#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৪৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
প্রত্যাশা ওপাশে যায় আইসক্রিম কিনতে। সামনের মেয়েটা সরতেই প্রত্যাশা বলল,
-” চকবার দিন তো।”
বিক্রেতা ছেলেটি জিজ্ঞেস করল,
-” কয়টা দেবো আপা?”
-” তি….”
তিনটা বলতে গিয়েও থেমে যায় ও। হালকা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লেগেছে। এই সময়ে আইসক্রিম খাওয়া ঠিক হবে না। তারপর নীরব জানলে বকাঝকা করবে। এসব ভেবে অগত্যা বলল,
-” দু’টো দিন।”
পার্স খুলে দুইশো টাকার একটা নোট দিলো প্রত্যাশা। ছেলেটি বলল,
-” আপা ভাংতি দেন।”
পার্স খুঁজে দেখে বলে প্রত্যাশা,
-” খুচরা নেই তো দেখছি।”
ছেলেটি তার টাকা রাখার থলে হাতড়ে টাকা বের করতে থাকে।
.
আনিশা আর ইচ্ছে বসে কথা বলছে আর হাসছে। কিছুপল পরে ইচ্ছের নরম তুলতুলে টেডিটায় আঙুল দিয়ে চাপ দিয়ে বলল আনিশা,
-” ওয়াও! কি নরম তুলতুলে টেডি!”
ইচ্ছের গালে হাসি ফুটল। ঝটপট বলল,
-” জানো আমার এরকম আরেকটা টেডি আছে। দুটোই পাপা গিফট করেছিল। এটা হোয়াইট কালারের আরেকটা ব্লাক। দ্যাখো দ্যাখো এর আইস কেমন বড়বড়। ইয়ু…তুমি ভ’য় পেয়েছো?”
টেডিটা দুইহাতে আনিশার সামনে তুলে ভ’য় দেখানোর মতো করে ইচ্ছে। মুখের এক্সপ্রেশন এমন করে যেন খুব ভয় পাচ্ছে সে। সাথে আনিশাকে ভ’য় দেখানো তার একমাত্র লক্ষ্য। আনিশা ছোট্ট তর্জনী আঙুলটা দিয়ে টেডির চোখে খোঁচা মা*র*ল। পাকা পাকা গলায় বলল,
-” ধূর, আমি ভ*য় পাইনা। আমি ব্রেভ গার্ল। বড় দাদান বলে, আমি বড় হয়ে সিইডি[ সিআইডি] হবো। ছোট দাদানকেও ছাড়িয়ে যাব, হুঁ। সেজন্য আমাকে এত্ত এত্ত সাহসী হতে হবে। যারা ভীতু তারা কখনো….”
আকস্মিক কেউ একজন আনিশার কথায় বাগড়া দিল। মুখে মাস্ক, মাথায় সানক্যাপ পড়া একটা লোক এসে মিষ্টি গলায় বলল,
-” এইযে পিচ্চি, এইযে তোমাকে তোমাকে বলছি।”
আনিশা ভ্রু কুঁচকে নাক ফুলিয়ে তাকাল। ইচ্ছে সরু চোখে চাইল। লোকটা আঙুল নেড়ে বলল,
-” লাল জামা পড়া পিচ্চি তোমাকে বলছি। ওইযে তোমার পাপা ওখানে। তোমাকে ডাকছে।”
পাপার কথা শুনে ইচ্ছে চনমনে হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকাল। কালো বাইকের উপর মাথায় কালো হেলমেট পরা একজন বসে। ঘাড়টা অন্যদিকে ঘুরিয়ে। বাইকটা সেম নীরবের বাইকের ডিজাইন। হেলমেট পরা ইচ্ছে অত বুঝল না। মাথা নেড়ে নেড়ে বলল,
-” পাপা ওখানে?”
-” হ্যাঁ, তোমার পাপা। তোমাকে ডাকছে। চলো আমার সাথে।”
ইচ্ছে উঠে যেতে নেয়। আনিশা থামিয়ে দেয়। বলে,
-” ইচ্ছে যেয়ো না। আমার আম্মু বলে অপরিচিতদের কথা না শুনতে। আর তাদের দেয়া কিছু খেতেও বারণ করে, হুম।”
-” ওটা পাপা নাকি চলো দেখে আসি তো।”
আনিশা সবেগে দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
-” না না…আমি যাব না। শুনলে না নতুন ভাবী বলল কোথাও না যেতে। দাঁড়াও আমি এক্ষুনি ভাবীমণিকে ডেকে বলছি।”
প্রত্যাশা ওপাশ থেকে মাঝেমাঝে তাকাচ্ছে। ওরা দু’টো ওখানেই চুপচাপ আছে। মাস্ক পড়া লোকটা প্রত্যাশার তাকানো দেখার সাথে সাথেই উল্টোদিক ঘুরে ফোন কানে ধরে কথা বলার অ্যাক্টিং করতে থাকে।
এদিকে ইচ্ছে ঘাড়টা পিছনে ঘুরিয়ে রাস্তার বাইকের দিকে তাকাল। বাইকার হাত তুলে একটা বল দেখাল। এবারে ইচ্ছের চোখে খুশির ঝিলিক ফুটল। সে তো ক’দিন আগেই পাপাকে বলেছিল বলের কথা। ইচ্ছে কোনো দিকে না তাকিয়ে ছুট্টে যায়।
আনিশা ছোট মানুষ অতকিছু না ভেবে সে শুধু ভাবল— ইচ্ছে কথা শোনেনি। তাই ভাবীকে বলে দিবে। ভাবী নিশ্চয় এর জন্য ওকে বকবে। এটা ভেবে আনিশা সামনের দিকে প্রত্যাশার আসার অপেক্ষায় থাকল।
ইচ্ছে দৌড়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ পরে যায়। মাস্ক পরা লোকটা তক্কে তক্কে পিছুন পিছুন আসছিল। এটা যেন তারজন্য সুবর্ণ সুযোগ হয়ে এল। দ্রুত গিয়ে ইচ্ছেকে তুলে দেয়। পিছুন সাইডটা একটু ফাঁকা। আর যে যার মতো ব্যস্ত। এটাই যেন মোক্ষম সুযোগ হলো মুখোশধারীর কাছে। সে আর কালবিলম্ব না করে বিদ্যুত বেগে ইচ্ছের মুখে রোমাল চেপে ধরে। চিৎকার করার সুযোগই পেল না ইচ্ছে। এক নিমেষে শরীরটা ঢিলে হয়ে নেতিয়ে পড়তে নেয়। অজ্ঞান হতেই লোকটা পরম যত্নে কোলে তুলে নিল মেয়েটাকে। মাথাটা লোকটার কাঁধে হেলে পড়ল। লম্বা পা ফেলে বাইকের কাছে আসতেই হেলমেট পরা বাইকার চাপা গলায় বলল,
-” তাড়াতাড়ি ওঠে বস।”
ইচ্ছেকে বসাতে গিয়ে ওর বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরা টেডিটা হাত ফসকে মাটিতে পড়ে গেল। লোকটা তাড়াতাড়ি সেটা তোলার জন্য ঝুঁকতেই বাইকার গালি ঝাড়ল,
-” শা*লা তাড়াতাড়ি কর। মানুষ টের পেয়ে যাবে। আর তুমি বাল আছো হুতুল-পুতুল তুলতে।”
বাইক স্টার্ট দিতে থাকে। ছেলেটি একহাতের সাহায্যে মাটি থেকে টেডিটা তুলে বাইকে চড়ে বসতে বসতে বলল,
-” শা”লা তুমি জানো না হে, বড়লোকের এসব বাচ্চারা বাপ-মাকে ছাড়া থাকতে পারে। তবে এই পুতুল ছাড়া নাওয়া খাওয়া বাদ দেয়। পুতুল কোলের কাছে না নিয়ে এদের ঘুম আসে না। জ্ঞান ফিরলে পুতুল পুতুল করে কাঁদবে দেইখা নিয়ো।”
বাইক চলছে। এরমধ্যে একজন মহিলা দেখে বলে উঠল,
-” ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে ওভাবে নিয়ে যাচ্ছে কেনো? আহারে ঘুমিয়ে পড়েছিল বোধহয়।”
বাইকার স্পিড বাড়িয়ে দিল। ইচ্ছে দু’জনের মাঝে। মাথাটা এপাশে-ওপাশে হেলে পড়তে চাচ্ছে। বাইকার এবার কড়া গলায় হুঁশিয়ারি করে বলল,
-” বাচ্চাটার মাথা ধরে রাখ ব্যাটা। এর কিছু হলে কিন্তু রক্ষে থাকবে না। বাচ্চাটার গায়ে ফুলের টোকাও দিতে বারণ আছে।”
-” ভাই এইটা কি ওই শা*লা এএসপির মেয়ে?”
প্রশ্নটা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই মুখটা বিকৃত করে ফেলল বাইকার ছেলেটি। বিশ্রীভাবে গা”লি ছুঁ’ড়ে বলল,
-” মা*** এএসপি। বালছাল ওর নাম বলে মাথা গরম করে দিলা আবার। শা*লার বউয়ের গায়ে হাত দেয়ার অপরাধে আমার ভাইটারে কী মাইরটাই না দিছিলো। শা”লার বউরে কিছুই তো করতে পারছিল না। ঠিকসময় মতো এএসপি তো হাজির হয়ই। বউকে সেভ করে নেয়। অথচ আমার ভাইয়ের হাতটা ভেঙে দেয়। ওর বউয়ের গায়ে হাত তোলার জন্য। আবার টগবগে গরম পানির মগে জোর করে ঠোঁট ডুবিয়ে রেখে কয়; এইডা নাকি ওর বউয়ের দিকে চুমু খাওয়ার জন্য ঠোঁট বাড়ানোর শা*স্তি।”
-” আপনার সে ভাই কই?”
-” ভাইয়ের সাথে আরেকজন ছিলো। দুইজন রে ই*য়া*বাসহ গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেলে ভরছে। তবে ভ*য় নাইকা। ম্যাডাম বড়লোক, অনেক টাকা দিছে। উনি কথা দিছে টাকার বিনিময়ে অল্পদিনের মধ্যেই ছাড়াইয়া আনবে। সেইজন্য মা*ইর খাইছে, তবু ম্যাডামের নাম মুখে আনেনি।”
.
.
আইসক্রিম বিক্রেতা দশ টাকার , বিশ টাকার নোট করে মিলিয়ে দু’বার করে গুণতে নেয়। প্রত্যাশা বিরক্ত হয়ে বলল,
-” আরে এতবার গুনতে হয় নাকি? ঠিকই আছে, দিন তো। বেশি দিলে তো অবশ্যই ফেরত পাবেন।”
টাকা হাতে নিয়ে ঘাড় ঘুরাতেই প্রত্যাশা একটু থমকে গেল। সামনেই আনিশা, কিন্তু ইচ্ছে কই? মনে হলো হয়তো শান বাঁধানো বসার জায়গার ওপাশে লুকিয়ে আছে। আবার লুকোচুরি খেলছে নাকি?
চকবার হাতে এগোতেই আনিশা দৌড়ে এলো। ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগের সুরে বলল,
-” নতুন ভাবী, ইচ্ছে তোমার কথা শোনেনি। ইচ্ছে না__”
প্রত্যাশা চারপাশে চোখ বুলিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,
-” ইচ্ছে কই আনিশা?”
-” ওদিকে গেছে।”
আঙুল দিয়ে পেছন দিকে দেখায় আনিশা। প্রত্যাশা ভ*য় পেয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,
-” ওদিকে গেছে মানে? কই গেল?”
এই বলে আনিশার হাত টেনে দ্রুত এগিয়ে যায় প্রত্যাশা। আনিশা ঘনঘন বলে,
-” এক লোক ইচ্ছেকে ওর পাপা ডাকছে বলতেই ও যায়।”
এবারে প্রত্যাশার বুক কেঁপে উঠল। চিন্তায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল। সামনে যাকেই পায় তাকেই প্রায় কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে প্রত্যাশা,
-” একটা ছোট বাচ্চা মেয়েকে দেখেছেন? লাল রঙের ফ্রক, হাতে সাদা টেডি বিয়ার? দেখেছেন কেউ?”
একজন মহিলা এগিয়ে এসে বলল,
-” হ্যাঁ, একটু আগেই দেখেছি। গায়ে লাল ফ্রক, ফর্সা রং, তাই তো?”
প্রত্যাশা হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা নাড়ল,
-” জ্বী জ্বী কোথায় দেখলেন? কোনদিকে গেছে?”
প্রত্যাশার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে খুব অসহায় ঠেকছে ওর। মহিলা চমকে দিয়ে বলল,
-” ঘুমন্ত মেয়েটাকে বাইকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল দু’টো ছেলে।”
প্রত্যাশার হাত থেকে চকবার মাটিতে পড়ে গেল। হঠাৎ যেন শিরা-উপশিরা অবশ হয়ে যাচ্ছে। কী করবে? কীভাবে বাড়িতে বলবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। দিশেহারা হয়ে ফোনটা হাতে নেয় ও। প্রথমে নীরবের নম্বরে কল দিলো। আশেপাশে এতক্ষণে মানুষ জড় হয়ে যায়। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এটা-ওটা বলে প্রত্যাশাকে আরো বিভ্রান্ত করে তুলছে। একজন বলল,
-” ইয়া আল্লাহ, নিশ্চয় ছেলেধরা ছিলো।”
আরেকজন ফিসফিসিয়ে বলল,
-” ইশশ্! অমন ফুটফুটে মেয়েটাকে মে*রে ফেলবে না তো।”
ভয়ে প্রত্যাশার হাত-পা হিম শীতল বরফ হয়ে আসে। মাথা ঝিমঝিম করছে। দুই হাতে মোবাইল চেপে ধরল কানে। প্রথমবার রিং হয়ে কে”টে গেল। আবার ডায়াল করল। অস্ফুটে ফিসফিস করে বলল,
-” প্লিজ নীরব, তাড়াতাড়ি ফোনটা তুলুন।”
এবারে তিন সেকেন্ডের মধ্যেই কল রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে নীরবের শান্ত গলা,
-” প্রত্যাশা আমি একটু ব্যস্ত। হাফ আওয়ার্স পরে ব্যাক করি? তুমি আবার এজন্য অভিমান করো না কিন্তু। কাজ শেষ করেই ব্যাক করব, প্রমিজ জান।”
প্রত্যাশার বুক ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে গেছে। জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে এক নিঃশ্বাসে বলল,
-” নীরব…নীরব ইচ্ছেকে পাওয়া যাচ্ছে না।”
-” হোয়াট? পাওয়া যাচ্ছে না মানে?”
প্রত্যাশা হোঁচট খাওয়া গলায় শর্টকাটে পুরো ঘটনাটা বলে। নীরব চোয়াল শক্ত করে আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে বলল কঠিন কণ্ঠে,
-” ড্যাম ইট! তুমি ওদের নিয়ে বের হয়েছিলে কেনো?”
প্রত্যাশা আর সামলাতে পারল না। শব্দ করে কেঁদে উঠল। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে অনুনয় করল,
-” নীরব প্লিজ ইচ্ছেকে খুঁজে বের করুন। আমার উপর যত রাগ করার আছে করবেন। আমি কিচ্ছুটি মনে করব না। শুধু প্লিজ, ইচ্ছের কিছু যেন না হয়। ইচ্ছেকে সুস্থ সমেত দ্রুত এনে দিন। আমার জন্য ইচ্ছের ক…”
কথা শেষ করার আগেই কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে গেল প্রত্যাশার। নীরব জোড়াল শ্বাস ফেলল। নিজেকে সামলে শান্ত স্বরে বলল,
-” টেনশন করো না। ইন শা আল্লাহ ইচ্ছের কিছু হবে না। আমি আসছি।”
.
.
মিনিট বিশের মধ্যেই নীরব উপস্থিত হয়। প্রত্যাশার চোখদুটো ভেজা। পাশে দাঁড়ানো আনিশাও ফুঁপাচ্ছে। ইচ্ছের হদিস না মেলার কষ্ট দু’জনার চোখেমুখেই স্পষ্ট। কয়েকজন মহিলা ঘিরে দাঁড়িয়ে নানা কথা বলতে বলতে কৌতূহল মেটাচ্ছে। একেকজন একেক কথা বলছে— বাসায় জানিয়েছো? তাড়াতাড়ি পুলিশ কে*স করতে হবে?
হঠাৎই কানে এলো বাইকের ব্রেক চাপার তীক্ষ্ণ শব্দ। সবাই একসাথে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। নীরব বাইক থামিয়ে দৃঢ় ভঙ্গিতে হেলমেটটা হাতলে ঝুলিয়ে দিল। চোখেমুখে অগ্নিগর্ভ দুশ্চিন্তা। লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে আসছে। ভিড়ের সামনে এসে দারাজ গলায় ডাক দিল,
-” প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ মাথা তুলে তাকায়। সামনের মহিলারা ইউনিফর্ম পরা নীরবকে দেখে বিস্ময়ে চেয়ে আছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রত্যাশা দৌড়ে নীরবের সামনে এসে দাঁড়াল। ভেজা চোখে ব্যাকুল হয়ে চেয়ে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
-” নীরব আ_”
প্রত্যাশার কোনো কথা না শুনে। নীরব শুধু বলল,
-” বাসায় যাবে, চলো।”
প্রত্যাশা ব্যাকুল কণ্ঠে অপরাধীর মতো বলল,
-” ইচ্ছেকে না নিয়ে কী করে বাড়ি যাই? ইচ্ছে আমার সাথে এসেছিল। আমি ওকে ছাড়া কোন মুখে বাসায় যাব?”
নীরব চোয়াল শক্ত করে তাকাল। বলল,
-” তুমি বাসায় না ফিরে এখানে থাকলে ইচ্ছেকে পাওয়া যাবে? যাবে না। তাই পা*গ*লামি করো না। ফাস্ট বাসায় চলো। তোমাকে নিরাপদে রেখে তারপর আমি আমার কাজ করব।”
.
.
ইচ্ছেকে পাওয়া যাচ্ছে না এ খবর এতক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে। নীরব ওদেরকে বাসায় দিয়ে দরজার সামনে থেকেই চলে যেতে নেয়। নীহারিকা পিছু ডাকলেন। এক আকাশ উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মিশিয়ে বললেন,
-” নীরব বাবা, মেয়েটাকে সহীহ সলামতে পাওয়া যাবে তো? কী থেকে কী হয়ে গেল! বিপদ যেনো পিছুই ছাড়ছে না। আমার ভীষণ ভ’য় হচ্ছে।”
-” ডোন্ট ওয়ারি মা। ইনশাআল্লাহ ইচ্ছেকে সুস্থ সমেত ফিরে পাব।”
নীহারিকা আরো কিছু বলতে নেয়। নীরব সেসব না শুনেই দ্রুত প্রস্থান করে। ওখানকার এক মহিলা বলছিল। সেখান থেকে একটা কথা নীরবের টেনশন মাইনাস করে একবারে অর্ধেকে নামিয়ে আনে। কথাটা— “পরে যাওয়া টেডি একটা ছেলে তুলে নেয়।” তারমানে টেডি ইচ্ছের সাথেই আছে। টেডির চোখে মাইক্রো ক্যামেরা লাগানো। যদিও মূল উদ্দেশ্য ছিলো ওই বাড়ির রহস্য উদঘাটনের জন্য এই চালাকি। তবে নিঃসন্দেহে আজ ইচ্ছেকে পেতে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রত্যাশা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে। নীলাশা শর্মিলা সবাই আছেন। প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে নীহারিকা আফসোস করে বললেন,
-” উফ্! আমারই ভুল হয়েছে। মস্ত বড় ভুল হয়েছে। যে নিজেকেই সামলাতে পারে না। তার সাথে দুইটা বাচ্চাকে পাঠিয়ে। ইশশ্! কেনো যে তখন বারণ করলাম না। বাড়িতে একটার পর একটা বিপদ চলছেই। একটুও ফুরসত মিলছে না। কবে যে এক দন্ড স্বস্তি মিলবে। ইয়া আল্লাহ! কোন পা*পে আজ আবার আমার নাতনীটাকে হারাতে বসেছি। যেভাবেই থাকুক সুস্থ রেখো।”
এটাওটা বলে হা হুতাশ করতে থাকেন নীহারিকা। শর্মিলা মেয়ের উপর চোটপাট দেখাতে নেন। ওর জিদ থেকেই এতকিছু ঘটল। নীহারিকা চেঁচিয়ে উঠলেন,
-” থাম তো। আমার আর ভালো লাগছে না। এইটুকু মেয়েকে দোষ দিয়ে কী হবে। বড়গুলা যখন কেয়ারলেস। দায়িত্ব নিয়ে গেছে অথচ পালন করতে পারে না। একটা অঘটন ঘটিয়ে এসেছে।”
নীলাশা হঠাৎ ধীর স্বরে বলে উঠল,
-” মা কেউ যদি আগে থেকে ওত পেতে থাকে তাহলে কী করার বলুন। আমার মনেহয় আগে থেকেই এটা প্ল্যান করা। প্রত্যাশা হয়তো তাদের কাজটা না বুঝে সহজ করে দিয়েছে। এভাবে না হোক অন্যভাবেও তো এরকম কিছু হতে পারতো।”
_________
প্রীতির কপালে চিন্তার ভাঁজ। ফোনটা কানে। ভাইয়ের কাছে অসহায় সুরে বলছে,
-” ভাইয়া ইচ্ছেকে পাওয়া যাচ্ছে না।___। এখন কী করব ভাইয়া? আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। বুঝতে পারছি না কে এমন করতে পারে? ইচ্ছের সাথে শ”ত্রুতাই বা কীসের?”
-” ছেলেধরা হতে পারে। আঁটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করতে পারে। কিন্তু কথা হলো যায়হোক, ইচ্ছের যেনো কোনো ক্ষ*তি না করে বসে। আচ্ছা প্রীতি তুই নীরবের সাথে কথা বলেছিস?”
তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে বলল প্রীতি,
-” নীরবের কেয়ারলেস বউয়ের জন্য আজ এমন হয়েছে। এর জবাবদিহিতা ওর বউসহ নীরবকে করতে হবে। আর নীরবের কাছে কীসের কথা বলতে যাব? ওর কাছে হেল্প চাইব? ইচ্ছেকে খুঁজে দিতে বলব? মাই ফুট। আমাদের কী লোকজন কম আছে নাকি? ওর থেকেও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে আমার মায়ের খাতির আছে।”
সার্থক কথা না বাড়িয়ে বলল,
-” টেনশন করিস না। আমি এক্ষুনি আসছি। ষযত দ্রুত সম্ভব ইচ্ছেকে তোর কাছে ফিরিয়ে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা থাকবে।”
প্রীতি ফোনটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। হুইলচেয়ারে বসা মায়ের দিকে অসহায় চাউনিতে চেয়ে অনুরোধের সুরে বলল,
-” প্লীজ মা জলদি কিছু একটা করো। আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে। ইচ্ছে কোথায়, কীভাবে আছে? আমি জাস্ট নিতে পারছি না।”
তানিয়া নির্লিপ্ত মুখে বসে। প্রীতি হাতের তালুতে মুখ ঢেকে নিল। পরপর দম ফেলে দাঁত কড়মড়িয়ে বলে উঠল,
-” যা রাগ ওই মেয়েটার উপর হচ্ছে না। হাতের কাছে পেলে সজোড়ে দু’টো থা*প্পড় দিতাম।”
প্রীতি মায়ের মুখপানে তাকিয়ে তিরিক্ষি হয়ে বলল,
-” এভাবে চুপ করে বসে থাকবে?”
তানিয়া একটু নড়েচড়ে উঠলেন। বললেন,
-” নীরব নিশ্চয় বসে নেই।”
প্রীতি তেজি কণ্ঠে বলল,
-” নীরবের অপেক্ষায় প্রীতি বসে আঙুল চুষতে চায় না। নীরব খুঁজে বের করার আগেই আমরা বের করব। তুমি আর্জেন্ট ইচ্ছেকে খুঁজে বের করো। আশাকরি তোমার লোকের অভাব নেই।”
তানিয়া শান্ত গলায় বলল,
-” তুমি চিন্তা করো না। আমি সব ব্যবস্থা করছি।”
___________
ঘড়ির কাঁটা রাত একটা ছুঁয়েছে। নিস্তব্ধ কক্ষে দুজন মানুষ। নীরবের চোখ গেঁথে আছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। সামনে ঝুঁকে টেবিলে হাত দু’টো ঠেস দিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে আছে সে। ল্যাপটপের নীল আলোয় চোখদুটো শিকারি বাজপাখির মতোন জ্বলজ্বল করছে। পেছনে দাঁড়ানো তানভীর ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
-” স্যার, ইচ্ছেকে কিডন্যাপ করে আসলে লাভটা কী? মানে উদ্দেশ্যটা একচুয়েলি কী হতে পারে? মাথায় কিছুই আসছে না।”
নীরব দৃষ্টি না সরিয়েই শান্ত গলায় বলল,
-” উদ্দেশ্য দুইটা হতে পারে। এক ব্ল্যাকমেইল করে ডাটা মুছে ফেলতে বলা। দুই চাপের মধ্যে রাখা।”
তানভীর কপালে ভাঁজ ফেলে আবার বলল,
-” কিন্তু স্যার যদি ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই হয়। তাহলে এখনো পর্যন্ত ফোন দিল না কেন?”
নীরব গভীর নিঃশ্বাস টেনে ঠান্ডা স্বরে উত্তরে বলে,
-” সেটাই ভাবছি। মনে হচ্ছে নতুন কোনো খেলা শুরু করতে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা ভুলে গেছে এই খেলাতেই আজ নিজেরাই ফাঁদে পা দিল। যে প্রমাণ আজ কমাস ধরে খুঁজছি। নিজেদের বোকামিতেই সেটা অনায়াসেই পাইয়ে দিল। নিজের ষ’ড়যন্ত্রে নিজেই ধরা খেল।”
-” এখন কী করবেন?”
-” যা করার ভোরের আলো ফুটলে। চাইলেই সব সম্ভব নয়। কিছু নিয়ম-কানুন আছে তো।”
-” জ্বী স্যার।”
__________
এদিকে রাতে ফোন দিয়ে প্রীতি প্রত্যাশাসহ বাড়ির সবার উপর রাগ ঝাড়ে। তাদের ওখান থেকেই মেয়েটা নিখোঁজ হলো। এটা তাদেরই ষড়যন্ত্র। হেনোতেনো বলে।
ঘড়িতে সকাল নয়টা বাজে। গোটা রাত পেরিয়ে গেলেও ইচ্ছের খোঁজ মেলেনি। চিন্তায় দু’চোখের পাতা করোরই এক হয়নি। এখন অবধি গলা দিয়ে খাবারো নামেনি। সবাই ভীষণ চিন্তিত। নীরব রাতে বাসায় ফেরেনি। এরমধ্যে ডোরবেল বাজতেই পরী দরজা খুলে দেয়। নীহারিকা শব্দ শুনে আশা নিয়ে আসেন, হয়তো ইচ্ছের খবর পাওয়া যাবে নীরব এসেছে। কিন্তু তার ভাবনায় গুড়ে বালি। একজন পুলিশ অফিসার পিছনে দু’জন লেডি কনস্টেবল। ওসি জিজ্ঞাসু গলায় বললেন,
-” ইয়ানূর প্রত্যাশা কে?”
শর্মিলা, নীলাশাও উপস্থিত হয়। নীরব এসেছে ভেবে প্রত্যাশা রুম থেকে ত্রস্ত বেরিয়ে আসে। পুলিশের মুখে নিজের নাম শুনে চমকে তাকাল। নীহারিকা কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ নিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন,
-” কেনো? তাকে কী দরকার?”
ওসি সোজাসাপ্টা বলল,
-” পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে ইচ্ছে। তাকে গতকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে ইয়ানূর প্রত্যাশার সাথেই ছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে থানায় যেতে হবে।”
বাড়িতে ছেলেরা কেউ নেই। নীহারিকা অবাক গলায় বললেন,
-” প্রত্যাশাকে থানায় যেতে হবে মানে?”
-” ওনার নামে কেস হয়েছে?”
প্রত্যাশা শাশুড়ির কাছে এসে দাঁড়াল। থমকে গেল সবাই। শর্মিলা বললেন,
-” প্রত্যাশার নামে কেস হয়েছে মানে? কে কেস করেছে?”
-” ইচ্ছের…”
কথা টান দিয়ে কেড়ে নেয় প্রীতি। পিছুন থেকে নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে আসতে আসতে উত্তর দেয়,
-” আমি করেছি কেস।”
প্রীতি এগিয়ে যায় ঠিক প্রত্যাশার সামনে। শাশুড়ি পাশেই ছিলো। রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন নীহারিকা,
-” তোমার মাথা পুরোপুরি গেছে নাকি?”
প্রীতি কথা কানেই তুলল না। ও প্রত্যাশার বাহু খাবলে ধরে বলল,
-” আমার মেয়েটাকে কোথায় রেখেছো? বলো?”
প্রত্যাশা কেঁপে উঠলো। বলল,
-” আমি জানি না।”
প্রীতি চেঁচিয়ে উঠল,
-” আলবাত জানো তুমি। তুমি কিছু করেছো ইচ্ছের সাথে। নইলে ইচ্ছে নিখোঁজ অথচ নীরব নির্লিপ্ত। ও কেনো এখনো ইচ্ছেকে বের করল না। তারমানে ও ঠিক জানে তুমিই ইচ্ছের সাথে খারাপ কিছু করেছো। ইচ্ছের কিছু হলে তোমাকে ছাড়বো না।”
কথা শেষ করেই প্রীতি হাত উঠায়। প্রত্যাশার গালে থাপ্পড় মারতে হাত তোলে। প্রত্যাশা চোখ খিচ মে*রে মাথাটা ঘুরিয়ে নেয়। প্রীতির হাতটা নীহারিকা ধরে ফেলে। এক ঝটকায় প্রীতির হাত ছেড়ে দিয়ে উল্টো ঠাস করে প্রীতির গালে সপাটে চড় বসালেন। পরপর দু’টো চ’ড় দিয়ে থামলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
-” তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি। আমার সামনে আমার নীরবের বউয়ের গালে হাত তুলতে যাও। আমার বাড়ির মানসম্মান পানিতে ডুবাতে আমার বাড়ির বউয়ের নামে কেস করো। কতটা বেপরোয়া ভাবতে পারছো তুমি? এতটা ডেসপারেট মেয়ে আমি জনমে দেখিনি। অ*সভ্য মেয়ে মানুষ।”
প্রীতি গালে হাত দিয়ে আ*গুন চোখে তাকাল। ফোঁস করে ওঠে বলল,
-” ওর জন্য আমার মেয়ে নিখোঁজ। আপনাদের একবারো আমার মেয়ের কথা চিন্তা হচ্ছে না।”
নীহারিকা বলেন,
-” প্রত্যাশাকে দেখে অমন মনেহয়? মনেহয় ও কখনো তোমার মেয়ের ক্ষ*তি করতে পারে?”
-” আমি অতশত জানি না। আমার মেয়েকে আমার কাছে চাই। যতক্ষণ আমার মেয়েকে পাচ্ছি না, ততক্ষন পর্যন্ত হলেও প্রত্যাশাকে লকাপে থাকতে হবে। অফিসার দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আপনাদের কাজ করুন।”
নীহারিকা শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-” নীরবের কাছে ফোন দে। সারাটা রাত গেল ও করছে টা কী?”
অফিসার একটু ভয়ে ভয়ে আছে। নীহারিকা নীরবের সাথে কথা বলার সময় চেয়ে নিলেন। শর্মিলা ফোনে সবটা নীরবকে বলে। নীরব তৎক্ষণাৎ সদর থানার ওসির কাছে কল দিল। নীরব বলল,
-” এএসপি নীরব মাহবুব স্পিকিং।”
ওসি লম্বা করে সালাম দিল। নীরব উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। সোজাসুজি বলল,
-” মিসেস নীরবের থেকে পাঁচশো গজ দূরে থাকবেন। আ’ম কামিং।”
ওসি ঠোঁট ভিজিয়ে নিচু স্বরে বলল,
-” স্যার, আইন তো সবার ক্ষেত্রেই সমান হওয়ার কথা।”
ওপাশ থেকে নীরবের বজ্রকণ্ঠ ভেসে এলো,
-” আইন সমান। তবে আইন মানে নির্দোষ মানুষকে প্রমাণ ছাড়া হ্যারেজ করা নয়। আমি অর্ধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছাচ্ছি। এর মধ্যে যদি আমার স্ত্রীকে কেউ স্পর্শ করারও দুঃসাহস দেখায়; মনে রাখবেন তখন আমি শুধু হ্যাজবেন্ড হয়ে নয়। এএসপি হিসেবে আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করব। মাইন্ড ইট।”
ওসি বেকায়দায় পড়েছে। দুদিক থেকেই সে প্রচন্ড চাপে আছে। সে বেচারা দিক পাচ্ছে না। এদিকে প্রীতিকে বলেছে,
-” আগে স্যার আসুক।”
নীরবের আসতে বিলম্ব হয়। আধা ঘন্টা পেরিয়ে যায়। এরমধ্যে খানিক্ষণ আগে প্রীতির সাথে কথা বলে এই ঘটনা শুনে সার্থক আসে। প্রীতিকে বোঝাতে বলল,
-” প্রীতি এসব বাড়াবাড়ি হচ্ছে। প্লীজ বন্ধ কর এসব। প্রত্যাশা কেনো ইচ্ছের ক্ষতি করতে যাবে।”
প্রীতি বলল,
-” হিং*সে করে। আমি জানি প্রত্যাশা এটা হিং*সে করেই করেছে। নীরব ইচ্ছেকে অনেক আদর করে, ইচ্ছে নীরবকে পাপা ডাকে। এসব প্রত্যাশার সহ্য হয় না। উপরে ভালো মানুষি দেখালেও ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড হিং*সায় জ্ব”লে ও। তাই তো আমার মেয়েকে নিয়ে কিছু একটা করেছে। পেপার পত্রিকায় অহরহ আসে হিংসার জের ধরে বাচ্চাকে ড্রেনে, নদীতে ফেলে মে**”
-” প্রীতি এসব তোর ভুল ধারণা। তুই আবার ভুল করতে যাচ্ছিস।”
প্রীতি এবারে ক্ষে*পে উঠল। অফিসারের উপর চড়াও হলো,
-” আপনারা কী এখানে মাছি তাড়ানোর জন্যে এসেছেন? মাথায় রাখবেন আইন সবার ক্ষেত্রে সমান। হোক সে এএসপি কিংবা প্রাইম মিনিস্টারের বউ। আপনারা এভাবে বসে থাকলে আমি উপর মহলে ফোন করতে বাধ্য হবো।”
এবারে ওসি শুকনো ঢোক গিলে লেডি কনস্টেবলকে নির্দেশ দেয়। প্রত্যাশা শাশুড়ির কাছেই জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে। থানা পুলিশ এসব তার এমনিতেই পছন্দ হয় না। এমন বিষয়ে এবারে বুকটা রীতিমতো কাঁপতে থাকল। লেডি কনস্টেবল যতটা এগোতে থাকল। প্রত্যাশা ততটাই জড়সড় হতে থাকে। প্রত্যাশার দিকে হাত বাড়িয়ে একজন লেডি কনস্টেবল বলল,
-” ম্যাডাম ভালোভাবে আমাদের সাথে চলুন। জোর করতে বাধ্য করবেন না।”
বুট পায়ে গটগট করে আসার শব্দে সবাই সচকিত দরজার দিকে চাইল। দরজার ফাঁক গলে কঠিন চোখেমুখে নীরব ঢুকল। মুখমণ্ডলে অ*গ্নি ঝলক, ঠোঁট দুটো চেপে ধরা। এক হাতে মাথার ক্যাপ চেপে ধরে একটু ঘুরিয়ে নেয়। অন্য হাত শার্টের কাফ শক্ত করে টেনে নিল। ওসি আর কনস্টেবলরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নীরবের দৃষ্টি প্রথমেই পড়ল প্রত্যাশার ভয়ে সঙ্কুচিত মুখপানে। তারপর কনস্টেবলের বাড়ানো হাতের দিকে তাকিয়ে বজ্রকণ্ঠে বলল,
-” স্টপ, স্টপ। আই সেইড স্টপ। স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মিসেস নীরব।”
সাথে সাথে লেডি কনস্টেবলের মুখ ভীতু হয়। নীরব ওসির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আইনকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আইন মানে নিরপরাধকে টেনে নিয়ে যাওয়া নয়। আমার আসা পর্যন্ত যেটুকু করেছেন ওটুকুই যথেষ্ট। এখন সরে যান।”
প্রীতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” তুমি তোমার ক্ষমতার অপব্যবহার করছো।”
নীরবের রাগের পারদ তরতরিয়ে আকাশ ছুঁলো। বলল,
-” তোমাকে আগেই বলেছিলাম নিজের মধ্যে চেঞ্জেস আনো। এ-ও বলেছিলাম তুমি যে ব্যবহার হচ্ছো সেটা যাতে করে হলে বোঝার চেষ্টাটুকু করো। কিন্তু না, তুমি তো তুমিই। সেই বেপরোয়া রাগ, জিদ নিয়ে নিজের ধ্বংস নিজেই ডেকে আনলে।”
প্রীতি তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-” আমার চেঞ্জের জন্য এতটুকু ভেবেছ এরজন্য থ্যাংকস। তবে সো স্যরি, তোমার বউয়ের উপর মার্সি করতে পারছি না। ইচ্ছেকে না পাওয়া অবধি প্রত্যাশাকে জেলহাজতেই থাকতে হবে। ওকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে আমি অন্তত পারছি না।”
নীরব মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে ফিচেল হাসি ফুটিয়ে বলল,
-” প্রিয়স্মিতা খান প্রীতির বিরুদ্ধে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। এখন কার বদলে কে জেলে যাবে সেটা সবাই দেখবে। যে পুলিশ ফোর্স তুমি প্রত্যাশার জন্য এনেছো। তারাই এখন তোমাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য।”
প্রীতি হকচকিয়ে উঠে বলল,
-” হোয়াট? প্রমাণ কী? আর..আর আমার বিরুদ্ধে কী অপরাধ আছে?”
নীরবের দৃষ্টিতে ঘৃ*ণা ঝলসে উঠে। বলল ঘৃ*ণা ভরা কণ্ঠে,
-” তোমার অপরাধ শুনতে চাও? তবে শোনো; প্রত্যাশার ডাবে ড্রা*গ মেশানো, গু*ণ্ডা ভাড়া করে প্রত্যাশাকে তুলে নেওয়া, নীবিড় মাহবুবের সঙ্গে প্রতারণা। হ্যাঁ এখানে তুমি ব্যবহার হয়েছো। তোমার মা তার স্বার্থে তোমাকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তার মানে তোমার অপরাধ কম নয়। নীবিড়কে ঠকানোর জন্য, তোমার প্রত্যেকটি অন্যায়ের জন্য ইচ্ছে করছে।”
বলতে বলতে রি’ভ’লবা’র বের করে প্রীতির কপালে ঠেকাল নীরব। দাঁত চেপে বলল,
-” ইচ্ছে করছে নিজ হাতে শা*স্তি দিতে। একদম শুট করে দিতে। দিই শুট করে?”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
-” ইচ্ছে করছে নিজ হাতে শা*স্তি দিতে। একদম শুট করে দিতে। দিই শুট করে?”
প্রীতির চোখেমুখে ভয়ের লেশটুকু নেই। ম*রা*রও যেন ভয়ডর নেই ওর। একজোড়া নির্ভয় চাহনিতে নীরবের মুখপানে চেয়ে রইল নির্বিকার। অথচ কপালে রি”ভ”লবার ঠেকানো সামনে দাঁড়ানো নীরবের চোখমুখে রাগ-ক্রোধের সাথে এক আকাশসম ঘৃ*ণা স্পষ্ট। উপস্থিত সবার চোখেমুখেই আতংকের ছাপ। সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নুইয়ে নিল। প্রচন্ড অসহায় ঠেকছে। আদরের বোন নিজের পরিণাম নিজে ডেকে এনেছে, এখন আর কিছুই যে করার নেই।
নীলাশা ভ্রু কুঁচকে আওড়ায়— আগেই ভেবেছিলাম একদম সুবিধার মেয়ে নয় প্রীতি। আজ তো স্বচক্ষেই দেখছি। কী ডেঞ্জারাস মেয়ে রে বাবা। কপালে ব*ন্দুক ঠেকানো, অথচ কেমন নির্লিপ্ত আছে। চোখেমুখে এক ফোঁটা ভয়ও নেই।
প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে তাকাল। মনেমনে ভাবল— এইরে এএসপি সাহেব সত্যি সত্যি গু*লি টুলি করে দিবে না তো? ভাবনার ছেদ ঘটল শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে। নীহারিকা সহসাই বলে উঠলেন,
-” নীরব বাবা ইচ্ছে… ইচ্ছে কোথায়? বাচ্চা মেয়েটার কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”
নীরবের শান্ত জবাব,
-” ইচ্ছে সুস্থ আছে, সেফ আছে।”
কথাটা শোনার সাথে সাথেই নীহারিকা স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনেমনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। প্রত্যাশা বুকের উপর ডান হাতটা রেখে দম ফেলল। এতক্ষণে যেন মাথার উপর থেকে চিন্তার পাহাড়টা ক্ষণিকের জন্য হলেও সরল।
প্রীতি অসহায় চোখে নীরবের মুখপানে তাকাল। কণ্ঠে ব্যাকুলতা নিয়ে বলে উঠল,
-” ইচ্ছে….কোথায় আছে ইচ্ছে? আমি ওর কাছে যেতে চাই?”
-” ইচ্ছে তোমার খুব খুব কাছেই ছিলো।”
-” কাছেই ছিলো মানে? নীরব হেঁয়ালি না করে বলো ইচ্ছে কোথায় আছে?”
রিভলবার ধরা হাতটা নামিয়ে নিয়েছে নীরব। চোয়াল কঠিন করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-” ইচ্ছে কোথায় ছিল সেটা জানার আগে, তোমার জানা দরকার ইচ্ছেকে আসলে কে কি*ড*ন্যা*প করিয়েছে? জানাটা জরুরী নয়?”
প্রীতি কম্পমান স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” ক-কে?”
.
টেডির ভেতরে রাখা ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টের সিকিউর সার্ভারে লিংক করে রাখা ছিল। গতকাল প্রত্যাশা আর আনিশাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে সোজা অফিসে চলে আসে নীরব। নিজের অফিস কক্ষের দরজাটা ভিজিয়ে সোজা ল্যাপটপ নিয়ে বসে। উত্তেজনায় বুকের ভেতরকার ধুকপুক শব্দটা কানে বাজছে। আঙুল কীবোর্ডে রেখে জোড়াল শ্বাস টেনে নিল। দ্রুত পাসওয়ার্ড টাইপ করে ল্যাপটপ চালু করল। ঘামে ভিজে গেছে কপাল, ভ্রূ কুঁচকে টেনশন জমাট বাঁধছে। প্রতিটা সেকেন্ড যেন একেকটা ঘণ্টা ঠেকছে। আঙুলগুলো ত্রস্ত চালিয়ে ফটাফট ইউজারনেম টাইপ করল, তারপর পাসওয়ার্ড দিয়ে সিকিউর সার্ভারে ঢুকল। স্ক্রিনে লিখল– “Authentication Successful.”
এক সেকেন্ডের জন্য নিঃশ্বাস আটকে গেল। সাথে সাথেই ঢুকে গেল রিমোট অ্যাক্সেস পোর্টালে। টেডি বিয়ারের ক্যামেরার আইডি সেখানে আলাদা কোডে রেজিস্টার করা ছিল। ক্লিক করতেই সংযোগ শুরু হয়। নিচের অধরে দাঁত চেপে ধরল নীরব। চোখ স্থির করে তাকিয়ে রইল। স্ক্রিনে একের পর এক শব্দ ভেসে উঠল,
“Connecting… Securing Channel…Connection Established.”
কানেক্ট হতেই ডান হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে অস্ফুটে বলে উঠল নীরব— ইয়েস!
পরপরই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ঝাপসা ফুটেজ। লাইভ ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। মৃদু আলোয় পুরনো ফার্নিচারে ঠাসা একটা রুম। নিঃসন্দেহে এটা কোন বড়লোক বাড়ির স্টোর রুম হবে। হঠাৎই নীরবের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সিঙ্গেল একটা খাটে ইচ্ছে। ঘুমিয়ে আছে কী অজ্ঞান? বোঝা দায়। ভিজ্যুয়াল দেখে নীরব ক্লু খুঁজতে থাকে।
লাইভ ফিডে ইচ্ছেকে দেখে বুক মোচড় খেলেও, মাথায় দ্রুত একটা চিন্তা খেলে গেল নীরবের– এর আগে কী হয়েছে? কীভাবে ইচ্ছেকে ধরে নিয়ে এলো?
এটা ভেবে কীবোর্ডে শর্টকাট টিপল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল,
-” Accessing Previous Recordings…”
[তথ্য কালেক্টেড]
ইচ্ছে নিখোঁজ হওয়ার টাইমের দিকে গিয়ে একএক করে ফুটেজ স্ক্রল করতে লাগলো। ক্যামেরাটা ভিডিও-অডিও দুইটাই ক্যাপচার করে। বাইকার আর সাথেকার ছেলেটির কথোপকথন শুনে নীরব ক্লিয়ার হয় প্রত্যাশার ক্ষ*তি করতে গুণ্ডা ভাড়া করেছিল প্রীতি। মাস্টারমাইন্ড ছিলো প্রীতি। ডাবে ড্রা*গ মেশানোর কথা প্রীতি নিজ মুখেই স্বীকার করেছে। সার্থকের কথা সেদিন পুরোপুরি বিশ্বাস হয়েছিল না নীরবের। কারন সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় প্রত্যাশাকে স্বাভাবিক করতে লেবুর শরবত সার্থক অ্যারেঞ্জ করে। প্রত্যাশাকে বাসেও ঠিকমতো সেইই পৌঁছে দেয়। সুযোগ নেয়ার কোনোকিছু চোখে পড়েনি।
প্রীতির উপর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কটা চ’ড় দিয়ে নীরব থেমে যায়। রাগ ক্ষোভ কন্ট্রোল করে। তানিয়ার রিকুয়েস্টে আর বাড়তি কথা বলে না। তবে এসবের পেছনে সুক্ষ্ম অভিসন্ধি ছিলো। এই ঘটনার মাসখানেক আগেই মা*দ*ক চো”রাচালানের কেসটা হাতে আসে। ইচ্ছের জন্য ছাড়াও এই বাড়িতে আসা-যাওয়ার একটা গোপন কারনও ছিলো। সেই গোপন কারনের জন্যই প্রীতিকে সাময়িক ছাড় দেয়া হয়। নোং/রা অপরাধ করলেও বড় কোনো স্টেপ নেয়া হয় না।
নীরব আবার লাইভে ফিরে আসে। সময় যায় কাউকেই দেখা যায় না। নীরব রাতে বাসায় ফেরে না। কিছু কাগজপত্র রেডি করতে থাকে। আর মাঝেমাঝেই ফুটেজ চেক করে।
রাত দশটার দিকে আধো অন্ধকার রুমে আলো জ্বলে ওঠে। সাথে সাথেই সবকিছু ফকফকা হয়, সাথে মৃদু শব্দ শোনা গেল। ক্র্যাচে ভর করে এগিয়ে আসছেন কেউ একজন। ইচ্ছের হাত দুটো বাঁধা। চোখেও পাতলা কাপড় বাধা। খানিক আগেই জ্ঞান ফিরেছে। সাউন্ড প্রুফ রুম। সামনের ব্যক্তি এগিয়ে এসে ইচ্ছের সামনে খাবার ধরল। ইচ্ছে বোধহয় না করল। সে কান্না করছে। ব্যক্তিটি গলার ভয়েজ চেঞ্জ করে মোটা স্বরে বলে– খাবার শেষ করলেই তাকে বাসায় দিয়ে আসবে।
এরকম বলে কয়ে অল্প কিছু খাওয়ায় ইচ্ছেকে। তারপর ইচ্ছের ডানায় ইনজেকশন পুশ করে। দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথেই নীরবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।
ঘুমের ইনজেকশন ছিলো। যাতে কান্নাকাটি না করে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়।
এরপরের দৃশ্য দেখে নীরবসহ উপস্থিত অপর অফিসারের চোখ কপালে উঠে। ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তি দেয়ালে টানানো একটা পুরনো পেন্টিংয়ের সামনে যায়। একটা রিমোটের বোতাম টিপতেই পেন্টিংসহ দেয়াল যেন পাশে সরে গেল। আসলে একটা ডোর বানানো ছিল, যা পেন্টিং দিয়ে ঢাকা। ভেতরে রাখা কয়েকটা ফাইল, স্যাটেলাইট ফোন আর নগদ টাকা ভর্তি ব্যাগ। একটা চেয়ার টেনে বসে গেল ফোনের সামনে। মহিলার পরনে শুভ্র রঙা শাড়ি। মুখে কালো মাস্ক। ওপাশ থেকে এক বিদেশি মুখ ভেসে উঠল। ভাঙা বাংলায় সে বলল,
-” নেক্সট কনসাইনমেন্ট রেডি তো?”
খুব স্পষ্ট গলায় বলল,
-” যদিও একটু সমস্যা আছে, তবে সব আগের মতো চলছে। কেউ কিছু টের পাবে না।”
খান পরিবারের ইতিহাস সেই আদিম থেকেই ভীষণ অন্ধকার। তানিয়ার বাবা শুরু করেছিলেন গাঁ*জার ব্যবসা দিয়ে। পরে ধীরে ধীরে প্রসার বাড়ে। ছেলেরা বাবার সাথে যেমন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। তেমনি ব্যবসাতেও জড়ায়। বড় ছেলে আজিজ মেয়র হওয়ার পর সাবেক চেয়ারম্যান বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিজ হাতে নেয়। গাঁ*জা থেকে আস্তে আস্তে হাত বাড়ায় ড্রা*গ চোরাচালানে।
এ নিয়ে কেস হয়েছিল। কিন্তু কোনো অফিসার টাকার কাছে হেরে গেছে। কেউ বা ভ*য়ে মুখ খুলতে পারেনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে, শুধু তাইই নয়; উপর মহলের ক্ষমতাধর লোকজন পেছনে থাকায় দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে গেছে তারা।
আজিজ তারপর ছোটভাই সহ চাচাতো ভাইয়ের মৃ*ত্যু*র পর সবাই ভেবেছিল ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে নতুন করে মা*দক পা”চারের কেস সামনে আসে। এর তদন্তের দায়িত্ব পড়ে এএসপি নীরবের হাতে। স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটা সেই পুরনো সিন্ডিকেটের কাজ। মানে এখনো সক্রিয়। শুধু নতুন নেতৃত্বের আড়ালে চলছে।
নীরব ক্লায়েন্ট সেজে দু’মাস আগে এক ডিলারকে ধরেছিল। রিমান্ডে নিয়ে ঘাম ঝরানো জেরা করা হলেও মুখ খুলতে পারেনি। সে শুধু বলেছে— ‘আসল লিডারকে কখনো দেখেনি। সব নির্দেশ আসে পর্দার আড়াল থেকে।’
স্পেশাল ব্রাঞ্চের মিটিংয়ে তখন উঠে আসে— খান পরিবারের দিকে নজর রাখা হয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু ধরা পড়েনি। ছেলে ডাক্তারি নিয়ে ব্যস্ত, মেয়ে তার পেশা নিয়ে থাকে, বাড়িতে থাকে শুধু বৃদ্ধা মা। হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। তাকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না।
তবে নতুন করে পাওয়া কিছু তথ্য ঘুরেফিরে বারবারই খান পরিবারকেই সন্দেহের তালিকায় ফেলছিল। বাইরে থেকে সব স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে যেন কিছু লুকানো রহস্য আছে। সেই রহস্যের সমাধানের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়। বলাবাহুল্য সেখানে নীরবও আছে।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হুইলচেয়ারে বসা অক্ষম এক মহিলা। যাকে সবার চোখে অসহায় মনে হয়, তার ওপরেই এবার নজরদারি শুরু হয়। পাঁচ সদস্যের মিটিংয়ে শলা-পরামর্শ করে পুরো ছক কষা হয়। সন্দেহ যতই ক্ষীণ হোক প্রমাণ জোগাড় করাই আসল লক্ষ্য। ইচ্ছের টেডি বিয়ারের দুটোচোখে নিখুঁতভাবে বসিয়ে দেওয়া হয় গুপ্ত ক্যামেরা। দু’টো টেডিবিয়ার দেয়া হয়। নীরব কৌশলে বলে একটা সবসময় নিচে রাখতে। নিচে খেলা করবে। আরেকটা উপরে বা যেখানে সেখানে খেলতে পারে। ইচ্ছে পুরো বাড়ি ঘোরে। টেডি নিয়ে ঘোরা, খেলার অভ্যাস তার ছোট্ট থেকেই। সেই সুযোগটাই নেয়া হয়।
তবে আশ্চর্যের বিষয় দুমাস ছুঁইছুঁই হলেও টেডির ক্যামেরায় খুব সাধারণ ফুটেজই ধরা পড়ছিল। সন্দেহজনক কারো আগমণ, তানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ তেমন কিছুই চোখে পড়েনি।
ফুটেজ দেখে নীরব আওড়ায়— পিপীলিকার পাখা গজে মরিবার তরে। মিসেস খান এবারে অন্যের জন্য খোঁড়া গর্তে নিজেই পড়েছেন। বেশি চালাকি করে ইচ্ছেকে তার বাড়িতেই রেখেছিল। কারন নিজ বাড়িতে কিডন্যাপ করে রাখবে এটা ভুলেও মাথায় আসবে না। পুরো শহর থেকে শুরু করে দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও নিজ বাড়ির কথা ঘূর্ণাক্ষরেও কারো মাথায় আসবে না। আর ইচ্ছেকেও পাবে না।
সাথে থাকা অফিসার মাথা নেড়ে সহমত পোষণ করল।
ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলা মানুষটি আর কেউ নয়। স্বয়ং তানিয়া খান। ভদ্র ভালো মানুষি সেজে থাকার আড়ালের রুপটা আজ প্রমাণসহ আইনের সামনে। টিমের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আগামীকাল একটা চালান যাচ্ছে, সেইসময় হাতেনাতে ধরা। এরমধ্যে ওই বাড়ির চতুর্দিকে সিভিল ড্রেসে পুলিশ রাখা হয়। যাতে কোনোভাবে ইচ্ছেকে অন্যকোথাও সরিয়ে না দেয়।
.
.
প্রীতির উত্তরে নীরব বলল,
-” ইচ্ছেকে কিডন্যাপ কারী অন্যকেউ নয়, স্বয়ং মিসেস খান। তোমার জন্মদাত্রী মা তানিয়া খান।”
সার্থক থমকে গেল। প্রীতি অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। বলল,
-” মিথ্যে, মিথ্যে বলছো তুমি।”
নীরব মোবাইল অন করে ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ দেখাল। নিজেদের স্টোর রুম চিনতে প্রীতির এক সেকেন্ড দেরি হয় না। সেখানে ইচ্ছেকে দেখে শিউরে উঠল। বলল প্রীতি,
-” ইচ্ছে ওখানে.. ওখানে কী করে? ক-কখন, কীভাবে?”
স্টোর রুমের চাবি সবসময় মায়ের কাছেই থাকে। মা অবশ্য কাউকেই ওই রুমের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয় না। প্রীতি মনেমনে উত্তর ভেবে নিল– তবে কী বাড়ির পিছন গেট দিয়ে? পিছন গেটের সাইডে তো স্টোর রুমের একটা দরজাও আছে।
নীহারিকা শিউরে উঠলেন। কণ্ঠে ঘৃ*ণা মিশিয়ে বললেন,
-” ইয়া আল্লাহ! এরা মানুষ না কী প*শু? প*শুও ওদের থেকে ভালো। ওদেরকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি। এইজন্য ওদের নাম শুনলেও গা কাঁ”টা দিয়ে ওঠে। আজও ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিই। ওরা নিজ স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। পা*প করতে করতে ওদের ভেতর নুন্যতম মনুষ্যত্বটুকু অবশিষ্ট নেই। সবাই অবাক হলেও আমি অবাক হচ্ছি না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এইটুকুন একটা বাচ্চা। তাও নিজের নাতনী।”
মা কেনো ইচ্ছেকে কিডন্যাপ করল অস্থির প্রীতির মাথায় ধরছে না। প্রীতি ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,
-” মা, মা কেনো ইচ্ছেকে কি*ড*ন্যা*প করতে যাবে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
মেরুদন্ড টানটান করে সটান দাঁড়িয়ে নীরব। চোখেমুখে বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা ফুটিয়ে বলল,
-” যে কারনে তোমার মা তোমাকে উস্কিয়ে ছিল এই বাড়িতে এসে পেনড্রাইভটা খুঁজে বের করতে। সেই পেনড্রাইভের ডাটা মুছে ফেলতে ব্লাকমেইল করার জন্য ইচ্ছেকে কিডন্যাপ করা হয়। ইচ্ছেকে সরিয়ে আমাকে চাপের মধ্যে রাখা। আবার তোমাকে দিয়ে প্রত্যাশার নামে কেস করানো এটাও তোমার মায়ের প্ল্যান। ইচ্ছে নিখোঁজ, প্রত্যাশা থানায়। আমি যাতে সবদিক থেকে হতাশায় থাকি। সেই মূহূর্তে ইচ্ছেকে ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময় পেনড্রাইভ থেকে ডাটা রিমুভ করতে বলা। ইচ্ছে ফিরলেই প্রত্যাশা নির্দোষ প্রমাণ হবে। ইচ্ছে আর প্রত্যাশা দু’জনের জন্যেই তাদের কথা রাখতে বাধ্য হবো। এটা মিসেস খানের প্ল্যান ছিলো। বাট তার সব প্ল্যান জলে গেল। যদিও যেসকল তথ্য আছে তার ভিত্তিতে খুব শ্রীঘ্রই পুরনো সিন্ডিকেটকে ছায়া দিয়ে পরিচালনা করা মাস্টারমাইন্ড মিসেস খানকে আইনের আওতায় আনা হতো। সেটা আরো উপযুক্ত প্রমাণসহ হচ্ছে। ব্যাপারটা মন্দ নয়।”
নীরবের পেনড্রাইভে আছে ড্রাগ সিন্ডিকেটের আসল চেহারা ফাঁস করে দেওয়ার মতো কিছু তথ্য। বিদেশি ব্যাংক লেনদেন, সাপ্লাই রুট, আরো কিছু প্রমাণ সেখানে গচ্ছিত। এমনকি উচ্চপদস্থ কিছু মুখোশধারীর সাথেও সরাসরি যোগাযোগের রেকর্ড রয়েছে।
মীর জাফরের মতো বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে খবরটা তানিয়ার কানে পৌঁছে যায়। তারপরই সে প্রীতিকে বলেন—কোনোভাবে যদি নীরবের কাছ থেকে ওই পেনড্রাইভটা আনা যায়। বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত থাকবে তারমধ্যে সবার অগোচরে কাজটা করা গেলে ভালো হয়।
ক্যাডেটে পড়া, তারপর মেডিকেলে পড়ার সুবাধে সার্থকের বেশি সময় বাইরেই কেটেছে। মায়ের এই রুপের সাথে সে পরিচিত নয়। মা-ই হয়তো টের পেতে দেয়নি। সার্থক হতভম্ব হয়ে গেল।
প্রীতির চোখ টলমল করে উঠল। কাল রাত থেকে কিছুই খেতে পারেনি, দু’চোখের পাতা এক হয়নি। যতই মেয়ের প্রতি উদাসীন হোক, মা তো। অদৃশ্য একটা টান থেকেই যায়। বারবার মেয়ের ইনোসেন্ট মুখটা চোখের তারায় ভাসছিল। বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছিল। রাত থেকে মা-ইই তো প্রত্যাশাকে দায়ী করে কেস করার জন্য ইন্ধন জোগাল। এখন এসব কিছু শুনে প্রীতির দম বন্ধ হয়ে আসছে। আসলে কাউকে ঠকানোর শাস্তি প্রকৃতি বোধহয় রিটার্ন দেয়। ঠিক নিজেকেও ঠকতেই হয়।
নীরবের বজ্র কণ্ঠের হুংকারে প্রীতির সম্বিত ফেরে। নীবর বলল,
-” নীবিড়কে তুমি কখনো ভালোবাসোনি। তোমার মায়ের কথামতো ওকে বিয়ে করেছিলে, রাইট?”
আরেকটা কথা যা নীরব জানে। তবুও চেপে গেল। রুচিতে বাঁধল। মা-ছোটো মার সামনে কথাটা তুলতেও দ্বিধা হলো। প্রীতি অবাক চোখে তাকাল। নীরব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-” অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইচ্ছের টেডিতে ক্যামেরা ছিল। ও সোফায় বসে খেলছিল। তোমার আর তোমার মায়ের কথোপকথন থেকে জানি। এখন বলো, নীবিড়ের সাথে ঠিক কী করেছিলে? নীবিড়ের খাবারে ড্রা*গ তুমিই দিতে, রাইট?”
প্রীতি তড়িৎ দু’পাশে মাথা নাড়ল। বলল,
-” আমি জানি না। আর আমি কিছু করিনি এটা সত্যি।”
সাথে সাথে দাবাং মার্কা একটা চ”ড় পড়ল প্রীতির মাখনের মতন নরম গালে। নীরব চেঁচিয়ে উঠল,
-” একদম মিথ্যে বলবে না। তুমি সব জানো।”
প্রীতি গালে হাত রেখেই উচ্চস্বরে বলল,
-” আমি সত্যি বলছি আমি নীবিড়কে ড্রা*গ দেইনি।”
নীরব কিছু বলবে সার্থক বলে উঠল,
-” প্রীতি আমি জানি তুই যখন এভাবে দৃঢ় গলায় কিছু বলিস সেটা মিথ্যে হয় না। তোকে একটু হলেও চিনি। তবে বলব, যদি তুই কিছু জেনে থাকিস সত্যি করে বল। কিছু লুকাস না বোন আমার। এখনো সময় আছে নিজেকে চেঞ্জ করে ফেল। তুই নিজেকে শুধরে নে। কাউকে তোর পাশে না পেলেও আমাকে পাবি। আমি তোরজন্য…”
প্রীতি এক নিঃশ্বাসে বলল,
-” নীবিড়ের অসুস্থতার জন্য মা দায়ী। মায়ের উপর নীবিড়ের সন্দেহ হয়। মা সেটা টের পেতেই সুকৌশলে নীবিড়কে সরানোর প্ল্যান করে। যাতে করে কারো সন্দেহ না হয়। সবাই জানে নীবিড় নিজে থেকেই ড্রা*গে আ*সক্ত হয়েছিল। কিন্তু ওর খাবারে রোজ ড্রা*গ দেয়া হয়। তবে এর ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নীবিড় ড্রাগে আ*স*ক্ত হয়ে পরে। তখন নিজ থেকেই ড্রা*গ নিতো। আবার খাবারের মধ্যে দেয়া হতো। সেজন্য খুব অল্প সময়েই ও অসুস্থ হয়ে প__”
নীরবের চোখদুটো র*ক্তবর্ণ ধারণ করে। স্ত্রী হয়ে কী সুন্দর করে গটগট বলে যাচ্ছে! অথচ দায়ভার কোনো অংশে কম না এই মেয়েটার। নীরবের কপালের রগ টনটন করছে। রাগে সজোরে প্রীতির গালে চ’ড় দিল, সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে অপর গালে। দাঁত কটমট করে বলল নীরব,
-” লজ্জা করছে না তোমার? যে মানুষটা তোমাকে পা*গলের মতো ভালোবাসতো। তার ক্ষতি চোখের সামনে দেখেও চুপ ছিলে। নীরব সম্মতি দিতে।”
থা*প্প*ড়ে টাল সামলাতে না পেরে প্রীতি দু’কদম পিছিয়ে যায়। ঠোঁট কে*টে লাল তরল গড়িয়ে পরছে। ব্যথায় কপাল কুঁচকে এল। নীহারিকার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ধপ করে বসে পড়লেন।
এরমধ্যে পকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট থাকায় কেঁপে উঠল। ইমার্জেন্সি ফোন হতে পারে ভেবে নীরব দ্রুত ফোন বের করে। এতক্ষণে পুলিশ ফোর্স খান বাড়িতে পৌঁছে গেছে। সেই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কল হতে পারে। নীরব দুই আঙুলে কপালের ঘামটুকু ছুঁড়ে লেডি কনস্টেবলকে নির্দেশ দিল,
-” ওকে পিকআপে তুলুন। জলদি করুন। আমাকে এক্ষুনি আর্জেন্ট যেতে হবে।”
এই বলে নীরব বাইরে বেরিয়ে এসে কল তুলল। ওসি অদূরে দরজা বরাবর কলের পুতুলের মতোন দাঁড়িয়ে।
নীহারিকা বসে চেঁচিয়ে উঠলেন,
-” একে এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে সরাও। কালনাগিনী একটা। আমার ছেলেটাকে শেষ করেছে।”
প্রত্যাশার শরীর উইক লাগছে। কাল রাত থেকে এখন অবধি একটা দানাও কাঁটা হয়নি। ইচ্ছে সেভ আছে আপাতত সব স্বাভাবিক আছে দেখেই পেটের ভেতর ক্ষিধেয় মোচড় দিল। এসব কাহিনী আর ভালো লাগছিল না। প্রীতির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করল— আরেব্বাস এই অপ্রীতির তো দেখছি কই মাছের জান। এএসপি সাহেবের হাতে দাবাং মার্কা তিন তিনটে চ’ড় খেয়েও কেমন দিব্য দাঁড়িয়ে আছে। আমি হলে তো একটা চ*ড়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলব।
ফাজিল মহিলা একটা। মনেমনে বলে মাথা ঝাড়া দিল। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়ে পেটের দিকে তাকাল। কাল থেকে খাওয়া হয়নি। নিজের জন্য না হলেও পুচকো-টার জন্য কিছু খাওয়া জরুরী। যাতে করে গায়ে একটু বল পাওয়া যায়। ওপাশে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফ্রুটস ঝুড়ি থেকে একটা আপেল হাতে তুলল। চেয়ার টেনে বসে ছুরিটা নিয়ে এক টুকরো আপেল কেটে মুখে পুড়ল।
এদিকে লেডি কনস্টেবল প্রীতির হাতে হাতকড়া পড়াতে এগিয়ে আসে। প্রীতি তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে যায়। সার্থকের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ভাইয়া কিছু কর। আমি..যাব না থানায়। ইম্পসিবল।”
সার্থক বোঝানোর সুরে বলল,
-” প্রীতি আমি তোর জামিনের ব্যবস্থা করব। তুই এখন ওনাদের সাথে যা। আমি নীরবকে বুঝিয়ে বলব।”
প্রীতি পেছাতে থাকে। তিনটা কেস হয়েছে। তারমধ্যে দুটোই প্রত্যাশাকে নিয়ে। প্রীতির নজর গেল চেয়ারে বসে থাকা প্রত্যাশার দিকে। এই মেয়েটাকে শুরু থেকেই সহ্য হয় না। আজ যেন আরো হলো না। মনে হলো যা হচ্ছে সব এরজন্য। এরজন্যই জেলে যেতে হচ্ছে।
প্রত্যাশা হাতের ছু*রি নামিয়ে রাখল। ধূর! ভালো লাগছে না। এক টুকরো কোনো মতো গিলেছে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। এরমধ্যে প্রীতি অবাক কান্ড করে বসল। প্রত্যাশা অল্প দূরত্বে ছিলো। আচমকা ছুটে গিয়ে ছু*রি হাতে নিল। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রত্যাশার গলায় ঠেকাল। প্রত্যাশা হকচকাল। রাগে ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে প্রীতি বলল,
-” জেলের অন্ধকার রুমে আমি থাকব। আর তুমি আরামে থাকবে তা কখনো হতে দেয়া যায়? উঁহু যায় না। তোমাকে এখন পর্যন্ত কোনো শা*স্তিই দিতে পারিনি। বরং তোমার জন্যই আজ আমার এই পরিণতি।”
প্রত্যাশা ভ’য় পেল না। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মনে মনে বলল—‘বাবাগো এক টুকরো আপেলই দেখছি জানের কাল হয়ে দাঁড়াল।’ পরপর প্রীতির দিকে মুখটা বাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-” আরে আমি না তোমার বোন হই। তাহলে এমন সতীনের মতোন আচরণ করছো কেনো?”
এই মেয়ে এখন বাড়তি কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইছে। তা সুচতুর প্রীতি ঠিক ধরে ফেলল। তাই উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। প্রত্যাশার ডান হাতটা পেছনে শক্ত করে মুচড়ে ধরা। প্রত্যাশা ঝটপট বাম দিয়ে ছুড়ি ধরা প্রীতির হাত ধরল। কিন্তু প্রীতির শক্তির কাছে প্রত্যাশার শক্তি কিছুই না। একেতে দূর্বল শরীর, তারউপর না খেয়ে আছে। প্রত্যাশার মাথা তখন থেকেই ঘুরছিল।
-‘লেডি কনস্টেবল দু’টো হা করে দেখছে কী? দু’টো মিলে একজনের সাথে যদি না পারে। তাহলে কীসের পুলিশ? আরে বাংলাদেশের পুলিশ। এদের নাকের ডগা দিয়ে আসামী পালাবে, অপরাধ করবে। আর এরা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে।’ এই ভেবে প্রত্যাশার প্রচন্ড রাগ হলো।
নীহারিকা,শর্মিলা আর্তনাদ করে উঠলেন। নীলাশার ফোন আসায় রুমে সে।
-” প্রীতি পা*গলামি করিস না।”
এই বলে সার্থক এগিয়ে যেতে নেয়। প্রীতি শক্ত কণ্ঠে বলল,
-” ওখানেই থাম ভাইয়া। এক পা এগোলে সাথে সাথেই প্রত্যাশাকে শেষ করে দিবো। তুই আমাকে ভালো করেই জানিস আমি নিজেকে সেফ করার জন্য ক্যারাটে থেকে ফাইট সবটাই আয়ত্ত করেছিলাম। আমি অদক্ষ হাতে ছু*রি চালাব না। আমার একটা টানই যথেষ্ট। তবে প্রত্যাশাকে কিছু কথা বলা জরুরী।”
কথা শেষ করে ভেতরে পা রাখতেই থমকে গেল নীরব। প্রীতির সব কথাই তার কানে গেল। রাগে মাথায় খু*ন চাপল ওর। মনে হচ্ছে তখন শুট করে দিলেই ভালো হতো। অবশ্য আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অপরাধ না থাকলে তাইই করতো। নীরব ক’কদম এগিয়ে চোয়াল শক্ত করে বজ্রকণ্ঠে স্রেফ বলল,
-” প্রীতি, লেট গো অফ প্রত্যাশা। আই উইল কাউন্ট টু থ্রি। ইফ ইউ ডোন্ট সারেন্ডার, আই উইল হ্যাভ নো চয়েস বাট টু শুট।”
প্রীতি তাকিয়ে দেখে নীরবের রিভলবার তার দিকে তাক করা। হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল প্রীতি। হাসি থামিয়ে চোখ কুঁচকে বিদ্রূপ ভরা স্বরে বলল,
-” করো শুট। তবে মনে রেখো যদি হাতটা কেঁপে সামান্য এদিক-সেদিক হয়, উনিশ-কুড়ির হেরফেরেই__”
থেমে একপলকে প্রত্যাশার মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকাল। প্রত্যাশা ওর সামনে, প্রীতি পেছনে। পরক্ষনেই বলল,
-” তোমার বউয়েরই প্রাণ যাবে। মনে রেখো প্রীতির কোনো পিছুটান নেই। ম”রারও ভয় নেই। তাই শুট করার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। জানো নীরব, আমি সবসময় একটা কথা বলতাম; যেদিন আমার ভালোবাসা থামবে, সেদিন তোমার নিঃশ্বাসও বন্ধ হবে। আজ মনে হয় সেই দিন এসে গেছে। উঁহু, তোমাকে কিছু করব না। তোমার প্রাণ তো এখন তোমার বউ। সেই প্রাণটাই যদি না থাকে, তবে কেমন লাগে বুঝবে। আর তোমার দেয়া থাপ্পড় গুলো হজম করা প্রীতির জন্য খুব সহজ নয়। এই মেয়ের জন্য আমাকে থাপ্পড় খেতে হয়েছে। যাকে কেউ কখনো ভুলেও ফুলের টোকা দেয়নি। সব মিলিয়ে এখন যা হবে সেটা প্রত্যাশার প্রাপ্য।”
নীরব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-” তুমি একটা সাইকো?”
প্রীতি হেসে উত্তর দিল,
-” হয়তো। তবে তোমারই জন্য।”
ঘৃ*ণায় একদলা থুতু ছুড়ে দিল নীরব। সার্থক অসহায় গলায় বলে উঠল,
-” প্রীতি, পাগলামি করিস না। প্রত্যাশাকে ছেড়ে দে।”
প্রীতি ঠান্ডা স্বরে বলল,
-” স্যরি ভাইয়া।”
পরপরই গুলির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। সবাই চোখ খিচে বুঁজে ফেলে। প্রত্যাশা থমকে গেল। কেঁপে উঠল সমস্ত শরীর। প্রত্যাশার চেয়ে প্রীতির হাইট বেশি। নীরবের নিশানা গিয়ে ঠিক লাগল। প্রীতির কাঁধ থেকে দেড় ইঞ্চি নিচ থেকে টগবগিয়ে লাল তরল উথলে পড়ছে। ছুরি ধরা প্রীতির ডান হাতটা কেঁপে উঠল। প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ নিজের বাম হাত দিয়ে ছুরিটা আঁকড়ে ধরে। প্রীতি পরে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। প্রত্যাশা ছুরি ধরেই প্রীতিকে পিছন দিকে ধাক্কা দেয়। ছুরিটা ধারাল থাকায় প্রত্যাশার আঙুলের পাতলা নরম চামড়া কে*টে র*ক্ত ঝরতে থাকে। প্রীতির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পেছনে পরে যেতে নেয় ও। সার্থক এগিয়ে প্রীতিকে ধরে। বোনকে ধরতেই র*ক্তে সাদা শার্ট মেখে যায়। নীরব এগিয়ে আসতেই ধুকপুক বুক নিয়ে প্রত্যাশা সামনে এসে দাঁড়ায়। এত র*ক্ত দেখে মাথা ঘুরতে থাকে। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা নীরবের বুকের উপর মাথা দিয়ে জাপটে ধরে। জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। নীরব একটা হাত প্রত্যাশার গালে রেখে বলল,
-” প্রত্যাশা ডোন্ট প্যানিক। কিচ্ছু হয়নি।”
প্রত্যাশা দু’হাতে নীরবের পিঠের কাছের শার্ট আঁকড়ে ধরল। চোখ খিচে বুঁজে রইল। নীরব আলগোছে প্রত্যাশার বাম হাতটা টেনে নিল। র*ক্ত ঝরছে। পকেট হাতড়ে রোমাল বের করে চেপে ধরে নীরব। সাদা রোমাল র*ক্তে ভিজে লাল হয়ে চপচপ করছে।
#চলবে