#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
প্রত্যাশা থমকে গেল। মনে হলো ভূমিকম্পে সব কেঁপে উঠেছে। গোটা পৃথিবী যেনো ভেঙে পড়ছে। পায়ের তলা ফাঁকা হয়ে যায়। দু’পা পেছাতেই পিঠ দেয়ালে ঠেকল। নীহারিকা একবার প্রত্যাশার দিকে আবার নীলাশার দিকে ভালো করে তাকালেন। কণ্ঠে অবিশ্বাস মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-” নীলাশা এসব কি সত্যি?”
নীলাশা মাথা নিচু করে ফেলতেই চিবুক গিয়ে বুকে ঠেকল। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না। রাগের মাথায় বলে ফেললেও এখন যেন হুঁশ ফিরল। প্রত্যাশা চোখে টলমলে অশ্রু নিয়ে আপুর দিকে চেয়ে। অবচেতনে বুকের ভেতর থেকে শুধু একটাই প্রার্থনা উঠে এল–আপু একবার বলো এসব সত্যি নয়। যা বললে সেসব মিথ্যে।
নীলাশাকে চুপ দেখে নীহারিকা এবারে গলা চড়িয়ে বললেন,
-” চুপ করে থেকো না নীলাশা। যা জিজ্ঞেস করছি জবাব দাও। এত বড় কথা কেউ এমনি এমনি মুখ ফস্কে বলে না। সত্যিটা তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।”
নীলাশার হাত-পা মৃদু কাঁপছে। প্রীতি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠল,
-” চুপ করে আছো কেনো? সবটা বলো…বলো সত্যিটা। আর একটা কথা সবাই জানে সত্য কখনো চাপা থাকে না। একদিন না একদিন সবাই জানতোই। আমি নিজেও জানি। অথচ তুমি আমাকে বলোনি, তবুও জেনেছি। ভ’য় না পেয়ে যা জানো সবটা বলো।”
নীহারিকা বিস্ময়ে প্রীতির দিকে তাকালেন,
-” তুমি জানো মানে?”
প্রীতি মুখটা ইনোসেন্ট বানিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে,
-” মা ওদের বিয়ের দিন কথাটা আমার কানে আসে। এক বৃদ্ধা মহিলা প্রত্যাশার মাকে বলছিলেন। তখনই বুঝেছিলাম প্রত্যাশা ওনাদের নিজের মেয়ে নয়। আমি ভেবেছিলাম আপনারা হয়তো জানেন। এত বড় কথা কি আর গোপন রাখা যায়। এতবড় একটা বিষয় আড়াল করে লুকিয়ে-চুরিয়ে বিয়ে দেয় নাকি কেউ। এরকম করা তো প্রতারণা, ঠকানোর শামিল। ওনাদেরকে যথেষ্ট ভদ্রলোক মনে হয়েছে। ভাবলাম সবটা জানিয়েই হয়তো বিয়ে দিচ্ছেন। তাই আর কথাটা তুলিনি। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনারা কিছু জানেনই না। মা আপনি যেহেতু জানেন না। আমার মনেহয় নীরবকেও জানানো হয়নি।”
প্রত্যাশার বুক ভেঙে আসছে কান্নায়। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে আছে। নীহারিকা কঠিন গলায় নীলাশাকে বললেন,
-” নীলাশা, এভাবে চুপ থেকে আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিও না। সবটা বলো, নইলে আমি এক্ষুনি তোমার আব্বু-আম্মুকে কল করতে বাধ্য হবো।”
নীলাশা শাড়ির আঁচল শক্ত করে মুঠোয় ধরল। মাথা নেড়ে কম্পমান স্বরে বলল,
-” হ-হু… সত্যি।”
প্রত্যাশা মূহুর্তেই পাথর বনে যায়। শুধু চোখ দিয়ে টলটল করে অশ্রু গড়াতে লাগল। অথচ মুখ থেকে একটি শব্দও বেরোলো না। শর্মিলা এগিয়ে প্রত্যাশাকে আগলে নিলেন। কী বলে সান্ত্বনা দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। প্রত্যাশাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,
-” তাহলে প্রত্যাশার আসল পরিচয় কী? ওর বাবা-মা কে? আমার তো মনে হচ্ছে তোমার সব জানা।”
প্রীতির খুব কৌতুহল হচ্ছে। প্রত্যাশার আসল পরিচয় জানতে। সমস্যা এই নীলাশার থেকে তো ধ’ম’ক দিয়ে দিয়ে কথা বের করতে হচ্ছে। এইভেবে প্রীতির খুব বি’র’ক্ত লাগলো। প্রীতির আর তর সইছে না। প্রীতি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট না করে সবটা বলাই ভালো। এমনিতেও সবাই এখন জানবে। মা আপনি না হয় অধরা আন্টিকে কল করুন। আন্টির থেকেই জেনে নিন।”
নীহারিকা রাগত স্বরে ধমকের সুরে বললেন,
-” তুমি থাম।”
প্রীতির গায়ে লাগল। ফর্সা মুখটায় নিমিষেই অন্ধকার নামল। রেগে ভাবল– এক পা কবরে যাওয়ার অবস্থা হলো, তবুও এখনো একটুও দেখতে পারেন না। এইযে এসেছি অবধি কত সুন্দর আচরণ শো করছি। তবুও মন পাওয়া তো দূর, ভালো মুখে দু’টো কথা পর্যন্ত বলেনি।
নীহারিকা গম্ভীর মুখে বললেন,
-” নীলাশা তুমি নির্ভয়ে সবটা বলো। আমি জানতে চাই সবটা। আশা রাখছি কোনোকিছু না লুকিয়ে, মিথ্যেও না বলে শুধু সত্যিটুকু বলবে। কারন সবশেষে সত্য প্রকাশ হয়ই। এটাই ধ্রুব।”
নীলাশা দৃষ্টিজোড়া ফ্লোরে নিবদ্ধ করে মিহি কণ্ঠস্বরে বলতে লাগল,
-” আমার যখন সাত বছর বয়স সেইসময় আমার মৃ*ত বোন হয়। আম্মু অসুস্থ থাকায় হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। সেই সময় প্রত্যাশাকে হাসপাতাল থেকে পায়। প্রত্যাশাকে জন্ম দিয়ে ফেলে তারা পালিয়ে যায়। আম্মুর বাচ্চাটাকে দেখে মায়া হয়। আম্মু নিয়ে আসে। আম্মুর এক ফুপু হাসপাতালে সাথে ছিলেন। উনি জানতেন আর আমার দুই মামা এক মামী জানে। এছাড়া আব্বু-আম্মু কাউকে জানতে দেয়নি।”
নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,
-” ওর বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি? পুলিশ কেস হয়েছিল না?”
-” পুলিশ কেস হয়েছিল কী না আমি জানি না। তবে জানি হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তার আর নার্সদের মাধ্যমে আম্মু বাচ্চাটাকে নিয়ে নেয়। বাচ্চাটা ক্ষুধার্ত ছিলো খুব কাঁদছিল। আম্মু সেচ্ছায় দুধপান করায়। ডিউটির নার্সরাও যেন আম্মুর কাছে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ক্লাস সিক্সে থাকতে আমি এসব জানি। আগে জানা ছিলো না। ছোটো মামী মামার কাছ থেকে একটু শুনেছিলেন। আম্মুকে প্রত্যাশার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। সেদিন আম্মু মামীকে বলছিল। আর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমি সবটা শুনে ফেলি।”
নীলাশা থামল। নীহারিকা জোরেজোরে নিঃশ্বাস ফেলে ফের শুধালেন,
-” ওর বাবা-মার পরিচয় কী?”
-” আমি জানি না।”
নীহারিকা বজ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-” নীলাশা তুমি সব জানো। মিথ্যে বলবে না। একটু আগেই বলেছিলে ‘অন্যের পাপ আমার আব্বু-আম্মু দয়া দেখিয়ে বড় করেছে।’ অতএব না জানার নাটক করবে না। তোমার থেকে এমনটা আশাকরি না।”
নীলাশা জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে অতীতে ডুব দিলো।
মেয়েটির নাম স্বপ্না। গায়ের রং হালকা চাপা, মুখের কাটিং সুন্দরই ছিলো নাকি। জন্ম দেয়ার সময় মায়ের প্রাণ যায়। ছোট থেকেই নানীর কাছে বেড়ে উঠেছে। বাবা আবার বিয়ে করে সংসার পাতেন। কখনো ফিরেও চায়নি। নানার ছোট্ট চায়ের দোকান। নানীর কাছে অভাব অভিযোগ নিয়েই বড় হওয়া। স্বপ্না পড়াশোনায় মিডিয়াম ছিলো। তবে চা বিক্রেতা নানার কাছে সেটাই অনেক বড় কিছু। কষ্ট করে নাতনিকে কলেজে ভর্তি করান। দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে স্বপ্নার প্রেমের সম্পর্ক হয় বড় লোকের ছেলের সাথে। ছেলেটি সম্পর্কে বোকা স্বপ্না অবগত ছিলো না। ছেলেটির চরিত্র মোটেই ভালো ছিল না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রুমডেট করে। মেয়েটি আবেগের বয়সে পা*পে সায় দিয়ে বসে। যেই পা*পে তার ফুলের মতোন জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। পা*প পা*পই। পা*পের পরিণয় হয় ভয়াবহ। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া, দাপট নিয়ে চলা ছেলেটি স্বপ্নাকে ছু*ড়ে ফেলে। স্বপ্না বিয়ের কথা তুললেই ছেলেটা অট্টহাসিতে ফেটে পরে —
-” যে মেয়ে একজনের কাছে শরীর দিতে পারে, সে আর কতজনের কাছে দিয়েছে হিসেব আছে নাকি! আর তোমার মতো একটা চা-ওয়ালীর নাতনিকে বিয়ে করব আমি? হাউ ফানি! তোমাকে বড়জোর আমার বাড়ির মেইড বানানো যায়। কত টাকা চাই? একদিন বেডে এসেছো, দশ হাজার চলবে?”
স্বপ্না লজ্জায়, অপমানে মুখ খুলতে পারে না। নিজের উপরই তার ঘেন্না হচ্ছে। তবুও বলে,
-” আমাকে ভালোবাসেন সেসব মিথ্যে ছিল? আপনি নিজেই জোর করেছিলেন। এ-ও বলেছিলেন দু’দিনের মধ্যেই বিয়ে করবেন।”
ছেলেটির অপমানমূলক কথার তোপে টিকতে না পেরে স্বপ্না কাঁদতে কাঁদতে ফেরে। গলায় ফাঁস দিতে যায়। নানী দেখে আঁটকে দেয়। এরপর সেই পা*পের ভার বাড়তে লাগলো। প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে যখন বুঝল তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। জানতে পারে চার মাসের প্রেগন্যান্ট। এবারে সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিল। রাখে আল্লাহ মা*রে কে? কথাটা ফলে যায়। গলায় ফাঁ’স নিয়ে খানিকটা জিভ বেরোলেও বেঁচে যায়।
স্বপ্না এবারে ট্রমায় চলে যায়। কারো সাথে কোনো কথা বলত না। সারাটা সময় রুমেই থাকত। এরপর ঘনিয়ে এল ডেলিভারি ডেট। নানী কৌশলে সদর হাসপাতালে নেয়। রাতের অন্ধকার আকাশে ঝলমলে চাঁদের আলোর মতো জ্বলজ্বলে একটা চাঁদ মুখের মেয়ে শিশুকে স্বপ্না জন্ম দেয়। নানীর অভাবের সংসার। এখন আবার আপদ আসতে যাচ্ছে। তাও আবার পা*প। বৃদ্ধা নানী প্লান আঁটে। কোনো রকমে বাচ্চাটাকে ফেলে স্বপ্নাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালালেন। এই পা*প, আপদ ফেলে যেন হালকা হলেন। কিন্তু সেই হালকা হওয়া বেশিক্ষণ টিকলো না। সেই রাতের শেষ ভাগে অতিরিক্ত র*ক্তক্ষরণে স্বপ্না মৃ*ত্যু*র কোলে ঢোলে পরে।
দুমাস খানেক পর নানী হাসপাতালে আসেন। অনেক কষ্টে হাসপাতালের ঝাড়ুদারের মাধ্যমে সাহায্য নিয়ে বাচ্চাটিকে কে নিয়েছেন তার ঠিকানা বের করেন। আসেন অধরার কাছে। সবটা বলেন। বাচ্চাটা যে অধরার কাছে ভালো থাকবে এতটুকু ঠিক বুঝলেন। নিজের পা*পের জন্য অনুশোচনা আর দুঃখ প্রকাশ করে সব ঘটনা অধরাকে জানায়। অধরা জিজ্ঞাসা করেন,
-” আপনার নাতনি পা”প করেছে। সেও দোষী। তাহলেও সেই ছেলের নামে মামলা কেন করলেন না?”
-” গরীবের আবার মামলা। পুলিশের কাছে গেইলে উল্টা ভ’য় দেখাইয়া চাপে রাখতো। ভয়ে যাই নাইকা। সেই পোলা মেয়র আজিম খানের ছোডো ভাই আবির খান। মামলা করতে গেছি হুনলে পোলাপান লইয়া আইয়া চায়ের দোকান তো ভাঙবোই। ঘরে আ*গুন দিতো। ডরে কিচ্ছু কইতে পারি নাইকা।”
নীহারিকা আঁটকে গেলেন নাম দুটোয়। প্রীতি চমকে তাকাল। মেয়র আজিজ খান তার বড় মামা ছিলেন। আর ছোট মামা আবির। অবাক হলো না প্রীতি। সে জানে ছোট মামার চরিত্র সম্পর্কে। মরহুম হওয়ার পরেও শয়তানটাকে প্রীতি দেখতে পারে না। ওই শয়তানটার জন্য বাবাকে হারাতে হয়েছে, মা পঙ্গু হয়েছে। তানিয়ার বিয়েও খান পরিবারেই হয়। চাচাতো ভাইয়ের সাথে। বেশ কয়েক বছর আগে আবির ড্রাইভিং করছিল গাড়িতে তানিয়া আর ওনার স্বামী ছিলেন। ড্রাঙ্ক অবস্থায় থাকায় এক্সিডেন্ট করে বসে। সেই এক্সিডেন্টে ছোটো মামা, আর বাবা প্রাণ হারায়। তবে মা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। তবে সারাজীবনের জন্য পা হারাতে হয়।
প্রীতি ঘনঘন চোখের পলক ফেলে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। সম্পর্ক যেনো নিমিষেই পাল্টে গেল। প্রত্যাশা খিচে চোখ বুঁজে নিল। নিজের র*ক্তে*র উপর ঘেন্না হচ্ছে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। দুই হাতে মুখ চেপে ধরল প্রত্যাশা। গাল ভিজে গলা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বোবা কান্নায় মেয়েটা বারবার ফুঁপিয়ে উঠছে।
নীহারিকা বাকশুণ্য, হতভম্ব। বুকের উপর হাত চেপে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
-” ছিঃ ছিঃ এতবড় একটা জঘন্য বিষয় জানায়নি। আর এই দুনিয়ায় কী মেয়ের আকাল পড়েছিল? ঘুরেফিরে আমার শত্রুর পরিবারের মেয়েদেরই এ বাড়ির বউ হতে হয়। যেখানে আমি প্রীতিকেই মেনে নিতে পারিনি। সেখানে এই অ”বৈধ, পা*পকে কী করে সহ্য করব। তাও আবার আমার নীরবের বউ হিসেবে। শফিক সাহেবকে এর জবাবদিহিতা করতে হবে। তোমার আব্বুকে এক্ষুনি ডাকো।”
প্রত্যাশার ম*রে যেতে ইচ্ছে করল। নীহারিকা রুমের দিকে যেতে লাগলেন। শর্মিলা প্রত্যাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা আমরা তোমার পাশে আছি। আমি এক্ষুনি নীরবকে ফোন করছি। আমার বিশ্বাস নীরব তোমার পাশে থাকবে।”
প্রত্যাশা মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে ভাবল—এখন আমার কাছে দিনের আলোর মতো সবটা পরিষ্কার। নীরব নিজেই আমার জেনেটিক, র*ক্ত নিয়ে কথা বলেছেন। তারমানে নীরব সবটা জানে। নীরব আমার কু'”ৎ”সিত জন্ম পরিচয় জেনেই দয়া দেখিয়েছেন। দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছেন উনি। যার জন্ম, অতীত এমন নোং/রা সেটা জেনেশুনে বিয়ে করা আসলেই মহান লোকের কাজ। আর নীরব মহান সেজে দয়া করেছেন আমাকে।
প্রত্যাশাকে নিয়ে সোফায় বসান শর্মিলা। প্রত্যাশা বিমূর্ত হয়ে হাঁটুতে কনুই রেখে দুইহাতে মুখ চেপে অঝোরে কাঁদছে।
নীহারিকা ফোন নিয়ে শফিক সাহেবের কাছে কল দিলেন। শর্মিলা বারণ করলেন সেসব শুনলেন না। এদিকে শর্মিলা কী করবেন ঠাওর করতে পারছেন না। ত্রস্ত নীরবের কাছে কল দিলেন। রিং হচ্ছে রিসিভ করছেন না। মাহবুব সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন। ফোনটা রেখে গেছেন। উনি সাধারণত ফেরেন একেবারে এশার নামাজ আদায় করে। শর্মিলা বিরক্ত হয়ে নিজে নিজেই বললেন— বিপদের সময় কাউকে ফোনে পাওয়া যায় না। নীরবকে ফোন দিচ্ছি তুলছেই না। ভাইজানও ফোন রেখে গেছেন দেখছি। ভাবীকে একমাত্র নীরবই সামলাতে পারবে। ওর আসাটা খুব জরুরী।
উপায়ান্তর না পেয়ে নিভানকে ফোন করল। নিভান আসছি বলল। শফিক সাহেব রিসিভ করতেই নীহারিকা রাগ-ক্ষোভ নিয়ে বলেন,
-” কী করে পারলেন এমন একটা…”
এতটুকু বলে থেমে গেলেন। জোরেজোরে শ্বাস নিতে লাগলেন নীহারিকা। শর্মিলা ফোন কেড়ে নিলেন। ভাবী রাগের মাথায় কী না কী বলে ফেলে; এইভেবে শর্মিলা ফোন নিয়ে ধীরেসুস্থে সবটা বলেন। ওদিকে সবটা শুনে অধরা বলে সেও যাবে। মেয়েটা অসুস্থ, এখনই এসব হওয়ার ছিলো। সব রাগ গিয়ে নীলাশার উপর জমে।
মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে নীহারিকা। প্রত্যাশা ওভাবেই বসে কাঁদছে। নীলাশার চোখ ভেজা। সে একপাশে থম মে*রে দাঁড়িয়ে। প্রীতি বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে।
বিশ মিনিট খানেকের মধ্যেই শফিক সাহেব আর অধরা আসেন। শফিক সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সোফায় বসা মেয়েকে দেখেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো। ডেকে উঠলেন,
-” প্রত্যাশা মা?”
প্রত্যাশা মাথা তুলে তাকাল। ছুটে বাবার বুকের উপর পড়ল। জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মুখটা তুলে বাবার মুখের দিকে চাইল। ব্যাকুল স্বরে বলল,
-” আব্বু আপু যা বলছে বলো সব মিথ্যে। আমি তোমার মেয়ে। তোমারাই আমার বাবা-মা। আপু আমাকে দেখতে পারে না জন্যই এমন মিথ্যে বানিয়ে বলছে, তাই না আব্বু? তুমি বলে দাও আমি তোমাদেরই মেয়ে।”
প্রত্যাশার মন মানতে চাইছে না। ওই সত্যিটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। এখনো মনটা চাইছে সব মিথ্যে হোক। এরমধ্যে ঠাসঠাস শব্দে সবাই চমকে উঠল। অধরা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে সোজা চ’ড় দিলেন নীলাশার গালে। নীলাশা অবাক চোখে চেয়ে বলল,
-” আম্মু।”
আরেকটা চ’ড় বসিয়ে অধরা রুষ্ট গলায় বললেন,
-” একদম আমাকে আম্মু ডাকবি না। তোর মতো একটা হিংসুটে মেয়েকে পেটে ধরে আমার লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। এতটা হিংসা তোর ভেতর? এখন মা হয়েও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি; নিজে মা হতে পারবি না জন্যই তোর সহ্য হচ্ছিল না প্রত্যাশার সুখ। তাই তো তুই এরকম করলি। তোর ভেতর যদি একটু মনুষ্যত্ব থাকতো তুই এই মূহুর্তে বলতিস না। এটা জানার পর এই মূহুর্তে প্রত্যাশার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে একবার ভাবতে পারছিস? অথচ এই সময় ওকে হাসিখুশি প্রফুল্ল রাখার কথা।”
নীলাশা ভেজা গলায় বলল,
-” আম্মু..”
অধরা হাত তুলে বললেন,
-” চুপ..”
নীহারিকা বলে উঠলেন,
-” শুধু শুধু ওর উপর কেনো রাগ ঝাড়ছেন? এরকম তো হওয়ারই ছিলো। আপনারাই বা কোন আক্কেলে এমন একটা মেয়েকে আমাদের ঘাড়ে গুঁজে দিলেন? প্রথমত মেয়েটার জন্ম নিয়ে আমার চরম আপত্তি। দ্বিতীয় বিষয় যেই পরিবারের লোক দেখলেই আমার ঘেন্না হয়। অথচ নিয়তির কী খেলা আমার ছেলেদের বউ সেই পরিবারের মেয়েরাই হলো। এই মেয়েকে কী করবেন জানি না। তবে আমার পক্ষে এই মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় থাকা অসম্ভব।”
শফিক সাহেব মুখ খুললেন। অসন্তুষ্ট বদনে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-” আমরা কোনোকিছু লুকাইনি। সবটা মাহবুব সাহেবকে জানানো হয়েছে। উনি যদি আপনাদেরকে না জানান সেখানে আমার নিশ্চয় কিছু করার নেই।”
নীহারিকা ঝটকা খেলেন। শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-” আবির কই? আবিরকে বল নিভানের বাবাকে ডেকে আনতে। আমি জানতে চাই, সব জেনেও কেনো আমার থেকে সবটা লুকাল।”
____________
অফিস থেকে ফেরার সময় বনলতাতে ঢোকে নীরব। বলল,
-” টু কিলো রসমালাই দিন।”
মিষ্টির প্যাকেট করে আনতে আনতে নীরব বিল মেটাতে ওপাশে গেল। বিল দিয়ে বাকি টাকা পকেটে রাখতে গিয়ে নজর যায় ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। ফোন হাতে তুলতেই খেয়াল হয় ফোন সাইলেন্ট আছে। সন্ধ্যার পর একটা মিটিংয়ে এটেন্ড করায় ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল। এরপর আর চেক করা হয়নি। ছোটমার বেশ কয়েকটা মিসড কল উঠে আছে। আবার নিভানের কল। ন্যানো সেকেন্ডেই নীরবের মনে প্রশ্ন জাগে— এতগুলো কল। বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? প্রত্যাশা আবার অসুস্থ হয়নি তো? বাবা ঠিক আছেন? ইদানিং বাবার শরীরটাও তো ভালো যাচ্ছে না।
ভাবতে ভাবতেই ফোন তুলে নীরব। রিসিভ করতেই নিভান সবটা বলে। নীরব অমনেই ছুটে যেতে নেয়। দোকানের সেলস বয় পিছু ডাকল। নীরবের কান অব্দি শব্দগুলো পৌঁছায় না। মিষ্টির প্যাকেট ডেস্কের উপর পরে রইল। সেলস বয় হেসে ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
-” মাথা খারাপ নাকি। ফেলেই চলে গেল।”
____________
মাহবুব সাহেব বাড়িতে পা রাখতেই নীহারিকা চেঁচিয়ে বললেন,
-” সব জেনেও কেনো আমার থেকে লুকিয়েছো? দেশে কী মেয়ে কম ছিলো? আমার ছেলের জন্য মেয়ের লাইন পড়ে যেতো। তারপরেও কেনো একটা পা”প, অ”বৈ”ধ ভাবে যার জন্ম। আমার শত্রুর পরিবারের র*ক্ত যার শরীরে সেই মেয়েকে আমার আদরের ছেলের বউ করে আনলে? কেনো? নীরব সব জানে? নাকি তার কাছেও সব গোপন করেছো। এই মেয়েকে নীরবের বউ হিসেবে আমি মানতে পারছি না। এখন কী করবে করো।”
ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছুনে তাকাল। নীরব গম্ভীর মুখে সবার দিকে একপল চেয়ে বলল,
-” কাউকে জন্ম দিয়ে মাপা যায় না। জন্ম কারো হাতে থাকে না। বাবা-মায়ের পাপ-পুণ্যের হিসেব সন্তানের গায়ে চাপানো অ’ন্যায়। প্রত্যাশার কোনো দো’ষ নেই। দো’ষ যদি থাকে তবে সেটা তার বাবা-মায়ের। কে কোন ঘরে জন্ম নেবে, কী র*ক্ত তার শরীরে বইবে, সেটা মানুষ বেছে নিতে পারে না। বেছে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে শুধু নিজের জীবনকে কেমন করে গড়ে তুলবে সেটার ওপর। প্রত্যাশা কেমন সেটা দিয়ে ওকে জাজ করা। নট ওর বায়োলজিক্যাল বাবা-মাকে দিয়ে।”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজা বরাবর তাকাল। লম্বা লম্বা কদম ফেলে নীরব এগিয়ে আসে। প্রত্যাশার মাথা তখনও অধরার কাঁধে ঠেসে রাখা। কান্নার কারণে চোখের পাপড়িগুলো একসাথে লেগে আছে। ভেজা পল্লব তুলে বিস্ময় নিয়ে একবার নীরবের দিকে তাকাল। নীরব বউয়ের মুখের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। নীরবের কপাল বেঁয়ে ঘাম ঝরছে। ফর্সা সুশ্রী বদনখানিতে উদ্বেগ, চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবুও চোখের পলক আলতোভাবে নামিয়ে ভরসা, আশ্বাস দিল। নিঃশব্দে চোখের ভাষায় ইশারায় কিছু বলতে চাইল, বোঝাতে চাইল— ডোন্ট ওয়ারি, আমি তো আছি।
কিন্তু পুরনো কিছু তিক্ত কথা ফের মন-মস্তিষ্কে বিরুপ প্রভাব ফেলল প্রত্যাশার। অভিমানে, অভিযোগে সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নেয় ও।
এদিকে ছেলের কথায় নীহারিকার মুখ মুহূর্তেই র*ক্তশূন্য হয়ে গেল। মাহবুব সাহেব হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নীহারিকা কঠিন দৃষ্টিতে নীরবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,
-” তারমানে নীরব, তুইও সব জানতিস?”
নীরব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। নীরবের নীরবতাই যেন উত্তর হয়ে দাঁড়াল। নীহারিকার গলা আরও কড়া হলো,
-” নীরব, তুই জানতিস? আমাকে জানাসনি কেনো? এখন বুঝতে পারছি, তোরা বাবা-ছেলে একসাথে মিলে লুকিয়েছিস। তোরা বাবা-ছেলে ঠিক জানতিস এসব জানলে আমি বিয়েটা কস্মিনকালেও হতে দিতাম না। তাই জানাসনি। তাই তো?”
-” মা তুমি ভুল বুঝছো..”
মাহবুব সাহেব নীরবকে থামিয়ে দিলেন। ধীর অথচ দৃঢ় গলায় বললেন,
-” নীরবকে আমিই নিষেধ করেছিলাম। শফিক ভাইয়ের কাছে প্রত্যাশা মা’কে চাওয়ার পর প্রথমে ওনারা দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সবটা আমায় বলেন। আমি ভেবেছিলাম এত বছর যেহেতু প্রত্যাশাকে নিজের মেয়ে হিসেবেই মানুষ করা হয়েছে। তাই কথাটা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো দরকার নেই। তবে নীরবের জানাটা জরুরি ছিলো। কারণ ওর জীবন প্রত্যাশার সাথে জড়াবে। তাই আমি নীরবকে সব জানাই। নীরবকে সবটা জানাতেই প্রত্যাশার বয়স নিয়ে আপত্তি করলেও এ ব্যাপারে ওর কোনো আপত্তি নেই জানায়। নীরবের যেহেতু আপত্তি নেই তাই আমি চাইনি আর কেউ জানুক বিষয়টা।”
নীহারিকার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল,
-” বাহ্ খুব ভালো কাজ করেছো। বাবা-ছেলে মিলে মহৎ কাজ করেছো দেখছি। আমি এ-ও বুঝতে পারছি তুমি ঠিক জানতে আমি এরকম জন্ম আর ও বংশের র*ক্ত যার শরীরে সেই মেয়েকে মেনে নিতে পারব না। সব জেনেবুঝেও এই মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে আনার খুব কী দরকার ছিলো?”
শাশুড়ির প্রতিটি কথা প্রত্যাশার বুকে ফলার মতো বিঁধছে। নীরবে নিঃশব্দে চোখের অশ্রু গড়িয়ে পরছে। নীরব দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরল। নীহারিকা এক মুহুর্ত থেমে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে তেরছা কণ্ঠে বললেন,
-” তোমাকে এসব বলেই বা কীই লাভ। তোমার তো আবার ওই পরিবারের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। যতই হোক প্রথম ভালোব___”
নীরব নিচের অধরে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। মা কেনো জানি এই একটা জায়গায় এসে অবুঝ হয়ে যায়। খুব বেশিই কঠোর বনে যান। মা এখন এমন কিছু বলে সবার সামনে বাবাকে ছোট না করে ফেলে। যে মানুষটা তার অতীত সন্তানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। জানতে দেননি। আজ ঘরভর্তি লোকের সামনে মা বাবাকে অস্বস্তিতে ফেলুক তা নীরব চায় না। তাই তো ডান হাতটা কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে তড়িঘড়ি মাকে থামিয়ে দিল,
-” ব্যস, মা যথেষ্ট হয়েছে। প্লীজ এবার থামো। এই বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি, মিটিং ডাকার আমি কিছু দেখি না। একটা সাধারণ বিষয়কে শুধুই টেনে জটিল করা হচ্ছে। প্রত্যাশাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুনতে পাচ্ছ? তারপরেও এত কথা উঠার মানেই হয় না।”
অদূরে দাঁড়ানো প্রীতির বুকে ভাঁজ করা হাত খসে পড়তে নেয়। পরপর সামলে ভাবে—এইরে এই মহিলার রাগ-জিদ সম্পর্কে আমি অবগত। ছেলে ডিরেক্ট বউয়ের পক্ষ নিয়ে এল। এটা হজম করা উনার পক্ষে কতটা কঠিন সেটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি।
নীহারিকা থমকে গেলেন। এভাবে ছেলের মুখের উত্তর শুনে স্তব্ধ বনে যায়। মনে হচ্ছে নীরব যেন পরোক্ষভাবে বলে দিল— ওর শ্বশুরদের ডেকে বউকে নিয়ে তিনি মিটিং ডেকেছে। এসব বাড়াবাড়ি।
নীহারিকার চোখ ছলছল করে উঠল। তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠস্বরে বললেন,
-” বাহ্! এটাই বাকি ছিলো। নীরব তুইও নীবিড়ের মতো রূপ দেখালি।”
নীরবের মাথা কিঞ্চিৎ নুইয়ে এল। করুণ চাহনিতে মায়ের মুখপানে তাকিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলল,
-” মা প্লীজ রাগ-ক্ষোভ সরিয়ে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। প্লীজ মা ভুল বুঝো না। একবার ভাবো, বাবা-মায়ের ভুলের শাস্তি প্রত্যাশা কেনো পাবে? ওর দোষটা কী? ”
নীহারিকার শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেল। কোনো কথা কানে না তুলে কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আফসোস নিয়ে বললেন,
-” এতদিন ভাবতাম আমার নীরব আলাদা। আমার নীরব মা বলতে পা”গ”ল। এখন তো আমি তোর মধ্যে শুধু চেহারায় মিল নীবিড় নয়, পুরো সেম মন মানসিকতার নীবিড়কে দেখতে পাচ্ছি। তোদের কাছে বউ আগে। মায়ের বিন্দুমাত্র দাম নেই। নীবিড়ের কাছেও ওই মেয়ের প্রায়োরিটি বেশি ছিল। তাই তো মায়ের কথা অমান্য করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করেছিল।”
মাহবুব সাহেব বললেন,
-” নিভানের মা তুমি একদম চাইল্ডিশের মতোন কথাবার্তা বলছো। মানছি এই একটা ব্যাপারে তুমি ছেলেমানুষী আচরণ করে বসো। তাই বলে সবসময় এমনই থাকবে? এবার একটু চেঞ্জেস আনা প্রয়োজন।”
নীরব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
-” মা, কখনো ভেবে দেখেছো শুধু কি নীবিড়েরই দোষ ছিলো? তোমাদের কোনো ভুল ছিলো না? শুরু থেকেই যদি প্রীতিকে মেনে নিতে তাহলে নীবিড়কে আলাদা থাকতে হতো না। হয়তো সে আজ যে অবস্থায় আছে, সেখানে পৌঁছাতো না।”
নীহারিকা গম্ভীর গলায় বললেন,
-” নীবিড় যদি আমার কথা শুনতো। ওই মেয়েকে বিয়ে না করতো। তাহলেও এমন হতো না।”
মায়ের এই একগুঁয়ে মনোভাব নীরবকে ক্লান্ত করে তুলছে। নীহারিকার বুকে হালকা ব্যথা হচ্ছে। বুকের উপর হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চকণ্ঠে বললেন,
-” তোদের কাছে মা কিছুই না। বউই সব। নীবিড় যেমন মাকে ফেলে চলে গিয়েছিল, তুইও তাই করবি। যা তোর বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে থাক। তোদের কাউকে আমার চাই না।”
নীরব করুণ স্বরে বলল,
-” প্লীজ মা, থামো।”
নীহারিকা একহাতে আঁচল টেনে মুখে গুজলেন। হাত নেড়ে নেড়ে কোনরকমে বললেন,
-” নীরব সেদিনও আমি মানতে পারিনি। আজও তোর ক্ষেত্রেও মানতে পারছি না। তবে আমার মানায় তোদের কিছু আসে যায় না। তোদের কাছে মা নয়, বউ বড়। আমার সোজা কথা পরিবারকে ছেড়ে বউ নিয়ে বাসায় উঠবি? নাকি এই মেয়েকে ছাড়বি?”
হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে নীহারিকা এবার যেন জিদ হিসেবে নিয়ে নিল। ঘর শুদ্ধ সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মাহবুব সাহেব ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,
-” নিভানের মা। ব্যস! অনেক হয়েছে এবারে থামো। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
নীরব দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরে মাথাটা কিঞ্চিৎ নত করল। মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল। কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ থেকে কথা সাজিয়ে নিল। প্রত্যাশার বুকটা আরও ভারী হয়ে এলো। শফিক সাহেব মুখ খুলবেন অধরা ইশারায় স্বামীকে থামিয়ে দিলেন। নীরব মায়ের নিকটে এগিয়ে গেল। দুইহাতে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। শান্ত নিচু স্বরে বলল,
-” আমার জন্য মা তুমি গুরুত্বপূর্ণ। আমার জন্য আমার স্ত্রীও গুরুত্বপূর্ণ। আমার মা হয়ে মা তোমার মুখে এ সমস্ত কথাগুলো একদম মানাচ্ছে না। বড্ড বেশি বেমানান লাগছে।”
নীহারিকা জোরেজোরে শ্বাস টানতে টানতেই ছেলের মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন। নীরব নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে স্রেফ বলল,
-” মা আমি নীবিড় নই। আমি নীরব। তুমি রাগ করে বলবে আমিও জিদ ধরে বাড়ি ছেড়ে যাব। এমনটা ভাবলে ভুল। আমি জানি আমার মায়ের মন কতটা নরম। আমার মা দিনের পর দিন নীবিড়ের জন্য চোখের পানি ফেলেছে। অপেক্ষায় থেকেছে। সেটা কেউ না জানলেও আমি জানি। আমার কাছে আমার মা, আমার পরিবার যতটা প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক ততটাই প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ আমার সহধর্মিণী। প্রত্যাশা আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমাদের কাউকে বাদ দিয়ে আমি পূর্ণ হতে পারবো না। মা আমি আবারো বলছি, প্রত্যাশার এখন একটাই পরিচয় ও তোমার নীরবের স্ত্রী। আর এই পরিচয়টাই কী ওর জন্য এনাফ নয়?”
নীহারিকা উত্তর দিলেন না। এবারে যেন ঝিমিয়ে গেলেন। এদিকে শফিক সাহেব মাহবুব সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ভারী স্বরে বলে উঠলেন,
-” প্রত্যাশাকে আমরা কোনোদিনও নীলার থেকে আলাদা করে দেখিনি। বরং ছোট বলে ওকে একটু বেশি আদর-আহ্লাদ দিয়ে বড় করেছি। ভালোবেসে প্রশ্রয় দিয়েছি। প্রত্যাশাকে জন্ম না দিলেও বাবা-মা হিসেবে সবটুকুই দিয়েছি, দেবো ইনশাআল্লাহ। সমাজের কাছে কে কীভাবে নেবে সেটা আমার ভাবনার বিষয় নয়। আমি বাবা হিসেবে বলছি প্রত্যাশা আমারই মেয়ে। শুধু ভরণপোষণের জন্য মেয়েকে বিয়ে দিইনি। আঠারোটা বছর যেভাবে আদরে, আবদার পূরণ করে বড় করেছি, আগামীতেও পারব। আল্লাহ আমাকে সেই সামর্থ্য দিয়েছেন। যদি আপনাদের কাছে আমার মেয়েকে মেনে নেওয়া এতটাই কঠিন হয়, তাহলে আমি ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমাদের মেয়ে ফেলনা নয়।”
নীরবের কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠল— আবার আরেকটা ঝামেলার শুরু।
মাহবুব সাহেব বললেন,
-” ভাই সাহেব আমি বুঝতে পারছি। তবে বলব এসব বিষয় আবেগে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়। মাথা গরম না করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। নিভানের মায়ের হয়ে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”
সহজ-সরল মেয়েটাকে মাহবুব সাহেবের বেশ ভালো লেগেছিল। এদিকে সম্পর্কটা আরো দৃঢ় করতে ছোট ছেলের জন্য প্রস্তাব রাখেন। যখন পরিচয় জানলেন, তিনিও দোদুল্যমান অবস্থায় পড়েন। পরবর্তীতে ভাবেন–শফিক সাহেব হয়তো ভাববে মেয়েটার এমন অতীত জেনেই হয়তো আর এগোলেন না। কিন্তু ভ’য় ছিলো এমন একটা দিনের। সব দোটানা একপাশে ঠেলে অবশেষে সব জেনেই ছেলের বউ করতে সম্মতি জানান। এদিকে নীহারিকা নীরবের জন্য পাত্রী দেখছিলেন তাই তো তাড়াহুড়া করে নীরবের আকদ করালেন।
প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,
-” আব্বু আমাকে নিয়ে চলো। আমি আর নিতে পারছি না।”
মেয়ের কথায় শফিক সাহেব তার কথায় অনড় অবস্থান নিলেন। মাহবুব সাহেব, শর্মিলা তাদেরকে বোঝাতে লাগলেন। প্রত্যাশা জিদ ধরেছে সে এক্ষুনি চলে যাবে। শফিক সাহেবও একগুঁয়ে ধরে রইলেন। অধরা স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করতেই শফিক সাহেব থামিয়ে দিলেন। শর্মিলা বললেন,
-” ভাই আপনি কী মেয়ের সাথে পাগল হলেন নাকি? মানছি অনেক কথা হয়েছে। তাই বলে এই রাতের বেলা এভাবে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে চলে যাবেন। মেয়ে বলছে কোথায় মেয়েকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে..”
কথার মাঝেই শফিক সাহেব অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
-” ভাবী আমার মেয়েটা অসুস্থ। এখানে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। এত কথা, এত অপমান আমার সহজ-সরল মেয়েটা নিতে পারবে না। দয়া করে আর জোর করবেন না। আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি।”
নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উঠে সোজা প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল। ভণিতা ছাড়াই স্রেফ বলল,
-” প্রত্যাশা রুমে চলো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
প্রত্যাশা মুখ ফিরিয়ে নিল। নীরবের রাগ বাড়তে লাগলো। অধরা মেয়েকে চোখের ইশারায় যেতে বলেন। প্রত্যাশা পাথরের মতন কঠিন হয়ে রইল। শর্মিলা বলল,
-” প্রত্যাশা তোমাকে তো লক্ষ্মী মেয়ে জানি। নীরব কী বলতে চায় শুনে আসো।”
নীরব আকস্মিক প্রত্যাশার কব্জি চেপে ধরল। আর একটাও টু শব্দটি না করে সোজা রুমে নিয়ে এল। রুমে এসেই দাঁত চেপে বলল,
-” কেনো পা”গলামি করছো? এত টেনশন আমি আর নিতে পারছি না। প্লীজ তুমি অন্তত থামো।”
ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেলেও উপরে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে প্রত্যাশা। তাচ্ছিল্য সুরে বলল,
-” যার জন্ম এতটা কুৎসিত, বাজে তার সাথে আপনাকে মানায় না। আপনি আমার থেকে হাজারগুণ বেটার কাউকে পাবেন। আমাকে আর দয়া দেখাবেন না প্লীজ। আমি স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে যেতে চাই। আপনার উপর আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই।”
ঝটিকায় প্রত্যাশার কাঁধ দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে নীরব। চোয়াল কঠিন করে বলল,
-” প্রত্যাশা এবারে তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো। কেনো বুঝতে চাইছো না তোমাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। জন্ম পরিচয় দিয়ে কাউকে জাজ করা যায় না। সব জেনেশুনেই আমি তোমাকে গ্রহণ করেছি।”
প্রত্যাশা এক ঝটকায় নীরবের হাত দু’টো কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল। দলা পাকানো কান্নারা ফের বাঁধ ভাঙল। কান্না জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
-” সেটাই তো সব জেনেশুনে দয়া করেছেন। বিয়েটা করেছেন দয়া দেখিয়ে। এখন আবার আপনার মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দয়া দেখাচ্ছেন। এত দয়া আমি আর নিতে পারছি না।”
এই বলে ধপ করে মেঝেতে বসে পরে প্রত্যাশা। দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
-” নীরব আমি আর দয়া চাই না। প্লীজ, লেট মি এলৌন। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স।”
নীরবের কপালের রগ টনটন করে উঠল। রাগে সজোরে দেয়ালে ঘু*ষি মা”রল। শব্দে প্রত্যাশা কেঁপে উঠে তাকাল। জ্বলজ্বল করে আ*গুনের মতো জ্বলা নীরবের চোখদুটোয় প্রত্যাশার তাকানোর সাহস হলো না। প্রত্যাশা দৃষ্টি নামিয়ে নিল। নীরব সোজা ব্যালকনিতে চলে যায়। নিস্তব্ধ ঘরে প্রত্যাশার কান্নার বেগ বাড়ল।
___________
নিভানের মুখের দিকে তাকাতেই নীলাশা ধরতে পারে নিভান তার উপর অসন্তুষ্ট। নীলাশা অসহায় স্বরে বলল,
-” নিভান তুমিও আমাকে ভুল বুঝলে?”
নিভান উত্তর দিল না। নীলাশা তাতে বেশি আহত হলো। নীলাশা ভারী মুখশ্রীতে বলল,
-” বিশ্বাস করো নিভান এমন কিছু হোক আমি চাইনি। নীরবের সাথে বিয়ের দিন প্রত্যাশাকে ফোর্স কিন্তু আমিই করেছিলাম। হ্যাঁ প্রত্যাশার সাথে আমার সম্পর্ক সুমিষ্ট ছিলো না। তবে ওর খারাপ হোক এ-ও চাইনি।”
নিভান তপ্ত শ্বাস ফেলে মেরুদন্ড টানটান করে দাঁড়াল। দৃষ্টি তার ব্যালকনির গ্রীল পেরিয়ে দূর অন্ধকারে। আকাশে আজ মেঘের ঘনঘটা। চাঁদ তো দূর একটা তাঁরাও দেখা যাচ্ছে না। নীলাশা অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে বলে গেল,
-” প্রত্যাশা ছোট থেকেই খুব বেশি আহ্লাদী ছিলো। আব্বু আম্মু ওকে সবসময় প্রশ্রয় দিতো। আমি এটা মানতে পারতাম না। আমার কাছে অতিরিক্ত লাগতো। সেই থেকেই একটু একটু করে প্রত্যাশার প্রতি বিরূপ মনোভাব জন্মে। এখনো প্রত্যাশা বাড়ি গেলে একবেলা হাত দিয়ে ভাত খায়, দুইবেলা আম্মু খাইয়ে দেয়। আমি নিজ থেকে এমন আহ্লাদ করতে আজও পারি না। তাই ওর এমন আচরণ আমার ভালো লাগতো না। আমার মনে হতো আমার আব্বু আম্মু ওকে বেশি আহ্লাদ করে। আবার এখন এ বাড়িতে ওর বাচ্চা হওয়া নিয়ে ওর প্রতি সবার এত কেয়ার দেখে আমার নিজেকে অসহায় লাগতো।”
-” তাই তো আজ রাগ জিদ করে এমন কান্ড করলে?”
নীলাশার প্রচন্ড কান্না পেল। নিজেকে সামলে বলল,
-” নিভান আমার পুরো কথাটা আগে শোনো। প্রীতি আমাকে উস্কালেও আমি বলিনি। আমি চাইনি বলতে। তবে আজ সন্ধ্যায় আমি রাগের মাথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলি। আমার হাত কেটে গেলেও মা কিছুই বললেন না। অথচ প্রত্যাশা পরে যেতে নেয়, এই দেখেই আমাকে কতগুলো কথা শুনালেন। আমার তখন প্রত্যাশার উপর রাগ হয়। আমি রাগ করতেই মা আমার উপর চড়াও হলেন। আচ্ছা, প্রত্যাশা তো সবার কাছে আমার বোন হিসেবেই পরিচিত। বোন কী বোনকে রাগ করে না? রাগ দেখায় না? মা তো সেই হিসেবেও নিতে পারতো। কিন্তু না মা আমাকে কড়া করে বললেন। সেই সময় আমি রাগের মাথায় বলে ফেলি। অথচ আমার নিজের আম্মু কী না আমাকে এতবড় একটা কথা বলল। আমার আম্মু বলল, আমি কোনোদিন মা হতে পারব না জন্য, প্রত্যাশার সুখ আমার সহ্য হচ্ছে না।”
ডুকরে কেঁদে উঠল নীলাশা। ভাঙা সুরে বলে,
-” একবারো কেউ আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে না। আম্মু কী করে পারল এমন বলতে?”
একহাতে নীলাশাকে আগলে বুকে টেনে নিল নিভান। চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বলল,
-” নীলাশা তোমার আম্মু রাগের মাথায় বলেছেন। রাগের সময়কার কথা ধরতে নেই। আর একদিন না একদিন তো সত্য সামনে আসতোই। বাট প্রত্যাশার প্রেগনেন্সির সময় এরকমটা না হলেও পারতো। তোমার আরেকটু ভেবে চিন্তে কথা বলা উচিত ছিলো। যাইহোক, সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না। আমার মায়ের রাগ হলে আ*গুন। আবার রাগ পড়লে একদম পানি। নীরব মা’কে সামলে নিবে।”
____________
আনিশাদের রুমে ইচ্ছে। একসাথে কার্টুন দেখছে। প্রীতি রুমে এসে পায়চারী করতে করতে কিছু ভেবে ফোন হাতে নিল। ঝটপট কল দিল। রিসিভ হতেই বেশ এক্সাইটেড হয়ে বলে প্রীতি,
-” ব্রো তোর তো কপাল খুলে গেল।”
ফোনের ওপাশ থেকে সার্থক প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,
-” কীভাবে?”
সবটা জানিয়ে প্রীতি শেষে বলল,
-” প্রত্যাশা আমাদের কাজিন।”
গলায় প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলে সার্থক,
-” এর সাথে আমার কপাল খুলার কী সম্পর্ক?”
-” আরে বুঝতে পারছো না। যেভাবেই হোক না কেনো প্রত্যাশা আমাদের নিজের। এ বাড়িতে ওর অপমান আমরা মানব না। ওকে ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে আমাদের কাছে নিবো। বুঝেছো? শুধু একটু বুদ্ধি খাটাও তাহলেই হবে। প্রত্যাশা যেহেতু আমাদের পরিবারের মেয়ে। এখন ওর লিগ্যাল গার্ডিয়ান আমরা। ওর উপর আমাদের একটা অধিকার আছে না? বলো আছে তো?”
-” তোকে তো আমি ব্রেনি জানতাম প্রীতি। এখন তো দেখছি সেই জানা ভুল ছিলো। তুই মোটেই ব্রেনি নোস। তুই আসলে একটা গাঁধী।”
প্রীতি রেগেমেগে চেঁচিয়ে বলল,
-” ভাইয়া…আআআআ।”
-” প্রত্যাশা আমাদের কাজিন। আর নীরবের? প্রত্যাশা নীরবের বউ। প্রত্যাশার উপর সকলের থেকে নীরবের অধিকার বেশি। আশাকরি এবার বুঝেছিস?”
হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না ঠিক তেমনি তার ভাইটাও তাদের পরিবারের সবার থেকে একটু হলেও ভিন্ন। এইযে তার আর ভাইয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে বলে,
-” প্রত্যাশার নামটা নীরবের নামের পাশে জড়ানোর একদিন আগেও যদি ওর সাথে আমার দেখা হতো, তাহলে আমি উঠে পড়ে লাগতাম। প্রত্যাশাকে নিজের করে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যেতাম। কিন্তু আফসোস ও যখন অলরেডি অন্যকারো সাথে বাঁধা পড়েছে। তখনই ভুল করে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। এটা আমার জীবনের একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকবে। তারপরও চাই, আমার না হোক, অন্তত সে যার শহরেই থাকুক, ভালো থাকুক। সুখে থাকুক।”
______________
রাগটা দমিয়ে নিঃশব্দে রুমে পা রাখল নীরব। প্রত্যাশা ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে। নীরব হাঁটু গেড়ে বসল। আলগোছে প্রত্যাশার কাঁধের উপর একটা হাত রাখতেই প্রত্যাশা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। বলল নীরব,
-” প্রত্যাশা তোমার আমার মাঝে দেয়াল কেনো দাঁড় করছো তুমি? তোমার সমস্যাটা কী?”
প্রত্যাশা কিছুপল নিশ্চুপ থেকে পরক্ষণেই অস্ফুটে বলল,
-” সমস্যা আপনি বারবার আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন। সমস্যা আমার শরীরে আপনাদের শত্রুর র*ক্ত বইছে।”
নীরব শান্ত ভঙিতে বলল,
-” আর আমার র*ক্ত, আমার অংশ যে এখন তোমার গর্ভে।*
-” প্লীজ নীরব এসব বলে আমাকে জোর করবেন না। এত অপমান সহ্য করে আমার পক্ষে আপনার সাথে থাকা সম্ভব নয়। আর আপনি নিজেও বলেছিলেন, দয়া দেখিয়ে বিয়েটা করা ভুল হয়েছে। তখন আমি বুঝতে না পারলেও এখন ক্লিয়ার। আপনার সেই ভুল শুধরে দিতে আমি চলে যেতে চাই। এতকিছুর পরেও থাকতে চাই না আমি।”
-” থাকতে হবে না। আমি জোর করব না। শুধু আমার বাচ্চাটা আমার কাছে আসা পর্যন্ত তুমি থাকবে, ব্যস!”
প্রত্যাশা সবেগে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলে,
-” অসম্ভব! মানে এক বছরের মতো আমাকে আটকে রাখতে চাইছেন?”
-” কে বলল এক বছর? তার সাথে আরো দু’টো বছর। বাচ্চাকে ফিড করানোর জন্য। যাও বেশি নয় আমার বাচ্চাটার জন্য তিনটে বছর থাকবে।”
প্রত্যাশা অসহায় মুখ করে বলল,
-” বুঝতে পারছি আপনার প্ল্যান। তিন বছর বলবেন, তারপর আবার আমায় প্রেগন্যান্ট করে নতুন অজুহাত দেবেন।”
নীরবের ঠোঁটের কোণে এবারে চাপা হাসি দেখা গেল। তবে হাসিটা চেপে রেখেই নির্লিপ্ত ভঙিতে বলে,
-” এই তো দেখছি মিসেস নীরবের বুদ্ধি খুলেছে। দরকার হলে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে এভাবেই আটকে রাখব। এই প্রসেস আর অজুহাত অব্যাহত রেখে।”
#চলবে