মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৪৭+৪৮

0
6

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

উপস্থিত সবাই স্তব্ধ হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজা বরাবর তাকাল। লম্বা লম্বা কদম ফেলে নীরব এগিয়ে আসে। প্রত্যাশার মাথা তখনও অধরার কাঁধে ঠেসে রাখা। কান্নার কারণে চোখের পাপড়িগুলো একসাথে লেগে আছে। ভেজা পল্লব তুলে বিস্ময় নিয়ে একবার নীরবের দিকে তাকাল। নীরব বউয়ের মুখের দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। নীরবের কপাল বেঁয়ে ঘাম ঝরছে। ফর্সা সুশ্রী বদনখানিতে উদ্বেগ, চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবুও চোখের পলক আলতোভাবে নামিয়ে ভরসা, আশ্বাস দিল। নিঃশব্দে চোখের ভাষায় ইশারায় কিছু বলতে চাইল, বোঝাতে চাইল— ডোন্ট ওয়ারি, আমি তো আছি।

কিন্তু পুরনো কিছু তিক্ত কথা ফের মন-মস্তিষ্কে বিরুপ প্রভাব ফেলল প্রত্যাশার। অভিমানে, অভিযোগে সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নেয় ও।

এদিকে ছেলের কথায় নীহারিকার মুখ মুহূর্তেই র*ক্তশূন্য হয়ে গেল। মাহবুব সাহেব হালকা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নীহারিকা কঠিন দৃষ্টিতে নীরবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,

-” তারমানে নীরব, তুইও সব জানতিস?”

নীরব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের প্রশ্নের জবাব দিল না। নীরবের নীরবতাই যেন উত্তর হয়ে দাঁড়াল। নীহারিকার গলা আরও কড়া হলো,

-” নীরব, তুই জানতিস? আমাকে জানাসনি কেনো? এখন বুঝতে পারছি, তোরা বাবা-ছেলে একসাথে মিলে লুকিয়েছিস। তোরা বাবা-ছেলে ঠিক জানতিস এসব জানলে আমি বিয়েটা কস্মিনকালেও হতে দিতাম না। তাই জানাসনি। তাই তো?”

-” মা তুমি ভুল বুঝছো..”

মাহবুব সাহেব নীরবকে থামিয়ে দিলেন। ধীর অথচ দৃঢ় গলায় বললেন,

-” নীরবকে আমিই নিষেধ করেছিলাম। শফিক ভাইয়ের কাছে প্রত্যাশা মা’কে চাওয়ার পর প্রথমে ওনারা দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সবটা আমায় বলেন। আমি ভেবেছিলাম এত বছর যেহেতু প্রত্যাশাকে নিজের মেয়ে হিসেবেই মানুষ করা হয়েছে। তাই কথাটা বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো দরকার নেই। তবে নীরবের জানাটা জরুরি ছিলো। কারণ ওর জীবন প্রত্যাশার সাথে জড়াবে। তাই আমি নীরবকে সব জানাই। নীরবকে সবটা জানাতেই প্রত্যাশার বয়স নিয়ে আপত্তি করলেও এ ব্যাপারে ওর কোনো আপত্তি নেই জানায়। নীরবের যেহেতু আপত্তি নেই তাই আমি চাইনি আর কেউ জানুক বিষয়টা।”

নীহারিকার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল,

-” বাহ্ খুব ভালো কাজ করেছো। বাবা-ছেলে মিলে মহৎ কাজ করেছো দেখছি। আমি এ-ও বুঝতে পারছি তুমি ঠিক জানতে আমি এরকম জন্ম আর ও বংশের র*ক্ত যার শরীরে সেই মেয়েকে মেনে নিতে পারব না। সব জেনেবুঝেও এই মেয়েকে আমার ছেলের বউ করে আনার খুব কী দরকার ছিলো?”

শাশুড়ির প্রতিটি কথা প্রত্যাশার বুকে ফলার মতো বিঁধছে। নীরবে নিঃশব্দে চোখের অশ্রু গড়িয়ে পরছে। নীরব দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরল। নীহারিকা এক মুহুর্ত থেমে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে তেরছা কণ্ঠে বললেন,

-” তোমাকে এসব বলেই বা কীই লাভ। তোমার তো আবার ওই পরিবারের প্রতি আলাদা একটা টান আছে। যতই হোক প্রথম ভালোব___”

নীরব নিচের অধরে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। মা কেনো জানি এই একটা জায়গায় এসে অবুঝ হয়ে যায়। খুব বেশিই কঠোর বনে যান। মা এখন এমন কিছু বলে সবার সামনে বাবাকে ছোট না করে ফেলে। যে মানুষটা তার অতীত সন্তানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছেন। জানতে দেননি। আজ ঘরভর্তি লোকের সামনে মা বাবাকে অস্বস্তিতে ফেলুক তা নীরব চায় না। তাই তো ডান হাতটা কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে তড়িঘড়ি মাকে থামিয়ে দিল,

-” ব্যস, মা যথেষ্ট হয়েছে। প্লীজ এবার থামো। এই বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি, মিটিং ডাকার আমি কিছু দেখি না। একটা সাধারণ বিষয়কে শুধুই টেনে জটিল করা হচ্ছে। প্রত্যাশাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুনতে পাচ্ছ? তারপরেও এত কথা উঠার মানেই হয় না।”

অদূরে দাঁড়ানো প্রীতির বুকে ভাঁজ করা হাত খসে পড়তে নেয়। পরপর সামলে ভাবে—এইরে এই মহিলার রাগ-জিদ সম্পর্কে আমি অবগত। ছেলে ডিরেক্ট বউয়ের পক্ষ নিয়ে এল। এটা হজম করা উনার পক্ষে কতটা কঠিন সেটা আর কেউ না জানলেও আমি জানি।

নীহারিকা থমকে গেলেন। এভাবে ছেলের মুখের উত্তর শুনে স্তব্ধ বনে যায়। মনে হচ্ছে নীরব যেন পরোক্ষভাবে বলে দিল— ওর শ্বশুরদের ডেকে বউকে নিয়ে তিনি মিটিং ডেকেছে। এসব বাড়াবাড়ি।

নীহারিকার চোখ ছলছল করে উঠল। তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠস্বরে বললেন,

-” বাহ্! এটাই বাকি ছিলো। নীরব তুইও নীবিড়ের মতো রূপ দেখালি।”

নীরবের মাথা কিঞ্চিৎ নুইয়ে এল। করুণ চাহনিতে মায়ের মুখপানে তাকিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলল,

-” মা প্লীজ রাগ-ক্ষোভ সরিয়ে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। প্লীজ মা ভুল বুঝো না। একবার ভাবো, বাবা-মায়ের ভুলের শাস্তি প্রত্যাশা কেনো পাবে? ওর দোষটা কী? ”

নীহারিকার শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেল। কোনো কথা কানে না তুলে কণ্ঠে এক সমুদ্দুর আফসোস নিয়ে বললেন,

-” এতদিন ভাবতাম আমার নীরব আলাদা। আমার নীরব মা বলতে পা”গ”ল। এখন তো আমি তোর মধ্যে শুধু চেহারায় মিল নীবিড় নয়, পুরো সেম মন মানসিকতার নীবিড়কে দেখতে পাচ্ছি। তোদের কাছে বউ আগে। মায়ের বিন্দুমাত্র দাম নেই। নীবিড়ের কাছেও ওই মেয়ের প্রায়োরিটি বেশি ছিল। তাই তো মায়ের কথা অমান্য করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করেছিল।”

মাহবুব সাহেব বললেন,

-” নিভানের মা তুমি একদম চাইল্ডিশের মতোন কথাবার্তা বলছো। মানছি এই একটা ব্যাপারে তুমি ছেলেমানুষী আচরণ করে বসো। তাই বলে সবসময় এমনই থাকবে? এবার একটু চেঞ্জেস আনা প্রয়োজন।”

নীরব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,

-” মা, কখনো ভেবে দেখেছো শুধু কি নীবিড়েরই দোষ ছিলো? তোমাদের কোনো ভুল ছিলো না? শুরু থেকেই যদি প্রীতিকে মেনে নিতে তাহলে নীবিড়কে আলাদা থাকতে হতো না। হয়তো সে আজ যে অবস্থায় আছে, সেখানে পৌঁছাতো না।”

নীহারিকা গম্ভীর গলায় বললেন,

-” নীবিড় যদি আমার কথা শুনতো। ওই মেয়েকে বিয়ে না করতো। তাহলেও এমন হতো না।”

মায়ের এই একগুঁয়ে মনোভাব নীরবকে ক্লান্ত করে তুলছে। নীহারিকার বুকে হালকা ব্যথা হচ্ছে। বুকের উপর হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চকণ্ঠে বললেন,

-” তোদের কাছে মা কিছুই না। বউই সব। নীবিড় যেমন মাকে ফেলে চলে গিয়েছিল, তুইও তাই করবি। যা তোর বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে থাক। তোদের কাউকে আমার চাই না।”

নীরব করুণ স্বরে বলল,

-” প্লীজ মা, থামো।”

নীহারিকা একহাতে আঁচল টেনে মুখে গুজলেন। হাত নেড়ে নেড়ে কোনরকমে বললেন,

-” নীরব সেদিনও আমি মানতে পারিনি। আজও তোর ক্ষেত্রেও মানতে পারছি না। তবে আমার মানায় তোদের কিছু আসে যায় না। তোদের কাছে মা নয়, বউ বড়। আমার সোজা কথা পরিবারকে ছেড়ে বউ নিয়ে বাসায় উঠবি? নাকি এই মেয়েকে ছাড়বি?”

হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে নীহারিকা এবার যেন জিদ হিসেবে নিয়ে নিল। ঘর শুদ্ধ সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মাহবুব সাহেব ধ’ম’কিয়ে উঠলেন,

-” নিভানের মা। ব্যস! অনেক হয়েছে এবারে থামো। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

নীরব দুই আঙুলে কপাল চেপে ধরে মাথাটা কিঞ্চিৎ নত করল। মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল। কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ থেকে কথা সাজিয়ে নিল। প্রত্যাশার বুকটা আরও ভারী হয়ে এলো। শফিক সাহেব মুখ খুলবেন অধরা ইশারায় স্বামীকে থামিয়ে দিলেন। নীরব মায়ের নিকটে এগিয়ে গেল। দুইহাতে মায়ের কাঁধ জড়িয়ে সোফায় বসিয়ে দিল। শান্ত নিচু স্বরে বলল,

-” আমার জন্য মা তুমি গুরুত্বপূর্ণ। আমার জন্য আমার স্ত্রীও গুরুত্বপূর্ণ। আমার মা হয়ে মা তোমার মুখে এ সমস্ত কথাগুলো একদম মানাচ্ছে না।‌ বড্ড বেশি বেমানান লাগছে।”

নীহারিকা জোরেজোরে শ্বাস টানতে টানতেই ছেলের মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন। নীরব নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে স্রেফ বলল,

-” মা আমি নীবিড় নই। আমি নীরব। তুমি রাগ করে বলবে আমিও জিদ ধরে বাড়ি ছেড়ে যাব। এমনটা ভাবলে ভুল। আমি জানি আমার মায়ের মন কতটা নরম। আমার মা দিনের পর দিন নীবিড়ের জন্য চোখের পানি ফেলেছে। অপেক্ষায় থেকেছে। সেটা কেউ না জানলেও আমি জানি। আমার কাছে আমার মা, আমার পরিবার যতটা প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক ততটাই প্রয়োজন, গুরুত্বপূর্ণ আমার সহধর্মিণী। প্রত্যাশা আমার অর্ধাঙ্গিনী। তোমাদের কাউকে বাদ দিয়ে আমি পূর্ণ হতে পারবো না। মা আমি আবারো বলছি, প্রত্যাশার এখন একটাই পরিচয় ও তোমার নীরবের স্ত্রী। আর এই পরিচয়টাই কী ওর জন্য এনাফ নয়?”

নীহারিকা উত্তর দিলেন না। এবারে যেন ঝিমিয়ে গেলেন। এদিকে শফিক সাহেব মাহবুব সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে ভারী স্বরে বলে উঠলেন,

-” প্রত্যাশাকে আমরা কোনোদিনও নীলার থেকে আলাদা করে দেখিনি। বরং ছোট বলে ওকে একটু বেশি আদর-আহ্লাদ দিয়ে বড় করেছি। ভালোবেসে প্রশ্রয় দিয়েছি। প্রত্যাশাকে জন্ম না দিলেও বাবা-মা হিসেবে সবটুকুই দিয়েছি, দেবো ইনশাআল্লাহ। সমাজের কাছে কে কীভাবে নেবে সেটা আমার ভাবনার বিষয় নয়। আমি বাবা হিসেবে বলছি প্রত্যাশা আমারই মেয়ে। শুধু ভরণপোষণের জন্য মেয়েকে বিয়ে দিইনি। আঠারোটা বছর যেভাবে আদরে, আবদার পূরণ করে বড় করেছি, আগামীতেও পারব। আল্লাহ আমাকে সেই সামর্থ্য দিয়েছেন। যদি আপনাদের কাছে আমার মেয়েকে মেনে নেওয়া এতটাই কঠিন হয়, তাহলে আমি ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছি। আমাদের মেয়ে ফেলনা নয়।”

নীরবের কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠল— আবার আরেকটা ঝামেলার শুরু।

মাহবুব সাহেব বললেন,

-” ভাই সাহেব আমি বুঝতে পারছি। তবে বলব এসব বিষয় আবেগে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়। মাথা গরম না করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। নিভানের মায়ের হয়ে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”

সহজ-সরল মেয়েটাকে মাহবুব সাহেবের বেশ ভালো লেগেছিল। এদিকে সম্পর্কটা আরো দৃঢ় করতে ছোট ছেলের জন্য প্রস্তাব রাখেন। যখন পরিচয় জানলেন, তিনিও দোদুল্যমান অবস্থায় পড়েন। পরবর্তীতে ভাবেন–শফিক সাহেব হয়তো ভাববে মেয়েটার এমন অতীত জেনেই হয়তো আর এগোলেন না। কিন্তু ভ’য় ছিলো এমন একটা দিনের। সব দোটানা একপাশে ঠেলে অবশেষে সব জেনেই ছেলের বউ করতে সম্মতি জানান। এদিকে নীহারিকা নীরবের জন্য পাত্রী দেখছিলেন তাই তো তাড়াহুড়া করে নীরবের আকদ করালেন।

প্রত্যাশা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,

-” আব্বু আমাকে নিয়ে চলো। আমি আর নিতে পারছি না।”

মেয়ের কথায় শফিক সাহেব তার কথায় অনড় অবস্থান নিলেন। মাহবুব সাহেব, শর্মিলা তাদেরকে বোঝাতে লাগলেন। প্রত্যাশা জিদ ধরেছে সে এক্ষুনি চলে যাবে। শফিক সাহেবও একগুঁয়ে ধরে রইলেন। অধরা স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করতেই শফিক সাহেব থামিয়ে দিলেন। শর্মিলা বললেন,

-” ভাই আপনি কী মেয়ের সাথে পাগল হলেন নাকি? মানছি অনেক কথা হয়েছে। তাই বলে এই রাতের বেলা এভাবে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে চলে যাবেন। মেয়ে বলছে কোথায় মেয়েকে একটু বুঝিয়ে সুঝিয়ে..”

কথার মাঝেই শফিক সাহেব অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,

-” ভাবী আমার মেয়েটা অসুস্থ। এখানে থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। এত কথা, এত অপমান আমার সহজ-সরল মেয়েটা নিতে পারবে না। দয়া করে আর জোর করবেন না। আমরা আমাদের মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি।”

নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উঠে সোজা প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল। ভণিতা ছাড়াই স্রেফ বলল,

-” প্রত্যাশা রুমে চলো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

প্রত্যাশা মুখ ফিরিয়ে নিল। নীরবের রাগ বাড়তে লাগলো। অধরা মেয়েকে চোখের ইশারায় যেতে বলেন। প্রত্যাশা পাথরের মতন কঠিন হয়ে রইল। শর্মিলা বলল,

-” প্রত্যাশা তোমাকে তো লক্ষ্মী মেয়ে জানি। নীরব কী বলতে চায় শুনে আসো।”

নীরব আকস্মিক প্রত্যাশার কব্জি চেপে ধরল। আর একটাও টু শব্দটি না করে সোজা রুমে নিয়ে এল। রুমে এসেই দাঁত চেপে বলল,

-” কেনো পা”গলামি করছো? এত টেনশন আমি আর নিতে পারছি না। প্লীজ তুমি অন্তত থামো।”

ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেলেও উপরে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে প্রত্যাশা। তাচ্ছিল্য সুরে বলল,

-” যার জন্ম এতটা কুৎসিত, বাজে তার সাথে আপনাকে মানায় না। আপনি আমার থেকে হাজারগুণ বেটার কাউকে পাবেন। আমাকে আর দয়া দেখাবেন না প্লীজ। আমি স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলে যেতে চাই। আপনার উপর আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই।”

ঝটিকায় প্রত্যাশার কাঁধ দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরে নীরব। চোয়াল কঠিন করে বলল,

-” প্রত্যাশা এবারে তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো। কেনো বুঝতে চাইছো না তোমাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। জন্ম পরিচয় দিয়ে কাউকে জাজ করা যায় না। সব জেনেশুনেই আমি তোমাকে গ্রহণ করেছি।”

প্রত্যাশা এক ঝটকায় নীরবের হাত দু’টো কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল। দলা পাকানো কান্নারা ফের বাঁধ ভাঙল। কান্না জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে উঠল,

-” সেটাই তো সব জেনেশুনে দয়া করেছেন। বিয়েটা করেছেন দয়া দেখিয়ে। এখন আবার আপনার মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দয়া দেখাচ্ছেন। এত দয়া আমি আর নিতে পারছি না।”

এই বলে ধপ করে মেঝেতে বসে পরে প্রত্যাশা। দুই হাতে মুখ ঢেকে ঝরঝরিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,

-” নীরব আমি আর দয়া চাই না। প্লীজ, লেট মি এলৌন। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স।”

নীরবের কপালের রগ টনটন করে উঠল। রাগে সজোরে দেয়ালে ঘু*ষি মা”রল। শব্দে প্রত্যাশা কেঁপে উঠে তাকাল। জ্বলজ্বল করে আ*গুনের মতো জ্বলা নীরবের চোখদুটোয় প্রত্যাশার তাকানোর সাহস হলো না। প্রত্যাশা দৃষ্টি নামিয়ে নিল। নীরব সোজা ব্যালকনিতে চলে যায়। নিস্তব্ধ ঘরে প্রত্যাশার কান্নার বেগ বাড়ল।

___________

নিভানের মুখের দিকে তাকাতেই নীলাশা ধরতে পারে নিভান তার উপর অসন্তুষ্ট। নীলাশা অসহায় স্বরে বলল,

-” নিভান তুমিও আমাকে ভুল বুঝলে?”

নিভান উত্তর দিল না। নীলাশা তাতে বেশি আহত হলো। নীলাশা ভারী মুখশ্রীতে বলল,

-” বিশ্বাস করো নিভান এমন কিছু হোক আমি চাইনি। নীরবের সাথে বিয়ের দিন প্রত্যাশাকে ফোর্স কিন্তু আমিই করেছিলাম। হ্যাঁ প্রত্যাশার সাথে আমার সম্পর্ক সুমিষ্ট ছিলো না। তবে ওর খারাপ হোক এ-ও চাইনি।”

নিভান তপ্ত শ্বাস ফেলে মেরুদন্ড টানটান করে দাঁড়াল। দৃষ্টি তার ব্যালকনির গ্রীল পেরিয়ে দূর অন্ধকারে। আকাশে আজ মেঘের ঘনঘটা। চাঁদ তো দূর একটা তাঁরাও দেখা যাচ্ছে না। নীলাশা অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে ধীরে ধীরে বলে গেল,

-” প্রত্যাশা ছোট থেকেই খুব বেশি আহ্লাদী ছিলো। আব্বু আম্মু ওকে সবসময় প্রশ্রয় দিতো। আমি এটা মানতে পারতাম না। আমার কাছে অতিরিক্ত লাগতো। সেই থেকেই একটু একটু করে প্রত্যাশার প্রতি বিরূপ মনোভাব জন্মে। এখনো প্রত্যাশা বাড়ি গেলে একবেলা হাত দিয়ে ভাত খায়, দুইবেলা আম্মু খাইয়ে দেয়। আমি নিজ থেকে এমন আহ্লাদ করতে আজও পারি না। তাই ওর এমন আচরণ আমার ভালো লাগতো না। আমার মনে হতো আমার আব্বু আম্মু ওকে বেশি আহ্লাদ করে। আবার এখন এ বাড়িতে ওর বাচ্চা হওয়া নিয়ে ওর প্রতি সবার এত কেয়ার দেখে আমার নিজেকে অসহায় লাগতো।”

-” তাই তো আজ রাগ জিদ করে এমন কান্ড করলে?”

নীলাশার প্রচন্ড কান্না পেল। নিজেকে সামলে বলল,

-” নিভান আমার পুরো কথাটা আগে শোনো। প্রীতি আমাকে উস্কালেও আমি বলিনি। আমি চাইনি বলতে। তবে আজ সন্ধ্যায় আমি রাগের মাথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলি। আমার হাত কেটে গেলেও মা কিছুই বললেন না। অথচ প্রত্যাশা পরে যেতে নেয়, এই দেখেই আমাকে কতগুলো কথা শুনালেন। আমার তখন প্রত্যাশার উপর রাগ হয়। আমি রাগ করতেই মা আমার উপর চড়াও হলেন। আচ্ছা, প্রত্যাশা তো সবার কাছে আমার বোন হিসেবেই পরিচিত। বোন কী বোনকে রাগ করে না? রাগ দেখায় না? মা তো সেই হিসেবেও নিতে পারতো। কিন্তু না মা আমাকে কড়া করে বললেন। সেই সময় আমি রাগের মাথায় বলে ফেলি। অথচ আমার নিজের আম্মু কী না আমাকে এতবড় একটা কথা বলল। আমার আম্মু বলল, আমি কোনোদিন মা হতে পারব না জন্য, প্রত্যাশার সুখ আমার সহ্য হচ্ছে না।”

ডুকরে কেঁদে উঠল নীলাশা। ভাঙা সুরে বলে,

-” একবারো কেউ আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে না। আম্মু কী করে পারল এমন বলতে?”

একহাতে নীলাশাকে আগলে বুকে টেনে নিল নিভান। চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে বলল,

-” নীলাশা তোমার আম্মু রাগের মাথায় বলেছেন। রাগের সময়কার কথা ধরতে নেই। আর একদিন না একদিন তো সত্য সামনে আসতোই। বাট প্রত্যাশার প্রেগনেন্সির সময় এরকমটা না হলেও পারতো। তোমার আরেকটু ভেবে চিন্তে কথা বলা উচিত ছিলো। যাইহোক, সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না। আমার মায়ের রাগ হলে আ*গুন। আবার রাগ পড়লে একদম পানি। নীরব মা’কে সামলে নিবে।”

____________

আনিশাদের রুমে ইচ্ছে। একসাথে কার্টুন দেখছে।‌ প্রীতি রুমে এসে পায়চারী করতে করতে কিছু ভেবে ফোন হাতে নিল। ঝটপট কল দিল। রিসিভ হতেই বেশ এক্সাইটেড হয়ে বলে প্রীতি,

-” ব্রো তোর তো কপাল খুলে গেল।”

ফোনের ওপাশ থেকে সার্থক প্রশ্ন ছুঁ’ড়ল,

-” কীভাবে?”

সবটা জানিয়ে প্রীতি শেষে বলল,

-” প্রত্যাশা আমাদের কাজিন।”

গলায় প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলে সার্থক,

-” এর সাথে আমার কপাল খুলার কী সম্পর্ক?”

-” আরে বুঝতে পারছো না। যেভাবেই হোক না কেনো প্রত্যাশা আমাদের নিজের। এ বাড়িতে ওর অপমান আমরা মানব না। ওকে ছাড়িয়ে আমাদের বাড়ির মেয়ে আমাদের কাছে নিবো। বুঝেছো? শুধু একটু বুদ্ধি খাটাও তাহলেই হবে। প্রত্যাশা যেহেতু আমাদের পরিবারের মেয়ে।‌ এখন ওর লিগ্যাল গার্ডিয়ান আমরা। ওর উপর আমাদের একটা অধিকার আছে না? বলো আছে তো?”

-” তোকে তো আমি ব্রেনি জানতাম প্রীতি। এখন তো দেখছি সেই জানা ভুল ছিলো। তুই মোটেই ব্রেনি নোস। তুই আসলে একটা গাঁধী।”

প্রীতি রেগেমেগে চেঁচিয়ে বলল,

-” ভাইয়া…আআআআ।”

-” প্রত্যাশা আমাদের কাজিন। আর নীরবের? প্রত্যাশা নীরবের বউ। প্রত্যাশার উপর সকলের থেকে নীরবের অধিকার বেশি। আশাকরি এবার বুঝেছিস?”

হাতের পাঁচটা আঙুল যেমন সমান হয় না ঠিক তেমনি তার ভাইটাও তাদের পরিবারের সবার থেকে একটু হলেও ভিন্ন। এইযে তার আর ভাইয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে বলে,

-” প্রত্যাশার নামটা নীরবের নামের পাশে জড়ানোর একদিন আগেও যদি ওর সাথে আমার দেখা হতো, তাহলে আমি উঠে পড়ে লাগতাম। প্রত্যাশাকে নিজের করে নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যেতাম। কিন্তু আফসোস ও যখন অলরেডি অন্যকারো সাথে বাঁধা পড়েছে। তখনই ভুল করে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। এটা আমার জীবনের একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে থাকবে। তারপরও চাই, আমার না হোক, অন্তত সে যার শহরেই থাকুক, ভালো থাকুক। সুখে থাকুক।”

______________

রাগটা দমিয়ে নিঃশব্দে রুমে পা রাখল নীরব। প্রত্যাশা ফ্লোরে বসে হাঁটুতে মুখ গুঁজে। নীরব হাঁটু গেড়ে বসল। আলগোছে প্রত্যাশার কাঁধের উপর একটা হাত রাখতেই প্রত্যাশা চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। বলল নীরব,

-” প্রত্যাশা তোমার আমার মাঝে দেয়াল কেনো দাঁড় করছো তুমি? তোমার সমস্যাটা কী?”

প্রত্যাশা কিছুপল নিশ্চুপ থেকে পরক্ষণেই অস্ফুটে বলল,

-” সমস্যা আপনি বারবার আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন। সমস্যা আমার শরীরে আপনাদের শত্রুর র*ক্ত বইছে।”

নীরব শান্ত ভঙিতে বলল,

-” আর আমার র*ক্ত, আমার অংশ যে এখন তোমার গর্ভে।*

-” প্লীজ নীরব এসব বলে আমাকে জোর করবেন না। এত অপমান সহ্য করে আমার পক্ষে আপনার সাথে থাকা সম্ভব নয়। আর আপনি নিজেও বলেছিলেন, দয়া দেখিয়ে বিয়েটা করা ভুল হয়েছে। তখন আমি বুঝতে না পারলেও এখন ক্লিয়ার। আপনার সেই ভুল শুধরে দিতে আমি চলে যেতে চাই। এতকিছুর পরেও থাকতে চাই না আমি।”

-” থাকতে হবে না। আমি জোর করব না। শুধু আমার বাচ্চাটা আমার কাছে আসা পর্যন্ত তুমি থাকবে, ব্যস!”

প্রত্যাশা সবেগে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলে,

-” অসম্ভব! মানে এক বছরের মতো আমাকে আটকে রাখতে চাইছেন?”

-” কে বলল এক বছর? তার সাথে আরো দু’টো বছর। বাচ্চাকে ফিড করানোর জন্য। যাও বেশি নয় আমার বাচ্চাটার জন্য তিনটে বছর থাকবে।”

প্রত্যাশা অসহায় মুখ করে বলল,

-” বুঝতে পারছি আপনার প্ল্যান। তিন বছর বলবেন, তারপর আবার আমায় প্রেগন্যান্ট করে নতুন অজুহাত দেবেন।”

নীরবের ঠোঁটের কোণে এবারে চাপা হাসি দেখা গেল। তবে হাসিটা চেপে রেখেই নির্লিপ্ত ভঙিতে বলে,

-” এই তো দেখছি মিসেস নীরবের বুদ্ধি খুলেছে। দরকার হলে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তোমাকে এভাবেই আটকে রাখব। এই প্রসেস আর অজুহাত অব্যাহত রেখে।”

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৮|
#মুসতারিন_মুসাররাত

ভোরের আলো ফুটে নতুন দিনের সূচনা হলেও, হঠাৎ জানা চরম সত্যিটা প্রত্যাশাকে যেন ঘুটঘুটে অন্ধকারে ফেলে দিলো। আঠারোটা বছর যাদেরকে বাবা-মা জেনে এসেছে হঠাৎ করেই জানা নিষ্ঠুর সত্যিটা; সেই সম্পর্কটা র*ক্তে”র নয়। মন মানতে পারছে না। কষ্টে অন্তর আত্মা ছিঁড়ে যাচ্ছে। বারবার চেষ্টা করেও স্বাভাবিক হতে পারছে না। সেই সন্ধ্যা থেকে কান্নাকাটি করতে করতে একদম দুর্বল হয়ে পড়েছে মেয়েটা।

প্রত্যাশার এমন ভেঙে পরা দশা দেখে অধরা মাহবুব সাহেব আর নীরবকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

-” আমার মনে হয় এখন প্রত্যাশাকে আমাদের সাথেই রাখা উচিত। মেয়েটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। এই মুহূর্তে ওর আমাদের দরকার। কিছুদিন আমাদের কাছে থাকুক স্বাভাবিক হলে আসবে। একটা সম্পর্ক ভাঙা খুব সহজ, কিন্তু জোড়া লাগানো কঠিন। আর বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয় যে রাগের মাথায় সবকিছু ভেঙে দেব। এসব ভাবাও বোকামি, নির্বুদ্ধিতা।”

অধরা থেমে নীরবের দিকে তাকালেন। বললেন,

-” আশা করি নীরব এ ব্যাপারে তোমার আপত্তি থাকবে না। প্রত্যাশা একটু স্বাভাবিক হলে তুমি গিয়ে নিয়ে আসবে। আমরা কোনো বাঁধা দেব না। আসলে আমরা বাঁধা দেওয়ার অধিকারও রাখি না। যেদিন মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, সেদিন থেকেই ওর ভাল-মন্দ, দায়িত্ব সব তোমার ওপর অর্পণ করা হয়েছে।”

নীরব চুপচাপ মাথা নাড়ল। বাড়িতে যে সিচুয়েশন এখন তাতে প্রত্যাশার কিছুদিন ও বাড়িতে থাকাই বেটার। এসব ভেবে সার্বিক দিক বিবেচনা করে নীরব আর দ্বিরুক্তি করে না।

.
.

নীহারিকা অবশ্য সেই যে রাতে ঝিমিয়ে গেলেন আর কিচ্ছুটি বলেননি। তবে রুম থেকেও আর বেরোয়নি। সকালে নীরব প্রথমে মায়ের রুমে যায়। মা’কে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টাটুকু বাদ রাখেনি। নীরব ঠাণ্ডা গলায় বলে,

-” প্লীজ মা, এভাবে অভিমান করে থেকো না। ভেবে দেখো তো যে মেয়েটা আঠারোটা বছর ধরে যাদের বাবা-মা জেনে বড় হয়েছে। হঠাৎ জানা নিষ্ঠুর সত্যিটা তার ভেতরটাকে কতটা ভেঙে দিতে পারে। তার লাইফে এরচেয়ে নি’র্মম আ’ঘা”ত আর কীই বা হতে পারে? এমন জন্ম, এমন দৃষ্টিকটু পরিচয় কেউ কি কখনো কামনা করে? এটা প্রত্যাশার জন্য ভীষণ কষ্টের। এই মুহূর্তে ওর পাশে দাঁড়ানো, একটু সাহস যোগানোই আমাদের উচিত নয় কী? জন্ম তো কেউ নিজের ইচ্ছায় বেছে নেয় না। তবে কেনো জন্মের দোষে তাকে দণ্ড পেতে হবে?”

ছেলের প্রতিটি কথা যুক্তিক। নীহারিকা উত্তর দিতে না পেরে পাথরের মূর্তির মতোন বসে রইলেন ঠাঁই। নীরব ব্যাকুল স্বরে বলল,

-” এভাবে চুপ করে থেকো না মা। প্লীজ কিছু তো বলো।”

নীহারিকা ঝিম ধরে থেকে পরোক্ষণেই প্রসঙ্গ বদলাতে বললেন,

-” তোর শ্বশুড় শাশুড়িকে নাস্তা দেয়া হয়েছে? ছোটোকে বল নাস্তা দিতে। না খেয়ে যেন না যায়। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। আমাকে একটু একা ছাড় বাবা। বাকিটা তোর যা ভালো মনেহয় কর। আমি আর এ ব্যাপারে কিছুই বলতে চাই না।”

.
.

প্রত্যাশা ব্যাগ গোছাচ্ছে। চোখের কোণে টলমল করছে অশ্রু। নীরব এগিয়ে এসে বাহু ধরে আলতো টান দিয়ে প্রত্যাশাকে ঘুরিয়ে নেয়। প্রত্যাশা মাথা নত করে ফেলল। নীরব গম্ভীর গলায় বলল,

-” প্রত্যাশা, আমার দিকে তাকাও।”

প্রত্যাশার চিবুক বুকের সাথে লেগে আছে। ওর সাহস হলো না মুখ তুলে তাকাতে। নীরব এবার কড়া সুরে পুনরায় বলল,

-” তাকাও বলছি। প্রত্যাশা আমার চোখের দিকে তাকাও।”

ধীরেধীরে মুখ তুলে তাকাল প্রত্যাশা। চোখ ভিজে গেছে। চোখের কোল ঘেঁষে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নীরব আলতো করে গালে হাত রেখে আঙুলের স্পর্শে চোখের পানি মুছে দিল। শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

-” যেতে চাইছো যাও। তবে মনে রেখো আমার বাচ্চার যেন একচুলও ক্ষ*তি না হয়। তোমার অবহেলা, নিজের অযত্নের কারণে যদি ওর কিছু হয়। আমি সেটা টলারেট করব না। নিজের যত্ন নেবে, যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে সামলে নেবে।”

প্রত্যাশা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। নীরব ফের বলল,

-” আর একটা কথা শুনে নাও র*ক্তের সম্পর্ক না থাকলেই কী? তোমার আব্বু-আম্মুর ভালোবাসায়, স্নেহে, তাদের যত্নে কি কখনো একফোঁটা কমতি পেয়েছো? তুমি জানো, উত্তরটা ‘না’। শোনো, একদম মন খারাপ করে কান্নাকাটি করবে না। ভুলেও মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তার জায়গা দেবে না। সো বি কেয়ারফুল।”

প্রত্যাশা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ঠোঁট কামড়ে আটকে রাখা কান্না ঝরে পড়ল। আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়ল নীরবের বুকে। ঝরঝরিয়ে কাঁদতে লাগল। প্রত্যাশাকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,

-” আমি তোমার আসার অপেক্ষায় প্রহর গুণব। আশাকরি অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ করবে না।”

___________

প্রত্যাশাকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নীহারিকার মনটা খচখচ করতে থাকে। সময় গড়াল রাগ-ক্ষোভও যেন একটু একটু করে মিইয়ে আসলো। নীরবের বলা কিছু কথা বারবার মনে উঠল। অবচেতনে ভাবেন— আসলেই তো এমন জন্ম কেউ কী নিজ থেকে চায়? জন্ম, মৃ*ত্যু এসব তো কারো হাতে থাকে না। আর সমস্যা বংশের হলে তাতে নিষ্পাপ মেয়েটার দো*ষ কীসে?

এসব ভেবে অনুতপ্ত অনুশোচনায় নীহারিকার ভেতরটা কেমন করে উঠল। অন্যদিকে ছেলের বিষণ্ণ, কষ্টেভরা মুখের দিকে তাকালে বুকটা হাহাকার করে উঠছে।‌ তিনদিনের দিন সকালে নাস্তার টেবিলে নীরবকে উদ্দেশ্য করে জড়তা নিয়ে নিম্নস্বরে শুধালেন,

-” প্রত্যাশার শরীর কেমন আছে?”

পরোটা ছিঁড়তে গিয়ে নীরবের হাত থেমে গেল। মায়ের মুখের দিকে একপল তাকিয়ে ফের খাবারে মনোযোগ দিয়ে বলল,

-” ভালো।”

অতঃপর বলে উঠলেন নীহারিকা,

-” নীরব বলছি যে, যা হওয়ার হয়েছে প্রত্যাশাকে গিয়ে নিয়ে আয় বাবা।”

নীরব একটুও অবাক হয় না। সে জানে তার মায়ের মন মোমের মতন। মোম যেমন কঠিন হলেও, আগুনের আঁচে আসতেই গলতে শুরু করে। ঠিক তেমনি তার মায়ের কঠিন হৃদয়ও সন্তানের ভালো থাকার জন্য গলে যায় নিমিষেই। নীবিড় ফিরে আসেনি, মা’কে এভাবে বোঝানোর চেষ্টাটুকু অবধি করেনি। পরোটা ছিঁড়ে মুখে পুড়তে পুড়তে বলল নীরব,

-” থাক আরো কিছুদিন। এমনিতে বলেও লাভ হবে না। মনেহয় না ও সহজে আসবে। আর এটা অস্বাভাবিক বা বাড়াবাড়ি নয়। ওর দিক দিয়ে ও ঠিকই আছে।”

নীহারিকা চুপ করে গেলেন। শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অবশেষে সবাইকে একদফা অবাক করে বিকেলে স্বামীর সাথে প্রত্যাশাকে আনতে যান। বাড়িটা কেমন মরামরা লাগছিল। অথচ ক’দিন আগেই সবাই কত হাসিখুশি প্রফুল্ল ছিলো। আর মেয়েটা অন্তঃসত্ত্বা। সব ভেবেচিন্তে নীহারিকা যান। অনুশোচনা অনুতপ্ত প্রকাশ করে প্রত্যাশাকে সাথে আসার জন্য অনুরোধের সুরেই বলেন। অধরা মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দেয়।

_____________

সাঁঝের অন্ধকারে ব্যস্ত নগরী ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। ড্রয়িংরুমে পায়ের উপর পা তুলে বসে কফির পেয়ালায় ছোট্ট করে চুমুক দেয় প্রীতি। গতকালকেই ফিরেছে সে। ইচ্ছে ওদিকটায় বসে টেডি নিয়ে খেলছে। ফের ধোঁয়া ওঠা কফিতে ঠোঁট ছোঁয়াতেই তানিয়া আসলেন। অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,

-” তোমাকে দিয়ে আজ অবধি একটা কাজও ঠিকঠাক হলো না প্রীতি। এতগুলো দিন ওখানে থেকে করলে টা কী শুনি? শুরু থেকেই তুমি সেই এক নীরবেই আঁটকে আছো। নিশ্চয় নিজের রাগ-জিদ, ইগো নিয়ে থাকায় আসল কাজটাই করার চেষ্টাটুকুই করোনি।”

পায়ের উপর থেকে পা নামাল প্রীতি। কাঁধ নাড়িয়ে বলল,

-” মা কী করে করব বলো তো? ওখানে গেলেও আমি নীরবকে এড়িয়ে চলি। ওর সাথে কথা বলা তো দূর এক টেবিলে বসে পর্যন্ত খাইনি। সেইচ্ছায় ওর সামনে পড়তে চাইনি।”

তানিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,

-” যে কাজ দিয়েছিলাম সেটা নীরবের অগোচরেই করতে, নট ওর সামনে।”

-” মা ওটা জয়েন ফ্যামেলি। রুম থেকে বেরোলেই একজন না একজনের সাথে দেখা হয়ই। সবার ভিড়ে আমি কী করতাম শুনি?”

-” সবাই নিশ্চয় নীরবের রুমে থাকে না। আর প্রত্যাশা বো*কা, তাকেও যদি সামলে কাজটা করতে না পারো। তাহলে তো আমার বলতে হচ্ছে, তুমি প্রত্যাশার থেকেও বো*কা।”

প্রীতির মুখটা কালো হয়ে এল। কফির মগ টেবিলে নামিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,

-” প্রত্যাশাকে আমার সহ্য হয় না। ওর জন্য নীরব আমাকে অপমান করছে, ইভেন গায়ে হাত তুলেছে। এত কিছুর পরে প্রত্যাশার সাথে অভিনয়টাও ঠিকঠাক আসে না।”

তানিয়া ঠোঁট ফাঁক করে কিছু বলবেন সেই মূহূর্তে সার্থকের গলা পেয়ে থেমে গেলেন। সার্থক ঢুকেই ইচ্ছেকে দেখে স্নিগ্ধ হেসে বলল,

-” মামা কখন এসেছো?”

ইচ্ছে ফ্লোর থেকে উঠে টেডিটা একহাতের ভাঁজে কোলের সাথে নিয়ে ঝটপট মামার সামনে দাঁড়াল। ঘনঘন চোখের পাতা নেড়ে বলল,

-” কাল এসেছি, মামা তুমি রাতে বাসায় আসোনি কেনো?”

সার্থক হেসে হাঁটু গেড়ে বসল। ইচ্ছের গালে চুমু খেয়ে বলল,

-” মামা আমার একটা সেমিনার ছিলো। সেখানে দু’দিন থাকতে হয়েছিল। বাই দ্য ওয়ে তোমাদেরকে খুব মিস করছিলাম। কিন্তু তুমি তো মামাকে ভুলে গিয়েছো। দাদু বাসায় থাকলে মামার কথা তো আর মনে থাকে না।”

-” থাকে তো। অল্প অল্প মনে থাকে।”

সার্থক মিছেমিছে মন খারাপ করার ভান ধরে বলল,

-” ভেরি ব্যাড। অল্প মনে থাকার জন্য আমি মন খারাপ করেছি। বেশি মনে রাখো না কেনো কিউটিপাই?”

-” পাপাকে বেশি মনে থাকে। তুমি মন খারাপ করো না। দিদুনকে, বড় পাপাকেও অল্প মনে থাকে।”

সার্থক গাল টিপে দিয়ে বলল,

-” ওকে সোনামণি।”

ইচ্ছে হঠাৎ হাতের টেডি দেখিয়ে বলল,

-” মামা এটা পাপা গিফট করেছে। কিউট না? দ্যাখো দ্যাখো কেমন বড়বড় আইস…ওয়াও!”

টেডির চোখদুটোয় তাকাতেই সার্থকের কপালে ভাঁজ পড়ল। নিচের অধরে দাঁত চেপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কিছু মনে হলো, তন্মধ্যে ইচ্ছে সার্থকের হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,

-” মামা আমার চকলেট।”

সার্থক কপাল চুলকিয়ে বলল,

-” ওহ্, শিট! ভুল হয়ে গেল তো। তোমরা যে আসছো জানতাম না। স্যরি লিটল প্রিন্সেস, যাও কালকে ডাবল চকলেট বক্স পাবে। সাথে নিউ টয়।”

টুপ করে মামার গালে চুমু খেয়ে বলল ইচ্ছে,

-” থ্যাংকিউ মামা।”

তানিয়া ছেলেকে ডেকে কোমরের ব্যথার কথা তুলতেই সার্থক সেদিকে এগিয়ে গেল।

___________

রাত প্রায় দশটা। পুরো বিল্ডিং জুড়ে গা ছমছম ভাব। করিডোর শুনশান, সব রুম তালাবদ্ধ। একমাত্র আলো জ্বলা রুমটার সামনে এসে দাঁড়াল তানভীর। হাতে একটা ফাইল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিলো। নীরবের দৃষ্টিজোড়া ল্যাপটপে। আঙুলগুলো ত্রস্ত চলছে কীবোর্ডে। তানভীর হালকা গলা খাঁকারি দিল। চাহনি ল্যাপটপের স্ক্রিনে রেখেই নীরব বলল,

-” কাম ইন”

তানভীর এগিয়ে হালকা স্বরে জিজ্ঞাসা করল,

-” স্যার বাসায় যাবেন না?”

-” একটু দেরি হবে।”

হাতের ফাইলটা সামনের টেবিলে নামাতে নামাতে চাপা আওয়াজে বলল তানভীর,

-” স্যার ওই মা*দক পাচারকারী ডিলারটা যাকে যে ছদ্মবেশে ধরলেন। ওইযে স্যার দুই মাস খানেক আগে। ওইযে বৃষ্টির মধ্যে ম্যাডামের সাথে দেখা হলো না…”

নীরব এবারে চোখ তুলে তাকাল। আর তাকাতেই তানভীর শুকনো ঢোক গিলল। নীরব গম্ভীর মুখে সোজাসাপ্টা বলল,

-” এত কাহিনী, দৃশ্যপট না টেনে সোজাসুজি বলো। আমার এত ভুলো মন নয়। ক্লিয়ার?”

তানভীর মাথা নাড়ল। জিভের ডগায় ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,

-” সেই কেস নিয়ে তো এখন উপর থেকে প্রচন্ড চাপ আসছে। এবার কি আসল গডফাদার ধরা পড়বে নাকি আগের মতো সব ধামাচাপা হবে? আসল অপরাধী আড়ালেই থেকে যাবে।”

-” লেট’স সি হাউ লং দে ক্যান কিপ হাইডিং বিহাইন্ড দেয়ার মাস্কস।”

তানভীর মাথা নেড়ে বলল,

-” যাদের দিয়ে এই গ্যাং তৈরি হয়েছিল, তারা তো বেঁচে নেই। তাদের পরিবারের একজনকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছিল। তবে নজরদারিতে রেখেও তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তাহলে স্যার বাইরের কেউ কি এটা চালাচ্ছে? নতুন করে শুরু করেছে।’

ল্যাপটপের শাটার নামাল নীরব। ধীরে ধীরে পেনড্রাইভটা হাতে তুলে নিতে নিতে বলল,

-” যাদের আমরা সাধারণত সন্দেহের বাইরে রাখি, তারাই আসলে মুখোশের আড়ালে ধ্বং*স করে বেড়ায়। এবার দেখা যাক শেষটা কী হয়! শুধু প্রমাণটুকু জোগাড় করা বাকি। আশারাখি সেটাও দ্রুতই পেয়ে যাব।”

.
.

ঘড়ির কাঁ’টা রাত্রি একটার ঘরে। এক্সট্রা চাবি দিয়ে মেইন দরজা খুলে ঢুকে নীরব। নিস্তব্ধ বাড়ি, সবাই হয়তো ঘুমে ডুবে আছে। রুমে ঢুকে লাইট অন করতেই চমকে গেল। বিছানায় প্রত্যাশা ঘুমোচ্ছে। দু’বার চোখের পলক ফেলল নীরব। ভেবেছিল হ্যালুসিনেশন, কিন্তু না। এগিয়ে গিয়ে শিওর হয়। ফ্যানের হাওয়ায় প্রত্যাশার মুখের ওপর ছোটছোট চুল উড়ছিল। নীরব হাত বাড়িয়ে কানের পাশে সরিয়ে দিল। নিচের অধরের ডানপাশে দাঁত বসিয়ে ভাবল—প্রত্যাশা তো আসার কথা বলেনি!

ফ্রেশ হয়ে মৃদু আলোটা জ্বালিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পরে নীরব। কিছুক্ষণ একনাগাড়ে তাকিয়ে রইল ঘুমন্ত প্রত্যাশার মুখের দিকে। ডেকে তোলার ইচ্ছে করল না। তবে বুকের ভেতরের শূন্যতা দূর করতে একহাতে জড়িয়ে নিল। ধীরে ধীরে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল। এ কদিন রুমটা একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। বুকটা হাহাকার করছিল। আজ যেন মুহূর্তেই মনটা হালকা হয়ে গেল।

গরম নিঃশ্বাস গলায় আছড়ে পড়ছে। পেটে উষ্ণ হাতের স্পর্শ। এবারে প্রত্যাশার ঘুম ভেঙে গেল। চোখবুঁজেই অনুভব করে চেনা স্পর্শ। নাসারন্ধ্রে বারি খাচ্ছে পরিচিত পারফিউমের ঘ্রাণ। প্রত্যাশা একটু নড়ার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল,

-” কখন এসেছেন?”

নীরব মৃদু হেসে বলল,

-” আগে বলো তুমি কখন এসেছো? না বলে চলে এলে? এটা কি আমার জন্য সারপ্রাইজ ছিলো? যাইহোক আমি কিন্তু সত্যিই সারপ্রাইজড!”

প্রত্যাশা আগের মতো হাসিখুশি নেই। কথাও কম বলে, চেহারায় সারাক্ষণ একটা বিষণ্ণ ছাপ। আগে হলে ঝটপট রেলগাড়ির মতো মুখ চলত। তবে আজ তা আর হলো না। ধীরেধীরে বলল,

-” মা-বাবা গিয়েছিলেন আনতে। সন্ধ্যার একটু আগে এসেছি। শুনলাম আপনি খুব ব্যস্ত। ক’দিন রাত করে ফিরছেন। বেশি বিজি আছেন ভেবে আর ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করিনি।”

-” আমি ব্যস্ত ছিলাম তোমার অভাবে। তোমাকে ছাড়া সবকিছুই ফাঁকা। অফিস, কাজের চাপে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা। ব্যস্ততার ভিড়েও তোমাকে প্রচন্ড মিস করেছি।”

প্রত্যাশা প্রত্যুত্তরে নিশ্চুপ রইল। নীরব মাথাটা তুলে প্রত্যাশার মুখের দিকে চাইল। বলল হিমশীতল স্বরে,

-” তুমি জানো তোমাকে ছাড়া, তোমার গায়ের মিষ্টি গন্ধ ছাড়া আমার ঘুম হয় না। তোমাকে ছাড়া মনে হচ্ছিল আমি শ্বাস নিচ্ছি, কিন্তু বেঁচে নেই। আজ তোমাকে বুকে নিয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। উফ্! এতক্ষণে নিজেকে জীবিত ঠেকছে।”

কথা বলতে বলতে প্রত্যাশাকে ফের বুকে টেনে নিলো নীরব। হঠাৎ নীরবের ঠোঁটের স্পর্শে শরীর শিউরে উঠল প্রত্যাশার। প্রত্যাশার গলায় ঠোঁট ছোঁয়ায় নীরব। প্রত্যাশা নিজেকে ছাড়াতে নড়েচড়ে উঠল। নীরব ওভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে প্রগাঢ় কণ্ঠস্বরে স্রেফ বলল,

-” শোনো আমি ভীষণ টায়ার্ড। সারাদিনের স্ট্রেস, দৌড়ঝাঁপের পর প্রশান্তি চাই। আর আমার শান্তি মানে তুমি। তিন রাত একটুও ঠিকমতো ঘুমাতে পারিনি। আজ একটাই অনুরোধ ডিস্টার্ব করো না। এভাবেই জড়িয়ে ঘুমাতে দাও, প্লীজ।”

প্রত্যাশার ঠোঁটে এবার হালকা হাসি ফুটল। অবশ্য সে হাসি নীরবের দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেল।

___________

তিন চারদিন পর। ঝলমলে বিকেল বেলা। শর্মিলার শরীরটা খারাপ। এদিকে আনিশা বায়না ধরেছে ঘুরতে যাবে। মায়ের সাথে সে প্রায়ই বিকেলে পার্কে ঘোরে, বিভিন্ন ইভেন্টে চড়ে। মেয়ের ঘ্যানঘ্যানিতে শর্মিলা রেগে পিঠের উপর দিলো দু’টো। আর তাতেই আহ্লাদী মেয়ে কেঁদে পুরো বাড়ির মানুষ জড় করল। ছেলেরা সবাই অবশ্য কর্মক্ষেত্রে। নীহারিকা এগিয়ে এসে আনিশাকে আগলে নিয়ে বললেন,

-” মেয়েটাকে এভাবে মারছিস কেনো ছোটো? বুঝিয়ে বললেই তো হয়।”

-” বলছি আমার মাথা ধরেছে কাল নিয়ে যাব। না কিচ্ছুতেই শুনতে চাইছে না। ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান করেই যাচ্ছে। অসহ্য ঠেকছে।”

প্রত্যাশা আগের মতো প্রফুল্ল না থাকলেও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক আছে। প্রত্যাশা এগিয়ে এসে বলল,

-” আনিশা কাঁদে না। আমার রুমে চকলেট আছে চলো খাবে। গেইমস খেলতে আমার ফোন দিবো। চলো ইচ্ছে আছে ওর সাথে খেলবে। এবার তো কান্না থামাও।”

ইচ্ছে দুপুরে এসেছে। ড্রাইভার রেখে গিয়েছে। আনিশা কোনোদিকে না তাকিয়ে গোঁ ধরে বলে,

-” নাহ আমার কিচ্ছু চাই না। না চকলেট না ফোন। কোনো কিছুই লাগবে না।”

শর্মিলা চেঁচিয়ে উঠলেন,

-” শুনেছো মেয়ের কথা। দ্যাখো তোমাদের আস্কারায় মেয়েটা দিনদিন বেশি বে’য়াদব, বে”য়াড়া হচ্ছে।”

নীহারিকা বললেন,

-” আহ্, থাম তুই। রাগিস না। আমি বুঝিয়ে বলছি।”

আনিশার কান্না থামছিল না দেখে প্রত্যাশা বলল,

-” পার্কে নয়, চলো আমরা বাসার সামনে থেকে ঘুরে আসি। একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি।”

আনিশার কান্না একটু কমল। ইচ্ছে এসে ঝটপট বলল,

-” মামণি আমিও যাবো।”

প্রত্যাশা ঘাড় নেড়ে বলে – আচ্ছা। নীহারিকা বললেন,

-” প্রত্যাশা বেশি দূর কিন্তু যেয়ো না।”

-” ঠিক আছে মা।”

.
.

হাঁটতে হাঁটতে ওরা রাস্তার উপর আসে। আনিশা বলল,

-” নতুন ভাবী চলো সামনে যাই।”

মোড় ছাড়িয়ে ডানদিকে আসতেই একটা খোলা পাবলিক পার্ক। লোকজনের ভিড় মোটামুটি। শান বাঁধানো বসার জায়গায় প্রত্যাশা বসে রইল ওরা দুজন দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। ইচ্ছে হঠাৎ বলল,

-” মামণি আইসক্রিম খাব।”

ওইতো ওপাশেই একজন আইসক্রিম বিক্রি করছে। ওখানে বেশ ভিড় জমেছে। প্রত্যাশা বলল,

-” তোমরা এখানে বসো। আমি আইসক্রিম আনছি।এখান থেকে একটুও নড়বে না, ঠিক আছে?”

দু’জনই একসাথে বলে উঠল,

-” আচ্ছা।”

#চলবে