#মধ্য_রাতের_চাঁদ |অন্তিম পর্ব প্রথম অংশ|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
-” মিস্টার নীরব, আপনার ওয়াইফের কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। পেশেন্টের শারীরিক কন্ডিশন দেখে মনেহয় না নরমাল ডেলিভারির স্ট্রেস নিতে পারবে। টুইন বেবির নরমাল ডেলিভারি পসিবল হবে না। আর অ্যাট দিস মিডনাইট কোনো সার্জন অ্যাভেইলেবল নেই। সো প্লিজ, প্রিপেয়ার ফর এনি ওরস্ট-কেস সিচুয়েশন।”
শব্দগুলো শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই নীরবের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। লহমায় পুরো পৃথিবী যেন থমকে গেল ওর। শ্বাসটা আটকে আসছে। বাইরে থেকে নিজেকে নিস্তব্ধ রাখলেও ভেতরে তোলপাড় করা ঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে নীরবের। শক্ত, আত্মবিশ্বাসী পুলিশ অফিসার নিজেকে এই মুহূর্তে একজন ভেঙে পড়া অসহায় স্বামী মনে হচ্ছে। এতটাই অসহায় যে বউ বাচ্চার এই ক্রিটিক্যাল মূহুর্তে কিছুই করতে পারছে না। নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।
হঠাৎই মস্তিষ্ক এক ফ্রেন্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। পুরনো এক ফ্রেন্ড গাইনোকলজিস্ট। যদিও দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। তবুও এই শহরে থাকে এতটুকু জানা আছে। তার কাছে কল দেয়ার আগে নীরব ডক্টর অদ্রিকা আহসানের কাছে দ্বিতীয় আর শেষ বারের মত চেষ্টাটুকু করল। ফোনটা কানে চেপে অস্থির চিত্তে ঠোঁটজোড়া নিঃশব্দে নড়ল,
-” প্লীজ, পিক আপ দ্যা ফোন…।”
ডিউটির ডক্টর হতাশ গলায় বললেন,
-” পেশেন্টকে যদি সাড়ে বারোটার মধ্যে আনা হতো, তাহলে এতটা জটিলতা তৈরি হতো না। বারোটা পর্যন্ত ডক্টর অ্যাভেইলেবল পাওয়া ব্যাপার না। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এই মুহূর্তে সকলে বিশ্রামে থাকে। প্রধান সমস্যা হলো ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, বেশিরভাগই ধরছেন না। যাও বা দু-তিনজন ধরল, আসতে রাজি হচ্ছেন না। নিজস্ব প্রব্লেম এটাসেটা বলে কাটিয়ে দিচ্ছেন। তারপরেও আমরা ট্রাই করছি, দেখি সকালের আগেই কাউকে ম্যানেজ করা যায় কী না।”
আবার কল আসতেই সার্থক বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
-” অদ্রি ধরবে?”
অদ্রিকা ঘুমঘুম স্বরেই বলল,
-” উফ্! ঘুমে চোখ মিলতে পারছি না এদিকে কে এই মাঝরাতে বিরক্ত করছে।”
-” তোমার কোনো পেশেন্ট হতে পারে।”
-” আচ্ছা, না কেটে দ্যাখো তো কে? আমার পেশেন্ট কী না।”
অদ্রিকার ফোন সার্থক ধরতে চাইছিল না, কিন্তু এই মেয়ে যে ঘুমকাতুরে তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই রিসিভ করে সার্থক। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে অস্থির, ব্যাকুল হয়ে একনাগাড়ে পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
-” আসসালামুয়ালাইকুম ডক্টর। আই অ্যাম এএসপি নীরব মাহবুব। আপনাদের ডক্টরস ক্লিনিকে আমার ওয়াইফকে এডমিট করা হয়েছে। আমার ওয়াইফের কন্ডিশন খুবই ক্রিটিক্যাল। টুইন বেবী, ডক্টর বলেছেন নরমাল ডেলিভারি হাই রিস্ক হবে। এই মুহূর্তে কোনো সার্জন অ্যাভেইলেবল নেই। প্লিজ, আই বেগ ইউ..কাইন্ডলি আসুন। ইটস আ লাইফ সেভিং ম্যাটার।”
নীরব নিজের পরিচয় দিয়ে শুরু করে, তারপর গলার স্বর শুনে সার্থক স্তব্ধ বনে যায়। ন্যানো সেকেন্ডে প্রত্যাশার মুখটা দু’চোখে ভেসে উঠল। আর উঠতেই কাল বিলম্ব না করে তড়িঘড়ি বলল,
-” ওকে ওকে, ডক্টর অদ্রিকা ইজ কামিং।”
নীরব স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলল,
-” থ্যাঙ্কস, থ্যাঙ্কস আ লট। প্লিজ হ্যাভ ডক্টর অদ্রিকা কাম অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। আমার ওয়াইফ আর বেবিদের জন্য এভরি সেকেন্ড ম্যাটার্স।”
সার্থক জোড়াল শ্বাস টেনে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে হাসপাতালে কল করল। বলল,
-” ইমার্জেন্সি যে পেশেন্ট এসেছেন উনার কী অবস্থা?”
-” স্যার পেশেন্ট ইয়ানূর প্রত্যাশার কথা বলছেন?
-” জ্বী।”
-” স্যার ডেলিভারি কেস। টুইনস জন্য নরমাল ডেলিভারির রিস্ক নিতে চাইছি না। বাট…”
সার্থক থামিয়ে দিয়ে কণ্ঠে আদেশ নামিয়ে বলল,
-” এক্ষুনি ও.টি রেডি করুন। আপনাদের ম্যাডাম ফিফটিনস মিনিটের মধ্যেই উপস্থিত হবে। ও হ্যাঁ, অ্যানেসথেসিয়া ডক্টর আছে?”
-” স্যার এক্ষুনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।”
-” না হলে আমাকে ফাস্ট জানান। আমি ম্যানেজ করে দিচ্ছি। এক সেকেন্ডও যেন ন’ষ্ট না হয়, মাইন্ড ইট?”
-” ঠিক আছে স্যার।”
অদ্রিকা ঘুমিয়ে থাকলেও সার্থকের কথা সে শুনতে পেল। তবে চোখে ঘুমের রেশ এতটাই যে কিছু বলতে পারল না। এরমধ্যে সার্থক ওর গায়ের উপর একটা হাত রেখে হালকা ধাক্কা দিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
-” অদ্রি, ফাস্ট উঠো। এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে।”
অদ্রিকা চোখবুঁজেই ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,
-” কে ফোন দিয়েছিল আমার পেশেন্ট? কী সমস্যা?”
-” তোমার পেশেন্ট নয়। তবে ইমার্জেন্সি কেস, সি-সেকশনে নিতে হবে। তাড়াতাড়ি উঠো।”
-” প্লীজ, বিরক্ত করো না। আজ দিনে পাঁচটা ও.টি ছিলো আমার। রাত সাড়ে এগারোটায় শেষ ও.টি টা করে বেড়িয়েছি। আজ পেশেন্টের চাপও বেশি ছিলো। আমি খুব টায়ার্ড। অন্য কাউকে একটু ম্যানেজ করে দাও না। বউয়ের উপর একটু তো রহম করো।”
সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে ক্লান্ত, তারওপরে কাঁচা ঘুম। অদ্রিকার ধ্যান যেন এখন ঘুমানোতেই সীমাবদ্ধ। ঘুমের চোটে বাকিসব তার মস্তিষ্ক ভালোভাবে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ। সার্থক উঠে বসল। বেড টেবিলের উপর থেকে পানির বোতলটা হাতে নিয়ে অদ্রিকার চোখমুখের উপর ছিটিয়ে দিল। অদ্রিকা এবারে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। আচমকা পানি পড়ায় সে ভড়কে যায়। হাত দিয়ে চোখমুখের পানি মোছার চেষ্টা করে চেঁচিয়ে উঠল,
-” কী আশ্চর্য! পাগল হলে নাকি! পানি ছিটাচ্ছো কেনো?”
-” টু মিনিটস সময় দিলাম রেডি হতে। জলদি তৈরি হয়ে নাও। প্রত্যাশা হাসপাতালে, লেবার পেইন উঠেছে। মাঝরাতে ডক্টর ম্যানেজ করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তুমি এক্ষুনি যাচ্ছো, আর কোনো কথা নয়।”
অদ্রিকার চোখের ঘুম নিমিষেই কেটে গেল। ও ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নিম্ন অধরে দাঁত চেপে বলল,
-” পেশেন্টটা প্রত্যাশা বলেই কী এতটা সিরিয়াস হচ্ছো? নাকি ইমার্জেন্সি বলে? কোনটা?”
সার্থক নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
-” দুটোই।”
অদ্রিকা বেড ছেড়ে নামতে নামতে বলল,
-” হাজবেন্ডের না হওয়া প্রে..”
সার্থক বুঝে নেয় অদ্রিকা কী বলতে চাইছে। অদ্রিকাকে থামিয়ে দিতে বলল,
-” তোমার থেকে এই মুহূর্তে এই ধরণের কথাবার্তা একদমই আশাকরি না।”
অদ্রিকা ওয়াশ রুমে যেতে যেতে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,
-” সার্থ শোনো, একজন ইমারজেন্সি পেশেন্ট, তারপর পেশেন্ট তোমার কাজিন আমি কিন্তু এই সূত্রেই যাচ্ছি। এছাড়া শুধু তোমার..”
সার্থক গলা চড়িয়ে বলল,
-” অদ্রি স্টুপিডের মতো কথা বলো না, প্লীজ।”
_____________
ব্যথায় মনে হচ্ছে জানটা এবার বেরিয়ে যাবে প্রত্যাশার। তীব্র ব্যথায় গলা কা*টা মুরগীর মতো ছটফট করছে। ফাঁকা হাতে বেড শিটটা শক্ত করে মুঠো করে ধরল, চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরছে অনবরত। অকস্মাৎ এই মুহূর্তে জন্মদাত্রী মায়ের কথা মনে উঠল। সত্যিটা জানার পরেও মায়ের কথা মনে পরে না। ওই জঘন্য সত্যিটা কখনো মনে উঁকি দিলেও মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃ*ণা হয়। ঘৃ*ণা হয় নিজের প্রতিও। মনেহয় অদৃশ্য থেকে চিৎকার করে বলে– তুই পাপ। তোর শরীরে পাপের র*ক্ত বইছে। সেই মূহূর্তে ঘৃ*ণাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তবে আজকে এই কঠিন মূহুর্তে মনে হচ্ছে, তার পরিণতিও বুঝি তার জন্মদাত্রীর মতোই হতে যাচ্ছে। তাকে জন্ম দিতে গিয়ে সেই মেয়েটা প্রাণ হারিয়েছে। আজ কী তবে সেটারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে?
প্রত্যাশার বুক কেঁপে উঠল। আজ নটা মাস দু’টো প্রাণ নিজের ভেতর বহন করছে, দুচোখে কত স্বপ্ন নিয়ে আজকের এই প্রতিক্ষিত দিনটার প্রহর গুনেছে। কত স্বপ্ন, কত আশা বুকে বাসা বেঁধেছে। ছোট প্রাণ দু’টোকে বুকে আগলে রাখবে, খুব আদর করবে। এই স্বপ্ন, এই আশা সব কী তবে অপূর্ণই রয়ে যাবে? বাচ্চাদের মুখটাও কী দেখা হবে না?
হাহাকারে প্রত্যাশার দম আঁটকে আসার উপক্রম। তবুও মায়ের মনটা চাইছে ছোট প্রাণ দু’টো যেন পৃথিবীর আলো দেখতে পায়। তারা যেন সুস্থ থাকে। মহান রবের কাছে এতটুকু প্রার্থণা করল প্রত্যাশা।
করিডোরে দেয়ালে ঠেস দিয়ে একপা দেয়ালের সাথে ভেঙে দাঁড়িয়ে নীরব। নিঃশব্দে ঠোঁট নড়ছে, দোয়া পাঠ করছে। আল্লাহকে বারংবার স্মরণ করছে। নিভান মাত্রই নীহারিকাকে নিয়ে আসল। নীহারিকা জিজ্ঞাসা করতেই শফিক সাহেব বলেন– ‘ডক্টর আসছে, রাস্তায় আছেন।’ এরমধ্যে দমে রাখা রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল নীরবের। শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে ফেলল,
-” প্রত্যাশা নয়টার পর যখন বলেছে তখন আপনারা কোন আশায় বসেছিলেন? আমাকে ফোন করে জানাননি কেনো?”
শফিক সাহেব মাথাটা নিচু করে ফেললেন। জবাব দিতে ব্যর্থ হলেন। নীরব গলার স্বর অমন চড়াও রেখেই ফের বলল,
-” মেয়েকে নেয়ার জন্য তো উঠেপড়ে লেগেছিলেন। আজ আপনাদের গাফিলতির জন্য যদি ভালো ছেড়ে মন্দ কিছু হতো? তখন নিজেরদেরকেই বা কী জবাব দিতেন?”
নিভান ফট করে নীরবের কাঁধের উপর একটা হাত রাখল। চোখের ইশারায় থামতে বলল। পরপর বলল,
-” নীরব থাম ভাই। এখন এসব বললে ফিরে আসবে না। যা ভুল হওয়ার হয়েছে। মাঝেমধ্যে এরকম হয়ে থাকে। হয়তো কপালে এতটুকু ভোগান্তি লিখা ছিলো তাই এমনটা হয়েছে।”
নীরব তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
-” ভাইয়া প্রত্যাশা ব্যথায় ছটফট করছে, আমার বাচ্চাদের রেসপন্স পাওয়া যাচ্ছে না। এই ভোগান্তি, এই দুঃসময় আসতো না, যদি না ওনারা গাফিলতি করতো। কীসের আশায় ওনারা বসে ছিলো, আমার মাথায় ধরছে না।”
নীহারিকা বললেন,
-” নীরব থাম বাবা। আমি ফোনে বেয়াইনের সাথে কথা বলেছি। নয়টার দিকে প্রত্যাশা চিনচিনে ব্যাথার কথা বলে। বাচ্চা ডেলিভারির আগে মাঝে মাঝে এমন ব্যথা হয়ে থাকে। আবার ঠিক হয়ে যায়। বেয়াইনও সেরকমটাই ভেবেছিল তাই সিরিয়াসলি নেননি। আচমকা বারোটার পর থেকে পেইন বেড়ে যায়।”
নীহারিকা থেমে দম ফেলে বললেন,
-” যা হওয়ার হয়েছে এখন এসব বাদ দে। সবটা যেনো ভালো হয় এই দোয়াই করি। বেশি বেশি দোয়া ইউনুস পাঠ কর বাবা।”
আর বাড়তি কথা না বলে কেবিনে ঢোকেন নীহারিকা।
_____________
সার্থক গাড়ি থেকে নামল না। জানালার কাঁচ নামিয়ে মাথাটা বের করে শুধু বলল,
-” অদ্রি, আমি এখানেই আছি। কোনো সহযোগিতা লাগলে কল দিও।”
অদ্রিকা গম্ভীর মুখে হালকা মাথা নেড়ে সায় দিল। দ্রুত পায়ে ক্লিনিক ভবনের দিকে এগিয়ে গেল। চেম্বারে ঢুকে সাদা এপ্রোন গায়ে চাপাল। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে পাঁচতলার উদ্দেশ্য লিফটে চড়ল। সাথে একজন নার্স ছিলো। নার্স দরজাটা খুলে ধরতেই অদ্রিকা কেবিনে প্রবেশ করে। ভিতরে প্রবল ব্যথায় ছটফট করতে থাকা প্রত্যাশাকে দেখে খারাপ লাগল। এগিয়ে গিয়ে প্রথমে স্টেথোস্কোপটা প্রত্যাশার পেটের ওপর রাখল। কয়েক সেকেন্ড মনোযোগ দিয়ে শুনে বলল,
-” ডোন্ট ওরি, বেবিগুলো ঠিক আছে। হার্টবিট ক্লিয়ারলি ফিল হচ্ছে।”
নীরব একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। মাথা ঊর্ধমুখী তুলে নিঃশব্দে আল্লাহকে শুকরিয়া জানাল। একটা অজানা ভার বুক থেকে নেমে গেল।
অদ্রিকা একহাত বাড়িয়ে প্রত্যাশার মাথায় রাখল। অমায়িক গলায় বলল,
-” প্রত্যাশা, চিনতে পারছো আমাকে?”
ব্যথায় জান যায় যায় যায় প্রত্যাশার কোনোদিকে লক্ষ্য নেই। বাচ্চারা সুস্থ আছে, এটুকু শুনতেই বুকের উপর থেকে পাথর নেমে যায় ওর। তীব্র যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে, তবু ভালো করে অদ্রিকার মুখের দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
-” হ-হুউউ।”
অদ্রিকা মিষ্টি করে হাসল। আশ্বস্ত করতে বলল,
-” ভ’য় পেয়ো না। মা হতে গেলে একটু কষ্ট সহ্য করতে হয় যে মিষ্টি মেয়ে। তুমি তো খুব সাহসী মেয়ে। কোনো ভ’য় নেই। টুইন্স না হলে আমি কিন্তু নরমাল ডেলিভারিই সাজেস্ট করতাম। যেহেতু টুইন্স বেবি, আর প্রথম ডেলিভারি রিস্ক নিচ্ছি না।”
পেটের ওপর হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলল,
-” ওয়েট ভালোই হয়েছে। তোমার শরীর স্ট্রেস নিতে পারবে না। এক্ষুনি সি-সেকশনে নিচ্ছি।”
নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল অদ্রিকা,
-” মিস্টার নীরব, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হবে। টেনশন করবেন না। ও.টি রেডি হলে প্রত্যাশাকে নিয়ে যাবে।”
এতক্ষণে নীরবের খেয়াল হলো, একে কোথাও দেখেছে। পরক্ষণেই তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক শিওর করল, হ্যাঁ একে সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছিল। সার্থকের ফ্রেন্ড। বলাবাহুল্য সার্থকের বিয়ের খবর অজানা। নীরব মাথা মাথা নুইয়ে কৃতজ্ঞ গলায় বলল,
-” থ্যাঙ্কস আ লট ডক্টর। সময়মতো আসার জন্য।”
-” এটা আমার ডিউটি।”
পরপর নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” পেশেন্টকে রেডি করে ও.টিতে আনো। আমি ও.টি তে যাচ্ছি। বাকিরা বোধহয় এতক্ষণে উপস্থিত হয়েছে।”
___________
স্ট্রেচারে প্রত্যাশা। ও.টি তে ঢোকার আগে সবার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ওর কান্না দেখে সবাই নিজেকে সামলে বুঝ দিতে থাকল। নীহারিকা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা চিন্তা করো না কিচ্ছু হবে না। সবকিছু ভালোই হবে ইনশাআল্লাহ।”
অধরা শাড়ির আঁচল টেনে মেয়ের গাল মুছে দিলেন। প্রত্যাশা মায়ের একটা হাত আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠল। অধরার বুক ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে। ঠোঁট মেলে কিছু বলবেন তার আগেই নার্স তাড়া দেয়। প্রত্যাশা মাথা তুলে নীরবের দিকে তাকাল। অধরা সরে দাঁড়ালেন। নীরব সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রত্যাশার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরল। অন্যহাতে প্রত্যাশার চোখের পানি টোকা দিয়ে ফেলে দিল। মৃদুস্বরে বলল,
-” প্রত্যাশা, চোখের পানি ফেলো না। একদম ভ’য় পেয়ো না। আমাদের তো একটা গোটা জীবন বাকি।তোমার আমার একসাথে হাঁটার গল্প, স্বপ্ন গড়া, ছোট ছোট ঝগড়া, বড় বড় ভালোবাসা। আমি তোমার হাত ধরে একটা গোটা জীবন পার করতে চেয়েছি। প্লীজ, ভেঙে পড়ো না। আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে সংসারটা পরিপূর্ণ করতে তুমি ফিরবে; আমার কাছে, আমাদের কাছে, ইনশাআল্লাহ।”
এরমধ্যে স্ট্রেচারে টান পড়ল। নীরবের হাতের মুঠোটা ধীরেধীরে আলগা হয়ে গেল। প্রত্যাশার হাতটা ছুটে যায়। প্রত্যাশার চোখদুটো ও.টি-র দরজার ওপাশে যাওয়ার আগ অবধি নীরবের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। নীরব চোখের পলক নামিয়ে আশ্বাস দিল। তারপর দুই আঙুল থুতনির সামনে ধরে বোঝাল হাসো। তোমার ওই হাসি মুখটা দেখতে চাই। কপালে তীব্র ব্যথার ভাঁজ নিয়েই ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটাল প্রত্যাশা। নীরব সেদিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে বিনিময় জোরপূর্বক অধর কোণে হাসি টানল।
.
কোমরে ইনজেকশন পুশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সব ব্যথা জাদুর মতো গায়েব হয়ে গেল। দীর্ঘ সময় ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করা প্রত্যাশার শরীরটা হালকা, নিস্তেজ হয়ে এল। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাল। ঠান্ডা, ঝকঝকে ও.টি রুম। মাথার ওপরে আলো, পাশে স্টিলের ট্রেতে সারি সারি যন্ত্রপাতি, কাঁচি-চিমটা সব গুছিয়ে রাখা হচ্ছে।
অদ্রিকা নীল রঙের ডাবল এপ্রোন পরে নিয়েছে। মুখ ঢাকা, হাতে গ্লাভস। একেবারে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে প্রত্যাশার পাশে এসে দাঁড়াল সে। ওপাশে আরেকজন ডাক্তার। অ্যানেসথেসিওলজিস্টও আছেন। নার্স বেডের পাশের বাটনে চাপ দিতেই প্রত্যাশার বুকের একটু নিচে স্ট্যান্ড উঠে এলো। তার ওপরে একটা পরিষ্কার তোয়ালে রাখা হলো। এক নার্স এসে প্রত্যাশার ডান হাতটা ধরল আলতো করে। প্রত্যাশার মন শান্ত রাখার জন্য অদ্রিকা মৃদু হেসে বলল,
-” তুমি কিন্তু সত্যিই অনেক সাহসী মেয়ে, প্রত্যাশা।”
নার্স মেয়েটা কোমল গলায় বলল,
-” মাথা নিচু করে রাখুন, চোখ বন্ধ করলে ভালো লাগবে।”
ক্যাচ ক্যাচ কা’টা’র শব্দ প্রত্যাশার কানে আসছে, পেটে একটা টানও অনুভব হচ্ছে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে প্রত্যাশার। ওই কম্পিত ঠোঁটে নিঃশব্দে বিড়বিড় করে সূরা ফাতিহা পাঠ করছে ও।
কিছুপল পরেই বাচ্চার কান্না শোনা গেল। ছোট্ট একটা গলা, অথচ তীব্র স্পষ্ট। অদ্রিকা দুইহাতে তুলতেই পাশের নার্স দ্রুত হাত বাড়িয়ে কোলে নিয়ে পরিষ্কার করতে নেয়। পরমূহুর্তেই আরেকটা বাচ্চা তুলতে তুলতে বলল,
-” আলহামদুলিল্লাহ। প্রত্যাশা তোমার দুইটা ছেলে বেবি হয়েছে।”
প্রত্যাশার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে। আনন্দ অশ্রুতে গাল ভিজে গেল। কয়েক মূহুর্ত পরপরই আরেকটা বাচ্চা তুলে আরেকজন নার্সের কোলে বাচ্চাটা দিতে দিতে বলল অদ্রিকা,
-” খেয়াল রেখো, এটা ছোট বাচ্চা হবে। প্রায় এক মিনিট দেরিতে এসেছে।”
এই বাচ্চাটা এখনো কাঁদছে না। সিস্টার বলল,
-” ম্যাডাম এ এখনো কাঁদেনি তো।”
অদ্রিকা বলল,
-” চেষ্টা করো। কাঁদবে, সময় নাও।”
পরপরই অদ্রিকা বলল,
-” মা’কে বাচ্চা দেখাও।”
ধবধবে ফর্সা নবজাতককে ধরা হলো প্রত্যাশার সামনে। ছোট্ট চোখ দুটি যেন কালো মার্বেল, ঠোঁট টকটকে লাল। প্রত্যাশার গালের পাশে গাল ছুঁয়ে দেয়া হলো। প্রত্যাশা ফুঁপিয়ে উঠল। ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে হৃদয় ভরে উঠল। প্রত্যাশার হাত বাড়িয়ে আদর করতে ইচ্ছে করছে। পরক্ষণেই নার্স টান দিয়ে সরিয়ে নেয়।
ওদিকে নার্স উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ছোট বাচ্চাটার পিঠ চাপড়ে বলল,
-” ম্যাডাম এ তো এখনো কাঁদছে না।”
কাঁদানোর সব কৌশল করা হচ্ছে, তবুও কাঁদছে না বাচ্চাটি। অদ্রিকা দক্ষ হাতে তার কাজ করতে করতে বলল,
-” চেষ্টা করো।”
প্রায় দশমিনিট পর ছোট বাচ্চাটা কাঁদল। আর কান্না শুরু করল তো করলোই থামছে না। প্রত্যাশা সবটা শুনছে। ও ভাঙা গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,
-” ছোট বাচ্চাটাকে দেখব।”
নার্স এসে ছোট বাচ্চাটিকে সামনে ধরল। কাপড়ে মোড়া, চোখ আধা বুজে কাঁদছে সে। নাকটা টুকটুকে লাল হয়ে গেছে কান্নার দরুণ। প্রত্যাশার সামনে থেকে ফট করে সরিয়ে নেয়া হয়। ঔষধের প্রভাবে প্রত্যাশা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।
ও.টির দরজার সামনে সবাই দাঁড়িয়ে। নীরব কপালে হাত চেপে চোখবুঁজে দাঁড়িয়ে। দরজা খুলতেই বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে এল। নার্সের কোলে সাদা তোয়ালের ভেতর বাচ্চা। এগিয়ে এসেই হাসিমুখে বলল,
-” জোড়া ছেলে বাচ্চা হয়েছে।”
সবাই একযোগে তাকাল। নীরব এগিয়ে এসে অস্থির গলায় জিজ্ঞাসা করে,
-” প্রত্যাশা… পেশেন্ট ইয়ানূর প্রত্যাশা কেমন আছে?”
-” সবাই ভালো আছে। বাচ্চাকে ধরুন।”
নীরব একটু থমকে গেল। পাশে অধরা, নীহারিকা দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে অভিভাবকসুলভ প্রশান্তি ওর। কিন্তু তাদের সামনে প্রথমবার সন্তানকে কোলে নেওয়ার লজ্জা, সংকোচ নীরবকে পেছনে টেনে রাখছে। ও ইতস্তত করতে লাগল। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল। নীহারিকা ছেলের মনের অবস্থা টের পেতেই পাশ থেকে বলে উঠলেন,
-” নীরব, কোলে নে।”
নীরব হকচকিয়ে গেল,
-” আমি? মানে, এখন?”
নীহারিকা হেসে বললেন,
-” নে তুই। বাচ্চাটাকে আগে তুইই ধর। আমরা পরে নেবো।”
নীরব হাত বাড়াল। নার্স সাবধানে তোয়ালে মোড়া বাচ্চাটিকে তার কোলে দেয়। নীরবের হাত দু’টো কাঁপছে। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। বাচ্চার গা থেকে গরম গরম কোমল একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল নীরবের বুকে। মনে হলো বুকের ভেতর কিছু একটায় জমে থাকা বরফ গলে যাচ্ছে। চোখের কোণে অজান্তেই পানি এসে ভিড়ল। ছোট্ট মুখ, কাঁপা কাঁপা ঠোঁট, চোখের কালো মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাচ্চাটি দেখছে। নিজের র*ক্ত, মাং*সের একটা প্রাণ স্পর্শ করছে। সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া নিজের অংশকে কোলে নিয়ে নীরবের চোখে আনন্দ অশ্রু চিকচিক করে উঠল। নীরব চেয়ে রইল বাচ্চাটির মুখের দিকে। অবচেতনে বলল,
-” আমার ছেলে, আমার র*ক্ত।”
পরপরই নীরব নার্সের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
-” আরেকজন? আরেকটা বেবি কই?”
-” বাচ্চাটার কান্না থামছে না, কান্না থামলেই দিবো।”
তন্মধ্যে আরেকটা বাচ্চাকে এনে বলল,
-” এই যে আপনাদের ছোট বাচ্চাকে নিন। কান্না থামছিলই না। যাক অবশেষে থামাতে পারলাম।”
অধরা সামনে ছিলো। অধরার কোলে দেয়া হয়। নীরব কোল থেকে বাচ্চাটাকে মায়ের কোলে দিলো।
নিভান ওখানেই ছিলো। সে গাল ছুঁইয়ে আদর দিল। বলল,
-” মাশা-আল্লাহ! দেখতে খুব কিউট হয়েছে।”
নীহারিকা বললেন,
-” কোলে নে।”
নিভান ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” এত ছোট ধরতেই ভয় হচ্ছে। পরে নিবো।”
নিভান দু’টো বাচ্চাকে নোটিশ করে বলে উঠল,
-” মা দ্যাখো একটা জিনিস, ছোটজনের কিন্তু নীরবের মতো জোড় ভ্রু, বড়জনের কিন্তু আলাদা। আর আমার কাছে মনে হচ্ছে দুজনে দেখতে একদম সেমও নয়।”
অধরাও বললেন,
-” হ্যাঁ একদম ঠিক ধরেছো। আমারও তাই মনে হচ্ছে।”
নিভান ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ফোনে ছবি তুলতে থাকল। বলল,
-” নীরব দু’জনকে একসাথে কোলে নে।”
নীরব এক আঙুলে কপাল চুলকিয়ে হেসে বলল,
-” একসাথে দুজনকে? সামলাতে পারব না। এত ছোট, লাগবে ভেবে ধরতেই ভ’য় হয়।”
নীহারিকা বললেন,
-” আমি পাশে থাকছি।”
নীরবের দুই হাতের মাঝে দু’টো বাচ্চাকে রাখা হলো। পাশেই অধরা আর নীহারিকা দাঁড়িয়ে। নিভান ছবি তুলতে থাকল। বলল,
-” মা আপনারা হাত সরান, কিছু হবে না। বাবার কাছে সবচেয়ে নিরাপদ যায়গায় আছে ওরা।”
নীরব মাথাটা হালকা নিচু করে বুকের সাথে আগলে রাখা নাজুক প্রাণ দু’টোকে দু’চোখ ভরে দেখল। প্রাণ জুড়িয়ে এল। এত আনন্দ আগে কখনো হয়নি। এই অনুভূতি নতুন, অন্যরকম। নীরব মনেমনে বলল,
-” আজ থেকে জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। যেখানে আমি আর প্রত্যাশা শুধু আমরা নই। আমাদের দুটো হৃদস্পন্দন আর নিঃশ্বাসও আছে। যারা আমাদের অংশ হয়ে এসেছে পৃথিবীতে। আর
এখন আমি শুধু নীরব নই, একজন বাবা। এই দুটো কোমল প্রাণ, আমার অস্তিত্বের সবচেয়ে নিখুঁত ব্যাখ্যা।
ভয়, দ্বিধা, ক্লান্তি সবকিছু ছাপিয়ে এখন শুধু একটাই চাওয়া; ওদের ভালো রাখা, ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা। আজ থেকে জীবন নতুন অর্থ পেল, নতুন দায়, নতুন ভালোবাসা। এই দুটি প্রাণ আমার চোখের মণি, আমার পৃথিবী। শুকরিয়া আমার রবকে, যিনি আমাকে পরিপূর্ণ করেছেন।”
___________
পরেরদিন…
সময়টা চারটা নাগাদ। বাচ্চার কান্নার শব্দে সকলের মাথা ধরে আসছে। তাকে থামাতে গিয়ে বড়রা হয়রান হলেও বাচ্চাটি কাঁদতে কাঁদতে এতটুকু হয়রান হচ্ছে না। চোখদুটো বুজে উঙগা উঙগা করে সর্বোচ্চ ভলিউম দিয়ে কাঁদছে। প্রত্যাশা বিরক্ত হয়ে বলল,
-” আম্মু, মাথা ধরে যাচ্ছে তো। ওকে থামাও।”
অধরা বললেন,
-” কী করব, থামছে না তো। পাঁচ মিনিট চুপ থাকলে আবার শুরু করে।”
এরমধ্যে নীলাশা আসে। এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাছে দাঁড়াল। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এত কাঁদছে কেনো?”
অধরা বললেন,
-” নীলা এসেছিস। দ্যাখ না ছোট বাচ্চাটার কেমন কান্না থামছেই না। একটু চুপ থাকলেই আবার শুরু করে।”
-” কোনো সমস্যা হয়নি তো? শিশু ডাক্তার দেখানো হয়েছে?”
-” হ্যাঁ, শিশু ডাক্তার দেখেছেন। কোনো সমস্যা নেই।”
প্রত্যাশা বেডে শুয়ে, হাতে স্যালাইন চলছে। এদিকে তাকিয়ে বলল,
-” এ তো প্রথমে কাঁদছিলোই না, তারপর থেকে ওইযে শুরু করল, বান্দা থামতেই চাইছে না। দুমিনিট থামলে আবার দশমিনিট কাঁদছে এমন।”
নীহারিকার কোলে বড় বাচ্চাটা। মাত্রই ফিড করানো হয়েছে। দু এক ফোঁটা যা পাচ্ছে সেটাই খেয়ে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে থাকছে। নীহারিকা বললেন,
-” নীলাশা ধরো।”
নীলাশা মনেমনে খুশিই হলো। সে সাহস করে বলতে পারছিল না। হাত বাড়িয়ে নিয়ে ওপাশের বেডে কোলের মধ্যে নিয়ে বসল। বুকের ভেতর একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেল। চোখদুটো ছলছল করে উঠল। আঙুল দিয়ে ঘুমন্ত বাচ্চাটার আঙুলের ভাঁজে একটা আঙুল গুঁজে দেয়। পরম যত্নে কপালে চুমু আঁকল। প্রত্যাশার ভাগ্য সুপ্রসন্ন মনে হলো, চাঁদের মতো দু’টো বাচ্চা। এদিকে সে একটা বাচ্চার জন্যই হাহাকারে ম*রছে। নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,
-” নিভান কই?”
-” আসছে, নিচে আছে ও। ফল কিনতে গেছে বোধহয়।”
-” নীরবকে তো দুপুরে জোর করে বাসায় পাঠালাম। সেই রাত থেকে দৌড়াদৌড়ি করছে, সকালে এখানে কী একটু মুখে দিল। বললাম বাসায় গিয়ে গোসল করে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আসিস। নীরব গিয়ে খেয়েছে, নীলাশা?”
-” আসার আগে নীরবকে লাঞ্চের জন্য ডাকতে গিয়ে দেখি ও ঘুমিয়ে পড়েছে। ডেকে খাওয়ার কথা বলতেই বলল, ভাবি পরে খেয়ে নিবো।”
-” ইচ্ছে কী করে? তাকে আনতে পারতে। সকালে ছোট এসেছিল তখন স্কুলে ছিলো বলে আনতে পারেনি। ভাবলাম তোমার সাথে আসবে হয়ত।”
নীলাশা জড়তা নিয়ে বলল,
-” ইচ্ছে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাই আনতে পারিনি। আমাকে আবার সন্ধ্যার আগেই ফিরে রাতের খাবার রান্না করতে হবে ভেবে একটু তাড়াতাড়ি আসলাম।”
প্রত্যাশার মনেমনে রাগ হচ্ছে এখানে বাচ্চাদের কান্নায় অতীষ্ঠ হচ্ছে সে। সেখানে নীরব বাসায় গিয়ে দিব্যি আরাম করে ঘুমাচ্ছে। নীরবকেও এই মাছের হাঁটে এক্ষুনি আনতেই হবে। এই ভেবে প্রত্যাশা বলল,
-” আম্মু আমার ফোনটা কই?”
-” কী করবি?”
-” দরকার আছে দাও তো।”
অধরার কোলে সাদা রঙের সফট তোয়ালের ভেতর বাচ্চাটা। অধরা থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কিচ্ছুতেই কিছু হচ্ছে না। কান্নার বেগ বাড়ছে বৈ কমছে না। প্রত্যাশা এবারে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-” এ এত কাঁদছে কেনো?”
-” ক্ষুধা পেয়েছে। ঠিকমতো দুধ পাচ্ছে না, তাই হয়তো।”
-” আরেকজন তো ঠিকই শান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে। লক্ষ্মী হয়ে আছে। যত ক্ষুধা কী এরই পেয়েছে, আশ্চর্য!”
প্রত্যাশার হাতের উপর বাচ্চাটাকে নামিয়ে বললেন অধরা,
-” ডাক্তার আজকেই বাইরের খাবার দিতে বারণ করেছেন। দু’টো বাচ্চা বুকের দুধে হয় নাকি। তবুও তারা বলছেন, কাল থেকে দিবেন।”
নীহারিকা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন,
-” বাচ্চার পেট ভরছে না জন্য কাঁদছে। ওরা বলছে, তিনদিন না খাইয়ে রাখব, তবুও বাচ্চা সুস্থ থাকবে। এক্ষুনি বাইরের খাবার দেয়া যাবে না। এদিকে কাঁদতে কাঁদতে যে বাচ্চার গলা বসে যাবে সে খেয়াল আছে।”
তিনটে আঙুল একসাথে মুখে পুরে চপচপ শব্দ তুলল বাচ্চাটা। প্রত্যাশা সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-” আম্মু, এর অতিরিক্ত খাইখাই স্বভাব দেখছি। সেকেন্ডে সেকেন্ডে খাওয়ানো হচ্ছে তবুও এর খাইখাই স্বভাবটা কমছে না, বরং বাড়ছে।”
অধরা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললেন,
-” চুপ করবি। ও দুধ পাচ্ছে নাকি। এমনিতেই সিজারের দু-তিনদিন পর দুধ নামে। তারপর দুজন।”
যতক্ষণ প্রত্যাশার হাতের উপর বুকের সাথে রাখা যায় ততক্ষণ চুপ করে থাকে। সরালেই চোখবুঁজে গলা ফাটিয়ে কাঁদে। প্রত্যাশা ফের বলল,
-” ফোনটা দাও।”
প্রত্যাশা ফাঁকা হাতে ফোনটা নিয়ে নীরবের কাছে ডায়াল করল। রাত জাগা হয়েছে, তারপর ছোটাছুটি করায় ক্লান্ত ছিলো। গোসল নিয়ে একটু শুতেই চোখ লেগে যায় নীরবের। প্রত্যাশার কল দেখে তড়িঘড়ি রিসিভ করল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
-” হ্যালো, প্রত্যাশা? কোনো সমস্যা?”
প্রত্যাশা সরাসরি বলল,
-” আপনার ছোট ছেলের খাইখাই বন্ধ করতে তাড়াতাড়ি দুধ নিয়ে আসুন। তার কান্নায় আমি অতীষ্ঠ, ওদিকে আপনি পালিয়ে রয়েছেন। বাসায় আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। এটা বরদাস্ত করা যাচ্ছে না।
এক্ষুনি দুধ নিয়ে আসুন, নইলে আমি কিন্তু আপনার ছোট ছেলের মুখে ভাত পুরে দিবো।”
নীরব থম মে*রে গেল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
-” খাইখাই এসব কী ওয়ার্ড প্রত্যাশা? আবার ভাত..”
-” অতশত জানি না, আপনি এক্ষুনি আসুন। আর ডক্টরের সাথে যোগাযোগ করে…”
-” আমি এক্ষুনি আসছি।”
শিশু ডাক্তার আজকেই বাইরের খাবার দিতে বারণ করেছিল। তবে যেহেতু দু’জন তাই বাধ্য হয়েই দিতে হবে। নীরব কিছুক্ষণ ভেবে অদ্রিকার সাথে ফোনে যোগাযোগ করে।
নীহারিকা মুখটা গম্ভীর করে অসন্তুষ্ট গলায় বললেন,
-” ছেলেটা বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম করছিল, কী দরকার ছিলো এক্ষুনি ফোন দিয়ে ডেকে আনার! এখানে সবাই আছে, এমনি তো কোনো সমস্যা নেই। আর বাচ্চারা একটু-আকটু কান্না করেই থাকে।”
.
.
নীরবের একহাতে পলিব্যাগে বায়োমিলের কৌটা। অন্যহাতটা ইচ্ছের হাত শক্ত করে ধরা। ইচ্ছেকে নিয়ে লিফটে ওঠে। আর উঠতেই ইচ্ছে চেঁচিয়ে উঠল,
-” মামা!”
লিফটে সার্থক অদ্রিকা দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। ইচ্ছে মুখে হাসি নিয়ে গমগমে স্বরে ঘনঘন বলল,
-” জানো মামা আমার ছোট্ট ছোট্ট দুইটা ভাইয়া এসেছে, আমার সাথে খেলার জন্যে। বড় পাপা আমাকে ছবি দেখিয়েছে আর বলেছে, পুচকো দুইটা আমার ভাইয়া হয়। এইটুকুন এইটুকুন মুখ। খুউউউব কিউট!”
#চলবে
#মধ্য_রাতের_চাঁদ |অন্তিম পর্ব দ্বিতীয় অংশ|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
নীরবের চোখ পড়ল সার্থকের দিকে। দুজনের চোখাচোখি হলো। পরপর সার্থকের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো অদ্রিকার দিকে নজর যেতেই তৎক্ষণাৎ সালাম দেয় নীরব। অদ্রিকা অমায়িক হেসে সালামের জবাব দেয়।
এই ফাঁকে সার্থক ইচ্ছেকে কাছে টেনে নিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
-” মামা, তুমি? আমার আম্মাটা কেমন আছে?”
-” ভালো আছি আমি। তুমি?”
সার্থক উবু হয়ে ইচ্ছের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-” ভালো।”
হঠাৎ ইচ্ছে প্রশ্ন করে উঠল,
-” মামা, আমার মাম্মা কোথায়?”
প্রশ্নটা শোনামাত্র সার্থকের মুখটা এক ঝটকায় মলিন হয়ে যায়। ইচ্ছে মুখটা ভার করে বলল,
-” মাম্মা আসছে না কেনো? মাম্মা আমাকে আর ভালোবাসে না একটুও…একটুও না। তাই তো আসছেই না।”
সার্থকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। ছোট্ট ইচ্ছের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না সে। চোখদুটো হঠাৎ জ্বালা করছে, নোনতা জলে ভরে গেল। অদ্রিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইচ্ছের ছোট্ট হাতটা ধরে সামনে টেনে আনল। প্রসঙ্গ ঘোরাতে চটপট বলল,
-” হেই কিউটিপাই! বলো তো আমি কে? তুমি কি জানো, আমি তোমার কে হই?”
ইচ্ছে চোখ কুঁচকে তাকাল। লিফটে বেশি ভিড় ছিল না, ওরা ছাড়া বাড়তি দু’জন লোক ছিলো মাত্র। এরমধ্যে লিফট চারতলায় এসে থামল। নীরব লক্ষ্য করে বলল,
-” নেমে কথা বললে ভালো হয়, অন্যদের ডিস্টার্ব হচ্ছে।”
অদ্রিকা জিজ্ঞাসু কণ্ঠে বলল,
-” আপনি তো পাঁচতলায় যাবেন?”
জবাবে বলল নীরব,
-” ব্যাপার না।”
করিডোরে নেমে এসে ইচ্ছেকে এক হাতে আগলে, অন্য হাতে তার চুল গুছিয়ে দিতে দিতে অদ্রিকা আবার বলল,
-” আমি কে হই জানো না, রাইট?”
ইচ্ছে মাথা নেড়ে জানাল সে জানে না। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-” তুমি কে?”
অদ্রিকা সুকোমল হেসে বলল,
-” আমি তোমার মামি হই।”
মামার বউ মানে মামি এটুকু ইচ্ছে জানে। মাম্মা একবার বলেছিল, মামা বিয়ে করে মামি আনবে। সেই কথাটা ওর মনে আছে। ইচ্ছে গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে বলল,
-” মামি?”
-” হুউউ, মামি।”
এতক্ষণে দুয়ে দুয়ে চার মিলালো নীরব। তারমানে রাতে অদ্রিকার ফোন সার্থক ধরেছিল। সেইসময় টেনশনে থাকায় কণ্ঠটা টের পায়নি। অবশ্য ফোনে মাত্র দু’টো কথা বলেছিল সার্থক, হুট করে টের পাওয়াটাও অসম্ভব প্রায়। তবে এখন সবটাই পরিষ্কার। মাঝরাতে ফোনে একবার বলতেই কোনো ডাক্তারের অতটা ফাস্ট আসার কারন সার্থক।
অদ্রিকা ইচ্ছের গালে আদর দিয়ে পার্স খুলতে খুলতে বলল,
-” তোমার সাথে দেখা হবে ভাবিনি সোনা। তাই তো চকলেট বা খেলনা আনতে পারিনি।”
পাঁচটা একহাজার টাকার নোট ইচ্ছের হাতে দিতে দিতে বলল,
-” এটা রাখো। চকোলেটস কিনে খেয়ো, কেমন?”
ইচ্ছে সবেগে মাথা নেড়ে বলল,
-” উঁহু।”
-” এমা কেনো? মামিকে পছন্দ হয়নি বুঝি? মামি এটা আদর করে দিচ্ছে তো। মামির তরফ থেকে প্রথম আদর এটা। নাও।”
-” পাপা বলেছে কারো থেকে কিছু না নিতে। কখনো কিছু চাইতেও বারণ করেছে। যখন আমার যা ইচ্ছে হবে, পাপাকে বলতে বলেছে। আর পাপা তক্ষুনি এনে দিবে। তুমি জানো? পাপা এত্ত এত্ত চকোলেটস কিনে দেয়। খেলনা, সব…সব পাপা দেয়, অনেক অনেক।”
দুই হাত প্রসারিত করে দেখিয়ে টেনেটেনে বলে ইচ্ছে। ঘনঘন ঠোঁট নেড়ে আরও যোগ করল,
-” বড় পাপাও দেয়। সব্বাই, হুম।”
অদ্রিকা হেসে ফেলল। বলল,
-” পাপা নিশ্চয় বাইরের লোকের থেকে কিছু নিতে নিষেধ করেছে তোমায়। আমি তো তোমার আপনজন, আমার থেকে নেয়াই যায়।”
ইচ্ছে তবুও নিতে রাজি হচ্ছিল না। এটা দেখে নীরব বলল,
-” ইচ্ছে, মামি আদর করে দিচ্ছে, নাও। নইলে মামির খারাপ লাগবে।”
ইচ্ছে এবারে নিল। সার্থক ইচ্ছেকে আদর করে “বাই” বলে পা বাড়াবে ঠিক তক্ষুনি ওকে উদ্দেশ্য করে নীরব মুখে সৌজন্যমূলক এক চিলতে হাসি টেনে বলল,
-” থ্যাঙ্কস।”
সার্থক কপাল গুটিয়ে তাকাল। নীরব কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে বলল,
-” বিগ থ্যাঙ্কস। ফর দ্যাট টাইমিং লাস্ট নাইট।”
সার্থকের একহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা। অন্যহাতের এক আঙুলে কপাল চুলকিয়ে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
-” ওয়েলকাম। বাট এটা একচুয়েলি অদ্রিকার কেস ছিলো। আমি শুধু খবরটা পৌঁছে দিয়েছি, দ্যাটস ইট। বাকিটা ওর দায়িত্ব ছিলো আর ও দারুণভাবে সেটা সামলিয়েছে। এটা একদম নরমাল ব্যাপার, স্পেশাল কিছু নয়।”
পরপর মুখে কৃত্রিম হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল,
-” আসছি।”
নীরব প্রত্যুত্তরে বলল,
-” শিওর।
নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল অদ্রিকা,
-” আসছি এবার। পেশেন্টরা বসে আছেন। সাতটায় রাউন্ড আছে। রাউন্ডে গিয়ে প্রত্যাশা আর বেবীদের সাথে দেখা হবে।”
-” ওকে।”
তারপর ইচ্ছের গাল টিপে বলল,
-” তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।”
ইচ্ছে সাথে সাথে নীরবের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। নাকমুখ কুঁচকে বলল,
-” আমি পাপার সাথে থাকব। দিদুন বাড়িতে।”
অদ্রিকা নিঃশব্দে হেসে বলল,
-” ওকে ওকে সোনা, তুমি পাপার সাথেই থাকবে।”
___________
দুধ বানিয়ে খাওয়ানোর পর কান্না থেমেছে ছোটজনের। এখন সে প্রত্যাশার কোলের সাথে লেপ্টে শুয়ে চোখের মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে। নীহারিকার কোলে বড়টা। ইচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট আঙুল আলতো করে ছুঁয়ে বলল,
-” দিদুন ভাইয়াকে কোলে নেবো।”
-” ভাইয়া তো খুব ছোটো, লেগে যাবে সোনা। এখন না পরে নিও, হ্যাঁ।”
ইচ্ছের মুখ ম্লান হয়ে আসল। নীরব মা’কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” মা তুমি ধরে রেখেই একটু দাও।”
নীহারিকা তাই করলেন। ইচ্ছে বেডে বাবু হয়ে বসে, নীহারিকা দুই হাতে ধরেই ইচ্ছের কোলের উপর রাখল। ইচ্ছে খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল,
-” আমার কিউট ভাইয়া। তোমাকে আমার সব খেলনা দিবো।”
নীরব বলল,
-” ওকে সব খেলনা দিবে, ছোট ভাইয়াকে দিবে না?”
ইচ্ছে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
-” হ্যাঁ ওকেও দিবো তো। তবে অল্প। ও কান্না করছে, কথা শুনছে না, তাই ও কম পাবে।”
উপস্থিত সবাই হেসে ফেলল। কয়েক পল পরে নীহারিকা বললেন,
-” হয়েছে আপু আবার পরে নিও। ভাইয়া কিন্তু গা ভরে হিসু করে দিতে পারে। তাই তাড়াতাড়ি দিয়ে দাও।”
যদিও ডায়াপার পরানো তবুও মিথ্যে বলে নীহারিকা। ছোট্ট নাজুক প্রাণটার লাগতে পারে এই ভয়ে। ইচ্ছে লক্ষ্মী মেয়ের মতোন হাসিমুখে সায় দিলো। এরমধ্যে নিভান এসে তাড়া দিয়ে বলল,
-” নীলাশা সন্ধ্যা হয়ে আসছে, বাসায় যাবে না? মা, ইচ্ছেকে নিয়ে যাই?”
নীলাশা মাথা নাড়িয়ে ‘হুঁ’ বলল। নীহারিকা ছেলের কথায় তৎক্ষণাৎ সায় দিয়ে বললেন,
-” হ্যাঁ, হ্যাঁ ওকে নিয়ে যা বাবা। এখানে রাতে শোয়ার কষ্ট হবে। এদের দু’টোকে সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছি। তুই বরং ওকে নিয়েই যা।”
ইচ্ছে নীরবের দিকে তাকাতেই নীরব কণ্ঠে আদর ঢেলে বলল,
-” তুমি বড় পাপা আর বড় মাম্মার সঙ্গে যাও। আমার ফিরতে দেরি হবে। ভাইয়ারা কাঁদছে, ডাক্তার ডাকতে হবে যে। তুমি কিন্তু একটুও মন খারাপ করো না, কেমন?”
-” আচ্ছা।”
নিভান ইচ্ছের ছোট্ট হাতটা মুঠোয় পুরে প্রস্থান করতে থাকে। নীলাশাকে উদ্দেশ্য করে রাতে কী খাবার পাঠাতে হবে সেসব বলে শেষে বললেন নীহারিকা,
-” ইচ্ছেকে খাইয়ে দিও, রাতে তোমাদের কাছে রেখো।”
-” আচ্ছা, মা।”
ওদিকে প্রত্যাশা মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। তখন শাশুড়ি বলার পরেই অধরাও একই সুরে বলেন। নীরবকে ফোন দিয়ে ডেকে আনার কী দরকার! ও একটু বিশ্রাম করছিল। আম্মু বকাঝকা করেন। তাই প্রত্যাশার রাগ হয়েছে। নীরব এসে জিজ্ঞাসা করে— কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
মুখটা গোমরা করেই উত্তরে এক শব্দে ‘না’ বলে। নীরব বুঝে নেয় তার সেমি মেন্টাল বউ কিছু নিয়ে অভিমান করেছে। কেবিনে মা, শাশুড়ি উপস্থিত থাকায় নীরব তাদের সামনে প্রত্যাশাকে কিছু বলতেও পারছে না, ইতস্তত লাগছে। প্রত্যাশার বেডের সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে ছোট বাচ্চাটার গালে আঙুল ছুঁয়ে বলল,
-” ছোট প্রিন্স তো ঘুমিয়ে পড়েছে।”
প্রত্যাশা ঠোঁটদুটো চেপে থমথমে মুখ করে নিরুত্তর রইল। পরক্ষণেই বলল নীরব,
-” প্রত্যাশা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কোনো সমস্যা বা দরকার হলেই ফোন দিও।”
তারপর এগিয়ে মায়ের কোলে থাকা বড় ছেলের গালে চুমু খেয়ে বলল,
-” আসছি বাবা, গুড বয় হয়ে থাকবে মাই চ্যাম্প।”
_________
অদ্রিকা প্রতিদিন সাড়ে সাতটা নাগাদ ওর আন্ডারে থাকা রোগীদের দেখতে বের হয়। কেবিন থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যন্ত। প্রতিদিনের ন্যায় আজও রাউন্ডে গিয়েছে। সাথে আছে ইন্টার্নশিপের এক তরুণী আর একজন নার্স। অদ্রিকার পরনে হালকা মিষ্টি রঙের সালোয়ার-কামিজ, তার উপর সাদা এপ্রোন। রেশমি চুলগুলো ক্লিপে গুছিয়ে আঁটকে রাখা। বাম হাতের মুঠোয় স্টেথোস্কোপটা মোড়ানো। ডান হাতটা আরাম করে এপ্রোনের পকেটে গুঁজে করিডোর দিয়ে এবারে প্রত্যাশার কেবিনে ঢুকল। মেয়েটার চালচলনে, কথাবার্তায়, এমনকি মুখের অভিব্যক্তিতেও সংযম আর শালীনতা ঝরে পড়ে। কেবিনে ঢুকেই এক ঝলক সবাইকে দেখে হালকা হেসেই সালাম দিলো। এগিয়ে যেতে যেতে নীহারিকাকে উদ্দেশ্য করে মজা করে বলল,
-” নাতিরা খুব বেশি জ্বালাচ্ছে বুঝি, আন্টি?”
তখন নীরব বলেছে সার্থকের সাথে অদ্রিকার বিয়ে হয়েছে। মোটামুটি সবাই এখন জানে। নীহারিকা কোমল স্বরেই উত্তরে বললেন,
-” আরে না না মা, এদের একটু কান্না, একটু জ্বালানো এসব তো স্বাভাবিক। ওরাও তো নতুন এসেছে এই পৃথিবীতে। এতদিন মায়ের গর্ভে এক পরিবেশে ছিলো, মানিয়ে নিতে সময় তো লাগবেই একটু, তাই না?”
অদ্রিকা মিষ্টি হেসে সায় দিল। তারপর প্রত্যাশার দিকে এগিয়ে বলল,
-” শুভ সন্ধ্যা টুইন্স বেবীদের মাম্মা।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলল।
-” বেবীদের মামীকেও শুভ সন্ধ্যা।”
প্রত্যাশার চোখটা টেনে ধরে প্রফেশনাল ভঙিতে দেখতে দেখতে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল অদ্রিকা,
-” কোনো সমস্যা হচ্ছে? ব্লিডিং খুব বেশি হচ্ছে কি?”
প্রত্যাশা মাথা নেড়ে জানালো– না। অদ্রিকা নার্সকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” স্যালাইনটা খুলে দাও। পেশেন্ট এখনো উঠে বসেনি দেখছি। ওকে বসতে সাহায্য করবে, সকাল থেকে হাঁটতেও পারবে।”
বড়দের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” রাতে লাইট লিকুইড ডায়েট দেওয়া যাবে। আর সকাল থেকে রাইস আইটেম, সেদ্ধ সবজি এগুলো দিতে পারেন।”
অধরা মাথা নেড়ে বললেন,
-” আচ্ছা।”
অদ্রিকা কিছু ইনজেকশন বলল, ইন্টার্নশিপের ডাক্তার সেটা ফাইলে লিখে নিলো। এরপর বাচ্চা দুটোর দিকে এগোল। ওরা দু’জন নানী আর দাদির কোলে। অদ্রিকা কোমল কণ্ঠে বলল,
-” এইযে বেবীরা, তোমরা কিন্তু মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো। কিন্তু মায়েরা সবই সহ্য করে শুধু তোমাদের জন্য। তাই এখন থেকে কিন্তু ভালো বাচ্চা হতে হবে।”
থেমে বড়দের উদ্দেশ্য করে বলল,
-” আন্টি, বাচ্চাদের মায়ের কাছে কোল ঘেঁষে একটু বেশি বেশি রাখবেন। মায়ের শরীরের উষ্ণতা, ওম এসময় জরুরী।”
অধরা বললেন,
-” দু’জন, তারপর প্রত্যাশা নিজেই অসুস্থ তাই একটু কম ওর কাছে দেয়া হচ্ছে।”
-” ঠিক আছে, তবে চেষ্টা করবেন।”
পরপরই জড়তা নিয়ে বলল অদ্রিকা,
-” পেশেন্ট দেখছি, বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে থাকতে হচ্ছে জন্য বাচ্চাদের কোলে নিতে পারলাম না। ধরতেও পারছি না এইজন্য। প্রত্যাশা তুমি আবার এজন্য মন খারাপ করো না কিন্তু।”
প্রত্যাশা ঝটপট বলল,
-” আরে না না, তা কেনো!”
অদ্রিকা কণ্ঠে মজা নামিয়ে বলল,
-” এই যে প্রত্যাশা, একটা কথা বলি? এই দুইজনের মধ্যে একজনকে কিন্তু আমি আগেভাগেই বুক করে রাখলাম!”
প্রত্যাশা অবাক হয়ে তাকাতেই অদ্রিকা ঠোঁট ছড়িয়ে হেসে বলল,
-” আমার ভবিষ্যৎ মেয়ের জামাই বানাতে চাই। এখন থেকেই বুকিং, পরে কেউ যেন আপত্তি না করে।”
প্রত্যাশা তড়িৎ বলে উঠল,
-” ওহ, তাহলে তো আবার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এইবার কিন্তু শাশুড়ি হিসেবে আমি ভিলেন হবো। ছেলের বউ হিসেবে মানি না… মানব না..”
এতটুকু বলে নিজের কথায় নিজেই হকচকিয়ে জিভে কামড় দিয়ে চুপ মে*রে যায় প্রত্যাশা। নীহারিকা ওর দিকেই তাকিয়ে। শাশুড়ির সাথে চোখেচোখ পড়তেই ভয়ে তটস্থ হলো। অধরা সবার আড়ালে মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে শাসালেন। অদ্রিকা একচোট শব্দ করে হাসল। বলল মজার সুরেই,
-” ছেলে পা*গল হলে, মায়েরা মানতে বাধ্য হবে।”
তারপর লাজুক হেসে নম্র স্বরে বলল,
-” স্যরি! এমনি মজা করেছি।”
সৌজন্যমূলক কিছু কথাবার্তা বলে প্রস্থান করে অদ্রিকা।
____________
পরের দিন…
ঘড়ির কাঁটা দুপুর দুইয়ের কাছাকাছি। কেবিন জুড়ে শান্ত, স্নিগ্ধ নিস্তব্ধতা। বাচ্চারা অ্যাটাচড দোলনায় দু’পাশে দু’জন ঘুমাচ্ছে। প্রত্যাশা বেডে পা মেলে বসে আছে। নীহারিকা সদ্য গোসল সেরে বেরোলেন। আবির একটু আগেই দুপুরের খাবার দিয়ে গেছে। অধরা খাবারের বক্সগুলো ব্যাগ থেকে নামাচ্ছেন।
তন্মধ্যে কেবিনের দরজা ঠেলে নীরব ঢুকল। ঢুকেই প্রত্যাশার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। নীরবের গায়ে ইউনিফর্ম, লাঞ্চ আওয়ারে সোজা অফিস থেকে এখানেই এসেছে। প্রত্যাশার পরনে হালকা আকাশি রঙের হাসপাতালের পোশাক। চুল দুইভাগ করে দুপাশে দু’টো বেণি গাঁথা। চোখে চোখ পড়তেই নীরব কিছু একটা বলল নিরব ভাষায়। প্রত্যাশা মুখ বাঁকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়।
নীরব এগিয়ে দোলনার দিকে ঝুঁকে মৃদুস্বরে বলল,
-” এই তো আমার চ্যাম্পরা একদম গুড বয় হয়ে গিয়েছে! আর কাঁদছে না দেখছি।”
প্রত্যাশা বলল,
-” ছোটজন এতক্ষণ কেঁদেছে। একেবারে হাঁপিয়ে তারপর মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।”
অধরা স্নেহভরা গলায় বললেন,
-” নীরব, মনে হচ্ছে অফিস থেকে সরাসরি এখানে চলে এসেছো। হাতমুখ ধুয়ে আগে খেয়ে নাও বাবা।”
নীরব ভদ্র গলায় বলল,
-” আমি বাসায় গিয়ে শাওয়ার নিয়ে তারপর খেয়ে নেব। কোনো সমস্যা নেই, আপনারা খেয়ে নিন।”
গরুর গোশ, ডাউল আর করলা ভাজি তিনপদ দিয়েছে সাথে বাসমতি চালের ভাত। অধরা বললেন,
-” প্রত্যাশা আজকেই গরুর গোশ খাওয়া ঠিক হবে না। তোর ভাত ডাল আর ভাজি দিয়ে নিলাম।”
প্রত্যাশা খাবারের দিকে কাঁদো কাঁদো চাহনিতে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট উল্টে বলল,
-” খাবার দেখেই বোঝা যাচ্ছে কে কোন পদ রেঁধেছে। ডালটা আপু রান্না করেছে আমি শিওর। বাকি দু’টো পদ ছোটো মা। আমি ডাল দিয়ে খাব না। ওটা ডাল নাকি শ্যাওলাযুক্ত পুকুরের পানি। দু’টো মাছ ছেড়ে দিলে সাঁতার কেটে বংশবিস্তার করে বাটি ভরিয়ে দেবে।”
নীরবের ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটল। কোনো রকমে হাসিটা চেপে রাখল সে। অধরা রাগি স্বরে বললেন,
-” বাজে কথা রেখে খেয়ে নে। কষ্ট করে রান্না করে দিয়েছে এই অনেক।”
প্রত্যাশা গাল ফুলিয়ে বলল,
-” মাশকালাইয়ের ডাল ঘন করে রাঁধতে হয়। তবেই টেস্টি হয়। আপু একদম কড়াই ভরে পানি দিয়েছিল মনেহয়।”
-” বাসায় গিয়ে সুস্থ হয়ে তুই নিজ হাতে ঘন করে রান্না করে খাস। এখন বেশি কথা বলিস না তো।”
নীহারিকা পাশ থেকে বলে উঠলেন,
-” নীলাশাটা কাজবাজ একটু কম পারে। রান্নার ক্ষেত্রে ওর আইডিয়া কমই আছে। যাইহোক করতে করতে শিখে যাবে। আর ছোটোকেও বলি ওর কোনো কান্ডজ্ঞান নেই নাকি! আজকেই গরুর গোশ দিয়েছে। দিয়েছে ভালো কথা, প্রত্যাশার জন্য মুরগি রেঁধে দিতে পারতো।”
অধরা বললেন,
-” বাড়িতে সবার রান্না, আবার হাসপাতালে পাঠানো অত কী খেয়াল থাকে, বলুন? ব্যাপার না।”
থেমে প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” ডালে সমস্যা, আচ্ছা করলা ভাজি নিচ্ছি।”
প্রত্যাশা হইহই করে উঠল,
-” কী আশ্চর্য! আমি কোনকালে করলা ভাজি খেলাম, আম্মু?”
-” আগে খাস নাই, আজ খাবি। করলা খাওয়া তো ভালো।”
প্রত্যাশা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,
-” সেই সকালে কী এক কালো জিরা ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়ালে, বাপরে সেটাও আবার সে কী ঝাল ছিলো! এখন আবার বিষ দিয়ে খাওয়াবে।”
অধরা মোটামোটা চোখে তাকাতেই প্রত্যাশা মুখটা ভোঁতা করে বলল,
-” করলা যে তেতো, ওটা আমার কাছে বিষ সমতুল্য।”
অধরা বললেন,
-” কালো জিরা ভর্তার কথা তো ডিউটির ডাক্তারই বললেন। দুধ বাড়ে, সেইজন্য দেয়া হলো।”
নীরব বলল,
-” রাস্তার ওপাশে কেএফসি এর একটা শাখা আছে। আমি এক্ষুনি খাবার নিয়ে আসছি। প্রত্যাশা কী খাবার আনবো?”
প্রত্যাশা কিছু বলার আগেই অধরা বাঁধ সাধলেন,
-” এখন আবার কষ্ট করে খাবার আনতে যেতে হবে না বাবা। যা আছে সেটা দিয়েই খেয়ে নিবে। রাতে অন্যকিছু আনো।”
আম্মুর উপর প্রত্যাশার রাগ হলো। নীরব ফোনটা অন করতে করতে বলল,
-” থাক মা, প্রত্যাশা যেহেতু এটা খায় না, ওকে জোর করে না খাওয়ানোই ভালো। আমি কেএফসি থেকে অনলাইনেই অর্ডার দিচ্ছি। এক্ষুনি দিয়ে যাবে।”
এরমধ্যে বাড়ি থেকে শর্মিলা ফোন করে জানায়। আবির ভুল করে একটা খাবারের ব্যাগ টেবিলে ফেলে গিয়েছে। ছোট বক্সে প্রত্যাশার জন্য কবুতরের বাচ্চা ভূনা ছিলো। অর্ডার করার কিছুক্ষণ পরেই খাবার দিয়ে যায়। ইলিশ ভূনা আর চিকেন। প্রত্যাশা খাবার মুখে পুড়ে নীরবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” এখান থেকে একপিস মাছ আর চিকেন নিয়ে খেয়ে নিন।”
নীরব দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল,
-” তুমি খাও, আমি বাসায় গিয়ে খেয়ে নেবো।”
নীহারিকা বললেন,
-” তুই মিথ্যে বলছিস নীরব। এখান থেকে তুই আর বাসায় গেলে তো। সরাসরি অফিসেই যাবি তুই, আমি জানি। এখানে অনেক খাবার আছে খেয়ে নে, বাবা।”
মায়ের জোরাজুরিতে হালকা কিছু খায় নীরব।
এরমধ্যে একটা বাচ্চা উঠে পড়ে। প্রত্যাশা বলল,
-” আম্মু ওকে আমার কাছে দিয়ে তুমি মায়ের সাথে খেয়ে নাও।”
অধরা তাই করলেন। প্রত্যাশা বেডে শুয়ে, ডান হাতের উপর বড় বাচ্চাটা। বাচ্চার গাল ছুঁয়ে আদুরে ভঙিতে বলে প্রত্যাশা,
-” ওলে ওলে আমার বাবাটা।”
বাচ্চার সাথে এটাওটা কথা বলছে আর হাসছে প্রত্যাশা। হাসতে গিয়ে ব্যথায় কপাল কুঁচকে নিল। অধরা সেটা দেখলেন। নীরব নিচে গিয়েছিল, মাত্র আসল, হাতে আপেল আর মাল্টা। নীহারিকা সেটা দেখে বললেন,
-” নিভান কাল কত ফল এনেছে, প্রত্যাশার আব্বুও সকালে এনেছে। এখন আবার আনতে গেলি কেনো। নষ্ট হয়ে যাবে তো।”
হাতের প্যাকেট নামিয়ে বলল নীরব,
-” না খেলে তো ন*ষ্ট হবেই। তোমরাও খাবে।”
প্রত্যাশা হঠাৎ বলে উঠল,
-” আম্মু দোলনা থেকে ওকে আমার আরেক হাতে দাও তো।”
-” ঘুমিয়েই তো আছে, থাক। একসাথে পারবি না।”
-” আরে দাও না।”
অধরা আলগোছে তুলে প্রত্যাশার হাতের উপর দিলেন। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় বেবীটা মোচড়ামুচড়ি করল খানিকক্ষণ। প্রত্যাশা নীরবের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল,
-” দেখুন তো এখন একদম পরিপূর্ণ লাগছে? লাগছে না?”
নীরব স্মিত হেসে হ্যাঁ বোঝাল। প্রত্যাশা হঠাৎ উচ্চ স্বরে বলল,
-” জানো আম্মু, তখন হাঁটতে হাঁটতে করিডোরে গিয়েছি, শোনা গেলো আজকে সকালে কোনো এক পেশেন্টের টুইন্স হয়েছে। কী বাচ্চা হয়েছে জানতে ইচ্ছে করছে।”
কথা বলতে বলতেই একটু নড়তে নেয় প্রত্যাশা। আর অমনি পেটের সেলাইয়ের জায়গায় টান পড়ার সাথে সাথে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে এল। অস্ফুটে মুখ থেকে বেরোল,
-” ইশশ্!”
অধরা সেটা দেখে বিরক্তির সুরে বললেন,
-” প্রত্যাশা, তুই আরো জোরেজোরে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা বল, হাসাহাসি কর, আর পেটের ব্যথাটা বাড়া। এমনিতেই দু’টো বাচ্চা, তোর সুস্থ হওয়াটা জরুরী। একটু সতর্ক থাকবি, তা না উল্টো চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। এত কথা বলে কেউ?”
প্রত্যাশা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ওঠে,
-” কী আশ্চর্য! আম্মু তুমি কথা বলতে বারণ কেনো করছো? এমনভাবে বলছো, যেন পেট নয় আমার গলা কা*টা হয়েছে। গলায় স্টিচ আছে, সেইজন্য কথা বলায় কণ্ঠনালীতে টান পড়ে প্রব্লেম হবে। আরে নড়তে গিয়ে ব্যথা লেগেছে।”
একটা আপেল ধুয়ে ছু*রিটা হাতে নিয়ে প্রত্যাশার বেডের পাশে থাকা টুলে বসল নীরব। প্রত্যাশার দুই হাতের উপর দুইপাশে দু’টো বাচ্চা। একজন ঘুমিয়ে আরেকজন আঙুল মুখে পুরে চুষছে। নীরব সেদিকে তাকিয়ে একপল দেখল। প্রত্যাশা ঘুমন্ত ছোট বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” নীরব জানেন, ছোটজন জন্মের পরেই কাঁদছিল না। ওকে জোর করে কাঁদানো হয়েছে। আমার মনে হয়, সেই রাগে এখন ও একটু বেশিই কাঁদে। বলছে, নাও আমাকে আরো কাঁদাও, এবার থামাও।”
আপেলে ছু*রি চালাতে চালাতেই বলে নীরব,
-” তোমার কাছে বলেছে?”
-” কীহ?”
-” এইসব যা বললে…মানে ছোট প্রিন্স তোমার কানে কানে এসে এসব কথা বলেছে, তাই তো?”
নীরবের ত্যাড়া জবাব শুনে প্রত্যাশা নাক ফোলাল। বলল,
-” বলতে হবে নাকি? আমি নিজেই বুঝেছ__”
কথাটা শেষ করতে পারল না প্রত্যাশা। তার আগেই নীরব আপেলের একটা টুকরো প্রত্যাশার মুখে পুরে দেয়। নীরব এভাবে মুখে জোর করে আপেল গুঁজে দেওয়ায় প্রত্যাশার রাগ হলো। দুই হাতে দুই বাচ্চা, কিছু করতেও পারছে না। আপেলের টুকরো মুখে নিয়েই উউউ শব্দ করে প্রত্যাশা। চোখের ইশারায় টুকরোটা এক্ষুনি সরিয়ে নিতে বলল। নীরব নির্লিপ্ত মুখাবয়বে ঠাণ্ডা গলায় বলল,
-” মুখটা বন্ধ রাখো, একটু চুপ থাকো। আর হ্যাঁ, তোমার ননস্টপ বকবকে আমার ছোট প্রিন্সের ঘুম ভেঙে যাবে।”
আরেক টুকরো আপেল নিজের মুখে দিয়ে বলল নীরব,
-” বেবীরা চুপ করে আছে, তুমি বিশ্রাম নাও। আমি আসছি।”
_____________
বাড়ির পরিবেশ আজ উৎসবমুখর। বাচ্চাদের আকিকাসহ কয়েকজন কাছের আত্মীয়কেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। সেই উপলক্ষে ঘরভরা সাজসজ্জা। দুপুরের দিকে প্রত্যাশা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি গুছিয়ে নিচ্ছে। হালকা ঘিয়ের মতো রঙের সিল্ক শাড়ি, যার চওড়া লাল পাড়ে সোনালি সুতোয় সূক্ষ্ম কারুকাজ। পুরো শাড়িতে ছাপা ছাপা নকশা, সূর্যের আলোয় ঝিলমিল করে উঠছে এমন। শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরেছে গাঢ় লাল ব্লাউজ, যার হাতা কনুই পর্যন্ত, আর হাতার প্রান্তজুড়ে ঘি রঙের মোটা পাড়। একেবারে শাড়ির সঙ্গে মানানসই।
আধভেজা চুলগুলো পিঠ জুড়ে ছেড়ে রাখে প্রত্যাশা। দুহাতে স্বর্ণের পাতলা কয়েকটা চুড়ি পরে নেয়। চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে একটু লিপবাম, স্নিগ্ধ সাজে নিজেকে পরিপাটি করে ও। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক দেখে মুচকি হাসল প্রত্যাশা। বিছানায় ঘুমন্ত বাচ্চাদের এক ঝলক দেখে নিয়ে, হাত বাড়িয়ে নেয় বেল্টটা। শাড়ির ওপর বেল্ট মানাবে না, আঁচলটা সাময়িকভাবে নামিয়ে মাথা কিঞ্চিৎ নুইয়ে কোমরে বেল্ট বাঁধছিলো। তন্মধ্যে নীরবের গলা এলো,
-” প্রত্যাশা, আমার ঘড়িটা দে__”
দরজার ফাঁক গলে মাথা ঢোকাতেই চোখ পড়ে প্রত্যাশার দিকে। চোখ পড়তেই শুকনো ঢোক গিলে নীরব। প্রত্যাশা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে তড়িৎ বেগে উল্টোদিক পিঠ করে ঘুরে দাঁড়ায়। প্রত্যাশা আঙুল তাক করে ওয়ারড্রবের দিকে দেখিয়ে বলে,
-” ঘড়িটা বোধহয় ওখানে।”
ঝটপট বেল্ট আটকে শাড়ির আঁচল তুলে নেয় প্রত্যাশা। সাদা পাঞ্জাবি পরনে নীরবের। পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে ভেতরে ঢুকল। ঘড়িটা হাতে পড়তে পড়তে দুষ্টু হেসে বলল,
-” এত লজ্জা পাচ্ছো কেনো? দেখার মতো কিছু বাকি আছে নাকি?”
প্রত্যাশা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল,
-” নীরব আপনি না?”
নীরব পেছন থেকে হঠাৎ কোমর জড়িয়ে ধরে প্রত্যাশার। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
-” কী?”
-” খুব অসভ্য।”
-” ভালো তো।”
-” কী ভালো?”
-” এইযে, একটু অসভ্য বলেই তো বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা হয়েছি।”
কথাটা বলতে বলতে প্রত্যাশার পিঠের উপর থাকা চুল একহাতে সরিয়ে গলার কাছটায় ঠোঁট ছোঁয়ায় নীরব। প্রত্যাশা খিচে চোখ বুঁজে নেয়। নীরব বউকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। একটা হাত বউয়ের কোমর পেঁচিয়ে রাখা। অন্যহাতের বৃদ্ধা আঙুল ঘঁষে প্রত্যাশার ঠোঁটের লিপবাম মুছতে থাকে। প্রত্যাশা বুঁজে থাকা চোখের পাতা খুলল। কম্পিত গলায় ফিসফিসিয়ে বলল,
-” ক-কী করছেন? ছাড়ুন!”
নীরব ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-” চুপ। কিছুই করিনি। জাস্ট, একটা কিস। অনেকদিন পর, একটু ডিপলি।”
প্রত্যাশার গাল লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। নীরব সময় ব্যয় না করে এক ঝটকায় প্রত্যাশার অধর চেপে ধরে পুরুষালি রুক্ষ অধর দিয়ে। মূহুর্তেই দু’জনে আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয়। নীরবের একটা হাত প্রত্যাশার চুলের ভাঁজে। প্রত্যাশার হাত দু’টো নীরবের পিঠের পাঞ্জাবি মুঠো করে ধরা। এমন সময় বাচ্চার কান্নার শব্দে দু’জনে চমকে তাকায়। চোখেচোখে দু’জনে হেসে উঠল। নীরব একটু পেছিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। অপ্রস্তুত হেসে বলল,
-” মাত্র একটা কিসিং টাইমেই এমন! না জানি সামনে আরো কী কী ওয়েট করছে।”
প্রত্যাশা লাজুক হেসে বিছানায় বসে বাচ্চাকে কোলে তুলল। দু’জনে নিঃশব্দে হাসল। এরমধ্যে বাইরে থেকে নীরবকে কেউ একজন ডাকল। নীরব রুম থেকে বেরিয়ে যাবে তক্ষুনি মনে পড়ার মতো করে বলে উঠল,
-” ওহ প্রত্যাশা, তোমাকে তো এখনো নামগুলো বলা হয়নি। হুজুরকে জানানোর আগে তোমার সাথে আলোচনা করে নেয়া ইম্পর্ট্যান্ট। ভেবেছি বড় প্রিন্সের নাম হবে; প্রত্যয় মাহবুব পূর্ব। আর ছোট প্রিন্সের নাম; প্রত্যুষ মাহবুব পুণ্য।”
প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু গলায় ফের বলে,
-” নিকনেইম হবে, পূর্ব আর পুণ্য। তোমার পছন্দ হয়েছে?”
প্রত্যাশার গাল কমলালেবুর মতো ফোলাফোলা হয়ে উঠল নিমেষে। নাকের ডগা মৃদু লাল হলো রাগে। ঠোঁট ফুলিয়ে তিরিক্ষি গলায় বলল,
-” শুধু পূর্ব-পূণ্য কেনো? পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, পাপ, পূণ্য যা খুশি রাখুন।”
নীরব চোখ কুঁচকে তাকাল। প্রত্যাশা অভিমানী স্বরে বলল,
-” ছেলে তো আপনার আমি তো কেউ নই। তাই তো তাদের জন্মের আগেই আমি নাম ঠিক করলেও, সে তো গেলো পানিতে ভেসে। আমার ভাবা নাম শেষমেষ আপনার কাছে ধোপে টিকলই না।”
নীরব স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল বউয়ের মুখপানে। সে তো আলোচনাই করতে এসেছিল। অথচ তার অবুঝ বউ এক কাঠি উপরে গিয়ে অভিমান জুড়ে দিল। নীরব মৃদু হেসে বলল,
-” প্রত্যুষ মাহবুব নীড়। এবার ঠিক আছে?”
প্রত্যাশার মুখের রাগের রেখা সেকেন্ডের মধ্যেই উবে গেল। বলল,
-” ঠিক আছে। তবে নীরব আপনার ভাবা নাম গুলোও সুন্দর। তাই আমার মনেহয়, ওগুলো বার্থ সার্টিফিকেটে থাকবে, আর বাসায় নিকনেইম নীড়। আর নীড়ের সাথে মিলিয়ে একটা বলুন তো।”
নীরব কয়েকপল ভেবে বলল,
-” নীড়ের বড় ভাই বীর।”
প্রত্যাশা ঠোঁট উল্টে বলল,
-” ধূর! আর নাম পেলেন না, শেষমেষ সাকিব খানের ছোট ছেলের নামই খুঁজে খুঁজে পেলেন।”
-” আরে আমি অতশত ভেবে বলেছি নাকি। তুমি বললে মিলিয়ে তাই হুট করে এটাই মনে হলো।”
-” আচ্ছা, আরেকটু ভেবে বলুন।”
নীরব ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে ভেবে বলল,
-” উমম! নিভ্র? বড় প্রিন্সের নাম নিভ্র হলে কেমন হবে?”
প্রত্যাশার চোখ চকচক করে উঠল।
-” ওয়াও! দারুণ মিলবে। আচ্ছা এটাই ফাইনাল; নিভ্র আর নীড়।”
_______________
সপ্তাহ খানেক পর..
রাতে সবার একটু পরে খাবার খেতে আসে প্রত্যাশা। বাচ্চাদের ঘুমিয়ে আসতে তার একটু দেরি হয়। অন্যদের খাওয়া শেষ প্রায়। কেউকেউ রুমে চলে গিয়েছে। নীরব খেতে খেতে বলল,
-” মা, বলছি যে তোমাকে আর কষ্ট করে প্রত্যাশার সাথে থেকে রাত জাগতে হবে না। প্রত্যাশা তো এখন অনেকটাই সুস্থ। আর রাতে তো বাচ্চারা ঘুমিয়েই থাকে। শুধু দুধ বানিয়ে দেয়া আমি বানিয়ে দিতে পারব, সমস্যা নেই।”
নীরব এ কদিন গেস্টরুমে থাকে। প্রত্যাশার সাথে শাশুড়ি থাকে। নীহারিকা বললেন,
-” রাতে বারবার জাগতে পারবি? ওরা কিন্তু জেগেও থাকে। সারাদিন ডিউটি করে আবার রাত জাগা, তোর সমস্যা হবে না?”
নীরব সাথে সাথে বলে উঠল,
-” এটা কোনো ব্যাপার হলো, মা?”
নীলাশা হাত ধুতে ধুতে মুচকি হাসল। বউকে ছেড়ে যে ঘুম আসে না সেটা নীরবের এই ব্যাকুলতাই বলে দিচ্ছে। প্রত্যাশা খাবার চিবাতে চিবাতে পৈশাচিক হেসে মনেমনে আওড়ালো,
-” হ্যাঁ এএসপি সাহেব, শুধু দুধ বানিয়ে দেয়া? আর রাতে ওরা ঘুমিয়েই থাকে, তাই না? আচ্ছা এতই যখন শখ, একদিন থেকেই দেখবেন, কতটা সহজ!”
এরমধ্যে বাচ্চার কান্নার শব্দ আসতেই প্রত্যাশা খাওয়া ফেলে উঠতে নেয়। নীলাশা বলল,
-” প্রত্যাশা তুই খা। আমার তো খাওয়া শেষ আমি নিচ্ছি।”
.
নীলাশা তখন নিভ্রের কান্না থামাতে থামাতে ওর রুমে নিয়ে আসে। নীলাশার রুমেও ওর কাছে বাচ্চারা থাকে। তবে সেটা দিনেই নীলাশা যখন রাখে। রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশ বাজে। নীড়কে ফিড করিয়ে শুয়ে দেয় প্রত্যাশা। দু’পাশে দু’টো কোলবালিশ দিয়ে বলল,
-” নীরব, নীড়কে দেখবেন। আমি নিভ্রকে আনছি।”
.
দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ডাকল প্রত্যাশা,
-” আপু?”
-” ভেতরে আয়।”
প্রত্যাশা ভেতরে যেতে যেতে বলল,
-” নিভ্র কী করে, ঘুমিয়ে পড়েছে?”
নীলাশার কোলের ভেতর নিভ্র ঘুমিয়ে আছে। নিভ্রের মুখপানে তাকিয়ে বলল নীলাশা,
-” নিভ্র তো গুড বয়। তখনই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
প্রত্যাশা বলল,
-” ওকে নিতে আসলাম, ঘুমাব। নীড়ও ঘুমিয়ে পড়েছে। আবার কখন জেগে পড়ে। তাড়াতাড়ি ওদের সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ব।”
নীলাশা জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে বলল,
-” নিভ্র তো ঘুমিয়েই আছে, থাক না হয়।”
প্রত্যাশা অবাক হয়ে বলল,
-” রাতে জাগবে না, খাওয়াতে হবে না।”
নীলাশা জড়তা নিয়ে বলল,
-” নিভ্র তো ফিডারই খায়, তুই বরং দুধ রেখে যা। আমি বানিয়ে খাওয়াব। নীড় তো আবার ফিডার খেতে চায় না।”
-” এ কদিনেই ওরা আমার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। ঘুমের মধ্যেও হাতড়ে হাতড়ে ওদেরকে দেখি। আগে এক ঘুমে সকাল হতো, এখন থেকে থেকেই ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে দেখি, ওরা ঠিকঠাক শুয়ে আছে তো! ডায়াপার চেক করে দেখি ভিজে উঠেছে কী না। ঘুম আসবে না।”
মুখটা শুকনো করে বলে প্রত্যাশা। নীলাশা কাষ্ঠ হেসে বলল,
-” ধর।”
প্রত্যাশা হাত বাডিয়ে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরল। গালে চুমু খেয়ে বলল,
-” আমার জান বাচ্চাটা। একদম ঘুমে ডুবে আছো যে।”
বলতে বলতে প্রত্যাশা বেরিয়ে যায়। নীলাশার চোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠল। হৃদপিন্ড ছিঁড়ে নেয়ার মতোন ব্যথা অনুভব হচ্ছে। নিভান এসে কাঁধের উপর একটা হাত রাখতেই জড়িয়ে ধরে নীলাশা ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। কিছুক্ষণ কাঁদতে কাঁদতে কিছু স্থির করে মায়ের কাছে ফোন করল। অধরা রিসিভ করে বলল,
-” নীলা এত রাতে ফোন দিলি, ভালো আছিস, সবাই ভালো আছে?”
নীলাশা ফুঁপিয়ে উঠল। অধরা উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালেন,
-” নীলা কাঁদছিস কেনো? কী হয়েছে? ও বাড়ির কেউ কিছু বলেছে তোকে?”
#চলবে