#মধ্য_রাতের_চাঁদ |অন্তিম পর্ব তৃতীয় অংশ|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
ফোনের ওপাশ থেকে অধরা ফের উদ্বিগ্ন স্বরে শুধালেন,
-” নীলা, কী হয়েছে মা? এমন করে কাঁদছিস কেন? খুলে বল। মায়ের যে চিন্তা হচ্ছে।”
নিজেকে সামলে মুখটা কিঞ্চিৎ হা করে শ্বাস টেনে নিল নীলাশা। কান্না মেশানো গলায় বলল,
-” আম্মু… আম্মু আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। চারপাশে এত অক্সিজেন থাকা সত্ত্বেও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। ভিতরে ভিতরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। একটা শুণ্যতা যে কাউকে এভাবে নিঃশেষ করে দেয় আমি সেটা আগে ভাবতেও পারিনি। আচ্ছা আম্মু, একটা বাচ্চা আমার কোলজুড়ে আসার পর এই অসুখটা হতে পারতো না? এতে কী খুব বেশিই ক্ষতি হতো? বলো না আম্মু?”
-” নীলা মা আমার, এটা একটা পরীক্ষা। সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাউকে ছেলে দিয়ে, কাউকে মেয়ে দিয়ে, কাউকে উভয়ই দিয়ে, আবার কাউকে কোনোটাই না দিয়ে পরীক্ষা করেন। ভেঙে না পড়ে ধৈর্য্য ধরতে হয় মা।”
অধরার গলা ধরে এল। নীলাশা ব্যালকনির গ্রিলে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে। অক্ষিপটে জলের নহর প্রবাহিত হচ্ছে। একহাতে ফোন কানে চেপে অন্যহাতের উল্টো পিঠে গাল মুছে বলল কান্নাভেজা কণ্ঠে,
-” আর কত ধৈর্য্য ধরব আম্মু? দিনকে দিন আমার নিজেকে এতটা অসহায় লাগছে কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। জানো আম্মু আমি যখন প্রত্যাশার বাচ্চাদের কোলে নেই না, ওই ছোট্ট মুখের দিকে তাকালে, বুকের সাথে চেপে ধরলে অদৃশ্য একটা শান্তি অনুভব হয়। ওদের নিঃশ্বাস গায়ে লাগে, তখন একটা অদ্ভুত প্রশান্তি পাই। মনেহয় সময়টা থেমে থাকুক। ওদের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলে মনে হয়, আমার হৃদয়ের ভাঙা জায়গাগুলো জোড়া লাগছে। ইচ্ছে করে ওভাবেই আঁকড়ে ধরে রাখি। নিজের করে নেই।”
অধরা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য শব্দের ভান্ডারও যেন শুণ্য হয়ে এল তার। গাল বেয়ে নীরব অশ্রু গড়াতে থাকল। অস্ফুটে বললেন,
-” নীলা..”
-” আচ্ছা আম্মু, আমি না তোমার নিজের মেয়ে, তুমি না আমার আম্মু। আমার এই অসহায় কান্না, এই বুকফাটা ব্যথা, একটুও কি তোমার হৃদয় ছুঁয়ে যায় না? বলো যায় না?”
বলতে বলতে রেলিং ঘেঁষে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে নীলাশা। অধরা মুখে আঁচল গুঁজে কান্নার শব্দ আটকালেন। নীলাশা ঠোঁট কামড়ে ধরে। কষ্টে রুদ্ধ গলায় বলে,
-” নিভ্রটা আমার কোলে প্রশান্তির সাথে ঘুমুচ্ছিল। আকুল হয়ে আমি প্রত্যাশাকে বলি, রাতটা না হয় নিভ্র থাক। ঘুমিয়েই তো আছে। জানো আম্মু প্রত্যাশার মনে আমার আকুলতা একটুও দাগ ফেলেনি, একটুও না। ওর কাছে তো নীড় ছিলো, আজকের রাতটুকু নিভ্র আমার কাছে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো! জানি আমি অবুঝের মতোন বলছি, তবুও আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমি কেনো নিজেকে সামলাতে পারছি না। আচ্ছা আম্মু নীরবের তো বদলির কথাবার্তা চলছে। প্রত্যাশা একাএকা কী করে দুটো বাচ্চা সামলাবে? এখানে সবাই নিভ্র আর নীড়কে রাখে। আম্মু প্রত্যাশা কী পারে না..”
নিভান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নীলাশাকে রুমে না দেখে ব্যালকনির দরজার সামনে দাঁড়াতেই নীলাশার কথা শুনে ধ’ম’কের সুরে বলে উঠল,
-” নীলাশা স্টপ দিস। পা”গল হলে নাকি?”
নীলাশা ফুঁপিয়ে ওঠে বলল,
-” তুমি প্রত্যাশাকে একটু বোঝাতে পারবে, আম্মু?”
ওপাশ থেকে অধরা ব্যাথিত কণ্ঠে বললেন,
-” না রে মা, এটা অসম্ভব। একটা মায়ের জন্য এটা করা অসম্ভব নীলা। আমি একজন মা, আমি মা হয়ে কেমন করে প্রত্যাশাকে এ কথা বলব? ওর থেকে ওর বুকের মানিক আলাদা করার কথা আমি বলতে পারব না নীলা।”
নীলাশা তিক্ত হেসে বলল,
-” জানি। জানি আম্মু। আমি তোমার গর্ভজাত সন্তান হলেও প্রত্যাশাকেই তুমি বেশি ভালোবাসো। আমি জানতাম তুমি পারবে না।”
এরমধ্যে নিভান এগিয়ে এসে একটানে ফোনটা কেড়ে নিল। কানে চেপে মৃদু গলায় বলল,
-” মা, আপনি কিছু মনে করবেন না। নীলাশা ঠিকঠাক নেই এখন, যা বলেছে সেটা আবেগ থেকে বলেছে। আমি ওকে বুঝিয়ে নেব। আপনি চিন্তা করবেন না।”
অধরার কণ্ঠে হতাশার দীর্ঘশ্বাস। তবু আর কিছু না বলে নিভানের সালামের জবাব দিয়ে ফোন রাখেন।
নীলাশা দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে অঝোরে কাঁদছে। নিভান ওর সামনে বসে আলতো করে একটা হাত মাথায় রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,
-” নীলাশা, এসব কথা তুমি মা’কে বলে ঠিক করোনি। তুমি কী পা’গ’ল হলে? আমরা বাচ্চা এডপ্ট নেবো। আমাকে একটু সময় দাও।”
নীলাশা মুখ তুলে তাকাল নিভানের চোখে। আচমকা নিভানের টিশার্টের কলার চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠল,
-” তুমি তো জানো নিভান, আমি শুরু থেকেই একটা বাচ্চার জন্য মরিয়া ছিলাম। শুরু থেকেই বলছিলাম, ডক্টরের কাছে চলো। তুমি আমার কথা গায়েই তোলোনি। ইশশ্! যদি প্রথম থেকে ট্রিটমেন্ট নেয়া যেতো। যদি কোনোভাবে একটা বাচ্চা হওয়ার পর অসুখটা হতো। তবুও আমার এতটুকু আফসোস থাকতো না। সব দোষ তোমার নিভান, সব দোষ তোমার।”
নীলাশার বুক ভাঙা আর্তনাদে রাতের গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা নিস্তব্ধ চারপাশ ভারী হয়ে উঠল। নিভান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নীলাশাকে। নীলাশার মাথাটা বুকে চেপে ধরল। তার চোখেও জমে উঠেছে অশ্রু। পুরুষের অক্ষম কান্না শব্দহীন হয়ে নীরবে ঝরল গাল বেয়ে।
____________
ঘুমন্ত নিভ্রকে আলগোছে শুয়ে দেয় প্রত্যাশা। নাজুক প্রাণটার নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ছোট্ট লাল ঠোঁটদুটো হালকা কাঁপছে। প্রত্যাশা শুয়ে হাতের উপর নিয়ে ফিড করাতে থাকে।
নীরব ফ্রেশ হয়ে এসে শুবে এমন সময় কপালে পরপর তিনটে ভাঁজ পড়ল। প্রত্যাশা মাঝে, দুইপাশে দু’জন। নীরব সেদিকে চেয়ে থমথমে মুখে বলল,
-” প্রত্যাশা তুমি কী ইন্ডাইরেক্টলি আমাকে সোফায় শুতে বলছো?”
প্রত্যাশা অবাক হয়ে বলল,
-” এ মা সেকি, তা কেনো বলব!”
-” তাহলে আমি কোথায় শুবো?”
-” এইপাশেই, নিভ্রের পাশেই তো জায়গা রেখেছি। চোখে কী কালো চশমা নিয়ে ঘুরছেন? যে দেখতে পাননি!”
-” দেখতে পাচ্ছি জন্যেই তো বলছি। এক হাত জায়গাও নেই, এইটুকুন জায়গায় শোবো কী করে? না যাবে এপাশ-ওপাশ ঘোরা। ঘুমের ঘোরে একটু ঘুরতে গেলেই মেঝেতেও পড়তে পারি।”
প্রত্যাশা ঠোঁট টিপে হাসল। বাচ্চাদের পাশে কোলবালিশ দিয়ে রেখে আরো বেশি জায়গা দখল করে রেখেছে। নীরব একহাত কোমরে রেখে গুরুত্বর ভঙিতে কিছু ভেবে নিয়ে বলল,
-” দাঁড়াও কালকেই একটা খাট অর্ডার দিয়ে আসব। চওড়ায় এর থেকে তিন ফিট বাড়াতে বলব।”
প্রত্যাশা হইহই করে উঠল,
-” আরে না না, অতবড় খাট রুমে মানাবে না। বিশ্রী, বেখাপ্পা লাগবে।”
উঠে বসে নিভ্রের ভেজা ঠোঁট দুটো টিস্যু দিয়ে মুছে দিল প্রত্যাশা। বলল,
-” এভাবে চারজন শোয়া হবে না, চওড়া দিক করে শুতে হবে।”
নীরব বলল,
-” থাক, আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি। আমার চ্যাম্পদের নেড়ে ঘুম ভেঙে দিও না। ওরা ঘুমাক।”
প্রত্যাশা না শুনে বাচ্চাদের আলগোছে ধরে ঘুরিয়ে নেয়। বলল,
-” আপনার ছেলেরা এই উঠল বলে। এদের চোখে ঘুম চড়ুই পাখির মতোন ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ আসে আর যায়।”
মিছেমিছে অভিনয় করে মৃদু গলায় বলল প্রত্যাশা,
-” নীরব, একজন থাকবে আমার পাশে, আর একজন আপনার পাশে। একজনকে আপনি সামলাবেন, আরেকজনকে আমি। রোজ রোজ অদলবদল হবে। বোঝা গেল?”
নীরব হকচকিয়ে গেল।
-” আ-আমি?”
-” হ্যাঁ, আপনি। ছেলে তো আপনারও, একজনকে দায়িত্ব নিয়ে সামলাতে পারবেন না?”
নীরব খানিকটা অপ্রস্তুত হলেও মুখে দৃঢ়তা নিয়ে বলল,
-” এ আর এমন কী!”
প্রত্যাশা কণ্ঠে ব্যঙ্গ নামিয়ে বলল,
-” তাই নাকি?”
-” জ্বী, ম্যাডাম।”
পরক্ষণেই করুণ চোখে তাকাল নীরব। বলল,
-” রাতে জাগলে রাখব, ফিডারও বানিয়ে দিবো। শুধু একটাই রিকোয়েস্ট ওদের দুজনকে পাশাপাশি রাখো।”
প্রত্যাশা বুঝেও না বোঝার ভান ধরে প্রশ্ন করল,
-” কেনো?”
-” দু’সপ্তাহ হয়ে গেল তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই না। আজ একটু ছাড় দাও, এই অধমের জন্য সহানুভূতিশীল হও।”
.
মাত্র চোখ লেগেছে নীরবের। এমন সময় বাচ্চার কান্নার শব্দ। কিন্তু চোখে ঘুমের রেশ এতটাই যে তাকাতে পারল না। প্রত্যাশা বলল,
-” নীরব, হাতের বাঁধন ঢিলে করুন। নীড় কাঁদছে, ওকে তুলে খাওয়াতে হবে।”
নীরব হাত সরিয়ে পাশ ঘুরে শুলো। খানিকক্ষণ পরেই প্রত্যাশা আবার বলল, ঘুমঘুম স্বরে,
-” শুনুন না?”
-” বলো?”
-” একটু উঠে দুধ বানিয়ে দিন না।”
নীরব উঠে ফিডার আর ফিলাক্স হাতে নিয়ে কত মি.লি পানি আর দুধের পরিমাণ শুনে নেয়। প্রত্যাশা নিভ্রের ডায়াপার চেক করে বলল,
-” একটা ডায়াপার দিন তো।”
নীরব হাই তুলে ডায়াপার বাড়ায়। প্রত্যাশা ভেজা ডায়াপার চেঞ্জ করতে করতে বলল,
-” ওর শরীরের ওজন যত না, তার চেয়েও বেশি ওজন মনে হচ্ছে এই ভেজা ডায়াপার। কাজ শুধু খাওয়া আর ট্যাপ ছাড়া।”
-” এসব কী ধরণের কথাবার্তা প্রত্যাশা?”
-” আপনাকে দিয়ে যখন চেঞ্জ করাবো তখন বুঝবেন সাধে কী আর এমন বলি।”
আবার এক দন্ড শুতে না শুতেই নীড় উঠল। প্রত্যাশা খাইয়ে নীরবকে ডেকে তুলে নীড়কে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-” নীড় জেগে আছে ওকে ধরুন। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।”
নীরবের চোখে রাজ্যের ঘুম। নীড়কে দুইপায়ের উপর বালিশ দিয়ে প্রত্যাশাই শুয়ে দিয়ে বলে– আস্তে আস্তে পা নাড়াবেন। এভাবে কিছুক্ষণ রাখলে ঘুমিয়ে পড়বে। বলেই প্রত্যাশা শুয়ে পড়ে। নীড়ের চোখদুটো ক্রমশ বড়বড় হতে থাকে। নীড়ের চোখে ঘুমের নামগন্ধ নেই। নীরব ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে ওর সঙ্গে কথা বলছে, গল্প করছে। ঘড়িতে তিনটা বাজে। রাত একটা পনেরো থেকে নীড়কে সে এভাবেই ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঘুমন্ত প্রত্যাশার দিকে একপল তাকাল নীরব। নিভ্রের গায়ের উপর একহাত দিয়ে সে আরামসে ঘুমিয়ে আছে। এদিকে নীড় চোখদুটো রস গোল্লার সাইজ বানিয়ে জেগে আছে। আঙুল মুখে দিয়ে থেকে থেকে কেঁদে উঠতে চাইছে। নীরব এবারে অসহায় গলায় বলল,
-” মাই চ্যাম্প, এবার ঘুমাও তো। তোমার বাড়ি পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব এখনো পড়েনি। পাপা আছেন না, নিশ্চিন্তে ঘুমাও তুমি।”
প্রত্যাশা চোখ বুজেই বলল,
-” খুব তো বড় গলায় বলেছিলেন, এ আর এমন কী! এখন কী মনে হচ্ছে?”
-” এখন মনে হচ্ছে আমার ডিউটির থেকেও বেশি কঠিন বাচ্চা নার্সিং।”
-” মানছেন?”
-” হুম, বলতে বাধ্য হচ্ছি অফিসের ডিউটির থেকেও কঠিন বাবার ডিউটি।”
প্রত্যাশা নীড়কে হাতের উপর নিল। নীড় মায়ের গায়ের সাথে লেপ্টে হাত-পা নেড়ে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়ে। নীরব ক্লান্তিতে চোখ বুজে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। একহাত দিয়ে কোমল আলিঙ্গনে প্রত্যাশার কোমর ঘিরে রাখল। প্রত্যাশার ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলে নীরব,
-” রাত চারটে বাজে, একটু ম্যাজিক করে হলেও সকাল সাতটা পর্যন্ত ওদেরকে ঘুমিয়ে রাখবে, প্লীজ।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলল। বলল,
-” কালকেও কী এই রুমে শুবেন? নাকি একদিনেই বাবা হওয়ার শখ মিটে গিয়েছে? কালকেই বুঝি গেস্ট রুমে শিফট করছেন?”
-” উঁহু। কালও শোবো, রোজ শোবো। শুরুতে একটু কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব অভ্যেস হয়ে যায়। আর এই কষ্টের মাঝেও একটা অদ্ভুত শান্তি আছে। তোমাদের সবাইকে একসাথে পাশে পাওয়ার শান্তি। হয়তো সময়ের সাথে সাথে ঘুমহীন রাতগুলো অভ্যেস হয়ে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তগুলো, এই অভিজ্ঞতাগুলো একদিন স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে। একদিন এই রাতগুলোকেই সবচেয়ে বেশি মিস করব।”
____________
দিনটা শুক্রবার। শুক্রবার দিনটায় কেমন একটা স্নিগ্ধ পবিত্রতা বিরাজ করে। বাচ্চাদের বয়স প্রায় তিন সপ্তাহ হতে যাবে এখনো মাথার চুল মুন্ডন করা হয়নি। নীহারিকা বলেন— এই চুল বেশিদিন থাকলে, মাথায় ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দু’জনেরই চুলগুলো ঘন আর বেশ বড়বড়। তাই তাড়াতাড়ি ন্যাড়া করতে বলেন।
এতটুকু বাচ্চা ধরতেই ভ’য় লাগে। কে এই কাজ করবে? নীহারিকা শর্মিলাকে বলতেই তিনি দুই হাত তুলে বললেন,
-” ভাবী, মাফ চাই। আমার ভয় লাগে। এত সফট ত্বক ভয়ের চোটেই হাতের কাঁপুনি বাড়বে।”
বলেই নীলাশার দিকে তাকালেন।
-” নীলাশা তুমি দাও।”
নীলাশা হকচকিয়ে বলল,
-” আমি?”
প্রত্যাশা সোফায় বসে ওর কোলে নিভ্র। নীড় শর্মিলার কোলে। প্রত্যাশা বলে উঠল,
-” আপু তুমিই দাও। তুমি না একবার পাশের বাসার রুমা আন্টির মেয়ের মাথা বেল করে দিয়েছিলে।”
বেল শব্দ শুনেই উপস্থিত সবাই হেসে ফেললেন। সবার বলায় অগত্যা নীলাশা বলল,
-” নিভ্র তোর কোলেই আছে, তাহলে ওকে দিয়েই শুরু করবি?”
-” হ্যাঁ, তাই করো।”
নিভ্র ঘুমিয়ে ছিলো একটু নড়াচড়া করলেও বেশি বেগ পোহাতে হয় না। অন্যদিকে নীড়ের মাথায় রেজার ছোঁয়াতেই মাথা এপাশ-ওপাশে টান মা’র’তে থাকে। তারপর আবার হাত বাড়িয়ে মাথায় দিতে নেয়, বেঁকে ওঠে কাঁদতে নেয়। প্রত্যাশা এসব দেখে বলল,
-” নীড়টা খুব পঁচা। নীড়টা যা জ্বালাতন করে না। উফ্! নিভ্র কী সুন্দর চুপচাপ ছিলো! এ তো হয়রানি করে ছাড়ছে।”
নীলাশা সাবধানে কাজটা করতে করতে মৃদু হেসে বলল,
-” বাচ্চারা এটুকু করে থাকে।”
নীহারিকা নিভ্রের গায়ে বেবী সোপ ঢেলে গোসল করিয়ে শরীর মুছে অলিভ অয়েল মালিশ করে দিচ্ছেন। নীড়ের নড়াচড়া দেখে প্রত্যাশা ধ’ম’কিয়ে উঠল,
-” নীড়..”
নীলাশা বলল,
-” তুই এমনভাবে ধমকাচ্ছিস যেন ও বুঝতে পারছে।”
-” আরে দেখছো না, কেমন বেঁকে বেঁকে উঠছে।”
নীলাশা হঠাৎ বলল,
-” প্রত্যাশা, শুনছি নীরবের নাকি রাজশাহীতে বদলি হবে। তোরাও কী যাবি?”
-” বদলির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। তবে নীরব জানিয়েছে কিছু কজ দেখিয়ে প্রয়োজনীয় ভিত্তিতে লিখিত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে আপাতত বদলি আদেশ স্থগিত রাখার চেষ্টা করবে। বর্তমানে পারিবারিক পরিস্থিতি বিশেষ করে বেবীদের দিক বিবেচনায় এখনই বদলি হলে সমস্যা হতে পারে। তাই ও চাইছে না এক্ষুনি বদলি হোক। পরবর্তী সময়ে বদলিতে ওর আপত্তি থাকবে না।”
-” ওহ্। আচ্ছা, তুই একা একা ওদের সামলাতে পারবি! না মানে এখানে সবাই রাখে, তাই বলছি আরকি।”
-” নীরব বলেছে দু’জন হেল্পিং হ্যান্ড রাখবে। রাতে তো আমি আর নীরবই ওদের রাখি। আমার তো আর অন্যকোনো কাজ নেই। শুধু এদেরকেই দেখে রাখব।”
নীলাশার মুখটা মলিন হয়ে আসে। জোড়ালো নিঃশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
-” প্রত্যাশা তোর একটা কথা মনে আছে?”
-” কীহ?”
-” তুই তো বলেছিলি কখনো যদি তোর কাছে কেউ কিছু চায়, তাকে শুণ্য হাতে ফিরিয়ে দিবি না। তোর সাধ্যের মধ্যে থাকলে দিবি। ধর আমি কিছু চাইলাম, তুই কী তোর সেই কথাটা রাখতে পারবি?”
প্রত্যাশার কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের উদয় হলো। মূহুর্তেই ভাবল— আপু কী চাইবে? কীই বা চাইতে পারে? শাড়ি-গহনা আমার চেয়ে আপুর কগুণ বেশি। জিজুর স্যালারি নীরবের চেয়ে ডাবল। তাহলে আমার কাছে আপুর চাইবার কীইবা আছে? যেটা আপুর কাছে নাই!
মূহুর্তেই বাচ্চার কথাটা মস্তিষ্কে বলের মতন ঢপ খেলো। প্রত্যাশার বুকটা ছলাৎ করে উঠল। শাশুড়ির কাছে থাকা নিভ্রের দিকে একপল চাইল, তারপর কোলের ভেতর থাকা নীড়কে একহাতে চেপে ধরল। প্রত্যাশার মুখটা রক্তশুণ্য হয়ে আসল। নীলাশা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-” ভ’য় পাস না, আমি অমন কিছুই চাইবো না। আসলে জানিস প্রত্যাশা, সব জিনিসই দেয়া যায় না।”
.
.
বাচ্চাদের শুয়ে তিন রড বিশিষ্ট বেবি মশারি দুজনের উপরে দু’টো দিয়ে দেয় প্রত্যাশা। এরমধ্যে নীরব এসে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল,
-” প্রত্যাশা টাওয়েল কই?”
-” ব্যালকনিতে।”
-” ব্যালকনিতে দেখে আসলাম। নেই জন্য তো জিজ্ঞেস করছি।”
হঠাৎ মনে পড়ার মতো করে বলল প্রত্যাশা,
-” ওহ্ হো, টাওয়েল দুটোই কেচে দেয়া হয়েছিল। পরী বোধহয় ছাদে শুকাতে দিয়েছে। আচ্ছা আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।”
-” তুমি থাকো, আমি আনছি।”
বলেই নীরব বেড়িয়ে যায়। এরমধ্যে নীলাশা আসল। হাতে একটা প্যাকেট। প্যাকেটটা প্রত্যাশার হাতে দিয়ে বলল,
-” নিভ্র আর নীড়ের জন্য আমাদের তরফ থেকে ছোট্ট গিফট। বানাতে দিয়েছিলাম তাই একটু সময় লাগলো।”
প্রত্যাশা খুলে দেখল। দু’টো লাল রঙের বক্স, ভেতরে দু’টো চেইন জ্বলজ্বল করছে। ইতস্তত করে বলল,
-” আপু, স্বর্ণের তো এখন অনেক বেশি দাম। এত মোটামোটা দু’টো চেইন না দিলেও পারতে। ওরা ছেলে মানুষ, স্বর্ণ তো পড়া হবে না। তাই বলছি।”
নীলাশা ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” এটুকু কিছুই না। ওরা আমাদের পরিবারের চোখেরমণি। ওদের জন্য তো সবটাই দিতে রাজি।”
এরমধ্যে শুয়ে দিতে না দিতেই নিভ্র কেঁদে ওঠে। প্রত্যাশা রাগ করে মশারি সরিয়ে কোলে তুলতে তুলতে বলল,
-” পাঁচ মিনিটও হলো না ওঠে পড়ল। এদের জ্বালায় জীবনটা ত্যানা ত্যানা হয়ে যাচ্ছে।”
থেমে নীলাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আপু একটু ধরবে ওকে? আমি গোসল করব।”
নীলাশা বলল,
-” তোকে এভাবে বলতে হবে ধরবে! আমি ফ্রিই আছি দে।”
প্রত্যাশা কোলে দিতে দিতে বলল,
-” নীরবকে বলে দেবো ওর বদলি হলেও আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোমরা সবাই আছো বলেই এখন অতটা মনে হচ্ছে না। বাসায় যতই হেল্পিং হ্যান্ড রাখুক, তাদের কাছে বাচ্চা দিয়ে নিশ্চিতে থাকা যায় নাকি। নিউজে কত কী দেখা যায়। না না বাবা, আমি এখানেই থাকব। নীরব প্রতি সপ্তাহে আসবে। তারপর প্রমোশন হয়ে এসপি হতে পারলে যেন এখানে চলে আসে।”
নীলাশা নিভ্রর গালে চুমু খেয়ে বলল,
-” তোরা বাসায় গেলে আমি কিন্তু আমাদের রাজপুত্রদেরকে খুব মিস করব রে প্রত্যাশা।”
প্রত্যাশা জামা-কাপড় হাতে ওয়াশ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
-” আমি যাচ্ছি না।”
নিভ্র আঙুল চুষতে থাকে। নীলাশা বলল,
-” প্রত্যাশা, নিভ্রের বোধহয় ক্ষিধে লেগেছে।”
ওয়াশ রুমের ভেতর থেকেই গলার স্বর বাড়িয়ে বলল প্রত্যাশা,
-” একটু ফিডার বানিয়ে খাইয়ে দাও।”
নিভ্রকে বিছানায় শুয়ে তারপর ফিডার বানায় নীলাশা। তারপর বাবু মেরে বসে নিভ্রকে কোলের ভেতর নেয়। সযত্নে ফিডার খাইয়ে দিতে থাকে। বাচ্চা দুটোর প্রতি একটা অদৃশ্য টান মায়া দিনকে দিন বাড়ছেই। ওদেরকে আগলে রাখতে গিয়ে অজান্তেই নিজের মধ্যে একটা মাতৃটানের সৃষ্টি হয়। একদম নিজের মনে হয়।
_____________
প্রত্যাশাকে কিছু বলতে গিয়েও বারবার আঁটকে যাচ্ছেন অধরা। বিবেকে বাঁধছে। অবশেষে দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচল থেকে বেরিয়ে আলতো গলায় ডাকলেন অধরা,
-” প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশা বাচ্চাদের কাঁথা ভাঁজ করছিলো। বলল ,
-” হ্যাঁ আম্মু, বলো।”
অধরা করুণ স্বরে বললেন,
-” তোর কাছে একটা অন্যায় আবদার করলে তুই কী আম্মুর উপর রেগে যাবি, খুব বেশীই ক্ষোভ জমবে কী?”
দুপুর থেকেই প্রত্যাশার বুকটা ভারী ভারী ঠেকছিল। আকস্মিক মায়ের অমন কথায় বুকটা ধ্বক করে উঠল। তবুও কম্পমান স্বরে বলল,
-” ব-বলো?”
অধরা সহসাই বলে উঠলেন,
-” বোনের জন্য পারবি স্যাক্রিফাইস করতে? নীলাশাটা না একদম ভালো নেই, ভালো নেই ও। ও বাইরে প্রকাশ করে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে গুমরে ম”র’ছে। মেয়ের জন্য এক মায়ের এই চাওয়াটা কী খুব বেশিই অন্যায়?”
প্রত্যাশার পুরো পৃথিবী দুলে উঠল। হাতে থাকা কাঁথাটা হাতের ভেতর থেকে পড়ে গেল। আর্তনাদ করে উঠল,
-” আম্মু, কী বলছো এসব?”
অধরার চোখে অশ্রু টলমল করছে। ধরা গলায় বললেন,
-” ও তোর সন্তানকে আগলে রাখবে। বিশ্বাস কর, তুই দেখিস তোর ছেলেকে ভালো রাখবে।”
প্রত্যাশার চোখ জ্বালাপোড়া করছে। ও জোরেজোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল,
-” আম্মু, আমি বেঁচে থাকতে আমার সন্তানকে ভালো রাখার দায়িত্ব অন্য কাউকে কেনো দিবো? আমি কী ম*রে গেছি?”
অধরা দাঁত চেপে কান্না সংবরণ করলেন,
-” প্রত্যাশা তুই তো ছোট থেকেই খুব মহান। সবার প্রতি তোর টান। নিজের টিফিন বান্ধবীদের সাথে ভাগ করে খেতি। মাঝেমাঝেই এটা-ওটা অসহায় কাউকে দিয়ে আসতিস। আমার নীলাটার সব থেকেও আজ একটা বাচ্চার জন্য অসহায়।”
প্রত্যাশা অদৃশ্য হাতে দুইহাত কানে চেপে ধরল। শক্ত কণ্ঠে বলল,
-” আম্মু সবকিছু ভাগ করা যায় না। অবলীলায় সব দেয়া গেলেও কিছু কিছু জিনিস কখনোই দেয়া সম্ভব নয়। আম্মু এভাবে বলো না, প্লীজ।”
বাচ্চাদের দিকে আঙুল তাক করে ভেজা গলায় বলল প্রত্যাশা,
-” আম্মু, ওরা দু’জনেই আমার প্রাণ। ওদেরকে এই পৃথিবীতে আনতে আমি কতটা কষ্ট সহ্য করেছি, সেটা কেবল আমিই জানি। ছোট প্রাণ দু’টো তিলে তিলে আমার মধ্যে বেড়ে উঠেছে। আমি ভারী পেট নিয়ে ঠিকঠাক চলতে পারিনি। রাতের পর রাত আমার নির্ঘুম কেটেছে। ওদেরকে পেটে নিয়ে আমার বসতে সমস্যা হয়েছে, শুতে সমস্যা হয়েছে। মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলতেও আমার সমস্যা হয়েছে। নটা মাস কষ্ট করে, মৃত্যু যন্ত্রণা সম প্রসব বেদনা সহ্য করেছি। তারপর যখন ওদের মুখটা দেখলাম না, এক নিমিষে আমার সব কষ্ট উবে গেল। আমার মধ্যে এক আকাশ ভালোবাসা জাগ্রত হলো। ওদের নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার বাসনা জাগলো। আম্মু, ও আম্মু আমি আমার সেই সন্তানকে কী করে অন্যকে দেই?”
অধরা বাকরুদ্ধ। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। নিজের মনটাকে পাথর বানিয়ে তবুও বললেন,
-” প্রত্যাশা আমি জানি তোর বুক ফেটে যাচ্ছে। তুই যা বলছিস তাতেই তোর মায়ের বুকও ছিঁড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমিও যে মা। আমার নীলাটা তোরই মতো একদিন পেটের সন্তান চেয়েছিল। পায়নি। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। প্রত্যাশা তুই হয়তো আমাকে অভিশাপ দিবি, ঘৃ*ণা করবি। দে তোর মায়ের মুখে সেই ঘৃ*ণা। কিন্তু মা হয়ে আমারও বুকটা আজ ভিক্ষুকের মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। তোর পায়ে পড়ে চাই না, তবু আমার বুকের ভেতর যে আরেকটা মায়ের কান্না জমে আছে। প্রত্যাশা তুই চাইলেই আবার মা হতে পারবি। নীলাটা যে তা কখনোই পারবে না। একবার ভেবে দ্যাখ না।”
মায়ের ব্যাকুলতা প্রত্যাশার মাতৃ মনে তেমন প্রভাব ফেলল না। ও ফুঁপিয়ে ওঠে বলল,
-” আম্মু তুমি কী প্রতিদান চাইছো? এতিম, কুড়িয়ে পাওয়া আমিকে মানুষ করার ঋণ শোধ করতে বলছো?”
বলতে বলতে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল প্রত্যাশা। ঘুমের মধ্যে কারো ধাক্কায় দপ করে চোখ মেলে চায় প্রত্যাশা। মাথার উপর সিলিংটা ঘুরছে, উপরে ছাদ। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিল, আর ফুঁপাচ্ছিল প্রত্যাশা। নীরবের ঘুম ভেঙে যায়। ও একহাতে আলতো করে প্রত্যাশাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডেকে ওঠে,
-” প্রত্যাশা? প্রত্যাশা…কী হয়েছে?”
প্রত্যাশা এবারে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। কপালে ঘাম জমেছে। বাহু টেনে ঘামটুকু মুছে নেয়। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল ওর। জিভ দিয়ে ঢোক গিলে বলল,
-” দু-দুঃস্বপ্ন দেখেছি একটা।”
নীরব ওঠে বেডটেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে মুখ খুলে বাড়িয়ে বলল,
-” পানি খাও।”
-” হুঁ।”
বলেই বোতল হাতে নিয়ে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো প্রত্যাশা। পরপর ঘুমন্ত বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল। নীরব বোতলটা হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
-” বুঝতে পেরেছি খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছো। বাদ দেও স্বপ্ন স্বপ্নই।”
-” হুউউ।”
নীরব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফের শুধাল,
-” ঠিক আছো তুমি?”
প্রত্যাশা ঠোঁটে হাসি টেনে বলল,
-” হ্যাঁ, ঠিক আছি।”
নীরব প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসল। অতঃপর হাতের বোতলটা মুখের সামনে ধরতেই প্রত্যাশা সেদিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি বলে উঠল,
-” আমি মুখ লাগিয়ে খেয়েছি। এটা এঁটো তো।”
নীরব মাছি তাড়ানোর ভঙিতে প্রত্যাশার মতো সেও মুখ লাগাল। তৃপ্তি সহকারে ক ঢোক পানি গিলে মৃদু হেসে বলল নীরব,
-” এ আর এমন কী! যেখানে সকাল বিকাল তোমার ঠোঁটের স্বাদ নিই।”
প্রত্যাশা বাঁকা চোখে তাকাল। ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে মুখটা এগিয়ে আনল নীরব। ফিসফিসিয়ে বলল,
-” অনেকদিন থুতু যুক্ত চুমুটা খাওয়া হয় না। কাম ফাস্ট।”
প্রত্যাশা চোখ বড়বড় করে চাইল। ঝটিকায় দু’টো আঙুল নীরবের ঠোঁটের উপর দিয়ে থামিয়ে দিল। হালকা কেশে বলল প্রত্যাশা,
-” উহুম, উহুম… ছেলেরা বড় হচ্ছে, এবারে তো একটু রোমান্টিকতা কমান।”
-” আমার রোমান্টিকতা তো তোমার উপর ঠিকঠাক এপ্লাই করতেই পারিনি। তার আগেই বাবা হয়ে গেলাম। সেই থেকেই ধৈর্য্যর পাহাড় গেড়ে চলছি।”
বলেই এক ঝটকায় প্রত্যাশাকে টেনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল নীরব। প্রত্যাশা উপরে উপরে বিরক্ত দেখিয়ে বলল,
-” উফ্! নীরব আপনি খুব জ্বালাচ্ছেন। আপনার ছেলেদের জ্বালাতনে আমি অস্থির। এদিকে রাত এলে আপনার জ্বালাতন সাথে হয় বাড়তি।”
________
দেখতে দেখতে অনেকগুলো মাস কে*টে গেছে। নিভ্র-নীড় এখন সাত মাসে পা দিয়েছে। ওরা দুজনেই ধীরে ধীরে বসতে শিখছে, তবে এখনো হামাগুড়ি দিতে শেখেনি। এদিকে নিভান ইচ্ছের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হলো, ইচ্ছে নীরব বলতেই পা”গ”ল।
ইচ্ছের স্কুলের অভিভাবক সম্বন্ধীয় বৈঠকে নীরব যায়।স্কুলে বন্ধুদের দেখিয়ে আনন্দে ঝুমঝুম করে বলে ওঠে — ‘ওই যে আমার পাপা আসছে। আমার পাপা আমাকে অনেক আদর করে।’
অন্যদিকে অসুস্থ ভাইকে ছুঁয়ে করা নীরবের অঙ্গীকার। ভাইয়ের অস্তিত্বকে আগলে রাখবে আজীবন। ইচ্ছে নীরবের কাছে কেবল শুধুমাত্র দায়িত্ব নয়। বরং প্রয়াত ভাইয়ের রেখে যাওয়া আমানত। সবদিক বিবেচনায় শেষমেশ নীরবই ইচ্ছের অভিভাবক হয়েছে। অবশ্য সবারই আদর আর স্নেহে ইচ্ছে বেড়ে উঠছে।
.
.
সময়টা তিনটে নাগাদ। আচমকা মুখের উপর গরম গরম পানি পড়ায় ঘুমের মধ্যে ধড়ফড়িয়ে ওঠে প্রত্যাশা। চোখ মেলে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে চারিপাশে উষ্ণ পানির উৎস খুঁজতে থাকে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসেছে কী না দেখতে তাকাল। জানালা দিয়ে আকাশ ঝকঝকা দেখা যাচ্ছে। বেকুবের মতোন মুখটা উঁচিয়ে এবার ছাদের দিকে চায়। পরপর নজর যায় বিছানার এক কোণে থাকা নীড়ের দিকে। নীড় দুই পা হাত নেড়েনেড়ে খেলছে। পায়ের আঙুল টেনে মুখে পুরেছে সে। প্রত্যাশা এক ঝটকায় উষ্ণ পানির উৎস টের পেল। মুখের উপর পড়া পানি ওড়না টেনে মুছে নেয়। তারপর বাঁকা চোখে তাকিয়ে নীড়ের গাল টিপে বলে প্রত্যাশা,
-” ওহে, এএসপি সাহেবের ছোট ছেলে, এটা কী হলো? যেখানে শুয়ে রেখেছিলাম সেখানে তো নেইই। আবার ট্যাপ ছেড়েছো তো ছেড়েছো একদম মাম্মামের মুখের উপর এসে পড়েছে। আরেকটু হলেই তো মুখের ভেতর চলে যেতো। ওয়াক…ওয়াক।”
মুখ বিকৃত করে ওয়াক ওয়াক করে প্রত্যাশা। নীড় সেটা দেখে ঠোঁট নেড়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওর ভাষায় শব্দ করতে থাকে,
-” গগগগউউঊগ।”
প্রত্যাশা একহাতে ছেলের পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল,
-” এইযে চাইনিজ ভাষি, কী বললে কিছুই বুঝলাম না। গগগগগ আবার কী?”
সুড়সুড়িতে নীড় খলখল করে হাসতে থাকল। হাত-পা সাইকেল চালানোর মতো নাড়াল। ছেলেকে টেনে বিছানার মাঝে আনে প্রত্যাশা। কোথায় শুইয়ে ছিলো, গেছে কোন কোণে। প্রত্যাশা ওয়াশরুম থেকে মুখ ধুয়ে বের হতেই নীরব রুমে প্রবেশ করে। ইচ্ছে নীরবের পিছুনে, কাঁধে স্কুল ব্যাগ। আজ স্কুলে অভিভাবক সম্বন্ধীয় মিটিং ছিলো দুপুরের পরে। নীরব অফিস থেকে সোজা সেখানে গিয়েছিল।
প্রত্যাশা ছেলেকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-” নীরব জানেন আপনার ছোটো ছেলে কী করেছে?..”
প্রত্যাশা নালিশের সুরে বলে। নীরবের ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটল। ঘর্মাক্ত শরীরেই ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল,
-” ব্যাপার না।”
ইচ্ছে ঝুমঝুম করে ওঠে,
-” ভাইয়া!”
নীরবের কোল থেকেই নীড় ওর ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল,
-” ককউউ.”
প্রত্যাশা এগিয়ে ইচ্ছের পিঠ থেকে ব্যাগ খুলতে থাকে। নীরব জিজ্ঞেস করল,
-” নিভ্র কোথায়?”
-” ঘুম থেকে জেগে নিভ্র বাইরে যাওয়ার জন্য জ্বালাচ্ছিলো। শুধু বাইরের দিকে ঠেলছিলো। আপু দেখে বাইরে নিয়ে গিয়েছে।”
-” তুমি নিশ্চয় বকেছিলে?”
প্রত্যাশা মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
-” আরে না। আপনার মনেহয় আমি শুধু আপনার ছেলেদের বকাঝকা করি।”
নীড়ের গালের সাথে গাল ঠেকাল নীরব। বলল,
-” ওরা জ্বালাতন করলেই তুমি ঝারি মারো, আমি জানি।”
-” সারাদিন বাসায় থাকেন না। তাই ওদের জ্বালাতন টের পেলেন না। যে রাখে সেই জানে।”
নীরবের গালের সাথে থুতু মাখিয়ে কামড়ানোর চেষ্টা করতে করতে নীড় চেঁচিয়ে ওঠে,
-” বা বা বা আব আব বা।”
নীরব ছেলের মুখে চুমু খেতে খেতে বলল,
-” হ্যাঁ বাবা, বাবা আমার।”
ইচ্ছের ড্রেস খুলে দিতে দিতে বলল প্রত্যাশা।
-” ওকে আমার কাছে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
নীহারিকা আর মাহবুব সাহেব দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়ের ছেলের বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছেন। শর্মিলা বাবার বাড়ি। প্রত্যাশা ইচ্ছের জন্য দুধ কলা ভাত মাখিয়ে দিল। ইচ্ছে চামচ দিয়ে এটা একাই খায়। নীরব ডাইনিংয়ে নীড়কে কোলে নিয়ে বসে। প্রত্যাশা ভাত বেড়ে দিল। নীরব বলল,
-” তুমি খেয়েছো?”
-” নাহ। ওদের সাথে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খাওয়া হয়নি।”
-” বসো একসাথে খেয়ে নাও।”
প্রত্যাশা নীড়ের দিকে তাকাতেই নীরব বলল,
-” নীড়কে কোলে নিয়েই আমি খাচ্ছি।”
প্রত্যাশা চেয়ার টেনে বসল। নীড়কে কোলে নিয়ে খেতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধল। নীড় হাত বাড়িয়ে প্লেটে থাবা দিতে যায়। প্রত্যাশা বলল,
-” নীড় কিন্তু আপনার ভাত মাখিয়ে দিবে, সাবধান।”
নীরব হেসে বলল,
-” এদের থাবা চিতার চেয়েও ফাস্ট দেখছি।”
এভাবে খাওয়া যাচ্ছিল না জন্য। প্রত্যাশা উঠে বলল,
-” দিন ওকে আপুর রুমে রেখে আসি।”
.
বাগান থেকে ঘুরে এসে নীলাশা নিভ্রকে নিয়ে রুমেই আছে। প্রত্যাশা রুমে ঢুকে দেখে নিভ্র নীলাশার পেটের উপর বসে। নীলাশা ছোট্ট হাত দু’টো ধরে এটাসেটা বলছে। আর ছোট্ট নিভ্র চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠছে, সাথে মুখে খৈ ফোঁটা হাসি। এগিয়ে নীড়কে বেডে বসিয়ে দিতে দিতে বলল প্রত্যাশা,
-” আপু নীড়কে দেখো।”
নীলাশা হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,
-” আচ্ছা।”
এরমধ্যে নীলাশার কপালে ভাঁজ পড়ল। গরম পানি পেট গড়িয়ে বিছানায় পড়ল। নীলাশা হাসতে হাসতে বলল,
-” এই রে কী করলে বাবা আমার।”
প্রত্যাশা হেসে ফেলে বলল,
-” এদের দুটোর কাজই তো এটা। আপু তুমি এরপর থেকে ডায়াপার পড়িয়ে কোলে নিবে।”
নীলাশা উঠে বসল। দুইভাইকে পাশাপাশি বসিয়ে বলল,
-” আরে না করে। বাচ্চারা ঘনঘন হিসু করবে এটাই স্বাভাবিক। বেশি ডায়াপার পড়ালে র্যাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”
দুইভাই বিছানায় একে অপরের দিকে তাকিয়ে খাবলে ধরতে নেয়। নীলাশা সামলে দু’জনের হাতে খেলনা দিলো।
.
খাবার মুখে পুড়ে চিবাতে চিবাতে জিজ্ঞেস করল নীরব,
-” মা-বাবা কখন আসবে?”
-” সন্ধ্যায় আসবে।”
হঠাৎ কিছু মনে পড়ার মতো করে বলে উঠল প্রত্যাশা,
-” ওহ্ হো, আপনাকে একটা কথা বলতেই ভুলে গিয়েছি। আপু বলেছে, জিজু আপনাকে সন্ধ্যায় বাসায় থাকতে বলেছেন। কী যেনো জরুরী কথা আছে।”
-” কী ব্যাপারে, জানো?
-” জানি না। জিজুকে দেখলাম কতগুলো কাগজপত্র নিয়ে সকালে হন্তদন্ত হয়ে বেরোতে। বুঝতে পারছি না।”
#চলবে