#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫৩|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ভার্সিটির মাঠ। বিকেলের নরম কোমল রোদে তাগড়া যুবকেরা ফুটবল খেলায় মাতোয়ারা। আজ নীবিড় আর নীরব দুই দলে। মাঠের এপাশ-ওপাশে কিছু মেয়ে হাঁটছে, কেউ দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে তো আবার কেউ গল্প করছে। প্রীতি আর ওর এক মেয়ে ফ্রেন্ড অদূরে দাঁড়িয়ে। প্রীতির পরনে নেভিব্লু গর্জিয়াস কুর্তি আর লেডিস জিন্স। সোনালী রং করা চুলগুলো মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। হাতে থাকা কোকাকোলার ক্যানটা থেকে থেকে মুখের সামনে ধরছে তো আবার আড়চোখে মাঠের দিকে তাকাচ্ছে।
খেলায় মনোযোগী নীবিড়ের দৃষ্টি বল ছেড়ে বারবার প্রিয়তমার দিকে যাচ্ছে। ওইযে চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে এসে প্রীতির হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে, এই দৃশ্যটুকু নীবিড়ের কাছে যা সুন্দর লাগছে না! একদম অপূর্ব! ইচ্ছে করছে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে নিষ্পলক চাহনিতে চেয়ে চেয়ে শুধু দেখতে।
এদিকে মাঠের হৈচৈয়ে নীবিড় চোখ সরিয়ে খেলায় মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করল। কয়েকপল পরে বলটা নীরবের পায়ে আসে। নীরব বল ড্রিবল করে এগোচ্ছিল। চরম উত্তেজনা, হৈচৈ.. কিক মা*রতেই বল জালে জড়ায়। শুরু হয় একদফা উল্লাস। নীবিড় হতাশ শ্বাস ফেলে নীরবের কাছে এগোল। পিঠ চাপড়ে মজার ছলে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” এই নীরব, তোদের দল তো দুই গোলে এগিয়ে গেল রে ভাই। মানসম্মানের ফালুদা বানাস না ভাই আমার। দ্যাখ ওপাশে প্রিয়স্মিতা দাঁড়িয়ে। আজ ওর সামনে হারলে হিরো থেকে হবো জিরো। তুই অন্তত একটু ছাড়ছুড় দে ভাই।”
কপালের ঘাম এক আঙুলে ছুঁড়ে ফেলল নীরব। বলল,
-” মাথা থেকে এসব প্রীতি ট্রিতির ভূ*ত বের কর। খেলায় মন দে, নাটক পরে কর। আজ তোর খেলায় মন নেই। বলের দিকে নজর না থেকে তোর নজর অন্য কোথাও আঁটকে যাচ্ছে। তাই বলছি, এখনও সময় আছে প্রীতির চিন্তা আউট করে খেলায় মনোনিবেশ কর।”
নীবিড় চোখ কুঁচকে বলল,
-” ওই প্রীতি কী.. হ্যাঁ? প্রীতি ট্রিতি আবার কী? ভাবী বল ভাবী। আমার ইন ফিউচার বউ। তোর ভাবী লাগে, ভাবী। এরপর থেকে এটা মাথায় রাখবি, বুঝলি?”
নীরব চোখ পাকিয়ে তাকাল,
-” বাড়িতে মায়ের কানে খবরটা পৌঁছে দিবো কী? ভাইয়া স্টিল সিঙ্গেল। আর এদিকে মায়ের মেঝো ছেলে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। যা ভাবসাব মনে হচ্ছে ভাইয়ার আগে বিয়ে না সারে।”
নীবিড় ঠোঁট মেলে কিছু বলবে তার আগেই পুরোদমে খেলা শুরু হয়। কিছুক্ষণ দুই দলেরই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল। বলটা নীরবের দখলে ফের আসে। ডান দিক দিয়ে দৌড়ে এগোতে গিয়ে প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পায়ের গোড়ালিতে জোরে চোট পায় নীরব। মুহূর্তেই ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ব্যথার ঝটকায় মুখ বিকৃত হয়ে গেল ওর। দুই হাত দিয়ে গোড়ালি আঁকড়ে ধরে হাঁপাচ্ছে। চারপাশে সবাই জড় হতে থাকে। নীরব ব্যথাতুর চোখমুখে বুট খুলতে শুরু করে। নীবিড় উদ্ভ্রান্তের মতো এগিয়ে এল। নীরবের গোড়ালিটা ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে। এটা দেখেই নীবিড়ের বুকটা কেঁপে উঠল। সামনে হাঁটু গেড়ে বসে অস্থির হাতে নীরবের পা-টা ধরে আস্তে চাপ দিল। কণ্ঠে তীব্র উদ্বেগ নিয়ে শুধাল,
-” নীরব আর কোথায় লেগেছে? খুব ব্যথা পাচ্ছিস? উফ্, বেশ ফুলে গেছে তো।”
নীরব দাঁত চেপে বলল,
-” এতটা কিছু না। সামান্য লেগেছে।”
এই বলে নীরব উঠে দাঁড়াতে নেয়। পায়ের উপর প্রেশার পড়তেই ব্যথায় কপাল কুঁচকে এল। নীবিড় ভাইকে সামলে নিল। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,
-” ব্যথা সহ্য করতে পারছিস না। আবার মাতব্বরি করে একাই হাঁটতে নিচ্ছিস। চল তোকে এখনই ডাক্তার দেখাতে হবে।”
-” আরে একটু সময় দিলে এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।”
নীবিড় একটা রোমাল জোগাড় করে ভিজিয়ে গোড়ালিতে চেপে ধরল। বলল,
-” এসব খেলার চোট হেলাফেলা করা ঠিক হবে না। এক্স-রে করে দেখতে হবে ফ্র্যাকচার হয়েছে কিনা।”
নীরব তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
-” ডাক্তার দেখাতে হবে না। বেশি ব্যথা হলে একটা পেইন কিলার খেয়ে নিলেই চলবে। আর ফোলা একাই ঠিক হয়ে যাবে।”
নীবিড় কোনো কথা শুনল না। একহাতে ভাইয়ের হাত নিজের কাঁধে তুলে নিল। আরেক হাতে শক্ত করে ধরে ধীরেধীরে হাঁটতে সাহায্য করে। তারপর জোর করেই ডাক্তার দেখায়। সে রাতে হলে নীরবের গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। সারারাত জেগে ভাইয়ের মাথায় জলপট্টি দেয় নীবিড়।
.
চোখের পলকে কে’টে গিয়েছে বেশ কটা মাস। প্রত্যাশার পাঁচ মাস চলছে। ইদানিং ওর মুড সুইং হচ্ছে। হঠাৎ নীরবের কাছে ফোন করে বায়নার সুরে বলে—বাসায় বোর লাগছে। একদম কোনোকিছু ভালো লাগছে না। ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছে।
বউয়ের মন ভালো করতে অগত্যা ডিউটি ফেলে বাসায় আসে নীরব। সার্কিট হাউসের পাশের মাঠে শান বাঁধানো বসার স্থানে দু’জনে বসে।
সূর্যের কমলা রঙা আলোয় একদল কিশোর ফুটবল খেলছে। হঠাৎ এক ছেলের পায়ে আ*ঘাত লাগে। সঙ্গে সঙ্গে আরেক ছেলে দৌড়ে আসে। কথা শুনেই বোঝা যায় ওরা ভাই। দেখে অনুমান করা যায় বয়সে বড়জোর দেড়-দুই বছরের তফাত। তবে ভাইয়ের ব্যথায় অপর ছেলেটার চোখ কেমন চিনচিনে হয়ে উঠল। খেলা ফেলে ভাইকে বুকে আগলে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে জোরেশোরে বলল,
-” অ্যাই শোন, আমি আর খেলব না রে। নাফির পায়ে চোট লেগেছে। ওকে বাসায় নিয়ে বরফ দিতে হবে।”
এই বলে ভাইকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটল। এই দৃশ্যটা চোখের সামনে আসতেই নীরবের বুকটা কেঁপে ওঠে। অতীতের কথা মনের ক্যানভাসে উঁকি দেয়। আর সেই দৃশ্যটুকু মনে উঠতেই নিঃশ্বাস আঁটকে এল। বুকের ভেতরটা মুষড়ে যাচ্ছে। চোখজোড়া চিকচিক করে উঠেছে। তন্মধ্যে পাশে বসা প্রত্যাশার ডাকে সম্বিত ফিরে পায় নীরব। নীরবের হাত ধরে মৃদু ঝাঁকি দিয়ে বলল প্রত্যাশা,
-” নীরব, শুনছেন? কী ভাবছেন? এত চুপচাপ আছেন যে।”
নীরব নিজেকে সামলে নিল। প্রত্যাশার সামনে নিজেকে প্রকাশ না করে বলল,
-” না, তেমন কিছু না। বলো?”
-” বাদাম খাবো।”
বাদামওয়ালাকে দেখিয়ে বলে প্রত্যাশা। নীরব খোসা ছাড়িয়ে ফুঁ দিয়ে প্রত্যাশার হাতে তুলে দিচ্ছে। প্রত্যাশা খাচ্ছে আর পা দুটো দুলাচ্ছে। চিবুতে চিবুতে বলল,
-” শুধু আমাকেই কেন দিচ্ছেন? আপনিও খান।”
-” তুমি তো আর একা নও। তোমাকে দিচ্ছি মানে একসাথে দু’জনকে খাওয়াচ্ছি। আমার বেবিকে আর তার মাম্মাকেও।”
প্রত্যাশার অধরে হাসি ফুটল। পা দুটো দুলাতে দুলাতে বলল,
-” জানেন, আমি বাদাম গাছ দেখেছি। নানুর বাসায় গিয়েছিলাম তখন। মামারা বাদামের চাষ করে। চরে ঘুরতে গিয়ে কাঁচা বাদাম ছিঁড়েছিলাম। ইয়া আল্লাহ, একেকটা গাছে পাতার চেয়ে বাদামই দেখি বেশি। বাদাম গাছ এত ফল দেয় না।”
-” হোয়াট? ফল দেয় মানে?”
-” হুঁ, ফলই তো। বাদাম ফলের কথা বলছি।”
-” স্টুপিড একটা। বাদাম ফল নয়, বাদাম হলো শস্য।”
স্টুপিড বলায় প্রত্যাশার মুখটা গম্ভীর হয়ে এল। ঠোঁট বাঁকিয়ে গম্ভীর সুরে বলল,
-” ওই হলো একই।”
এর সাথে বেশি কথা বললে নিজের ভুল শুধরানো দূর উল্টো অভিমান করে থাকবে। তাই নীরব কথা না বাড়িয়ে বলল,
-” হয়েছে এবার উঠো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাসায় চলো।”
____________
গত সপ্তাহে আদালত রায় ঘোষণা দিয়েছে। ড্রা”গ সিন্ডিকেটের হেড, ড্রা’গের চো’রাচা’লান করে কোটি কোটি কালো টাকা উপার্জনকারী তানিয়া আর তার সিন্ডিকেটসহ যারা সাহায্যকারী ছিল সবারই যথাযথ সাজার ঘোষণা দেয়া হয়। জীবন ধ্বং*সী নিষিদ্ধ ড্রা’গ কত মানুষের জীবন ধ্বং*স করেছে ইয়াত্তা নেই। এটা গুরুতর অপরাধ। কতকত নীরিহ প্রাণ বিপথে গেছে, নেশায় আ*সক্ত হয়েছে, মাত্রাতিরিক্ত অ্যাডিক্টেড হয়ে কেউ বা আকালেই ঝরে গিয়েছে, যাচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে নীবিড়ের ব্যাপারটাও স্বীকার করেছে তানিয়া। সিন্ডিকেটের হেড অপরাধী তানিয়ার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। আদালত সকল সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তানিয়ার মৃ*ত্যুদন্ড রায় দেয়।
প্রীতির তিনটি কেসের জন্য বাদির আইনজীবী দশ-বারো বছরের কারাদণ্ড দাবি করেছিলেন। তবে সার্থকের ধরা আইনজীবীর প্রচেষ্টায়, মেয়ে ইচ্ছের ভবিষ্যত মননে নিয়ে সাত বছরের জেল দেয় আদালত। সার্থক তবুও সিদ্ধান্ত নেয় রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে। যদি আরেকটু হলেও বোনের সাজাটা কমানো যায়।
.
.
সকালে নাস্তার টেবিলে মাহবুব সাহেব দুই ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন— রাতে যেন ওনার সাথে দেখা করেন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে। রাত দশটা বাজে। বাবা-মায়ের রুমে নিভান-নীরব দাঁড়িয়ে। প্রত্যাশা আর নীলাশাকেও ডাকা হয়। মাহবুব সাহেব সিঙ্গেল সোফায় বসে। নীহারিকা বিছানার একপাশে বসে। মাহবুব সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
-” দেখ বাবারা, আমার বয়স হয়েছে। শরীরটাও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। কখন কী হয়! বয়স হয়েছে আল্লাহ দীর্ঘদিন হায়াত দিয়েছেন, শুকরিয়া। এখন সবসময় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই থাকি। আমার যেটুকু আছে সবটা তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দেয়াই ভালো।”
ব্যাংকের চেক সামনে। কলমটা হাতে তুলতে তুলতে বললেন,
-” বাড়িসহ আঙিনা আমাদের দুই ভাইয়ের নামে। যতদিন পারো একসাথে মিলেমিশে থেকো। তবে এক সময় না একসময় তো প্রয়োজনে আলাদা বাড়ি করতেই হয়। বড় আঙিনা আছে, ভাগবাটোয়ারা করে যার যার মতো বাড়ি করে নিয়ো। আবিরদেরটা নায্য ভাবে দিও। যদিও আমি জানি আমার সন্তানেরা কখনো বেইনসাফি করবে না। তবুও বাবা হিসেবে বলা আমার দায়িত্ব। জানি না নীবিড় কখনো সুস্থ হবে কী না!”
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠল। থেমে গেলেন মাহবুব সাহেব। চশমাটা সরিয়ে চোখ মুছলেন। ফের বললেন,
-” নীবিড়ের ভাগেরটা ইচ্ছেকে দিও।”
নামকরা ফার্মে উচ্চ পদে দীর্ঘ সময় চাকুরী করেছেন মাহবুব সাহেব। হ্যান্ডসাম স্যালারি ড্র করতেন। সন্তানদের মানুষ করেও বেশকিছু টাকা ব্যাংকে জমিয়েছিলেন। খরচাপাতি করে এখন অবশ্য বিশ লাখ সামথিং আছে। নিভান চাকরি পাওয়ার পর সেই সংসারে বেশি টাকা দেয়। এখনো সেই সংসারে বেশি অংশ দিয়ে থাকে। নীবিড়ের চিকিৎসার ব্যয় নীরব বহন করছে। তারপর তার যা বেতন দুহাত ভরে খরচা করতে গিয়ে, সবমিলিয়ে সংসারে কমই দেয়া হয়। তবে মাঝেমাঝেই সবার জন্য এটাওটা দেয়া হয়। চেকের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন মাহবুব সাহেব,
-” এখানে বিশ লাখ টাকা আছে। তোমাদের দুইভাইয়ের পাঁচ লাখ করে দিচ্ছি, ইচ্ছেরটা ওর নামে আলাদা রাখব। আর বাকি পাঁচ লাখ তোমার মায়ের জন্য।”
চেকে সই করতে নিলে নিভান থামিয়ে দিল,
-” বাবা এসব রাখো। তোমাকে এসব ভাগবাটোয়ারা করতে হবে না। সবটা মায়ের নামেই রাখো। আর হ্যাঁ, ইচ্ছের জন্য কিছু করতে চাইলে সেটা আলাদা।”
নীরব বলে উঠল,
-” বাবা আমার মনেহয় আমার বা ভাইয়ার কারোরই টাকাগুলোর প্রয়োজন নেই। তোমাদের দোয়ায় আল্লাহ যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, ইনশা-আল্লাহ গোটা জীবন ভালোভাবে কে*টে যাবে। বাবা আমি বলতে চাইছি, এখান থেকে ইচ্ছেরটা ইচ্ছের জন্য রেখে বাকিটা যদি নীবিড়ের ট্রিটমেন্টের জন্য লাগানো যায়। বছরখানেক হলো নীবিড়ের থেরাপি চলছে। বাট কোনো উন্নতি নেই। উন্নতির জন্য বিদেশে নিলে যদি কিছুটা হলেও উন্নতি হয়।”
নিভানও সাথেসাথে সহমত পোষণ করল। ছেলেদের কথা আর ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখে মাহবুব সাহেব গর্বে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলেন। টাকার জন্যই আজকাল মানুষ অহরহ পা*প করছে, ঘুষ খাচ্ছে, খু*নাখু*নি পর্যন্ত করছে। অথচ ভাইয়ের প্রতি এদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে আবেগাপ্লুত হলেন ভদ্রলোক। নীহারিকাও ছেলেকে কাছে পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সহসাই বললেন,
-” ওরা ঠিকই বলেছে। নিভানের বাবা তাই করো। আল্লাহ যেনো এবারে আমার বুকের মানিক আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। এ জীবনে আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই আমার। আমার ছেলেরা হাসিখুশি থাকলেই আমি খুশি। আমার নীবিড় সুস্থ হোক। ওর মেয়েটাকে, ওর র*ক্তকে আঁকড়ে ধরে বাঁচুক।”
বলতে বলতে কেঁদে উঠলেন নীহারিকা। কান্নার শব্দ আটকাতে শাড়ির আঁচল টেনে মুখে গুজলেন। মাহবুব সাহেব ছেলেদের কথায় সন্তুষ্ট। তবুও বউমাদেরকেও জিজ্ঞেস করেন। তাদের মতামত কী? নীলাশা-প্রত্যাশাও একই কথা বলল। এতে তারা খুশি।
___________
রাত নয়টার দিকে পড়ার টেবিলে বসে প্রীতি। হাতে পেন, কিছু নোট করছিল। হঠাৎ হাতের উপর উষ্ণ স্পর্শ পেল। লম্বা লম্বা, রুক্ষ আঙুল দিয়ে কেউ তার আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজল। প্রীতির কপালে বিরক্তির ছাঁট পড়ল। নীবিড় ঝুঁকে প্রীতির কানের পাশে মুখটা নিল। ফিসফিসিয়ে বলল,
-” এখন পড়া বাদ দাও। হাজবেন্ডকে টাইম দাও।”
অপর হাত দিয়ে নীবিড়ের হাতটা সরিয়ে দেয় প্রীতি। বলল,
-” নীবিড়, সামনে প্রেজেন্টেশন আছে। আর হঠাৎ এই সময় তুমি?”
নীবিড় প্রীতির হাত ধরে টান দিয়ে সামনে দাঁড় করাল। অভিযোগের সুরে বলল,
-” আমি জানি তুমি ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া স্বাভাবিক। তবে প্রীতি আমি রিলাইজড করলাম আমি আগের প্রীতিকে মিস করছি। বিয়ের পর থেকে তোমার আগের স্বরূপটা মিস করছি। প্রেমের সময় তুমি যেভাবে নিজেকে দেখাতে, এখন তার ছিটেফোঁটাও পাচ্ছি না। বিয়ের পর পরিবর্তন আসে জানি, কিন্তু এভাবে হবে কখনো ভাবিনি।”
বলতে বলতে কোমর জড়িয়ে কাছে টানল নীবিড়। প্রীতি কোমর থেকে নীবিড়ের হাতটা সরিয়ে দিতে দিতে এড়িয়ে গেল। বলল,
-” না বলেই এই মুহূর্তে আসলে?”
-” তোমাকে সারপ্রাইজড করতে। এই প্রিয়স্মিতা অসময়ে আমাকে দেখে তুমি খুশি হয়েছো? নাকি বোর হচ্ছো? উমম, মুখ দেখে তো খুশির কিছুই পাচ্ছি না।”
প্রীতি নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে বলল,
-” নীবিড় তুমি যে নোটগুলো দিয়েছিলে না, সেগুলো এখনও কমপ্লিট হয়নি। আজকে সেগুলো শেষ করার প্ল্যান করেছি। তুমি বসো, আমি কফি দিতে বলছি। আমাকে নোটগুলো শেষ করতে হবে।”
নীবিড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রীতি চটপটে হাতে ওয়ারড্রবের উপর রাখা নোটগুলো টান দিয়ে নিতে থাকে। অবাক করা বিষয় প্রেগন্যান্সি টেস্টের রিপোর্টটা পাশেই নোটের গা ঘেঁষে ছিল। আকস্মিক রিপোর্টটা মেঝেতে পড়ল। আর উড়তে উড়তে নীবিড়ের পায়ের সামনে ঠেকল। প্রীতির চোখ কপালে উঠার জোগাড়। নীবিড় উবু হয়ে রিপোর্ট তুলতে নেয়; উপরে তারিখ আর প্রীতির নাম দেখে কপাল কুঁচকে আসে ওর। রিপোর্ট হাতে তুলে বলল,
-” প্রীতি এখানে তোমার নাম দেখছি। আবার গতকালের তারিখ? কিসের রিপোর্ট এটা? অ্যানি প্রব্লেম প্রীতি?”
প্রীতি থতমত খেল। সে তো ভেবে রেখেছিল, নীবিড়কে কিচ্ছুটি টের পেতে দিবে না। দু-একদিনের মধ্যেই অ্যাবরশন করবে। প্রীতি হাত বাড়িয়ে টান দিয়ে নিয়ে নিবে তার আগেই নীবিড় খুলে ফেলে। নীবিড়ের চোখ স্থির হয় প্রেগন্যান্সি টেস্ট “Positive” লেখা ওয়ার্ডটির উপর। নীবিড় চমকে প্রীতির মুখের দিকে তাকাল। প্রীতি তড়িৎ উল্টো ঘুরে দাঁড়াল। নীবিড় ভাবে প্রীতি লজ্জা পেয়েছে। নীবিড়ের চোখেমুখে আনন্দ ঝিকিমিকি করে ওঠে। পেছন থেকে প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি ঠেকাল। ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল। কোমল স্বরে বলল,
-” আমি বাবা হচ্ছি!”
এক সেকেন্ড থামল। একটা হাত আলগোছে প্রীতির পেটের উপর রাখল। মেদহীন মসৃন পেটে হাত বুলিয়ে বলল,
-” প্রিয়স্মিতা, আমি বাবা হচ্ছি। থ্যাংক ইউ প্রিয়স্মিতা।”
প্রীতিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। উত্তেজিত চোখমুখে জিজ্ঞেস করল,
-” এত বড় সুখবর এখনো জানাওনি কেন? গতকালকের তারিখ দেখছি। ফোনেও তো বলতে পারতে।”
প্রীতি রোবটের মতোন দাঁড়িয়ে। মুখটা বিবর্ণ। গম্ভীর গলায় বলল,
-” নীবিড় আমাদের দুজনেরই পড়াশোনা শেষ হয়নি। তুমি বেকার__”
নীবিড় কথার মাঝেই বলে উঠল,
-” ডোন্ট ওয়ারি, বেকার আজ আছি। অনার্সটা কমপ্লিট হলেই চাকুরী পেয়ে যাব। আমার নিজের উপর এতটুকু কনফিডেন্স আছে প্রীতি।”
প্রীতির বি*র*ক্ত লাগছিল। নীবিড় হাঁটু গেড়ে বসল। দুইহাতে প্রীতির কোমর টেনে দূরত্ব ঘুচাল। পেটের উপর চুমু খেয়ে বলল,
-” আমার অংশ। আমার অস্তিত্ব বহনকারী। বাবা খুব খুব খুশি। এত তাড়াতাড়ি আসবে কখনো ভাবিনি। বাবাকে সারপ্রাইজড করে দিলে তো।”
মাথা তুলে তাকিয়ে প্রীতির মুখটা বিবর্ণ খেয়াল হতেই নীবিড়ের কপাল গুটিয়ে আসে। দাঁড়িয়ে প্রীতির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” অ্যাই প্রিয়স্মিতা মন খা’রা’প কেনো?”
প্রীতি নিরুত্তর রইল। নীবিড় মৃদু হেসে বলল,
-” ওহহো, ভাবছো বাচ্চা এলে তোমাকে কম ভালোবাসব। ভালোবাসায় ভাগ বসাবে আমাদের বেবি।”
প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল,
-” শোনো প্রীতি, তোমাকে আমি বড্ড বেশিই ভালোবাসি। আমার লাইফের থেকেও বেশি। তোমার জন্য আমি সবটা ছেড়েছি। আর বাচ্চা? আমাদের বাচ্চা তো আমাদের ভালোবাসারই অংশ। এই ছোট্ট প্রাণটা আমাদের ভালবাসারই এক কোমল সাক্ষ্য। আমরা দুজনেই তাকে ভালোবেসে বড় করবো। তোমার জন্য আমার ভালবাসা কখনো ফিকে হবে না। তুমি আমার শ্বাস-প্রশ্বাস। তোমার জন্য এক সুমদ্র ভালোবাসা এই বুকে নিয়েই আমি ম*র*তে চাই।”
.
মাথার উপর পুরনো পাখাটা খটখট আওয়াজ তুলে ঘুরছে। তিনটে পাখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাতাস গায়ে লাগা দূর আওয়াজ দেয়াই যেন ফ্যানটার কাজ। নিচে ঘুমন্ত এক রমণী অস্থির ভাবে নড়াচড়া করছে। ধপ করে চোখ মেলে সে। স্বপ্ন দেখে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসে প্রীতি। কপাল ঘেমে দরদর করে পানি ঝরছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। হাতড়ে পাশের স্টিলের গ্লাসটা হাতে নিল। মুখে নিতে গিয়ে দেখে গ্লাস ফাঁকা। পানির ছিটেফোঁটাও নেই। শুকনো জ্বিভ দিয়ে গলা ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে প্রীতি। এই রাতে সবাই ঘুমিয়ে এখন ডেকে ম*রে গেলেও পানি পাওয়া যাবে না।
হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল প্রীতি। ইদানিং মাঝেমাঝেই নীবিড়ের স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের মাঝে পুরনো অতীতও উঠে আসে। যা আজকাল প্রীতিকে দ*গ্ধ করছে। অবচেতন মনটা চিৎকার করে বারবার বলতে চায়—- তুই পা”পী, পা*পী”ষ্ঠ, তুই নীরিহ মানুষটাকে ঠকিয়েছিস। তার নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দিনের পর দিন প্র”তারণা করেছিস। তুই এটা
ডিজার্ভস করিস।
.
উচ্চ পদস্থ এক পরিচিতজনের সুপারিশে জেল ডেপুটি সুপারের সাথে সার্থকের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সুবাদেই সপ্তাহে দুবার বোনের সাথে দেখা করার সুযোগ নেয় সে। বোনের জন্য খাবার, ফলমূল, পোশাক দিয়ে যায়। তবে খাবার প্রীতির গলা দিয়ে নামতে চায় না। পোশাক সে সবসময় মলিন সাদামাটা রঙেরটাই পরে থাকে। ভাইয়াকে আসতে বারণ করে। কিন্তু ভাইয়া পারলে যেন রোজ আসে। সেদিন দেখা করার সময় লোহার গ্রিলটা দুই হাতে চেপে ধরে বলল প্রীতি,
-” ভাইয়া আমাকে একবার নীবিড়ের সাথে দেখা করানোর ব্যবস্থা করতে পারবি? আমি একবার… শুধু একবার ওর পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে চাই। জানি ও আমার কথা অনুধাবন করার মতো অবস্থায় নেই। তবুও একবার ওর পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষমা..”
বোনকে দেখলেই বুকটা হু হু করে ওঠে। ইচ্ছে করে এক ঝটকায় বুকে টেনে নিয়ে পরম আদুরে হাতটা মাথায় বুলিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস সে সুযোগটুকুও যে নেই। গ্রিলের ওপাশে দাঁড়ানো বোনের দিকে তাকালেই চোখ চিকচিক করে ওঠে। সার্থক আঙুলের সাহায্যে চোখের পানি মুছল। বলল,
-” চেষ্টা করলে অনুমতি নিয়ে দেখা করাতে পারব। কিন্তু নিয়েও লাভ নেই। নীরব আর ওর পরিবার এলাউ করবে না। দেখা করতে দিবে না। ঝামেলার সৃষ্টি হবে। নীরব বিচারের সময় ইচ্ছেকে অবধি আনতে দেয়নি। ইচ্ছেকে আনলে ও তোকে ছাড়া থাকতে চাইতো না, কান্না করতো। এটাকে জজের সামনে উপস্থাপন করে তোর সাজা আরো কমানো যেতো। বাট নীরবের সাথে তর্কাতর্কি করেও ও ইচ্ছেকে আমার সাথে আসতে দেয়নি।”
প্রীতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” আচ্ছা থাক। ভাইয়া কখনো যদি নীবিড় সুস্থ হয়। আমার হয়ে বলে দিস; পারলে যেন আমাকে মাফ করে। জানি আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তারপরেও বলছি; তবু যদি তার হৃদয়ে এক ফোঁটা দয়ার জায়গা থাকে, তবে যেন আমাকে মাফ করে।”
____________
নীবিড়কে সিঙ্গাপুর নেয়ার জন্য কাগজপত্র জমা দেয়া সব পুরোদমে চলছিল। এরমধ্যে নীবিড় গত তিন-চার দিন ধরে বেশি অসুস্থ হয়ে পরে। লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। নীহারিকা হাসপাতালে। নীরব, নিভান হাসপাতালে ছুটাছুটি করছে। সবার আশায় জল ঢেলে, সবাইকে কাঁদিয়ে অবশেষে নীবিড় না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়। ভোর রাতে কম্পিউটারের শব্দ সবকিছু এক নিমিষেই থেমে যায়। মনিটরে ঢেউ তুলে চলা হার্টবিট থমকে যায়।
গত এক সপ্তাহ ধরে নীবিড়ের অবস্থা ক্রমশ অবনতি হচ্ছিল। ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি আর নিউরোটক্সিনে স্নায়ুর স্থায়ী ড্যামেজ দুটো একসাথে শরীরকে দুর্বল করে দিয়েছে। শেষ মুহূর্তে তীব্র শ্বাসকষ্ট ও সংক্রমণ সামাল দিতে না পেরে হঠাৎ cardio-respiratory failure হয়ে মৃ*ত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
বাড়িতে শোকের মাতম। নীহারিকার আহাজারিতে চারিপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। মাহবুব সাহেব শোকে পাথর বনে গেছেন। নিভান নিজেকে সামলাতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদছে। পাথরের মূর্তির মতোন নীরব বসে।
বাড়ির আঙিনায় ভাইয়ের খাটিয়া। বরই পাতা গরম পানিতে শেষবারের মতোন গোসল দেয়ানো হয়। নীরব সাথে থাকে। বুক ফেটে যাচ্ছে ওর। তবুও ভাইকে আদরে হাতে শেষ স্পর্শটুকু বুকে পাথর বেঁধে করে। সাদা কাফনে মুড়িয়ে দেয়া হয়।
এদিকে চাচ্চুর পোস্টিং খাগড়াছড়িতে হয়েছে। সেখান থেকে আসতে সময় লাগছে বিধায় দেরি করা হচ্ছে। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছে— যতই বউ খারাপ হোক। শেষ দেখাটা তো দেখতে দেয়া লাগে।
আরেকজন বলে উঠল— কী কও এসব? বউয়ের জন্যই এতদিন ভুগে ভুগে ছ্যাড়াডা শ্যাষ পর্যন্ত ম*র*ল। আর সেই বউরে নাকি..
দুপুর বারোটার দিকে সার্থকের কাছে খবরটা পৌঁছায়। প্রীতির সাথে দেখা করতে ছুটে যায়। মনেহয় খুব ভুল হয়ে গেল। প্রীতিকে একবার দেখা করানোর চেষ্টা করলেই ভালো হতো। প্রীতিকে খবরটা শোনায় সার্থক। প্রীতি অসাড়ের মতোন দাঁড়িয়ে রয়। সময় নিয়ে নিরস কণ্ঠস্বরে বলে,
-” একবার শেষ দেখাটা দেখানোর ব্যবস্থাটা করতে পারবি ভাইয়া? একবার জাস্ট একবার। একবার দেখব। দূর থেকেই।”
প্রীতি কাদে না। তবে পাথরের মতন কঠিন দেখাচ্ছে ওকে। সার্থক নিজেকে সামলাতে না পেরে একটা হাত চোখের উপর রাখল। আঙুল দিয়ে চোখ ডলে নেয়।
এদিকে ছেলের লাশ বহন করা কী যে ভারী সেটা একমাত্র একজন পিতাই জানে। মাহবুব সাহেবকে দু’জন ধরে রেখেছেন। সবাই তাড়া দিচ্ছে জানাজা পড়াতে নেয়া হবে। নীরব-নিভান সবার পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। ভাইয়ের খাটিয়া কাঁধে তুলতে গিয়ে হাত দু’টো অবশ হয়ে এল নীরবের। চোখদুটো অসম্ভব লাল ওর। ছেলে মানুষ দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে পারছে না।
নিভান-নীরব সামনে খাটিয়া কাঁধে। চাচ্চু, আবির পিছে, আত্মীয়রা পাশ দিয়ে। নীরবের পা উঠছিল না। একটা খাটিয়া এত ভারী হয়? নিজের কাছের মানুষের খাটিয়া এই প্রথম ধরছে। এতটা ভারী হয় আগে জানা ছিল না।
এগোবে এরমধ্যে পুলিশের জিপ এসে বাড়ির সামনে থামল। সার্থক সবটা ম্যানেজ করে আনতে আনতে দেরি হয়ে যায়।
এদিকে কেউকেউ বলাবলি করল– বউটারে একবার মুখটা দেখতে দাও। কেউ আবার বিরোধীতা করছে। চাচ্চু খাটিয়া নামাতে বললেন। নীরবকে বোঝাতে চাইলেন। নীরব রাগি স্বরে বলল,
-” না, সম্ভব নয়।”
রাগে আরো কিছু বলতে চাইলেও নিজেকে সামলে নেয় নীরব।
প্রীতিকে জীপ থেকে নামানো হয়েছে। ওর পাশে মহিলা পুলিশ সদস্যসহ অদ্রিকা আছে। গায়ে ধবধবে সাদা থ্রি পিস। মাথার উপর ওড়নাটা তোলা। মাথা নুইয়ে রেখেছে। দৃষ্টিজোড়া মাটির দিকে। অনুভূতিশূন্য মূর্তি ঠেকছে ওকে।
ওখানে নীরবের সাথে সার্থকের তর্কাতর্কি শুরু হয়। সার্থক রেগে বলল,
-” তুমি অলওয়েজ বাড়াবাড়ি করো। একজন মানুষ ইতিমধ্যেই শাস্তি ভোগ করছে। সে যদি অনুতপ্ত হয়, তাহলে কি একবার ওর একটা ইচ্ছে, চাওয়া পূরণ করতে দেয়া যায় না? আমার বোন অপরাধ করেছে, ঠিক আছে। বাট এই মুহূর্তে আমরা কি ওর মানসিক অবস্থা কিছুটা বিবেচনা করতে পারি না?”
নীরব কণ্ঠ চড়িয়ে বলল,
-” তোমার বোন তোমার কাছে ছোট হতে পারে। বাট ও যা যা অন্যায় করেছে তখন ও এডাল্ট ছিল। আর জেনেবুঝেই সব করেছে ও। ওর এই অনুতপ্ত মাই ফুট। ওর এই সো কলড অনুশোচনায় আমার ভাই ফিরে আসবে না। প্লীজ, এখন এই মুহূর্তে তোমার বোনকে নিয়ে চলে যাও। আমার ভাইয়ের ল..”
লা*শ কথাটা মুখ দিয়ে বের করতে পারল না নীরব। বুকের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। লাল টকটকে চোখজোড়া নিয়ে আঙুল নাড়িয়ে শুধু বলল,
-” এই মুহূর্তে আমি সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না। প্লিজ, টেক ইয়োর সিস্টার অ্যান্ড লিভ।”
ওদিকের তর্কাতর্কির শব্দগুলো প্রীতির কানে পৌঁছায়। মানুষে ভরা ভিড়ের ফাঁকফোকর গলে খাটিয়াটা দেখা গেল। প্রীতি বুক ভেঙে, হাঁটু গেড়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। হাঁটুজোড়া মাটিতে ঠেকল। দমকা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার উপর টানা সাদা ওড়নাটা নড়তে লাগল। প্রীতি দৃষ্টি নত করে নেয়। ফের তাকানোর সাহস হলো না। প্রীতির মনে হলো অদৃশ্য হতে কেউ যেন ধিক্কার ছেড়ে বারংবার বলছে,
-” সব ছেড়ে যাকে আপন করেছিলাম, সেই দিল প্রতারণা। ফুল ভেবে গেঁথেছিলাম তাকে বুক পিঞ্জরে। হায়! সে ভাবনা তো ছিলো মস্ত বড় ভুল। আসলে সে যে ছিলো বিষাক্ত। আমার স্বপ্নের গাছে ছড়িয়ে থাকা শুধু কাঁটা।”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
সার্থক ব্যর্থ হয়ে মাহবুব সাহেবের দিকে এগোয়। হাতজোড় করে অনুনয়ের সুরে বলল,
-” আংকেল প্লীজ, একটিবার শুধু একটিবার দেখার সুযোগটা দিন। এই মুহূর্তে আমার বোনের মানসিক অবস্থাটাও একটু কনসিডার করুন। একটা মানুষ অনুতপ্ত হলে, তাকে সুযোগ দেয়া যায় না? মানুষ রাগে জিদে অন্ধ হয়ে অনেক ভুল করে বসে। সেই ভুলের মাশুলও তাকে গুণতে হয়। একটু অনেস্টলি ভাবলে দেখবেন, সবচেয়ে ক্ষতিটা কিন্তু আমার বোনেরই হলো। যদিও এটা ওরই কৃতকর্মের ফল। তবুও নিজের বোন তো, সহ্য করা যায় না।”
নীরব পাশ থেকে উচ্চস্বরে বলল,
-” তোমার বোনের ভুল কোনো সাধারণ মামুলি ভুল নয়। তোমার বোন একটা খু*নি।”
মাহবুব সাহেব ভেজা চোখজোড়া মুছে নিলেন। নিচু স্বরে বললেন,
-” নীরব থামো। হ্যাঁ, ও অপরাধ করেছে, অন্যায় করেছে। তবুও একজন মানুষ তার স্বামীকে শেষবারের মতো দেখার অধিকার রাখে। আমরা ওর সেই অধিকারটুকু কেড়ে নিতে পারি না।”
নীরব তৎক্ষণাৎ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠল,
-” একজন খু*নির কোনো অধিকার থাকে না বাবা। ওর দেখার অধিকার নেই। সেই অধিকার ও নিজে শেষ করেছে। ও একটা সাইলেন্ট কিলার, একজন অভিনেত্রীও। দিনের পর দিন আমার ভাইয়ের সাথে অভিনয় করে গেছে। ও একটা বিশ্বাসঘাতক, নীরবঘাতক। শি ইজ বোথ ডাইরেক্টলি অ্যান্ড ইন্ডাইরেক্টলি রেসপন্সিবল ফর নীবিড়’স ডেথ। সো নো মার্সি।”
মাহবুব সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গলার স্বর কঠিন করে বললেন,
-” নীরব আমি যা বলছি শুনো। সময় ন*ষ্ট হচ্ছে। একটা নজর দেখতে দিলে এমন কিছু হবে না। শেষবারের মতো শেষ দেখাটা রোধ করলে অন্যায় করা হবে। আশাকরি আমার উপর দিয়ে আর কিছু বলবে না তুমি।”
নীরব আঙুলগুলো পাকিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করল। দাঁত চেপে বলল,
-” ওকে দয়া দেখাতে যেয়ো না বাবা। ও সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য নয়।”
মাহবুব সাহেব ছোটো ভাইকে ইশারা করতেই ছোটো চাচ্চু নীরব কে টেনে ওপাশে নিয়ে গেল। বাবার কথার উপর দিয়ে আর কিছু বলে বেয়াদবি করতে চাইল না নীরব। উল্টোদিক ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলাল।
এরমধ্যে মাহবুব সাহেব নিভানকে ডেকে উঠলেন,
-” নিভান?”
নিভান তাকাতেই বাবার নিঃশব্দে করা আদেশ বুঝে নিল। নিভান বাঁধনটা খুলতে থাকে। চোখের পানি টপটপ করে পড়তে লাগলো ওর। বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে ভাই হারানোর বেদনায়।
সার্থক প্রীতিকে আগলে ধরে এগিয়ে আনে। মুখের উপর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে দেয়া হয়। আর সরিয়ে দিতেই ফর্সা মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল। দুই টুকরো সাদা কাপড় নাকে দেয়া, চোখের ঘন পাপড়ি মুদে আছে। একদম নিষ্পাপ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে প্রশান্তির সহিত ঘুমে বিভোর।
প্রীতির বুকটা ধক করে উঠল। সেদিন হাসপাতালে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গিয়েও হাতটা নামিয়ে নিয়েছিল। অদ্ভুতভাবে আজ কেনো জানি একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু, হায়! আফসোস! এই প্রথম মন থেকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে জাগলেও, ইচ্ছেটা পূর্ণ করার সাহস বা অধিকারবোধ কোনোটাই জোগাতে পারল না প্রীতি। চোখের কোল ঘেঁষে উষ্ণ নোনতা জল গড়িয়ে পড়ল নিঃশব্দে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না প্রীতি। পাশে দাঁড়ানো ভাইয়ের বুকে মাথাটা গুঁজে নিল।
মাহবুব সাহেব ইশারা করতেই সার্থক বোনকে টান দিয়ে দূরে সরে গেল। চোখের পলকে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে সবাই বেরিয়ে গেল। যতদূর দেখা গেল প্রীতির চোখদুটো ওই খাটিয়ার দিকে চেয়ে রইল। প্রীতি শব্দ করে কাঁদে না। শুধু নিঃশব্দে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়ল। অবচেতন মনটা বলতে চাইল,
-” মাফ করে দিও নীবিড়। জানি, আমার শব্দগুলো তোমার কাছে পৌঁছবে না। তবুও বলতে চাই, আজ আমি অনুতপ্ত। আমার কারণে তুমি এত অকালেই চলে যাচ্ছ। আফসোস আমাদের মেয়েটার জন্য। তার পা’পী মা তাকে এতিম করল। বাবার স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে। এ-ও জানি এত এত পা”পের কোনো ক্ষমা নেই। তবুও যে আমি আজ ক্ষমাপ্রার্থী।”
___________
ছোট্ট ইচ্ছে অতকিছু বোঝে না। পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা কীই-বা বুঝবে। নিভান তখন কোলে করে নিয়ে শেষবারের মতন বাবার মুখটা দেখিয়েছিল। বলেছিল– পাপাকে আদর করে দাও।
দিদুন ভেতরে চিৎকার করে কান্না করছিল। সবার কান্নাকাটি দেখে তার ছোট্ট মনটা খারাপ করছে। মিষ্টি মুখটা শুকনো করে ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুপল বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মুখটা ভার করেই বড় পাপার কথা রাখতে হোক আর অদৃশ্য টানেই হোক ইচ্ছে বাবার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। উফ্! শেষবারের মতন ছুঁয়ে দেয় বাবাকে। শেষ আদরটুকু আঁকে বাবার কপালে। আফসোস! বাবা টেরই পেলো না। অনুভব করতে পারল না।
.
ইচ্ছে মন খারাপ করে ভেতরে এককোণে দাঁড়িয়ে ছিলো। এরমধ্যে আনিশা বাইরে থেকে দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
-” ইচ্ছে তোমার মাম্মা এসেছে।”
ইচ্ছের চোখ চকচক করে উঠল।
-” মাম্মা?”
-” হ্যাঁ তোমার মাম্মাকে দেখলাম।”
-” কোথায় মাম্মা? আমি যাব মাম্মার কাছে।”
আনিশা চোখদুটো সরু করে ঘনঘন বলতে থাকে,
-” তোমার মাম্মা বাইরে। জানো বাইরে পুলিশ আবার পুলিশের গাড়িও আছে।”
পরের কথাগুলো কানে পৌঁছায় না ইচ্ছের। মাম্মা বাইরে আছে শুনেই ও ছোটে।
প্রীতির আসা নিয়ে আত্মীয় স্বজনরা এটাওটা বলে ফিসফিস করছে। কেউ আবার মুখে যা আসছে তাই সামনের উপর বলে দিচ্ছে। নীহারিকার জ্ঞান নেই। ছেলেকে নেয়ার আগে মা’কে আরেকবার দেখানো হয়। সেই তখন জ্ঞান হারিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজন মাথায় পানি দিচ্ছে।
প্রত্যাশা ওখানেই ছিল। এরমধ্যে নীলাশা এগিয়ে ইশারায় প্রত্যাশাকে ডাকল। প্রত্যাশা এগিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। রুমভর্তি মহিলা মানুষে। নীলাশার চোখদুটো ফোলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
-” শুনেছিস কী..”
কথার মাঝেই প্রত্যাশা নিচুস্বরে বলল,
-” হ্যাঁ শুনেছি। সবাই এখানে বলাবলি করছে। নীরব নাকি দেখতে দিচ্ছে না। উনাকে একটু বুঝিয়ে বলো দেখতে যেন দেয়। সবাই অনেক কিছু বলবে এটা জেনেও যখন দেখতে আসছে, তখন নিশ্চয় মন থেকেই আসছে। আর আপু, আত্মীয় স্বজন মানুষগুলোও না কেমন মুখের উপর যাচ্ছে না তাই নাকি বলতিছে।”
-” হুম, অনেকেই অনেক কিছু বলেছে। আর বলার কথাই। যাগগে বাদ দেই। বাবা নীরবকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখতে দিয়েছে। শোন যা বলার জন্য ডাকলাম, ইচ্ছে বাইরে ওর মায়ের কাছে গেছে। ইচ্ছে তো তোর কথা শোনে, তুই একটু নিয়ে আয় না। নিভানরা সবাই চলে গেছে। আর মনেহয় না ইচ্ছে আমার কাছে আসবে। তুই একটু যাবি?”
প্রত্যাশা মাথা নেড়ে বলল,
-” আচ্ছা, যাচ্ছি।”
মাথার উপর থাকা ওড়নাটা ভালো করে টেনে পা বাড়াল প্রত্যাশা।
.
প্রীতিকে পুলিশের জিপে তোলা হবে। এরমধ্যে পিছুন থেকে বাতাসের সাথে ভেসে এল মিষ্টি কণ্ঠস্বর,
-” মাম্মা…..আআআআআআআ।”
বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মতো ছুট্টে আসছে ইচ্ছে। যেন কোনো বেড়িবাঁধ, বাঁধা তাকে থামাতে পারবে না। মেয়ের কণ্ঠস্বর কর্ণযুগলে পৌঁছাতেই প্রীতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মেয়ে দৌড়ে এল। সামনে থামল। নিচের দিকে ঝুঁকে দুইহাত হাঁটুতে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘনঘন বললো ইচ্ছে,
-” মাম্মা, ও মাম্মা… আমাকে রেখে তুমি এতদিন কোথায় গিয়েছিলে?”
মুখটা উঁচু করে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। বাচ্চা মেয়েটার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে খুশির ঝিলিক ফোঁটে। প্রীতির চোখ ঝাপসা হয়ে এল চোখের বাঁধ ভাঙা বন্যায়। ইশশ্! কানে বাজছে, এত আদুরে ডাক—‘ মাম্মা, ও মাম্মা।’ প্রীতি নিজেকে সামলাতে পারল না। হাঁটু ভেঙে বসে মেয়েকে একটানে বুকের সাথে চেপে ধরল। শব্দ করে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। মায়ের কান্নার শব্দে ইচ্ছে ভড়কাল। ভীতু স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” মাম্মা তুমি কাঁদছো কেনো? সবাই আজকে কাঁদছে। দিদুন, দাদুভাই, বড় পাপা, পাপা, মামণি সব্বাই। আমার না খুউব মন খারাপ হচ্ছে। একটুও ভালো লাগছে না। একটুও না।”
মাথা নেড়ে নেড়ে বলতে থাকে ইচ্ছে। প্রত্যাশা এতক্ষণে এসে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়েছে। ভেজা চোখে তাকিয়ে রইল। প্রীতি কান্নার বেগ থামিয়ে নাক টেনে নিল। মেয়ের আদুরে মুখটা দু’হাতে আগলে ধরে চুমু খেতে লাগল। সারা মুখে চুমু খেয়ে ভরিয়ে দিল। ইচ্ছে একের পর এক প্রশ্ন করছে। প্রীতি কিছুই বলতে পারছে না। গলায় যেন বেড়ি পড়ানো এমন ঠেকছে। ওদিকে বরাদ্দ সময় শেষের দিকে তাড়া দিচ্ছে। সার্থক এগিয়ে বোনের কাঁধের উপর হাত দিল। মৃদুস্বরে ডাকল,
-” প্রীতি?”
প্রীতির বুঝতে বাকি রইল না। শেষবারের মতন মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। একদম চেপে ধরল। পরপর ছেড়ে দিয়ে মেয়ের ছোট্ট হাত দুটো এক করে ধরে তারপর সেই হাতের উপর চুমু খেল। উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। ঠিক প্রত্যাশার সামনে দাঁড়াল। আচমকা প্রত্যাশার একটা হাত ধরে, সেই হাতের উপর ইচ্ছের হাতটা রাখল। প্রত্যাশা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। প্রীতি একটাও শব্দ উচ্চারণ করল না। সোজা উল্টো ঘুরে লম্বা কদমে এগিয়ে যায়। ইচ্ছে পিছুন থেকে ডাকে,
-” মাম্মা, কোথায় যাচ্ছো মাম্মা? তুমি আবার চলে যাচ্ছ মাম্মা? দিদুন বলে তুমি অফিসের কাজে গিয়েছো? আমিও যাবো তোমার সাথে।”
প্রীতি আর ফিরে তাকায় না। ইচ্ছের এবারে কান্না পাচ্ছে। ছুটে যেতে নিয়ে বাঁধা পায়। প্রত্যাশা ওর হাতটা ধরে আছে। ইচ্ছে হাত ছুটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
-” মামণি ছাড়ো, আমি মাম্মার কাছে যাব।”
মূহুর্তেই জিপটা দূরে চলে যেতে লাগল। ইচ্ছের কান্নার বেগ বাড়ল। চিৎকার করে বলল,
-” মাম্মা…..ও মাম্মা…আআআআআ।”
নিমিষেই জীপটা ধুলো উড়িয়ে চোখের আড়াল হয়ে যায়। ইচ্ছে কাঁদতে থাকে। প্রত্যাশা আগলে ধরে বলে,
-” কাঁদে না সোনা। মাম্মা আসবে, কাজ শেষ হলেই আসবে।”
ইচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” মামা, মামা ওরা মাম্মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? মামা আমি যাব মাম্মার সাথে।”
সার্থক এগিয়ে এল। ইচ্ছের চোখের পানি মুছে দেয়। কপালে চুমু খেয়ে বলল,
-” তোমার মাম্মার কাজ শেষ হলেই তোমার কাছে আসবে। সোনামণি তুমি না গুড গার্ল। আর গুড গার্লরা তো এভাবে জিদ করে না সোনা। তুমি তো মাম্মার ভালো মেয়ে। বলো ভালো মেয়ে না তুমি?”
ফুপাতে ফুপাতে মাথা নেড়ে -‘হ্যা’ বোঝায় ইচ্ছে। সার্থক বলল,
-” ভালো মেয়ে হলে মাম্মার কথা শুনবে। মাম্মা বলেছে; বাসার সবার কথা শুনে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকতে। এখন গুড গার্ল হয়ে মামণির সাথে ভেতরে যাও তো।”
আরো এটাসেটা বুঝিয়ে বলার পর ইচ্ছে নাক টেনে ফুপাতে ফুপাতে প্রত্যাশার সাথে ভেতরে আসে।
অদ্রিকা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সার্থক গিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরে বসে সে। সার্থক চুপচাপ ড্রাইভিং করছে। অদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-” ইচ্ছের জন্য খুব বেশি খারাপ লাগছে। বাচ্চা মেয়েটা খুব সাফার করবে।”
সার্থক দৃষ্টিজোড়া পিচের রাস্তায় রেখেই বলল,
-” ইচ্ছে এখানে খুব ভালো থাকবে। ওর ফ্যামেলি বাবা-মায়ের শুন্যতা টের পেতে দিবে না। নীরব আছে, তারপর বাড়ির প্রতিটি সদস্যও ইচ্ছেকে আগলে রাখবে। তবে যখন বড় হবে সব সত্য জানলে কষ্ট পাবে। মায়ের প্রতি এখন যে ভালোবাসাটা আছে, তখন হয়তো সেটা ঘৃ’ণা’য় পরিণত হবে। আফসোস! প্রীতি চাইলেই জীবনটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিতে পারতো। বেপরোয়া রাগ, জিদ, ইগো ওকে ধ্বং*স করে দিয়েছে। এখন হয়তো টের পাচ্ছে। সব শেষ করে উপলব্ধি করার এক পয়সাও মূল্য নেই। যার জলজ্যান্ত উদাহরণ প্রীতি।”
_________
সবাই একে একে ফিরতে নেয়। সাড়ে তিনহাত মাটির অন্ধকার ঘরে ভাইকে একলা ফেলে যেতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এতই কষ্ট প্রবল যে নীরবের পা দুটো যেন গেঁথে গেল। লাল টকটকে চোখজোড়া অশ্রুতে টলমল করতে থাকল। আকস্মিক নীরবের কানে বাজছে উচ্ছ্বাস নিয়ে ভাইয়ের বলা কিছু কথা, কিছু মূহুর্ত। যা এখন ভাইয়ের স্মৃতি। রেজাল্ট দেয়ার পর উল্লাস নিয়ে বলেছিল নীবিড়। যদিও মজার ছলে বলেছিল,
-” এই নীরব তোর থেকে এবারে আমার সিজিপিএ বেশি। যদিও তুইও হ্যান্ডসাম সিজিপিএ তুলেছিস। তবুও তোর থেকে এবারে এগিয়ে কিন্তু আমিই। তোর থেকে তিন মিনিট আগে হলেও পৃথিবীতে এসেছি। তিন মিনিটের হলেও বড় আমি। তাই রেজাল্টের মতন সবকিছুতে এভাবেই এগিয়ে থাকতে হবে, বুঝলি।”
বলেই কলারে হাত রেখে ভাব নেয়ার অ্যাক্টিং করে নীবিড়। মায়ের মুখ থেকে শোনা কত সময়ের ব্যবধান দু’জনের ভূমিষ্ঠ হওয়ার। ভাইয়ের খুনসুটি গুলো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে নীরবের। আর করছে বলেই খুব পীড়া দিচ্ছে। নীরব ধপ করে কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। শরীর কাঁপছে, চোখদুটোতে অঝোরে বর্ষণ নামছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল,
-” নীবিড় তুই বলেছিলি সবকিছুতে এগিয়ে থাকবি। কিন্তু এই এগিয়ে থাকা তো আমি কোনোদিনও চাইনি। আগে জানলে বলতাম; তুই সবসময় আমার থেকে পিছিয়ে থাকিস। দুজনের আসার ব্যবধান যদি তিন মিনিটই হয়, তবুও কেন এত দ্রুত ছেড়ে গেলি?”
নিভান ভাইয়ের পাশে বসে কাঁধের উপর হাতটা রাখল। ভেজা গলায় বলল,
-” নীরব, উঠ। ভাই বাসায় চল।”
আঁটকে রাখা কান্না এবার ছিটকে যেন বেরিয়ে এল। ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল নীরব। এক ঝটকায় বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। নিভানও নিজেকে সামলাতে পারল না। ভাই বিয়োগের বেদনার কান্নায় চারপাশ ভারী হয়ে উঠল।
বৃদ্ধ বাবা বুকে হাহাকার নিয়ে মরহুম ছেলের জন্য দোয়া করতে থাকলেন। এ ছাড়া যে আর কিছুই করার নেই। আত্মীয়-স্বজন এগিয়ে এসে ওদের দুইভাইকে সামলে নিয়ে ফিরতে থাকে।
___________
কারো জন্য কোনো কিছুই থেমে থাকে না। যে যাওয়ার সেই যায়। রেখে যায় কেবল স্মৃতি, যা প্রিয়জনের বেদনা বাড়িয়ে দেয়। তবুও সময়ের সাথে সাথে মানুষের দুঃখ ফিকে হয়ে আসে। ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়ে যায় অশ্রুর ভারী মুহূর্তগুলো। এরই মাঝে কে”টে গেছে আড়াইটা মাস। বাড়ির শোকের ছায়া অনেকটা সরে গেছে। আগের মতো না হলেও সবাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে।
প্রত্যাশার সাড়ে সাত মাস চলছে। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ইবনে সিনা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওয়েটিং চেয়ারে প্রত্যাশা আর নীরব পাশাপাশি বসে। চেকআপের জন্য প্রত্যাশাকে আনা হয়েছে। গাইনোকলজিস্ট এটাসেটা টেস্ট দিয়েছে। টেস্টের জন্য স্যাম্পল হিসেবে ব্লাড, আর ইউরিন কালেক্ট করা হয়েছে। এখন আল্ট্রাসাউন্ড বাকি আছে।প্রত্যাশার হাতে ফ্রেশ এর মিনারেল ওয়াটার বোতল। মুখের সামনে ধরে দু ঢোক গিলে মাথাটা নীরবের কাঁধের উপর রাখল। শরীর দূর্বল লাগছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে কোমরও ধরে গেছে। বিরক্ত সুরে বলল,
-” নীরব আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকব? আমার বিরক্ত লাগছে। তাড়াতাড়ি বলুন না।”
নীরব কিছু বলার আগেই আল্ট্রাসাউন্ড রুমে প্রবেশের জন্য প্রত্যাশার নাম ডাকা হলো।
#চলবে