মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৫২+৫৩

0
8

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫২|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

কে*টে গেছে এক সপ্তাহ। ঘড়ির কাঁটা বিকেল পাঁচটার ঘরে। প্রত্যাশা সোফায় বসে। পরনে অফ-হোয়াইট কালারের কুর্তি, ওড়নাটা কাঁধের ডান সাইডে ঝুলে রাখা। ফ্যানের বাতাসে চুলগুলো বারবার উড়ে গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে। সামনে টি-টেবিলে রাখা বাটিতে কিসমিস আর কাজুবাদাম। থেকে থেকে দুই আঙুলে তুলে মুখে দিচ্ছে, আর অন্য হাতে ফোনে বান্ধবীদের সাথে মেসেজ চালাচালি করছে।

ওপাশে ইচ্ছে আর আনিশা রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি নিয়ে খেলায় মগ্ন। তন্মধ্যে নীলাশা এসে প্রত্যাশার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে বসল। চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” কার সাথে এত কথা বলছিস? নীরব?”

ফোনের স্ক্রিনে দৃষ্টি রেখেই জবাব দেয় প্রত্যাশা,

-” উঁহু! হ্যাপি আর কোয়েলের সাথে গ্রুপে কথা বলছি। আর তোমার দেবরের কথা বলছো? তার তো অফিসে বসে মেসেজ করার ফুরসত থাকে না।”

-” ওহ।” বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরোক্ষণেই নীলাশা শুধিয়ে বলল,

-” কালকে তো রেজাল্ট দিবে, জানিস?”

-” হ্যাঁ।”

বোল থেকে কাজুবাদাম হাতে তুলে মুখে দেয়ার আগে থেমে গেল প্রত্যাশা। বোলের দিকে ইশারা করে বলল,

-” আপু নাও।”

নীলাশা মাথা নেড়ে বলল,

-” না খেতে ইচ্ছে করছে না। তুই খা।”

প্রত্যাশা মুখে পুড়ে ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিল। নীলাশা ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কয়েক মূহুর্ত চুপ থেকে আচমকা ডাকল,

-” প্রত্যাশা”

ডাকটা যেন একটু ভিন্নরকম লাগল। প্রত্যাশা অস্ফুট স্বরে বলল,

-” হুঁ?”

নীলাশা হঠাৎ নরম কণ্ঠে বলে উঠল,

-” তোর সাথে সবসময় মিসবিভেব করার জন্য স্যরি রে। সেদিনের জন্য আমি অনুতপ্ত। আমার ওভাবে রিয়েকট করা একদম উচিত হয়নি। আর..”

প্রত্যাশা কথা কেড়ে নিল। বলল,

-” আপু বাদ দাও এসব। যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে। তুমি বলেছো এজন্য তোমার উপর রাগ-ক্ষোভ, অভিমান করব, এমন না। তোমার উপর আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরঞ্চ সত্যিটা জানিয়ে ভালোই করেছো। আমিই সকলের কাছে ঋণী। আমার গোটা জীবন এভাবে ঋণী হয়েই কাটাতে হবে। র’ক্তে’র সম্পর্ক নেই, অথচ তারা আমাকে কখনো বুঝতেই দেয়নি। আদর যত্ন ভালোবাসার এতটুকু খামতি রাখেনি। আরো সবটা উজাড় করে দিয়ে আমাকে বড় করেছে।”

কণ্ঠে অপরাধ বোধ নামিয়ে বলে নীলাশা,

-” শুধু সেদিনের জন্য স্যরি বলছি না। তোর সাথে অহেতুক রাগারাগি করা, হেয় করে কথা বলা সবের জন্য আমি রিপেন্ট।”

প্রত্যাশা বলল,

-” সত্যি বলতে, তোমার উপর একটু অভিমান, একটু অভিযোগ,একটু আফসোস ছিলো। তবে যেদিন থেকে সত্যিটা জানি, সেদিন থেকে আর আফসোস, অভিযোগ কোনোটাই নেই। আমি তোমার নিজের বোন নই। সেটা জানার পরেও আমাকে যতটুকু দিয়েছো, যা করেছো সেটাই আমার কাছে অনেক বেশি। আর ঠিকই তো বলতে, উড়ে এসে জুড়ে বসেছি আমি। তোমার আদরে ভাগ বসিয়েছি। তারপরেও তুমি যে সকলের সামনে বোন হিসেবে পরিচিতি দিতে। একদম সত্যি বলছি এটা আমার জন্য অনেক।”

নীলাশার ফর্সা মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। এরমধ্যে পায়ের শব্দ শুনে দুই বোনই চুপ হয়ে যায়। দুই জা বাগান থেকে আসলেন। শর্মিলার হাতে পেয়ারা। টি-টেবিলের উপর নামাতে নামাতে বললেন,

-” নীলাশা, প্রত্যাশা পেয়ারা খাও।”

নীলাশা শুকনো হেসে বলল,

-” পরে খাব ছোটো মা, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।”

প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে নীহারিকা জিজ্ঞেস করলেন,

-” তোমার পেট ব্যথা কমেছে?”

প্রত্যাশা মাথা তুলে তাকাল। বলল,

-” এখন করছে না। মাঝেমাঝে পেইনটা হয়।”

কপালে ভাঁজ ফেলে শর্মিলা বললেন,

-” তাহলে তো ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগে। নীরবকে বলে চেকাপ করিয়ে আসো। অল্প থাকতেই ট্রিটমেন্ট নেয়া ভালো। পরে না আবার বেশি সমস্যা হয়।”

নীহারিকা বললেন,

-” এই সময় কারো কারো ক্ষেত্রে একটু-আকটু ব্যথা হয়। অস্বাভাবিক না। তবে বেশি সমস্যা হলে আগে ভাগেই ডাক্তারের কাছে যেয়ো। হেলাফেলা করে পাছে যেন কোনো ক্ষ”তি না হয়।”

মূহুর্তেই নীলাশার কাছে পরিবেশটা ভারী হয়ে উঠল। মুখে স্বাভাবিক ভান করে বসে থাকলেও বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করছে। ফর্সা মুখটা এক মুহূর্তে নিস্তেজ হয়ে গেল। চোখে জল চিকচিক করে উঠল। অন্যদিক তাকিয়ে সবার অগোচরে মুছে নিল। মা না হতে পারার বেদনা ঠিক কেমন এটা কাউকে বোঝানো যায় না। শুধু সেই জানে, প্রতিদিন কীভাবে ভেতরে ভেতরে নিজেকে গিলে খেতে হয়। চারপাশে যখন শিশুদের কোলাহল, নতুন জীবনের আগমনের আনন্দ। তখন হাসি মুখে পাশে দাঁড়াতে হয় ঠিকই, কিন্তু অন্তরের গভীরে চাপা কান্না গড়িয়ে পড়তে চায়। মা না হওয়ার কষ্টটা এক অন্তহীন শূন্যতা। যে শুণ্যতায় প্রতিটি ক্ষণ নীলাশা গুমরে ম’র’ছে।

__________

ঘড়ির কাঁটা ঠিকঠিক দুপুর দু’টোর ঘরে। দুইটার পরেই রেজাল্ট প্রকাশ হবে। প্রত্যাশা বিছানায় বসে হাত দুটো সমানে ঘষছে। হাতের তালু টেনশনে ভিজে উঠছে ঘামে।

আজকে লাঞ্চ আওয়ারে একবারে চলে এসেছে নীরব। সে দাঁড়িয়ে আছে প্রত্যাশার থেকে দু’হাত দূরত্বে। ফটফট করে আঙুল স্পর্শ করে রেজাল্ট বিডি ওয়েবসাইটে ঢুকল। রোল, রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে সবটা পূরণ করে সাবমিট করতেই সাইট ঘুরপাক খেতে থাকল।

প্রত্যাশা চোখদুটো বুঁজে বিড়বিড় করে দোয়া দরুদ পড়ছে। নিঃশব্দে পাতলা অধরজোড়া নড়ছে,

-” ইয়া আল্লাহ, রেজাল্টটা ভালো দিও। মানসম্মানটা যেন থাকে। হাই-ফাই জিপিএ না হোক, অন্তত মুখ দেখানোর মতো কিছু একটা হোক।”

নীরব কোণা চোখে প্রত্যাশাকে এক ঝলক দেখল। পরপরই মিটমিট করে হেসে মজার ছলে বলল,

-” যেভাবে হাত দুটো ঘষছো, মনে হচ্ছে যখন-তখন আ”গুন ধরে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। সাবধান, আমি কিন্তু ফায়ার এক্সটিংগুইশার আনিনি।”

নীরবের কথায় হকচকিয়ে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এল প্রত্যাশা। কপালে বিরক্তির ছাঁট ফেলে অস্থির গলায় বলল,

-” মা’রা’ত্মক টেনশন হচ্ছে। এখন এসব আজেবাজে কথা বলবেন না তো। হাত-পা কাঁপছে আমার।”

নীরব ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে বলল,

-” আরে এত্তো টেনশন করার কী আছে? রিল্যাক্স হও। চিল করো। দ্যাখো বিয়েটা তো হয়ে গেছে। বিয়ের আগে হলে না হয় টেনশনের একটা কারন ছিলো। ধরো তুমি ফেল করলে, যার ফলে তোমার আম্মু একটা রিকশাওয়ালা ম্যানেজ করে তার সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দিতো। ভাগ্যিস আমি হিরো হয়ে আগে থেকেই সব সিল করে ফেলেছি। তোমাকে বউ করে নিয়েছি।”

প্রত্যাশা গলা উঁচু করে চেঁচিয়ে উঠল,

-” নীর…ব। উফ্! থামবেন আপনি। আমি নার্ভাস আর এদিকে আপনি মজা নিচ্ছেন, না? মজা নিচ্ছেন? এবারে কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই রেগে যাচ্ছি, হুঁ।”

ঠোঁট কামড়ে হাসল নীরব। কণ্ঠে দুষ্টুমি মিশিয়ে বলল,

-” তোমাকে রাগাতেই চাইছি। কজ রাগলে পরে তোমাকে আরো সুন্দর লাগে। তখন ইচ্ছে করে টুপটুপ করে কটা চুমু খেতে, তোমার ওই রাগে লাল হওয়া ফোলাফোলা গালে।”

-” আশ্চর্য মানুষ তো আপনি! এই মূহুর্তে এসেও কেউ এমন মজা করে নাকি?”

-” আমি করি।”

নীরবের সোজাসাপ্টা নির্লিপ্ত জবাব শুনে প্রত্যাশা মুখ বাঁকাল। নীরব সিরিয়াস গলায় বলল এবারে,

-” অতিরিক্ত টেনশন করে বিপি হাই করে ছাড়বে। যাতে আমার বাচ্চাটার প্রব্লেম হবে। যেটা হওয়ার সেটা হতো হবেই। সো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। শোনো, তোমার রেজাল্ট যেমনই আসুক না কেনো, তুমি কিন্তু আমার লাইফের ফার্স্ট ডিভিশন।”

এবারে প্রত্যাশার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল,

-” রেজাল্ট আসেনি এখনো? দুটো তো অলরেডি বাজে।”

-” ওয়েবসাইট গুলোতে এই মুহূর্তে প্রচুর চাপ পরে। তাই একটু লেট হচ্ছে। ডোন্ট ওয়ারি, চলে আসবে।”

বলতে বলতেই রেজাল্ট শো করল। নীরব বলল,

-” আসছে।”

প্রত্যাশা তড়িঘড়ি উঠে নীরবের পাশে দাঁড়াল। উত্তেজিত চোখমুখে শুধাল,

-” কি আসছে? কী গ্রেড? কত পয়েন্ট?”

ফোনটা প্রত্যাশার সামনে মেলে ধরল নীরব। বলল,

-” এইযে তুমিই দ্যাখো।”

প্রত্যাশা ফট করে চোখের ঘন পাপড়ি নামাল। চোখবুঁজে কম্পিত গলায় বলল,

-” না, আপনি বলুন।”

বলেই নীরবের হাত শক্ত করে চেপে ধরল প্রত্যাশা। টেনশনে নখ ডেবে গেল নীরবের হাতে। নীরব হাতের দিকে একপল তাকাল পরপর প্রত্যাশার মুখের দিকে। তারপর স্মিত হেসে স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে পড়ল,

-” ইয়ানূর প্রত্যাশা, অল সাবজেক্ট পাসড। জিপিএ ফোর পয়েন্ট জিরো জিরো।”

কথাটা মাথায় ঢুকতে পাঁচ সেকেন্ড সময় লাগল প্রত্যাশার। প্রথমে একটু রাগ হলো নীরবের উপর। এত কাহিনী করে বলতে হলো, ডিরেক্ট ফোর পয়েন্ট বললেই হয়। তবে রেজাল্ট শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সব রাগ উবে গেল নিমিষেই। প্রত্যাশা উচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে ওঠে,

-” ইয়াআআ! আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।”

খুশিতে সামনে দাঁড়ানো নীরবকে ঝাঁপটে ধরল। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল,

-” যাজ্ঞে এ গ্রেড তো পেয়েছি।”

এসএসসিতে থ্রি পয়েন্ট ফাইভ জিরো ছিলো। একদম কাঁটায় কাঁটায় এ মাইনাস হয়েছিল। এবারে একটু উন্নতি হয়েছে। তবুও সেই যেন কাঁটায় কাঁটায়। প্রত্যাশা তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে বলে,

-” দেখি দেখি এবার, কোন সাবজেক্টে কত মার্কস এসেছে।”

ফোনটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে নম্বরগুলো দেখতে লাগল প্রত্যাশা। নীরব ভ্রু নাড়িয়ে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” উহুম, উহুম, আচ্ছা এখন তো তোমার মিষ্টি মুখ করানো উচিত।”

প্রত্যাশা ভুরু কুঁচকে সরু চাউনিতে তাকাল। বলল,

-” আরে বউ পাস করেছে, মিষ্টি তো আপনিই এনে খাওয়াবেন। শুধু আমাকে না, সবাইকে।”

প্রত্যাশার দিকে ঝুঁকল নীরব। চোখ টিপে বলল,

-” আমার তরফ থেকে সবাইকে তো ঠিকই মিষ্টি খাওয়ানো হবে। তবে আমার বউকেও মিষ্টি খাওয়াতে হবে আমাকে। অন্যভাবে, ক্লিয়ার?”

প্রত্যাশা চোখ নামিয়ে নিল। লজ্জার আভা লুকাতে চটপট বলল,

-” ধূর, সবসময় ফাজলামি করেন। যান তো, আমি এখন ফ্রেন্ডদের সাথে কথা বলব। ওদের রেজাল্ট জানতে হবে।”

-” আগে তোমার আব্বু- আম্মুর সাথে কথা বলে নাও।”

প্রত্যাশা মাথা নেড়ে বলল,

-” ও.. হ্যাঁ।”

.

প্রত্যাশার রেজাল্ট উপলক্ষে বিকেলে মিষ্টি নিয়ে আসে নীরব। ড্রয়িংরুমে আনিশা আর ইচ্ছের হাতে মিষ্টির পিরিচ। আনিশা সুন্দর করে কাঁটা চামচে তুলে তুলে খাচ্ছে। ইচ্ছে খেতে গিয়ে গায়ে মেখে নিচ্ছে। সে নিজেই অবশ্য বলেছিল আনিশার মতো নিজে নিজে একাই খাবে। এখন খেতে গিয়ে মিষ্টির রস ফোঁটা ফোঁটা ফ্রকে মেখে ফেলছে। প্রত্যাশা ড্রয়িংরুমে আসছিল। এটা দেখেই ইচ্ছের কাছে এসে বলল,

-” এই রে তুমি তো একদম গায়ে মেখে নিচ্ছো। মিষ্টির রস যে আঠালো। দাও দাও আমি খাইয়ে দেই।”

ইচ্ছে ঘাড় নেড়ে বলল,

-” দাও।”

প্রত্যাশা পাশে বসল। সুকোমল হেসে ইচ্ছের গালে তুলে দিল। ইচ্ছে মুখে নিয়ে চিবুতে থাকে। প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,

-” খেতে টেস্টি?”

জ্বিভ বের করে ঠোঁট মুছার মত করে উচ্ছ্বসিত মুখে বলল ইচ্ছে,

-” হ্যাঁ টেস্টি…অনেক ইয়াম্মিইইই।”

ইচ্ছের এক্সপ্রেশন দেখে প্রত্যাশা হেসে ফেলল। এরমধ্যে নীহারিকা অদূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখলেন। দেখে ভেতরে ভেতরে প্রসন্ন হাসলেন। কিছুপল পর এগিয়ে এসে প্রত্যাশাকে শুধালেন,

-” প্রত্যাশা, নীরব কোথায়?”

-” রুমেই আছে।”

-” সবাইকে মিষ্টি দেয়া হয়েছে। নীলাশা পরে খাবে বলেছে। তুমিও তো খাওনি। একাই নিয়ে খেয়ো কিন্তু। আর হ্যাঁ, নীরবকে নিয়ে দিও।”

-” আচ্ছা, মা।”

ইচ্ছে খেতে খেতে হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠল।

-” মামণি, আমার মাম্মা কবে আসবে গো?”

প্রত্যাশার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। জবাব দিতে পারল না। ইচ্ছে ফের বলল,

-” দিদুন তুমি তো বলেছো মাম্মা অফিসের কাজে গেছে। কাজ শেষ হয়নি? এখনো আসছে না যে। আচ্ছা আমি যদি মাম্মার সাথে ফোনে কথা বলতে চাই, মাম্মা কী রেগে যাবে? মাম্মা তো অফিসের কাজে আছে। সেজন্য রাগ করবে কী? মামণি তুমি মাম্মার সাথে কথা বলে শুনবে, হ্যাঁ?”

প্রত্যাশা থম মেরে গেল। নীহারিকা এড়িয়ে যেতে বলে উঠলেন,

-” আনিশা আর ইচ্ছে খাওয়া শেষে হাতমুখ ভালো করে ধুয়ে বাইরে এসো। আমি সামনেই দাঁড়াচ্ছি। তোমাদেরকে হাঁটতে নিয়ে যাব।”

কথাটা শুনেই ওদের দু’জনের চোখমুখে খুশির ঝিলিক ঝিকমিক করে উঠল। ইচ্ছেকে খাইয়ে পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে দেয় প্রত্যাশা। ইচ্ছের রস মাখানো ফ্রক চেঞ্জ করে আরেকটা পড়িয়ে দিল। ওরা দু’টো ফুঁড়ুৎ করে দৌড়ে নীহারিকার কাছে যায়। বাসার সামনে লাগানো সবজি বাগানে নীহারিকা এটাওটা দেখছিল। অতঃপর দু’জনকে সাথে নিয়ে সামনেই হাঁটতে বেরোন।

রসমালাই আর সানার জিলাপি দু’টো মিষ্টিই প্রত্যাশার পছন্দের। আজকে দুটোই এনেছে নীরব। প্রত্যাশা এখন রসমালাই রেখে দু’টো পিরিচে দু’টো দু’টো করে চারটে সানার জিলাপি আর অল্প রস তুলল।

রুমে ঢুকতেই বেডে নজর যায়। ডার্ক ব্লু টিশার্ট, আর অফ হোয়াইট ট্রাউজার পরনে নীরবের। বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে। কপালে ভাঁজ ফেলে দৃষ্টিজোড়া ফোনে নিবদ্ধ রেখেছে। প্রত্যাশা এগিয়ে হাতের ট্রে বেডটেবিলে রাখল। একটা পিরিচ হাতে নিয়ে হালকা কেশে বলল,

-” এহেম এহেম, এইযে আপনার মিষ্টি।”

ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একবার প্রত্যাশার হাতের দিকে তাকাল নীরব। অতঃপর ফোনের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল,

-” খাইয়ে দাও।”

প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে বলল,

-” মানে?”

-” কানে শোনোনি? কথাটা রিপিট করতে হবে?”

-” পারব না। আপনি খেয়ে নিন।”

-” হাত জোড়া আমার। দেখছো না ফোন স্ক্রল করছি।”

প্রত্যাশা এক ঝটকায় নীরবের ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে নিল। মিষ্টির পিরিচ বাড়িয়ে বলল,

-” নিন এবারে খান।”

দুই ভ্রুর মাঝখানে ঢেউ তুলে প্রত্যাশার মুখের দিকে তাকাল নীরব। নরম স্বরে বলল,

-” খাও তুমি। মিষ্টি আমার তেমন পছন্দ নয়।”

-” অল্প করে খান।”

-” উঁহু। আমার গুলো তোমার জন্য। আমারটা তুমি খেয়ে নিও।”

প্রত্যাশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

-” আমাকে কী আপনার রাক্ষস মনে হয় নাকি? আর আমার লাগলে আরো আছে সেখান থেকে নেয়া যাবে।”

-” আরে রাগ করছো কেনো? ভালোবেসেই তো বলছি।”

প্রত্যাশা কাঁটা চামচে এক টুকরো মিষ্টি তুলে নীরবের সামনে ধরল। বলল,

-” নিন আমিও ভালোবেসে খাইয়ে দিচ্ছি। এবার তো একটু খেয়ে দেখুন।”

নীরব স্মিত হাসল। বলল,

-” ওকে, এত সুন্দর করে বউ ভালোবেসে দিচ্ছে। না করি কী করে।”

নীরব মুখে নিল। প্রত্যাশা এবারে নিজের মুখে পুড়ে চিবুতে চিবুতে বলল,

-” আপনাকে তো আমার ফ্রেন্ডদের রেজাল্ট বলা হয়নি। হ্যাপি প্লাস পেয়েছে, নাহিদ ফোর পয়েন্ট থ্রি ফাইভ। রোহান ফোর পয়েন্ট ফাইভ এইট। কোয়েল টা না একটু খারাপ করেছে। থ্রি পয়েন্ট সেভেন ফাইভ পেয়েছে।”

একনাগাড়ে বলে থামল প্রত্যাশা। এবারে চোয়াল শক্ত করে বলল,

-” করবে না, সারাক্ষণ বয়ফ্রেন্ডের সাথে চ্যাটিং ফ্যাটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আর আমাদের মধ্যে বেশি বেশি লুচুগিরি কথা না ওই বলে থাকে। মাথায় আজেবাজে ভাবনা থাকলে তো এমন হবেই। ওইযে অল্প বয়সে পাকলে যা হয়।”

ভ্রুকুটি করে প্রত্যাশার মুখের দিকে তাকাল নীরব। বলল,

-” আর তুমি নিজে এসব কী ওয়ার্ড ইউজ করছো, শুনি? লুচুগিরি, পাকা?”

চোখদুটো কপালে তুলে বলল প্রত্যাশা,

-” আরে যে যা করে তাকে সেরকম বলব না? এখন বলতে গিয়ে যদি ওসব ওয়ার্ড চলে আসে তাতে আমার দোষ কী?”

হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেল নীরব। গ্লাস নামাতে নামাতে বলল,

-” আচ্ছা বাদ দাও এসব। অন্যের রেজাল্ট কেমন হলো এ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তুমি তোমার নিজের ব্যাপারে মনোযোগী হও। আমার বউ হিসাবে সামনে তোমাকে আরো ভালো করা চাই। টার্গেট রাখবে হ্যান্ডসাম সিজিপিএ তোলার।”

প্রত্যাশা গাল ফুলিয়ে বলল,

-” বুঝেছি আমার এই রেজাল্টে আপনি খুশি হোননি। প্লাস পাইনি তো।”

-” আরে আমি কী তাই বলছি? উল্টো বুঝে অভিমান করছো। আমি বলছি, সামনে আরো ভালো কিছু করার। পেতেই হবে এমন নয়, তবে চেষ্টাটুকু তো রাখতে হয়।”

-” ওহ্।”

প্রসঙ্গ পাল্টাতে নীরব বলল,

-” তোমার তরফ থেকে আমার জন্য আসল মিষ্টি কিন্তু পাওনা রয়ে গেছে।”

প্রত্যাশা কণ্ঠে কৌতুক নামিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” তাহলে যেটা মাত্র খেলেন, সেটা নকল মিষ্টি ছিলো নাকি?”

নিচের অধর কামড়ে ধরে স্বল্প হাসল নীরব। দুষ্টু স্বরে বলল,

-” নাহ। তবে পানসে কড়া মিষ্টি নয়। আমার জন্য কড়া মিষ্টি হলো… তোমার ঠোঁট।”

___________

তিন-চার দিন পর…

হাসপাতালের ক্যান্টিনে টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি বসে আছে অদ্রিকা আর সার্থক। সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। সার্থকের মুখ শুকনো, চোখ লালচে। দেখেই বোঝা যায় ঠিকমতো ঘুমায় না। অদ্রিকা মৃদু স্বরে বলল,

-” তোকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবো জানি না সার্থ। তবে একটা কথা বলব, ভেঙে পড়িস না। নিজের কথাটাও ভাব। প্রীতি ভুল করেছে, তবু বোনের কষ্ট দেখা যায় না। তুই যদি সাজা কমানোর চেষ্টা করিস, সেটা অন্যায় নয়। আচ্ছা, জামিনের ব্যাপারটা?”

সার্থক হতাশ গলায় বলল,

-” প্রীতির জন্য ল’য়ার নিয়েছি। জামিনের জন্য আপিল করেছিলাম। কিন্তু খারিজ করে দিয়েছে। জামিন হবে না। তিনটা কেস নীরব করেছে, সব প্রমাণ সহ। দুইটা প্রত্যাশাকে নিয়ে, আরেকটা নীবিড়কে ঠকানোর জন্য।”

অদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল,

-” আর আন্টি?”

সার্থকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মুষ্টিবদ্ধ হাত কাঁপতে লাগল।

-” প্লিজ অদ্রি, ওই মহিলার নামটা আমার সামনে তুলিস না। ওনার জন্যই আজ এই পরিস্থিতি।”

বোনের জন্য নামকরা বড় ল’য়ার ঠিক করলেও মায়ের ক্ষেত্রে নির্বিকার। তানিয়ার পক্ষে কোনো উকিল দাঁড়ায়নি। যেখানে নিজের ছেলেই দাঁড়ায়নি, সেখানে আর কে তার পক্ষ নিবে?

কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ কাটল। দু’জনেই কফির মগের দিকে তাকিয়ে। অদ্রিকা জিজ্ঞেস করল,

-” তুই গিয়েছিলি প্রীতিকে দেখতে?”

সার্থক ধীরে মাথা নাড়ল। বলল,

-” হ্যাঁ। দুই দিন হলো হাসপাতাল থেকে জেলে নিয়েছে। এত অল্প সময়ে এতটা দলে গেছে যে চেনাই যাচ্ছে না। চোখের নিচে কালি জমেছে, শুকিয়ে গেছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয়নি। চুপ করে থেকেছে, আর নীরবে চোখের পানি ফেলেছে।”

এতটুকু বলে থামল। ব্যথাতুর কণ্ঠে ফের বলল,

-” আজ দু’টো সপ্তাহ খাবার মুখে তুলতে গিয়ে প্রীতির মুখটা ভেসে ওঠে। ও কী খাচ্ছে? কীভাবে জেলের চার দেয়ালের মধ্যে আছে? এসির মধ্য ছাড়া থাকতে পারে না, যে সে খাবার মুখে তুলতে পারে না। আমার সেই ছোট্ট বোনটা কী করে সহ্য করছে? ভাবলেই আমার এত অসহায় লাগে বলে বোঝানো যাবে না।”

গলার স্বর ভারী হয়ে ওঠে সার্থকের। চোখ চিকচিক করে উঠল।

দেখা করার মূহুর্তের প্রীতিকে এটাওটা জিজ্ঞেস করলেও নিশ্চুপ থাকে। শুধু একটাই প্রশ্ন করে — ভাইয়া ইচ্ছে কোথায়? কেমন আছে?

ইচ্ছে ওর দাদুর বাসায় আছে। ভালো আছে। সার্থকের উত্তর শুনেই প্রীতি বলে— জানি তো ওখানে থাকলে ইচ্ছে ভালো থাকবে। সবার আদরে খুব খুব ভালো থাকবে।

সার্থক জিজ্ঞেস করে— ইচ্ছেকে দেখতে চাস? একদিন নিয়ে আসব?

প্রীতি সাথে সাথেই না করে। বলে— নাহ। ওকে কখনো এখানে আনিস না ভাইয়া। ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইবে না। কান্নাকাটি করবে। তার চেয়ে ওর বাড়িতে, নিজের পরিবারের লোকদের কাছে ভালো থাক। আর পারলে ওকে বোঝাস, ওর বাজে মাম্মাটা নেই। ওর খারাপ মাম্মাটা ম*রে গেছে। ও যেন এটা জেনেই বড় হয়।

.

কিছু সময় নীরবে কাটল। মগের কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই ঠাণ্ডা কফিই গলাধঃকরণ করতে থাকে সার্থক। তবে তেতো ঠেকছে। বোনের কথা মনে পড়ল গলা দিয়ে কিছু নামানো কষ্ট হয়ে ওঠে। অদ্রিকা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্য প্রসঙ্গে গেল,

-” সার্থ, তুই এখন কোথায় থাকিস?”

-” ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।”

অদ্রিকা কফির মগে ঠোঁট ছোঁয়াল। খানিকক্ষণ দ্বিধা দ্বন্দ্বে থেকে নিচু গলায় বলল,

-” জানি, এই মুহূর্তে আমার কথাটা বলা একদম ঠিক না। তবু বলছি, বাবা-মা আমার বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিচ্ছে। তোকে তো আমি কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ইভেন বলেছি; আমার তোকে ভালো লাগে। তুই অবুঝ নোস সার্থক। এই ভালোলাগার মানে বোঝার জ্ঞান আছে। আর আমি-ও বোকা নই। ওই মেয়েটার প্রতি তোর যে টান আছে। কুয়াকাটায় থাকতে সেটা আমিও বুঝেছি। সব জেনেশুনেই বলছি, এভাবে সময় ন*ষ্ট না করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়া যায় না?”

সার্থক থম মে*রে গেল। চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

-” অদ্রি আমার একটু সময় লাগবে। এখন এই পরিস্থিতিতে…”

অদ্রিকা কথার মাঝখানেই বলল,

-” সময় নিতে নিতে বুড়ো হয়ে যাবি। কিছুদিন গেলে চুলে পাক ধরে যাবে কিন্তু। আর এদিকে গ্রামের বাড়িতে গেলেই সবাই আড়ালে আড়ালে আমাকে আয়বুড়ো বলে। মেয়েটার সমস্যা আছে নইলে বিয়ে করে না কেনো? ভাবছি, সবার মুখ বন্ধ করার জন্য হলেও দ্রুত বিয়ে করে দেখিয়ে দিবো। তিনদিন সময় দিলাম সার্থ। ডিরেক্ট হ্যাঁ বা না বলবি। নয়তো বাবা-মায়ের ঠিক করা পাত্রকে বিয়ে করে নেবো। আর বিয়ে হলে আপনাআপনি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়ে যায়। পুরনো মোহটোহ কোথায় চলে যায়, হুঁ।”

অদ্রিকা একটু অ্যাক্টিং করে বলতে থাকে। একাকী নিঃসঙ্গ লাইফের দুঃসময়ে অদ্রিকার সাথে কথা বলে একটু হলেও হালকা লাগছে সার্থকের।

___________

রাত সাড়ে এগারোটা। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঘরে হালকা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। প্রত্যাশা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। নীরব পাশ ফিরে ফোনে স্ক্রল করছিল। কাঁথাটা গায়ে টেনে নিতে নিতে প্রত্যাশা বলল,

-” আবহাওয়াটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার তো শীত শীত লাগছে। এরমধ্যেও এসিটা অন করে রেখেছেন। পাওয়ারটা একটু বাড়িয়ে দিন।”

নীরব ফোনটা নামিয়ে একহাতে প্রত্যাশাকে কাছে টেনে নিল। বলল,

-” শীত লাগলে উষ্ণতা পেতে কাঁথা না টেনে আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারো। এতে কিন্তু আমি একটুও আপত্তি করব না, বরং খুশিই হবো।”

প্রত্যাশা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

-” জানি তো সেটা।”

-” জানো, তাহলে নিজে থেকে করো না কেন?”

-” আমি না করলেও, আপনি তো ঠিকই জড়িয়ে নিবেন।”

নীরব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মজা করে বলল,

-” কপাল মন্দ, শুধু জড়িয়ে ধরেই থাকতে হচ্ছে। ডক্টরের কথা মেনে চলতে গিয়ে নিজের উপরই জুলুম করছি।”

প্রত্যাশা হেসে মাথাটা নীরবের বুকের উপর রাখল। নীরব আলতো করে হাত পেঁচিয়ে ধরল। হঠাৎ প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,

-” আচ্ছা, বলুন তো আপনার মনে হয় ছেলে হবে নাকি মেয়ে?”

-” আই হ্যাভ নো আইডিয়া।”

-” আরে, শুধু অনুমান করে বলুন না।”

-” ছেলে হোক বা মেয়ে, যাই হোক না কেন সুস্থ হলেই আমার খুশি।”

প্রত্যাশা মিষ্টি হেসে বলল,

-” উমম! যদি টুইন হয়? যেমন ধরুন, নীড় আর প্রাপ্তি একসাথে আসল।”

নীরব ভ্রু কুঁচকে তাকাল,

-” ওটা কী সম্ভব নাকি?”

-” কেনো, হতে পারে না?”

-” না মানে আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্টে তো সিঙ্গেল ফিটাস লেখা ছিল। তাই টুইনের সম্ভাবনা নেই।”

প্রত্যাশা একটু ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল,

-” ও হ্যাঁ, ঠিকই বলছেন। আমার মাথায়ই আসেনি। একদম খেয়াল করিনি।”

নীরব এক ঝটকায় প্রত্যাশাকে নিচে ফেলল। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,

-” তোমার বাড়তি কোনোকিছুর খেয়াল রাখার দরকার নেই। এখন শুধু আমার দিকেই খেয়াল রাখো।”

কথা শেষ করে কাঁথাটা টেনে নিল নীরব। জানালার কাঁচ বেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। ঘরটা ধীরে ধীরে ভালোবাসার উষ্ণতায় ভরে উঠল।

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ভার্সিটির মাঠ। বিকেলের নরম কোমল রোদে তাগড়া যুবকেরা ফুটবল খেলায় মাতোয়ারা। আজ নীবিড় আর নীরব দুই দলে। মাঠের এপাশ-ওপাশে কিছু মেয়ে হাঁটছে, কেউ দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে তো আবার কেউ গল্প করছে। প্রীতি আর ওর এক মেয়ে ফ্রেন্ড অদূরে দাঁড়িয়ে। প্রীতির পরনে নেভিব্লু গর্জিয়াস কুর্তি আর লেডিস জিন্স। সোনালী রং করা চুলগুলো মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। হাতে থাকা কোকাকোলার ক্যানটা থেকে থেকে মুখের সামনে ধরছে তো আবার আড়চোখে মাঠের দিকে তাকাচ্ছে।

খেলায় মনোযোগী নীবিড়ের দৃষ্টি বল ছেড়ে বারবার প্রিয়তমার দিকে যাচ্ছে। ওইযে চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে এসে প্রীতির হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে, এই দৃশ্যটুকু নীবিড়ের কাছে যা সুন্দর লাগছে না! একদম অপূর্ব! ইচ্ছে করছে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চাহনিতে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখতে।

এদিকে মাঠের হৈচৈয়ে নীবিড় চোখ সরিয়ে খেলায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করল। কয়েকপল পরে বলটা নীরবের পায়ে আসে। নীরব বল ড্রিবল করে এগোচ্ছিল। চরম উত্তেজনা, হৈচৈ.. কিক মা*রতেই বল জালে জড়ায়। শুরু হয় একদফা উল্লাস। নীবিড় হতাশ শ্বাস ফেলে নীরবের কাছে এগোল। পিঠ চাপড়ে মজার ছলে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” এই নীরব, তোদের দল তো দুই গোলে এগিয়ে গেল রে ভাই। মানসম্মানের ফালুদা বানাস না ভাই আমার। দ্যাখ ওপাশে প্রিয়স্মিতা দাঁড়িয়ে। আজ ওর সামনে হারলে হিরো থেকে হবো জিরো। তুই অন্তত একটু ছাড়ছুড় দে ভাই।”

কপালের ঘাম এক আঙুলে ছুঁড়ে ফেলল নীরব। বলল,

-” মাথা থেকে এসব প্রীতি ট্রিতির ভূ*ত বের কর। খেলায় মন দে, নাটক পরে কর। আজ তোর খেলায় মন নেই। বলের দিকে নজর না থেকে তোর নজর অন্য কোথাও আঁটকে যাচ্ছে। তাই বলছি, এখনও সময় আছে প্রীতির চিন্তা আউট করে খেলায় মনোনিবেশ কর।”

নীবিড় চোখ কুঁচকে বলল,

-” ওই প্রীতি কী.. হ্যাঁ? প্রীতি ট্রিতি আবার কী? ভাবী বল ভাবী। আমার ইন ফিউচার বউ। তোর ভাবী লাগে, ভাবী। এরপর থেকে এটা মাথায় রাখবি, বুঝলি?”

নীরব চোখ পাকিয়ে তাকাল,

-” বাড়িতে মায়ের কানে খবরটা পৌঁছে দিবো কী? ভাইয়া স্টিল সিঙ্গেল। আর এদিকে মায়ের মেঝো ছেলে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। যা ভাবসাব মনে হচ্ছে ভাইয়ার আগে বিয়ে না সারে।”

নীবিড় ঠোঁট মেলে কিছু বলবে তার আগেই পুরোদমে খেলা শুরু হয়। কিছুক্ষণ দুই দলেরই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল। বলটা নীরবের দখলে ফের আসে। ডান দিক দিয়ে দৌড়ে এগোতে গিয়ে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পায়ের গোড়ালিতে জোরে চোট পায় নীরব। মুহূর্তেই ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ব্যথার ঝটকায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল ওর। দুই হাত দিয়ে গোড়ালি আঁকড়ে ধরে হাঁপাচ্ছে। চারপাশে সবাই জড় হতে থাকে। নীরব ব্যথাতুর চোখমুখে বুট খুলতে শুরু করে। নীবিড় উদ্ভ্রান্তের মতো এগিয়ে এল। নীরবের গোড়ালিটা ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে। এটা দেখেই নীবিড়ের বুকটা কেঁপে উঠল। সামনে হাঁটু গেড়ে বসে অস্থির হাতে নীরবের পা-টা ধরে আস্তে চাপ দিল। কণ্ঠে তীব্র উদ্বেগ নিয়ে শুধাল,

-” নীরব আর কোথায় লেগেছে? খুব ব্যথা পাচ্ছিস? উফ্, বেশ ফুলে গেছে তো।”

নীরব দাঁত চেপে বলল,

-” এতটা কিছু না। সামান্য লেগেছে।”

এই বলে নীরব উঠে দাঁড়াতে নেয়। পায়ের উপর প্রেশার পড়তেই ব্যথায় কপাল কুঁচকে এল। নীবিড় ভাইকে সামলে নিল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,

-” ব্যথা সহ্য করতে পারছিস না। আবার মাতব্বরি করে একাই হাঁটতে নিচ্ছিস। চল তোকে এখনই ডাক্তার দেখাতে হবে।”

-” আরে একটু সময় দিলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।”

নীবিড় একটা রোমাল জোগাড় করে ভিজিয়ে গোড়ালিতে চেপে ধরল। বলল,

-” এসব খেলার চোট হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। এক্স-রে করে দেখতে হবে ফ্র্যাকচার হয়েছে কিনা।”

নীরব তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,

-” ডাক্তার দেখাতে হবে না। বেশি ব্যথা হলে একটা পেইন কিলার খেয়ে নিলেই চলবে। আর ফোলা একাই ঠিক হয়ে যাবে।”

নীবিড় কোনো কথা শুনল না। একহাতে ভাইয়ের হাত নিজের কাঁধে তুলে নিল। আরেক হাতে শক্ত করে ধরে ধীরেধীরে হাঁটতে সাহায্য করে। তারপর জোর করেই ডাক্তার দেখায়। সে রাতে হলে নীরবের গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। সারারাত জেগে ভাইয়ের মাথায় জলপট্টি দেয় নীবিড়।

.

চোখের পলকে কে’টে গিয়েছে বেশ কটা মাস। প্রত্যাশার পাঁচ মাস চলছে। ইদানিং ওর মুড সুইং হচ্ছে। হঠাৎ নীরবের কাছে ফোন করে বায়নার সুরে বলে—বাসায় বোর লাগছে। একদম কোনোকিছু ভালো লাগছে না। ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে।

বউয়ের মন ভালো করতে অগত্যা ডিউটি ফেলে বাসায় আসে নীরব। সার্কিট হাউসের পাশের মাঠে শান বাঁধানো বসার স্থানে দু’জনে বসে।

সূর্যের কমলা রঙা আলোয় একদল কিশোর ফুটবল খেলছে। হঠাৎ এক ছেলের পায়ে আ*ঘাত লাগে। সঙ্গে সঙ্গে আরেক ছেলে দৌড়ে আসে। কথা শুনেই বোঝা যায় ওরা ভাই। দেখে অনুমান করা যায় বয়সে বড়জোর দেড়-দুই বছরের তফাত। তবে ভাইয়ের ব্যথায় অপর ছেলেটার চোখ কেমন চিনচিনে হয়ে উঠল। খেলা ফেলে ভাইকে বুকে আগলে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে জোরেশোরে বলল,

-” অ্যাই শোন, আমি আর খেলব না রে। নাফির পায়ে চোট লেগেছে। ওকে বাসায় নিয়ে বরফ দিতে হবে।”

এই বলে ভাইকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটল। এই দৃশ্যটা চোখের সামনে আসতেই নীরবের বুকটা কেঁপে ওঠে। অতীতের কথা মনের ক্যানভাসে উঁকি দেয়। আর সেই দৃশ্যটুকু মনে উঠতেই নিঃশ্বাস আঁটকে এল। বুকের ভেতরটা মুষড়ে যাচ্ছে। চোখজোড়া চিকচিক করে উঠেছে। তন্মধ্যে পাশে বসা প্রত্যাশার ডাকে সম্বিত ফিরে পায় নীরব। নীরবের হাত ধরে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলল প্রত্যাশা,

-” নীরব, শুনছেন? কী ভাবছেন? এত চুপচাপ আছেন যে।”

নীরব নিজেকে সামলে নিল। প্রত্যাশার সামনে নিজেকে প্রকাশ না করে বলল,

-” না, তেমন কিছু না। বলো?”

-” বাদাম খাবো।”

বাদামওয়ালাকে দেখিয়ে বলে প্রত্যাশা। নীরব খোসা ছাড়িয়ে ফুঁ দিয়ে প্রত্যাশার হাতে তুলে দিচ্ছে। প্রত্যাশা খাচ্ছে আর পা দুটো দুলাচ্ছে। চিবুতে চিবুতে বলল,

-” শুধু আমাকেই কেন দিচ্ছেন? আপনিও খান।”

-” তুমি তো আর একা নও। তোমাকে দিচ্ছি মানে একসাথে দু’জনকে খাওয়াচ্ছি। আমার বেবিকে আর তার মাম্মাকেও।”

প্রত্যাশার অধরে হাসি ফুটল। পা দুটো দুলাতে দুলাতে বলল,

-” জানেন, আমি বাদাম গাছ দেখেছি। নানুর বাসায় গিয়েছিলাম তখন। মামারা বাদামের চাষ করে। চরে ঘুরতে গিয়ে কাঁচা বাদাম ছিঁড়েছিলাম। ইয়া আল্লাহ, একেকটা গাছে পাতার চেয়ে বাদামই দেখি বেশি। বাদাম গাছ এত ফল দেয় না।”

-” হোয়াট? ফল দেয় মানে?”

-” হুঁ, ফলই তো। বাদাম ফলের কথা বলছি।”

-” স্টুপিড একটা। বাদাম ফল নয়, বাদাম হলো শস্য।”

স্টুপিড বলায় প্রত্যাশার মুখটা গম্ভীর হয়ে এল। ঠোঁট বাঁকিয়ে গম্ভীর সুরে বলল,

-” ওই হলো একই।”

এর সাথে বেশি কথা বললে নিজের ভুল শুধরানো দূর উল্টো অভিমান করে থাকবে। তাই নীরব কথা না বাড়িয়ে বলল,

-” হয়েছে এবার উঠো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাসায় চলো।”

____________

গত সপ্তাহে আদালত রায় ঘোষণা দিয়েছে। ড্রা”গ সিন্ডিকেটের হেড, ড্রা’গের চো’রাচা’লান করে কোটি কোটি কালো টাকা উপার্জনকারী তানিয়া আর তার সিন্ডিকেটসহ যারা সাহায্যকারী ছিল সবারই যথাযথ সাজার ঘোষণা দেয়া হয়। জীবন ধ্বং*সী নিষিদ্ধ ড্রা’গ কত মানুষের জীবন ধ্বং*স করেছে ইয়াত্তা নেই। এটা গুরুতর অপরাধ। কতকত নীরিহ প্রাণ বিপথে গেছে, নেশায় আ*সক্ত হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত অ্যাডিক্টেড হয়ে কেউ বা আকালেই ঝরে গিয়েছে, যাচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে নীবিড়ের ব্যাপারটাও স্বীকার করেছে তানিয়া। সিন্ডিকেটের হেড অপরাধী তানিয়ার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। আদালত সকল সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তানিয়ার মৃ*ত্যুদন্ড রায় দেয়।

প্রীতির তিনটি কেসের জন্য বাদির আইনজীবী দশ-বারো বছরের কারাদণ্ড দাবি করেছিলেন। তবে সার্থকের ধরা আইনজীবীর প্রচেষ্টায়, মেয়ে ইচ্ছের ভবিষ্যত মননে নিয়ে সাত বছরের জেল দেয় আদালত। সার্থক তবুও সিদ্ধান্ত নেয় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। যদি আরেকটু হলেও বোনের সাজাটা কমানো যায়।

.
.

সকালে নাস্তার টেবিলে মাহবুব সাহেব দুই ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন— রাতে যেন ওনার সাথে দেখা করেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে। রাত দশটা বাজে। বাবা-মায়ের রুমে নিভান-নীরব দাঁড়িয়ে। প্রত্যাশা আর নীলাশাকেও ডাকা হয়। মাহবুব সাহেব সিঙ্গেল সোফায় বসে। নীহারিকা বিছানার একপাশে বসে। মাহবুব সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

-” দেখ বাবারা, আমার বয়স হয়েছে। শরীরটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। কখন কী হয়! বয়স হয়েছে আল্লাহ দীর্ঘদিন হায়াত দিয়েছেন, শুকরিয়া। এখন সবসময় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই থাকি। আমার যেটুকু আছে সবটা তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দেয়াই ভালো।”

ব্যাংকের চেক সামনে। কলমটা হাতে তুলতে তুলতে বললেন,

-” বাড়িসহ আঙিনা আমাদের দুই ভাইয়ের নামে। যতদিন পারো একসাথে মিলেমিশে থেকো। তবে এক সময় না একসময় তো প্রয়োজনে আলাদা বাড়ি করতেই হয়। বড় আঙিনা আছে, ভাগবাটোয়ারা করে যার যার মতো বাড়ি করে নিয়ো। আবিরদেরটা নায্য ভাবে দিও। যদিও আমি জানি আমার সন্তানেরা কখনো বেইনসাফি করবে না। তবুও বাবা হিসেবে বলা আমার দায়িত্ব। জানি না নীবিড় কখনো সুস্থ হবে কী না!”

শেষ কথাটা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠল। থেমে গেলেন মাহবুব সাহেব। চশমাটা সরিয়ে চোখ মুছলেন। ফের বললেন,

-” নীবিড়ের ভাগেরটা ইচ্ছেকে দিও।”

নামকরা ফার্মে উচ্চ পদে দীর্ঘ সময় চাকুরী করেছেন মাহবুব সাহেব। হ্যান্ডসাম স্যালারি ড্র করতেন। সন্তানদের মানুষ করেও বেশকিছু টাকা ব্যাংকে জমিয়েছিলেন। খরচাপাতি করে এখন অবশ্য বিশ লাখ সামথিং আছে। নিভান চাকরি পাওয়ার পর সেই সংসারে বেশি টাকা দেয়। এখনো সেই সংসারে বেশি অংশ দিয়ে থাকে। নীবিড়ের চিকিৎসার ব্যয় নীরব বহন করছে। তারপর তার যা বেতন দুহাত ভরে খরচা করতে গিয়ে, সবমিলিয়ে সংসারে কমই দেয়া হয়। তবে মাঝেমাঝেই সবার জন্য এটাওটা দেয়া হয়। চেকের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন মাহবুব সাহেব,

-” এখানে বিশ লাখ টাকা আছে। তোমাদের দুইভাইয়ের পাঁচ লাখ করে দিচ্ছি, ইচ্ছেরটা ওর নামে আলাদা রাখব। আর বাকি পাঁচ লাখ তোমার মায়ের জন্য।”

চেকে সই করতে নিলে নিভান থামিয়ে দিল,

-” বাবা এসব রাখো। তোমাকে এসব ভাগবাটোয়ারা করতে হবে না। সবটা মায়ের নামেই রাখো। আর হ্যাঁ, ইচ্ছের জন্য কিছু করতে চাইলে সেটা আলাদা।”

নীরব বলে উঠল,

-” বাবা আমার মনেহয় আমার বা ভাইয়ার কারোরই টাকাগুলোর প্রয়োজন নেই। তোমাদের দোয়ায় আল্লাহ যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ইনশা-আল্লাহ গোটা জীবন ভালোভাবে কে*টে যাবে। বাবা আমি বলতে চাইছি, এখান থেকে ইচ্ছেরটা ইচ্ছের জন্য রেখে বাকিটা যদি নীবিড়ের ট্রিটমেন্টের জন্য লাগানো যায়। বছরখানেক হলো নীবিড়ের থেরাপি চলছে। বাট কোনো উন্নতি নেই। উন্নতির জন্য বিদেশে নিলে যদি কিছুটা হলেও উন্নতি হয়।”

নিভানও সাথেসাথে সহমত পোষণ করল। ছেলেদের কথা আর ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে মাহবুব সাহেব গর্বে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলেন। টাকার জন্যই আজকাল মানুষ অহরহ পা*প করছে, ঘুষ খাচ্ছে, খু*নাখু*নি পর্যন্ত করছে। অথচ ভাইয়ের প্রতি এদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে আবেগাপ্লুত হলেন ভদ্রলোক। নীহারিকাও ছেলেকে কাছে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সহসাই বললেন,

-” ওরা ঠিকই বলেছে। নিভানের বাবা তাই করো। আল্লাহ যেনো এবারে আমার বুকের মানিক আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। এ জীবনে আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই আমার। আমার ছেলেরা হাসিখুশি থাকলেই আমি খুশি। আমার নীবিড় সুস্থ হোক। ওর মেয়েটাকে, ওর র*ক্তকে আঁকড়ে ধরে বাঁচুক।”

বলতে বলতে কেঁদে উঠলেন নীহারিকা। কান্নার শব্দ আটকাতে শাড়ির আঁচল টেনে মুখে গুজলেন। মাহবুব সাহেব ছেলেদের কথায় সন্তুষ্ট। তবুও বউমাদেরকেও জিজ্ঞেস করেন। তাদের মতামত কী? নীলাশা-প্রত্যাশাও একই কথা বলল। এতে তারা খুশি।

___________

রাত নয়টার দিকে পড়ার টেবিলে বসে প্রীতি। হাতে পেন, কিছু নোট করছিল। হঠাৎ হাতের উপর উষ্ণ স্পর্শ পেল। লম্বা লম্বা, রুক্ষ আঙুল দিয়ে কেউ তার আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজল। প্রীতির কপালে বিরক্তির ছাঁট পড়ল। নীবিড় ঝুঁকে প্রীতির কানের পাশে মুখটা নিল। ফিসফিসিয়ে বলল,

-” এখন পড়া বাদ দাও। হাজবেন্ডকে টাইম দাও।”

অপর হাত দিয়ে নীবিড়ের হাতটা সরিয়ে দেয় প্রীতি। বলল,

-” নীবিড়, সামনে প্রেজেন্টেশন আছে। আর হঠাৎ এই সময় তুমি?”

নীবিড় প্রীতির হাত ধরে টান দিয়ে সামনে দাঁড় করাল। অভিযোগের সুরে বলল,

-” আমি জানি তুমি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া স্বাভাবিক। তবে প্রীতি আমি রিলাইজড করলাম আমি আগের প্রীতিকে মিস করছি। বিয়ের পর থেকে তোমার আগের স্বরূপটা মিস করছি। প্রেমের সময় তুমি যেভাবে নিজেকে দেখাতে, এখন তার ছিটেফোঁটাও পাচ্ছি না। বিয়ের পর পরিবর্তন আসে জানি, কিন্তু এভাবে হবে কখনো ভাবিনি।”

বলতে বলতে কোমর জড়িয়ে কাছে টানল নীবিড়। প্রীতি কোমর থেকে নীবিড়ের হাতটা সরিয়ে দিতে দিতে এড়িয়ে গেল। বলল,

-” না বলেই এই মুহূর্তে আসলে?”

-” তোমাকে সারপ্রাইজড করতে। এই প্রিয়স্মিতা অসময়ে আমাকে দেখে তুমি খুশি হয়েছো? নাকি বোর হচ্ছো? উমম, মুখ দেখে তো খুশির কিছুই পাচ্ছি না।”

প্রীতি নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে বলল,

-” নীবিড় তুমি যে নোটগুলো দিয়েছিলে না, সেগুলো এখনও কমপ্লিট হয়নি। আজকে সেগুলো শেষ করার প্ল্যান করেছি। তুমি বসো, আমি কফি দিতে বলছি। আমাকে নোটগুলো শেষ করতে হবে।”

নীবিড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রীতি চটপটে হাতে ওয়ারড্রবের উপর রাখা নোটগুলো টান দিয়ে নিতে থাকে। অবাক করা বিষয় প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্টটা পাশেই নোটের গা ঘেঁষে ছিল। আকস্মিক রিপোর্টটা মেঝেতে পড়ল। আর উড়তে উড়তে নীবিড়ের পায়ের সামনে ঠেকল। প্রীতির চোখ কপালে উঠার জোগাড়। নীবিড় উবু হয়ে রিপোর্ট তুলতে নেয়; উপরে তারিখ আর প্রীতির নাম দেখে কপাল কুঁচকে আসে ওর। রিপোর্ট হাতে তুলে বলল,

-” প্রীতি এখানে তোমার নাম দেখছি। আবার গতকালের তারিখ? কিসের রিপোর্ট এটা? অ্যানি প্রব্লেম প্রীতি?”

প্রীতি থতমত খেল। সে তো ভেবে রেখেছিল, নীবিড়কে কিচ্ছুটি টের পেতে দিবে না। দু-একদিনের মধ্যেই অ্যাবরশন করবে। প্রীতি হাত বাড়িয়ে টান দিয়ে নিয়ে নিবে তার আগেই নীবিড় খুলে ফেলে। নীবিড়ের চোখ স্থির হয় প্রেগন্যান্সি টেস্ট “Positive” লেখা ওয়ার্ডটির উপর। নীবিড় চমকে প্রীতির মুখের দিকে তাকাল। প্রীতি তড়িৎ উল্টো ঘুরে দাঁড়াল। নীবিড় ভাবে প্রীতি লজ্জা পেয়েছে। নীবিড়ের চোখেমুখে আনন্দ ঝিকিমিকি করে ওঠে। পেছন থেকে প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি ঠেকাল। ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল। কোমল স্বরে বলল,

-” আমি বাবা হচ্ছি!”

এক সেকেন্ড থামল। একটা হাত আলগোছে প্রীতির পেটের উপর রাখল। মেদহীন মসৃন পেটে হাত বুলিয়ে বলল,

-” প্রিয়স্মিতা, আমি বাবা হচ্ছি। থ্যাংক ইউ প্রিয়স্মিতা।”

প্রীতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। উত্তেজিত চোখমুখে জিজ্ঞেস করল,

-” এত বড় সুখবর এখনো জানাওনি কেন? গতকালকের তারিখ দেখছি। ফোনেও তো বলতে পারতে।”

প্রীতি রোবটের মতোন দাঁড়িয়ে। মুখটা বিবর্ণ। গম্ভীর গলায় বলল,

-” নীবিড় আমাদের দুজনেরই পড়াশোনা শেষ হয়নি। তুমি বেকার__”

নীবিড় কথার মাঝেই বলে উঠল,

-” ডোন্ট ওয়ারি, বেকার আজ আছি। অনার্সটা কমপ্লিট হলেই চাকুরী পেয়ে যাব। আমার নিজের উপর এতটুকু কনফিডেন্স আছে প্রীতি।”

প্রীতির বি*র*ক্ত লাগছিল। নীবিড় হাঁটু গেড়ে বসল। দুইহাতে প্রীতির কোমর টেনে দূরত্ব ঘুচাল। পেটের উপর চুমু খেয়ে বলল,

-” আমার অংশ। আমার অস্তিত্ব বহনকারী। বাবা খুব খুব খুশি। এত তাড়াতাড়ি আসবে কখনো ভাবিনি। বাবাকে সারপ্রাইজড করে দিলে তো।”

মাথা তুলে তাকিয়ে প্রীতির মুখটা বিবর্ণ খেয়াল হতেই নীবিড়ের কপাল গুটিয়ে আসে। দাঁড়িয়ে প্রীতির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” অ্যাই প্রিয়স্মিতা মন খা’রা’প কেনো?”

প্রীতি নিরুত্তর রইল। নীবিড় মৃদু হেসে বলল,

-” ওহহো, ভাবছো বাচ্চা এলে তোমাকে কম ভালোবাসব। ভালোবাসায় ভাগ বসাবে আমাদের বেবি।”

প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,

-” শোনো প্রীতি, তোমাকে আমি বড্ড বেশিই ভালোবাসি। আমার লাইফের থেকেও বেশি। তোমার জন্য আমি সবটা ছেড়েছি। আর বাচ্চা? আমাদের বাচ্চা তো আমাদের ভালোবাসারই অংশ। এই ছোট্ট প্রাণটা আমাদের ভালবাসারই এক কোমল সাক্ষ্য। আমরা দুজনেই তাকে ভালোবেসে বড় করবো। তোমার জন্য আমার ভালবাসা কখনো ফিকে হবে না। তুমি আমার শ্বাস-প্রশ্বাস। তোমার জন্য এক সুমদ্র ভালোবাসা এই বুকে নিয়েই আমি ম*র*তে চাই।”

.

মাথার উপর পুরনো পাখাটা খটখট আওয়াজ তুলে ঘুরছে। তিনটে পাখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাতাস গায়ে লাগা দূর আওয়াজ দেয়াই যেন ফ্যানটার কাজ। নিচে ঘুমন্ত এক রমণী অস্থির ভাবে নড়াচড়া করছে। ধপ করে চোখ মেলে সে। স্বপ্ন দেখে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসে প্রীতি। কপাল ঘেমে দরদর করে পানি ঝরছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। হাতড়ে পাশের স্টিলের গ্লাসটা হাতে নিল। মুখে নিতে গিয়ে দেখে গ্লাস ফাঁকা। পানির ছিটেফোঁটাও নেই। শুকনো জ্বিভ দিয়ে গলা ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে প্রীতি। এই রাতে সবাই ঘুমিয়ে এখন ডেকে ম*রে গেলেও পানি পাওয়া যাবে না।

হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল প্রীতি। ইদানিং মাঝেমাঝেই নীবিড়ের স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের মাঝে পুরনো অতীতও উঠে আসে। যা আজকাল প্রীতিকে দ*গ্ধ করছে। অবচেতন মনটা চিৎকার করে বারবার বলতে চায়—- তুই পা”পী, পা*পী”ষ্ঠ, তুই নীরিহ মানুষটাকে ঠকিয়েছিস। তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দিনের পর দিন প্র”তারণা করেছিস। তুই এটা
ডিজার্ভস করিস।

.

উচ্চ পদস্থ এক পরিচিতজনের সুপারিশে জেল ডেপুটি সুপারের সাথে সার্থকের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সুবাদেই সপ্তাহে দুবার বোনের সাথে দেখা করার সুযোগ নেয় সে। বোনের জন্য খাবার, ফলমূল, পোশাক দিয়ে যায়। তবে খাবার প্রীতির গলা দিয়ে নামতে চায় না। পোশাক সে সবসময় মলিন সাদামাটা রঙেরটাই পরে থাকে। ভাইয়াকে আসতে বারণ করে। কিন্তু ভাইয়া পারলে যেন রোজ আসে। সেদিন দেখা করার সময় লোহার গ্রিলটা দুই হাতে চেপে ধরে বলল প্রীতি,

-” ভাইয়া আমাকে একবার নীবিড়ের সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করতে পারবি? আমি একবার… শুধু একবার ওর পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে চাই। জানি ও আমার কথা অনুধাবন করার মতো অবস্থায় নেই। তবুও একবার ওর পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমা..”

বোনকে দেখলেই বুকটা হু হু করে ওঠে। ইচ্ছে করে এক ঝটকায় বুকে টেনে নিয়ে পরম আদুরে হাতটা মাথায় বুলিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস সে সুযোগটুকুও যে নেই। গ্রিলের ওপাশে দাঁড়ানো বোনের দিকে তাকালেই চোখ চিকচিক করে ওঠে। সার্থক আঙুলের সাহায্যে চোখের পানি মুছল। বলল,

-” চেষ্টা করলে অনুমতি নিয়ে দেখা করাতে পারব। কিন্তু নিয়েও লাভ নেই। নীরব আর ওর পরিবার এলাউ করবে না। দেখা করতে দিবে না। ঝামেলার সৃষ্টি হবে। নীরব বিচারের সময় ইচ্ছেকে অবধি আনতে দেয়নি। ইচ্ছেকে আনলে ও তোকে ছাড়া থাকতে চাইতো না, কান্না করতো। এটাকে জজের সামনে উপস্থাপন করে তোর সাজা আরো কমানো যেতো। বাট নীরবের সাথে তর্কাতর্কি করেও ও ইচ্ছেকে আমার সাথে আসতে দেয়নি।”

প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-” আচ্ছা থাক। ভাইয়া কখনো যদি নীবিড় সুস্থ হয়। আমার হয়ে বলে দিস; পারলে যেন আমাকে মাফ করে। জানি আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তারপরেও বলছি; তবু যদি তার হৃদয়ে এক ফোঁটা দয়ার জায়গা থাকে, তবে যেন আমাকে মাফ করে।”

____________

নীবিড়কে সিঙ্গাপুর নেয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দেয়া সব পুরোদমে চলছিল। এরমধ্যে নীবিড় গত তিন-চার দিন ধরে বেশি অসুস্থ হয়ে পরে। লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। নীহারিকা হাসপাতালে। নীরব, নিভান হাসপাতালে ছুটাছুটি করছে। সবার আশায় জল‌ ঢেলে, সবাইকে কাঁদিয়ে অবশেষে নীবিড় না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়। ভোর রাতে কম্পিউটারের‌ শব্দ সবকিছু এক নিমিষেই থেমে যায়। মনিটরে ঢেউ তুলে চলা হার্টবিট থমকে যায়।

গত এক সপ্তাহ ধরে নীবিড়ের অবস্থা ক্রমশ অবনতি হচ্ছিল। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি আর নিউরোটক্সিনে স্নায়ুর স্থায়ী ড্যামেজ দুটো একসাথে শরীরকে দুর্বল করে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে তীব্র শ্বাসকষ্ট ও সংক্রমণ সামাল দিতে না পেরে হঠাৎ cardio-respiratory failure হয়ে মৃ*ত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

বাড়িতে শোকের মাতম। নীহারিকার আহাজারিতে চারিপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। মাহবুব সাহেব শোকে পাথর বনে গেছেন। নিভান নিজেকে সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদছে। পাথরের মূর্তির মতোন নীরব বসে।

বাড়ির আঙিনায় ভাইয়ের খাটিয়া। বরই পাতা গরম পানিতে শেষবারের মতোন গোসল দেয়ানো হয়। নীরব সাথে থাকে। বুক ফেটে যাচ্ছে ওর। তবুও ভাইকে আদরে হাতে শেষ স্পর্শটুকু বুকে পাথর বেঁধে করে। সাদা কাফনে মুড়িয়ে দেয়া হয়।

এদিকে চাচ্চুর পোস্টিং খাগড়াছড়িতে হয়েছে। সেখান থেকে আসতে সময় লাগছে বিধায় দেরি করা হচ্ছে। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছে— যতই বউ খারাপ হোক। শেষ দেখাটা তো দেখতে দেয়া লাগে।

আরেকজন বলে উঠল— কী কও এসব? বউয়ের জন্যই এতদিন ভুগে ভুগে ছ্যাড়াডা শ্যাষ পর্যন্ত ম*র*ল। আর সেই বউরে নাকি..

দুপুর বারোটার দিকে সার্থকের কাছে খবরটা পৌঁছায়। প্রীতির সাথে দেখা করতে ছুটে যায়। মনেহয় খুব ভুল হয়ে গেল। প্রীতিকে একবার দেখা করানোর চেষ্টা করলেই ভালো হতো। প্রীতিকে খবরটা শোনায় সার্থক। প্রীতি অসাড়ের মতোন দাঁড়িয়ে রয়। সময় নিয়ে নিরস কণ্ঠস্বরে বলে,

-” একবার শেষ দেখাটা দেখানোর ব্যবস্থাটা করতে পারবি ভাইয়া? একবার জাস্ট একবার। একবার দেখব। দূর থেকেই।”

প্রীতি কাদে না। তবে পাথরের মতন কঠিন দেখাচ্ছে ওকে। সার্থক নিজেকে সামলাতে না পেরে একটা হাত চোখের উপর রাখল। আঙুল দিয়ে চোখ ডলে নেয়।

এদিকে ছেলের লাশ বহন করা কী যে ভারী সেটা একমাত্র একজন পিতাই জানে। মাহবুব সাহেবকে দু’জন ধরে রেখেছেন। সবাই তাড়া দিচ্ছে জানাজা পড়াতে নেয়া হবে। নীরব-নিভান সবার পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। ভাইয়ের খাটিয়া কাঁধে তুলতে গিয়ে হাত দু’টো অবশ হয়ে এল নীরবের। চোখদুটো অসম্ভব লাল ওর। ছেলে মানুষ দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে পারছে না।

নিভান-নীরব সামনে খাটিয়া কাঁধে। চাচ্চু, আবির পিছে, আত্মীয়রা পাশ দিয়ে। নীরবের পা উঠছিল না। একটা খাটিয়া এত ভারী হয়? নিজের কাছের মানুষের খাটিয়া এই প্রথম ধরছে। এতটা ভারী হয় আগে জানা ছিল না।
এগোবে এরমধ্যে পুলিশের জিপ এসে বাড়ির সামনে থামল। সার্থক সবটা ম্যানেজ করে আনতে আনতে দেরি হয়ে যায়।

এদিকে কেউকেউ বলাবলি করল– বউটারে একবার মুখটা দেখতে দাও। কেউ আবার বিরোধীতা করছে। চাচ্চু খাটিয়া নামাতে বললেন। নীরবকে বোঝাতে চাইলেন। নীরব রাগি স্বরে বলল,

-” না, সম্ভব নয়।”

রাগে আরো কিছু বলতে চাইলেও নিজেকে সামলে নেয় নীরব।

প্রীতিকে জীপ থেকে নামানো হয়েছে। ওর পাশে মহিলা পুলিশ সদস্যসহ অদ্রিকা আছে। গায়ে ধবধবে সাদা থ্রি পিস। মাথার উপর ওড়নাটা তোলা। মাথা নুইয়ে রেখেছে। দৃষ্টিজোড়া মাটির দিকে। অনুভূতিশূন্য মূর্তি ঠেকছে ওকে।

ওখানে নীরবের সাথে সার্থকের তর্কাতর্কি শুরু হয়। সার্থক রেগে বলল,

-” তুমি অলওয়েজ বাড়াবাড়ি করো। একজন মানুষ ইতিমধ্যেই শাস্তি ভোগ করছে। সে যদি অনুতপ্ত হয়, তাহলে কি একবার ওর একটা ইচ্ছে, চাওয়া পূরণ করতে দেয়া যায় না? আমার বোন অপরাধ করেছে, ঠিক আছে। বাট এই মুহূর্তে আমরা কি ওর মানসিক অবস্থা কিছুটা বিবেচনা করতে পারি না?”

নীরব কণ্ঠ চড়িয়ে বলল,

-” তোমার বোন তোমার কাছে ছোট হতে পারে। বাট ও যা যা অন্যায় করেছে তখন ও এডাল্ট ছিল। আর জেনেবুঝেই সব করেছে ও। ওর এই অনুতপ্ত মাই ফুট। ওর এই সো কলড অনুশোচনায় আমার ভাই ফিরে আসবে না। প্লীজ, এখন এই মুহূর্তে তোমার বোনকে নিয়ে চলে যাও। আমার ভাইয়ের ল..”

লা*শ কথাটা মুখ দিয়ে বের করতে পারল না নীরব। বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। লাল টকটকে চোখজোড়া নিয়ে আঙুল নাড়িয়ে শুধু বলল,

-” এই মুহূর্তে আমি সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না। প্লিজ, টেক ইয়োর সিস্টার অ্যান্ড লিভ।”

ওদিকের তর্কাতর্কির শব্দগুলো প্রীতির কানে পৌঁছায়। মানুষে ভরা ভিড়ের ফাঁকফোকর গলে খাটিয়াটা দেখা গেল। প্রীতি বুক ভেঙে, হাঁটু গেড়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। হাঁটুজোড়া মাটিতে ঠেকল। দমকা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপর টানা সাদা ওড়নাটা নড়তে লাগল। প্রীতি দৃষ্টি নত করে নেয়। ফের তাকানোর সাহস হলো না। প্রীতির মনে হলো অদৃশ্য হতে কেউ যেন ধিক্কার ছেড়ে বারংবার বলছে,

-” সব ছেড়ে যাকে আপন করেছিলাম, সেই দিল প্রতারণা। ফুল ভেবে গেঁথেছিলাম তাকে বুক পিঞ্জরে। হায়! সে ভাবনা তো ছিলো মস্ত বড় ভুল। আসলে সে যে ছিলো বিষাক্ত। আমার স্বপ্নের গাছে ছড়িয়ে থাকা শুধু কাঁটা।”

#চলবে