মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব-৫৬+৫৭

0
8

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

সাঁঝ নেমেছে একটু আগেই। দূরের রাস্তা, বড় বড় বিল্ডিংয়ের কাচে সোনালী ঝকমকে আলো ঝলকাচ্ছে। রাস্তায় চলমান গাড়ির হেডলাইট গুলো মিষ্টি মিষ্টি আলোর দৃষ্টির ফাঁক দিয়ে একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অফিসার্সদের কারো কারো কক্ষে তালা ঝুলছে, কেউ বা মাত্র বেড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানে অফিস সহকারী তালা ঝুলাতে ব্যস্ত। কোনো অফিসার্স আবার অল্প সময়ের জন্য কাজে মগ্ন। নীরবের রুমটা ফকফকা সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রিভলভিং চেয়ারে আধো ঝুঁকে বসে থাকা নীরবের মনোযোগ সামনের ফাইলে। টেবিলে কেস ফাইলের স্তূপ। আজকের কেস এক হাই-প্রোফাইল অর্থ জালিয়াতি মামলা। যেখানে সাসপেক্ট ব্যাংক ট্রান্সেকশন আর ফেক কোম্পানির আড়ালে বড় টাকা পাচার করছে। নীরব বিস্তারিত রিপোর্ট পড়ছে, সাসপেক্ট এর মোবাইল ট্র্যাকিং, সাক্ষীদের বিবৃতি, ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেক করছে। মাঝে মাঝে কলম ঠেসে রেখে ভেবেচিন্তে নোটে দাগ দিচ্ছে তো আবার চোখ ফেরাচ্ছে ফাইলের দিকে। একদম চটকদার মনোযোগ দিয়ে ছোটোখাটো সব তথ্য টুকে নিচ্ছে নীরব।

একটা ফাইল টেনে খোলার পর চোখ বেঁকে কলম দিয়ে নোট নিচ্ছে ঠিক তক্ষুনি দরজায় কড়া নড়ার শব্দ হলো। বিনম্র কণ্ঠস্বর এলো,

-” স্যার, আসব?”

দৃষ্টি সামনের ফাইলে রেখেই নীরব হালকা মাথা নাড়ল। অফিস সহকারীর হাতে চায়ের ট্রে। নিঃশব্দে টেবিলের একপাশে ফাঁকা জায়গাটুকুতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নামাল। কিছুটা জড়তা নিয়ে ইতস্তত স্বরে বলল,

-” স্যার, বাসায় যাবেন না?”

-” এইতো হাতের কাজটা কমপ্লিট করে যাবো।”

চায়ের কাপটা তুলে ঠোঁট ছুঁয়ে গলাটা ভেজাল নীরব। বলল,

-” তুমি চলে যাও। আমি বেরোনোর সময় আমার রুম লকড করে দেব।”

অফিস সহকারী নীরবের অমায়িক ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়ে লাজুকভাবে মাথা নাড়ল। কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে বলল,

-” ঠিক আছে স্যার। আসছি।”

ল্যাপটপে আঙুল চালিয়ে নতুন রিপোর্ট টাইপ করল নীরব। সাসপেক্ট এর লাইন, টাইমলাইন, নোট সবই অ্যানালাইজ করে সাজাল। কাজ শেষ করে ল্যাপটপের শাটার নামিয়ে ফোন হাতে নিয়ে কললিস্টে গিয়ে কলে চাপ দিল। ওপাশ থেকে কাঙ্খিত মিষ্টি কণ্ঠস্বর রিনিঝিনি সুর তুলে এল,

-” এতক্ষণে এএসপি সাহেবের মনে পড়ল?”

ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে নরম স্বরে বলল নীরব,

-” এতক্ষণে নয়, সব সময়ই মনে পড়ে। মনে শুধু পড়েই না, মনে গেঁথে থাকে। মন-মস্তিষ্কের দখলদারিত্বও কিন্তু তোমার দখলেই আছে। আমার সব ব্যস্ততার ফাঁক গলে প্রতিটা শ্বাসে জায়গা করে বসে আছো তুমি।”

-” মিথ্যে। আজ সারাদিন একটিবারও ফোন দেননি। ইভেন লাঞ্চেও আসেননি। আমি মেসেজ দিয়েছি ডেলিভার্ড হয়েছে, অথচ সীন পর্যন্ত করেননি। এরপরও বলবেন, মনে পড়ে? তাও আবার শ্বাসে শ্বাসে? অসম্ভব!”

মিছেমিছে অভিমান মিশিয়ে বলে প্রত্যাশা। নীরব শব্দহীন হাসল। বলল,

-” একসাথে এত অভিযোগ? এই নাও স্যরি বলছি। আজ একটু বিজি ছিলাম। কী করছিলে বলো?”

-” এই তো বসে আছি।”

-” সন্ধ্যার নাস্তা করেছো?”

-” হ্যাঁ করেছি। কখন ফিরছেন?”

-” এই তো..”

-” এএসপি সাহেবের অপেক্ষায় আছি।”

-” অপেক্ষার প্রহর শেষ করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।”

-” ওকে।”

-” প্রত্যাশা একটা কাজ করো তো।”

-” কী?”

-” তোমার রিসেন্ট প্রেসক্রিপশনের একটা ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ট করো। একটু ফাস্ট, ওকে?”

-” প্রেসক্রিপশনের ছবি! কিন্তু কেনো?”

-” যা বলছি তাই করো।”

প্রত্যাশা ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবল। গমগমে স্বরে বলল,

-” ঔষধ আছে তো। এখনো বেশ কিছুদিন চলে যাবে। যদি অল্প কিছু লাগেও আব্বুকে বলব আনতে। আর…”

নীরবের কথায় ওর কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। নীরব ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,

-” বাড়তি কথা না বলে, যা বললাম ফাস্ট করো। নো মোর ওয়ার্ডস।”

অগত্যা প্রত্যাশা প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে পাঠিয়ে দেয়। ফেরার পথে ফার্মেসিতে প্রথমে যায় নীরব। প্রত্যাশার ঔষধ, তারপর বাবার ব্যথার, প্রেশারের‌ ঔষধ নেয়। বাবার গুলো মাঝেমাঝেই নেয়া হয়, ওটা এখন মুখস্থ যেন। বাবা-মায়ের ঔষধ ভাইয়াও এনে রাখে। বাবা-মাকে মুখ ফুটে ঔষধ আনার কথা বলতে হয় না। ঔষধ ঘরে থাকতেই ছেলেরা এনে হাজির করে।

.
.

ইচ্ছেকে পড়াচ্ছে প্রত্যাশা। খাতায় অক্ষর তুলে দিয়ে শব্দ লিখতে বলে। ইচ্ছে লক্ষ্মী মেয়ের মতো লিখতে থাকে। ন্যাশনালে ভর্তি হয়েছে প্রত্যাশা। ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে হ্যাপিই শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। বাকিরা ন্যাশনালে। এই মুহূর্তে ক্লাস করা হয় না ওর। নোট কালেক্ট করেছে, বাকিটা বই পড়ে প্রথম ইনকোর্স দিয়েছে। মোটামুটি হয়েছে। সায়েন্সের সাবজেক্ট বাদ দিয়ে চয়েজ দিয়েছিল। বর্তমানে বাংলার ছাত্রী ও। সাহিত্য বইটা সামনে ধরে চোখ বুলাচ্ছে। ইচ্ছে লিখা শেষ করে বলল,

-” মামণি, কমপ্লিট।”

প্রত্যাশা এক গাল হেসে বলল,

-” গুড গার্ল।”

সাইন করে ভেরি গুড লিখে দিল। প্রত্যাশা বই-খাতা গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

-” আজকের মতো পড়া শেষ। এখন খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে কেমন?”

ইচ্ছে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। পরপর কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল,

-” বড় মাম্মা বলেছে বড় মাম্মার কাছে গিয়ে পড়তে। তুমি নাকি আর থাকবে না? কোথায় যাবে গো তুমি?”

-” ওহ্, তাই! ভালো তো। আমি আমাদের বাড়িতে যাবো। সেখানে অনেকদিন থাকব। তুমি কিন্তু বড় মাম্মার কাছে লক্ষ্মী মেয়েটি হয়ে পড়বে? বড় মাম্মা খুব ভালো করে তোমাকে পড়া বুঝিয়ে দিবে। তুমি শুধু গুড গার্ল হয়ে তার কথা শুনবে, কেমন?”

-” আচ্ছা, শুনব।”

-” আচ্ছা মামণি তুমিও কী আমার মাম্মার মতো চলে যাবে?”

-” না তো সোনা। কিছুদিন পরেই আবার আসব। তোমার জন্য দু’টো খেলার সঙ্গী আনব। তুমি তাদেরকে আদর করবে, তাদের সাথে খেলবে।”

ইচ্ছে ঝলমলে চোখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,

-” ইয়েএএএ! অনেক মজা হবে।”

ইচ্ছের খুশি দেখে ভালো লাগার পাশাপাশি চোখজোড়া চিকচিক করে উঠল প্রত্যাশার। অবুঝ বাচ্চা মেয়েটা কিছু বোঝে না বলেই হয়তো এতটা প্রাণবন্ত আছে। প্রত্যাশার ভাবনা বিচ্ছিন্ন হলো ইচ্ছের প্রশ্নে। প্রত্যাশার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে মায়ায় ডোবানো চাহনিতে কেমন করে তাকিয়ে বলে ওঠে ইচ্ছে,

-” মামণি আমার মাম্মা এখনো আসছে না কেনো গো? আমার মাম্মা কী আর কোনোদিনও আসবে না?”

লহমায় প্রত্যাশার মুখটা ম্লান হয়ে যায়। কিছু বলবে তার আগেই নীরবের গলা পেল।

ফেরার সময় জ্যামে আটকা পড়েছিল নীরব। সেইসময় হকারের ঝলমলে খেলনাগুলো চোখে পড়ে। ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের পাখি, ফল, আর ফুল। সবই রঙিন লাইটিং টয়। হাতে নিলেই নরম স্পঞ্জের মতো লাগে। আর একটু নাড়লেই ভেতর থেকে ঝলমলে আলো বেরিয়ে চারদিকে ঝিকিমিকি ছড়িয়ে যায়। রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার, গাড়িসহ দামিদামি খেলনা তো আছেই। নতুন এই ঝলমলে খেলনা দেখে ইচ্ছে খুশি হবে। তাই ভেবে নেয় নীরব। রুমে ঢুকতেই কানে এল ইচ্ছের প্রশ্ন। নীরব ডেকে উঠল,

-” ইচ্ছে?”

ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নীরব মুখে হাসি টেনে বলল,

-” ইচ্ছে আজ দেখো তোমার জন্য কী এনেছি।”

আলো ঝলমল খেলনা দেখে ইচ্ছের চোখ গোল হয়ে গেল। নীরব এগিয়ে এসে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদর করল।

-” পড়া শেষ সোনামণি?”

-” হ্যাঁ, শেষ।”

-” গুড গার্ল। তাহলে এবার এগুলো নিয়ে খেলবে, কেমন?”

ইচ্ছে উচ্ছ্বসিত হাসি নিয়ে নীরবের গালে চুমু দিয়ে বলল,

-” থ্যাংকিউ পাপা।”

-” মাই প্লেজার কিউটি।”

ইচ্ছেকে বিছানায় দাঁড় করিয়ে বলল,

-” এখান থেকে ডাবল থাকা খেলনাগুলো আনিশাকে দিবে।”

-” ওকে।”

পকেট থেকে চকচকে রঙিন মোড়কে মোড়া দুটো ক্যাটবেরি করে বলে নীরব,

-” এই নাও।”

ইচ্ছে ঝলমলে হাসি মুখে নিয়ে চকোলেট হাতে নিল। কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল,

-” মামণিরটা? পাপা মামণিরটা কই?”

পকেট হাতড়ে আরেকটা ক্যাটবেরি বের করে প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে বলল,

-” এই তো সোনা মামণিরটাও আছে। সে-ও তো আরেকটা বাচ্চা, না?”

ইচ্ছে এবারে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। এদিকে প্রত্যাশা এক চিলতে রাগি দৃষ্টি নীরবের দিকে ছুঁড়ল। চোখের ভাষায় বলছে; আপনি বলতে চাইছেন আমাকে এসব বাচ্চাদের খাবারে ভাগ না দিলে আমি রাগ করবো? তাই তো? বুঝেছি, হুম।

নীরব ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে চুপ করে রইল। এরমধ্যে নীহারিকা এসে ইচ্ছেকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যায়। ইচ্ছে দিদুনের কাছেই রাতে থাকে। ঝলমলে খেলনাগুলো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে যায় ইচ্ছে। আনিশাকে এগুলো দেখাবে এক্ষুনি।

নীরব ঘর্মাক্ত ইউনিফর্ম খুলছিল। আকস্মিক প্রত্যাশা বলে উঠল,

-” ইচ্ছেকে একবার ওর মায়ের সাথে দেখা করানো যায় না?”

-” নো।”

প্রত্যাশা কিছুটা ভয়ে ভয়েই বলল,

-” ও বারবার মায়ের কথা বলে। একবার দেখা করানো গেলে। মানে… মাঝে মাঝে এক আধ বার।”

নীরব স্রেফ বলল,

-” ইচ্ছেকে দেখা করাতে নিলে প্রব্লেম হবে। তখন ও মা’কে দূর থেকে দেখে কান্না করবে। মায়ের কাছে থাকার জন্য জিদও করতে পারে। সবমিলিয়ে তখন বেশি সমস্যা ক্রিয়েট হবে। তাই বলছি, এই চিন্তা বাদ দাও।”

.
.

ডিনার করার পর থেকেই গা টা কেমন গুলাচ্ছে প্রত্যাশার। যদিও আগের থেকে বমির সমস্যা এখন অনেকটাই কমেছে। প্রথম চারমাস খুব বেশিই বমি হতো। এখন হয় মাঝেসাঝে। বিছানায় শুতে যাবে নীরব বেডটেবিলে থাকা দুধের গ্লাসের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,

-” গ্লাসটা ফাঁকা করে দেন শুবে।”

-” পেট একদম ভরা। এখন কিছুই খেতে পারব না।”

ব্লাডে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ একটু কম আছে। রক্তের স্যালাইন নিয়েছে। তারপর ডাক্তার পুষ্টিকর খাবার খেতে বলেছেন। নীরব ভেবে বলল,

-” অন্তত অর্ধেক টা খাও।”

নীরব ছাড়বে না বরং না খেলে রাগ করবে, অগত্যা জোর করেই অর্ধেকটা কোনো রকমে গলাধঃকরণ করে প্রত্যাশা। ডিমবাতি জ্বালিয়ে নীরব শুয়ে পরে। প্রত্যাশার হালকা মাথা ব্যথা করছিল। নড়াচড়া দেখে নীরব জিজ্ঞেস করল,

-” কোনো সমস্যা?”

-” উঁহু, একটু হেডেক হচ্ছে।”

বলেই নীরবের বুকের উপর মাথাটা রাখল প্রত্যাশা। নীরব একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। আরেক হাত প্রত্যাশার চুলে বুলিয়ে দিতে লাগল। এরমধ্যে কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রত্যাশা হুড়মুড় করে উঠে বসতে নেয়। একহাতে মুখ চেপে ধরে। তবে ধরায় লাভের লাভ কিছুই হলো না। গলগলিয়ে বমি করতে থাকে। বমি নীরবের গায়ের উপর পড়ল। নীরব ত্রস্ত ওঠে বসল। নিজের টিশার্টয়ের দিকে না তাকিয়ে প্রত্যাশাকে আগলে ধরল। উদ্বেগ নিয়ে বলল,

-” প্রত্যাশা? ঠিক আছো?”

প্রত্যাশা ঘাড় নেড়ে ঝট করে বেড ছেড়ে নামল। সেখানেও হড়বড় করে আরেক দফা বমি করল। নীরব লাইট জ্বালিয়ে পাশে দাঁড়াল। প্রত্যাশার চোখে পানি টলমল করছে। বমি করার সময় মনেহয় ভেতর থেকে আত্মা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশা হাঁপাতে লাগলো। নীরব ওকে ধরে ওয়াশরুমে নিল। ট্যাপের নব ছেড়ে বলল,

-” কুলি করে চোখেমুখে পানির ছিটা দাও।”

প্রত্যাশার গায়েও বমি লেগেছে। নীরবের টিশার্ট ভিজে বুকের সাথে লেপ্টে আছে। নীরব দুই হাতে টিশার্ট টেনে গায়ের থেকে ফাঁকা করল। রুমটা গন্ধে ছেয়ে যাচ্ছে। নীরব প্রত্যাশার কাপড় এগিয়ে দিয়ে বলল,

-” এখন শাওয়ার নেয়ার দরকার নেই। এসময় ঠাণ্ডা লাগলে প্রব্লেম হবে। শুধু চেঞ্জ করে নাও। তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

প্রত্যাশা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কিছু বলতে চাইল। নীরব থামিয়ে বলল,

-” আমি পরে ফ্রেশ হচ্ছি। আর পরীকে ডেকে ক্লিন করতে বলছি।”

পরীকে ডাকতেই হুরমুর করে দৌড়ে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

-” কিছু লাগবো ভাইজান?”

-” ফ্লোরে, বেডে বমি পড়েছে। বেডশিট চেঞ্জ করে তারপর ফ্লোরটা ক্লিন করে দিতে হবে।”

-” আইচ্ছা, আইচ্ছা, এক্ষুনি দিতাছি।”

বলতে বলতে নীরবের টিশার্টে ওর নজর যায়। আর যেতেই পরী দুইহাত গালে ধরে বেকুবের মতোন মুখটা বানাল। অবাক কণ্ঠে আস্তে করে বলে উঠল,

-” ইয়া আল্লাহ, পোয়াতি ছোডো ভাবী। বমি তো তার করার কথা। এতদিন দেখছি যার প্যাডে বাচ্চা সেই বমি করে। বাচ্চার বাপেরাও যে বমি করে এই প্রথম দেখতাছি।”

আস্তে বললেও কথাটা নীরবের কানে যায়। বেকুবের মতোন কথা শুনে নীরবের মেজাজ চটল। বজ্রকণ্ঠে ধ’ম’ক দিয়ে উঠল,

-” একটা থাপ্পর দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিবো। আজব চিড়িয়া সব! দেখা নেই শোনা নেই, সব মুখ খুললেই উল্টাপাল্টা বলতেই থাকে।”

পরী ভ’য়ে কেঁপে উঠল। মিনমিনে স্বরে বলল,

-” ইয়ে মানে ছোডো ভাইজান আপনার গেঞ্জিতে বমি ভরা। তাই ভাবছিলাম… থুক্কু থুক্কু বুল অয়া গ্যাছে গা।”

পরী সাথে সাথে জিভে কামড় দিল। অদৃশ্য হাতে মাথায় চাটি মে*রে ভাবল — ছোডো ভাবীর আশেপাশে থাকতে থাকতে তার ছোঁয়া লাগল নাকি? তার মতো কীসব পা*গলের মতো কয়া ফ্যালাইছি। হায় আল্লাহ! ছোডো ভাইজান তো এহন আমারে বেকুব ভাববো।

নীরব কোমড়ে একহাত চেপে জোড়াল শ্বাস ফেলল। এদিকে প্রত্যাশা ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই নীরব ওয়াশরুমে যায়। পরী প্রথমে বেডশিট চেঞ্জ করল। তারপর ফ্লোর থেকে বমি মুছে নেয়। অতঃপর একটা বালতিতে পানি এনে ন্যাকড়া দিয়ে ফ্লোর মুছতে থাকে। নীরব ততক্ষণে একটু তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। ভেজা চুলে আঙুল চালিয়ে ঝেড়ে নিল। পরপর লেমন এয়ার ফ্রেশনার নিয়ে স্প্রে করতে করতে প্রত্যাশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” শুয়ে পড়ো। তোমাকে ভীষণ উইক দেখাচ্ছে।”

প্রত্যাশা বেডে গিয়ে গা এলিয়ে দিল ক্লান্ত ভঙিতে। কণ্ঠে অপরাধ মিশিয়ে বলল,

-” ইশশ্! আমার জন্য তোমাকে ঘুম ভেঙে এখন এসব করতে হচ্ছে। স্যরি গো।”

পরী একগাল হেসে বলল,

-” আরে ছোডো ভাবি এইডা কোনো কাম হইল। আমার অভ্যেস আছে। আর এই সময় এমন অয়।”

পরীর মনে কৌতুহল জাগল। ফ্লোর মুছতে মুছতে বিড়বিড় করল,

-” বমি কইরা এক্কেবারে বন্যা বইয়া দেছে। তয় কথা হইলো ভাইজানের গায়োত পড়লো ক্যামনে?”

____________

কোনো রকমের জাঁকজমকপূর্ণতা, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান ছাড়াই সার্থক আর অদ্রিকার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় সার্থকের নামে তিন কবুল পড়ে বিবাহিত জীবনে পদার্পণ করেছে অদ্রিকা আহসান। এমন সময় রাত সাড়ে এগারোটায় হাসপাতাল থেকে ইমার্জেন্সি একটা পেশেন্টের আর্জেন্ট সিজার করতে হবে বলে কল আসে অদ্রিকার কাছে। কোনো ডাক্তারের সিডিউল নেই। রাতে ডক্টর পাওয়া যাচ্ছিল না। উক্ত হাসপাতালের শেয়ারে অদ্রিকা- সার্থক দু’জনেই আছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে মা ও শিশুর জীবন রক্ষার্থে অদ্রিকা হাসপাতালে ছোটে। যদিও বিয়েতে সাদামাটা সাজগোজ ছিলো। সেই সাদামাটা সাজগোজ ধুয়ে, শাড়ি পাল্টে স্যালোয়ার স্যুট পরে যায়। সার্থক নিজেই ড্রপ করে দেয়। পেশেন্টের একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছে।

সার্থকের সাদা মার্সিডিজ গাড়িটা শহরের রাতের ফাঁকা শুনশান রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। অদ্রিকা গাড়ির হেড রেস্টে মাথাটা এলিয়ে বলল,

-” বিয়ের রাতে নতুন বউ বাসর ঘরে না থেকে ও.টিতে। এরকম একটা নিউজ হেডলাইন হলে মন্দ হয় না, ঠিক বলেছি না?”

সার্থকের হাত দুটো স্টিয়ারিংয়ে। সে নিরুত্তর রইল । অদ্রিকা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,

-” এইযে ডাক্তার বাবু, আপনাকে দেখে ইন্টার্নশিপের স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে। কোনো কথা নেই, কেমন চুপচাপ। মনে হচ্ছে নতুন জীবনে পদার্পণে আপনি খুবই ভীতু সন্ত্রস্ত। ঠিক ইন্টার্নশিপ নেয়া স্টুডেন্টের মতো।”

#চলবে

#মধ্য_রাতের_চাঁদ |৫৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ঘড়িতে সকাল আটটা পাঁচ বাজে। নীরব অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে একবার ঘাড় ফিরে তাকাল; প্রত্যাশা বেডে জুবুথুবু হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাতভর বমিতে ক্লান্ত হয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ক্লান্ত, দূর্বল শরীর চোখের ঘুমটুকুও কেড়ে নিয়েছিল। শেষ রাতের দিকে তবেই একটু ঘুমিয়েছে। বাচ্চা একটা মেয়ে, তার মধ্যে দু’টো প্রাণ বেড়ে উঠছে। দেখলেই কেমন মায়া কাজ করে। বড্ড টেনশনও হয়।

নীরব রেডি হয়ে চুপচাপ এসে বেডের হেডসাইডে বসল। আলগোছে কাথাটা টেনে প্রত্যাশার গা ভালো করে জড়িয়ে দিল। তারপর ঝুঁকে প্রত্যাশার মুখের উপর এসে পড়া চুল সরিয়ে দিল। ঠোঁটের কোণে একটুখানি মুচকি হাসি নিয়ে নিঃশব্দে কপালে একটা নরম চুমু খেল। প্রত্যাশা আদুরে ভঙিতে একটু নড়ল। তা দেখে নীরবের ঠোঁটের কোণের হাসি চওড়া হলো।

নীরব উঠতে যাচ্ছিল ঠিক তক্ষুনি হাতে টান পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখে প্রত্যাশা ঘুমের মধ্যেই হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছে। হাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার গালে আলতোভাবে একটা হাত রাখল নীরব। কিছুপল নিঃশব্দে ঘুমন্ত ইনোসেন্ট মুখটা চেয়ে চেয়ে দেখল। অতঃপর সন্তর্পণে আঙুল ছাড়িয়ে নিল। পরপর ঝুঁকে এবারে প্রত্যাশার গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। চটচট করে দু তিনটে চুমু দেয় নীরব। ঘুমে বিভোর প্রত্যাশা কিচ্ছুটি টের পেল না।

নীরব চুপচাপ উঠে একটা পেন আর প্যাড হাতে নিল। কয়েকটা কথা লিখে রাখল। বেড টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের গ্লাস দিয়ে কাগজের কোণায় চাপিয়ে দেয়। একবার শেষবারের মতো তাকাল প্রত্যাশার দিকে, তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল নীরব।

আরো আধা ঘন্টাখানেক পর প্রত্যাশার ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে জেগে সোফায় নীরবের ট্রাউজার টিশার্ট দেখে সেকেন্ডেই বুঝে নেয় জনাব অফিসে চলে গেছে। না বলে চলে যাওয়ায় প্রত্যাশার মুখটা মলিন হয়ে আসে। ফ্রেশ হয়ে এসে হাতমুখ মুছছিল প্রত্যাশা, তক্ষুনি নজর যায় বেডটেবিলে গ্লাস দিয়ে চাপা দেয়া কাগজের দিকে। প্রত্যাশা কৌতুহলী হয়ে ত্রস্ত কাগজটা হাতে নিল। প্রতিটি লাইন পড়ল আর ঠোঁটে হাসি ফুটতে থাকল। মন খারাপ নিমিষেই কর্পূরের মতো উবে গেল। গোটা গোটা অক্ষরে গুছিয়ে লেখা,,

– ‘শুভ সকাল মাই মিসেস। নতুন দিনের আলো যেন তোমার মুখে নরম হাসি ফোটায়। সকল ক্লান্তি, অবসাদ দূর করে দেয়। সুন্দর মিষ্টি ঘুম ভেঙে তোমাকে জাগাতে ইচ্ছে করল না। এমনিতেই আমার বেবিরা তাদের মাম্মামকে অনেক জ্বালাতন করছে, কষ্ট দিচ্ছে। তাই আমার দিক থেকে জ্বা’লানো কমিয়ে দিয়েছি। দিনের শুরুর নিঃশ্বাস বন্ধ করা চুমুটা আজও পাওনা রইল। যখন সুস্থ হবে, তখন সুদে আসলে নিবো। তখন নো ছাড়।

এই যে না বলে যাচ্ছি, এজন্য তুমি আবার রাগ করো না কিন্তু। সাবধানে চলাচল করবে, ঠিকমতো বিশ্রাম করো, সময়মতো মেডিসিন নিও। তোমার ভেতর আমার পৃথিবী বেড়ে উঠছে। তুমি আর ওদের নিয়েই আমার সব স্বপ্ন, আমার সবকিছু। ভালোবাসি। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি আমার পা’গলী বউটাকে। এই পৃথিবীর সবকিছু মিলিয়ে যতটা ভালোবাসা যায়, তারচেয়েও বেশি ভালোবাসি আমার বাচ্চাদের মাম্মামকে।’

— নীরব মাহবুব

____________

জনমানবশূন্য সার্থকের ফ্লাটটা আজ যেন একটু প্রাণ পেয়েছে। বদ্ধঘরে আলো বাতাস ঢুকছে। থাই গ্লাস টেনে একহাতে জানালার পর্দাটা সরিয়ে দেয় অদ্রিকা। সরিয়ে দিতেই ফরফর করে হাওয়া ঢুকতে থাকে। সাথে এক টুকরো ঝলমলে রোদ রুমময় লুটোপুটি খেতে থাকল।

অদ্রিকা আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। মাথায় সাদা টাওয়েলটা শক্ত করে পেঁচিয়ে নিল। গোলাপি রঙের শাড়িটার কোণা গুজে পেঁচিয়ে নেয়। পরপর আঙুলের ফাঁকে কুঁচি উঠাতে থাকে। এমন সময় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সার্থক। এক ঝলক চোখে পড়তেই থমকে গেল সে। মুহূর্তেই উল্টে ঘুরতে চাইল। অদ্রিকা খেয়াল করতেই হেসে বলল,

-” ডাক্তার বাবুর হঠাৎ কী হলো? রুমে পা ফেলতে না ফেলতেই আবার পালাচ্ছে যে?”

সার্থক মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” নাহ। কিছু না, এমনি।”

অদ্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,

-” এমনি মানে?”

-” মানে তুই তো রেডি হচ্ছিস, ভেবেছিলাম পরে আসি।”

অদ্রিকা শাড়ির কুঁচি কোমরে গুঁজে নিল। আঁচলটা কাঁধে গুছাতে গুছাতে ঠোঁটে একরাশ দুষ্টু হাসি টেনে বলল,

-” ধুর! রাতে বাসর হয়েছে। তারপরও এত লজ্জা কিসের? আমি তো পায়ের শব্দ শুনেই ভেবেছিলাম; এসে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবি, তারপর কোমর জড়িয়ে মিষ্টি কথার বন্যা বইয়ে দিবি। তা না, বর বাবু দেখি উল্টো পালাচ্ছে। এমনি এমনিই কী আর ইন্টার্নশিপের স্টুডেন্টের সাথে টিট করেছি?”

সার্থক কেশে উঠল। এই মেয়েটা দিনদিন খুব ঠোঁট কাঁ*টা হচ্ছে। আগে তো এমন ছিলো না। কালকের পর থেকে একশো আশি ডিগ্রী এঙ্গেলে চেঞ্জ হয়েছে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে ঝটপট বলল সার্থক,

-” অনলাইনে খাবার অর্ডার করেছিলাম। দিয়ে গেছে। জলদি ব্রেকফাস্ট করতে আয়। আমার সাথেই বেরোবি নাকি পরে? আমার নয়টায় রাউন্ড আছে।”

আঁচলটা গুছিয়ে অদ্রিকা এক আঙুল নেড়ে বলল,

-” এই ওয়েট ওয়েট। এদিকে আসুন।”

অদ্রিকার মুখভঙ্গি, ডাকার ধরণ সব অদ্ভুত লাগল। সার্থক একটু হকচকিয়ে গেল। অদ্রিকা কাছে এগিয়ে আচমকা সার্থকের গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

-” বিয়ে হয়েছে। এখন বউ আমি আপনার। ফ্রেন্ড নই, ক্লিয়ার?”

সার্থক বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল। অদ্রিকা স্রেফ জানিয়ে দিল,

-” এরপর থেকে তুই-তোকারি ওয়ার্ডটা আমাদের দু’জনের মধ্য থেকে ডিলেট করে দিতে হবে। কেমন অড লাগছে। এরপর থেকে এই অদ্রি শোন, অদ্রি আয় এভাবে ডাকবে না।”

সার্থক একটু ত্যাড়া সুরে বলল,

-” তাহলে কী ম্যাডাম বলে ডাকবো?”

অদ্রিকা বিরক্তির সুরে বলল,

-” ধ্যাত, আনরোমান্টিক একটা। কিচ্ছু জানে না। কথা না শুনেই একটা বলে দেয়। আমি বলছি, তুমি করে বলবে। আর মাঝেমধ্যে বউ বলে কোকিল সুরে ডাকতে পারো।”

শেষের কথাটা ফাজলামির সুরে বলে চোখ টিপে অদ্রিকা। সার্থক গলা থেকে অদ্রিকার হাত দু’টো নামিয়ে বলল,

-” যথা আজ্ঞা মহারানী, এবারে অন্তত ব্রেকফাস্ট করতে এসে আমাকে ধন্য করুন। আমাকে বেরোতে হবে।”

অদ্রিকা হইহই করে উঠল,

-” আমাকে না বলে খাবার অর্ডার কেনো করেছো? আজকের পর থেকে আমি নিজে রান্না করব, সব করব। চুটিয়ে প্রেম করে মানুষ। সেটা তো কপালে ছিলো না। আমি না হয় চুটিয়ে সংসারটাই করব।”

-” ঘড়িতে নয়টা পঞ্চান্ন বাজে। তোমার অপেক্ষায় থাকলে, তাহলে আজকের ব্রেকফাস্ট বাদ দিয়ে সরাসরি লাঞ্চ করতে হতো।”

অদ্রিকা মিষ্টি হেসে বলল,

-” আজকের দিনে এরকম দেরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এরমধ্যেও একটা রোমাঞ্চ ব্যাপার থাকে। আপনাকে এসব বলেই বা কী লাভ? আপনি তো আর ভালোবেসে কাছে আসেননি। জাস্ট আসা লাগে তাই হয়তো।”

সার্থক ভ্রু নাড়িয়ে বলল,

-” ভালোই তো বাসলাম।”

-” উঁহু।”

অদ্রিকা থেমে কিছুক্ষণ সার্থকের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকল। তারপর এক অদ্ভুত মিষ্টি ধ্যানভঙ্গিতে একটা আঙুল সার্থকের বুকের উপর রাখল। কোমল স্বরে বলল,

-” যেদিন এখানে শুধু আমারই নাম থাকবে, তোমার চোখে আমি শুধু আমাকেই দেখতে পাব। সেদিনের প্রতিটি স্পর্শই হবে ভালোবাসা। আলতো চোখে আমাকে দেখাটাও হবে ভালোবাসা। আমাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হালাল, প্রতিটি ছোঁয়াও হালাল। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের পবিত্র সম্পর্কটাই তোমার মাঝে ভালোবাসা তৈরি করবে। আমার প্রতি সবটা জাস্ট রেসপন্সবিলিটি থেকে নয়, ভালোবেসে করবে।”

মাথাটা সার্থকের বুকের উপর রাখল অদ্রিকা। বলল,

-” জানি না কতটা বাধ্য করেছি তোমাকে, আমাকে জীবনসঙ্গী বানাতে। তবে আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তোমাকে বাধ্য করবে আমাকে ভালোবাসতে।”

সার্থকের একটা হাত আপনাআপনি অদ্রিকার পিঠ পেঁচিয়ে ধরল। শ্যাম্পুর মিষ্টি গন্ধে কেমন একটা ঘোরের সৃষ্টি হলো। মিষ্টি মেয়েটির মিষ্টি ব্যবহারে সার্থক ধীরেধীরে দূর্বল হয়ে পড়ছে। আর সার্থক নিজেও চায় গ্রো-আপ করতে। সব দূর্বলতা ছেড়ে বিয়েটা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুধুই অদ্রিকার চাওয়াকে প্রায়োরিটি দিতে নয়, নিজের বিষণ্ণ লাইফটা গুছিয়ে নিতেই বিয়েতে মত দেয় সে। সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে তার দিক হতে সর্বোচ্চ এফোর্ট থাকবে।

____________

-” নীরব, আপনি বন্ধন সিনেমা দেখেছেন?”

ঘুমে বিভোর নীরবের ঘুম ভাঙে ফোনের রিংটোনের শব্দে। প্রত্যাশা প্রায় মাসখানেকের মতো হবে বাবার বাড়ি গিয়েছে। এত রাতে প্রত্যাশার কল দেখে প্রচন্ড টেনশন হয় নীরবের। এমনিতেই আর সপ্তাহ খানেক আছে ডেটের। আগে পরেও হতে পারে। ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে দুশ্চিন্তায় হার্টবিট বেড়ে যায়। রিসিভ করে অস্থির গলায়,

-” হ্যালো, প্র…”

এতটুকু বলতে না বলতেই ওপাশ থেকে প্রত্যাশার অমন প্রশ্নে হকচকাল নীরব। কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। কপালে জ্যামিতিক সুক্ষ্ম রেখার ন্যায় ভাঁজের উদয় হলো। কিছু বলার আগেই অধৈর্য গলায় প্রশ্ন করে উঠল প্রত্যাশা,

-” কী হলো চুপ করে আছেন যে? আমার কথা বোঝেননি? আমি বলতে চাইছি, ওপার বাংলার জিৎ আর কোয়েলের বন্ধন সিনেমা দেখেছেন কী না?”

কান থেকে ফোনটা নামিয়ে সামনে ধরে সময় দেখল নীরব। রাত একটা তেরো বাজে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে এরকম উদ্ভট প্রশ্নের মানে আছে? বিরক্তিতে নীরবের কপালে প্রগাঢ় খাঁজ পড়ল। দাঁত চেপে বলল,

-” মাথা ঠিক আছে?”

-” আমার উত্তর এটা নয়, হ্যাঁ বা না। এক শব্দে দিলেই হলো।”

কিছু বললে তো আবার ম্যাডাম রাগ করে ফোন কে”টে দিবে। শুধু কি তাই? উঁহু, এখানেই শেষ নয়। দিনে ফোন করলেও কথা বলবে না। শেষে ও বাড়ি গিয়ে তার অভিমান ভাঙিয়ে আসতে হবে। অগত্যা বিরক্তি, রাগ একপাশে চেপে উত্তরে বলল নীরব,

-” না।”

-” ওহ্। বিকেলে জলসা মুভিজে ছবিটি হচ্ছিল। দেখার পর থেকেই মনটা কেমন খচখচ করছিল। আর একটু আগেই অমন একটা স্বপ্ন দেখলাম। এই সিনেমায় বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে কোয়েল মা*রা যায়। জিৎ বউকে এত ভালোবাসে অথচ ক বছর পর আবার বিয়ে করল। আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমি নেই। আমাদের বাচ্চার দেখভালের অজুহাত দিয়ে আপনি বিয়ে করেছেন। আচ্ছা নীরব এমনি ধরুন, কখনো অমন পরিস্থিতি হলে আপনি কী আবার বিয়ে থা করবেন? জাস্ট ধরুন। সিরিয়াসলি নেয়ার দরকার নেই।”

নীরবের চোখে ঘুমের রেশ। কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে এমন সব কথা বলায় নীরবের মেজাজ চটল। তবে বলল ঠাণ্ডা গলায়,

-” এই মুহূর্তে তোমার এসব সিনেমা দেখতে কে বলেছে? আর মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে কীসব পা’গ’লের প্রলাপ শুরু করেছো বলো তো?”

-” এই তো বুঝেছি বুঝেছি।”

-” স্ট্রেইঞ্জ! কী বুঝলে?”

-” এইযে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতে রাগ দেখাচ্ছেন। তারমানে বুঝলাম, আপনিও অমন পুরুষ।”

-” কেমন পুরুষ?”

-” আমার এক আত্মীয় ছেলেমেয়ে বড়বড়। বউয়ের মৃ*ত্যুর বছর না হতেই আবার ঘরে নতুন বউ এনেছে। আসলে পৃথিবীর সব পুরুষই সমান। যতই জান, ফুসফুস, কিডনি, লিভার বলুক না কেনো। আসলে তো তারা মূলত একটা বিষয়েই…”

বলতে গিয়ে থেমে যায় প্রত্যাশা। নীরব শুধাল,

-” কী?”

-” কী বলতে চাইছি বুঝতে পেরেছেন। ফিডার খাওয়া বাচ্চা নন আপনি। বাচ্চার বাবা হচ্ছেন। সো না বোঝার অ্যাক্টিং করবেন না।”

নীরব নিজেকে সামলে নরম স্বরে বলল,

-” প্রত্যাশা উল্টাপাল্টা উদ্ভট কথাবার্তা বাদ দিয়ে ঘুমাও। আর তোমার এইসব অদ্ভুত উদ্ভট কথাবার্তায় রেফারেন্স টানার জন্য তোমার সব আত্মীয়-স্বজনও আছে। দুনিয়ার সবকিছু তাদের মধ্যে ঘটে থাকে, আর তুমিও কথায় কথায় অমুক-তমুক টেনে রেফারেন্স দাও।”

-” কী আশ্চর্য! আত্মীয়-স্বজন একজন নাকি? হাজার জনের হাজারো কাহিনী। আপনাকে তো তেমন কিছু বলাই হয়নি।”

-” ও গড! তেমন কিছু বলা হয়নি, তাই এই অবস্থা।”

বিড়বিড় করে বলে নীরব। গলা ঝেড়ে বলল,

-” প্রত্যাশা, উল্টাপাল্টা ভাবনা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়। আর এই মুহূর্তে অমন সিনেমা দেখবে না।”

-” নীরব?”

-” হুঁ।”

-” আপনাকে একটা কথা দিতে হবে?”

নীরবের কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। পাগলীটা আবার কী বলে ফেলে আল্লাহ মালুম! নীরব ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,

-” কী?”

-” আগে বলুন কথাটা রাখবেন?”

-” আগে বলো তো।”

-” নাহ, আপনি বলুন।”

-” আচ্ছা, যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তুমি নির্দ্বিধায় বলো।”

-” আমাদের বাচ্চাকে অনেক আদর করবেন, আর কখনো অমন কিছু হলে আমার জায়গাটা কাউকেই দিবেন না।”

বেডের হেডে গা এলিয়ে শুয়ে একটা কুশন বুকের উপর টেনে নেয় নীরব। বলল,

-” তুমি কী এরকম পাগলীই থাকবে? আমার বাচ্চাকে আদর করার কথা তোমাকে বলতে হবে। আমার অংশ, আমার রক্ত, তাদেরকে আমার থেকেও বেশী ভালোবাসব, আগলে রাখব। আর শোন শেষে যেটা বলেছো, অমনটা ভুলেও আর বলবে না। সবটা ভালো হবে, ইনশাআল্লাহ।”

-” আপনি এসে সামনাসামনি বলুন। আমার চোখেচোখ রেখে বলবেন। আপনার চোখ দেখে বুঝব সত্যি নাকি মিথ্যে বলছেন।”

-” প্রত্যাশা অবুঝপনা বাদ দাও, এখন কী করে সামনাসামনি যাবো।”

-” আপনি এক্ষুনি আসুন।”

-” মাঝ রাতে শ্বশুর বাড়ি গেলে তোমার আব্বু-আম্মু কী ভাববে?”

-” কিছু একটা বলে দিবেন।”

-” প্রত্যাশা পাগলামি বন্ধ করো। যাও সকালে অফিস যাওয়ার আগে তোমার সাথে দেখা করে যাব। এবারে, হ্যাপি?”

প্রত্যাশা কয়েক সেকেন্ড থম মে”রে থাকল। পরক্ষণেই কাটকাট গলায় বলল,

-” আচ্ছা, আসতে হবে না। আপনি ভিডিও কল দিন। আমার চোখে চোখ রেখে উত্তর দিবেন। স্বপ্নটা দেখার পর থেকে আমার মনটা কেমন কেমন করছে।”

নীরব সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল করল। সাথে সাথেই স্ক্রিনে একটা শুকনো মুখ ভেসে উঠল। নীরব সেদিকে তাকিয়ে স্মিত হাসল। প্রত্যাশা গম্ভীর মুখে তাকাল। শুকনো ঠোঁটজোড়া নেড়েনেড়ে বলে প্রত্যাশা,

-” কুড ইউ এভার ফিল দ্য এম্পটি স্পেস আই লিভ বিহাইন্ড?”

-” নো, নেভার। দ্যাট এম্পটি স্পেস ইজ রিজার্ভড ওনলি ফর ইয়্যু।”

প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল নীরব। প্রত্যাশা ঠোঁটে হাসি ফুটাল। বলল,

-” স্যরি ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্ত করার জন্য। আচ্ছা এবারে শুয়ে পড়ুন। রাখছি।”

নীরব তৎক্ষণাৎ আদেশের সুরে বলল,

-” কল কাটবে না। ফোনটা এমন জায়গায় রাখো যাতে তোমার ফেসটা দেখা যায়। তুমি যতক্ষণ না ঘুমাচ্ছ, আমি ততক্ষণ লাইনটা কাটব না। তুমি ঘুমাচ্ছ নিশ্চিত হলেই কল কাটব।”

-” দরকার ছিলো না। প্রব্লেম নেই।”

-” আমার প্রব্লেম হবে। সো, যা বলছি তাই করো।”

প্রত্যাশা ফোনটা একটা বালিশ আর দু’টো কুশনের উপর একটু উঁচুতে রেখে দেয়। তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করে। প্রায় মিনিট পনেরো পরে লাইনটা কা”টে নীরব।

___________

দু-তিনদিন পর।
সন্ধ্যার পরপর… নীরবের সামনে ল্যাপটপ। স্ক্রিনে প্রত্যাশার মুখ। কিছু কথাবার্তা শেষে ভিডিও কলের ওপাশ থেকে বলল প্রত্যাশা,

-” আগামীকাল তো শুক্রবার। কালকে দুপুরে ইচ্ছেকে সাথে নিয়ে আসবেন।”

-” আচ্ছা।”

হঠাৎ প্রত্যাশা কপাল কুঁচকে নেয়। সেটা নীরবের নজরে পড়তেই উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” প্রত্যাশা ঠিক আছো? এনি প্রব্লেম?”

কপালের ভাঁজ মিলিয়ে একটা হাত পেটের উপর রাখল প্রত্যাশা। মুখে হাসি টেনে বলল,

-” নাহ, তেমন কিছু নয়। আপনার বাচ্চারা পেটের মধ্যে ফুটবল খেলছে। একটু লেগেছিল।”

নীরবের অধর কোণে চাপা হাসি ফুটল। বলল,

-” হুম, সেদিন তো দেখলামই। তোমার পেটের উপর মাথাটা রাখতেই মনেহলো; বেবিরা পিকেটিং শুরু করেছে। দু’জনে একসাথে তোমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে, না?”

-” মা হতে গেলে এটুকু কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা রাখতে হয়।”

.

রাত সাড়ে বারোটা পার। মাত্র চোখটা লেগেছিল নীরবের। আর তক্ষুনি ফোনের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙে। ফোনটা হাতে নিয়ে শফিক সাহেবের কল দেখে যা বোঝার বুঝে নেয় নীরব। শফিক সাহেব অস্থির গলায় বললেন,

-” নীরব বাবা প্রত্যাশাকে হাসপাতালে নিচ্ছি। আমরা এখন গাড়িতে আছি। ডক্টরস হাসপাতালের কাছাকাছি প্রায়।”

-” আমি এক্ষুনি আসছি।”

গলাটা একটু কাঁপল বোধহয়। প্রত্যাশার কান্নার শব্দ হালকা কানে আসে নীরবের। টেনশনে হাত-পা হিম হয়ে আসতে লাগলো। ত্রস্ত প্যান্টটা পড়ে নিল, পরনে যে টিশার্ট ছিল ওটাই পড়ে বেরোনোর সিদ্ধান্ত নেয়। ওয়ালেট, আর ক্রেডিট কার্ডটা পকেটে গুঁজে মোবাইলটা হাতে নিয়ে জোড়াল শ্বাস টেনে রুম থেকে বেরোয়।

নীহারিকাকে ডেকে একবাক্যে বলেই হন্তদন্ত হয়ে যেতে থাকে নীরব। নীহারিকা পিছুন থেকে ডেকে বললেন,

-” নীরব দাঁড়া বাবা আমিও যাবো।”

নীরব ঘুরে না তাকিয়ে যেতে যেতেই উত্তর দিল,

-” পরে এসো।”

এক সেকেন্ড যেন বিলম্ব করার সময় নেই নীরবের। নীহারিকার গলা পেয়ে বড়রা রুম থেকে আসে। নিভান মায়ের অস্থিরতা দেখে বলল,

-” রেডি হও, আমি নিয়ে যাচ্ছি।”

.

সন্ধ্যার পর থেকেই হালকা পেইন শুরু হয়েছিল। প্রত্যাশা বুঝতে না পেরে ভেবেছিল অ্যাসিডিটির জন্য বোধহয় এমন হচ্ছে। আম্মুকেও কিছু জানায়নি। রাত নয়টার পর চিনচিনে ব্যথাটা ক্রমশ একটু একটু করে বাড়ছিলো। তখন আম্মুকে জানায়। ওদিকে দু একজন প্রতিবেশী এসে হুলুস্থুল লাগায়। বলে, প্রথম বাচ্চা দু-একদিন আগে থেকেই একটু আধটু এমন হয়ই। রাতটা দেখে সকালে যেয়ো। ফলস পেইন হতে পারে। এখনো ডেট আছে। ব্যথাটা তখনও চিনচিনেই ছিলো। অতটাও তীব্র নয়।

বারোটার পর থেকে আচমকা হুট করেই ব্যথাটা তীব্র হয়। তখন শফিক সাহেবকে বলে সাথে সাথে গাড়ি ভাড়া করে হাসপাতালে নেয়া হয়। গাড়ির ঝাঁকুনিতে ব্যথা প্রকাণ্ড বাড়ে, জান যায় যায় এমন অবস্থা হয় প্রত্যাশার। অসহনীয় ব্যথায় প্রত্যাশার মুখ নীল হয়ে আসে। প্রত্যাশা যে গাইনির আন্ডারে চেকাপ করাতো, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তিনি বিশেষ প্রয়োজনে বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে আছেন। তাই চাইলেও এই মুহূর্তে আসা অসম্ভব।

রাত একটা কেবিনে প্রত্যাশার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। অসহ্য ব্যথায় মেয়েটা ঝটফট করছে। দীর্ঘ সময় ধরে বাচ্চার নড়াচড়া টের পাচ্ছে না। এটা শোনার সাথে সাথে ডিউটি ডাক্তার অক্সিজেন দিতে বলে। অক্সিজেনের ঘাটতি হলে বাচ্চার নড়াচড়া কমে যায়।

নীরবের আসতে আসতে একটা পাঁচ বেজে যায়। দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় ওঠে নীরব। করিডোরে নীরব ঢুকতেই শফিক সাহেবকে পেল। তাঁর মুখ গম্ভীর, চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। নীরব উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” প্রত্যাশার কী অবস্থা? ডক্টর দেখেছে?”

শফিক সাহেব হতাশ গলায় উত্তর দিলেন,

-” বাবা, ডাক্তার একজনই ডিউটিতে আছে। উনি বলছে, গাইনি ডাক্তার সকালে আসবে। এত রাতে নাকি কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।”

কথাটা শুনে নীরবের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। মুখ শক্ত করে বলল,

-” একজন মুমূর্ষু রোগী রাতভর ব্যথায় কষ্ট পাবে, আর ডাক্তার তাঁর সুবিধামতো সকালে আসবেন? যদি এরমধ্যে কোনো বিপদ হয়, তখন দায় নেবে কে? চিকিৎসা মানে শুধু প্রেসক্রিপশন না। এটা তো মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা, মানবিকতার জায়গা থেকেও দাঁড়ানো উচিত।”

কেবিন থেকে প্রত্যাশার ছটফটানির শব্দ ভেসে এল।
নিজেকে সামলে তাড়াহুড়ো করে কেবিনে ঢোকে নীরব। প্রত্যাশা বেডে শুয়ে, মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে স্যালাইন চলছে। ব্যথায় ছটফট করতে করতে মাস্কটা বারবার সরিয়ে দিচ্ছে। নীরব সামনে যেতেই প্রত্যাশা উঠতে চাইল। নীরব এগিয়ে গিয়ে ওকে আগলে ধরল। অস্থির চিত্তে তবুও স্বাভাবিক গলায় বলল,

-” প্রত্যাশা, চিন্তা করো না। সব ভালো হবে ইনশাআল্লাহ। আমি এক্ষুনি ডাক্তার ম্যানেজ করছি। একটু সহ্য করে নাও।”

প্রত্যাশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-” নীরব আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আর পারছি না। প্লীজ, তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকুন। আমি বোধহয় মরেই যাব।”

নীরবের বুকটা হাহাকার করে উঠল। অধরার গাল বেয়ে টপটপ পানি ঝরছে। নীরব আশ্বাস দিতে বলল,

-” প্রত্যাশা এসব আর মুখেও আনবে না। সবটা ভালো হবে ইনশা-আল্লাহ। তোমার কিচ্ছু হবে না।”

পাশ থেকে অধরাও বোঝানোর চেষ্টা করল। নীরব ব্যাকুল গলায় জিজ্ঞেস করল,

-” বাচ্চাদের নড়াচড়া টের পাচ্ছো?”

প্রত্যাশা দুপাশে মাথা নেড়ে না বোঝাল। তারপরই হাহাকার ভরা কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা। নীরবের বুকে মাথা গুঁজে একহাতে পিঠের টিশার্ট আঁকড়ে ধরল। শব্দ করে কাঁদতে থাকল। নীরবের চোখ জলে ভরে উঠল। খুব হেল্পলেস লাগছে নিজেকে। কী করবে ঠাওর করে উঠতে পারছে না। নীরব ইশারায় অধরাকে প্রত্যাশাকে সামলাতে বলল। আর দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেল ডিউটি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে।

ডিউটির ডাক্তারের সাথে কথা বলে প্রত্যাশার কন্ডিশন সম্পর্কে শোনে নীরব। তারপর সোজা কাউন্টারের দিকে এগোয়। কর্তব্যরত একজন ম্যানেজমেন্ট স্টাফ কাগজপত্র গুছাচ্ছিল। নীরব তাড়াহুড়ো করে বলল,

-” এখনই গাইনি ডাক্তারকে আনতে হবে। রোগী খুবই ক্রিটিক্যাল।”

লোকটা মাথা নেড়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,

-” স্যার, এতরাতে কোনো ম্যাডামই আসতে রাজি হচ্ছেন না। কয়েক জনের সাথেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কেউ আসতে রাজি হচ্ছে না। বেশিরভাগ ফোন পিক করছেই না। অবশেষে আমরা একজনকে ম্যানেজ করেছি, কিন্তু উনিও ভোর ছটার আগে আসবেন না। বাকিরা তো আটটা-নটার পর আসবে।”

নীরব চোয়াল শক্ত করে দাঁত চেপে বলল,

-” মানে কী? একজন মা রাতভর যন্ত্রণায় ছটফট করবে। বাচ্চাদের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও আপনারা শুধু বলে যাবেন সকাল হলে আসবে? মানুষের জীবন যদি আপনাদের কাছে এত সস্তা হয়, তাহলে হাসপাতাল চালান কেন?”

লোকটা একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,

-” স্যার, আমরা চেষ্টা করছি। ডাক্তারদেরও তো সীমাবদ্ধতা আছে__”

নীরব এবার আর ধৈর্য ধরতে পারল না। কণ্ঠ উঁচু করে বলল,

-” এক সেকেন্ডও যদি দেরি হয়, মা-বাচ্চা দুজনেরই জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। আমি চুপচাপ বসে থাকব না। এখনই ব্যবস্থা নিন। আপনি চাইলে উনাদের ফোন ধরিয়ে দিন, আমি নিজেই কথা বলব।”

লোকটা কিছু বলার আগেই নীরব আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলে চাপড়ে গলা চড়িয়ে বলল,

-” ডিউটির নাম করে শুধু সাইন দেয়া হবে না। এখানে মানুষ মরছে, মানুষ বাঁচানোই আপনাদের কাজ। যা বলছি ফাস্ট করুন।”

কয়েকজন ডাক্তারের কাছে কল দিলেও তোলে না। সিনিয়র নার্স এসে বলল,

-” আমাদের এখানে একজন কাইন্ড হার্টেড ম্যাম আছেন। ওনাকে একবার কল দিয়ে দেখতে পারেন। কিছুদিন আগে এরকম রাতে একটা ইমার্জেন্সি কেসে এসেছিলেন।”

নীরব বলল,

-” কাইন্ডলি নম্বরটা দিন। আমি কল করছি।”

.

অদ্রিকার ফোনটা ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে কাঁপতে লাগলো। সার্থক বলল,

-” অদ্রি ফোন এসেছে।”

অদ্রিকা ঘুমের মধ্যে নড়েচড়ে বলল,

-” কে দিয়েছে?”

সার্থক ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,

-” আন্নাউন নম্বর।”

অদ্রিকা চোখ বুজেই বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল,

-” ধূর, বাদ দাও তো। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। পাওয়ার অফ করে রাখো।”

এই বলে সার্থকের গায়ের উপর হাত রেখে জড়িয়ে ধরে আয়েশিভঙ্গিতে শোয় সে।

রিং হয়ে কে’টে গেল। নীরবের কপালের রগ টনটন করছে। এরমধ্যে ডিউটি ডাক্তার প্রত্যাশাকে আবার দেখে আসে। প্রত্যাশার ওয়াটার ব্রেক হয়েছে। ব্যথাও তীব্র। ডিউটি ডক্টরের হাতের ভাঁজে স্টেথোস্কোপ মোড়ানো। নীরবের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলল,

-” মিস্টার নীরব, আপনার ওয়াইফের কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। পেশেন্টের শারীরিক কন্ডিশন দেখে মনেহয় না নরমাল ডেলিভারির স্ট্রেস নিতে পারবে। টুইন বেবির নরমাল ডেলিভারি পসিবল হবে না। আর অ্যাট দিস মিডনাইট কোনো সার্জন অ্যাভেইলেবল নেই। সো প্লিজ, প্রিপেয়ার ফর এনি ওরস্ট-কেস সিচুয়েশন।”

#চলবে।