#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
রোদ ঝলমলে মিষ্টি দিন। নীরব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। হঠাৎই সামনে এসে দাঁড়াল প্রত্যাশা। মুখে টেনে নিল দুষ্টুমিষ্টি হাসি। নীরব শার্টটা গায়ে জড়াতে জড়াতে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-” কী? কিছু বলবে?”
প্রত্যাশা আরেক পা এগিয়ে আচমকা নীরবের শার্টের বাটনে হাত দেয়। আলতো হাতে বাটন লাগাতে শুরু করল। নীরব কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তবে বুঝল বউ নিশ্চয় কোনো আবদার করবে। প্রত্যাশা মিহি স্বরে বলল,
-” শুনুন না?”
একহাতে প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে কাছে টেনে নেয় নীরব। ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলে,
-” শুনছি তো বলো। তবে নিশ্চয়ই কোনো স্পেশাল ডিমান্ড আছে? এত মিষ্টি ব্যবহার একেবারেই হজম হচ্ছে না যে।”
-” বাড়ির জন্য মনটা কেমন কেমন করছে। আমি বাড়ি যাব।”
নীরব ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল,
-” জানি জানি। এমন কিছুই বলবে ভেবেছিলাম। শোনো, বাড়ি যাবে একমাস পর। প্রথম প্রথম দেখে মাসে একবার ছাড় দিচ্ছি। এরপর থেকে নিয়ম হবে বছরে একবার যেতে পারবে। ব্যস।”
প্রত্যাশা চোখ বড় করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
-” অসম্ভব! এরকম হলে আমি ম’রেই যাব।”
আরেকটু কাছে টেনে নির্লিপ্ত ভঙিতে বলে নীরব,
-” ম’রলেও আমার কাছেই ম’রবে। পালানোর রাস্তা নেই। আর ঘনঘন বাড়ি যাওয়ার চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে আউট করো।”
প্রত্যাশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
-” উঁহু। আপনি এমন করলে আমি কিন্তু সত্যি রাগ করে থাকব।”
প্রত্যাশার মুখের উপর থাকা এক গাছি কাঁটা চুল এক আঙুলের সাহায্যে ঠেলে কানের পিঠে গুঁজে দেয় নীরব। প্রত্যাশার চোখে চোখ রেখে কোমল স্বরে বলল,
-” ইয়ানূর প্রত্যাশা অল্প ক’দিনেই নীরব মাহবুবের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সে না থাকলে তার ঘুমই হবে না। তাকে ছাড়া রাত কাটানোর কথা নীরব ভাবতেই পারে না। ম্যাডাম শুনলেন তো, এবার কী করবেন, ভেবে দেখুন? আশাকরি, অধমের উপর সহৃদয় হবেন।”
প্রত্যাশা রষকষহীন কাঠখোট্টা স্বরে প্রত্যুত্তর দেয়,
-” দেখুন, অভ্যাস-টভ্যাসের অজুহাত দিয়ে আটকে রাখতে পারবেন না। আমার বাড়ি যেতেই হবে। অনেকদিন এসেছি। আব্বু-আম্মুর জন্য মন কেমন করছে। আমি বাড়ি যাব, যাব মানে যাবই। আর অনেকদিন থাকব। হুঁ।”
প্রত্যাশার কোমড় থেকে হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে নেয় নীরব। মুখটা গম্ভীর করে আঙুল নাড়িয়ে বলল,
-” যাও এক্ষুনি রেডি হয়ে নাও। তোমাকে এখনই দিয়ে আসব। তোমার তো এখানে ভালো লাগে না। দিনে দশবার করে বাড়ি যাওয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যান করো। আজ রেখে আসব। মন চাইলে আসবে না চাইলে নাই।”
ইন করে কোমড়ে বেল্ট পড়তে নেয় নীরব। কয়েক মূহুর্ত পরপরই নীরবের মুখাবয়ব আর কথা শুনে প্রত্যাশার এবারে খারাপ লাগলো। মনেহলো, ওভাবে বলা উচিত হয়নি। ভালো করে বললেই তো হতো। প্রত্যাশা অপরাধীর মতো মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
-” নীরব, স্যরি! আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আপনি রেগে থাকবেন না, প্লীজ।”
নীরব ভেতরে ভেতরে হাসল, তবে উপরে কপট রাগটা ধরে রাখল। নীরব ওর দিকে তাকাচ্ছে না, মুখটা গম্ভীর করে আছে এই দেখে প্রত্যাশার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে এল। নীরবের সামনে দাঁড়িয়ে ফের বলে,
-” নীরব স্যরি বলছি তো। কথা বলুন।”
-” তুমি রেডি হও।”
বলেই নীরব উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়াল। প্রত্যাশাকে এড়িয়ে সে রেডি হতে ব্যস্ত হয়। প্রত্যাশা সামনে দাঁড়িয়ে কানে দুইহাত দিয়ে বলল,
-” এইযে দেখুন কান ধরে স্যরি বলছি।”
নীরবের এবার প্রচন্ড হাসি পেল। নীরব হাসি লুকাতে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। প্রত্যাশা ভাবল নীরব রাগ করে তাকাচ্ছে না। প্রত্যাশা বলল,
-” যান আর কখনো বাড়ি যাওয়ার কথা বলব না। আপনার কথামতো মাসে একবারই যাবো। তবুও…”
নীরব মজা নিতে মেকি রাগ উপরে ধরে আছে।
মুখের হাসি লুকাতে নীরব টি-টেবিল থেকে পানির গ্লাস হাতে নিতে উল্টোদিক ঘুরতে ঘুরতে বলল,
-” স্যরি-ট্যরি বাদ দিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নাও।”
নীরব গ্লাসে ঠোঁট ডুবিয়ে মিটমিট করে হাসছে। প্রত্যাশা অসহায় মুখ করে বলে,
-” আপনি রাগ করে বাড়ি নিয়ে গেলে আম্মু আমাকেই দোষারোপ করবে। সবাই আমাকেই বকবে। বলছি তো ওভাবে বলা উচিত হয়নি। তবুও কেনো..”
বলতে বলতে প্রত্যাশা ঘুরে ঠিক সামনে দাড়াতেই দেখে নীরবের চোখেমুখে মিটমিটে হাসি। তারমানে উনি মজা নিচ্ছে। প্রত্যাশা এবারে কোমড়ে দুই হাত রেখে চোখ রাঙাল,
-” নীরব, আপনি রাগ করার নাটক করছেন? নাটক করছেন আপনি? বাহ্!”
গ্লাস নামিয়ে প্রত্যাশার সামনে দাঁড়িয়ে একহাত কোমড়ে রেখে বলল নীরব,
-” কীসের নাটক, আমি সিরিয়াসলি বলছি।”
-” আমিও এবার সিরিয়াসলি ব্যাগ গোছাই।”
প্রত্যাশা রাগ দেখিয়ে পা বাড়ায়। তক্ষুনি নীরব ওর হাত টেনে ধরে। একটানে বুকের উপর নিয়ে একহাতে পিঠ প্যাঁচিয়ে ধরে,
-” স্যরি, এমনি মজা করেছি। তবে সারাক্ষণ বাড়ি যাব, বাড়ি যাব করে বিরক্ত করে ফেলো।”
প্রত্যাশা রাগ নিয়ে বলল,
-” ছাড়ুন।”
মাথাটা নুইয়ে প্রত্যাশার মুখটা দুইহাতে আঁজলা করে ধরে নীরব। চট করে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল,
-” আগামীকাল শুক্রবার। অফডে আছে, সকালে রেডি হয়ে থাকবে নিয়ে যাব। দু’দিন থাকবে, এর বেশি না কিন্তু?”
প্রত্যাশা প্রশ্ন করে উঠল,
-” আপনার মা’কে বলতে হবে না। না মানে ওনার থেকে পারমিশন নিতে হবে না।”
-” তোমাকে বলতে হবে না। আমি মাকে বলে রাখবো।”
প্রত্যাশার মুখে হাসি ফুটল। খুশিতে নীরবের গালে চুমু খেয়ে বলে উঠল,
-” থ্যাংকিউ।”
নীরব চোখের কালোমণি ঘুরিয়ে চোখ বড়বড় করে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। প্রত্যাশা লজ্জা পেল। নীরব চোখেমুখে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে এক আঙুল নিজের ঠোঁটের উপর রেখে ইশারা করল। প্রত্যাশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বলল,
-” যাহ পারব না।”
___________
সকালের নাস্তায়, রুটি, ডিমভাজি, সবজি, খিচুড়ি, বেগুনের চাক ভাজি আর ইলিশ মাছ ভাজি আছে। রুটি সবাই খায় না, সেইজন্য সাথে ভাত বা খিচুড়ি থাকে। নীরবের প্লেটে নীহারিকা রুটি, ডিমভাজি আর সবজি তুলে দিলেন। প্রত্যাশা ঝিমুচ্ছে। নীহারিকা জিজ্ঞেস করলেন,
-” প্রত্যাশা কী নিবে রুটি না খিচুড়ি?”
রুটি প্রত্যাশার অতটা পছন্দ নয়। পরোটা হলে একটা খাওয়া যেতো। ও বলল,
-” খিচুড়ি।”
-” আচ্ছা, যেটা ভালো লাগে নাও।”
নিভান আবির খেয়ে মাত্র উঠে যায়। নীলাশা রুমে। প্রীতি কফি খেয়ে বেরিয়ে গেছে। অফিস থেকে সে খেয়ে নিবে। এত মশলাদার, তেলযুক্ত খাবার তার মুখে কম রুচে। প্রত্যাশা খিচুড়ির সাথে চাক ভাজি আর ইলিশ মাছ ভাজি তুলে নিল। ইলিশ মাছ তার আবার খুব প্রিয়। এক লোকমা ভাত মাছের সাথে গালে দিল। তবে কেমন যেনো স্বাদ লাগছে না। মাছের গন্ধে গা গুলিয়ে আসছে। কয়েক লোকমা খেতেই হঠাৎ ওয়াক ওয়াক করে উঠল। একহাতে মুখ চেপে দ্রুত উঠে বেসিনের সামনে যায়। গলগল করে বমি করতে থাকে। নীহারিকা কপালে চিন্তার ছাপ ফেলে শুধালেন,
-” প্রত্যাশা, হঠাৎ কী হলো এত বমি করছো যে? শরীর খারাপ লাগছে? জ্বর-টর আসেনি তো।”
ট্যাপের নব ঘুরিয়ে পানি হাতে নিয়ে কুলি করে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায় প্রত্যাশা। নীহারিকা তবুও কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে চেক করলেন। নীরবের খাওয়া থেমে গিয়েছে। এদিকে চেয়ে বলল,
-” কী না কী খেয়েছে, আবার বদহজম হয়েছে বোধহয়।”
প্রত্যাশার অস্থির লাগছে। ছোট করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
-” কই তেমন কিছুই তো খাইনি।”
নীরব বলে,
-” বিয়ের মধ্যেও তো এমন হয়েছিল। আচ্ছা, বমির ঔষধ আছে রুমে। একটা ফাস্ট খেয়ে নাও। বেশি সমস্যা হলে চলো ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই।”
ওড়নার আঁচল দিয়ে ভেজা মুখটা মুছে নিয়ে বলল প্রত্যাশা,
-” উঁহু, লাগবে না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।”
শর্মিলা হঠাৎ বলে উঠলেন,
-” নীরব, তুই বরং প্রত্যাশাকে ডক্টরের কাছেই নিয়ে যা। একবার চেকাপ করিয়ে আন। যদি কোনো সুখবর-টুখবর থাকে।”
নীরব বেষম খেল। নিজেকে সামলে দৃঢ় গলায় বলল,
-” বললামই তো বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যেও ওর এরকম হয়েছিল। বদহজম হয়েছে। অমন কিছু না ছোটমা।”
প্রত্যাশার নার্ভাস লাগছে। সে তো এক ভুল করে বসে আছে। নীরব তো আর জানে না। তবে এমনিও এরকম হতে পারে বলে প্রত্যাশা মাথা ঝেড়ে ফেলে। নীহারিকা বললেন,
-” অন্য প্লেটে খাবার দিচ্ছি, ওটা রাখো। খেয়ে ঔষধ খেয়ে নাও।”
প্রত্যাশা বলল,
-” মা এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। পরে খেয়ে নিবো।”
কেবল বমি টমি করল বলে কেউই আর প্রত্যাশাকে জোর করে না। প্রত্যাশা রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। নীরব হালকা নাস্তা করে রুমে যায়। জিজ্ঞেস করল,
-” শরীর বেশি খারাপ লাগছে?”
প্রত্যাশা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল,
-” নাহ, ঠিক আছি।”
-” আমি যাচ্ছি, শরীর খারাপ লাগলে সাথে সাথে ফোন করে জানাবে। শুয়ে বিশ্রাম নাও, কোনো কিছু করার দরকার নেই। আমি ফোন দিবো।”
প্রত্যাশা আলতো হেসে বলল,
-” চিন্তা করবেন না। ঠিক আছি।”
-” টেইক কেয়ার। বাই।”
_________
দুপুরে আ’গু’ন ধরিয়ে দেয়া গরম পড়ছে। রোদের তাপে সবকিছু খাঁ খাঁ করছে। প্রত্যাশা কিচেনে সাহায্য করছিল। নীহারিকা অবশ্য একবার বলেছিলেন ওকে রুমে যেতে। প্রত্যাশা ‘সমস্যা নেই’ বলে রান্না করতে থাকে। প্যানে আলু ভাজছিলো, কপাল বেঁয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছিলো। শরীরটা ক্লান্ত লাগছিলো, হঠাৎ কোনোকিছু ঠাহর করার আগেই মাথা ঘুরে পরে যায়।
চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফেরে। বিছানায় শুয়ে আছে প্রত্যাশা। নীহারিকা চিন্তিত বদনে চেয়ে। কণ্ঠে উদ্বেগ প্রকাশ করে বললেন,
-” হঠাৎ কী হলো? ভালো লাগে না আর। বাড়িতে একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে।”
শর্মিলা বললেন,
-” আরে ভাবী, ভালো কিছুও তো হতে পারে। শুধু শুধু চিন্তা করছো।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীহারিকা বললেন,
-” আর ভালো রে ছোটো। ভালো কিছু ভাবতেও আজকাল ভ’য় হয়। যা সব হচ্ছে আমার ছেলেদের সাথে।”
শর্মিলা বললেন,
-” চিন্তা করো না। দাঁড়াও আমি নীরবকে ফোন করছি। ওকে আসতে বলি, একবার প্রত্যাশাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনুক। আমার তো মন বলছে___”
প্রত্যাশা কথা কেড়ে নিয়ে ইতস্তত করে বলল,
-” ছোটো মা থাক না। ওনাকে ফোন করার দরকার নেই। উনি ডিউটিতে আছেন, ব্যস্ত আছেন। শুধু শুধু ফোন দিয়ে…”
-” এ মা শুধু শুধু কেনো? আর এ বাড়ির ছেলেরা বউ পাগল। বউ অসুস্থ শুনলে সব কাজ ফেলে ছুটে আসবে।”
প্রত্যাশা আবারো বলল,
-” থাক ছোটো মা।”
নীহারিকা বললেন,
-” ছোটো তুই নীরবকে কল দে। এসে মেয়েটাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনুক। এমনিতেই আমার ভাগ্যে সমস্যার শেষ নেই। আমার ছেলেদের কপালটাই পোড়া।”
.
.
নীরবকে জানানোর আধা ঘন্টার মাঝেই চলে আসে। এসেই প্রত্যাশাকে পাঁচ মিনিট সময় দেয় রেডি হতে। প্রত্যাশা উপায়ান্তর না পেয়ে রেডি হয়। নীরব আগে প্রত্যাশা পিছে। নীরবের আঙুলের ডগায় বাইকের চাবি। ঘুরাতে ঘুরাতে ভাবছে, দুশ্চিন্তা হচ্ছে। পিছুন থেকে শর্মিলা বলে উঠলেন,
-” নীরব, কী হয় ফোন করে সাথে সাথে জানাস কিন্তু।”
-” আচ্ছা।”
শর্মিলা এবারে একগাল হেসে বললেন,
-” আল্লাহর কাছে দোয়া করি, মিষ্টি হাতে যেনো ফিরিস।”
নীরব বিরক্ত হলো। এত তাড়াতাড়ি এমন কিছু হবে কী করে? তারপর প্রত্যাশাকে পিল দেয়া হয়েছে। নীরব তাই নিশ্চিন্তে আছে অমন কিছু নয়।
.
.
বাইক ছুটছে ব্যস্ত শহর দিয়ে। নীরব দৃষ্টি সামনে রেখেই আচমকা প্রত্যাশাকে জিজ্ঞাসা করল,
-” লাস্ট মেনস পিরিয়ড কবে ছিলো?”
-” গত মাসের পাঁচ তারিখ।”
-” আজকে চার তারিখ। তারমানে একমাস হয়নি।”
-” হুঁ।”
-” তাহলে টেনশনের কিছু নেই। বিয়ের ডেট বিশ তারিখ। আর এত তাড়াতাড়ি ফিজিক্যালি সিমটম প্রকাশ পায় না। অবশ্য কারো কারো ক্ষেত্রে একটু আগেই সিমটম প্রকাশ পায়, তবুও মিনিমাম এক সপ্তাহ তো পার হওয়া লাগে।”
.
ডক্টরের কাছে গেলেই এ টেস্ট সে টেস্ট এখন কমন বিষয়। কয়েকটা টেস্ট দেয়া হয় সাথে আলট্রাও করা হয়। রিপোর্টগুলো আসতেই প্রত্যাশাকে ফের ডাকা হয়। নীরব-প্রত্যাশা পাশাপাশি বসে। নীরব মনেমনে প্রে করছে সব যেন ওকে থাকে। মাঝ বয়সী ডক্টর তাহমিনা আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট হাতে নিয়ে দেখেই অমায়িক গলায় বললেন,
-” মিস্টার নীরব, কনগ্রাচুলেশন। আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।”
নীরব থমকে গেল। ‘আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন’ কথাটা কানে ঝিঁঝিঁ পোকার মতো ঝিনঝিন শব্দ তুলে বাজতে লাগল। স্তম্ভিত হয়ে বিমূর্ত চাহনিতে আকাশসম বিস্ময় নিয়ে প্রত্যাশার দিকে তাকায়। প্রত্যাশা মাথা নত করে হাতের তালু ঘষছে সমানে। ডাক্তার প্রত্যাশাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-” তোমার পিরিয়ড সাধারণত কতদিন পরপর হতো? মনে হচ্ছে সাইকেল ৩০ দিনের নয়।”
প্রত্যাশা আস্তে করে বলল,
-” প্রায় ২৫ দিনের মতো হতো, কখনো কখনো তারও আগে।”
-” যাদের সাইকেল একটু ছোট হয়, যেমন ২৫ দিন বা তার কম। তাদের ক্ষেত্রে ওভুলেশন একটু আগে হয়। তবে এটা নরমাল ব্যাপার।”
বিপি চেক করে বললেন,
-” পেশার লো, শরীর উইক। এইজন্য মাথা ঘুরে পরেছো। আমি কয়েকটা মেডিসিন লিখে দিচ্ছি, আর একটু নিয়ম মেনে চলবে। বিশ্রামে থাকবে, পুষ্টিকর খাবার খাবে। ঠিক হয়ে যাবে ইনশা-আল্লাহ।”
নীরবের বিস্ময়ের ঘোর কা’টছেই না। ও থম মে*রে আছে।
.
নীরব একটাও কথা বলেনি প্রত্যাশার সাথে। প্রত্যাশা ভয়ে ভয়ে আছে। না জানি কখন বকাঝকা শুরু করে দেয়। বাসায় ফিরতে ফিরতে গোধূলি হয়ে যায়। নীলাশা ড্রয়িংরুমে বসে। প্রীতিও মাত্র ফিরেছে। প্রত্যাশা মাথা নত করে ধীরে ধীরে যাচ্ছে। নীরব গটগট পা ফেলে রুমে যেতে থাকে। নীহারিকা জিজ্ঞেস করলেন,
-” ফোন দিলাম ধরলি না যে। ডাক্তার কী বলল?”
নীরব থেমে গেল। নীহারিকা ফের বললেন,
-” কী হলো কী হয়েছে? চুপ করে আছিস যে? কোনো সমস্যা?”
নীরব গম্ভীর স্বরে বলল,
-” প্রত্যাশা কনসিভ করেছে।”
আর বাড়তি একটাও টু শব্দটি না করে নীরব পা বাড়ায়। শর্মিলা বলে উঠলেন,
-” নীরব, খালি হাতে ফিরলি যে মিষ্টি কই? এত বড় সুখবর মিষ্টি ছাড়া দেয়? তোকে তো যাওয়ার সময়ই বলে দিলাম।”
নীরব রুমে গিয়ে হাতের ফাইল বিছানায় শব্দ করে রাখল। ছোটমার কথাগুলো কানে আসে তার। নীলাশার মুখে অন্ধকার নামল। না চাইতেও কোথাও একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব হতে থাকে। শর্মিলা প্রত্যাশার কাঁধ আগলে ধরে হাসি মুখে বললেন,
-” আলহামদুলিল্লাহ। কী যে আনন্দ লাগছে না!”
নীহারিকার চোখেমুখে আনন্দের ছাপ না পড়লেও ভেতরে ভেতরে খুশিই হলেন। ভাবলেন — এখন তো মানুষের নানান সমস্যা। তাড়াতাড়ি হয়েছে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। এমনিতেই বড় ছেলেটার কী থেকে কী হয়ে গেল। ভাবলে এখনো ফাপর ঠেকে। প্রত্যাশা ছোট, বুদ্ধি শুদ্ধি কম এই একটু দুশ্চিন্তা। তাতে কী হয়েছে? বাড়িতে সবাই আছে। বাচ্চা মানুষ করা সমস্যা হবে না।
নীহারিকা বললেন,
-” ডাক্তার আর কী বলেছেন? এমনি কোনো সমস্যা নেই তো?”
প্রত্যাশা কলের পুতুলের মতন মাথা নেড়ে বলল,
-” নাহ।”
নীলাশার চোখ ভিজে আসছিল। এখানে আর থাকতে না পেরে সন্তর্পণে উঠে রুমে চলে যায়। প্রীতি থ*ম মে*রে তাজ্জব বনে আছে। নীহারিকা বললেন,
-” রুমে যাও, বিশ্রাম নাও।”
রুমে গিয়ে বেডে পা ঝুলিয়ে বসে প্রত্যাশা। নীরব ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোয়। প্রত্যাশা শুকনো ঢোক গিলে আড়চোখে নীরবের দিকে তাকাল। নীরব কিছুই না বলে সোজা ব্যালকনিতে যায়। কিছুক্ষণ পরেই পরী ফল দিয়ে যায়। নীহারিকা পাঠিয়েছেন।
আরো মিনিট দশেক পরে নীরব রুমে ঢুকল। বেডের সামনে প্রত্যাশার মুখোমুখি দাঁড়াল। প্রত্যাশার নার্ভাসনেস শৃঙ্গে উঠল। আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্টটা বের করে হাতে ধরল। প্রেগনেন্সি পজিটিভ এটা দেখেই তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল নীরব। দাঁত কটমট করে বলল,
-” এটা কী করে হলো?”
ভেতরে ভেতরে ভ’য় পেলেও উপরে শক্ত খোলসে নিজেকে আবৃত করে প্রত্যাশা। নিজেকে সামলে চিরাচরিত স্বভাবটা ফুটিয়ে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! আপনার স্মরণ শক্তি সব লোপ পেয়েছে নাকি? ভুলে গিয়েছেন সব?”
নীরবের বেষম খাওয়ার উপক্রম হলো। হালকা কেশে জিজ্ঞেস করল,
-” উল্টাপাল্টা বাড়তি কথা না বলে, যা প্রশ্ন করছি সরাসরি উত্তর দাও; আমি তোমাকে *****প্যাকেট দিয়েছিলাম। তুমি ঠিকমতো খাওনি?”
প্রত্যাশা মুখটা লটকে ফেলল। বলল,
-” উঁহু। মেডিসিনে আমার এলার্জি। সর্দি জ্বরের ওষুধ আম্মু জোর করে দিতো। সেটাই চোখমুখ বুঁজে কোনো রকমে গিলতাম।”
একটু থেমে অ্যাক্টিং করে অনর্গল বলতে লাগল প্রত্যাশা,
-” আচ্ছা শুনেছি, টিভি সিনেমায় দেখিও মানুষ বাবা হওয়ার খবরে খুশি হয়। খুশিতে বউকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরায়। আর আপনি কী করছেন? মুখটা তো বাংলা পাঁচ বানিয়ে রেখেছেনই। আবার একের পর এক জেরা করছেন।”
নীরবের গলার স্বর এবারে একটু মিইয়ে এল। তবে চিন্তার সুরেই বলে,
-” প্রত্যাশা তুমি বুঝতে পারছো না, তুমি এখনো বেশ ছোটো, তারউপর অবুঝ। তোমার পড়াশোনাও এখনো অনেক বাকি। তুমি নিজেকেই সামলাতে পারো না। বাচ্চা কীভাবে সামলাবে?”
ফলের প্লেট থেকে এক টুকরো আপেল নিয়ে বাইট দিল প্রত্যাশা। গমগমে স্বরে বলল,
-” আমি ছোটো এটা এখন ভেবে কপাল না চাপড়ে। আপনার আরো আগে ভাবা উচিত ছিলো। আমি ছোট এটা সঠিক সময়ে যদি ভাবতেন। তাহলে এখন এসে হা হুতাশ করতে হতো না, হুঁ। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন।”
ডোন্ট কেয়ার ভঙিতে মুখে থাকা আপেল চিবুতে লাগলো প্রত্যাশা। এর সাথে বেশি কথা বললে নিজের মানসম্মান সব যাবে। এইভেবে নীরব থম মে*রে শুধু চেয়ে রইল।
.
.
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নীলাশা। রুমের দরজা হালকা চাপানো। প্রীতি দুই আঙুল দিয়ে টোকা দিল। নীলাশা চোখের অশ্রু মুছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অবাক হয়ে বলল,
-” তুমি?”
-” আসব?”
-” আসো।”
প্রীতি সোজা নীলাশার সামনে দাঁড়াল। এক আঙুলে কপাল চুলকিয়ে বলতে থাকে,
-” প্রত্যাশা তোমার আপন বোন নয়, রাইট?”
নীলাশা চমকে তাকায়। চোখে ওর প্রশ্নের ঝলক। নীলাশার চোখের প্রশ্ন পড়ে নেয় প্রীতি। নিঃশব্দে হেসে বলল,
-” আমি কীভাবে জানলাম সেটা বড় কথা নয়। কথাটা যে সত্যি সেটা আমিও জানি তুমিও জানো।”
নীলাশা এখনো নিশ্চুপ। প্রীতি ধীরেধীরে বলতে লাগলো,
-” এই বাড়িতে আমার অবস্থান তো জানোই। তোমার অবস্থানও যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে আইডিয়া আছে? এখন প্রথম প্রথম তোমার প্রতি সবাই সহানুভূতি দেখাচ্ছে। তবুও কিছু কিছু মানুষের কথা নিশ্চয় কানে ঢুকেছে? প্রত্যাশা প্রেগন্যান্ট। এ বাড়ির বংশের বাতি সে দিবে। তুমি তো আর কখনো দিতে পারবে না। সবাই তো প্রত্যাশাকে মাথাই তুলে রাখবে।”
থেমে নীলাশার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল প্রীতি। কথাগুলো ঠিক যায়গা মত লাগতে শুরু করছে। প্রীতি মনেমনে ভাবে— নীরবের বউয়ের প্রতি যে প্রেম। তারপর এখন আবার বউ প্রেগন্যান্ট। নীরব যে বউয়ের পাশে দাঁড়াবে নো ডাউট। তাই নতুন করে নীরবের রোষানলে পড়তে চাইছি না। এখন একমাত্র অ*স্ত্র নীলাশা। যা করার ওইই করবে। শুধু দেখে যাব।
___________
নীরব থম ধরে থেকে চলে যেতে নেয়। ঠিক তক্ষুনি প্রত্যাশা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। পিঠের সাথে মাথাটা ঠেকিয়ে কোমল স্বরে বলল,
-” আপনি খুশি হোননি? খুব কী বেশিই রেগে আছেন?”
নীরব উত্তর দেয় না। কিছুপল উত্তরের অপেক্ষায় থেকে প্রত্যাশা নীরবের সামনে দাঁড়াল। নীরব এখনো নির্লিপ্ত। প্রত্যাশা আস্তে করে নীরবের পায়ের পাতার উপর পা দু’টো রাখল। দুইহাতে গলা জড়িয়ে বলল,
-” এবারে সত্যিটা বলছি। ঔষুধে আমার এলার্জি আছে। তবে ইচ্ছে করে খাইনি এমন না। ঔষধটা খাব তখন কোনো এক আত্মীয় রুমে চলে আসে। হাতের প্যাকেট ফট করে বিছানার তলায় রেখে দিই। তারপর কথা বলে ওনারা বের হওয়ার পর আমার আর খেয়ালই থাকে না।”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
-” প্রত্যাশা তোমার মধ্যে এখনো যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি আসেনি। শুধু বাচ্চা জন্ম দিলেই হয় না। তাকে বড় করা, মানুষ করা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আমি মনে করি না তুমি এখন বাচ্চা সামলাতে পারবে। আরেকটা কথা আছে-‘আমাকে একজন সুশিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।’ কথাটা সত্যি। তোমার মধ্যে জানাশোনার অভাব আছে। তোমাকে পড়াশোনা করে জ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে হবে। একদিকে তোমার বয়স কম, অন্যদিকে পড়াশোনাও বাকি। তোমার জন্য এখন বাচ্চা নেয়ার উপযুক্ত সময় নয় প্রত্যাশা।”
প্রত্যাশা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। নীরব একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে,
-” বাচ্চা দু’জনের ভালোবাসায় যেমনি আসে, ঠিক তেমনি দুজনের ইচ্ছেতেও আসা জরুরী। সার্বিক দিক ভেবে আমি মনে করি___”
প্রত্যাশার বুকের ভেতর ঝড় উঠেছে। নীরব এভাবে বলবে কস্মিনকালেও ভাবেনি সে। কাঁপা ঠোঁটে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল,
-” কি?”
নীরব সোজাসাপ্টা বলল,
-” বাচ্চাটা অ্যাবরশন করাই বেটার।”
প্রত্যাশার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। চোখ ভিজে এল মুহূর্তেই। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-” নীর….ব।”
একহাতে মুখ চেপে ধরে প্রত্যাশা। কোনোরকমে ভেজা গলায় বলে,
-” নীরব এটা আমাদের প্রথম বাচ্চা। অ্যাবরশন মানে তো খু”ন করা। নীরব আপনি নিজের বাচ্চাকে খু*ন করার কথা বলছেন। আপনি এতটা কঠিন আমি ভাবতে পারিনি।”
-” আমরা আবার বাচ্চা নেবো। তবে দু’জনের সিদ্ধান্তে, সঠিক সময়ে। আগে তোমার পড়াশোনা শেষ হোক। তোমার মধ্যে সিরিয়াসনেস আসুক।”
প্রত্যাশা সবেগে দু’পাশে মাথা নাড়ল। চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে বলল,
-” আমি পারব না। এটা পা”প। আমি কিছুতেই এই পা”প করতে পারব না।”
নীরব কড়া গলায় বলল,
-” প্রত্যাশা আমি চাই না এখন বাচ্চাটা আসুক। আমার সাথে সংসার করতে চাইলে, আমি যা বলছি তাই করবে। বাড়তি কথা না বলে এখনই ডাক্তারের কাছে চলো। লেটস গো।”
ঘুমের মধ্যে অস্থিরভাবে নড়তে লাগল প্রত্যাশা। হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। চোখ মেলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে। বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ হচ্ছে। হাঁপাতে লাগলো মেয়েটা। এতক্ষণে ঠাহর করে এটা স্বপ্ন ছিলো। একটু শুয়েছিলো আর চোখটা লেগে আসতেই দুঃস্বপ্নটা দেখে। ফোনে সময় দেখে রাত নয়টা চল্লিশ বাজে। নীরব রুমে নেই। সন্ধ্যায় বেরিয়েছে এখনো ফেরেনি বোধহয়। নীরবের মুখে এক ফোঁটা হাসিও দেখা যায়নি, কেমন নির্লিপ্ত আছে। স্বপ্নটা আবার সত্যি হবে না তো?
চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে আলতো পায়ে রুম থেকে বেরোয় প্রত্যাশা। শাশুড়ির সাথে দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করলেন,
-” নীরব কোথায় গিয়েছে? রাত দশটা বাজতে চলল এখনো ফিরল না যে?”
-” কী জানি, বলে যায়নি তো।”
-” ফোন দিয়েছিলে?”
-” নাহ।”
-” ফোন করে শোনো কখন ফিরবে। ওর ফিরতে দেরি হলে তুমি সবার সাথে খেয়ে নাও।”
তন্মধ্যে নীরব আসে। দুইহাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেটে। শর্মিলা ডায়নিংয়ে খাবার সাজাচ্ছিল। দেখেই বললেন,
-” ওমা নীরব তুই তো দেখছি মিষ্টির দোকান টাই তুলে এনেছিস। পা’গ’ল ছেলে এত মিষ্টি কেউ আনে।”
নীরব কিছু না বলে প্যাকেটগুলো রাখল। নীহারিকা বললেন,
-” ছোটো সবাইকে মিষ্টি দে। আর সকালে প্রতিবেশীদের বাড়িতে দেয়া যাবে।”
নীলাশা রুম থেকে বেরোতেই এসকল দৃশ্য তার চোখে পড়ে। বুক ফুঁড়ে তার দীর্ঘশ্বাস আর এক বুক না পাওয়ার আফসোস জমতে লাগল। মনে হচ্ছে কষ্টটা কগুণ বাড়ছে, এসব দৃশ্য তাকে বেশি পোড়াচ্ছে।
____________
রাতের খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে প্রত্যাশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বিনুনি করছিল। নীরব ফ্রেশ হয়ে এসে বেডে বসতে বসতে হালকা গলায় শুধাল,
-” ঔষধ খেয়েছো?”
-” হুঁ।”
-” মনে করে ঠিকঠাক সময় মতো ঔষধ খেয়ো। তোমার তো আবার ভুলে যাবার রোগ আছে।”
নীরবের শেষোক্ত কথাটা যে ত্যাড়া সুরে বলা তা প্রত্যাশা ধরতে পারল। আর পারল বিধায় রাগ হলো। হেয়ার ব্যান্ড চুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে রাগী গলায় বলল,
-” আপনি যে একটুও খুশি হোননি সেটা আপনার মুখ দেখে আর কথা শুনেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লোক দেখাতে আর ছোটমা বলেছিল বিধায়ই মিষ্টি আনলেন। নিজ থেকে খুশি মনে তো আর আনেননি।”
একটু থেমে আকস্মিক প্রত্যাশা বলে উঠল,
-” নীরব আপনি কি সত্যিই চান না এই বাচ্চা? সন্ধ্যায় আমি এতকিছু বললাম, কিছুই বললেন না। এড়িয়ে গেলেন। তারপর সেই যে গেলেন মাত্র ফিরলেন।”
-” বাইরে হঠাৎ দু’জন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা। অনেকদিন পর দেখা, কথাবার্তা বলতে বলতে একটু দেরি হয়ে গেল। আর বাচ্চা চাই না মানে কী বলতে চাইছো?”
প্রত্যাশা মিনমিনে স্বরে বলে,
-” কেনো জানি ভ’য় হচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনি খুশি নন। যদি..যদি অ্যাবরশন করতে চান?”
নীরব ধ’ম’ক দিয়ে বলল,
-” পা’গল না হলে তুমি এমন ভাবনা আনতে পারো? অবশ্য তোমার মাথায় মাঝে মাঝে একটু-আধটু গোলমাল হয়। সেটা আমি জানি।”
প্রত্যাশা রাগী চোখে তাকাতেই নীরব হেসে ফেলল। হেসেই ঝটপট বলল,
-” স্যরি!স্যরি!”
প্রত্যাশা গাল ফুলিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলে নীরব ওর কব্জি ধরে টেনে সামনে দাঁড় করল। পরপর দুইহাতে কোমর জড়িয়ে একদম কাছে টেনে নিল। মাথাটা রাখল প্রত্যাশার বুকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধীরেধীরে গভীর কণ্ঠে বলল,
-” শোনো প্রত্যাশা একটা ছেলের কাছে বাবা হওয়ার সুখবরের চেয়ে বড় আনন্দ আর কিছু নেই। এই সুখটা হুট করে, অপ্রত্যাশিতভাবে এলো বলে আমি অবাক হয়েছি। নিজেকে ধাতস্থ করতে আমার সময় লাগছে। তুমি জানো আজকের দিনটা আমার জীবনের অবিস্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। আমি কতটা হ্যাপি বলে বোঝাতে পারব না।”
উষ্ণ একটা হাত প্রত্যাশার মসৃণ নরম তুলতুলে পেট ছুঁয়ে গেল। প্রত্যাশা চোখবুঁজে ফেলল। নীরব আলতো করে হাতটা বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” আমার র*ক্ত, আমার অংশ, তোমার গর্ভে। ভাবলেই আমার বুক ভরে যাচ্ছে আনন্দে। মনে একটুকরো শীতল প্রশান্তির স্রোত বইছে। নাম না জানা অনুভূতিতে আমি শিহরিত। আমার ফিলিংসটা আমি ঠিকঠাক ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারছি না। পৃথিবীর সবচেয়ে হ্যাপি নিজেকে মনে হচ্ছে।”
প্রত্যাশার ঠোঁটে হাসি ফুটল। বুকের উপর জমা দুশ্চিন্তার পাথরটা নিমিষেই হাওয়ায় উড়ার মতো উড়ে গেল। প্রত্যাশার একটা হাত নীরবের চুলের ভাঁজে যায়। প্রত্যাশা হাঁফ ছেড়ে আলতো গলায় বলল,
-” উফ্! টেনশন হচ্ছিল। যাক এবারে টেনশন ফ্রি হলাম।”
নীরব মাথাটা তুলে প্রত্যাশার মুখের দিকে চাইল। মুখে হাসি নিয়েই বলল,
-” তবে আমার কিন্তু টেনশন বাড়ছে। আমার বাচ্চাটাকে ঠিকঠাক সামলাতে পারবে তো তুমি?”
-” আমি না পারি, আপনি তো আছেন।”
বিনিময় ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসল নীরব। পরপর প্রত্যাশার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে টুপ করে পেটের উপর চুমু খায়। মিষ্টি আদুরে কণ্ঠে বলল,
-” হেই আমার ছোট্ট বেবি। মাই লিটল হার্টবিট তাড়াতাড়ি এসো। পাপা এখন থেকেই তোমার আগমনের প্রহর গুণা শুরু করে দিয়েছে। তোমাকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য পাপা পুরো হৃদয়টা প্রস্তুত করে রেখেছি। তুমি আসলেই আমাদের পৃথিবীটা সম্পূর্ণ হবে।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলল। নীরব ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিল। শেষে একটা গভীর চুমু এঁকে দুষ্টু আদুরে ভঙ্গিতে বলল,
-” তুমি আমার অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা। হেই লিটল হার্টবিট শোনো পাপার ভিতরে কিন্তু অজস্র এক্সাইটমেন্ট অলরেডি জমতে শুরু করেছে। তাড়াতাড়ি এসো। পাপা তোমাকে দুনিয়ার সব চুমু সব ভালোবাসা দিতে প্রস্তুত।”
__________
বিছানায় শুয়ে নীলাশা। দু’চোখের পাতায় ঘুম নামছে না। হঠাৎ বলে উঠল,
-” নিভান আম্মু বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলো। আমি বরং কিছুদিন বাড়ি গিয়ে থাকি।”
নীলাশার মনের অবস্থা নিভান বুঝতে পারছে। গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ যেন আরও বেশি ভেঙে পড়া, ক্লান্ত, বিমর্ষ লাগছে নীলাশাকে। অবশ্য লাগাটা অস্বাভাবিকও নয়। এই কষ্ট নিভানও জানে, এই অনুভূতির সাথে তারও পরিচয় আছে। অফিসে বসে সহকর্মীদের বাচ্চা নিয়ে হাসাহাসি, খুনসুটি শুনতে শুনতে তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। ওরা ফোনে বাচ্চাদের খবর নেয়, অফিস শেষে ছুটে বাড়ি ফেরে। এইসব তো নিভানেরও চাওয়া ছিল একসময়। কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর হাতে সে স্বপ্ন ভেঙে গেছে।
প্রত্যাশাকে সামনে দেখলে নীলাশার কষ্ট আরও বাড়বে, ভেতর থেকে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। তাই নিভান মনেমনে বদলি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নিভান নিম্ন স্বরে বলল,
-” অফিস থেকে যেকোনো সময় আমার বদলির নির্দেশ আসতে পারে। একবার নির্দেশ এলে বাসা দেখে তোমাকে নিয়ে যাবো। কিন্তু প্লীজ, আর মন খারাপ করে থেকো না। তুমি যদি সবসময় এমন মুখ করে থাকো, বলো তো সেটা আমার ভালো লাগে নাকি? সত্যি বলো ভালো লাগে?”
নিভানের বুকের উপর মাথাটা রেখে নীলাশা উদাস গলায় বলল,
-” প্রত্যাশাটা কত লাকি। আর আমি?”
মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে অবচেতনেই বলে নীলাশা,
-” সারাজীবন এর জন্য প্রত্যাশার থেকে পিছিয়ে গেলাম। হেরে গেলাম আমি। আমার মনেহয়, প্রত্যাশাকে সবসময় হেয় করা, ওকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার জন্যই প্রকৃতি থেকে শা”স্তি পাচ্ছি।”
____________
তিন-চারদিন পর…
প্রত্যাশা দু’দিনের যায়গায় তিনদিন আছে ও বাড়ি। নীরব সকালে ফোন দিয়ে বলে–আজকে ব্যস্ত থাকবে। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে। তাই প্রত্যাশাকে আনতে যেতে পারবে না।
শুনে তো প্রত্যাশা খুব খুশি হয়। যাকগে সে আরো একটা দিন বেশি থাকতে পারবে। ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই প্রত্যাশার সে খুশি উবে যায়। নীরবের পরবর্তী কথা থাকে– বাবা দুপুরে যাবে। বাবার সাথে চলে আসবে।
লোকটা আচ্ছা খারাপ লোক। বাড়তি একদিনও তার সহ্য হচ্ছে না। প্রত্যাশা না না করে। কাটকাট গলায় বলে– আপনি আসলে তবেই যাব। বাবাকে বলুন, এমনি ঘুরে যেতে। আমি আজ থাকব। যেতে-টেতে পারব না।
নীরব ভণিতা ছাড়া সোজাসুজি বলে– চলে আসবে।
প্রত্যাশা গাল ফুলিয়ে থাকে। আম্মু বুঝিয়ে বলে তারপর সে আসে।
এসেই রুমটা অগোছালো পায়। সোফায় নীরবের টিশার্ট, শার্ট-প্যান্ট পরে আছে। বিছানার চাদর ঘুচানো। বেডশিট তুলে কাচা বেডশিট টানটান করে পারল, পিলো কাভার ভরল। শার্ট-প্যান্ট গুছিয়ে পরপর বেডশিট ওয়াশিংমেশিনে দিয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে পারফিউম গুলো গুছিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখল। অবশেষে ফ্রেশ হয়ে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে শোয়।
আম্মু কয়েক রকমের আচার দিয়ে দিয়েছে। আচারের বয়ামটা পাশে রেখে খেতে খেতে ফোনটা হাতে নিয়ে নীরবের নম্বরে ভিডিও কল দেয়।
বউয়ের ভিডিও কল দেখেই হাতের ফাইল দূরে ঠেলে কল তুলল নীরব। প্রত্যাশার হাতে আমের মোরব্বা একটু মুখে নিতেই ফোনের স্ক্রিনে নীরবের ছবি ভেসে উঠল। প্রত্যাশা মিষ্টি হেসে লম্বা করে সালাম দিল,
-” আসসালামুয়ালাইকুম এএসপি সাহেব। খুব ব্যস্ত আছেন?”
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম মাই মিসেস। উঁহু! এতক্ষণ ব্যস্ত ছিলাম। এখন সব ব্যস্ততা একদিকে আর বউ আরেকদিকে। আমি আবার বউয়ের দিকেই।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলল। বলল,
-” লাঞ্চ করেছেন?”
-” হুঁ।”
-” তো বেবির পাপা ফিরছেন কখন?”
-” বেবির মাম্মা কী আমাকে মিস করছেন?”
-” নাহ।”
নীরব কণ্ঠে আফসোস মিশিয়ে ফাজলামো করে বলল,
-” ভেরি ব্যাড।”
প্রত্যাশা ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। নীরব জিজ্ঞাসা করল,
-” কখন এসেছো?”
-” তিনটার দিকে।”
-” বাসায় ফেরার সময় তোমার জন্য কী আনব? আইসক্রিম বাদে অন্যকিছু বলবে কিন্তু।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে ফেলল।
-” উম, লাগবে না কিছু।”
-” আচ্ছা যাও বলতে হবে না। তোমার ফেভরিট রসমালাই হলে চলবে?”
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা শেষে কল কা*টে।
.
.
সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছে নীলাশা। প্রত্যাশা কিচেনের দিকে আসতেই নীহারিকা দেখে বারণ করলেন। কিচেন থেকেই সেই কথা নীলাশার কানে গেল। এসব কিছু নীলাশার কাছে আদিখ্যেতা মনে হচ্ছে। প্রত্যাশা আপুকে সাহায্য করবে বলে আসলো। প্রত্যাশা আসতেই নীলাশা বলল,
-” মা বারণ করল, আবার আসতে গেলি কেনো? যা রুমে গিয়ে শুয়ে থাক। তোরই তো কপাল।”
প্রত্যাশা গায়ে না মেখে বলল,
-” আপু দাও আমি পেঁয়াজ কুচি করে দিই। তোমার ঝাঁঝ লাগছে দেখছি।”
পেঁয়াজ কুচি করতে গিয়ে নীলাশার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে মুছে নিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-” তোকে কাজ করতে দিয়েছি দেখলে বাড়ির সবাই আমাকেই কথা শোনাবে।”
কথাটা বলতে বলতে নীলাশা –‘আহ’ শব্দ করে ওঠে। ছু’রিতে আঙুল কে”টে যায়। মূহুর্তেই র*ক্ত বেরোতে থাকে। প্রত্যাশা আর্তনাদ করে ওঠে,
-” ইয়া আল্লাহ, হাত কে”টে নিলে তো। দাঁড়াও আমি ফাস্ট এইড বক্স আনছি।”
এই বলে দ্রুত রুমে যায় প্রত্যাশা। ফাস্ট এইড বক্স হাতে হন্তদন্ত পায়ে কিচেনে ঢুকতে গিয়ে ফ্লোর ভেজা ছিলো স্লিপ খায়। অল্পের চেয়ে পরতে পরতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেয়। নীহারিকাও মাত্রই এসেছেন। এই দেখে অসন্তুষ্ট চাহনিতে চেয়ে হৈচৈ করে উঠলেন,
-” ইয়া মাবুদ, এখনি তো যাচ্ছিলে পরে। এইসময় এত দৌড়াদৌড়ি কেউ করে। তোমাকে নিয়ে আর এমনি এমনি তো টেনশন হয় না। কোনদিন কী অঘটন ঘটিয়ে বসো আল্লাহ জানে।”
প্রত্যাশা বুকে হাত দিয়ে দম ফেলে বলল,
-” কিছু হয়নি মা। ঠিক আছি আমি।”
নীলাশা আঙুল ধরে দাঁড়িয়ে। অনেকটাই কে”টেছে। নীহারিকা তাকে বলে উঠলেন,
-” আর নীলাশা তোমাকে বলি, কীভাবে কাজ করো? একটু কাজ করতে এসেই অকাম করে বসে থাকো। আরো ঝামেলার সৃষ্টি করো।”
শাশুড়ির কথা শুনে সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে প্রত্যাশার উপর বর্তায়। এখন মনে হচ্ছে — প্রীতি ঠিকই বলেছে সবার চোখের মণি প্রত্যাশাই হবে। বাচ্চা হয়নি, হবে তাই এই অবস্থা। বাচ্চা হলে তো মনেহয় তাকে কেউ দেখতেও পারবে না।
প্রত্যাশা এক টুকরো তুলোতে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে নীলাশার আঙুল ধরতেই সে এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিল। রুক্ষ স্বরে বলল,
-” সর তুই, নাটক করিস না। তোর নাটক আমার সহ্য হচ্ছে না। তোর এই ভালো মানুষি স্বভাব অন্যদের দেখাস, আমাকে নয়।”
প্রত্যাশা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। নীহারিকা বিরক্ত গলায় বলেন,
-” নীলাশা এটা কী ধরণের আচরণ? ছোট বোনের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে। শুধু আজ নয়, এর আগেও আমি লক্ষ্য করেছি। আমার নজর এড়ায়নি। তুমি প্রত্যাশার সাথে শুধু শুধু কেমন রুঢ় আচরণ করো। আমি আর ছোট জা। কখনো দেখছো এভাবে কথা বলতে? বাড়িতে সবার আচরণ কেমন, সেটা দেখেও তো শিখতে পারো। তোমার জন্যই এখন একটা দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। আল্লাহ বাঁচিয়েছেন। তারপরেও তুমি…ছিহ। নিজের ছোট বোনের সাথে কেউ কখনো এরকম বিহেভ করে?”
নীলাশার ভেতরের রাগ-ক্ষোভ, ক্রোধ, হিংসা সব যেন একসাথে দপ করে জেগে উঠল। শাশুড়ি আগে কখনো এভাবে বলেনি। আজ বললেন। তাও শুধু… শুধুই প্রত্যাশার জন্যে। নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাশা চেঁচিয়ে উঠল,
-” কীসের ছোট বোন। ওর জন্মই হয়েছে আমার থেকে সবকিছু কেড়ে নেয়ার জন্যে। আমার আব্বু-আম্মুর আদরে ও উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। এখন আবার আমার শ্বশুরবাড়ির সবার কাছে আমাকে খারাপ বানাচ্ছে। নিজে প্রিয় হচ্ছে।”
চেঁচামেচি শুনে শর্মিলা প্রীতি এসে দরজায় দাঁড়ায়। নীহারিকা বললেন,
-” মনে হচ্ছে মাথা গেছে তোমার। তোমার আব্বু আম্মুর আদরে ও উড়ে এসে ভাগ কেনো বসাবে। কী বলছো না বলছো নিজেই জানো না। আশ্চর্য!”
প্রত্যাশা ছলছল চোখে চেয়ে। এত চেঁচামেচি মনে হচ্ছে তারজন্যই হচ্ছে। খারাপ লাগছে। প্রীতি মনেমনে ভাবছে– নীলাশা বলে দেয় না কেনো? এই মেয়ে এখনো চুপ আছে কেনো? আজব তো!
নীলাশার গাল গড়িয়ে জল পরছে। প্রীতি ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় ইন্সপায়ার করতে থাকে। এখনো চুপ দেখে প্রীতি ভাবে; এবারে সে নিজেই বলে দিবে কী? প্রীতির তো আবার পিছুটান নেই। যার কিছুই নেই, তার তো হারানোর ভ’য় নেই। এমনিও এ বাড়ির লোক তাকে তেমন পছন্দ করে না। যা ভাবার ভাবুক গে।
প্রীতি মুখ খুলবে তার আগেই নীলাশা বলে উঠল,
-” আমি ঠিকই বলছি। ও উড়ে এসেই জুড়ে বসেছে। প্রথমে আমার আব্বু আম্মুর কাছে আমার থেকেও ও প্রিয় হয়েছে। এখন আবার আমার শ্বশুরবাড়িতে সবার কাছে ও প্রিয় হচ্ছে। ও আমার জন্য অভিশাপ।”
নীহারিকা ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,
-” নীলাশা। এবারে থামো। নিজের আপন বোনকে কেউ এতটা হিংসা করতে পারে তোমাকে না দেখলে জানতাম না।”
নীলাশা ভেজা কণ্ঠস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,
-” প্রত্যাশা আমার আপন বোন নয়। ওর সাথে আমার কোনো র’ক্তের সম্পর্ক নেই। অন্যকারো পাপের ফল, আমার আব্বু-আম্মু দয়া দেখিয়ে ওকে নিজের সন্তানের মতো করে বড় করেছে।”
প্রত্যাশা থমকে গেল। মনে হচ্ছে ভূমিকম্প হচ্ছে, পুরো পৃথিবী টলছে। আচমকা দু’পা পিছিয়ে যায় প্রত্যাশা। এতবড় কথা কেউ কখনো মিথ্যে, বানোয়াট বলে না। নীহারিকার মাথায় মেঘ বিনা বজ্রপাত হলো যেন।
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
প্রত্যাশা থমকে গেল। মনে হলো ভূমিকম্পে সব কেঁপে উঠেছে। গোটা পৃথিবী যেনো ভেঙে পড়ছে। পায়ের তলা ফাঁকা হয়ে যায়। দু’পা পেছাতেই পিঠ দেয়ালে ঠেকল। নীহারিকা একবার প্রত্যাশার দিকে আবার নীলাশার দিকে ভালো করে তাকালেন। কণ্ঠে অবিশ্বাস মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-” নীলাশা এসব কি সত্যি?”
নীলাশা মাথা নিচু করে ফেলতেই চিবুক গিয়ে বুকে ঠেকল। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না। রাগের মাথায় বলে ফেললেও এখন যেন হুঁশ ফিরল। প্রত্যাশা চোখে টলমলে অশ্রু নিয়ে আপুর দিকে চেয়ে। অবচেতনে বুকের ভেতর থেকে শুধু একটাই প্রার্থনা উঠে এল–আপু একবার বলো এসব সত্যি নয়। যা বললে সেসব মিথ্যে।
নীলাশাকে চুপ দেখে নীহারিকা এবারে গলা চড়িয়ে বললেন,
-” চুপ করে থেকো না নীলাশা। যা জিজ্ঞেস করছি জবাব দাও। এত বড় কথা কেউ এমনি এমনি মুখ ফস্কে বলে না। সত্যিটা তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।”
নীলাশার হাত-পা মৃদু কাঁপছে। প্রীতি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠল,
-” চুপ করে আছো কেনো? সবটা বলো…বলো সত্যিটা। আর একটা কথা সবাই জানে সত্য কখনো চাপা থাকে না। একদিন না একদিন সবাই জানতোই। আমি নিজেও জানি। অথচ তুমি আমাকে বলোনি, তবুও জেনেছি। ভ’য় না পেয়ে যা জানো সবটা বলো।”
নীহারিকা বিস্ময়ে প্রীতির দিকে তাকালেন,
-” তুমি জানো মানে?”
প্রীতি মুখটা ইনোসেন্ট বানিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে,
-” মা ওদের বিয়ের দিন কথাটা আমার কানে আসে। এক বৃদ্ধা মহিলা প্রত্যাশার মাকে বলছিলেন। তখনই বুঝেছিলাম প্রত্যাশা ওনাদের নিজের মেয়ে নয়। আমি ভেবেছিলাম আপনারা হয়তো জানেন। এত বড় কথা কি আর গোপন রাখা যায়। এতবড় একটা বিষয় আড়াল করে লুকিয়ে-চুরিয়ে বিয়ে দেয় নাকি কেউ। এরকম করা তো প্রতারণা, ঠকানোর শামিল। ওনাদেরকে যথেষ্ট ভদ্রলোক মনে হয়েছে। ভাবলাম সবটা জানিয়েই হয়তো বিয়ে দিচ্ছেন। তাই আর কথাটা তুলিনি। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনারা কিছু জানেনই না। মা আপনি যেহেতু জানেন না। আমার মনেহয় নীরবকেও জানানো হয়নি।”
প্রত্যাশার বুক ভেঙে আসছে কান্নায়। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে আছে। নীহারিকা কঠিন গলায় নীলাশাকে বললেন,
-” নীলাশা, এভাবে চুপ থেকে আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিও না। সবটা বলো, নইলে আমি এক্ষুনি তোমার আব্বু-আম্মুকে কল করতে বাধ্য হবো।”
নীলাশা শাড়ির আঁচল শক্ত করে মুঠোয় ধরল। মাথা নেড়ে কম্পমান স্বরে বলল,
-” হ-হু… সত্যি।”
প্রত্যাশা মূহুর্তেই পাথর বনে যায়। শুধু চোখ দিয়ে টলটল করে অশ্রু গড়াতে লাগল। অথচ মুখ থেকে একটি শব্দও বেরোলো না। শর্মিলা এগিয়ে প্রত্যাশাকে আগলে নিলেন। কী বলে সান্ত্বনা দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। প্রত্যাশাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,
-” তাহলে প্রত্যাশার আসল পরিচয় কী? ওর বাবা-মা কে? আমার তো মনে হচ্ছে তোমার সব জানা।”
প্রীতির খুব কৌতুহল হচ্ছে। প্রত্যাশার আসল পরিচয় জানতে। সমস্যা এই নীলাশার থেকে তো ধ’ম’ক দিয়ে দিয়ে কথা বের করতে হচ্ছে। এইভেবে প্রীতির খুব বি’র’ক্ত লাগলো। প্রীতির আর তর সইছে না। প্রীতি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট না করে সবটা বলাই ভালো। এমনিতেও সবাই এখন জানবে। মা আপনি না হয় অধরা আন্টিকে কল করুন। আন্টির থেকেই জেনে নিন।”
নীহারিকা ধমকের সুরে বললেন,
-” তুমি থাম।”
প্রীতির গায়ে লাগল। ফর্সা মুখটায় নিমিষেই অন্ধকার নামল। রেগে ভাবল– এক পা কবরে যাওয়ার অবস্থা হলো, তবুও এখনো একটুও দেখতে পারেন না। এইযে এসেছি অবধি কত সুন্দর আচরণ শো করছি। তবুও মন পাওয়া তো দূর, ভালো মুখে দু’টো কথা পর্যন্ত বলেনি। ডিজগাসটিং।
নীহারিকা গম্ভীর মুখে বললেন,
-” নীলাশা তুমি নির্ভয়ে সবটা বলো। আমি জানতে চাই সবটা। আশা রাখছি কোনোকিছু না লুকিয়ে, মিথ্যেও না বলে শুধু সত্যিটুকু বলবে। কারন সবশেষে সত্য প্রকাশ হয়ই। এটাই ধ্রুব।”
নীলাশা দৃষ্টিজোড়া ফ্লোরে নিবদ্ধ করে মিহি কণ্ঠস্বরে বলতে লাগল,
-” আমার যখন সাত বছর বয়স সেইসময় আমার মৃ*ত বোন হয়। আম্মু অসুস্থ থাকায় হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। সেই সময় প্রত্যাশাকে হাসপাতাল থেকে পায়। প্রত্যাশাকে জন্ম দিয়ে ফেলে তারা পালিয়ে যায়। আম্মুর বাচ্চাটাকে দেখে মায়া হয়। আম্মু নিয়ে আসে। আম্মুর এক ফুপু হাসপাতালে সাথে ছিলেন। উনি জানতেন আর আমার দুই মামা এক মামী জানে। এছাড়া আব্বু-আম্মু কাউকে জানতে দেয়নি।”
নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,
-” ওর বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি? পুলিশ কেস হয়েছিল না?”
-” পুলিশ কেস হয়েছিল কী না আমি জানি না। তবে জানি হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তার আর নার্সদের মাধ্যমে আম্মু বাচ্চাটাকে নিয়ে নেয়। বাচ্চাটা ক্ষুধার্ত ছিলো খুব কাঁদছিল। আম্মু সেচ্ছায় দুধপান করায়। ডিউটির নার্সরাও যেন আম্মুর কাছে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ক্লাস সিক্সে থাকতে আমি এসব জানি। আগে জানা ছিলো না। ছোটো মামী মামার কাছ থেকে একটু শুনেছিলেন। আম্মুকে প্রত্যাশার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। সেদিন আম্মু মামীকে বলছিল। আর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমি সবটা শুনে ফেলি।”
নীলাশা থামল। নীহারিকা জোরেজোরে নিঃশ্বাস ফেলে ফের শুধালেন,
-” ওর বাবা-মার পরিচয় কী?”
-” আমি জানি না।”
নীহারিকা বজ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-” নীলাশা তুমি সব জানো। মিথ্যে বলবে না। একটু আগেই বলেছিলে ‘অন্যের পাপ আমার আব্বু-আম্মু দয়া দেখিয়ে বড় করেছে।’ অতএব না জানার নাটক করবে না। তোমার থেকে এমনটা আশাকরি না।”
নীলাশা জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে অতীতে ডুব দিলো।
মেয়েটির নাম স্বপ্না। গায়ের রং হালকা চাপা, মুখের কাটিং সুন্দরই ছিলো নাকি। জন্ম দেয়ার সময় মায়ের প্রাণ যায়। ছোট থেকেই নানীর কাছে বেড়ে উঠেছে। বাবা আবার বিয়ে করে সংসার পাতেন। কখনো ফিরেও চায়নি। নানার ছোট্ট চায়ের দোকান। নানীর কাছে অভাব অভিযোগ নিয়েই বড় হওয়া। স্বপ্না পড়াশোনায় মিডিয়াম ছিলো। তবে চা বিক্রেতা নানার কাছে সেটাই অনেক বড় কিছু। কষ্ট করে নাতনিকে কলেজে ভর্তি করান। দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে স্বপ্নার প্রেমের সম্পর্ক হয় বড় লোকের ছেলের সাথে। ছেলেটি সম্পর্কে বোকা স্বপ্না অবগত ছিলো না। ছেলেটির চরিত্র মোটেই ভালো ছিল না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রুমডেট করে। মেয়েটি আবেগের বয়সে পা*পে সায় দিয়ে বসে। যেই পা*পে তার ফুলের মতোন জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। পা*প পা*পই। পা*পের পরিণয় হয় ভয়াবহ। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া, দাপট নিয়ে চলা ছেলেটি স্বপ্নাকে ছু*ড়ে ফেলে। স্বপ্না বিয়ের কথা তুললেই ছেলেটা অট্টহাসিতে ফেটে পরে —
-” যে মেয়ে একজনের কাছে শরীর দিতে পারে, সে আর কতজনের কাছে দিয়েছে হিসেব আছে নাকি! আর তোমার মতো একটা চা-ওয়ালীর নাতনিকে বিয়ে করব আমি? হাউ ফানি! তোমাকে বড়জোর আমার বাড়ির মেইড বানানো যায়। কত টাকা চাই? একদিন বেডে এসেছো, দশ হাজার চলবে?”
স্বপ্না লজ্জায়, অপমানে মুখ খুলতে পারে না। নিজের উপরই তার ঘেন্না হচ্ছে। তবুও বলে,
-” আমাকে ভালোবাসেন সেসব মিথ্যে ছিল? আপনি নিজেই জোর করেছিলেন। এ-ও বলেছিলেন দু’দিনের মধ্যেই বিয়ে করবেন।”
ছেলেটির অপমানমূলক কথার তোপে টিকতে না পেরে স্বপ্না কাঁদতে কাঁদতে ফেরে। গলায় ফাঁস দিতে যায়। নানী দেখে আঁটকে দেয়। এরপর সেই পা*পের ভার বাড়তে লাগলো। প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে যখন বুঝল তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। জানতে পারে চার মাসের প্রেগন্যান্ট। এবারে সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিল। রাখে আল্লাহ মা*রে কে? কথাটা ফলে যায়। গলায় ফাঁ’স নিয়ে খানিকটা জিভ বেরোলেও বেঁচে যায়।
স্বপ্না এবারে ট্রমায় চলে যায়। কারো সাথে কোনো কথা বলত না। সারাটা সময় রুমেই থাকত। এরপর ঘনিয়ে এল ডেলিভারি ডেট। নানী কৌশলে সদর হাসপাতালে নেয়। রাতের অন্ধকার আকাশে ঝলমলে চাঁদের আলোর মতো জ্বলজ্বলে একটা চাঁদ মুখের মেয়ে শিশুকে স্বপ্না জন্ম দেয়। নানীর অভাবের সংসার। এখন আবার আপদ আসতে যাচ্ছে। তাও আবার পা*প। বৃদ্ধা নানী প্লান আঁটে। কোনো রকমে বাচ্চাটাকে ফেলে স্বপ্নাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালালেন। এই পা*প, আপদ ফেলে যেন হালকা হলেন। কিন্তু সেই হালকা হওয়া বেশিক্ষণ টিকলো না। সেই রাতের শেষ ভাগে অতিরিক্ত র*ক্তক্ষরণে স্বপ্না মৃ*ত্যু*র কোলে ঢোলে পরে।
দুমাস খানেক পর নানী হাসপাতালে আসেন। অনেক কষ্টে হাসপাতালের ঝাড়ুদারের মাধ্যমে সাহায্য নিয়ে বাচ্চাটিকে কে নিয়েছেন তার ঠিকানা বের করেন। আসেন অধরার কাছে। সবটা বলেন। বাচ্চাটা যে অধরার কাছে ভালো থাকবে এতটুকু ঠিক বুঝলেন। নিজের পা*পের জন্য অনুশোচনা আর দুঃখ প্রকাশ করে সব ঘটনা অধরাকে জানায়। অধরা জিজ্ঞাসা করেন,
-” আপনার নাতনি পা”প করেছে। সেও দোষী। তা হলেও সেই ছেলের নামে মামলা কেন করলেন না?”
-” গরীবের আবার মামলা। পুলিশের কাছে গেইলে উল্টা ভ’য় দেখাইয়া চাপে রাখতো। ভয়ে যাই নাইকা। সেই পোলা মেয়র আজিম খানের ছোডো ভাই আবির খান। মামলা করতে গেছি হুনলে পোলাপান লইয়া আইয়া চায়ের দোকান তো ভাঙবোই। ঘরে আ*গুন দিতো। ডরে কিচ্ছু কইতে পারি নাইকা।”
নীহারিকা আঁটকে গেলেন নাম দুটোয়। প্রীতি চমকে তাকাল। মেয়র আজিজ খান তার বড় মামা ছিলেন। আর ছোট মামা আবির। অবাক হলো না প্রীতি। সে জানে ছোট মামার চরিত্র সম্পর্কে। মরহুম হওয়ার পরেও শয়তানটাকে প্রীতি দেখতে পারে না। ওই শয়তানটার জন্য বাবাকে হারাতে হয়েছে, মা পঙ্গু হয়েছে। তানিয়ার বিয়েও খান পরিবারেই হয়। চাচাতো ভাইয়ের সাথে। বেশ কয়েক বছর আগে আবির ড্রাইভিং করছিল গাড়িতে তানিয়া আর ওনার স্বামী ছিলেন। ড্রাঙ্ক অবস্থায় থাকায় এক্সিডেন্ট করে বসে। সেই এক্সিডেন্টে ছোটো মামা, আর বাবা প্রাণ হারায়। তবে মা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। তবে সারাজীবনের জন্য পা হারাতে হয়।
প্রীতি ঘনঘন চোখের পলক ফেলে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। সম্পর্ক যেনো নিমিষেই পাল্টে গেল। প্রত্যাশা খিচে চোখ বুঁজে নিল। নিজের র*ক্তে*র উপর ঘেন্না হচ্ছে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। দুই হাতে মুখ চেপে ধরল প্রত্যাশা। গাল ভিজে গলা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বোবা কান্নায় মেয়েটা বারবার ফুঁপিয়ে উঠছে।
নীহারিকা বাকশুণ্য, হতভম্ব। বুকের উপর হাত চেপে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
-” ছিঃ ছিঃ এতবড় একটা জঘন্য বিষয় জানায়নি। আর এই দুনিয়ায় কী মেয়ের আকাল পড়েছিল? ঘুরেফিরে আমার শত্রুর পরিবারের মেয়েদেরই এ বাড়ির বউ হতে হয়। যেখানে আমি প্রীতিকেই মেনে নিতে পারিনি। সেখানে এই অ”বৈধ, পা*পকে কী করে সহ্য করব। তাও আবার আমার নীরবের বউ হিসেবে। শফিক সাহেবকে এর জবাবদিহিতা করতে হবে। তোমার আব্বুকে এক্ষুনি ডাকো।”
প্রত্যাশার ম*রে যেতে ইচ্ছে করল। নীহারিকা রুমের দিকে যেতে লাগলেন। শর্মিলা প্রত্যাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা আমরা তোমার পাশে আছি। আমি এক্ষুনি নীরবকে ফোন করছি। আমার বিশ্বাস নীরব তোমার পাশে থাকবে।”
প্রত্যাশা মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে ভাবল—এখন আমার কাছে দিনের আলোর মতো সবটা পরিষ্কার। নীরব নিজেই আমার জেনেটিক, র*ক্ত নিয়ে কথা বলেছেন। তারমানে নীরব সবটা জানে। নীরব আমার কু'”ৎ”সিত জন্ম পরিচয় জেনেই দয়া দেখিয়েছেন। দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছেন উনি। যার জন্ম, অতীত এমন নোং/রা সেটা জেনেশুনে বিয়ে করা আসলেই মহান লোকের কাজ। আর নীরব মহান সেজে দয়া করেছেন আমাকে।
প্রত্যাশাকে নিয়ে সোফায় বসান শর্মিলা। প্রত্যাশা বিমূর্ত হয়ে হাঁটুতে কনুই রেখে দুইহাতে মুখ চেপে অঝোরে কাঁদছে।
নীহারিকা ফোন নিয়ে শফিক সাহেবের কাছে কল দিলেন। শর্মিলা বারণ করলেন সেসব শুনলেন না। এদিকে শর্মিলা কী করবেন ঠাওর করতে পারছেন না। ত্রস্ত নীরবের কাছে কল দিলেন। রিং হচ্ছে রিসিভ করছেন না। মাহবুব সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন। ফোনটা রেখে গেছেন। উনি সাধারণত ফেরেন একেবারে এশার নামাজ আদায় করে। শর্মিলা বিরক্ত হয়ে নিজে নিজেই বললেন— বিপদের সময় কাউকে ফোনে পাওয়া যায় না। নীরবকে ফোন দিচ্ছি তুলছেই না। ভাইজানও ফোন রেখে গেছেন দেখছি। ভাবীকে একমাত্র নীরবই সামলাতে পারবে। ওর আসাটা খুব জরুরী।
উপায়ান্তর না পেয়ে নিভানকে ফোন করল। নিভান আসছি বলল। শফিক সাহেব রিসিভ করতেই নীহারিকা রাগ-ক্ষোভ নিয়ে বলেন,
-” কী করে পারলেন এমন একটা…”
এতটুকু বলে থেমে গেলেন। জোরেজোরে শ্বাস নিতে লাগলেন নীহারিকা। শর্মিলা ফোন কেড়ে নিলেন। ভাবী রাগের মাথায় কী না কী বলে ফেলে; এইভেবে শর্মিলা ফোন নিয়ে ধীরেসুস্থে সবটা বলেন। ওদিকে সবটা শুনে অধরা বলে সেও যাবে। মেয়েটা অসুস্থ, এখনই এসব হওয়ার ছিলো। সব রাগ গিয়ে নীলাশার উপর জমে।
মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে নীহারিকা। প্রত্যাশা ওভাবেই বসে কাঁদছে। নীলাশার চোখ ভেজা। সে একপাশে থম মে*রে দাঁড়িয়ে। প্রীতি বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে।
বিশ মিনিট খানেকের মধ্যেই শফিক সাহেব আর অধরা আসেন। শফিক সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সোফায় বসা মেয়েকে দেখেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো। ডেকে উঠলেন,
-” প্রত্যাশা মা?”
প্রত্যাশা মাথা তুলে তাকাল। ছুটে বাবার বুকের উপর পড়ল। জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মুখটা তুলে বাবার মুখের দিকে চাইল। ব্যাকুল স্বরে বলল,
-” আব্বু আপু যা বলছে বলো সব মিথ্যে। আমি তোমার মেয়ে। তোমারাই আমার বাবা-মা। আপু আমাকে দেখতে পারে না জন্যই এমন মিথ্যে বানিয়ে বলছে, তাই না আব্বু? তুমি বলে দাও আমি তোমাদেরই মেয়ে।”
প্রত্যাশার মন মানতে চাইছে না। ওই সত্যিটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। এখনো মনটা চাইছে সব মিথ্যে হোক। এরমধ্যে ঠাসঠাস শব্দে সবাই চমকে উঠল। অধরা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে সোজা চ’ড় দিলেন নীলাশার গালে। নীলাশা অবাক চোখে চেয়ে বলল,
-” আম্মু।”
আরেকটা চ’ড় বসিয়ে অধরা রুষ্ট গলায় বললেন,
-” একদম আমাকে আম্মু ডাকবি না। তোর মতো একটা হিংসুটে মেয়েকে পেটে ধরে আমার লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। এতটা হিংসা তোর ভেতর? এখন মা হয়েও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি; নিজে মা হতে পারবি না জন্যই তোর সহ্য হচ্ছিল না প্রত্যাশার সুখ। তাই তো তুই এরকম করলি। তোর ভেতর যদি একটু মনুষ্যত্ব থাকতো তুই এই মূহুর্তে বলতিস না। এটা জানার পর এই মূহুর্তে প্রত্যাশার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে একবার ভাবতে পারছিস? অথচ এই সময় ওকে হাসিখুশি প্রফুল্ল রাখা দরকার।”
নীলাশা ভেজা গলায় বলল,
-” আ-আম্মু..”
অধরা হাত তুলে বললেন,
-” চুপ..”
নীহারিকা বলে উঠলেন,
-” শুধু শুধু ওর উপর কেনো রাগ ঝাড়ছেন? এরকম তো হওয়ারই ছিলো। আপনারাই বা কোন আক্কেলে এমন একটা মেয়েকে আমাদের ঘাড়ে গুঁজে দিলেন? প্রথমত মেয়েটার জন্ম নিয়ে আমার চরম আপত্তি। দ্বিতীয় বিষয় যেই পরিবারের লোক দেখলেই আমার ঘেন্না হয়। অথচ নিয়তির কী খেলা আমার ছেলেদের বউ সেই পরিবারের মেয়েরাই হলো। এই মেয়েকে কী করবেন জানি না। তবে আমার পক্ষে এই মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় থাকা অসম্ভব।”
শফিক সাহেব মুখ খুললেন। অসন্তুষ্ট বদনে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-” আমরা কোনোকিছু লুকাইনি। সবটা মাহবুব সাহেবকে জানানো হয়েছে। উনি যদি আপনাদেরকে না জানান সেখানে আমার নিশ্চয় কিছু করার নেই।”
নীহারিকা ঝটকা খেলেন। শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-” আবির কই? আবিরকে বল নিভানের বাবাকে ডেকে আনতে। আমি জানতে চাই, জেনেও কেনো আমার থেকে সবটা লুকাল।”
____________
অফিস থেকে ফেরার সময় বনলতাতে ঢোকে নীরব। বলল,
-” টু কিলো রসমালাই দিন।”
মিষ্টির প্যাকেট করে আনতে আনতে নীরব বিল মেটাতে ওপাশে গেল। বিল দিয়ে বাকি টাকা পকেটে রাখতে গিয়ে নজর যায় ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। ফোন হাতে তুলতেই খেয়াল হয় ফোন সাইলেন্ট আছে। সন্ধ্যার পর একটা মিটিংয়ে এটেন্ড করায় ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল। এরপর আর চেক করা হয়নি। ছোটমার বেশ কয়েকটা মিসড কল উঠে আছে। আবার নিভানের কল। ন্যানো সেকেন্ডেই নীরবের মনে প্রশ্ন জাগে— এতগুলো কল। বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? প্রত্যাশা আবার অসুস্থ হয়নি তো? বাবা ঠিক আছেন? ইদানিং বাবার শরীরটাও তো ভালো যাচ্ছে না।
ভাবতে ভাবতেই ফোন তুলে নীরব। রিসিভ করতেই নিভান সবটা বলে। নীরব অমনেই ছুটে যেতে নেয়। দোকানের সেলস বয় পিছু ডাকল। নীরবের কান অব্দি শব্দগুলো পৌঁছায় না। মিষ্টির প্যাকেট ডেস্কের উপর পরে রইল। সেলস বয় হেসে ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
-” মাথা খারাপ নাকি। ফেলেই চলে গেল।”
____________
মাহবুব সাহেব বাড়িতে পা রাখতেই নীহারিকা চেঁচিয়ে বললেন,
-” সব জেনেও কেনো আমার থেকে লুকিয়েছো? দেশে কী মেয়ে কম ছিলো? আমার ছেলের জন্য মেয়ের লাইন পড়ে যেতো। তারপরেও কেনো একটা পা”প, অ”বৈ”ধ ভাবে যার জন্ম। আমার শত্রুর পরিবারের র*ক্ত যার শরীরে সেই মেয়েকে আমার আদরের ছেলের বউ করে আনলে? কেনো? নীরব সব জানে? নাকি তার কাছেও সব গোপন করেছো। এই মেয়েকে নীরবের বউ হিসেবে আমি মানতে পারছি না। এখন কী করবে করো।”
ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছুনে তাকাল। নীরব গম্ভীর মুখে সবার দিকে একপল চেয়ে নিয়ে বলে,
-” কাউকে জন্ম দিয়ে মাপা যায় না। জন্ম কারো হাতে থাকে না। বাবা-মায়ের পাপ-পুণ্যের হিসেব সন্তানের গায়ে চাপানো অ’ন্যায়। প্রত্যাশার কোনো দো’ষ নেই। দো’ষ যদি থাকে তবে সেটা তার বাবা-মায়ের। কে কোন ঘরে জন্ম নেবে, কী র*ক্ত তার শরীরে বইবে, সেটা মানুষ বেছে নিতে পারে না। বেছে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে শুধু নিজের জীবনকে কেমন করে গড়ে তুলবে সেটার ওপর। প্রত্যাশা কেমন সেটা দিয়ে ওকে জাজ করা। নট ওর বায়োলজিক্যাল বাবা-মাকে দিয়ে।”
#চলবে