মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৫০+৫১

0
10

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

-” ইচ্ছে করছে নিজ হাতে শা*স্তি দিতে। একদম শুট করে দিতে। দিই শুট করে?”

প্রীতির চোখেমুখে ভয়ের লেশটুকু নেই। ম*রা*রও যেন ভয়ডর নেই ওর। একজোড়া নির্ভয় চাহনিতে নীরবের মুখপানে চেয়ে রইল নির্বিকার। অথচ কপালে রি”ভ”লবার ঠেকানো সামনে দাঁড়ানো নীরবের চোখমুখে রাগ-ক্রোধের সাথে এক আকাশসম ঘৃ*ণা স্পষ্ট। উপস্থিত সবার চোখেমুখেই আতংকের ছাপ। সার্থক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নুইয়ে নিল। প্রচন্ড অসহায় ঠেকছে। আদরের বোন নিজের পরিণাম নিজে ডেকে এনেছে, এখন আর কিছুই যে করার নেই।

নীলাশা ভ্রু কুঁচকে আওড়ায়— আগেই ভেবেছিলাম একদম সুবিধার মেয়ে নয় প্রীতি। আজ তো স্বচক্ষেই দেখছি। কী ডেঞ্জারাস মেয়ে রে বাবা। কপালে ব*ন্দুক ঠেকানো, অথচ কেমন নির্লিপ্ত আছে। চোখেমুখে এক ফোঁটা ভয়ও নেই।

প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে তাকাল। মনেমনে ভাবল— এইরে এএসপি সাহেব সত্যি সত্যি গু*লি টুলি করে দিবে না তো? ভাবনার ছেদ ঘটল শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে। নীহারিকা সহসাই বলে উঠলেন,

-” নীরব বাবা ইচ্ছে… ইচ্ছে কোথায়? বাচ্চা মেয়েটার কোনো খোঁজ পেয়েছিস?”

নীরবের শান্ত জবাব,

-” ইচ্ছে সুস্থ আছে, সেফ আছে।”

কথাটা শোনার সাথে সাথেই নীহারিকা স্বস্তির শ্বাস ফেলে মনেমনে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন। প্রত্যাশা বুকের উপর ডান হাতটা রেখে দম ফেলল। এতক্ষণে যেন মাথার উপর থেকে চিন্তার পাহাড়টা ক্ষণিকের জন্য হলেও সরল।

প্রীতি অসহায় চোখে নীরবের মুখপানে তাকাল। কণ্ঠে ব্যাকুলতা নিয়ে বলে উঠল,

-” ইচ্ছে….কোথায় আছে ইচ্ছে? আমি ওর কাছে যেতে চাই?”

-” ইচ্ছে তোমার খুব খুব কাছেই ছিলো।”

-” কাছেই ছিলো মানে? নীরব হেঁয়ালি না করে বলো ইচ্ছে কোথায় আছে?”

রিভলবার ধরা হাতটা নামিয়ে নিয়েছে নীরব। চোয়াল কঠিন করে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

-” ইচ্ছে কোথায় ছিল সেটা জানার আগে, তোমার জানা দরকার ইচ্ছেকে আসলে কে কি*ড*ন্যা*প করিয়েছে? জানাটা জরুরী নয়?”

প্রীতি কম্পমান স্বরে জিজ্ঞাসা করল,

-” ক-কে?”

.

টেডির ভেতরে রাখা ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টের সিকিউর সার্ভারে লিংক করে রাখা ছিল। গতকাল প্রত্যাশা আর আনিশাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে সোজা অফিসে চলে আসে নীরব। নিজের অফিস কক্ষের দরজাটা ভিজিয়ে সোজা ল্যাপটপ নিয়ে বসে। উত্তেজনায় বুকের ভেতরকার ধুকপুক শব্দটা কানে বাজছে। আঙুল কীবোর্ডে রেখে জোড়াল শ্বাস টেনে নিল। দ্রুত পাসওয়ার্ড টাইপ করে ল্যাপটপ চালু করল। ঘামে ভিজে গেছে কপাল, ভ্রূ কুঁচকে টেনশন জমাট বাঁধছে। প্রতিটা সেকেন্ড যেন একেকটা ঘণ্টা ঠেকছে। আঙুলগুলো ত্রস্ত চালিয়ে ফটাফট ইউজারনেম টাইপ করল, তারপর পাসওয়ার্ড দিয়ে সিকিউর সার্ভারে ঢুকল। স্ক্রিনে লিখল– “Authentication Successful.”

এক সেকেন্ডের জন্য নিঃশ্বাস আটকে গেল। সাথে সাথেই ঢুকে গেল রিমোট অ্যাক্সেস পোর্টালে। টেডি বিয়ারের ক্যামেরার আইডি সেখানে আলাদা কোডে রেজিস্টার করা ছিল। ক্লিক করতেই সংযোগ শুরু হয়। নিচের অধরে দাঁত চেপে ধরল নীরব।‌ চোখ স্থির করে তাকিয়ে রইল। স্ক্রিনে একের পর এক শব্দ ভেসে উঠল,

“Connecting… Securing Channel…Connection Established.”

কানেক্ট হতেই ডান হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে অস্ফুটে বলে উঠল নীরব— ইয়েস!

পরপরই স্ক্রিনে ভেসে উঠল ঝাপসা ফুটেজ। লাইভ ফুটেজ দেখা যাচ্ছে। মৃদু আলোয় পুরনো ফার্নিচারে ঠাসা একটা রুম। নিঃসন্দেহে এটা কোন বড়লোক বাড়ির স্টোর রুম হবে। হঠাৎই নীরবের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সিঙ্গেল একটা খাটে ইচ্ছে। ঘুমিয়ে আছে কী অজ্ঞান? বোঝা দায়। ভিজ্যুয়াল দেখে নীরব ক্লু খুঁজতে থাকে।

লাইভ ফিডে ইচ্ছেকে দেখে বুক মোচড় খেলেও, মাথায় দ্রুত একটা চিন্তা খেলে গেল নীরবের– এর আগে কী হয়েছে? কীভাবে ইচ্ছেকে ধরে নিয়ে এলো?

এটা ভেবে কীবোর্ডে শর্টকাট টিপল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল,

-” Accessing Previous Recordings…”

[তথ্য কালেক্টেড]

ইচ্ছে নিখোঁজ হওয়ার টাইমের দিকে গিয়ে একএক করে ফুটেজ স্ক্রল করতে লাগলো। ক্যামেরাটা ভিডিও-অডিও দুইটাই ক্যাপচার করে। বাইকার আর সাথেকার ছেলেটির কথোপকথন শুনে নীরব ক্লিয়ার হয় প্রত্যাশার ক্ষ*তি করতে গুণ্ডা ভাড়া করেছিল প্রীতি। মাস্টারমাইন্ড ছিলো প্রীতি। ডাবে ড্রা*গ মেশানোর কথা প্রীতি নিজ মুখেই স্বীকার করেছে। সার্থকের কথা সেদিন পুরোপুরি বিশ্বাস হয়েছিল না নীরবের। কারন সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায় প্রত্যাশাকে স্বাভাবিক করতে লেবুর শরবত সার্থক অ্যারেঞ্জ করে। প্রত্যাশাকে বাসেও ঠিকমতো সেইই পৌঁছে দেয়। সুযোগ নেয়ার কোনোকিছু চোখে পড়েনি।

প্রীতির উপর প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কটা চ’ড় দিয়ে নীরব থেমে যায়। রাগ ক্ষোভ কন্ট্রোল করে। তানিয়ার রিকুয়েস্টে আর বাড়তি কথা বলে না। তবে এসবের পেছনে সুক্ষ্ম অভিসন্ধি ছিলো। এই ঘটনার মাসখানেক আগেই মা*দ*ক চো”রাচালানের কেসটা হাতে আসে। ইচ্ছের জন্য ছাড়াও এই বাড়িতে আসা-যাওয়ার একটা গোপন কারনও ছিলো। সেই গোপন কারনের জন্যই প্রীতিকে সাময়িক ছাড় দেয়া হয়। নোং/রা অপরাধ করলেও বড় কোনো স্টেপ নেয়া হয় না।

নীরব আবার লাইভে ফিরে আসে। সময় যায় কাউকেই দেখা যায় না। নীরব রাতে বাসায় ফেরে না। কিছু কাগজপত্র রেডি করতে থাকে। আর মাঝেমাঝেই ফুটেজ চেক করে।

রাত দশটার দিকে আধো অন্ধকার রুমে আলো জ্বলে ওঠে। সাথে সাথেই সবকিছু ফকফকা হয়, সাথে মৃদু শব্দ শোনা গেল। ক্র্যাচে ভর করে এগিয়ে আসছেন কেউ একজন। ইচ্ছের হাত দুটো বাঁধা। চোখেও পাতলা কাপড় বাধা। খানিক আগেই জ্ঞান ফিরেছে। সাউন্ড প্রুফ রুম। সামনের ব্যক্তি এগিয়ে এসে ইচ্ছের সামনে খাবার ধরল। ইচ্ছে বোধহয় না করল। সে কান্না করছে। ব্যক্তিটি গলার ভয়েজ চেঞ্জ করে মোটা স্বরে বলে– খাবার শেষ করলেই তাকে বাসায় দিয়ে আসবে।

এরকম বলে কয়ে অল্প কিছু খাওয়ায় ইচ্ছেকে। তারপর ইচ্ছের ডানায় ইনজেকশন পুশ করে। দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথেই নীরবের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।

ঘুমের ইনজেকশন ছিলো। যাতে কান্নাকাটি না করে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়।

এরপরের দৃশ্য দেখে নীরবসহ উপস্থিত অপর অফিসারের চোখ কপালে উঠে। ক্র্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়ানো ব্যক্তি দেয়ালে টানানো একটা পুরনো পেন্টিংয়ের সামনে যায়। একটা রিমোটের বোতাম টিপতেই পেন্টিংসহ দেয়াল যেন পাশে সরে গেল। আসলে একটা ডোর বানানো ছিল, যা পেন্টিং দিয়ে ঢাকা। ভেতরে রাখা কয়েকটা ফাইল, স্যাটেলাইট ফোন আর নগদ টাকা ভর্তি ব্যাগ। একটা চেয়ার টেনে বসে গেল ফোনের সামনে। মহিলার পরনে শুভ্র রঙা শাড়ি। মুখে কালো মাস্ক। ওপাশ থেকে এক বিদেশি মুখ ভেসে উঠল। ভাঙা বাংলায় সে বলল,

-” নেক্সট কনসাইনমেন্ট রেডি তো?”

খুব স্পষ্ট গলায় বলল,

-” যদিও একটু সমস্যা আছে, তবে সব আগের মতো চলছে। কেউ কিছু টের পাবে না।”

খান পরিবারের ইতিহাস সেই আদিম থেকেই ভীষণ অন্ধকার। তানিয়ার বাবা শুরু করেছিলেন গাঁ*জার ব্যবসা দিয়ে। পরে ধীরে ধীরে প্রসার বাড়ে। ছেলেরা বাবার সাথে যেমন রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। তেমনি ব্যবসাতেও জড়ায়। বড় ছেলে আজিজ মেয়র হওয়ার পর সাবেক চেয়ারম্যান বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিজ হাতে নেয়। গাঁ*জা থেকে আস্তে আস্তে হাত বাড়ায় ড্রা*গ চোরাচালানে।

এ নিয়ে কেস হয়েছিল। কিন্তু কোনো অফিসার টাকার কাছে হেরে গেছে। কেউ বা ভ*য়ে মুখ খুলতে পারেনি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে, শুধু তাইই নয়; উপর মহলের ক্ষমতাধর লোকজন পেছনে থাকায় দিব্যি ব্যবসা চালিয়ে গেছে তারা।

আজিজ তারপর ছোটভাই সহ চাচাতো ভাইয়ের মৃ*ত্যু*র পর সবাই ভেবেছিল ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে নতুন করে মা*দক পা”চারের কেস সামনে আসে। এর তদন্তের দায়িত্ব পড়ে এএসপি নীরবের হাতে। স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটা সেই পুরনো সিন্ডিকেটের কাজ। মানে এখনো সক্রিয়। শুধু নতুন নেতৃত্বের আড়ালে চলছে।

নীরব ক্লায়েন্ট সেজে দু’মাস আগে এক ডিলারকে ধরেছিল। রিমান্ডে নিয়ে ঘাম ঝরানো জেরা করা হলেও মুখ খুলতে পারেনি। সে শুধু বলেছে— ‘আসল লিডারকে কখনো দেখেনি। সব নির্দেশ আসে পর্দার আড়াল থেকে।’

স্পেশাল ব্রাঞ্চের মিটিংয়ে তখন উঠে আসে— খান পরিবারের দিকে নজর রাখা হয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু ধরা পড়েনি। ছেলে ডাক্তারি নিয়ে ব্যস্ত, মেয়ে তার পেশা নিয়ে থাকে, বাড়িতে থাকে শুধু বৃদ্ধা মা। হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। তাকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না।

তবে নতুন করে পাওয়া কিছু তথ্য ঘুরেফিরে বারবারই খান পরিবারকেই সন্দেহের তালিকায় ফেলছিল। বাইরে থেকে সব স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে যেন কিছু লুকানো রহস্য আছে। সেই রহস্যের সমাধানের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি স্পেশাল টিম গঠন করা হয়। বলাবাহুল্য সেখানে নীরবও আছে।

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হুইলচেয়ারে বসা অক্ষম এক মহিলা। যাকে সবার চোখে অসহায় মনে হয়, তার ওপরেই এবার নজরদারি শুরু হয়। পাঁচ সদস্যের মিটিংয়ে শলা-পরামর্শ করে পুরো ছক কষা হয়। সন্দেহ যতই ক্ষীণ হোক প্রমাণ জোগাড় করাই আসল লক্ষ্য। ইচ্ছের টেডি বিয়ারের দুটোচোখে নিখুঁতভাবে বসিয়ে দেওয়া হয় গুপ্ত ক্যামেরা। দু’টো টেডিবিয়ার দেয়া হয়। নীরব কৌশলে বলে একটা সবসময় নিচে রাখতে। নিচে খেলা করবে। আরেকটা উপরে বা যেখানে সেখানে খেলতে পারে। ইচ্ছে পুরো বাড়ি ঘোরে। টেডি নিয়ে ঘোরা, খেলার অভ্যাস তার ছোট্ট থেকেই। সেই সুযোগটাই নেয়া হয়।

তবে আশ্চর্যের বিষয় দুমাস ছুঁইছুঁই হলেও টেডির ক্যামেরায় খুব সাধারণ ফুটেজই ধরা পড়ছিল। সন্দেহজনক কারো আগমণ, তানিয়ার সাথে সাক্ষাৎ তেমন কিছুই চোখে পড়েনি।

ফুটেজ দেখে নীরব আওড়ায়— পিপীলিকার পাখা গজে মরিবার তরে। মিসেস খান এবারে অন্যের জন্য খোঁড়া গর্তে নিজেই পড়েছেন। বেশি চালাকি করে ইচ্ছেকে তার বাড়িতেই রেখেছিল। কারন নিজ বাড়িতে কিডন্যাপ করে রাখবে এটা ভুলেও মাথায় আসবে না। পুরো শহর থেকে শুরু করে দেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও নিজ বাড়ির কথা ঘূর্ণাক্ষরেও কারো মাথায় আসবে না। আর ইচ্ছেকেও পাবে না।

সাথে থাকা অফিসার মাথা নেড়ে সহমত পোষণ করল।

ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলা মানুষটি আর কেউ নয়। স্বয়ং তানিয়া খান। ভদ্র ভালো মানুষি সেজে থাকার আড়ালের রুপটা আজ প্রমাণসহ আইনের সামনে। টিমের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আগামীকাল একটা চালান যাচ্ছে, সেইসময় হাতেনাতে ধরা। এরমধ্যে ওই বাড়ির চতুর্দিকে সিভিল ড্রেসে পুলিশ রাখা হয়। যাতে কোনোভাবে ইচ্ছেকে অন্যকোথাও সরিয়ে না দেয়।

.
.

প্রীতির উত্তরে নীরব বলল,

-” ইচ্ছেকে কিডন্যাপ কারী অন্যকেউ নয়, স্বয়ং মিসেস খান। তোমার জন্মদাত্রী মা তানিয়া খান।”

সার্থক থমকে গেল। প্রীতি অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। বলল,

-” মিথ্যে, মিথ্যে বলছো তুমি।”

নীরব মোবাইল অন করে ছোট্ট একটা ভিডিও ক্লিপ দেখাল। নিজেদের স্টোর রুম চিনতে প্রীতির এক সেকেন্ড দেরি হয় না। সেখানে ইচ্ছেকে দেখে শিউরে উঠল। বলল প্রীতি,

-” ইচ্ছে ওখানে.. ওখানে কী করে? ক-কখন, কীভাবে?”

স্টোর রুমের চাবি সবসময় মায়ের কাছেই থাকে। মা অবশ্য কাউকেই ওই রুমের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেয় না। প্রীতি মনেমনে উত্তর ভেবে নিল– তবে কী বাড়ির পিছন গেট দিয়ে? পিছন গেটের সাইডে তো স্টোর রুমের একটা দরজাও আছে।

নীহারিকা শিউরে উঠলেন। কণ্ঠে ঘৃ*ণা মিশিয়ে বললেন,

-” ইয়া আল্লাহ! এরা মানুষ না কী প*শু? প*শুও ওদের থেকে ভালো। ওদেরকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি। এইজন্য ওদের নাম শুনলেও গা কাঁ”টা দিয়ে ওঠে।‌ আজও ঘেন্নায় মুখ ফিরিয়ে নিই। ওরা নিজ স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। পা*প করতে করতে ওদের ভেতর নুন্যতম মনুষ্যত্বটুকু অবশিষ্ট নেই। সবাই অবাক হলেও আমি অবাক হচ্ছি না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এইটুকুন একটা বাচ্চা। তাও নিজের নাতনী।”

মা কেনো ইচ্ছেকে কিডন্যাপ করল অস্থির প্রীতির মাথায় ধরছে না। প্রীতি ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,

-” মা, মা কেনো ইচ্ছেকে কি*ড*ন্যা*প করতে যাবে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”

মেরুদন্ড টানটান করে সটান দাঁড়িয়ে নীরব। চোখেমুখে বুদ্ধিদীপ্ত ভাবটা ফুটিয়ে বলল,

-” যে কারনে তোমার মা তোমাকে উস্কিয়ে ছিল এই বাড়িতে এসে পেনড্রাইভটা খুঁজে বের করতে। সেই পেনড্রাইভের ডাটা মুছে ফেলতে ব্লাকমেইল করার জন্য ইচ্ছেকে কিডন্যাপ করা হয়। ইচ্ছেকে সরিয়ে আমাকে চাপের মধ্যে রাখা। আবার তোমাকে দিয়ে প্রত্যাশার নামে কেস করানো এটাও তোমার মায়ের প্ল্যান। ইচ্ছে নিখোঁজ, প্রত্যাশা থানায়। আমি যাতে সবদিক থেকে হতাশায় থাকি। সেই মূহূর্তে ইচ্ছেকে ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময় পেনড্রাইভ থেকে ডাটা রিমুভ করতে বলা। ইচ্ছে ফিরলেই প্রত্যাশা নির্দোষ প্রমাণ হবে। ইচ্ছে আর প্রত্যাশা দু’জনের জন্যেই তাদের কথা রাখতে বাধ্য হবো। এটা মিসেস খানের প্ল্যান ছিলো। বাট তার সব প্ল্যান জলে গেল। যদিও যেসকল তথ্য আছে তার ভিত্তিতে খুব শ্রীঘ্রই পুরনো সিন্ডিকেটকে ছায়া দিয়ে পরিচালনা করা মাস্টারমাইন্ড মিসেস খানকে আইনের আওতায় আনা হতো। সেটা আরো উপযুক্ত প্রমাণসহ হচ্ছে। ব্যাপারটা মন্দ নয়।”

নীরবের পেনড্রাইভে আছে ড্রাগ সিন্ডিকেটের আসল চেহারা ফাঁস করে দেওয়ার মতো কিছু তথ্য। বিদেশি ব্যাংক লেনদেন, সাপ্লাই রুট, আরো কিছু প্রমাণ সেখানে গচ্ছিত। এমনকি উচ্চপদস্থ কিছু মুখোশধারীর সাথেও সরাসরি যোগাযোগের রেকর্ড রয়েছে।

মীর জাফরের মতো বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে খবরটা তানিয়ার কানে পৌঁছে যায়। তারপরই সে প্রীতিকে বলেন—কোনোভাবে যদি নীরবের কাছ থেকে ওই পেনড্রাইভটা আনা যায়। বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত থাকবে তারমধ্যে সবার অগোচরে কাজটা করা গেলে ভালো হয়।

ক্যাডেটে পড়া, তারপর মেডিকেলে পড়ার সুবাধে সার্থকের বেশি সময় বাইরেই কেটেছে। মায়ের এই রুপের সাথে সে পরিচিত নয়। মা-ই হয়তো টের পেতে দেয়নি। সার্থক হতভম্ব হয়ে গেল।

প্রীতির চোখ টলমল করে উঠল। কাল রাত থেকে কিছুই খেতে পারেনি, দু’চোখের পাতা এক হয়নি। যতই মেয়ের প্রতি উদাসীন হোক, মা তো। অদৃশ্য একটা টান থেকেই যায়। বারবার মেয়ের ইনোসেন্ট মুখটা চোখের তারায় ভাসছিল। বুকের ভেতর কষ্ট হচ্ছিল। রাত থেকে মা-ইই তো প্রত্যাশাকে দায়ী করে কেস করার জন্য ইন্ধন জোগাল। এখন এসব কিছু শুনে প্রীতির দম বন্ধ হয়ে আসছে। আসলে কাউকে ঠকানোর শাস্তি প্রকৃতি বোধহয় রিটার্ন দেয়। ঠিক নিজেকেও ঠকতেই হয়।

নীরবের বজ্র কণ্ঠের হুংকারে প্রীতির সম্বিত ফেরে। নীবর বলল,

-” নীবিড়কে তুমি কখনো ভালোবাসোনি। তোমার মায়ের কথামতো ওকে বিয়ে করেছিলে, রাইট?”

আরেকটা কথা যা নীরব জানে। তবুও চেপে গেল। রুচিতে বাঁধল। মা-ছোটো মার সামনে কথাটা তুলতেও দ্বিধা হলো। প্রীতি অবাক চোখে তাকাল। নীরব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-” অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইচ্ছের টেডিতে ক্যামেরা ছিল। ও সোফায় বসে খেলছিল। তোমার আর তোমার মায়ের কথোপকথন থেকে জানি। এখন বলো, নীবিড়ের সাথে ঠিক কী করেছিলে? নীবিড়ের খাবারে ড্রা*গ তুমিই দিতে, রাইট?”

প্রীতি তড়িৎ দু’পাশে মাথা নাড়ল। বলল,

-” আমি জানি না। আর আমি কিছু করিনি এটা সত্যি।”

সাথে সাথে দাবাং মার্কা একটা চ”ড় পড়ল প্রীতির মাখনের মতন নরম গালে। নীরব চেঁচিয়ে উঠল,

-” একদম মিথ্যে বলবে না। তুমি সব জানো।”

প্রীতি গালে হাত রেখেই উচ্চস্বরে বলল,

-” আমি সত্যি বলছি আমি নীবিড়কে ড্রা*গ দেইনি।”

নীরব কিছু বলবে সার্থক বলে উঠল,

-” প্রীতি আমি জানি তুই যখন এভাবে দৃঢ় গলায় কিছু বলিস সেটা মিথ্যে হয় না। তোকে একটু হলেও চিনি। তবে বলব, যদি তুই কিছু জেনে থাকিস সত্যি করে বল। কিছু লুকাস না বোন আমার। এখনো সময় আছে নিজেকে চেঞ্জ করে ফেল। তুই নিজেকে শুধরে নে। কাউকে তোর পাশে না পেলেও আমাকে পাবি। আমি তোরজন্য…”

প্রীতি এক নিঃশ্বাসে বলল,

-” নীবিড়ের অসুস্থতার জন্য মা দায়ী। মায়ের উপর নীবিড়ের সন্দেহ হয়। মা সেটা টের পেতেই সুকৌশলে নীবিড়কে সরানোর প্ল্যান করে। যাতে করে কারো সন্দেহ না হয়। সবাই জানে নীবিড় নিজে থেকেই ড্রা*গে আ*সক্ত হয়েছিল। কিন্তু ওর খাবারে রোজ ড্রা*গ দেয়া হয়। তবে এর ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নীবিড় ড্রাগে আ*স*ক্ত হয়ে পরে। তখন নিজ থেকেই ড্রা*গ নিতো। আবার খাবারের মধ্যে দেয়া হতো। সেজন্য খুব অল্প সময়েই ও অসুস্থ হয়ে প__”

নীরবের চোখদুটো র*ক্তবর্ণ ধারণ করে। স্ত্রী হয়ে কী সুন্দর করে গটগট বলে যাচ্ছে! অথচ দায়ভার কোনো অংশে কম না এই মেয়েটার। নীরবের কপালের রগ টনটন করছে। রাগে সজোরে প্রীতির গালে চ’ড় দিল, সাথে সাথে বাম হাত দিয়ে অপর গালে। দাঁত কটমট করে বলল নীরব,

-” লজ্জা করছে না তোমার? যে মানুষটা তোমাকে পা*গলের মতো ভালোবাসতো। তার ক্ষতি চোখের সামনে দেখেও চুপ ছিলে। নীরব সম্মতি দিতে।”

থা*প্প*ড়ে টাল সামলাতে না পেরে প্রীতি দু’কদম পিছিয়ে যায়। ঠোঁট কে*টে লাল তরল গড়িয়ে পরছে। ব্যথায় কপাল কুঁচকে এল। নীহারিকার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ধপ করে বসে পড়লেন।

এরমধ্যে পকেটে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট থাকায় কেঁপে উঠল। ইমার্জেন্সি ফোন হতে পারে ভেবে নীরব দ্রুত ফোন বের করে। এতক্ষণে পুলিশ ফোর্স খান বাড়িতে পৌঁছে গেছে। সেই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ কল হতে পারে। নীরব দুই আঙুলে কপালের ঘামটুকু ছুঁড়ে লেডি কনস্টেবলকে নির্দেশ দিল,

-” ওকে পিকআপে তুলুন। জলদি করুন। আমাকে এক্ষুনি আর্জেন্ট যেতে হবে।”

এই বলে নীরব বাইরে বেরিয়ে এসে কল তুলল। ওসি অদূরে দরজা বরাবর কলের পুতুলের মতোন দাঁড়িয়ে।

নীহারিকা বসে চেঁচিয়ে উঠলেন,

-” একে এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে সরাও। কালনাগিনী একটা। আমার ছেলেটাকে শেষ করেছে।”

প্রত্যাশার শরীর উইক লাগছে। কাল রাত থেকে এখন অবধি একটা দানাও কাঁটা হয়নি। ইচ্ছে সেভ আছে আপাতত সব স্বাভাবিক আছে দেখেই পেটের ভেতর ক্ষিধেয় মোচড় দিল। এসব কাহিনী আর ভালো লাগছিল না। প্রীতির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করল— আরেব্বাস এই অপ্রীতির তো দেখছি কই মাছের জান। এএসপি সাহেবের হাতে দাবাং মার্কা তিন তিনটে চ’ড় খেয়েও কেমন দিব্য দাঁড়িয়ে আছে। আমি হলে তো একটা চ*ড়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলব।

ফাজিল মহিলা একটা। মনেমনে বলে মাথা ঝাড়া দিল। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুঁকিয়ে পেটের দিকে তাকাল। কাল থেকে খাওয়া হয়নি। নিজের জন্য না হলেও পুচকো-টার জন্য কিছু খাওয়া জরুরী। যাতে করে গায়ে একটু বল পাওয়া যায়। ওপাশে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে ফ্রুটস ঝুড়ি থেকে একটা আপেল হাতে তুলল। চেয়ার টেনে বসে ছুরিটা নিয়ে এক টুকরো আপেল কেটে মুখে পুড়ল।

এদিকে লেডি কনস্টেবল প্রীতির হাতে হাতকড়া পড়াতে এগিয়ে আসে। প্রীতি তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে যায়। সার্থকের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভাইয়া কিছু কর। আমি..যাব না থানায়। ইম্পসিবল।”

সার্থক বোঝানোর সুরে বলল,

-” প্রীতি আমি তোর জামিনের ব্যবস্থা করব। তুই এখন ওনাদের সাথে যা। আমি নীরবকে বুঝিয়ে বলব।”

প্রীতি পেছাতে থাকে। তিনটা কেস হয়েছে। তারমধ্যে দুটোই প্রত্যাশাকে নিয়ে। প্রীতির নজর গেল চেয়ারে বসে থাকা প্রত্যাশার দিকে। এই মেয়েটাকে শুরু থেকেই সহ্য হয় না। আজ যেন আরো হলো না। মনে হলো যা হচ্ছে সব এরজন্য। এরজন্যই জেলে যেতে হচ্ছে।

প্রত্যাশা হাতের ছু*রি নামিয়ে রাখল। ধূর! ভালো লাগছে না। এক টুকরো কোনো মতো গিলেছে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। এরমধ্যে প্রীতি অবাক কান্ড করে বসল। প্রত্যাশা অল্প দূরত্বে ছিলো। আচমকা ছুটে গিয়ে ছু*রি হাতে নিল। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রত্যাশার গলায় ঠেকাল। প্রত্যাশা হকচকাল। রাগে ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে প্রীতি বলল,

-” জেলের অন্ধকার রুমে আমি থাকব। আর তুমি আরামে থাকবে তা কখনো হতে দেয়া যায়? উঁহু যায় না। তোমাকে এখন পর্যন্ত কোনো শা*স্তিই দিতে পারিনি। বরং তোমার জন্যই আজ আমার এই পরিণতি।”

প্রত্যাশা ভ’য় পেল না। চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মনে মনে বলল—‘বাবাগো এক টুকরো আপেলই দেখছি জানের কাল হয়ে দাঁড়াল।’ পরপর প্রীতির দিকে মুখটা বাঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-” আরে আমি না তোমার বোন হই। তাহলে এমন সতীনের মতোন আচরণ করছো কেনো?”

এই মেয়ে এখন বাড়তি কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাইছে। তা সুচতুর প্রীতি ঠিক ধরে ফেলল। তাই উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। প্রত্যাশার ডান হাতটা পেছনে শক্ত করে মুচড়ে ধরা। প্রত্যাশা ঝটপট বাম দিয়ে ছুড়ি ধরা প্রীতির হাত ধরল। কিন্তু প্রীতির শক্তির কাছে প্রত্যাশার শক্তি কিছুই না। একেতে দূর্বল শরীর, তারউপর না খেয়ে আছে। প্রত্যাশার মাথা তখন থেকেই ঘুরছিল।

-‘লেডি কনস্টেবল দু’টো হা করে দেখছে কী? দু’টো মিলে একজনের সাথে যদি না পারে। তাহলে কীসের পুলিশ? আরে বাংলাদেশের পুলিশ। এদের নাকের ডগা দিয়ে আসামী পালাবে, অপরাধ করবে। আর এরা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে।’ এই ভেবে প্রত্যাশার প্রচন্ড রাগ হলো।

নীহারিকা,শর্মিলা আর্তনাদ করে উঠলেন। নীলাশার ফোন আসায় রুমে সে।

-” প্রীতি পা*গলামি করিস না।”

এই বলে সার্থক এগিয়ে যেতে নেয়। প্রীতি শক্ত কণ্ঠে বলল,

-” ওখানেই থাম ভাইয়া। এক পা এগোলে সাথে সাথেই প্রত্যাশাকে শেষ করে দিবো। তুই আমাকে ভালো করেই জানিস আমি নিজেকে সেফ করার জন্য ক্যারাটে থেকে ফাইট সবটাই আয়ত্ত করেছিলাম। আমি অদক্ষ হাতে ছু*রি চালাব না। আমার একটা টানই যথেষ্ট। তবে প্রত্যাশাকে কিছু কথা বলা জরুরী।”

কথা শেষ করে ভেতরে পা রাখতেই থমকে গেল নীরব। প্রীতির সব কথাই তার কানে গেল। রাগে মাথায় খু*ন চাপল ওর। মনে হচ্ছে তখন শুট করে দিলেই ভালো হতো। অবশ্য আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অপরাধ না থাকলে তাইই করতো। নীরব ক’কদম এগিয়ে চোয়াল শক্ত করে বজ্রকণ্ঠে স্রেফ বলল,

-” প্রীতি, লেট গো অফ প্রত্যাশা। আই উইল কাউন্ট টু থ্রি। ইফ ইউ ডোন্ট সারেন্ডার, আই উইল হ্যাভ নো চয়েস বাট টু শুট।”

প্রীতি তাকিয়ে দেখে নীরবের রিভলবার তার দিকে তাক করা। হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল প্রীতি। হাসি থামিয়ে চোখ কুঁচকে বিদ্রূপ ভরা স্বরে বলল,

-” করো শুট। তবে মনে রেখো যদি হাতটা কেঁপে সামান্য এদিক-সেদিক হয়, উনিশ-কুড়ির হেরফেরেই__”

থেমে একপলকে প্রত্যাশার মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাকাল। প্রত্যাশা ওর সামনে, প্রীতি পেছনে। পরক্ষনেই বলল,

-” তোমার বউয়েরই প্রাণ যাবে। মনে রেখো প্রীতির কোনো পিছুটান নেই। ম”রারও ভয় নেই। তাই শুট করার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। জানো নীরব, আমি সবসময় একটা কথা বলতাম; যেদিন আমার ভালোবাসা থামবে, সেদিন তোমার নিঃশ্বাসও বন্ধ হবে।‌ আজ মনে হয় সেই দিন এসে গেছে। উঁহু, তোমাকে কিছু করব না। তোমার প্রাণ তো এখন তোমার বউ। সেই প্রাণটাই যদি না থাকে, তবে কেমন লাগে বুঝবে। আর তোমার দেয়া থাপ্পড় গুলো হজম করা প্রীতির জন্য খুব সহজ নয়। এই মেয়ের জন্য আমাকে থাপ্পড় খেতে হয়েছে। যাকে কেউ কখনো ভুলেও ফুলের টোকা দেয়নি। সব মিলিয়ে এখন যা হবে সেটা প্রত্যাশার প্রাপ্য।”

নীরব দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-” তুমি একটা সাইকো?”

প্রীতি হেসে উত্তর দিল,

-” হয়তো। তবে তোমারই জন্য।”

ঘৃ*ণায় একদলা থুতু ছুড়ে দিল নীরব। সার্থক অসহায় গলায় বলে উঠল,

-” প্রীতি, পাগলামি করিস না। প্রত্যাশাকে ছেড়ে দে।”

প্রীতি ঠান্ডা স্বরে বলল,

-” স্যরি ভাইয়া।”

পরপরই গুলির শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। সবাই চোখ খিচে বুঁজে ফেলে। প্রত্যাশা থমকে গেল। কেঁপে উঠল সমস্ত শরীর। প্রত্যাশার চেয়ে প্রীতির হাইট বেশি। নীরবের নিশানা গিয়ে ঠিক লাগল। প্রীতির কাঁধ থেকে দেড় ইঞ্চি নিচ থেকে টগবগিয়ে লাল তরল উথলে পড়ছে। ছুরি ধরা প্রীতির ডান হাতটা কেঁপে উঠল। প্রত্যাশা তৎক্ষণাৎ নিজের বাম হাত দিয়ে ছুরিটা আঁকড়ে ধরে। প্রীতি পরে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। প্রত্যাশা ছুরি ধরেই প্রীতিকে পিছন দিকে ধাক্কা দেয়। ছুরিটা ধারাল থাকায় প্রত্যাশার আঙুলের পাতলা নরম চামড়া কে*টে র*ক্ত ঝরতে থাকে। প্রীতির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পেছনে পরে যেতে নেয় ও। সার্থক এগিয়ে প্রীতিকে ধরে। বোনকে ধরতেই র*ক্তে সাদা শার্ট মেখে যায়। নীরব এগিয়ে আসতেই ধুকপুক বুক নিয়ে প্রত্যাশা সামনে এসে দাঁড়ায়। এত র*ক্ত দেখে মাথা ঘুরতে থাকে। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা নীরবের বুকের উপর মাথা দিয়ে জাপটে ধরে। জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। নীরব একটা হাত প্রত্যাশার গালে রেখে বলল,

-” প্রত্যাশা ডোন্ট প্যানিক। কিচ্ছু হয়নি।”

প্রত্যাশা দু’হাতে নীরবের পিঠের কাছের শার্ট আঁকড়ে ধরল। চোখ খিচে বুঁজে রইল। নীরব আলগোছে প্রত্যাশার বাম হাতটা টেনে নিল। র*ক্ত ঝরছে। পকেট হাতড়ে রোমাল বের করে চেপে ধরে নীরব। সাদা রোমাল‌ র*ক্তে ভিজে লাল হয়ে চপচপ করছে।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫১|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

মূহুর্তেই টকটকে লাল র*ক্তে সাদা টাইলস ভেসে যেতে লাগল। প্রীতির বাহু থেকে গলগল করে র*ক্ত ছিটকে বেরোচ্ছে। সার্থক ফ্লোরে বসে দু’হাত দিয়ে বোনকে আঁকড়ে ধরল। তার সাদা শার্ট বোনের র*ক্তে ভিজে চপচপে হয়ে গেল। কাঁপা হাতে প্রীতির গালে হাত বুলিয়ে বলল। কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল,

-” প্রীতি বোন আমার কষ্ট হচ্ছে? খুব কষ্ট হচ্ছে, না? ভাইয়া এখানে আছে। তোর পাশে আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি এক্ষুনি তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। একদম কষ্ট পেতে দিবো না। একটু সহ্য কর।”

প্রীতির চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। ঘন পাপড়িগুলো নিভুনিভু হয়ে বুঁজে আসতে চাইছে। ব্যথায় ভেতরটা মুষড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস ভারী হতে হতে থেমে যাচ্ছে যেন। হা করে শ্বাসটুকু টেনে নিতে চাইল। হঠাৎই শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল। বোনের গাল আলতো করে চাপড়ে অস্থির গলায় বলল সার্থক,

-” প্রীতি, প্রীতি তাকা। বোন আমার শোন ভাইয়া আছি তো তোর পাশে।”

এক ঝটকায় বোনের নিস্তেজ শরীরটা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরল সার্থক। চোখের কোল ঘেঁষে দুফোঁটা নোনতা জল গড়িয়ে পড়ল। উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ।

নীরবের বুক থেকে ধীরেধীরে মাথাটা তুলল প্রত্যাশা। ঘাড়টা কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে প্রীতির নিস্তেজ দেহটা দেখেই বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠল। নীরবের একটা হাত এখনো প্রত্যাশার হাতে রোমালটা চেপে ধরে আছে। প্রত্যাশার হাতে রোমালটা সযত্নে পেঁচিয়ে দিল নীরব। অতঃপর পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করল। রিসিভ হতেই কণ্ঠে আদেশ নামিয়ে বলল,

-” এএসপি নীরব মাহবুব স্পিকিং, ইমার্জেন্সি কেস। আই নিড আন অ্যাম্বুলেন্স ইমিডেটলি। লোকেশন…।”

কী থেকে কী হয়ে গেল উপস্থিত সবাই যেন এখনো ধাতস্থ করতে পারছে না। সার্থক পালস রেট চেক করল। চলছে খুব ক্ষীণ। প্রীতি সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। রক্তক্ষরণ থামছেই না। সার্থক বোনের হাতটা নেড়েচেড়ে দেখতে নিল। বুকের ভেতরটা কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে ওর। বোনের হাত ধরে মুখ উঁচিয়ে অসহায় স্বরে বলল,

-” প্লীজ, এক টুকরো সুতি কাপড় দিন। জাস্ট আ পিস।”

যদিও প্রীতির উপর এতক্ষণ ঘৃ*ণা হচ্ছিল। তবুও এহেন দৃশ্যে খারাপ লাগছে। শর্মিলা দ্রুত একটি সুতির ওড়না এগিয়ে দিল। সার্থক বোনের ক্ষ*ত স্থানে চেপে ধরল। বলল,

-” বুলেটটা হাড়ে আটকে গেছে মেবি। কুইকলি, হাসপাতালে নিতে হবে। ওটি রেডি করতে হবে। আমি এক্ষুনি ফোন করে সব ব্যবস্থা করব।”

এই বলে বাম হাত দিয়ে ফোন বের করতে নেয় সার্থক। নীরব থামিয়ে দিল। বলল,

-” স্টপ, তুমি কিছু করার চেষ্টা করো না। সব হবে অফিশিয়ালি। ওকে মেডিকেলে নেয়া হবে।”

সার্থক তড়িৎ বলল,

-” মেডিক্যালে নিলে সময় লাগবে। ওখানে চিকিৎসা ডিলে হয়। এতে ক্ষ*তি হতে পারে। ইমার্জেন্সি বুলেট রিমুভাল না করলে হাতটা ফরএভার ড্যামেজ হওয়ার শঙ্কা থাকে। তারপর বুলেট যদি ধমনিতে লাগে, এক্ষেত্রে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য লাইফ রিস্ক হাই।”

কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল সার্থকের। এক মূহুর্ত থেমে ফের আকুল হয়ে অনুরোধ করল,

-” নীরব অন মাই রিকুয়েস্ট, প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। প্রীতি অনেক আদরের আমার। ছোট থেকেই ও যা চেয়েছে তাইই দেয়া হয়েছে। চাওয়ার সাথে সাথেই ওর আবদার পূরণ করা হয়েছে। ওর জন্য বেস্টটাই দেয়া হয়েছে। কোনো কিছুর জন্য ওকে কষ্ট দেয়া হয়নি। অথচ আমার মনেহয় সবার অগোচরে ও খুব বেশিই কষ্ট পেয়েছে। কষ্টে থেকেছে। প্রীতির ভুলগুলোকে আমি উপেক্ষা করছি না। তবুও একজন ভাই হিসেবে বোনের জন্য এতটুকু চাওয়া অপরাধ নয়; সী নিডস বেস্ট কেয়ার।”

নীরব ঠাণ্ডা কণ্ঠে প্রত্যুত্তরে বলে,

-” সী ইজ আন অ্যাকিউজড। এখন যা হবে, তা আইন দেখবে।”

সার্থক ব্যাকুল চিত্তে বলল,

-” আমি জানি সে ভুল করেছে, কিন্তু চোখের সামনে আমার আদরের বোন কষ্ট পেতে পারে না। আই ওয়ান্ট দ্য বেস্ট ফর হার, প্লীজ।”

নীরব সোজাসুজি বলল,

-” রুলস আর রুলস। নো এক্সকিউজ।”

নীরবের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের ভাষায় কিছু বোঝাতে চাইল প্রত্যাশা। নিঃশব্দে যেন রিকুয়েস্ট রাখল। হঠাৎ নিহারিকা বলে উঠলেন,

-” নীরব আমি চাই না আমার ছেলের হাতে কারো প্রাণ যাক। ওর অপরাধ কম নয়। শাস্তি হোক, তবে মৃ*ত্যু নয়। আজ ওর প্রাণ গেলে কোনো না কোনোদিন ইচ্ছে তোকে ভুল বুঝবে। কারন মানুষ না থাকলে তার করা ভুলও কেমন জানি ঢাকা পরে যায়। তার পা*পের কথা ভুলে তার অসহায়ত্বের কথাই স্মরণে আসে। তাই বলছি, যা করলে ভালো হয় তাই করিস। আর উপরওয়ালা তো আছেনই। যার যার কৃতকর্মের ফল তাকে দিবেন। ইহকালে সাময়িক ছাড় দিলেও পরকালে ঠিকই পাকড়াও করা হবে।”

.

এরমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে পরে। প্রীতির মুখে অক্সিজেন মাস্ক, স্ট্রেচারে নিস্তেজ দেহটা পরে আছে। একটা হাত ঝুলছে। সার্থক সাথে যেতে চাইলে নীরব বাঁধা দেয়। সার্থক হাতজোড় করে বলল,

-” প্লীজ নীরব,অন্তত ওটি পর্যন্ত আমাকে এলাউ করো। আমি থাকতে চাই।”

নীরব সোজাসাপ্টা বলল,

-” নো ওয়ে।”

তারপর ড্রাইভারকে যেতে ইশারা করতেই অ্যাম্বুলেন্স শব্দ তুলে ছুটতে থাকে। এক অসহায় ভাই ভেজা চোখে তাকিয়ে রইল যতদূর দেখা গেল। জীবনে এর থেকে বেশি কখনো নিজেকে অসহায় লাগেনি সার্থকের। বোনের র*ক্তে মেখে আছে শার্ট, হাতজোড়া। র*ক্তে মাখা হাতজোড়া সামনে তুলল। চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল। মনে হচ্ছে বোনকে এই র*ক্তে মাখা দু’টো হাতেই একটু আদর করতে পারলে অশান্ত মনটা একটু শান্ত হতো।

অসহায় হৃদয় নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন রাখল—আর কী কখনো বোনের সাথে বসে একসাথে নাস্তা করা হবে না? ব্রো বলে ডাকটা কী আর শোনা যাবে না?

গলার কাছে নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে সার্থকের। প্রীতির বলা একটা কথা কানে বাজছে,

-” ভাইয়া তুই খুব মহান, আমি আবার তোর মতো মহান নই।”

সার্থক হাঁটু ভেঙে ধপ করে বসে পড়ল। হাঁটুদ্বয় মাটিতে ঠেকল। মুখটা উঁচিয়ে আকাশের দিকে একপল তাকাল। সমস্ত প্রার্থণা মহান রবের কাছে রাখল। পরপর একহাতে কিছু চুল মুষ্টিবদ্ধ করে দৃষ্টি নিচু করল। নিঃশব্দে বুকের ভেতর থেকে আর্তনাদ, অসহায়ত্ব বেরিয়ে এল,

-” প্রীতি, একটু মহান যদি তুই হওয়ার চেষ্টাটুকু করতিস না, তাহলে আর কিছু না হলেও অন্তত সুখী হতিস তুই। আফসোস সুখ যেন তোর ভাগ্যেই নেই। সব থেকেও শুণ্য তুই। অবশ্য তোর একার দোষ না। তোকে বোঝানো দূর, তোকে উস্কানো হয়েছে। খারাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ভাই হিসেবে লজ্জিত আমি। নিজের বোনকে বোঝাতে পারিনি, সঠিক পথে আনার চেষ্টাটুকু করা হয়নি। এটা শুধুই আমার ব্যর্থতা নয়, এটা আমার অন্যায়।”

অ্যাম্বুলেন্সে ওসিসহ লেডি কনস্টেবলও আছে। নীরব বাইকে বসতে বসতে ফোন করল।‌ সময় ব্যয় অন্যান্য ঝামেলা ছাড়াই ট্রিটমেন্ট দেয়ার কথা বলা হয়। ওদিকে বারবার ফোন আসছে। নীরব ছুটল সেখানে।

___________

এক পলকের এক দেখাতেই প্রীতির মন ধস করে সেদিন পিছলে পড়ে। নীরবের দাঁড়ানোর ভঙ্গি, চোখেমুখে সাহসী নির্লিপ্ত ভাব, অতি সুদর্শন একজন যুবকের এসব কিছু প্রীতিকে অদ্ভুতভাবে টেনে নেয়। ধীরেধীরে সেই টান আরও প্রবল হয়। শেষ পর্যন্ত নিজের অহংকার ভেঙে, জেদি আর দাম্ভিক প্রীতিই নিজ থেকে প্রপোজ করে নীরবকে। কিন্তু নীরব সরাসরি রিজেক্ট করে। ভার্সিটির আ*গু*ণ সুন্দরী, ওভার স্মার্ট, কথা বলার সময় দাম্ভিকতা, অহংকার চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরে। দিনে কয়টা প্রপোজাল পায় হিসেব নেই। কেউ তাকে রিজেক্ট করতে পারে দাম্ভিক প্রীতি তা ভাবতেই পারেনি। নীরবের বন্ধুরা বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করে, মজা নেয়, যা প্রীতির আত্মসম্মানে গভীর আ”ঘাত হানে। রিজেকশন প্রীতি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। একদিন এক বান্ধবী ঠাট্টার ছলে বলে ওঠে,

-” নীরবকে ভুলে যা দোস্ত, ও খুব রিজার্ভ টাইপ। তবে ওর জমজ ভাই নীবিড় কিন্তু আলাদা। একটা চান্স নিতে পারিস। দেখতে তো একই, তাহলে আর প্রব্লেম কী?”

প্রীতি কথাটা মনে গেঁথে ফেলে। সিদ্ধান্ত নেয় নীরবের স্ট্যান্ড ইন হিসেবে তার ভাই নীবিড়কে টার্গেট করবে। দেখতে তো একই। ফিলিংস সৃষ্টি হতেও পারে। সেটা না হলেও ব্যাপার না। প্রেমে ফেলে ছুঁড়ে দেবে। যাতে একটু হলেও নীরব বুঝতে পারে প্রীতি কী জিনিস! তাকে রিজেক্ট করেছিল না, তার ভাইকে প্রেমের জলে হাবুডুবু খাইয়ে ছেড়ে দিবে। কিছুটা হলেও নীরবের রিজেকশনের শাস্তি দেয়া যাবে।

এরপর থেকে ক্যাম্পাসে নীবিড়কে দেখলে আলতো চাহনি, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানো, ঠোঁটে হালকা হাসি এসব দিয়ে ধীরেধীরে প্রভাবিত করতে থাকে প্রীতি। দুদিন পরেই সরাসরি নীরবের সামনে দাঁড়িয়ে ‘স্যরি’ বলে জানায় প্রীতি— আসলে তার পছন্দ নীরব নয় নীবিড়। জমজ বলে ভুল করে প্রপোজ করেছে।

এদিকে ধীরেধীরে প্রীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে নীবিড়। প্রীতির গ্রিন সিগন্যালে সাড়া দিয়ে দু’জনে রিলেশনে যায়। ক-মাসের মধ্যেই প্রীতির মা তানিয়ার কানে আসে মেয়ের প্রেমের খবর। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, নীরব আর নীবিড় হচ্ছে মাহবুব সিদ্দিকী ও নীহারিকার ছেলে। এটা জেনে তার বহু পুরোনো ক্ষত আবারও জেগে ওঠে। তিনি বিশ্বাস করেন, তার জমজ বোনের মৃ*ত্যুর জন্য দায়ী মাহবুব সিদ্দিকী আর নীহারিকা। মনে করেন, ওরাই আ*গুন লাগিয়ে তার বোনকে মে*রেছিলো। সেই দিনের স্মৃতি আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বোনের অকাল মৃ*ত্যুতে আজও তার চোখের জল শুকোয়নি।

এই আক্রোশ থেকেই তানিয়া পরিকল্পনা করেন– মেয়ে যদি নীবিড়কে বিয়ে করে ওই পরিবারে ঢোকে, তাহলে প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ আসবে। ওই পরিবার কীভাবে ঘুরে দাঁড়াল তানিয়ার বোধগম্য হয় না। তাদের সুখশান্তি তানিয়ার সহ্য হলো না। প্রীতির সাথে নীবিড়ের বিয়ের কথা বলতেই প্রীতি সাথে সাথে নাকোচ করে। প্রীতি বলে— নীবিড়কে বিয়ে করা অসম্ভব মা। নীবিড়ের প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই। ওরা দু’জন দেখতে এক হলেও, কথা বলা, চলার ভঙি, এটিটিউড সব ভিন্ন। নীরবের সবকিছুই আমাকে মুগ্ধ করে। নীবিড়ের মাঝে মুগ্ধতা খুঁজতে গিয়েও ব্যর্থ হই। যার প্রতি ফিলিংস নেই তাকে বিয়ে করা প্রীতির জন্য ইম্পসিবল।

ভালো স্টুডেন্ট, দেখতেও সুদর্শন। এমন একটা ছেলে মেয়ের জামাই হলে মন্দ হয় না। এদিকে উদ্দেশ্য ওদের জমজ সন্তানকে আলাদা করা। একজন সন্তানকে আলাদা করলে মাহবুব-নীহারিকা বুঝবে আরেক জনকে আঁকড়ে ধরা কতটা কষ্টের। একসাথে সবই হবে। এইভেবে মেয়েকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। বোঝাতে থাকেন— বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

মায়ের বোঝানোতে একসময় প্রীতি সত্যি সত্যিই নীবিড়কে স্ট্যান্ড ইন হিসেবে নিতে চায়। যদি বিয়ের পর ঠিক হয়ে যায়। তাছাড়া নীরব আসলেই রিজার্ভ টাইপ। এরকম না হলে তার মতো সুন্দরী মেয়েকে রিজেক্ট করে।

এদিকে প্রীতির মা নীবিড়কে ডেকে বিয়ের কথা বলেন। স্টুডেন্ট, কিছু করে না। তাই এখনই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয় নীবিড়। তানিয়া বলেন– প্রীতিকে নেয়ার জন্য তাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে লাইন পরে গেছে। কেউ কেউ খুব জোর করছে। এক আত্মীয়ের ছেলে বুয়েট থেকে পড়াশোনা কমপ্লিট করেছে ইউএসএ থাকে। তারা এক প্রকার প্রেশার দিচ্ছে। নাও করতে পারছি না। প্রীতি যেহেতু তোমাকে পছন্দ করে, তাই।

ভালোবাসায় উন্মাদ নীবিড় বাবা-মাকে ম্যানেজ করে আনে। কিন্তু ঘটনা উল্টো ঘটল। প্রীতির মা’কে দেখেই নীহারিকা শকড্ খায়। কোনোকিছু না দেখেই উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। ডিসিশন ফাইনাল— এই বাড়ির মেয়েকে মানতে পারবেন না।

নীরবের রিজেক্ট, নীহারিকার এমন কথা সবকিছু মিলিয়ে প্রীতির জেদ হলো এবার। এই পরিবারে আছে টা কী? তাকে রিজেক্ট করছে। প্রীতি এবারে নিজেই জিদ হিসেবে নেয়— নীবিড়কে বিয়ে করে ছাড়বেই।

বিয়ে ঠিকই হলো। তবে মায়ের কথার অমান্য করে নীবিড়কে বাড়ি ছাড়তে হলো। তানিয়ার প্ল্যানে নীহারিকা বুড়িগঙ্গার দূষিত পানি ঢেলে দেয়। তানিয়া মেয়েকে কান পড়া দিলেন, ওই নীহারিকার জিদ ভাঙতে হবে। প্রীতি ও বাড়ির চৌকাঠ মারিয়ে একদিন প্রবেশ করবেই। প্রীতিকে নীবিড়কে মানিয়ে নিতে বলেন। নীবিড় হলে থেকে টিউশনি করে পড়াশোনা চালাতে থাকে। প্রীতি নিজ বাড়িতে থাকে। বিয়ে হলেও কাছে যেতে চাইলে প্রীতি শরীর খারাপ লাগছে, অসুস্থ এটাসেটা অজুহাত দিতো। তবে পরবর্তীতে প্রীতির অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাছে আসা হতো। প্রীতির কাছে স্পর্শগুলো সুখকর লাগতো না। অসহ্য লাগতো।

তারপর ইচ্ছের আসার বার্তা পায়। প্রীতি অ্যাবরশন করতে চায়। তানিয়া বাঁধা দেয়। বাচ্চাটা থাকলে ওই বাড়ি যাওয়া সহজ হবে।

এরপর অনার্স কমপ্লিট করেই নীবিড় কর্পোরেট জবে ঢোকে। এক বছর বয়সী মেয়েসহ প্রীতিকে বাসায় নেয়। প্রীতি মন থেকে নীবিড়কে মানতে পারেনি। তবুও কিছুটা অভিনয় করে একসাথে থাকে। প্রীতি মেয়ের প্রতি উদাসীন, নীবিড়কেও এড়িয়ে যেতে একটা প্রজেক্টে ঢোকে। সারাদিন অফিশিয়াল কাজে ডুবিয়ে রাখতে চায় নিজেকে। নীবিড় ভাবে প্রীতি জব করে তাই অন্যান্য মেয়েদের থেকে একটু আলাদা। সংসারে সময় দিতে পারে না। আয়া রাখা হয় ইচ্ছের জন্য। নীবিড় মেয়েকে সময় দেয়। অফিশিয়াল কাজ শেষ করেই বাসায় চলে আসে। ইচ্ছে বড় হতে থাকে, পাপার নেওটা হয় সে। নীবিড়ও মেয়েকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে।

এদিকে প্রীতি নীবিড়কে মেনে নিতে চেয়েও পারে না। তার মন আজও যেন নীরবে পরে আছে। মনেহয়— কারো পূর্ণতা তার মতো কাউকে দিয়েও হয় না। আসলে তার পূর্ণতা তো কেবল সে নিজেই হয়, অন্যকেউ নয়।

নীবিড়ও ধীরেধীরে উপলব্ধি করে প্রীতির মন তার উপর নেই। কিছু একটা সমস্যা আছে। তারপরেও মেয়েটাকে নিয়ে দিন চলছিল। ইচ্ছের বয়স যখন চার বছর। সেইসময় প্রীতিদের বাড়িতে এসে নীবিড়ের তানিয়ার উপর সন্দেহ হয়। স্টোররুমে কিছু একটা আছে। পরপর দু’দিন রাতে তানিয়াকে বের হতে দেখা যায়। নীবিড় ফলো করছে এটা দেখেই তানিয়া তাকে সরানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তার গোপন খবর আজ পর্যন্ত ঘরের ছেলে-মেয়েকে জানতে দেয়নি। আর এ সন্দেহ করে বসল। তিনদিন থেকেই চট্টগ্রামে নীবিড়দের চলে যেতে হয়। এরমধ্যে কিছুদিন পর তানিয়া ঘুরতে যায় মেয়ের কাছে। সরাসরি কিছু করলে সমস্যা হতে পারে, এদিকে নীরব ট্রেনিংয়ে আছে। মাহবুব পরিবার এখন বেশ ক্ষমতাশালী। ছেলে পুলিশের অফিসার। তাই যা করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। ড্রাগ যাদের ব্যবসা সেই ড্রাগই বানালেন হাতিয়ার। সুকৌশলে খাবারের মাধ্যমে নীবিড়কে দেয়া হয়। তানিয়া মাসখানেক মেয়ের বাসায় থাকেন। প্রীতি একদিন মা’কে দেখে ফেলে। তবে নীবিড়ের প্রতি অনুভূতি না থাকায় কিছুই বলে না। মনেহয় লাইফে নীবিড়ের উপস্থিতি না থাকলেই বোধহয় বেটার হবে।

ছ-সাত মাসের ব্যবধানেই নীবিড় অসুস্থ হয়ে পরে। নীরব ট্রেনিং শেষ করে ভাইয়ের অসুস্থতার কথা শুনে আসে। এদিকে ছোট্ট ইচ্ছেও বাবাকে আগের মতো না পেয়ে ধীরেধীরে ট্রমায় চলে যেতে থাকে। নীবিড়কে হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে ইচ্ছে মানসিক ট্রমায় চলে যায়। নীরবকে ফাস্ট দেখে ইচ্ছে পাপা ডেকে ওঠে। তারপর একদিন ডক্টর বলেন— জমজ হওয়ার জন্য ইচ্ছে যেহেতু আপনাকে পাপা ভাবে। আপনার সংস্পর্শে থাকলে হাসে,কথা বলে। তাই কয়েকমাস এভাবেই চলুন। এটাও একটা থেরাপি।

প্রীতি পাপীষ্ঠ মন তো সেই নীরবেই আঁটকে আছে। তারপর নীরবের সাথে প্রত্যাশাকে সহ্য হতো না। সেই থেকে পাপের পরিমাণ বাড়তে লাগল। তবে পা*পে যে ধ্বং*স অনিবার্য। তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আজ স্বয়ং প্রীতি। চাইলেই লাইফটা সুন্দর করে সাজানো যেতো।

____________

অভিযান শুরুর পূর্বে নিরাপত্তাজনিত কারণ, এবং সকল প্রকার তথ্য আদান-প্রদান বন্ধ করতে খান বাড়ির বিদ্যুৎসহ সকল নেটওয়ার্ক সংযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে বস্তা ভর্তি টাকা, স্টোররুমের গোপন সিক্রেট কক্ষ থেকে ড্রাগও পাওয়া যায়। এখনো তল্লাশি চলছে।

তানিয়া হুইলচেয়ারে মাথা নত করে বসে। হাতে হ্যান্ডকাফ। দুজন লেডি কনস্টেবল পাশেই ঘিরে দাঁড়িয়ে। নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় কোনো আপডেটই আর পায়নি তানিয়া। এরমধ্যে আচমকা পুলিশ ফোর্সের আগমনে ভড়কে যান। বাড়ির গার্ডরা পুলিশের জিম্মায়। বাইরে কোনো খবরও পৌঁছানোর সময়টুকু পাওয়া যায়নি। লহমায় সব যেন হাতের বাইরে চলে গেছে।

গটগট পা ফেলে গম্ভীর মুখে ভেতরে ঢুকল নীরব। তানভীর তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকল। নীরব সোজা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,

-” ইচ্ছে কোথায়?”

তানভীর দ্রুত জবাব দিল,

-” স্যার, ইচ্ছেকে উদ্ধার করা হয়েছে। উপরে আছে। ওর সাথে ওকে দেখার আয়াটা আছে। আর একজন লেডি কনস্টেবলকেও রাখা হয়েছে নজরদারির জন্য।”

নীরব মাথা নাড়ল। ঠাণ্ডা গলায় বলল,

-” গুড।”

সামনে এগোতেই তানভীরের কথায় থেমে যায় নীরব। কপালে ভাঁজ ফেলে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,

-” স্যার, আপনার ইউনিফর্মে ব্লাড। আ”ঘা”ত পেয়েছেন নাকি?”

পিঠের দিক ইশারা করতেই নীরব এক সেকেন্ডে বুঝে নিল। প্রত্যাশার হাতের র*ক্ত লেগে আছে। সংক্ষিপ্ত এক শব্দে উত্তর দিল নীরব,

-” না।”

বাড়তি শব্দ উচ্চারণ না করে এগিয়ে এসে তানিয়ার সামনে গিয়ে সোফায় বসল নীরব। পায়ের উপর পা-টা তুলে আরাম করে বসল। ভ্রুতে তির্যক ভাঁজ, ঠোঁটে বাঁকা ব্যঙ্গের রেখা। বলল স্পষ্ট গলায়,

-” মিসেস খান গেম ওভার। অনেক খেলেছেন ছলচাতুরি, অনেক জমিয়েছেন পাপের হিসাব। এবার আপনার জন্য আলাদা আসন রেডি জেলের চার দেয়ালের ভেতর। আত্মীয়স্বজনের খাতিরে একটু বাড়তি যত্নের ব্যবস্থা অবশ্য করিয়ে দেব। চিন্তা নেই।”

তানিয়া ধীরে মাথা তুলল। চোখে আ*গু*নের দ্যুতি। অথচ শীতল কণ্ঠে বলল,

-” খানদের খেল কোনোদিন শেষ হয় না, অফিসার। শুধু সময়ের সাথে সাথে হাতবদল হয়।”

নীরব ঠাণ্ডা হেসে জবাব দিল,

-” আপনি ভুল করছেন। এই খেলাটা আমি শেষ করতে এসেছি। যত বড় সিন্ডিকেটই হোক, ছায়ায় লুকিয়ে থাকা মাথাটা কে”টে না ফেললে খেলা সত্যিই খতম হয় না। আর আজ সেটাই হতে চলেছে।”

তানিয়া দাঁত কটমট করে চুপ হয়ে নিজেকে সামলে নেয়। নীরব চোয়াল শক্ত করে ফের বলল,

-” আমার নিরপরাধ, নির্দোষ বাবাকে মিথ্যে আসামী বানিয়ে জেল খাটানো, আমার মা’কে অসহায় বানিয়ে কষ্টে রাখার জন্য, আমার নিরীহ ভাইটার ফুলের মতো জীবনটা ধ্বং*স করার শাস্তি দেয়ার জন্য ব্যাকুল আমি। সবের প্রতিশোধ আমি নিতে চাই। এতদিন অনেক ধৈর্য্য দেখিয়েছি। আর অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত দিনটা আজ এসেছে। খান সিন্ডিকেটের পা*পের হিসাব আমি একেবারেই শেষ করব। ধৈর্যের ফল মিঠা হয়; আজ সেটা প্রমাণ হবে।”

কণ্ঠে অহংকারের নিয়ে বলে উঠল তানিয়া,

-” তুমি হয়তো ভাবছো সবটা নিজের মতো করে শেষ করতে পারবে। কিন্তু ভুল করছো অফিসার। খানদের ক্ষমতা কখনো পুরোপুরি শেষ হয় না। যারা ছায়ায় লুকায়, তাদের কৌশল আর ক্ষমতা সময়ের সাথে বদলায়।”

নীরব চোখ সরিয়ে না নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,

-” আপনাদের ছায়া যত গভীরই হোক, আলো ঢুকিয়ে সেই গভীরতম কোণেও ধরা হবে। আর আজ সেই আলোই আপনাকে, আপনার মেয়েকে শেষের দিকে ঠেলে দেবে।”

মেয়ের কথা শুনে কিছুটা আঁতকে উঠল তানিয়া। বললেন,

-” প্রীতি…আমার মেয়ে কই?”

-” মেয়ে বেঁচে গেলে, জেলে দু’জনের একবেলা সাক্ষাৎ এর ব্যবস্থা করে দিবো।”

তানিয়া বারবার প্রীতির কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে। নীরব বলল,

-” মেয়েকে ন’ষ্ট করার পিছনে এইট্টি পার্সেন্ট হাত আপনার। মেয়ের এই পরিণতির জন্য আপনি দায়ী মিসেস খান।”

এরমধ্যে লেডি কনস্টেবলের সাথে ইচ্ছে নেমে আসতে থাকে। সিঁড়ির নিচের ধাপে দাঁড়িয়েই উচ্চ স্বরে ডেকে উঠল,

-” পাপা।”

নীরব এগিয়ে ইচ্ছের সামনে উবু হয়ে দু’হাতে মুখটা আঁজলা করে ধরল। কপালে চুমু খেতে খেতে বলল,

-” ইচ্ছে সোনা, তুমি ঠিক আছো তো?”

-” পাপা তুমি এসেছো। জানো আমার খুব ভয় করছিলো। বাজে লোক আমার হাতে ব্যথা দিয়েছে।”

ইনজেকশন পুশ করার স্থান দেখিয়ে বলে ইচ্ছে। নীরব আদুরে গলায় বলল,

-” বাজে লোকদের শাস্তি দেয়া হবে। এই তো আমি এসে গেছি। আর ভ’য় নেই সোনামণি।”

আশেপাশে পুলিশ দেখে ইচ্ছে ভয়ে সিটকে রইল। বলল,

-” এত লোক কেনো? আর নানুর কাছেও ওরা। কেনো পাপা?”

নীরব উত্তর দেয়ার আগেই একজন কনস্টেবল এসে বলল,

-” স্যার, সাংবাদিকরা এসে পড়েছে। বাইরে প্রবেশের জন্য হট্টগোল করছে। তল্লাশি, উদ্ধার প্রায় শেষ, স্যার।”

নীরব কপালে ভাঁজ ফেলে ঠাণ্ডা চোখে তাকাল। বলল,

-” ডোন্ট ওয়ারি, সবকিছুর উত্তর আছে আমাদের। সাংবাদিকরা ভিড় করুক। আমরা করব আমাদের কাজ। ক্রিমিনাল কে পুলিশ ভ্যানে তোলো।”

নীরব ইচ্ছের হাত ধরে এগোতে লাগল। বাইরে আসতে না আসতেই সাংবাদিকরা ভনভন করে মাছির মত ঘিরে ধরল। ইচ্ছে ভয়ে নীরবকে আঁকড়ে ধরল। নীরব এক ঝটকায় ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। মৃদু হেসে বলল,

-” ভ’য় নেই মামণি, আমি আছি তো।”

সাংবাদিকরা একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো। কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নও উঠে এল। নীরব কিছু এড়িয়ে যায়। কিছু প্রশ্নের জবাব অল্প কথায় দেয়। পাশ থেকে এক সাংবাদিক চড়া কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

-” স্যার, এত বড় অট্টালিকা, কোটি কোটি টাকা সব অবৈধ। এই বিশাল সম্পত্তি কী হবে? সাধারণ মানুষ কি ভাবছে, এর কোনো হিসাব থাকবে না?”

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শব্দগুলো সাজিয়ে নিল। দৃঢ় গলায় বলল নীরব,

-” এই টাকা, এই সম্পত্তি যেটা বছরের পর বছর অবৈধ পথে জমেছে, সব সরকারের নিলামে উঠবে। দেশ এবং জনগণই এর অধিকারী। আর যারা ভাবছে, ক্ষমতার ছায়ায় সব কে*টে যাবে। তাদের জন্য বার্তা, কোনো কোণে নিরাপদ আশ্রয় নেই। আলো সবসময় অন্ধকারের কোণে পৌঁছায়। দ্রুত সুষ্ঠু বিচার করা হবে, অপরাধী সাজা ভোগ করবে।”

ভিড় কাটিয়ে নীরব বেরিয়ে এল। ইচ্ছে বাইকে বসে জিজ্ঞেস করল,

-” মাম্মা কই?”

নীরব এড়িয়ে গেল। উত্তরে বলল,

-” বাসায় চলো সোনা। তোমার দিদুন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর বাসায় তোমার জন্য অনেক চকলেট রেখেছি। নিবে না?”

-” হুম, নিবো তো।”

.
.

এতক্ষণে টিভি, সোশ্যাল মিডিয়ায় নিউজে সয়লাব। টিভির স্ক্রিনে নীরবের সাথে ইচ্ছেকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন নীহারিকা। যাক, মেয়েটা সুস্থ আছে। তবে দুশ্চিন্তা হচ্ছে, মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে কী উত্তর দিবে? কীভাবে বুঝিয়ে রাখবে? যদিও ইচ্ছের অনেকটা অভ্যাস আছেই মা’কে ছাড়া থাকার। তবুও তো কখনো না কখনো মায়ের কাছে যেতে চাইবে।

প্রত্যাশা শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে ভেজা চুল মুছে আঁচড়াতে থাকে। ঠিক তক্ষুনি ড্রয়িংরুমে হৈচৈ শোনা গেল। এগিয়ে গিয়ে ইচ্ছেকে দেখেই ঠোঁটে হাসি ফুটল। ডেকে উঠল,

-” ইচ্ছে?”

ইচ্ছে এগিয়ে আসতেই প্রত্যাশা হাঁটু মুড়ে বসে দু’হাতে জাপটে ধরল। ইচ্ছের মাথাটা প্রত্যাশার কাঁধে। প্রত্যাশা বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। অপরাধীর সুরে বলল,

-” মামণি খুব পঁচা। তোমাকে দেখে রাখতে পারিনি। এবারের মতো মামণিকে মাফ করে দাও। তবে প্রমিজ করছি, এরপর থেকে তোমাকে দেখে রাখব। একটুও কষ্ট পেতে দেবো না। আর এ-ও প্রমিজ করছি, তোমাকে এত্ত এত্ত আদর দিবো সোনা।”

ইচ্ছে মাথা তুলে তাকাল,

-” সত্যি?”

ইচ্ছের সারা মুখে চুমু খেয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” একদম সত্যিই। তোমাকে সবসময় কাছেই রাখব। একদম আদর দিয়ে মুড়িয়ে রাখব। পাক্কা প্রমিজ।”

#চলবে