচাচ্ছে তো খুলছে। কোনোকিছু না বলে সরাসরি নীরব ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোয়। পরনে নেভি ব্লু টিশার্ট আর অফ হোয়াইট ট্রাউজার। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে শুধাল,

-” মন খা’রাপ?”

মাথা নাড়িয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” উঁহু।”

.
.

নীহারিকা, শর্মিলা টেবিল গুছিয়ে রাখছে। নীলাও হাতে হাতে সাহায্য করছে। জগ থেকে ওয়াটার বোতলে পানি ঢালছিলো প্রীতি। এরমধ্যে জয়নব আরা এগিয়ে এসে বললেন,

-” এই যে মেজো নাতবউ? এদিকে আয়ো।”

প্রীতি কাছে আসতেই বৃদ্ধা ফিসফিসিয়ে বললেন,

-” শোনো তোমারে বলি, বড় নাতবউ তো আবার নতুন বউয়ের বোন হয়। সে কেমনে এসব ব্যাপারে থাকবো। তাই তোমারেই বলতাছি, এইযে দুধের গ্লাসটা একটু দিয়া আইসো। আর শোনো, নতুন বউটা নাদান, বাচ্চা মাইয়া। হেতিরে একটু সবকিছু বুঝাইয়া দিও। তুমি জাও মানুষ। এগুলান তো তোমার দায়িত্ব।”

প্রীতির মেজাজের পারদ আকাশ ছাড়িয়ে মহাকাশে যাওয়ার অবস্থা। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নেয়। মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টেনে টিপিক্যাল বউদের মতো রসিকতার ছলে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে,

-” আরে নানু এত টেনশন করবেন না তো। আমাদেরকে কিছু শিখিয়ে দিতে হবে না। যার বউ সেইই শিখিয়ে পড়িয়ে নিবে।”

পরপর দুধের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ইয়ে নানু, ইচ্ছে রুমে একলা আছে। ও ভ’য় পাবে। আমি রুমে যাচ্ছি। দুধটা পরী দিয়ে আসুক। কী হলো পরী দুধটা তুমি গিয়ে দিয়ে আসো।”

এই বলে প্রীতি কে*টে পরে।

_________

পরী দুধের গ্লাস আর ফলের প্লেট প্রত্যাশার হাতে দিয়ে চলে যায়। প্রত্যাশা দরজা লক করে হাতের ট্রে বেড টেবিলে রাখে। নীরব তোয়ালে ব্যালকনিতে রেখে রুমে পা দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” কে এসেছিল?”

প্রত্যাশা দেখিয়ে বলল,

-” পরী এসেছিল। নানু বলেছেন দুধটা আপনাকে দিতে।”

-” ওটা তুমি খাও। আমার থেকেও তোমার জন্য বেশি জরুরী।”

মুখ লটকে ‘না’ করে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল প্রত্যাশা। নীরব একটা গোলাপ হাতে নিয়ে পাপড়িগুলো একটা একটা করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল,

-” ফার্স্ট নাইটে কী গিফট করতে হয়, আই হেভ নো আইডিয়া। অনেক ভেবেও কী গিফট করব ভেবে পাইনি। তাই অবশেষে ভাবলাম গিফটটা তোমার উপর ছেড়ে দিই। এবার বলো, কী গিফট চাও?”

-” যা চাইব তাই দিবেন?”

-” অফকোর্স! আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব, সেটা তোমাকে দেয়ার।”

-” গিফটটা তোলা থাক। পরে পাছে কখনো চেয়ে নিবো।”

ফুলের পাপড়ি গুলো প্রত্যাশার মাথার উপর ছেড়ে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল নীরব,

-” ওকে, শুধু মনে করে চেয়ে নিয়ো।”

প্রত্যাশার চুলের ভাঁজে ভাঁজে লাল গোলাপের পাপড়ি বেঁধে থাকল। মুখের উপর পড়তেই নীরব ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দিল। বলল,

-” আজ পূর্ণিমা। তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি, তোমার পরীক্ষা শেষ হতেই একটু তাড়াহুড়ো করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার কারন আজকের ডেট। ক্যালেন্ডারে দেখলাম আজকের তারিখটায় পূর্ণিমা। আকাশের পূর্ণ চাঁদকে সাক্ষী রেখে আমার জীবনের চাঁদের সাথে প্রথম মূহুর্ত কাটাবো, এটা আমার শখ ছিলো। শখটা উপরওয়ালার মেহেরবাণীতে পূরন হয়ে যাচ্ছে।”

নীরব উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। প্রত্যাশা ঝটপট পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলল

-” আগে বলেননি কেনো?”

নীরব পেছন থেকে প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল,

-” এখন তো শুনলে।”

আকাশে থালার মতো চাঁদটা রুপোলি আলো ঠিকরে দিচ্ছে। মূহুর্তটাকে আরো আবেশিত করে তুলছে। নীরবের গরম নিঃশ্বাস প্রত্যাশার ঘাড়ে আঁছড়ে পড়ছে। প্রত্যাশার শরীর কেঁপে উঠল। নীরবের হাত প্রত্যাশার শাড়ির আঁচল গলে পেট ছুঁয়েছে। প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

-” নী-নীরব..”

প্রত্যাশাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় নীরব। প্রত্যাশার ঠোঁটের উপর তর্জনী আঙুল রেখে হাস্কি স্বরে বলল,

-” চুপ…সে নাথিং। জাস্ট ফিল মি।”

প্রত্যাশার চোখ বুঁজে আসার যোগাড়। কপালে চুমু এঁকে বলল কোমল স্বরে নীরব,

-” দিস মোমেন্ট, জাস্ট আস।”

নীরবের আবেশ প্রত্যাশার আকস্মিক প্রশ্নে যেনো হালকা হলো। প্রত্যাশা নিভু নিভু দৃষ্টিজোড়া অদূরে রাখে। আকস্মিক প্রশ্ন করে উঠে,

-” নীরব, হাউ মাচ ডু ইউ লাভ মি?”

নীরব আকাশে জ্বলজ্বল করা চাঁদের দিকে একপল চাইল। পরপর মুগ্ধ চোখে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে সম্মোহিত কণ্ঠে বলল,

-” ইফ দ্য ফুল মুন এভার আস্কড্ মি হু আই লাভ মোর হার অর ইউ? আই’ড স্মাইল অ্যান্ড সে, ‘ইউ… বিকজ ইভেন দ্য মুন ফেডস হুয়েন ইউ আর অ্যারাউন্ড।”

প্রত্যাশার ভেতর একটা শীতল শান্ত প্রশান্তির স্রোত বইয়ে গেল। দু’জনের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রত্যাশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরো বলল নীরব,

-” আই লাভ ইউ মোর দ্যান এনিথিং এভরিথিং.. অলওয়েজ। আই লাভ ইউ সো মাচ।”

নীরবের বুকে মাথাটা এলিয়ে চোখ বুজে অস্ফুটে বলল প্রত্যাশা,

-” আই লাভ ইউ সো মাচ ঠু।”

নীরব কিছুক্ষণ প্রত্যাশাকে বুকের ভেতর ধরে রাখল। তারপর ছেড়ে কাবার্ডের উপর রাখা ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট বের করে সামনে ধরল। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলল,

-” উম! বাসর রাতে কিছু তো একটা গিফট দিতে হয়। সেই হিসেবে এটা। তবে তোমার পছন্দ মতো, তোমার চাওয়া অনুযায়ী গিফটটাও পাওনা রইল।”

একটা সূক্ষ্ম নকশার বিছা প্রত্যাশার সামনে জ্বলজ্বল করছে। প্রত্যাশা হেসে ফেলল। বলল,

-” এইরে আমি তো কোনো গিফট আনিনি।”

প্রত্যাশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বসতে বলে নীরব,

-” আস্ত তুমিটাই তো আমার। এরচেয়ে বড় গিফট আর কিছু হয় নাকি।”

একহাতে শাড়ির আঁচল সরিয়ে বিছাটা যত্ন সহকারে পড়িয়ে দেয় নীরব। আঙুলের স্পর্শে প্রত্যাশার শরীর শিরশির করে উঠছে। পড়ানো শেষে নীরব অদ্ভুত এক কাজ করে বসল। প্রত্যাশার কোমড় দুই হাতে শক্ত করে ধরে নিজের কাছে টানল। পেটে মুখ ডুবিয়ে নরম এক চুমু আঁকে। প্রত্যাশার নিঃশ্বাস বুকে আঁটকে আসলো। আঙুল ছুটে গেল নীরবের চুলের ভাঁজে। খিচে চোখ বুঁজে নেয় প্রত্যাশা। নীরব এক ঝটকায় বউকে কোলে তুলে নিয়ে আলগোছে বিছানায় শুইয়ে দেয়।

জানালার পর্দা টেনে আলো নিভিয়ে দেয় নীরব। ক্যান্ডেলের মৃদু আলো জ্বলছে। সেই আলোয় লজ্জায় লাল হওয়া প্রত্যাশাকে মোহনীয় লাগছে। নীরবের নিঃশ্বাস বেপরোয়া ছুটছে। প্রত্যাশার উপর ভার ছেড়ে চোখে চোখ রেখে গম্ভীর কোমল স্বরে বলল নীরব,

-” বিয়ে শুধু একটা পবিত্র বাঁধনই নয়। বিয়ে হলো দুইটা হৃদয়ের একসাথে চলার অঙ্গিকার। দায়িত্ব, বিশ্বাস, সেক্রিফাইস আর ভালোবাসা দিয়ে যে বাঁধন গড়ে ওঠে, সেটা কখনো ভাঙে না, অটুট থেকে যায়। আমি চাই, আমাদের তেমনই দৃঢ়, অম্লান বাঁধন হোক।”

গরম নিঃশ্বাসের বর্ষণ প্রত্যাশার চোখেমুখে পড়ছে। প্রত্যাশার বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে। কথারা আজ যেন খেই হারিয়েছে। কিছুই বলতে পারছে না। নীরব প্রত্যাশার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

-” তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। আজ থেকে আমি প্রতিদিন তোমাকে নতুন করে চাইবো, নতুন করে ভালোবাসবো। পৃথিবী বদলালেও, সময় বদলালেও আমি বদলাবো না। তুমি থাকবে আমার প্রথম আর শেষ ঠিকানা হয়ে। ভালোবাসা দিয়ে মুড়িয়ে রাখব তোমাকে। প্রত্যাশা, মে আই?”

প্রত্যাশা মুখে কিছুই বলতে পারল না। অনুভূতিতে টালমাটাল প্রত্যাশা নীরবতাকে বেছে নিল। আপনাআপনি প্রত্যাশার হাত দু’টো নীরবের টিশার্টের কলার আঁকড়ে ধরল। আরেকটু কাছে টানল। বউয়ের নীরব অনুমতি পেতেই নীরব চূড়ান্ত বেসামাল হয়।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪২|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ভোরের হালকা কোমল আলো সফেদ পর্দার ফাঁকফোকর গলে রুমে ঢুকছে। আধো অন্ধকার ঘরটায় এক অদ্ভুত শান্তি মিশে আছে। শরীরে গত রাতের ক্লান্তি মিশে থাকা এক মিষ্টি ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙে প্রত্যাশার। নতুন ভোরের শুরুতেই একটু অন্যরকম অনুভূতি হলো। দূর্বল শরীর, হালকা পেইন, চোখেমুখে একরাশ লজ্জার আভা নিয়ে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় প্রত্যাশা। এরমধ্যে হঠাৎ করেই কানে এলো দরজায় টোকা পড়ার শব্দ।

প্রত্যাশা সহসাই উঠে বসে হাতড়ে শাড়ি খুঁজল। ব্লাউজের হুকগুলো এলোমেলো করে জোড়া লাগানো। শাড়ি না পেয়ে ত্রস্ত কাঁথা টেনে বুকের উপর তুলতেই চোখে পড়ল— নীরবের ফর্সা উন্মুক্ত পিঠ। সাথে সাথেই লজ্জায় জিভ কা’টল মেয়েটা। নীরব উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে বিভোরে। পরমূহুর্তেই নজর যায়, শাড়ির কিছু অংশ নীরবের গায়ের তলা হয়ে বেড ছাড়িয়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আলতো করে নীরবের পিঠে হাত রাখল। মৃদু ধা’ক্কা দিয়ে ডাকল,

-” শুনুন?”

নীরব এক চুলও নড়ল না, পূর্বের মতন নিশ্চিন্তে আরামসে বান্দা ঘুমুচ্ছেন। প্রত্যাশা এবারে একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল,

-” এই উঠুন না, কেউ এসেছে বোধহয়। শাড়িটা আপনার গায়ের তলায়।”

নীরব এবারে কিঞ্চিৎ নড়ল। প্রত্যাশা দাঁত চেপে বলল,

-” নীরব? কী ঘুম রে বাবা!”

নীরব পাশ ফিরল। কপালে বিরক্তির ছাপ নিয়ে ঘুমুঘুমু স্বরে বলল,

-” সকাল সকাল কী শুরু করেছো বলো তো?”

-” শাড়ি নিবো। আপনার গায়ের তলায় পড়ে আছে।”

চোখদুটো বুজেই এক ঝটকায় প্রত্যাশার হাত চেপে ধরে টেনে নেয় বিছানায়। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে নীরব,

-” ঘুমাও তো। এক্ষুনি উঠতে হবে না।”

প্রত্যাশা হৈচৈ করে উঠল,

-” আরে ছাড়ুন তো, বললাম কেউ নক করল মনে হলো।”

একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে নীরব। ঘড়িতে সময় দেখে, সাতটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। বলল,

-” বাড়ির সবার মাথা গেছে নাকি! আজকের দিনে সাতটা বাজার আগেই নক করতে আসবে? কেউ আসেনি। তোমার মনের ভুল।”

বলেই লতার মতো প্যাঁচিয়ে ধরে নীরব। প্রত্যাশার দম আঁটকে আসার উপক্রম। হাঁসফাঁস করে ওঠে,

-” মা গো, চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি তো। নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে, ছাড়ুন। দূরে সরুন।”

নীরব নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

-” দূরে সরা ইম্পসিবল।”

দু সেকেন্ড থেমে পরমূহুর্তেই বলল,

-” বরকে ঠিকঠাক সামলানোর জন্য হলেও, তোমার বেশিবেশি খেয়েদেয়ে একটু মোটা হওয়া জরুরী। এতটা থিন যে আমাকে খুব বেশি সতর্ক থাকতে হয়।”

প্রত্যাশা ভেংচি কে”টে ফের মোচড়ামুচড়ি আরম্ভ করে।

__________

বাড়ির গিন্নিরা কিচেনে ব্যস্ত। এরমধ্যে এক প্রতিবেশী প্রৌঢ় হন্তদন্ত হয়ে এসেছেন সাতসকালে। কণ্ঠে এক সমুদ্দুর অসহায়ত্ব মিশিয়ে লোকটা বললেন,

-” ভাবী নীরবকে একটু ডেকে দিন। কী যে ঝামেলায় আছি ভাবী, বলে বোঝানো যাবে না। সারারাত চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক হয়নি। এখন কী করব ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না।”

নীহারিকা উত্তরে বলেন,

-” নীরব এখনো উঠেনি। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। নীরব বেরোলেই কথা বলবেন।”

লোকটা নাছোড়বান্দার মতো বলে উঠলেন,

-” ভাবী একটু ডেকে দিন না।”

নীহারিকা বেশ বিরক্ত হলো। ছেলেটা চাকরি পাওয়ার পর থেকে এলাকার মানুষের একটু কিছু হতে না হতেই ছুটে আসে। যত দায়দায়িত্ব মনেহয় ওনার ছেলের। নিজেরা অকাম-কুকাম করে আসবে, সেখানে তার ছেলের কাছে সাহায্যের জন্য ধন্নাধরবে। নীহারিকা বিরক্তির ছাঁট কপালে নিয়েই বললেন,

-” আপনি বসুন। চা খান।”

অতঃপর পরীকে চা নাস্তা দিতে বলে কিচেনে ঢোকেন নীহারিকা।

.

শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে নীলার। তলপেটে ব্যথা হচ্ছে। চিনচিনে ব্যথাটা ক্রমশ বাড়ছে। দু’দিন আগেই পিরিয়ড ভালো হয়েছে। তারপর রাত থেকে হঠাৎ আবার ব্লিডিং হচ্ছে। বিছানায় দুইহাত ঠেস দিয়ে কপাল কুঁচকে বসে নীলা। নিভান তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল,

-” নীলাশা বেশি সমস্যা হচ্ছে?”

-” পেইন বাড়ছে।”

-” আমি পরীকে বলছি খাবার রুমে দিতে। অল্প করে হলেও কিছু মুখে দিয়ে পেইন কিলার খেয়ে নাও। আজ যেহেতু বাড়িতে অনুষ্ঠান। অনেক ব্যস্ত থাকব। তাই এ বেলায় ডক্টরের কাছে না গিয়ে বিকেলে যাব। এটুকু সময় খুব কী বেশি সমস্যা হবে?”

নীলা দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,

-” না, কিছু হবে না। মেডিসিন নিলে ব্যথা চলে যাবে। তবে হঠাৎ এরকম হওয়ার জন্য মেজাজ খা’রা’প হচ্ছে। বাড়িতে লোকজন, অনুষ্ঠান তারমধ্যে এসবে যা রাগ হচ্ছে না। এমনিতেই প্রত্যেকটা মাসের শেষে আমি কতটা আশা নিয়ে থাকি। বাট বারবার হতাশ হই।”

-” ডোন্ট ওয়ারি। আমরা তো এমনিতেই এই মাসে ডক্টরের সাথে পরামর্শ করতে যেতাম। যাইহোক সেটা না হয় আজই গেলাম। আই হোপ, দ্রুতই আমরা দুজন থেকে তিনজন হবো।”

শেষের কথাশুনে লাজে ফর্সা গাল রঙিন হয়ে ওঠে নীলার। ব্যথায় কপাল কুঁচকে আসলেও অদৃশ্য এক টুকরো ভালোলাগায় ভেতরটা শিহরিত হয়ে উঠল।

.
.

লোকটা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন। আনিশাকে দেখে কাছে ডাকলেন। আদুরে গলায় বললেন,

-” নীরবকে একটু ডেকে দাও তো পিচ্চি।”

আনিশা গোলগোল চোখ করে তাকিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল,

-” ছোটো দাদান?”

লোকটা অত বুঝলেন না। তবে চট করে বললেন,

-” এ বাড়ির পুলিশ ছেলেটাকে তো চিনো?”

-” হুঁ।”

-” হ্যাঁ, হ্যাঁ তার কথাই বলছি। একটু ডাকো তো জলদি।”

আনিশা গিয়ে ছোট হাতে দু’বার থা’প্পড় দিয়েছিল দরজায়। এসে নাকমুখ কুঁচকে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,

-” ছোটো দাদান, নতুন ভাবী ঘুমুচ্ছে। দরজা খোলে না।”

-” একটু বলো একজন দেখা করতে এসেছে।”

-” আমি আর যেতে পারব না। ছোটো দাদান ব’ক’বে।”

আনিশা আর কথা কানে না তুলে ইচ্ছের কাছে যায়।

এদিকে চা নাস্তা শেষ হয়েছে, তবুও নীরবের ঘুম থেকে উঠার নাম নেই। লোকটা আবার ডেকে উঠলেন,

-” ভাবী একটু ডেকে দিন না।”

প্রীতি ফ্রেশ হয়ে কিচেনে যায়। মুখে হাসি টেনে কোমল গলায় বলল,

-” মা, আমি কফি বানাই?”

নীহারিকা একপল দেখে ফের হাতের কাজ করতে করতে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ সূচক বললেন। ওই লোক আবার বলে উঠতেই পরী খাক করে উঠল,

-” কী গরুর মতো হাম্বা হাম্বা শুরু করছে। একে তো সাত সকালে আইছে। আবার আওনের পর থেইকাই ডাক আসা গরুর মতো ছটফট করতিছে। ওর বউরে না ধইরা ওরে ধরনের দরকার আছিলো।”

নীহারিকা মোটামোটা চোখে তাকাতেই জিভ কা’টে পরী। নীহারিকা গম্ভীর মুখে বললেন,

-” যা নীরবকে ডেকে দে।”

পরী হাত দু’টো ধুয়ে কোমরে গুঁজে রাখা ওড়নার আঁচল ছাড়িয়ে মুছতে মুছতে গেল। দরজার এপারে দাঁড়িয়েই শুকনো ঢোক গিলে নেয়। কোনো রকমে জোরেজোরে বলে,

-” ছোডো ভাইজান, কালাম চাচা আপনার লগে দেখা করতে আইছে।”

বলেই ভো দৌড় দেয় পরী। মানুষের জন্য সে আর ধ’ম’ক টমক খেতে পারবে না। এখন নীরব শুনলে শুনছে না শুনলে নাই।

শাওয়ার নিয়ে এ্যশ কালারের ট্রাউজার আর সাদা টিশার্ট গায়ে চেপে বেরোয় নীরব। ভেজা চুলে আঙুল ঢুকিয়ে ব্রাশ করতে করতে ড্রয়িংরুমে আসছিল। প্রীতি কফির ফ্লাস্কটা ডায়নিংয়ে রাখতে আসতে গিয়ে নীরবের সামনাসামনি পরে। একবার চোখ তুলে নীরবের দিকে তাকায়। মাথাভর্তি ভেজা চুল, কপালের উপর থাকা চুল থেকে দুএক ফোঁটা পানি ঝরছিল। তাৎক্ষণিকভাবে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় প্রীতি। নীরব ওর মতো গিয়ে সোফায় বসল। আর বসতেই ভদ্রলোক গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করলেন,

-” বাবা বড় বিপদে পড়ে আইছি। শালার ছোট ছেলে এক অকাম করে ফেলেছে। হারামজাদা ছেলে পাশের এলাকার একটা মাইয়ারে নিয়া পালাইছে। মাইয়ার বাপ কেস করছে। এখন রাতে পুলিশ এসে তোমার চাচিরে ধরে নিয়া গেছে। আমার নামেও কেস হয়েছে। তবে আমি বড় বেয়াই বাড়ি দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম দেখে অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গিয়েছি। তোমার চাচি থানায়। মহিলা মানুষ, কও তো কেমনডা লাগে? অকাম করে রাখছে হারামজাদাটা আর গুষ্টি শুদ্ধ এখন ভুগছি। রাতেই তোমার কাছে কল করছি। সারারাতে কতবার তোমার নম্বরে যে কল দিছি হিসাব নাইকা। বারবার ফোন দিয়া বন্ধ পাইছি।”

নীরব খুকখুক করে কেশে উঠল। মনেমনে ভাবল— ভাগ্যিস ফোনটা বন্ধ রেখেছিলাম। ভদ্রলোক এক নাগাড়ে বলতে লাগলেন,

-” তোমাদের আর কারো নম্বর ছিলো না। অবশেষে এই সক্কাল সক্কাল ছুটে আসা লাগলো। বাবা, তোমার চাচিরে জেলে চালান না করে দেয়। দেখা করতে যাব, গেলে আমাকেও আটকিয়ে দিবে। সেই ভয়ে দেখাও করতে পারছি না। বাবা একটা কিছু করো। যেভাবেই হোক তোমার চাচিরে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করো।”

সবটা শুনে গম্ভীর স্বরে বলল নীরব,

-” মেয়েটা অনার্সে পড়ে, মানে এডাল্ট। সে যদি নিজের ইচ্ছায় যায়, জবানবন্দি দিলেই কেস হালকা হবে। আপনাদের দিক থেকে চাপ কমে যাবে। আগে আপনার ছেলের সাথে বসে কথা বলুন। তাদেরকে আসতে বলুন।
না এসে ভ’য় পেয়ে পালিয়ে থাকলে উল্টা আপনাদের সমস্যাই বাড়বে।”

-” হারামজাদা কোনে ঘাপটি মাই’রা আছে। ওর মারে জেলে নিয়েছে, ওর একটুও চিন্তা হচ্ছে না। ও শালার ছাওয়াল আছে, আসলে পড়েই মাইয়ার বাপ মাইয়ারে জোর করে নিয়ে যাবে। এমন হারামজাদা জন্ম দিছি।”

_________

প্রত্যাশা চুল আচড়াচ্ছিল। নীরব একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বলল,

-” পরীকে বলেছি তোমার নাস্তা রুমে দিয়ে যেতে। এখানে পেইন কিলার আছে খেয়ে নিবে।”

প্রত্যাশা ঘাড় কাত করে বলে,

-” আচ্ছা।”

-” ভেতরে*** আছে। মনে করে কিন্তু খেয়ে নিবে। খেয়াল ছিলো না, আরো আগে দরকার ছিলো। ইমার্জেন্সি খাবে কিন্তু।”

-” আচ্ছা রাখুন। খেয়ে নিবো।”

ওয়্যারড্রবের উপর রাখতে রাখতে নীরব আবারো সতর্ক করে প্রত্যাশাকে। প্রত্যাশা চিরুনি নামিয়ে কিছুটা বিরক্ত গলায় বলে,

-” আচ্ছা বাবা মনে থাকবে। মনে করে খাবো। এবার হয়েছে?”

এরমধ্যে নীলার গলা এল। দরজার ওপাশ থেকে নক করতেই প্রত্যাশা ঝটপট বলল,

-” আরে আপু দাড়িয়ে কেনো? ভেতরে আসো।”

দুইবোনকে স্পেস দিতে নীরব রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রত্যাশার পরনে লাল রঙের শাড়ি। নীলা দেখে বলল,

-” এখন তো ভালোই একাএকা শাড়ি পড়া শিখে গিয়েছিস।”

প্রত্যাশা একটু খুশিই হলো। আহ্লাদী সুরে বলল,

-” শাড়িটাতে আমাকে ভালো লাগছে?”

নীলা ছোট করে বলল,

-” হুম।”

তারপর একটা ছোট্ট প্যাকেট থেকে লাল বক্স বের করল। প্রত্যাশার হাতে দিয়ে বলল,

-” তোর বিয়ের গিফট আমাদের তরফ থেকে। কখনো আবার বলে বসবি, বোন-দুলাভাই বিয়েতে কিছু দেয়নি। আর ও হ্যাঁ, একটা শাড়িও আছে। দুপুরে শাড়িটা দিবো, ওটা বউভাতের গিফট। এবার দেখ দুলজোড়া পছন্দ হয়েছে কী না।”

একজোড়া স্বর্ণের ঝুমকা। প্রত্যাশা একগাল হেসে বলল,

-” বাহ্, ভারী সুন্দর ডিজাইন। আচ্ছা এটা পড়িয়ে দাও।”

-” তুই পড়ে নে, আমার কাজ আছে।”

-” আরে দাও না। হুক লাগিয়ে দাও।”

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা কানে দেয়, নীলা হুক লাগিয়ে দেয়। প্রত্যাশা আঙুল দিয়ে ঝুমকা নাড়িয়ে বলল,

-” ডিজাইনটা সত্যিই চমৎকার হয়েছে! থ্যাংকিউ আপু।”

বারবার নীলার কপাল কুঁচকে আসছিল। প্রত্যাশার নজরে পড়তেই মুখের হাসি উবে গেল‌। কণ্ঠে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলল,

-” আপু তোমার মুখটা শুকনো লাগছে। অসুস্থ তুমি।”

-” না তেমন কিছু না।”

নীলা আর বাড়তি কথা না বলে চলে আসে। বাড়িতে আত্নীয় স্বজন আছে কাজটাজ না করলে আবার কথার সৃষ্টি হবে। নীলা কিচেনে যায়। বারবার কোমড়ে হাত চেপে ধরছিল ও। নীহারিকা লক্ষ্য করতেই বললেন,

-” নীলাশা শরীর খারাপ লাগলে রুমে যাও, বিশ্রাম নাও।”

-” হাতের কাজটা শেষ করি।”

-” সবাই আছে কাজ একটু দেরি হলেও হয়ে যাবে। তুমি রুমে যাও।”

যদিও কাজটাজ করতে একটুও ভালো লাগে না নীলার। তবে সবার সামনে ভালো থাকতে চাওয়ার জন্য হলেও একটু-আকটু নিজ ইচ্ছায় করতে আসে। অবশ্য আজ শরীরটা সত্যিই খারাপ। নীলা যেতেই পরী ভেংচি কে’টে বলল,

-” বড় ভাবীর তো কাম দেখলেই শরীর খারাপ হইয়া থাকে। যেদিনই বেশি কাম থাকে সেদিনই উনি__”

নীহারিকার কথায় থেমে যায় পরী। নীহারিকা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,

-” বাড়তি কথা বাদ দিয়ে তোর কাজ তুই কর।”

___________

বউভাতের অনুষ্ঠান ভালোভাবে মিটতে না মিটতেই নীলাশা অসুস্থ হয়ে পড়ে। আত্মীয়-স্বজনের খাওয়া-দাওয়ার পাঠ অবশ্য চুকে গিয়েছিল। কাছের নিকট আত্মীয় ছাড়া বাকি নিমন্ত্রিত অতিথিরা বিদায় নিয়েছে। প্রত্যাশা-নীরব ও বাড়ি যাবে। এরমধ্যে অতিরিক্ত ব্লিডিংয়ে নীলা জ্ঞান হারায়। সাথে সাথেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দ্রুত ব্লাড দেয়া হয়। সাথে একের পর এক টেস্ট তো আছেই। টেস্টের রিপোর্ট এখনো দেয়া হয়নি। ঘড়ির কাঁটা রাত দশটার ঘর ছুঁইছুঁই। নীরব নিভানের সাথে হাসপাতালে। অধরা আর নীহারিকা আছেন কেবিনে নীলার কাছে।

নীরবের ফোনটা কেঁপে উঠল। রিসিভ করতেই প্রত্যাশার কান্না মিশ্রিত কণ্ঠস্বর আসলো। একটু পরপরই ফোন দিয়ে জ্বা’লিয়ে খাচ্ছে। আর কান্না করছে। নীরব ঠাণ্ডা গলায় বলল,

-” হ্যাঁ, প্রত্যাশা বলো।”

প্রত্যাশা ভেজা গলায় বলল,

-” নীরব, আপু কেমন আছে? আমি ওখানে যাব।”

-” প্রত্যাশা, বাচ্চাদের মতো জিদ করো না। এখানে ভিড় বাড়ালে ভালো হবে না। ভাবী আগের থেকে একটু ভালো আছেন, জ্ঞানও ফিরেছে। রিপোর্ট হাতে আসুক, সব তোমাকে জানাব। রাতের খাবার আনতে আমি একটু পর বাসায় আসছি। তুমি খেয়ে নাও, আর একদম কান্নাকাটি করবে না, কেমন?”

প্রত্যাশাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নীরব ফোন রাখে। এরমধ্যে একজন দায়িত্বরত নার্স এসে কাগজে কিছু লিখতে লিখতে জিজ্ঞেস করলেন,

-” পেশেন্টের ছেলে-মেয়ে কজন?”

জানানো হলো এখনো কোনো সন্তান নেই। বিয়ের বছরও পূর্ণ হয়নি। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার পেশেন্টের গার্ডিয়ানকে ডাকে। নিভান যায়। গাইনোকলজিস্ট সাবরিনা জাহান জিজ্ঞেস করলেন,

-” পেশেন্টের কী হোন আপনি?”

নিভানকে খুব টেনস আর উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো চোখেমুখে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। বুকটা অজানা আশংকায় অস্থির। বলল,

-” আমি নিভান মাহবুব, পেশেন্টের হ্যাজবেন্ড। ডক্টর আমার ওয়াইফ..”

ডক্টর হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। বললেন,

-” বসুন।”

হাতের পেনটা এক টুকরো কাগজে ঠুকতে ঠুকতে বললেন,

-” রিপোর্টে দেখা গেছে, পেশেন্টের ইউটেরাসে টিউমার। সেটা দ্রুত বাড়ছে এবং জটিল আকার নিচ্ছে। অপারেশন না করলে অবস্থা মারাত্মক হতে পারে। এমনকি রোগীর জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।”

নিভানের মাথায় বজ্রপাত হল যেন। অসহায় দু’টো চোখে ডাক্তারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। ডক্টর এক মূহুর্ত থেমে এক নিঃশ্বাসে বললেন,

-” মিস্টার নিভান আপনার স্ত্রীর ইউটেরাসে টিউমার হয়েছে। যেটা দ্রুত ছড়াচ্ছে, ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। ইমিডিয়েট অপারেশন জরুরি। তবে একটা তিক্ত সত্যি মেনে নিতে হবে, এই সার্জারির পর আপনার ওয়াইফ সারাজীবনের জন্য মা হওয়ার সক্ষমতা হারাবে। আপনার ওয়াইফ কোনোদিন মা হতে পারবে না।”

গোটা আসমান গুঁড়োগুড়ো হয়ে যেন নিভানের মাথায় ভেঙে পড়ল। পৃথিবীর সবচেয়ে তিক্ত কথা মনে হলো এই প্রথম শুনল সে। শরীর অবশ হয়ে এল সেকেন্ডেই। বুকের উপর পাথর চাপা দেয়ার মতো যাতনায় দম আঁটকে এল।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছুই নয়। তবুও নিভান হাল ছাড়েনি। দু’দিন ধরে এক ডক্টরের পর আরেক ডক্টরের কাছে ছুটে গেছে। অনুরোধ করেছে–
‘কোনোভাবে কি ইউটেরাস না কে”টে শুধু টিউমারটা ফেলা যায়?’

প্রতিটি ডক্টরের একই উত্তর,

-” দেখুন মিস্টার নিভান, আপনার স্ত্রীর জরায়ুতে ইতিমধ্যেই সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এই অবস্থায় যদি টিউমার রেখে দেওয়া হয়, ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি খুব বেশি। যেখানে জীবন হুমকির মুখে, সেখানে ভবিষ্যতের সন্তান নেওয়ার আশা ধরে রাখা ঠিক হবে না। আমরা শুধু একটা পথই দেখছি জরায়ু কে’টে টিউমার অপসারণ।”

অবশেষে অপারেশন করা হয়। সময় গড়িয়েছে। এর মধ্যে কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। পাঁচ-ছ’দিন হলো নীলাশাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে। মেয়েটার মুখে এক ফোঁটা হাসি নেই। সারাক্ষণ রুমে বিষণ্ণ চিত্তে বসে থাকে। কেউ কথা বললে দুএকটা বলে, এছাড়া সবসময় পাথর বনে থাকে। মেয়েটা ভেতরে ভেতরে একদম ভেঙে পড়েছে।

বাইরে গোধূলির ম্লান আলো থাকলেও রুমের ভেতরটা অন্ধকারে ঢাকা। বিছানার হেডে হেলান দিয়ে নীলা আধশোয়া হয়ে চোখবুঁজে ছিল। এমন সময় রুমে আলো জ্বলে উঠতেই চোখের পাতা কুঁচকে এল। হাতের অফিশিয়াল ব্যাগটা সোফায় নামাতে নামাতে স্ত্রীর দিকে তাকাল নিভান। আর তাকাতেই বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শার্টের হাতার বোতাম খুলতে খুলতে মৃদুস্বরে বলল,

-” লাইট না দিয়ে অন্ধকারে বসে আছো যে এই ভর সন্ধ্যায়।”

নীলার শুকনো খরখরে ঠোঁটজোড়া কেঁপে উঠল। নিঃসাড় গলায় উত্তর দিল,

-” যার গোটা জীবনটাই অন্ধকারে ঢেকে গেছে, তার জীবনে আলো জ্বালিয়েই বা কী হবে।”

-” নীলাশা বাচ্চাই জীবনের সব নয়। তুমি এত ভেঙে পড়ছো কেনো?”

কয়েক মূহুর্ত নিরুত্তর থেকে পরমূহুর্তেই আকস্মিক প্রশ্ন করে ওঠে নীলা,

-” তুমি কী আবার বিয়ে করবে নিভান?”

নিভান থমকে গেল। চমকে তাকাল স্ত্রীর দিকে। নীলা ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলল,

-” শুধু শুধু আমার জন্য তুমি কেনো বাবা হওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে? আমি কোনোদিন তোমাকে সন্তান দিতে পারব না। তোমাকে নিজের সন্তানের খুশি দিতে পারব না। সমস্যা তো আমার। আমার জন্য তুমিই বা কেনো সাফার করবে?”

নীলার সামনে বসল নিভান। নীলার হিম শীতল হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,

-” নীলা, আজ যা বলেছো আর কখনো বলবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি সুস্থ আছো, আমার পাশে আছো এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমার বাচ্চা চাই না।”

এতক্ষণ শক্ত হয়ে থাকা নীলার ঠোঁট ফেটে কান্না বেরিয়ে এল। ফুঁপিয়ে উঠল,

-” নিভান, আমার মনে হচ্ছে এবারে আমি বোধহয় তোমাকে হারিয়ে ফেলব।”

এক ঝটকায় নীলাকে বুকে টেনে নেয় নিভান। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে বলল,

-” নীলাশা, তুমি আমাকে এই চিনো? আমার বাচ্চার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে চাই, শুধু তোমাকেই। আমি তোমাকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চাই। আর বাচ্চা আমরা এডপ্ট নিবো। তাহলেই তো সমস্যা সলভ হয়ে যাবে।”

নীলা মাথা নাড়ল। কান্না ভেজা গলায় বলল,

-” তা হয় না নিভান। তা হয় না। নিজের রক্তের সন্তান, নিজের শরীরের বাচ্চার সাথে যে অনুভূতি জড়িয়ে থাকে, সেটা অন্যের বাচ্চাকে মানুষ করে পাওয়া যায় কী? নিজের র*ক্ত বলেও একটা কথা আছে।”

নীলা ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। ফাপর নিয়ে বলে ওঠে,

-” নিভান এ কোন পাপের শাস্তি আমি পাচ্ছি? নিয়তি কেনো এতটা নিষ্ঠুর হলো। একটা বাচ্চা হওয়ার পরে এই অসুখটা হলেও তো আমি নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। নিভান তুমি তো জানো আমি শুরু থেকেই একটা বাচ্চা চাইতাম। ছোট্ট একটা বাচ্চা, যে তোমার আর আমার ভালোবাসায় এই পৃথিবীতে আসবে। আমাকে মা বলে ডাকবে। আমি কত আদর করব! আমি একটা বাচ্চা নিয়ে কত কী ভেবে রেখেছিলাম। একটা অসুখ, একটা অসুখ, আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিল। আমি এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না নিভান। পারছি না।”

নীলার আহাজারিতে রুমের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। এদিকে নোনতা জলে নিভানের খোঁচা খোঁচা দাড়ি ভিজে গেল। আজকাল চোখের পানি বেঈমানি করছে। তারও কী কম কষ্ট হচ্ছে নাকি? ছেলে মানুষ বলতে পারে না, প্রকাশ করতে পারে না। সেও যে ভেতরে ভেতরে গুমরে ম’রছে। ইসলামী ব্যাংকে অফিসার পোস্টে ভালো অ্যামাউন্টের বেতনের চাকুরী করে সে। এ বাড়িতে সবার থেকে মাস গেলে সেই বেশি টাকা পায়। আল্লাহর রহমতে অর্থের অভাব কোনোদিন হবে না। তবে সারাজীবনের জন্য একটা বড় অপূর্ণতা রয়ে যাবে। নিভান নিজেকে সামলে বলল,

-” নীলাশা শান্ত হও। নীলাশা তুমি নিজেকে কেনো দায়ী ভাবছো? আজ যদি আমার কোনো সমস্যা হতো। এমনও তো হতে পারত। আর অনেক মানুষ আছে যাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই কোনো সমস্যা নেই, অথচ তাদের সন্তান হয় না, হয়নি। আল্লাহ কাউকে ছেলে দিয়ে , কাউকে মেয়ে দিয়ে, কাউকে বা উভয়ই দিয়ে, আবার কাউকে সন্তান না দিয়ে পরীক্ষা করেন। এটা আমাদের জন্য পরীক্ষা। ধৈর্য্য ধরো। সন্তান সন্ততিই জীবনের একমাত্র টার্গেট নয়।”

নিভানের পিঠের শার্ট আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে নীলা। নীলার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল নিভান,

-” নীলা আমার উপর ভরসা রাখো, আমি তোমাকে ভালোবাসি, সারাজীবন এভাবেই ভালোবেসে যাবো। ভুলেও আর উল্টাপাল্টা কথা মাথায় আনবে না।”

এক মূহুর্ত থেমে নরম কোমল স্বরে ফের বলল,

-” আমার কাছে বাবা হওয়ার স্বপ্নের চেয়েও বড় তুমি। তুমি থাকলেই আমার পৃথিবী পরিপূর্ণ। তোমাকে নিয়েই আমি বাকিটা জীবন পার করতে চাই। আমার বাচ্চা দরকার নেই। আমার সুখ, আমার স্বপ্ন সবকিছুই শুধু তোমাকে নিয়েই।”

___________

সারাদিন অফিসেই থাকে প্রীতি। সন্ধ্যা থেকে সকালটুকু বাড়িতে কা”টে তার। সবার সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ শো করে চলছে। তবে সত্যি বলতে তার দম আঁটকে আসছে। আর একটা সপ্তাহই আছে সে। এদিকে এই এক সপ্তাহের মধ্যেই সে প্রত্যাশার ব্যাপারটা যেভাবেই হোক সবার সামনে আনবে। আনবে মানে আনবেই। এদিকে বাড়ির সবাই এ ক’দিন নীলাশাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। তাই সুযোগ পেয়ে উঠেনি প্রীতি। এ কদিনে শাশুড়ির মনও বেশ বুঝে ফেলেছে। শাশুড়ি যে বিষয়টা পজিটিভলি নিবে না তা সুচতুর প্রীতি নিশ্চিত। নীলাশার সাথে প্রত্যাশার সম্পর্কও সুমধুর নয়। এখানেও প্লাস পয়েন্ট। সে যেহেতু সুখী হয়নি। অন্যের সুখ তার সহ্য হচ্ছে না। যে করেই হোক সেই সুখে আ”গুন ধরলেই যেন একটু শান্তি মিলবে। মনেমনে প্রীতি ছক কষছে। কীভাবে বিষয়টা সবার সামনে উপস্থাপন করবে?

নীলা-নিভান রুমে বাকিরা ড্রয়িংরুমে। নীরব অফিসে। প্রত্যাশা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে অন্যহাতে ফোন স্ক্রল করছে। এক প্রতিবেশী এসেছে। হঠাৎ বলে উঠলেন,

-” নিভানের মা বউমা গুলান দারুণ পেয়েছে। মাশাআল্লাহ মেজো বউ তো দেখছি খুবই সুন্দরী। বড় বউও সুন্দরী। তবে সেই হিসেবে ছোট বউটা একটু..”

এতটুকু বলে থামলেন মহিলা। প্রত্যাশা কানে শুনেও না শোনার ভান ধরে রইল। নীহারিকা বিরক্ত চোখে তাকালেন। মহিলা হাসার চেষ্টা করে বললেন,

-” না মানে ছোট ছেলেটা যত সুন্দর, সেই হিসেবে একটু কম আরকি। তবে মন্দ না।”

নীহারিকা প্রত্যুত্তরে বলেন,

-” কারো সৌন্দর্য চোখে মাপা যায় না। আপনার চোখে হয়তো কম বেশি লাগে, কিন্তু আমাদের চোখে তিনজনই সমান। আসল সৌন্দর্য চরিত্রে, মনের ভেতরে। সেটা হয়তো চোখে ধরা পড়ে না।”

মহিলা সুর মিলিয়ে বললেন,

-” হ্যাঁ, হ্যাঁ তা তো ঠিকই।”

আরও কয়েকটা কথা বলে এবারে একটু ফিসফিসিয়ে বললেন,

-” ভাবী আপনার বড় বউমার কথা শুনলাম। শুনে তো খুব খারাপ লাগলো। বেশি খারাপ লাগছে নিভানের জন্য। তা ভাবী ছেলেকে আর বিয়েশাদী দিবেন না? ছেলে তো সুস্থ-সক্ষম বউয়ের জন্য ছেলে কেনো নির্বংশ থাকবে। এই ব্যাপারে আপনি কী বলেন? আপনার মতামত কী?”

প্রত্যাশার জিভের আগায় কথা চলে আসে। তবে ভাবে দেখি শাশুড়ি কী উত্তর দেয়? অবশেষে কথাগুলো পেটেই চালান করে নেয় প্রত্যাশা। নীহারিকা মুখটা গম্ভীর করলেন। এই হয়েছে প্রতিবেশীরা সমবেদনা জানানো তো নয়, আরো যেন মজা নেয়। বিকেলে একবার একজন তো নীলার সামনেই নিভানের বিয়ে নিয়ে কথা বলছে। সেই থেকে নীলার মুখটা বেশি বিষণ্ণ ঠেকছে। নীহারিকা অসন্তুষ্ট চাহনিতে চেয়ে বললেন,

-” আজ যদি নীলাশা আমার মেয়ে হতো তাহলে আমি কী করতাম ভাবি? উত্তরটুকু আপনার কাছেই রাখলাম। অসুখ-বিসুখ আল্লাহর দেয়া, আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা করেন। এতে তো নীলাশার হাত নেই। নীলাশা সুস্থ আছে এই অনেক। আমার ছেলের জীবন, বাকিটা সে যা ভালো বুঝে করবে‌। আমি একজন মা যেমন তেমন একটা মেয়েও ছিলাম। আজ না হয় প্রৌঢ়া হয়েছি। এই সময় একটা মেয়ের মানসিক অবস্থা কেমন থাকে এতটুকু বুঝতে পারি। আর আপনারা এই মূহুর্তে কীভাবে এসকল কথা তোলেন? তাও আবার কেউ কেউ ওর সামনেই বলে।”

কথাগুলো শুনে প্রত্যাশার ভেতর শাশুড়ির জন্য শ্রদ্ধা কগুন বেড়ে গেল। মহিলা মুখটা থমথমে করে দ্রুত চলে যায়। মহিলা যাওয়ার পর শর্মিলা ঝাড়লেন খানিক।

ড্রয়িংরুমের দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মনেমনে কিছু হিসাব করছে প্রত্যাশা। ডেট দেখে কপালে চিন্তার ছাপ পড়ে। ঠোঁট কামড়ে ভাবতে থাকে। এরমধ্যে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে ইচ্ছের ধাক্কায়। ছোট্ট প্রজাপতি ক্লিপটা প্রত্যাশার সামনে ধরে অন্যহাতে প্রত্যাশার হাত নাড়িয়ে বলল,

-” এই এই এটা লাগিয়ে দাও তো। খুলে গেছে।”

প্রত্যাশা মিষ্টি হেসে চুলে লাগিয়ে দিতে থাকে। শর্মিলা ফোড়ন কাটলেন,

-” এই যে ইচ্ছে আপি, এই এই আবার কেমন, হ্যাঁ? আমি কিন্তু লক্ষ্য করেছি তুমি প্রত্যাশাকে এভাবেই ডাকো। কাকিমণি বলো না কেনো? মাম্মা শেখায়নি?”

ইচ্ছে ঘাড় নেড়ে বলে,

-” নাহ।”

-” আচ্ছা এবার থেকে প্রত্যাশাকে কাকিমণি ডাকবে, কেমন?”

ইচ্ছে ঘাড় কাত করে ‘আচ্ছা’ বলে। ইচ্ছের গাল টিপে বলে প্রত্যাশা,

-” এইযে পিচ্চি কিউটিপাই আমার বরকে তো পাপা ডাকো। পাশে থাকা আমাকে যখন কাকি ডাকবে তখন তো নিজেকে পরপর লাগবে। মানাবে না। তারচেয়ে আমাকে তুমি মামণি ডাকবে। বুঝেছো?”

-” ওকে।”

বলে ইচ্ছে বায়না করল,

-” মাম্মা পায়েস খাবো।”

প্রীতি ফোন স্ক্রল করছিল। বিরক্ত হয়ে বলল,

-” এখন?”

নীহারিকা বললেন,

-” ফ্রিজে আছে। একটু গরম করে দাও।”

এরমধ্যে নীরব আসে। হাতে আনিশা আর ইচ্ছের জন্য চকলেট থাকে। ওদের দুজনকে দিতে দিতে প্রত্যাশার দিকে একপল তাকায়। মায়ের সাথে দু একটা কথা বলে রুমে যেতে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে। প্রত্যাশাও চোখের ইশারায় উত্তর দিল। বোঝাল— আপনি যান, আমি আসছি।

অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে কফি খাওয়া নীরবের নিত‌্যদিনের অভ্যাস। প্রত্যাশা উঠে সোজা কিচেনে যায় কফি বানাতে। কফি বানাতে ব্যস্ত প্রত্যাশা। এরমধ্যে প্রীতি মেয়ের জন্য পায়েস গরম করতে আসে।

ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে যেতে গিয়ে কী মনে করে প্রত্যাশা টেস্ট করতে হঠাৎ ঠোঁট ছোঁয়াল।‌ সাথে সাথে নাকমুখ সিঁটকে বিড়বিড় করে,

-” ইশশ্! কী তেতো। এএসপি সাহেব ব্লাক কফি খায় কী করে! এইজন্য তো মুখের কথাও রষকষহীন তেতো।”

পাশ থেকে প্রীতি সরু চোখে তাকিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,

-” ওয়েট, কফিটা নীরবের জন্য বানালে, না?”

-” হুঁ।”

প্রীতি ভুরু কুঁচকে বলল,

-” মানে, নিজের ঠোঁট ছোঁয়ানো কফি এখন অন্যকে দিবে, এঁটো করে? বাহ, কী দারুণ আদব-কায়দা তোমার!”

প্রত্যাশা চোখমুখ কুঁচকে বলল,

-” আরে এ আবার এমন কী? যার রোজকারের রুটিনেই আমার থুতু ইনক্লুডেড। তার কাছে একটা চুমুক কি খুব বেশি?”

প্রীতি বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল,

-” হোয়াট?”

-” বলতে চাচ্ছি, যেখানে এএসপি সাহেব নিজেই রোজ থুতু যুক্ত চুমু খায়। সেখানে তার কফিতে আমার চুমুকে এঁটোর কী আছে? বরং মহব্বত বাড়বে, হুঁ।”

প্রীতি খুকখুক করে কেশে উঠল। প্রত্যাশা ভেংচি কে”টে সামনের চুল এক হাতে উড়িয়ে ভাব নিয়ে চলে গেল, মুচকি মুচকি হেসে। যেতে যেতে বিড়বিড় করল,

-” শাকচুন্নী একটা। এরজন্য এএসপি সাহেবের কাছে কী বকুনিটাই না খেতে হয়েছিল। ভাই-বোন দু’টো মিলে আমাকে উনার কাছে খাঁটো করেছিল না। এবার দ্যাখ আর জ্বল। সাথে লুচির মতো ফোল।”

#চলবে